• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৬৪ | সেপ্টেম্বর ২০১৬ | রম্যরচনা
    Share
  • দেশান্তরের কথা : সন্ধ্যা ভট্টাচার্য


    ইংরাজি ১৯৯৫ সালে, সাতষট্টি বছর অতিক্রম করে সত্তরের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে বিগত দিনের জীবনটাকে ফিরে দেখার অভিপ্রায়ে, যৎসামান্য অক্ষর পরিচিতি জ্ঞান নিয়ে আশ্রয় নিলাম খাতা আর কলমের। সমাজের কঠোর বন্ধনীর আওতায় থেকে ছোটবেলায় গ্রাম্য পাঠশালায় যৎকিঞ্চিৎ অক্ষর পরিচয়ের সুযোগ ঘটেছিল। কাজেই এই লেখায় আমার অনেক ত্রুটি বিচ্যুতি, অসঙ্গতি ঘটে থাকবে। আধুনিক যুগের আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিতদের কাছে এই লেখা হয়ত খুবই নগণ্য। তবু পিছনে ফেলে আসা ভারবাহী জীবন থেকে আজ মুক্ত হয়ে অবসরক্ষণে ফিরে তাকালাম অতীতের দিকে।

    বিগত ৪৫ বছরের কর্মময় জীবনে আমার পুত্র কন্যাগণ, একে একে নিজ নিজ ক্ষমতায় নানাবিধ প্রতিকূলতা, প্রতিবন্ধকতাকে অতিক্রম করে জীবনে পূর্ণ সফলতা অর্জন করেছে। সংসারের নিয়মেই যে যার গন্তব্যে পৌঁছে গেছে। আজ আমার অখণ্ড অবসর। এই অবসরক্ষণের নিভৃতে বসে, বিগত জীবনের জমাখরচ হিসাবের খাতা খুলে বসলাম। ভারাক্রান্ত মন নিয়ে স্মৃতিসুখের রস আস্বাদনের অভিপ্রায়ে ছুটে চল্লাম শৈশবের মধুস্মৃতি বিরজিত আমার জন্মভূমি গ্রামবাংলার পরিবেশে। ডুব দিলাম সুদূর স্মৃতির সাগরে। ভাব স্রোতস্বিনীর অতলে দীর্ঘ বৎসর যে অতীত, যেসব আনন্দঘন ঘটনা বিস্মৃতির পলির মত জমে ছিল, লেখনীর সাহায্যে পুনরায় তুলে আনার চেষ্টায় বৃত হলাম। অবসরের জানালাপথে রঙীন বুদবুদের মত ভেসে আসতে লাগল ফেলে আসা দিনের নানা স্মৃতি। সেই স্মৃতির রোমন্থনে বুঁদ হয়ে আনন্দসাগরে ভেসে বেড়ানো আমার উদ্দেশ্য।

    বাল্যকালে যা দেখেছি, যা পেয়েছি, যা হারিয়েছি, যা উপভোগ করেছি সব স্মৃতি ভীড় করে এল আমার মনে। পিতামাতার স্নেহ, ভাইবোনের প্রীতি, প্রতিবেশীর সৌহার্দ্য, খেলুড়িদের সাথে অনাবিল আনন্দে মেতে থাকা, হাওয়ায় সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ফাঁকা প্রান্তরে ছোটা, পুকুরে সাঁতার কাটা, খরস্রোতা নদীতে নির্ভয়ে নৌকায় চড়ার আনন্দ সব মনে পড়ে গেল। ভোর না হতেই বাগানে বাগানে ফুল চুরি করে বেড়ানো, কালবৈশাখীর প্রবল হাওয়ার তাণ্ডবকে উপেক্ষা করে আমের গুটি কুড়িয়ে আনার প্রতিযোগিতা, মহাসমারোহে পুতুলের বিয়ে দেওয়া-কী নেই সেই স্মৃতির পাতায়। অবসরের সুযোগে, নীরবে অনুভূতিতে সেইসব ফেলে আসা দিনের সুখস্মৃতির নৈকট্য লাভ করে আনন্দ লাভ করাতেই আমার দিনগুলি আনন্দময় হয়ে ওঠে। ছায়াহীন এই সংসার মরুপথে চলতে গিয়ে কত উত্থান-পতন, আশা-নিরাশা, হাসি-কান্নার স্মৃতি বিজড়িত এই জীবন। সুদীর্ঘ জীবনের আত্মকথা লিপিবদ্ধ করতে গিয়ে, অনেক অপ্রীতিকর ঘটনার কথাও মনে আসা স্বাভাবিক। কিন্তু আমি সে’সব কথা বাদ রেখেছি। পূর্বাপর অন্যান্য প্রখ্যাত লেখিকারাও তাঁদের আত্মকথা লিপিবদ্ধ করার সময় জীবনের রঙ্গমঞ্চের কিছু কিছু ঘটনার গোপনীয়তা অবশ্যই বজায় রাখতেন বলে আমার ধারণা। কারণ আমার মনে হয় স্ত্রীজাতির পক্ষে লেখনীর সাহায্যে সর্বসমক্ষে নিজেকে সম্পূর্ণ উন্মুক্ত করা বিবেকবিরুদ্ধ, অনৈতিক।

    ছেলেবেলার স্মৃতি রোমন্থনের সাথে পরবর্তী জীবনের ধারাবাহিকতার সূত্রটানে আসা রাজনৈতিক ক্রমপরিবর্তনের অস্থিরতার কথাও উঠে এসেছে আমার মনে। রাজনীতির জটিল খেলায় দেশ গাঁয়ের শান্ত স্নিগ্ধ পরিবেশের পরিবর্তন, সাধারণ মানুষের জীবনে আতঙ্কের ছায়াপাত, অস্থিরতা, সবই আমার তখনকার অপরিণত মনের কোণে আবছা, অস্পষ্ট দৃশ্যপট হিসাবে সঞ্চিত হয়েছিল। বর্তমানে আধুনিক বিজ্ঞানের কল্যাণে এ যুগের ছোট ছোট ছেলে মেয়েরাও টেলিভিশান আর বেতারের দৌলতে সমাজ ও রাজনীতির অনেক বিষয় জেনে বুঝে পারদর্শী হয়ে যায়। অনাবিল আলো বাতাসময়, শান্ত স্নিগ্ধ গ্রাম্য পরিবেশে আমি মানুষ হয়েছি, ছোটবেলায় তাই এ সব বিষয়ে সম্পূর্ণ অনভিজ্ঞ ছিলাম।

    জীবনের শেষপ্রান্তের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে প্রতিটি অতীত অধ্যায়কে স্মৃতির আয়নায় স্ব স্ব রূপে ফিরে দেখতে দেখতে কল্পনার স্মৃতি রসে খানিক ডুবে থাকার অভিপ্রায়ে আমার এ লেখার প্রয়াস।

    দীর্ঘকাল পূর্বের এক গ্রীষ্মের মধ্যাহ্ন। রৌদ্রজ্জ্বল ঝকঝকে নীল আকাশ। নীরব নিস্তব্ধতার সুযোগে আঙিনাময় ঘুরে বেড়াচ্ছে কয়েকটি ঘুঘু, আমি একা বসে দেখছি। মনে পড়ে গেল খুব ছোটবেলায় পাখি ধরার কথা।

    ছোটবেলায় বাড়ির আনাচকানাচে, নীরব জায়গায় কিছু শস্যদানা ছড়িয়ে দিতাম। একটি বড় ঝুড়িকে একটি লম্বা কঞ্চি দিয়ে ঠেকনা দিয়ে দাঁড় করিয়ে রেখে দূরে চুপ করে বসে থাকতাম। খাবারের খোঁজে বাচ্চা সহ মা পাখিরা এদিক ওদিক তাকিয়ে যেই খাবার খুঁটে খেতে মগ্ন হয়ে যেত অমনি দূর থেকে এক ঝটকায় লম্বা কঞ্চিকে ঠেলে দিতাম। ঝুড়িটা পড়ে যেত। চতুর মা পাখিরা সুরুৎ করে পালালেও বাচ্চারা ঝুড়ির তলায় আটকা পড়ে যেত।

    সেই বাচ্চাদেরকে ধরে এনে একখানা ঝুড়িতে ছেঁড়া ন্যাকড়ার বিছানায় রেখে আর একটি ঝুড়ি চাপা দিয়ে যত্নআত্তিতে মন দিতাম। মুখে করে চাল চিবিয়ে মুখের লালাযুক্ত চিবোনো চালের গুঁড়ো ন্যাকড়ার পুঁটুলিতে ভরে নিতাম। এবার সেই পুঁটুলিতে একটি ছিদ্র করে পুঁটুলিটি বাচ্চা পাখির ঠোঁটের ফাঁকে ঢুকিয়ে দিতাম। ছিদ্র দিয়ে খাবার বের করে নিত বাচ্চা পাখিরা। প্রচণ্ড খিদেয় তারা খেত। অতিভোজনে কেউ আবার মরেও যেত। কেউ কেউ আবার অতি আদরের ফাঁকে হাত থেকে সুরুৎ করে পালিয়ে যেত। মনে পড়ে, একবার আমাদের বাড়ির বেড়ার বাইরের দিকে একটা তুলো গাছে টুনটুনি বাসা বেঁধেছিল। এই গাছের তুলো থেকে তক্‌লিতে সুতো কাটতেন মা কাকিমারা। সেই সুতো দিয়ে পৈতে তৈরি হত।

