আমাদের বাড়িতে কারা যেন এসেছে! আমরা যখন ঘুমোই তখন তারা হেঁটে চলে বেড়ায়! মা বাবা অঘোরে ঘুমোয় কিছু শুনতে পারে না, আমি কিন্তু সব শুনি।
পরদিন ওদের বললাম, “এই বাড়িতে আরো কেউ রয়েছে। আমি ঘুমের মধ্যে আওয়াজ শুনতে পেয়েছি!”
মা বাবা পরস্পরের মুখ চাওয়া চাওয়ি করলেন, তারপর বললেন, “তোমাকে ও-সব নিয়ে ভাবতে হবে না!”
এর আগেও একবার তেনাদের উপদ্রব হয়েছিল। তখন মার্কাসকাকু কীভাবে জানি ওদের ভাগিয়েছিলেন। সেটা বেশ কিছুদিন আগেকার কথা তাই ঠিক মনে নেই। আসলে বাড়িটা অনেক পুরোনো আর বেশ বড়সড় তাই মাঝে মাঝেই তেনাদের উপদ্রব হয় এখানে!
খেয়ে দেয়ে শুয়ে পড়েছিলাম। হঠাৎ কিসের একটা শব্দে ঘুমটা ভেঙে গেল! গলাটা শুকিয়ে গেছে। এখন আমি বড় হয়েছি তাই জল তেষ্টা পেলে আর মাকে বিরক্ত করি না। নিজেই উঠে নিয়ে নি। ঘর থেকে বেরিয়ে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়িয়েছি এমন সময় তাকে দেখতে পেলাম! আমারই বয়সি একটা ছেলে! পরনে হাফপ্যান্ট আর গেঞ্জি! আমার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রয়েছে!
“কে তুমি?” আমাকে জিগ্যেস করল সে।
“আমি টোটো! এই বাড়িতেই থাকি!”
“ধ্যাৎ! এই বাড়িতে তো আমরা থাকি!”
“তোমার নাম কি?” আমি ছেলেটাকে জিজ্ঞেস করলাম।
“রোহিতাশ্ব তবে সবাই আমাকে গাবলু বলে ডাকে।”
ওর নাম শুনে আমি, “গাবলু হু হু হু!” করে হাসতে লাগলাম!
ছেলেটাও তখন আমার দিকে তাকিয়ে আমাকে আপাদমস্তক দেখে, “টোটো হো হো হো!” বলে হেসে উঠল!
সেই থেকেই আমাদের দুজনের খুব বন্ধুত্ব হয়ে গেল! গাবলুর কথা আমি মা বাবাকে বললাম না! ও তো শুধু সবাই ঘুমিয়ে পড়লে আসে তাই মা বাবা জানতে পারেন না ওর আসার কথা! কী দরকার? জানতে পারলে যদি আবার মার্কাসকাকুকে ধরে নিয়ে আসে ওদের তাড়াতে তাহলে তো আর গাবলুর সাথে আমার কোনদিন দেখাই হবে না! গাবলু অবশ্য বলেছে সেও আমার কথা কাউকে বলেনি!
“আমরা এখানে নতুন এসেছি তো তাই আমার এখানে কোন বন্ধু নেই!” গাবলু দুঃখ করে বলে।
“কেন আমি তো আছি!”
“হ্যাঁ, তা ঠিক! তবে কি জানো তো আমরা আগে যেখানে থাকতাম সেখানেও যে আমার খুব একটা বন্ধু ছিল তা নয়! আমি নিজের মনে বকবক করতাম বলে সবাই আমার উপর হাসত!”
“ও তাই নাকি!” আমি আর ওকে বললাম না যে আমারও তেমন বন্ধু নেই। ও মনে হয় বুঝছিল।
“হ্যাঁ! তারপর আমার খুব শরীর খারাপ হল! কত ডাক্তার কত ওষুধ! সে রোগ আর সারে না!”
“তারপর?”
