ক্যানসার! কর্কটরোগ! নাম শুনলেই বুকে ধাক্কা মারে। পুরাকাল থেকেই শুনে আসছি এ মারণ রোগ, কোনো চিকিৎসা নাই। রোগ হওয়ার আগে থেকেই প্রতিরোধের চেষ্টা তো দূরের কথা। বেশিরভাগ ক্যানসারেরই কোনো কারণ জানা ছিল না। সিগারেট খাওয়া ও ফুসফুসের ক্যানসারও গত তিরিশ চল্লিশ বছরের আগে কেউ জানত না।
কিন্তু গত চল্লিশ বছরে এসব বদলে গেছে।
এখন আমরা জানি যে রেডিয়েশন, সিগারেট ও আরও নানারকম পরিবেশ দূষক পদার্থ শরীরে ক্যানসারের সৃষ্টি করে। প্রসঙ্গতঃ অতিরিক্ত রেডিয়েশন যেমন ক্যান্সার ঘটায় তেমনি নিয়ন্ত্রিত রেডিয়েশন ক্যান্সার চিকিৎসার এক অতি প্রয়োজনীয় ও গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্র। (পারমাণবিক শক্তির বিষয়ে সাধারণ মানুষের ভয় ও দ্বিধার একটি সঙ্গত কারণ হল চুল্লির কোনো এক বড় দুর্ঘটনার দরুন বে-লাগাম রেডিয়েশনের নিষ্ক্রমণ। কিন্তু এরকম দুর্ঘটনার সম্ভাবনা গ্রহণযোগ্য মাত্রায় কমাতে পারলে শুধুমাত্র রেডিয়েশনের কারণে তার বিরোধিতা যুক্তিসঙ্গত নয়। সাধারণভাবে প্রকৃতিতেই আমরা রেডিয়েশন কিছুটা পেয়ে থাকি। দেখতে হবে চুল্লি থেকে নিষ্ক্রিত রেডিয়েশনের 'মাত্রা' নিয়ন্ত্রণে রাখার ব্যবস্থার ওপর কতটা আস্থা রাখা যায়।) আমরা জানি যে কয়েকটি বিশেষ জেনেটিক রোগ পেট ও স্তনের ক্যানসারের রিস্ক বাড়িয়ে দেয়। আর আমরা জেনেছি ঠিক কীভাবে কয়েকটি ভাইরাস সুস্থ শরীরের কোষে ঢুকে তাকে ক্যানসার কোষে বদলে দিতে পারে।
আমার মতে এই ভাইরাস ও ক্যানসারের যোগাযোগটাই গত পঞ্চাশ বছরে ক্যানসার গবেষণা ও চিকিৎসার অন্যতম প্রধান ফল। সার্ভিকস ক্যানসারের কথাই ধরুন। সার্ভিকস (cervix) হচ্ছে জরায়ুর মুখের অংশটা। এটার ক্যানসার পঞ্চাশ বছর আগে পর্যন্ত বিশ্বের প্রধান রোগ ছিল। এখনও তৃতীয় বিশ্বে এই ক্যানসারে লক্ষ লক্ষ নারীর মৃত্যু হয়। ভারতেও প্রতিদিন গড়ে তিনজন এই ক্যানসারে মারা যাচ্ছেন। ধনী দেশগুলোতেও পঞ্চাশ বছর আগে পর্যন্ত ঐ অবস্থাই ছিল, কিন্তু ১৯৫০ দশকে — একজন গ্রীক বিজ্ঞানী জর্জ প্যাপানিকুলাও প্রথম আবিষ্কার করলেন এক অভিনব পরীক্ষা — যার সাহায্যে ক্যানসার শরীরে ছড়িয়ে পড়ার আগেই ধরা পড়ে যাচ্ছে। এটা ক্যানসারের (বা অন্য কোনো অসুখে) ইতিহাসে প্রথম। পত্তন হল প্যাপ টেস্ট যা সম্বন্ধে মহিলা পাঠকরা নিশ্চয়ই পরিচিত। ব্যাপকভাবে প্যাপ টেস্টের চল হওয়ায় সার্ভিকস ক্যানসারের হার খুবই কমে গেছে। কিন্তু দারিদ্র্য ও অশিক্ষার দরুণ গরীব দেশে এর চল নেই ও সেখানেই সার্ভিকস ক্যানসারের জন্ম।