    তুলোগাছে টুনটুনির বাসা থেকে পোকামাকড় খেতে পারার মত বড় একটি টুনটুনির বাচ্চা ধরে এনেছিলাম। সেটিকে খানিক আদর করে, তার পায়ে সুতো বেঁধে জানালায় বসিয়ে রেখে দলবল মিলে চললাম শন ক্ষেতে, গঙ্গাফড়িং ধরে আনতে। কচুপাতার পুঁটুলিতে করে গঙ্গা ফড়িং এনে বাচ্চাটিকে খাওয়াতে গেছি, যেই না গায়ে হাত দিয়েছি অমনি তার শরীর নীচে পড়ে পায়ে বাঁধা সু্তোর টানে ঝুলতে লাগল।

    আসলে, জানালায় বসে থাকা পাখির বাচ্চাটা বৈশাখের প্রচণ্ড রোদের তাপ সহ্য করতে পারেনি। বসেই মরে গিয়েছিল। তখন খুব কেঁদেছিলাম। এরপর মায়েদের ভীতিপ্রদ নীতিবাক্যে পাখির বাচ্চা পোষা বন্ধ হয়েছিল।

    তখনকার দিনে এক একটি বাড়ি ৩/৪ এলাকায় বিভক্ত থাকত। যৌথ পরিবারে আবার সাত ভাগেও বিভক্ত থাকত। রান্নাবাড়ি থাকত একটি আলাদা অংশে। আমাদের রান্নাঘরের সামনে দরমার বেড়ায় ঘেরা এক ছোট্ট উঠান ছিল, যেখানে বাড়ির বৌয়েরা মাথার ঘোমটা খুলে অবলীলায় ঘোরাফেরা করতে পারত, একটু আরাম পেত। এই রান্নাবাড়ির উঠানের এক কোণে ছিল একটি ডালিম গাছ। বারোমাস ফলে ফুলে ভরে থাকত। প্রতিবৎসর নির্দিষ্ট সময়ে বুলবুলি এসে এই ডালিম গাছটিতে বাসা করে ডিম পাড়ত। আমার কাজ ছিল রোজ সুযোগ মত বুলবুলির বাসায় উঁকি দেওয়া আর ডিমগুলি গোনা। ক’টা ডিম, ক’টা বাচ্চা হবে এই ভাবনায় মজে থাকতাম কিছুদিন।

    আমাদের দশজন ভাই বোনের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ ছিলাম আমি। পিতৃদেব দুর্গানাথ কাব্যতীর্থ ছিলেন সংস্কৃতে অগাধ পাণ্ডিত্যের অধিকারী। তখনকার দিনে স্কুল, কলেজের শিক্ষার সাথে সংস্কৃতের কদর ছিল যথেষ্ট। তিনি ছিলেন এক সংস্কৃত টোলের হেডপণ্ডিত। অগাধ পাণ্ডিত্যের অধিকারী হলেও সংসার সম্বন্ধে সম্পূর্ণ অনভিজ্ঞ ছিলেন। সংসারের দায়িত্ব সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার গুরুভার আমার মায়ের উপর ন্যস্ত ছিল। আমার পিতৃদেবরা ছিলেন দুই ভাই আর এক বোন। আমার পিতামহী কৃষ্ণমনি দেব্যা তাঁর একমাত্র কন্যা যামিনীসুন্দরীকে অষ্টম বৎসরে গৌরী দান করলেন। পাত্রের যে মৃগীরোগ ছিল দুর্ভাগ্যক্রমে সে বিষয়টি অজ্ঞাত ছিল। মৃগীরোগাক্রান্ত পিসেমশাই বিয়ের দুই বৎসর পর একদিন প্রাতঃকৃত্য সেরে হাত মুখ ধুতে পুকুরঘাটে গিয়ে হঠাৎ মৃগীরোগে আক্রান্ত হয়ে লোকচক্ষুর অন্তরালেই জলে ডুবে মারা গেলেন। নিঁখোজ পিসেমশাইএর খোঁজ পাওয়া গেল, ঘাটে পড়ে থাকা গাড়ু আর খড়ম দেখে। সেদিনের সেই দুঃখদীর্ণ দৃশ্যের কথা আজও আবছা চোখে ভেসে ওঠে, মনকে ভারাক্রান্ত করে তোলে।

    সেকালে সন্তানহীনা বালবিধবার শ্বশুরবাড়ির সম্পত্তিতে কোনো মালিকানা ছিল না। যদি শ্বশুরবাড়ির সহৃদয় কোনো কর্তাব্যক্তি বালবিধবার নামে উইল করে সম্পত্তির কিছু অংশ দিয়ে যেতেন তবেই কিছু পেত সেই বালিকা বিধবা। তবে এ নিয়ম কার্যকর হবার ঘটনা খুবই বিরল। যাই হোক দশ বৎসর বয়সে পিসিমা তাঁর দেবীতুল্য রূপের ঐশ্বর্যকে বিসর্জন দিয়ে ভিন্ন রূপে পিত্রালয়ে ফিরে এলেন। একমাত্র আদরের কন্যার এই রূপান্তর কৃষ্ণমনি দেব্যার সহ্য হলনা, শয্যা নিলেন এবং কিছুদিন পর দেহত্যাগ করলেন। পূর্ণ বয়সের সমাগমে পিসিমা হয়ে উঠলেন অপূর্ব সুন্দরী। একমাথা চুল, টানা ভুরু, দীঘল চোখ, দীর্ঘাঙ্গী, উজ্জ্বল গৌর বর্ণ, উন্নত নাসিকাযুক্তা পিসিমা যেন এক দিব্যসুন্দরী। সে যুগে সমাজের কঠোর অনুশাসনে পিসিমার রূপের অঙ্গহানি ঘটল। ঘন চুলের রাশ বিসর্জন দিয়ে রূপের হানি ঘটাতে হল।

    আবার আসি আমার কথায়। আমার মেজদার কাছে আমি সবচেয়ে আদরের ছিলাম। একবার বাড়িতে কাঠের খেলনা নিয়ে ফেরিওয়ালা এসেছে। আমি একখানা বড় কাঠের পুতুলের বায়না ধরলাম, মেজদা কিনেও দিল। মেজদা এই পুতুলের নাম দিল সিদ্ধেশ্বরী। এই সিদ্ধেশ্বরীকে তেল মাখানো, স্নান করানো, পায়ের ওপর বালিশ পেতে ঘুম পাড়ানো, রাতে বিছানায় সাথে নিয়ে শোয়া, পাড়ায় বেড়াতে গেলে এক বগলে শাড়ির পুঁটুলি আর কোলে সিদ্ধেশ্বরী এইভাবেই চলত দিনগুলো। কখনও সিদ্ধেশ্বরীর চান খাওয়া নিয়ে বায়না উঠলে, মেজদাকে ডেকে নালিশ জানাতাম।

    খুব ছোটবেলায় আমার মুখের ভাষা অস্পষ্ট ছিল। মেজদাকে ‘মাধু’ বলে ডাকতাম। ‘গ’ বেরোত না বলে গোরাদাকে বলতাম ‘দোরাদা।’ গরুকে ‘দরু’। আমাদের পাশের বাড়ির জ্যাঠতুতো দাদাদের খ্যাপা স্বভাবের একটি গাই গরু ছিল। খ্যাপা স্বভাবের দরুন যেখানে সেখানে গুঁতিয়ে গুঁতিয়ে মাথার শিং দুটো ভোঁতা হয়ে গেছিল। গায়ের রং ছিল লাল। আমি বলতাম লাল দরু।

    আমাদের গ্রামটা ছিল লম্বায় এক মাইলের উপর, বাড়িগুলো ছিল সারিবদ্ধভাবে। প্রতি বাড়ির উঠানের মাঝখান দিয়ে মেয়েদের এক পাড়া থেকে আরেক পাড়া যাওয়ার রাস্তা ছিল। তবে পুজোপার্বণ, বিয়ে ইত্যাদি কোন উৎসব অনুষ্ঠানে মেয়ে বা বউদের পায়ে হেঁটে যাতায়াত নিন্দনীয় ছিল, বউ বা বড় মেয়েরা উৎসববাড়ি যেত পালকি কিংবা সোয়ারী (দুই বেহারার ডুলিজাতীয় কাঁধে বওয়া যান-সম্পাঃ) করে, নতুবা নৌকাপথে।

    আমাদের গ্রামের দক্ষিণপাড়ায় ছিল আমার এক মাসীর বাড়ি। এক অঘ্রাণের শীতে মাসীর মেয়ের বিয়ে। বৌদি আর আমার এক ১৩/১৪ বছর বয়সের দিদি পালকি চেপে চলে গেছে মাসীর বাড়ি। আমার মায়ের কোন বাধা নেই, তিনি বয়স্ক, পায়ে হেঁটেই চলে গেছেন। আমার তখন বিয়েবাড়ি আর আমাদের বাড়ি, এই দুয়ের মধ্যে অনবরত যাতায়াত চলছে।