“তারপর আর কি এখানে চলে এলাম! এখন ভাল আছি!”
“ও!”
“আর ওসব নিয়ে কথা বলতে ভাল লাগে না, চল খেলি! এই দেখো আমার খেলনা এনেছি!”
আমিও নিজের খেলনা নিয়ে এসেছি তাই দুজনে মিলে বেশ মজা করে খেলা করলাম। গাবলু ভারি মজার ছেলে আমাকে খালি হাসায়!
সব কিছু ঠিকঠাক চলছিল এমন সময় একদিন মা দেখে ফেললেন! আমি আর গাবলু সেদিন টেবিলের তলায় ঢুকে গুহা গুহা খেলছিলাম এমন সময় কিছু একটা ঠক করে পড়ে গেল। আমার মার মনে হয় সেই শব্দেই ঘুমটা ভেঙে গেল। কোণের ঘরে এসে মা আমাকে আর গাবলুকে দেখতে পেলেন। গাবলুকে দেখেই মার মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে গেল। গাবলুও বুঝল মা ওকে দেখেছেন তাই সে স্যাঁৎ করে পালাল।
আমি মুখ গোমড়া করে মাকে বললাম, “দিলে তো খেলাটা নষ্ট করে! গুহার গুপ্তধন আমরা প্রায় খুঁজে ফেলেছিলাম! আর একটু পরে আসতে পারছিলে না তুমি!”
মা আর কিছু বললেন না, শুধু বললেন, “চল শোবে চল!”
পরে শুনলাম মা বাবাকে বলছেন, “টোটো আবার যাদের নাম করতে নেই তাদের সাথে গিয়ে মিশছে! কি হয়েছে বল তো ছেলেটার? কেন এই রকম করে? এই বাড়িটা ছেড়ে দিতে হবে মনে হয়, তেনাদের বড্ড উপদ্রব বাড়ছে! ভয়ে আমার বুক কাঁপছে!”
বাবা বললেন, “ভয়ের কিছু নেই, আবার মার্কাসকে ডাকতে হবে আর কি! সেই আসবে ঝাড়ু ঝ্যাঁটা ভয় দেখানো ঝাঁপি নিয়ে ওদের তাড়াতে! বাড়ি ছাড়ার দরকার হবে না। বাসা বদল করা বড্ড ঝামেলা ওসবের মধ্যে আর যেতে চাই না।”
আমি চিৎকার করে উঠলাম, “না, না, আমার বন্ধুকে তাড়িও না!”
বাবা মা অদ্ভুত দৃষ্টি দিয়ে আমার দিকে তাকালেন। ভাবখানা এমন যেন এই ছেলেটাকে আর বাঁচানো যাবে না!
বাবা তো বলেই ফেললেন, “তোমাকে বলছিলাম ওকে শিশিরের স্কুলে ভর্তি করে দিতে তুমি শুনলে না! এখন বোঝো!”
মা বললেন, “আমি ভাবছিলাম আর কয়েকদিন না হয় যাক... এখন দেখছি ভর্তি করে দিলেই ভাল হত! কিন্তু এখন তো আর হবে না, সেশানের মধ্যে, পরের বছর চেষ্টা করে দেখতে হবে।”
বাবা মার্কাসকাকুকে খুঁজতে চলে গেলেন। আমার মনে হয় ভাগ্যটা ভাল চলছিল কারণ একটু পরেই ফিরে এসে বললেন, “নাহ মার্কাসকে এখন কিছুদিন পাওয়া যাবে না। রবার্ট সাহেবের বড় নাতনিরও টোটোর মতন তেনাদের সাথে খেলা করার রোগ হয়েছে তাই সে রবার্ট সাহেবের বাংলোতে গেছে।”
আমি তো সেটা শুনে আনন্দে নাচানাচি শুরু করে দিলাম।
মা বললেন, “তাহলে উপায়?”