ডক্টর প্যাপানিকুলাও আমাদের দেখালেন সুস্থ কোষ ধীরে ধীরে কিভাবে ক্রমাগত ক্যানসার কোষে পরিণত হয় ও সেটা সারা শরীরে ছড়িয়ে মৃত্যু ডেকে আনে। কিন্তু এই পরিবর্তন রাতারাতি হয় না। পনেরো থেকে কুড়ি বছর সময় লাগে। সেই সময় সুস্থ কোষগুলি প্রথমে একটু বদলায় Pre-cancer অবস্থায়। এই সময় রোগ সার্ভিকসেই অন্তর্গত থাকে, সারা শরীরে ছড়ায় না। পরে একেবারে ক্যানসারে পরিণত হলে ছড়াতে শুরু করে। এই দশ-কুড়ি বছর সময়ে যদি Pre-cancer কোষগুলো সনাক্ত করা যায় তাহলে তক্ষুনি অল্প চিকিৎসা করেই সেটা দূর করা যায় ও ভবিষ্যতে ক্যানসারের সম্ভাবনা আর থাকে না। এইটাই হল বিখ্যাত প্যাপ টেস্টের মূল তথ্য।
এই ক্যানসারের আগের অবস্থা — Pre-Cancer — যখন রোগীর কোনো লক্ষণ দেখা দেয় না, এটার আবিষ্কার ক্যানসার ইতিহাসে প্রথম। এর পর আমরা এই রকম Pre-cancer ফুসফুস, স্তন, অন্ত্র ও অন্যান্য ক্যানসারেও পেয়েছি। তাদের পরীক্ষার ফলে সেই ক্যানসারগুলোর মারণহার কমানো গিয়েছে। ক্যানসার চিকিৎসায় এটা একটা বিরাট সাফল্য।
দ্বিতীয় সাফল্যের খবর এল ১৯৭০ দশকে জার্মানী থেকে। গবেষকরা প্রমাণ করলেন যে একধরনের সাধারণ ভাইরাস — Human Papilloma Virus বা HPV — সার্ভিকসের ক্যানসার ও Precancer কোষগুলোও বর্তমান। আরও পরীক্ষার পর জানা গেল যে এই ভাইরাসের অনেক রকম প্রকৃতি। কোনোটা (Type 6, 11 ইত্যাদি) কোষের ভেতর ঢুকে চুপচাপ বসে থাকে। কোষটি Pre-cancer এর আকার নেয় কিন্তু ক্যানসারে পরিণত হয় না। কয়েক বছর পরে ভাইরাস আপনা আপনিই নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। বেশীর ভাগ HPV এই ধরনের। এগুলিকে Low Risk বলা যায়। নির্বিষ। এরা শুধু পুরুষ ও নারীর যৌন অঙ্গে ছোট্ট আঁচিলের সৃষ্টি করে। ভাইরাসগুলি সংক্রামক ও একজন থেকে অনেকজন ছড়িয়ে পড়তে বেশী সময় লাগে না। এছাড়াও অল্প সংখ্যক HPV আছে যারা High Risk (Type 16, 18 ইত্যাদি) সেগুলিও Precancer সৃষ্টি করে কিন্তু কোষে ঢুকে এরা চুপচাপ বসে থাকে না। সোজা নিউক্লিয়াসের ভেতরে সুস্থ DNA- এর ক্ষতি করে দেয়। এর ফলে সুস্থ কোষ গুলি অবাধ হারে বাড়তে থাকে ও ক্যানসারের সৃষ্টি হয়।
প্যাপ টেস্টের Pre-Cancer -এর আবিষ্কারের মতই এই ব্যাপারটাও ক্যানসার ইতিহাসে বিরাট ঘটনা। এর আগে আমরা এত সূক্ষ্মভাবে ক্যানসারের সৃষ্টি ও ভাইরাসের ক্রিয়াকর্ম দেখতে শিখিনি। এরই সূত্র দিয়ে আমরা আরও কয়েকটা ভাইরাস জনিত ক্যানসারের খোঁজ পেয়েছি — মাথা ও মুখের ক্যানসার, যকৃত বা লিভারের ক্যানসার ও এইড্স্ সংলগ্ন চামড়া ও মস্তিষ্কের ক্যানসার। এগুলি সবই আলাদা আলাদা ভাইরাস জাত কিন্তু কোষের ভেতরে DNA ক্ষতি করার ব্যাপারটা প্রায় একই রকম।
মানুষের শরীরে HPV ভাইরাসের সংক্রমণ খুবই সাধারণ। পুরাকালে ইজিপ্টের হায়ারোগ্লিফিক আঁকা ছবিতেও যৌনাঙ্গে আঁচিলের চিহ্ন দেখা গেছে। যৌনাঙ্গ ছাড়াও হাতের পাতায়, আঙ্গুলের ডগায় বা ঠোঁটের কোণে এমন আঁচিল আকছার হয়। কিন্তু ঐ ভাইরাস গুলি HPV হলেও অন্য টাইপের। যৌন HPV গুলি পুরুষ ও নারী দুইজনকেই আক্রান্ত করে কিন্তু পুরুষদের যৌন ক্যানসার মেয়েদের থেকে অনেক কম হয় এর সঠিক কারণ এখনও জানা নেই। তবে