    গ্রামের এক মাথা থেকে অন্যদিকে যাতায়াতের জন্য প্রত্যেক বাড়ির বাইরে দিয়ে ছিল একটি সরু রাস্তা। এই রাস্তার পাশে ছিল একটি পগার (যাকে এদেশে বলে ডোবা)। পগারের পাশে সরু রাস্তার ধারে দাদাদের খ্যাপা লাল গাইকে বাড়ির চাকর শ্যামাচরণ লম্বা দড়ি দিয়ে বেঁধে রেখেছিল। বিয়েবাড়িতে সবাই ব্যস্ত। চঞ্চল স্বভাবের তাড়নায় এক কোলে সিদ্ধেশ্বরী আর বগলে শাড়ির পুঁটুলি নিয়ে আমি এপাড়া ওপাড়া করছি। লাল গরুকে দেখেও পগারের পার দিয়ে আসার মতলবে যেই না ঘুরেছি অমনি খ্যাপা গরু তেড়ে এসে এক গুঁতো মারল, সঙ্গে সঙ্গে গড়িয়ে পড়ে গেলাম পগারের জলে।

    তখন শীতকাল আগত। বর্ষার জল শুকিয়ে পগারে নানা জাতের ঘাস গজিয়ে ঘন জঙ্গল হয়ে আছে। ধাক্কা খেয়ে গড়িয়ে পড়ার চোটে কোল থেকে ছিটকে সিদ্ধেশ্বরী ঘন ঘাসে কোথায় হারিয়ে গেল। গড়িয়ে পড়ার চমক ভেঙে উঠে জংলা ঘেঁটে সিদ্ধেশ্বরীকে খুঁজেপেতে কোলে নিয়ে পগারের ওপার দিয়ে বাড়ি এসে সবচেয়ে বড়োভাই গোরাদাদাকে বললাম।

    শুনে গোরাদাদা রেগে আগুন। সঙ্গে সঙ্গে আমাকে নিয়ে গেলেন বিয়েবাড়ি। কেমন করে আমি একলা বেরোলাম সেই নিয়ে দিদি আর বৌদিকে খুব বকাবকি করে আমাকে নিয়ে বাড়ি চলে এলেন।

    এরপর দিদি এসে বিয়েবাড়িতে নিয়ে গেল, সেখানে বন্দি হলাম, রক্ষী হলেন দিদিমা। সারাদিন সিদ্ধেশ্বরী কোলে দিদিমার সঙ্গে রইলাম। সন্ধে হল। চারিদিক হ্যাজাকের আলোয় আলোকিত। বাজনদাররা এগিয়ে গেছে বর আনতে। যথাসময়ে বর এল। কলাতলায় শুভ দৃষ্টি, সম্প্রদান আরম্ভ হয়েছে। দিদিমা একখানা আগুনের ‘আইলসা’ (আগুন পোয়ানোর মালসা) নিয়ে ঘরের বারান্দায় বসে আছেন। আমার গায়ে একটি ফ্লানেলের জামা আর খদ্দরের একটা চাদরে মাথা ঢেকে পিছনে ঘাড়ের কাছে গিট দিয়ে বাঁধা। বিয়েবাড়ির পোশাক হিসাবে ভালই। পা ছড়িয়ে শাড়ির পুঁটুলিতে মাথা দিয়ে সিদ্ধেশ্বরীকে পাশে শুইয়ে দিদিমার কাছেই আছি। দিদিমার নির্দেশ মত গান শুরু করলাম, আধো আধো ভাষায় সে গানের সঠিক শব্দগুলো ছিল

    “সন্ধ্যারানি, সন্ধ্যারানি
    এইত মোদের
    গোপন মিলন
    কেউ জানে না
    আমরা জানি
    সন্ধ্যারানি সন্ধ্যারানি।”
    গান শুনে বরযাত্রীরা আমাকে ধরে নিয়ে গেল বিয়ের আসরে। অনেক বলাবলির পর আবার গান ধরলাম—
    “নূপুর বেজে যায় রিনিঝিনি
    আমার মন কয় চিনি চিনি--”
    এই সমস্ত কথা আমার আবছা আবছা মনে পড়ে, কারণ তখন আমার বয়স পাঁচ কি ছয় বৎসর হবে। খুব ছোটবেলার, কতগুলি উল্লেখযোগ্য ঘটনার কথা আমার স্মৃতি থেকে সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়নি। ছোটবেলার স্মৃতি সর্বদাই সুখের হয়। মনে পড়ে, সেই বিয়ে সমাপ্তির পর যে যার বাড়ি যাচ্ছে। আমি বৌদির কোলে বসে পালকি চেপে বাড়ি এসেছিলাম।

    ********

    কিছুকাল পরের কথা। আমি তখন আর একটু বড় হয়েছি। দেশে যে একটা বিপদের হাওয়া বইছে সে আভাস পাচ্ছিলাম বাড়ির বড়দের কথাবার্তা থেকে। স্বদেশী আন্দোলনের হাওয়া তখন দেশগাঁয়ে বইতে শুরু করেছে। পরোক্ষে সেই আন্দোলনে যুক্ত বলে গ্রেপ্তারি এড়াতে গোরাদা অর্থাৎ আমার বড়দাকে দেশ (তৎকালীন পূর্ববাংলার ময়মনসিং) ছেড়ে চলে যেতে হল কলকাতায়। আমাদের সংসারে তখন নেমে এল ঘোর অন্ধকার, বিরাট মহীরুহের পতন হলে যেমন তলায় আশ্রিত চারাগাছগুলি বাঁচার তাগিদে হীনবল হয়েও বেঁচে থাকে, আমাদের সংসারটার অবস্থাও হল সে রকম। বড়দের মনের শান্তি, আনন্দ, উৎসাহ উধাও হয়ে গেল। মা গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লেন। বাঁচার কোন আশা ছিল না। অনেক চেষ্টায় মা সুস্থ হলেন। কিন্তু সংসারের সেই নির্মল শান্তি আর ফিরে এল না। আমি তখন একটু বড় হয়েছি। কিছু কিছু বুঝতে শিখেছি। সংসারের কর্তব্যের রশিতে মা আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা! মায়ের বাকি সন্তানদের জীবনের কোন ক্ষতি যেন না হয়, অর্ধমৃত অবস্থাতেও সে দিকে মায়ের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ছিল।

    আমার বাবা তাঁর পাণ্ডিত্যের সুনামে হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে সর্বজনের মান্য ছিলেন। মনে পড়ে তাঁর কাছে শাস্ত্র আলোচনা শুনতে আসতেন একজন মুসলমান। নাম ছিল আতর আলী। দেখতে বেঁটেখাটো কিন্তু অদ্ভুত সুন্দর। সাদা ধবধবে এক মাথা লম্বা চুল পিঠ পর্যন্ত, তেমনি ধবধবে সাদা লম্বা দাড়ি। বৃদ্ধ মানুষটির গায়ের রঙ ছিল উজ্জ্বল গৌরবর্ণ। লুংগির মত করে পরা ধবধবে সাদা ধুতি আর ঢিলা হাতা পাঞ্জাবী, পায়ে থাকত খড়ম। প্রাতঃস্নান সমাপনান্তে গাই দুইয়ে এক ঘটি দুধ নিয়ে আমাদের বাড়ি আসতেন। বসতেন বাহিরবাড়ির ঘরের বারান্দায়। ঘন্টার পর ঘন্টা চলত শাস্ত্র আলোচনা।

    আমার চোখে আমার বাবা ছিলেন দেবতার মত। দৈর্ঘেপ্রস্থে বিশাল চেহারা, সুগৌর, সুডৌল, সুগঠিত দেহের মানুষ ছিলেন তিনি। তামাকের নেশা ছিল না তবে পান খেতেন খুবই। নানাধরনের হাতের কাজে বাবা খুব দক্ষ ছিলেন।

    আমাদের গৃহদেবতার আঙিনার শেষে ছিল বেড়া আর ঢোকার পথটিতে ছিল বেতের তৈরি একটি সিংহদরজা। সে দরজা কেমন ছিল বলি। দরজার দু’পাশে সামনাসামনি দাঁড়িয়ে দুটি সিংহ, পেছনের পায়ে ভর দিয়ে সামনের দু’পা তুলে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে। এটি বাবা নিজে হাতে বানিয়েছিলেন। আরও বিভিন্নরকম বেতের কাজে বাবা ছিলেন দক্ষ।