“কিছু করার নেই। রবার্ট সাহেবের নাতনির রোগ ছাড়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতেই হবে! তবে মার্কাসের এখন খুব পসার। লাইন পড়ে গেছে ওর জন্যে! আমার পিছন আরো দুজন ছিল!”
রবার্ট সাহেবের নাতনির রোগ মনে হয় বেশ পেঁচালো কারণ বেশ কিছুদিন হয়ে গেল তাও মার্কাসকাকু এলেন না। এদিকে আমার আর গাবলুর খেলাধুলা ভালই চলছিল।
তারপর একদিন গাবলু খেলতে এল না। আমি বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলাম ওর জন্যে তারপরও ও যখন এল না তখন আমার বেশ চিন্তা হল। গাবলুর মা বাবা কি জেনে গেল নাকি যে ও আমার সাথে খেলে তাই কি ও আসতে পারছে না? নাকি মার্কাসকাকুর মতন কেউ ওর রোগ সারাবার জন্যে এসেছে?
আর অপেক্ষা করতে পারছিলাম না আমি। পা টিপে টিপে গাবলুর ঘরের দিকে চললাম। বাড়ির ওই দিকটায় আমি কখনও যাইনি। আমার ওদিকে যাওয়া নিষেধ কারণ যাদের নাম করতে নেই তারা থাকে ওদিকে আর গাবলুও তো ওদেরই একজন! কিন্তু গাবলুর ঘর কোনটা আমি জানি। ওই আমাকে বলেছে।
উফফ এদিকটা একেবারে অন্যরকম! এত বেশি আলো লাগিয়েছে এরা! যাই হোক গাবলুর ঘর পর্যন্ত পৌঁছে গেলাম আমি। ভেজানো দরজার ফাঁক দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখলাম। ওই তো গাবলুকে দেখা যাচ্ছে! বিছানায় শুয়ে রয়েছে সে! আরো বেশ কয়েকজন ওর বিছানার আশপাশে দাঁড়িয়ে!
ও তাহলে কী গাবলুর আবার শরীর খারাপ হয়েছে তাই সে খেলতে আসতে পারেনি?
ভিতরের কথাবার্তা শোনা যাচ্ছে। লম্বা মতন একজন বাকিদের বলছে, “আমি অত্যন্ত দুঃখিত মিস্টার ব্যানার্জী! ওকে আর ...”
হঠাৎ পিঠে টোকা পড়তে আমি ভয়ে চমকে ফিরে তাকালাম! দেখি গাবলু দাঁড়িয়ে আমার দিকে চেয়ে মিটিমিটি হাসছে!
“কিরে এদিকে এসেছিস কেন আর আমার ঘরে উঁকি দিচ্ছিস কেন?” ও বলল।
“কিন্তু তুই তুই...”
“হ্যাঁ, আমার সাথে খেলতে আর তোর কোন ভয় নেই! আর ঘুম থেকে উঠেও আসতে হবে না!”
আমি আর গাবলু এখন খুব খেলি। এখন তো গাবলুও আমাদের মতনই একজন তাই মা বাবা আর আপত্তি করেন না! গাবলুর মা বাবা বাড়িটা ছেড়ে চলে যাওয়ার পর বাড়িটাতে অনেকদিন আর কেউ আসেনি। তারপর একদিন আমরা খেলছি এমন সময় দেখি একটা পুঁচকে মেয়ে হাঁ করে আমাদের দিকে তাকিয়ে রয়েছে!
আমি গাবলুর দিকে তাকিয়ে বললাম, “আবার কেউ এসেছে রে বাড়িটাতে, আবার ওদের উপদ্রব শুরু হবে!”
শুনতে পেলাম কেউ একজন ডাকছে, “কোথায় গেলে রিমি চলে এসো! ওদিকটায় যেতে বারণ করেছি না!”
রিমি বলে মেয়েটা আমাদের দিকে পিছন ফিরে যেতে যেতে উত্তর দিল, “আসছি মা! এখানে দুটো বাচ্চা ভূত আছে তাদের দেখছিলাম!”