সমকামী পুরুষের পায়ুদেশে ও মুখেও ঐ রকম আঁচিল ও ক্যানসার দেখা গেছে। সিগারেট খাওয়া মুখের ক্যানসারের সম্ভাবনা আরও বাড়িয়ে দেয়। অনেক সময়ই আঁচিল ও PreCancer গুলি খুব ছোট্ট হয়। খালি চোখে প্রায় দেখাই যায় না। শরীরে ব্যথা, জ্বালা বা রক্তপাত ইত্যাদি কোনো লক্ষণও হয় না তাই এই অবস্থায় রোগগুলি ধরাও পড়ে না, কোনো চিকিৎসাও হয় না। তারপর ক্যানসার ছড়াতে শুরু করলে অপারেশন, কিমোথেরাপি, রেডিয়েশন ইত্যাদির দরকার হয়।
অনেক সময় এতসব করেও মৃত্যুকে ঠেকিয়ে রাখা যায় না।
HPV একটি যৌনসংক্রামক রোগ — ঠিক গনোরিয়া বা সিফিলিসের মতই। এবং সারভিক্স ক্যানসারও একটি যৌনসংক্রামক রোগ। যৌন সংসর্গ না করলে এই ক্যানসার হয় না। তাই নান (Nun)-দের মধ্যে এই ক্যানসার প্রায় দেখাই যায় না এবং যৌন কর্মীদের মধ্যে এর প্রকোপ অনেক বেশী।
কিন্তু HPV সংক্রমণ থেকে ক্যানসার হতে অনেক বছর সময় লাগে। সেই অবসরে প্যাপ টেস্ট করে যে কোনো Pre-Cancer সারিয়ে নেওয়া যায়। এইখানেই এই সহজলভ্য ও অল্পদামী পরীক্ষাটির উপযোগ। প্যাপ টেস্ট শুরু করা উচিত ১৭-১৮ বয়স থেকে (অথবা যে বয়সে যৌন সংসর্গ শুরু হয়)। নিয়মিত দুতিন বছর অন্তর টেস্ট করানো উচিত। ডাক্তাদের মতে ৬৫ বছর বয়স পর্যন্ত টেস্ট চালু রাখা দরকার। (বিশেষ নিয়ামাবলী জানতে হলে আপনার ডাক্তার বা নার্সের সঙ্গে যোগাযোগ করুন)। এখন প্যাপ টেস্টের সঙ্গে সঙ্গেই HPV Type টেস্টও পাওয়া যাচ্ছে — আমেরিকা ও অন্যান্য পশ্চিমী দেশে। High Risk HPV যদি Positive থাকে তাহলে নিয়মত প্যাপ টেস্ট চালু রাখা উচিত আর যদি Negative হয় তাহলে ক্যানসারের আশংকা এতই কম যে পাঁচ বছর অন্তর প্যাপ টেস্টই যথেষ্ট।
গত দশ-পনেরো বছর থেকে সার্ভিকস ক্যানসারের জগতে তৃতীয় আন্দোলন — HPV Vaccine বা টিকা। এই-ই প্রথম ক্যানসারের বিরুদ্ধে টিকা, দশ থেকে কুড়ি পর্যন্ত যে কোনো বয়সে এই টিকা নেওয়া যায় — তিনটি ইঞ্জেকশন ছমাসের মধ্যে নিতে হবে। প্যাপ টেস্টের মত সস্তা নয় কিন্তু। প্রতিটি ইঞ্জেকশনের দাম ১৫০ ডলার মতো। আমেরিকা ও পশ্চিমী দেশে এগুলো সুলভ। ভারতেও দিল্লী ও অন্যান্য বড় শহরগুলিতে এই টিকা পাওয়া যাচ্ছে। নাম Cervarix অথবা Gerdasil টিকা নেওয়া মহিলাদের HPV সংক্রমণ ও তথাকথিত ক্যানসারের সম্ভাবনা প্রায় শূন্য। মেয়েরা ছাড়াও পুরুষদেরও টিকা নেওয়ায় উপকার আছে মুখের ক্যানসার প্রতিরোধ করা জন্য।
তৃতীয় বিশ্বে এই টিকা এখনও সুলভ নয়। কিন্তু আশা করি আরও কয়েক দশকের মধ্যেই এই টিকার মাধ্যমে আমরা এই ভয়ংকর ক্যানসার প্রতিরোধ করতে পারবো। হয়ত স্মলপক্স বা পোলিওর মত HPV-ও পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে — এবং সেই সঙ্গে একটি প্রধান মারণাত্মক ক্যানসারও। হয়ত আমাদের জীবনে হবে না কিন্তু আমাদের মেয়েদের ও নাতনীদের জীবনে নিশ্চয়ই হতে পারে।