    আমাদের গ্রামের দক্ষিণে, একেবারে শেষপ্রান্তে ছিল পণ্ডিতপাড়া। এঁরা ব্রাহ্মণ ছিলেন না। কিন্তু এই পণ্ডিতদের সাথে আমাদের পরিবারের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়তা হয়েছিল আমার বাবার বিয়ের পর, সে অনেক দিনের পুরাতন কথা। আমার মাতামহরা ছিলেন দুই ভাই। তাঁদের নাম ছিল গুরুদাস রায় আর আনন্দ রায়। পণ্ডিতপাড়ার দুই ভাইয়ের নামও ছিল গুরুদাস আর আনন্দ। নামের সূত্রে আমাদের সঙ্গে পণ্ডিতদের পরিবারের ডাকাডাকি সম্পর্ক হয়েছিল। আমরা তাঁদের ছেলেদের মামা ডাকতাম। ডাকাডাকির সম্পর্ক যে এত সুন্দর আর বংশানুক্রমিকভাবে দীর্ঘস্থায়ী হয় তা ভাবা যায় না। পূজাপার্বণে, যজ্ঞেব্যাপারে, আপদেবিপদে, মায়ের আপন ভাইদের মত ব্যবহার বা উপস্থিতি ছিল পণ্ডিত মামাদের। আমার মাতামহ আনন্দ রায়ের মতই পণ্ডিতপাড়ার দাদামশাই আনন্দ পণ্ডিতের ছিল দুই ছেলে, রমেশ, সুরেশ। রমেশ মামা নিঃসন্তান স্ত্রী রেখে অকালে মারা যান। সুরেশ মামা ছিলেন চাকুরে, সস্ত্রীক আসামে থাকতেন। এঁরাও আমার মামাদের মতই গানবাজনায় ওস্তাদ ছিলেন। সুরেশ মামা কর্মস্থল থেকে যখন বাড়ি আসতেন তখন জমিয়ে গানের আসর বসত। আমাদের বাড়িতেই বেশি সময় কাটাতেন। সুরেশ মামা যখন মায়ের সঙ্গে কথা বলতেন তখন নিজের ভাই নয় তা কেউ বুঝত না।

    তখনকার দিনে গ্রামাঞ্চলের সমাজে জাতপাতের ব্যাপার খুব কঠোরতার সঙ্গে মানতে হত, কিন্তু আমাদের বাড়ি ছিল খানিকটা ব্যতিক্রমী। ত্রিসন্ধ্যা আহ্নিক করা সংস্কৃত পণ্ডিত হলেও আমার বাবা ছিলেন উদারপন্থী। কুসংস্কার ছিল না এতটুকু। তাই আমাদের সংসারে জাতপাতের কঠোর বাঁধনের কিছু শিথিলতা ছিল। মানুষকে মানুষ হিসাবে দেখতেই অভ্যস্ত ছিল আমাদের পরিবার।

    তিন বছরের বড় দিদির সাথে আমার, পণ্ডিত মামাদের বাড়ি যাওয়া ছিল দৈনন্দিন কাজ। সুরেশ মামাদের অপর শরিকের আমার বয়সি একটি মেয়ে ছিল। তার নাম ছিল কনক। সবাই ডাকত কনি বলে। মা আর মেয়ে থাকত। ছোটবেলায় ওর বাবা মারা গিয়েছিল। খেলার সূত্রে কনির সাথে আমাদের খুব ভাব ছিল। বয়সে আমার সমান হলেও একটিমাত্র মেয়ে বলেই আট বৎসর পর্যন্ত মায়ের দুধ খেত। কনি কাপড় পরতে জানত না। তখনকার দিনে দেশগাঁয়ে জামাপ্যান্টের প্রচলন বড় বেশি একটা ছিল না। কনিকে দেখতে ফর্সা টুকটুকে ছিল।

    এই পণ্ডিতদের মধ্যে ছেলেমেয়েদের খুব ছোট বয়সেই বিয়ে হত। এত ছোট ছোট ছেলেমেয়ের বিয়ে দেখা আমাদের কাছে ছিল এক দর্শনীয় ব্যাপার। সেই রেওয়াজ মেনে সেই ছোট বয়সেই কনির বিয়ে ঠিক হয়েছিল। কনির আর্শীবাদের দিন দেখলাম কনি একটি ছোট গামছা পরে বসে আছে।

    এরপর নির্দিষ্ট দিনে কনির বিয়ে। দেখতে গিয়ে দেখি কনির সাজ হচ্ছে। মাথা তেল চুকচুকে, মাঝখানে সিঁথি কেটে দুপাশে পাতা কেটে অর্ধেক কপাল ঢেকে চুল আঁচড়ানো। পেছনে লাল সুতো (‘কার’ বলা হয় এদের। এখনও মাদুলি বাঁধতে ব্যবহার হয়--টীকাকার) দিয়ে ঘাড়ের কাছে ছোট্ট চুলের ছুঁচলো একটি খোঁপা বাঁধা। কপালে গোলা সিঁদুরের টিপ, কানে মাকড়ি, গলায় সুতোয় গাঁথা চৌকো তিনটি ধুকপুকি, দু’হাতে তিনখানা করে মত ছ’খানা শাঁখার সাথে রুলি, কোমরে চন্দ্রহার, পায়ে বাঁকা খাড়ু, গায়ে সেমিজ আর পাছাপেড়ে আগুন রং-এর পাটের শাড়ি।

    ছোট্ট বরের সাথে তো কনির বিয়ে হল। কিন্তু পরদিন ভোরে কনিকে খুঁজে পাওয়া গেল না। বিয়ের শাড়িখানা খুলে রেখে, গামছা পরে কনি পালিয়েছে। কনিদের বাড়ির পাশে কুড়ি বিঘের উপর জায়গা নিয়ে বাঁশ এবং অন্যান্য নানারকম বড়-ছোট গাছের বিশাল বন ছিল। তার মধ্যে নানারকম ফলের গাছও ছিল। তার মধ্যে একটি গাছ ছিল যার ফলগুলি থোকা ধরে ঝুলে থাকত। ডুমুরের মত দেখতে, একএকটি থোকায় অনেকগুলি ফল হত। গ্রামীন ভাষায় এর নাম ছিল “ভুবি”। কোন কোন দেশে বলে লটকা, মনে হয় গাছে লটকে থাকে বলেই লটকা নামকরণ। পশ্চিমবঙ্গে এখন পর্যন্ত এই ফলের দেখা পাইনি। আসামে এদের দেখা যায় এবং ভুবি নামেই পরিচিত। এই ভুবির খোসা ছাড়ালে ভেতরে মেরুন রঙের শাঁস, রসে টসটসে, খেতে খুব সুস্বাদু।

    এই গাছপালার মধ্যে ভুবি সহ আরও অনেকরকম বন্যফল ছিল। তার কোনকোনটি বড় সুস্বাদু। এই সবের টানে দিদির আর আমার এই বন খুব প্রিয় আর পরিচিত ছিল। কনিও আমাদের সঙ্গে সেখানে প্রায়ই যেত।

    হারিয়ে যাওয়া কনিকে খুঁজতে আমরা গেলাম সেই বনের ভুবি গাছের দিকে। সেখানেই পলাতক কনিকে পাওয়া গেল। বনের ভিতর ভুবি গাছে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে রয়েছে। খবর পেয়ে বাড়ির লোকেরা কনিকে ধরে পাঁজকোলা করে বাড়ি নিয়ে এল। বরের পালকি তৈরি, কনি তো কিছুতেই যাবে না। মাটিতে গড়াগড়ি আর কান্না। মজার দৃশ্য। আমরা দল বেঁধে দেখছি। অবশেষে জোর করে কনিকে পালকিতে তুলে দিল। কনির কান্নার মাত্রা দ্বিগুণ চড়ল। বাড়িতেও মেয়েদের মধ্যে কনে বিদায়ের জন্য কান্নার রোল উঠল, তারপর বেহারারা পালকি নিয়ে উধাও হল। আমাদের দলের দর্শকরা কেউ কেউ চোখ মুছতে মুছতে বাড়ি ফিরল।

    তিনদিন পর দ্বিরাগমনে কনি বাপের বাড়ি এল, খবর পেয়ে দেখতে গেছি। গিয়ে দেখি ঘরের বারান্দায় ঢেঁকির উপর বসে মায়ের দুধ খাচ্ছে। তিনদিন পর শ্বশুরবাড়ি থেকে কনিকে নিতে সোয়ারী এল। কনি তো কিছুতেই যাবেনা। কান্নার ঠেলায় সেদিন সোয়ারী ফিরে গেল। এরপর যেদিন কনিকে নিতে সোয়ারী এল, (সোয়ারীর চারধার ফাঁকা থাকে) সেদিন কাপড় দড়ির মতো পেঁচিয়ে সোয়ারীর চারধার রেলিংয়ের মত করা ছিল, যাতে কনে সোয়ারী থেকে লাফিয়ে পড়তে না পারে। কনিকে হাত পা বেঁধে সোয়ারীতে তুলে দিল। গ্রাম ছাড়িয়ে ফাঁকা মাঠ দিয়ে বেহারারা বেমালুম ছুটে চলেছে। সেদিন কনির চিৎকার আমাদের মনে খুব দাগ কেটেছিল। বিয়ে ব্যাপারটাকে খুব বিভীষিকাজনক বলে মনে হয়েছিল। আমার বয়স তখন নয় কি দশ। এরপর আর কোনদিন কনির সঙ্গে দেখা হয়নি।

    সুরেশ মামাদের বাড়ি ছিল গ্রামের শেষ প্রান্তে। তারপরেই ছিল মুসলমানপাড়া। লাইন করে ছিল মুসলমানদের মাটির বাড়ি, খড়ের ছাউনি। মাটির দেওয়ালগুলিতে সাদা রং-এর উপর বিভিন্ন রং-এর গাছ, লতাপাতা, ফুলের ছবি আঁকা। সারিবদ্ধ রংবেরং এর ছবি আঁকা ছোট ঘরগুলি দূর থেকে দেখতে ভারী সুন্দর লাগত। উঠোনগুলি সব লালমাটিতে নিকানো, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন।

    এই মুসলমানদের মধ্যে একটি পরিবার ছিল। তাদের দুই মেয়ে আর মা বাবা। নিষ্কর্মা বাবাটি অধিকাংশ সময়ই শুয়ে কাটাত। মা আর মেয়েরা লোকের বাড়ি কাজ করে সংসার চালাত। মেয়েদুটির সাথে আমাদের খুব ভাব ছিল। দিদির আর আমার সমবয়সী। বড়টির নাম ছিল চাঁদবানু, ছোটটির নাম ছিল সফরবানু। চাঁদ, বা চানবানুর গায়ের রঙ ছিল নিকষ কালো, কিন্তু অঙ্গ গঠনে অত্যন্ত সুন্দরী ছিল। বিয়ে হয়েছিল। কিন্তু অল্পদিন পর বিধবা হয়ে যায়। মা বাবা দ্বিতীয় বিয়ে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু চানবানু রাজি হয়নি। বলে বিয়ে একবারই হয়। চানবানুকে আমি এখনও ভুলিনি। মুখের দাঁত থেকে মাথার চুল হাত পা সবই নিখুঁত সুন্দর ছিল।

    সফরবানু ছিল আমারই বয়সি, রোজ আমাদের বাড়ি আসত। কুল, জলপাই, তেঁতুল কুড়িয়ে নিয়ে, খেলার সামগ্রী নিয়ে আসত। বাঁশের ডগার দিকটা কেটে রণপা তৈরি করতে পারত আর নিজেও রণপায় দ্রুত হাঁটতে পটু ছিল।

    চৈত্রমাসের শেষের দিকে গ্রামে আসত পিরালিরা। এই পিরালি কী এবং কাকে বলে স্পষ্ট করে কোনদিন বুঝতে পারিনি। বাংলাদেশ প্রচণ্ড ঝড়বাদলের দেশ। এই পিরালিদের কাজ ছিল বাড়ি বাড়ি ঘুরে মানুষের ঘর মন্ত্রঃপুত করে বেঁধে দেওয়া। বদলে সিধে নিয়ে যেত। আমাদের পাড়ায় যে পিরালি লোকটি আসত সে আমাদের পরিবারের বিশেষ পরিচিত ছিল। তার পরিবারের ছেলেমেয়েদের সাথে আমাদের খুব ভাব ছিল। পিরালি যেদিন পাড়ায় আসত সেদিন অদ্ভুত সাজে আসত। পরনে থাকত গেরুয়া রং-এর জামাকাপড়। কাঁধে থাকত একটি গেরুয়া ঝোলা আর হাতে একটি ত্রিশূল। সঙ্গে আনত একখানা মস্ত বড় বাঁশ যার ডগার উপরের অংশ নানারকম ফুলে সাজানো থাকত। ত্রিশুলের এক একটি খোঁচায় ঘরের চারকোনায় গর্ত করে, কৌটা থেকে সরষে বের করে গর্তে দিত আর মুখে অনবরত উচ্চৈঃস্বরে মন্ত্র আউড়িয়ে ঘরকে ঝড় তুফানের হাত থেকে সুরক্ষিত করত। পিরালীর পিছন পিছন ঘুরে মন্ত্রগুলি আমাদেরও মুখস্থ হয়ে গেছিল। তার কিছু এখনও মনে আছে। মন্ত্রের বয়ানগুলির সংক্ষিপ্তাকারে একটু নমুনা দিলামঃ

    “কালা মেঘ সাজল রে
    কালা অন্ধকার
    গোরা মেঘ সাজল রে
    গোরা অন্ধকার
    বরুণ মেঘ সাজল রে
    পরনে দিল বাও
    মহাদেবের আজ্ঞা হইল পুব ভায় যাও”
    ইত্যাদি ইত্যাদি। এর মধ্যে, নানা রকম অশ্লীল শব্দও ছিল। শুনে শুনে মুখস্থ হওয়া সেসব শব্দ অর্থ না বুঝেই বলতাম আর বড়দের কাছে বকুনি খেতাম। তারই কিছু অংশ ছিল
    “বাপ-ভাতারি, কুল-ভাতারি, শোন তোর আদ্যির বাণী
    তোর বাপের বড়ডা শীল তুফান কইরা দিস পানি”
    আমাদের গ্রামের পাড়াগুলির পূর্বদিকে ছিল একটি প্রকাণ্ড দিঘি। এই দিঘির জন্ম, বা আবিষ্কারের কথা রহস্যপূর্ণ। যদিও সবই বড়দের কাছে শোনা, তবে দিঘিকে আমরা চাক্ষুষ দেখেছি বা ব্যবহার করেছি। সংস্কারের অবহেলায় আমাদের সময় দিঘির জলের গভীরতা কমে এসেছিল। তবুও যেটুকু জল ছিল সেটুকুই কাছের দূরের বহু গ্রামের লোকের উপকারে লেগেছে। শুনেছি বহু বৎসর পূর্বে দিঘির উপরি অংশটায় নাকি মাটি এবং বড় ছোট বিভিন্ন গাছা আগাছার ঘন অরণ্য ছিল এবং বন্যজন্তুর বাস ছিল। কোন একদিন রাখাল ছেলেদের গরু ওই বনে ঢুকে যায়। গরু খুঁজতে গিয়ে রাখাল ছেলেরা আবিষ্কার করল একটি কুয়ো। তাতে রয়েছে স্বচ্ছ পরিষ্কার জল। দেখে রাখালদের মধ্যে ডাকাডাকি পড়ে যায়। ক্রমে এই খবর চারদিকে ছড়িয়ে পড়ায় কিছু উৎসাহী লোক জঙ্গল কেটে পরিষ্কার করে কুয়োয় যাবার রাস্তা তৈরি করেছিল। বৎসরের পর বৎসর জল নিতে নিতে এই কাঁচা কুয়ো ক্রমে একটি ছোট ডোবায় পরিণত হল। প্রয়োজনের তাগিদে চৈত্র বৈশাখের খরায় গ্রামবাসীরা ঘটির গলায় দড়ি বেঁধে ঐ কুয়ো থেকে জল আনতে শুরু করল। ক্রমে জঙ্গল পরিষ্কার হল। গ্রামবাসী মানুষদের সমাগমে বাঘ শিয়াল ইত্যাদি যত বন্যরা ছিল সব পালিয়ে গেল। এইভাবে দীর্ঘকাল চলার পর নতুন প্রজন্মের কিছু মানুষের নিশ্চিত ধারণা হল মাটির নীচে নিশ্চয় কিছু আছে। বিভিন্ন জায়গার ধ্বস দেখে সিদ্ধান্ত হল এই জায়গায় মাটি খুঁড়ে দেখা দরকার। সরকারের কাছে আবেদন গেল। উপযুক্ত পর্যবেক্ষণের পর সরকারী তত্ত্বাবধানে ও সহায়তায় তিনমাস কাল অবধি খনন সংস্কারের ফলে বের হল বিরাট এক দিঘি।

    এই পর্যন্ত আমাদের শোনা গল্প। এরপর আমরা যা দেখেছি তা লিখছি। বারো মাস তাতে থাকত অগাধ জল। এপার থেকে ওপারের সব মানুষ কিংবা জলপানে রত চতুষ্পদীদের খুব ছোট দেখাত। তবে আমরা দলবদ্ধ হয়ে স্নান করতে গিয়ে সাঁতরে এপার ওপার করেছি অনায়াসেই। মুষলধারে প্রচণ্ড বৃষ্টির পর সবাই ছুটে যেতাম ঐ দিঘির ধারে। বৃষ্টিতে দিঘির ধারের মাটি কেটে যাওয়ার ফলে বিভিন্ন রকম জিনিস বেরিয়ে আসত মাটির তলা থেকে। এককালে নাকি মূল্যবান ধাতুর জিনিসও পাওয়া যেত। মিলত সাংসারিক ব্যবহার্য তৈজস বা বিভিন্ন সোনা রূপার মুদ্রা। শুনেছি ঘটিবাটি যা পাওয়া যেত, তাদের গড়ন ছিল ভিন্নপ্রকৃতির। দিঘির জল খুব স্বচ্ছ আর মিষ্টি ছিল। গ্রামবাসীরা পানীয় হিসাবেও ব্যবহার করত।

    তখনকার দিনে হিন্দু মুসলমান একই ঘাট ব্যবহার করত না। কাজেই মুসলমানদের ব্যবহার্য ঘাট ছিল দিঘির পুবপারে। কিন্তু জলে নামলে পরে সফরবানু আমাদের সাথে সাঁতারে একাকার হয়ে যেত। পড়ন্ত রোদের বিকালে মুসলমান মেয়েরা তাদের নির্দিষ্ট ঘাট থেকে কালো রংয়ের পোড়ামাটির ঘড়ায় করে জল নিয়ে যেত। সারিবদ্ধ হয়ে ফাঁকা মাঠের ক্ষেতের আল দিয়ে পরনে নীল ডুরে শাড়ির আঁচলের ঘোমটায় মাথা ঢেকে, হাতে গিলটির চুড়ি, পায়ে মল বা খাড়ু পরে তারা জল নিতে আসত। পড়ন্ত রোদের আলোয় গয়নার ঝলকানি আর নীল ডুরে শাড়ি পরা ঘড়া কাঁখে সারিবদ্ধ ভাবে পথ চলা মেয়েদের দেখতে ভারি সুন্দর লাগত। কতো নিশ্চিন্ত সুখে পুরুষানুক্রমে জাতিধর্ম নির্বিশেষের সমঝোতা সম্প্রীতির বাসস্থান ছিল এই সোনার বাংলায়!

    ছোটবেলায় টক জাতীয় খাদ্য খাওয়ায় ওস্তাদ ছিলাম আমি। টক্ খেতে খেতে মুখের ঠোঁট অধিকাংশ সময় সাদা থাকত। কাঁচা তেঁতুল মাখা, কিংবা আনারসের গড়-এ ঢুকে না-পাকা আনারস মটমটিয়ে ভেঙে এনে খোসা ছাড়িয়ে নুন মেখে কলাপাতায় রৌদ্রে সেঁকে নরম করে খাওয়া--কোনকিছুই বাদ যেত না। নাম না জানা বন্য ফলও খেতাম। তবে সেক্ষেত্রে প্রথমে দলবদ্ধভাবে সবাই পরীক্ষামূলকভাবে একটু কামড়ে পরীক্ষা করা হত বিষফল কিনা। যদি বিষফল হয় তবে সবাই একসঙ্গে মরে যাব। কোন বন্ধুকে হারাতে হবে না।

    একদিন বনে একরকম ফল আবিষ্কার হল। দেখতে ছোট, কালো জামের মত আকৃতি। স্বাদ টক্ মিষ্টি। প্রথম বিষফল কিনা পরীক্ষা করে নিয়ে যখন দেখলাম সবাই বেঁচে আছি তখন এই নাম না জানা ফলের নামাকরণ করা হল ‘ছাগলের বড়ি' (খানিকটা ছাগলের নাদির আকারের মত বলে)।

    চৈত্রমাসে পাকা তেঁতুলের সময়, মায়েরা পাকা তেঁতুলের খোসা ছাড়াত। আমরা এই পুষ্ট তেঁতুলের লম্বা খোসায় একটু খানি চাল, নুন আর অল্প জল দিয়ে উনুনের নিভন্ত আংরায় চেপে বসিয়ে রেখে কিছুক্ষণ বাদে তুলে আনতাম, দেখতাম চালগুলি আধফোটা হয়ে আছে, জল শুকিয়ে গেছে। লাউ কিংবা কলাপাতায় করে সেগুলি নিয়ে চলে যেতাম ফাঁকা গাছতলায়। তেঁতুলের গরম খোসা থেকে কাঠির সাহায্যে আধফোটা টকটক চালই খেতাম দলবেঁধে। এই মজার ব্যাপারগুলো এখন মনে পড়লে আপন মনে নিজে একটু হেসে নিই।

    আমাদের বাড়ির সম্মুখদিকে পাড়া ছাড়িয়ে মাঠের এককোণে ছিল একটি প্রকাণ্ড তেঁতুলগাছ। তারই এক পাশে ছিল হরচরণ মাস্টারের পাঠশালা। এই পাঠশালাতেই ছোটবেলায় চালপোড়া কালির দোয়াত আর বাঁশের কঞ্চির কলম আর কলাপাতা নিয়ে স্কুলে যেতাম। প্রাথমিক হাতের লেখা হত কলাপাতায়। হরচরণ মাষ্টার মশাই ছিলেন জাতিতে যুগী। কিন্তু শিক্ষক হিসাবে খুবই অভিজ্ঞ ছিলেন। ওঁর হাতে তৈরি অনেক ছাত্র ওঁর কর্মরত অবস্থাতেই অনেকে উচ্চশিক্ষিত বা উচ্চপদে অধিষ্ঠিত হয়েছেন।

    হরচরণ মাষ্টার মাথায় ছিলেন খাটো। গায়ের রং মাঝারি। মাথার সম্মুখভাগে টাক। পিছনের অংশে অল্প পাকাচুলসহ একখানা মস্ত টিকি ছিল। পথচলার সাথে বাতাসে এই টিকি উড়তে থাকত। গলায় দুই সারি তুলসির মালা। পরনে থাকত চুলপেড়ে (চুলের মত সরু পাড়বিশিষ্ট) হাঁটু পর্যন্ত খাটো ধুতি। খালি পা, হাতে একখানা কঞ্চির বেত, সর্বক্ষণ থুতু ফেলার অভ্যাস হেতু পথচলার সময় ডাইনে বায়ে থু থু করতে করতে এসে স্কুলে ঢুকতেন। বেশভূষা বা আকৃতির সাথে, পড়ানোর পদ্ধতির সম্পূর্ণ তফাৎ ছিল। দূর থেকে টাক মাথায় পাকা চুল দেখেই আমরা সব তেঁতুলতলা থেকে ছুটে এসে ঢুকে যেতাম স্কুল ঘরে।

    হরচরণ মাস্টারের কাছে পোড়াচালের কালি আর কঞ্চির কলমে কলাপাতার লেখা শেষ করে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীতে ওঠার পর সরকারি সহায়তায় পাঠশালার উন্নতিকল্পে শিক্ষকের সংখ্যাবৃদ্ধি হেতু এলেন একজন সরকারপ্রেরিত মুসলমান শিক্ষক। সাত আট বছর বয়স তখন। অতএব বড় হয়ে গেছি। ব্যাস্ স্কুলে পড়া বন্ধ হল।

    তবে আমার মা বাড়িতে শিক্ষার ব্যবস্থা করলেন অন্যভাবে। রামায়ণ, মহাভারত এবং ওপরের ক্লাসে ওঠা ছেলেদের পুরানো বইগুলি এনে বাড়িতে লেখাপড়া করার ব্যবস্থা করেছিলেন। অবসর সময় আমাদের দিয়ে রামায়ণ, মহাভারত পাঠ করাতেন, একসঙ্গে ধর্মগ্রন্থ পাঠ আর স্কুলের সীমিত সময়ের শেখা ভাষা যেন ভুলতে না পারি তার জন্যই মায়ের এই চেষ্টা। রামায়ণের গল্প শুনতেন আমাদের মুখ থেকে। এতে আমাদের স্মৃতিশক্তির উন্নতি হত সন্দেহ নেই।

    বাংলাদেশে ঝড়ের দাপট ছিল বরাবরই খুব বেশি। চৈত্র-বৈশাখ মাসে কালবৈশাখীর ঝড়ের সময় ফাঁকা মাঠে দেখা যেত প্রচণ্ড হাওয়ার এক প্রকার আকাশগামী কুণ্ডলী। বড়দের কাছ থেকে শুনতাম একে বলে ‘মারণী বায়ু’ বা বায়ুকুণ্ডলী। এই বায়ুকুণ্ডলীর প্যাঁচে যদি কখনও কোন মানুষ পড়ত তাকে নাকি সোজা উঁচুতে তুলে আছড়ে ফেলে দিত। চতুর্দিক থেকে ছুটে আসা এলোমেলো ঝোড়ো হাওয়ার প্রচণ্ড দাপটে গাছের ভাঙা ডালপালা, পাতা, মাঠের শুকনো ধুলো নিয়ে এক বিরাট ঘূর্ণির সৃষ্টি হয়ে সোজা উপরের দিকে উঠে যেত। এই কুণ্ডলীর শক্তি বা আয়তন অনুযায়ী অনেক উঁচুতে উঠে, হাওয়ার বেগ কমার সঙ্গে সঙ্গে গাছের ডালপাতাসহ ধুলোর ঝড় আছড়ে পড়ত বাড়িঘরের ওপর, চারদিক ধুলোর মেঘে আঁধার হয়ে যেত।

    বাংলাদেশের ঘুর্ণিঝড়ের তাণ্ডব নিয়ে আমার বাবার কাছে শোনা একটা ঘটনা বলি। বাবার তখন মাঝবয়স। আমাদের বাড়ি থেকে চারক্রোশ দূরে একটি হাইস্কুলে সংস্কৃতের প্রধানশিক্ষক পদে নিযুক্ত ছিলেন আমার বাবা। দেশগাঁয়ে যানবাহনের কোন বাহুল্য ছিল না বলে পায়ে হাঁটার অভ্যাস ছিল। স্কুলে যাবার পথের ধারে এক জায়গায় ছিল একটি প্রকাণ্ড বটগাছ। পথশ্রান্ত মানুষ এই গাছতলায় খানিক বিশ্রাম নিত। এই গাছতলায় বিশ্রাম সেরে বাবাও সেদিন স্কুলে গেছেন। দুপুরের পর ঈশান এবং বায়ুকোণ জুড়ে আকাশে মিশমিশে কালো ঘন মেঘ জমল। কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রকাণ্ড মত্ত হাতীর মত সেই পুঞ্জীভূত কালো মেঘ প্রচণ্ড বেগে ধেয়ে এল। বাতাসের তীব্রতায় প্রকৃতিকে একেবারে তছনছ করে দিয়ে নেমে এল প্রচণ্ড শিলাবৃষ্টি।

    দেখতে দেখতে সন্ধে হয়ে রাত হল ঝড় বৃষ্টি থামল। আকাশ পরিষ্কার হয়ে চাঁদ উঠলে বাবা তখন বাড়িমুখো হাঁটতে শুরু করেছেন। পথ চলতে চলতে সেই বিশাল বটগাছের কাছাকাছি এসে দেখেন দীর্ঘকালের প্রকাণ্ড বুড়ো বট ঘুর্ণিঝড়ের প্যাঁচে পড়ে নিজের জায়গা হারিয়েছে। উপড়ে যাওয়া বটগাছের জায়গায় হয়ে গেছে একটা ডোবা আর সেই ডোবাতে বসে গলা সাধছে অনেক ব্যাঙ। তারস্বরে দলবদ্ধ ব্যাঙেদের গণসঙ্গীত শুনতে শুনতে বাবা এগোতে এগোতে দেখলেন সুদীর্ঘকাল জীবকুলের আশ্রয়দাতা, ছায়াদানকারী বুড়ো বটগাছটি বাস্তুহারা হয়ে দূরে ধানজমিতে ক্লান্ত বিপর্যস্ত দেহ নিয়ে কাৎ হয়ে পড়ে আছে।

    আকাশে ঝড়ের পূর্বাভাসে আমাদের খুব আনন্দ হত (কথায় বলে, না বুঝে বাবাজি পরম সুখী)। আমের সময় আম কিংবা অন্যান্য সময় সময়োপযোগী নানারকম তেঁতুল, কুল, বেল ইত্যাদি কুড়ানোর উৎসাহে এই আনন্দ। ঝড় উঠবে টের পেলেই খুড়িমার ঘরে ঢুকে যেতাম। কারণ রাতের বেলায় মায়ের কাছে থাকলে রাতের ঝড়ে ঝরে পড়া আম, তেঁতুল কুড়োতে যেতে দেবেন না।

    খুড়িমার ঘরে আমি আর আমার খুড়তুতো বোন কল্যাণী রাতে ঝড়ের সময় ওত পেতে বসে থাকতাম। বাঁশের বেড়ার ফাঁক দিয়ে চেয়ে দেখতাম, মাঠের কোণের সেই প্রকাণ্ড তেঁতুল গাছের দিকে ঝড়ের দাপটে তেঁতুল গাছে পাকা তেঁতুলগুলি একটার সাথে আরেকটির ধাক্কায় খটাখট্ আওয়াজ, শুনছি আর বিদ্যুত চমকে মুহূর্তের জন্য দেখে নিচ্ছি। কী উৎসাহ আর আনন্দ তখন! পরদিন ভোর না হতেই সোজা রাস্তায় দেরি হবে ভেবে, ক্ষেতের আল বেয়েই ছুটে যেতাম তেঁতুলতলায়। কাপড়ের কোঁচড় ভর্তি করে নিয়ে আসতাম কুড়নো সামগ্রী। এখন বসে বসে ভাবি সেইসব দিনগুলির কথা।

    গ্রাম ছাড়িয়ে, মাঠের ধান জমি পেরিয়ে ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের চওড়া সড়ক। এই সড়ক দিয়ে দূর পথের যাত্রীরা যাতায়াত করত। পালকি, সোয়ারী, গরুর গাড়ির ভিড় লেগে থাকত। সড়কের ধারে খানিক দূরে দূরে ছিল রেনট্রি, কড়ই, বট, তেঁতুল ইত্যাদি নানারকম বড়বড় গাছ।

    সাধারণত, সড়কের কাছাকাছি কোন বাড়ি থাকলে, পথশ্রান্ত পথিকের সুবিধার্থে সে বাড়ির মালিক পথিকদের জলপানের জন্য ইঁদারা বা কুয়ো তৈরি করে দিতেন। চারধারে চাতাল বাঁধিয়ে দিতেন। পাশে ছায়াযুক্ত গাছ বসিয়ে দিতেন। তবে অবশ্যই বাসগৃহ থেকে খানিক দূরে। আমাদের গ্রাম ছাড়িয়ে মাঠের মাঝখানটায় ছিল তেমনই একটি বাড়ি। বাড়ির মালিক ভোলানাথ সরকার বৃদ্ধ বয়সে দৃষ্টিহীন হয়ে গেছিলেন। এই সরকাররা অবস্থাপন্ন লোক। একমাত্র পুত্র অশ্বিনী সরকার আর পুত্রবধুকে নিয়ে বিপত্নীক ভোলানাথ সরকারের সংসার। অশ্বিনী সরকার আমার গোরাদার সমবয়সী। সেই সুবাদে উভয় পক্ষেরই যাতায়াত ছিল খুব।

    সরকারবাড়ি থেকে একটি রাস্তা গিয়ে পড়েছে ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের বড় সড়কে। তিনমহলা বাড়ির বহির্ভাগে ছিল বিরাট একটি ইঁদারা আর অনেকখানি জায়গা জুড়ে বাঁধানো চাতাল। চাতালকে ঘিরে গোল করে নানারকম গাছ লাগানো। দূরপাল্লার যাত্রীরা পথশ্রান্ত হয়ে এখানে এসে বিশ্রাম করত। ইঁদারার জলে তারা স্নান করে আহার সমাপ্ত করত। কখনও যদি পাড়া থেকে চোখে পড়ত দূরপাল্লার কোন যাত্রী বড় সড়ক থেকে পালকি নিয়ে সরকারবাড়ি ঢুকছে, অমনি আমরা ছোটরা চষা ক্ষেতের মাটির ঢেলার উপর দিয়েই ছুটে যেতাম পালকির যাত্রীদের দেখতে। সে মাটি প্রচণ্ড রোদের তাপে পুরো তামার রঙ হয়ে আংরার মত গরম হয়ে থাকত। আমাদের গ্রাহ্যও হত না।

    অতিথ পালকির বেহারারা পালকি নামিয়ে ইঁদারার জলে স্নান করত, তারপর খেতে বসত। চারজন বেহারা, মস্তবড় একটি কানাওয়ালা পেতলের থালায় ছাতু, নুন, কাঁচালঙ্কা নিয়ে গোল হয়ে থালার চারিদিকে বসত। সামান্য জল দিয়ে ছাতুগুলি মেখে ড্যালা পাকিয়ে কাঁচালঙ্কায় এক একবার কামড় দিত আর ছাতুর ড্যালা টপাটপ মুখে পুরত। আমরা দাঁড়িয়ে অবাক হয়ে দেখতাম। ইত্যবসরে বাড়ির মহিলারা, পালকির বাচ্চা এবং মহিলা যাত্রীদের নামিয়ে নিত বাড়ির ভিতর। প্রয়োজনীয় কাজ সেরে আবার এসে তারা পালকিতে চাপত। বেহারারাও পালকি নিয়ে গন্তব্যে পাড়ি দিত।

    এই সরকারদের তিনমহলা বাড়ির বহির্ভাগে ছিল বিরাট বড় এক ফুলের বাগান। ছোটবেলায় ফুল তোলার প্রচণ্ড নেশা ছিল। ভোররাতে কখন যে ফুল তুলতে বের হতাম তা কেউ টের পেত না। আমার মা নানারকম ভয় দেখাতেন। ভূতের গল্প শোনাতেন যাতে এত ভোরে ঘর থেকে বের না হই। ফলে পাড়ায় মেয়েদের সঙ্গে যুক্তি হত। যে আগে উঠবে সে অন্যদের সাঙ্কেতিক শব্দ করে ডাকবে। সঙ্গীরা মিলে মাঠের চষা ক্ষেত পেরিয়ে ছুটে যেতাম ফুল তুলতে। ভোরের শান্ত, স্নিগ্ধ নির্মল বাতাসে শ্বাস নিতে নিতে ছুটতাম। পূব আকাশে দেখা দিত উদীয়মান সূর্যের লাল আভা, আমরা গিয়ে ঢুকতাম সরকারদের বাগানে। কতরকমের যে ফুল গাছ ছিল সেখানে! প্রকৃতি যেন তার অকৃপণ হাত উজাড় করে সাজিয়ে দিয়েছিলেন বাগানের ফুলগাছগুলিকে।

    বাগানে ঢুকে আত্মহারা হয়ে যেতাম। এক জাতীয় ফুল ছিল তাকে বলত কানাইবাঁশি। দেখতে ধুতুরা ফুলের মত। খুব ছোট আকারের, ইষৎ বাঁকা দেহটি সাদা, মুখের অংশটা বেগুনী রং। আর ছিল বেলফুল। একা বেলফুলের গন্ধেই আমোদিত থাকত বাগানটি। ইচ্ছামত ফুল তুলে সাজি ভর্তি করে ফিরে আসতাম।

    বাগানের রক্ষী ছিল একজন বোবা মুসলমান লোক। রাতে ঘুমাত সরকারদের গোয়ালের এককোণে একটি উঁচু বাঁশের মাচায়। একদিন বাগানে ঢুকে কঞ্চির লগি দিয়ে উঁচু গাছের ডাল টেনে ফুল পাড়ছি, তখন কীভাবে যেন ঐ রক্ষীটি টের পেল। কথা বলতে পারত না সে। অবরুদ্ধ ক্রোধে মানুষটি আস্তে আস্তে গোয়াল থেকে বের হয়ে দাঁতে দাঁত ঘসে কড়কড় আওয়াজ তুলে তাড়া করেছিল। আমাদের দল মরিপড়ি করে চষা ক্ষেতের মাটির ঢেলার উপর দিয়ে দে ছুট। দৌড়ে যারা পটু তারা তো পালিয়ে পাড়ায় এসে পৌঁছাল। যারা পারেনি তারাও শেষমেস আছাড় খেতে খেতে বাড়ি এসে উঠল।

    আমাদের পাশের বাড়িতে জ্ঞাতি সম্পর্কের এক জ্যাঠাইমা ছিলেন। ওঁর ছোটবেলায় গুটিবসন্তে নাকের ক্ষতি হয়েছিল। নাকি সুরে কথা বলতেন। এই বাড়ির এলাকা ছাড়িয়ে জ্যেঠাইমাদের ছিল রকমারী ফুলের গাছ ভরা মস্ত এক ফুলের বাগান। বাগানের চারিদিকে গন্ধরাজের ঘন শক্তপোক্ত বেড়া ছিল। সে বেড়া তিন চার ফুট উঁচু, সমান করে ছাঁটা। যখন নির্দিষ্ট সময় গন্ধরাজ ফুটত আধ মাইল পর্যন্ত গন্ধে আমোদিত হয়ে যেত। দূর থেকে অদ্ভুত সুন্দর দেখাত।

    বাগানের পাশেই ছিল বিরাট বাঁশবন। এই বাঁশবনের তলা দিয়ে সরু রাস্তা, এই রাস্তা দিয়েই পূর্বকথিত সেই দিঘিতে যাতায়াত করতে হত। দিনের বেলাতেও সূর্যের আলো বাঁশতলায় পৌঁছাত কম। তবে সব সময় যাতায়াত ছিল বলে আমাদের বড় একটা ভয় হত না। একবারের কথা। শুক্লপক্ষের শেষ রাত। পশ্চিম আকাশে অস্তগামী চাঁদ। ভোর হয়ে আসছে। আমি বিছানায় শুয়ে দিদির কানে কানে বললাম, “দিদি চল যাই জ্যাঠাইমার বাগানে।”

    চুপি চুপি উঠে ফুলের সাজি নিয়ে আস্তে আস্তে দরজা খুলে বেরিয়ে পড়লাম। বাগানের সামনে দাঁড়িয়ে এত ফুল দেখে আর ফুলের গন্ধে অভিভূত হয়ে গেলাম। বাগানের ভিতর যতরকমের গাছ আছে তার প্রত্যেকটি গাছ ফুলে ফুলে বিভূষিত। বাগানের এককোণে শিউলি গাছটি মাটিতে সাদা সুগন্ধি ফুলের চাদর বিছিয়ে হাতছানি দিচ্ছে। প্রকৃতির উদার দানে পুষ্পিত গাছগুলি অফুরন্ত ফুলের সম্ভার নিয়ে যেন আসন্ন প্রভাতের প্রতীক্ষায় ধ্যানমগ্ন।

    বাইরে থেকেই দেখছিলাম, কারণ বাগানের দরজায় তালা লাগানো। কিন্তু লোকজন দেখে ফেলার আগেই ফুল তুলে পালাতে হবে। দিদি তখন এক বুদ্ধি বের করল। গন্ধরাজের বেড়া দুহাতে টেনে ফাঁক করে ধরল আর আমি ভেতরে ঢুকে সাজি ভর্তি ফুল নিয়ে বেরিয়ে এলাম।

    শিবমন্ত্রে দীক্ষিত ছিলেন আমার মা। প্রত্যহ সকালে মাটির শিব তৈরি করে পুজো করতেন। গাছ ঝেড়ে ফুল চুরির নালিশ জানাতে এলেন জ্যাঠাইমা। টের পেয়ে মায়ের ধ্যান আর ভঙ্গ হচ্ছে না। মা চোখ বুজে বসেই আছেন যতক্ষণ জ্যাঠাইমা দাঁড়িয়ে নাকিসুরে নালিশ জানাচ্ছেন।

    এই জ্যেঠাইমাদের ছিল একটি নিজস্ব নৌকো। গাঙের ঘাটে একটি গাছের সাথে শিকল দিয়ে চাবি দেওয়া থাকত। গাঙের ওপারে ছিল মুসলমান পাড়া। বাড়ির পিছনে ছিল মেয়েদের স্নান করার পুকুর। এই পুকুরের সংলগ্ন জমি পশ্চিমে ক্রমশ ঢালু হয়ে নেমে গেছে গাঙের ঘাটে। সরু পথ। এই পথের দুপাশেই ছিল পুরুষানুক্রমিকভাবে মৃতদেহ দাহ করানোর জায়গা--গ্রামের শ্মশান। আশপাশে ছিল ছোটবড় আগাছার ঘন ঝোপঝাড়। আমাদের একটি বহুদিনের পুরানো তালগাছ গাঙের ওপর ঝুঁকে ছিল। তালগাছ ঘিরে বিরাট এলাকা নিয়ে ছিল বেতবন। বেতফল খেতে খুব মিষ্টি। দেখতে প্রায় লিচুর মত তবে খুবই ছোট ছোট।

    নৌকোর চাবি চাকর শ্যামাচরণ লুকিয়ে রাখত গোয়ালে। একদিন হাটবারে, শ্যামাচরণ হাটে গিয়েছিল। এই সুযোগে আমরা সঙ্গীসাথিরা মিলে খুঁজে পেতে গোয়াল থেকে চাবি পেলাম। নৌকোর তালা খুলে খোলের ভেতর পাতা সরু বাঁশের ফালি দিয়ে সবাই মিলে নৌকো বাইতে শুরু করলাম।

    তখন ভরা বর্ষা, বৃষ্টির জলে সরু মরা গাঙ তখন খরস্রোতা নদীর মত। স্রোতের টানে নৌকা তরতর করে এগিয়ে চলল। নৌকো বেতবন ছাড়িয়ে চলে যাচ্ছে দেখে আমাদের ভয় হল। আমাদের দলে ঊষা নামে একটি কায়স্থ মেয়ে ছিল। সে ছিল খুবই বুদ্ধিমতী। ঊষা বুদ্ধি করে জলে আধডোবা বেতের ডগা টেনে ধরে নৌকাকে আটকালো। সকলে মিলে বেতের ডগা টেনে ধরে রেখে বাঁশের চটির বৈঠাকে লগির মত ব্যবহার করে গুণ টেনে পিছিয়ে আসতে লাগলাম ঘাটের দিকে। ভয় ডর বলে অবশ্য কারো কিছু নেই; সবাই সাঁতারে পটু। তাছাড়া গ্রামের এলাকা যতদূর পর্যন্ত ততদূর পর্যন্ত নদীর দুইধারে ছোট বড় গাছপালা, কোন কোন গাছ আবার নুয়ে নদীর জলে ডুবে আছে। নৌকো উল্টালে সেইসব গাছের ডাল ধরেই বাঁচতে পারতাম। কাজেই সে অবস্থাতেও কয়েকজন টেনে টেনে বেতফলের ছড়া ছিঁড়ে নিয়ে কোঁচড় ভর্তি করে ফেলেছি। এই করতে করতে নৌকা নিয়ে ফিরে এলাম ঘাটে।

    আমাদের ঘাটের পাড়ের এই তালগাছ কতদিন আগের তা কেউ জানত না। নদীর পাড় থেকে বেঁকে মাঝনদী পর্যন্ত গিয়ে গাছটি সোজা উপরে উঠে গেছে। একেকটি তাল হতো মস্ত বড়। একে বলা হতো মেছো তাল। তালের সেরা নাকি এই মেছো তাল। যেমন বড় তেমনই মিশমিশে কালো তার রং।

    বর্ষা আসার আগে চৈত্রের খরায় যখন নদীর জল কম থাকত তখন আমার জ্যেঠামশাই বাঁশঝাড় থেকে কঞ্চিসমেত আস্ত বাঁশ কেটে মাঝ নদী পর্যন্ত অনেকখানি এলাকা নিয়ে গোল করে বেড়া দিতেন। ফলে গাছ থেকে জলে পড়া পাকা তাল বর্ষায় ভরা নদীর স্রোতে ভেসে যেতে পারত না। বর্ষার রাতে ঝম্ ঝম্ আওয়াজে বিরামহীন মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। বিছানায় শুয়ে শুনছি তালগাছ থেকে প্রচণ্ড শব্দে তাল পড়ছে নদীর জলে। পরদিন বাঁশের লগি আর কলার ভেলা নিয়ে জ্যাঠামশাই যেতেন নদীতে, বাঁশের বেড়ায় আটকে থাকা তাল আনতে। আমরাও যেতাম সঙ্গে। গ্রামের জীবনটাই ছিল এমন আমোদপূর্ণ।

    মনে পড়ে বাংলা দেশের বারো মাসে তেরো পার্বণের কথা। একবার জামাইষষ্ঠী, বাবার হাতে পয়সার মন্দা চলছে। অতএব সেবার জামাইষষ্ঠীতে নতুন কাপড়চোপড় হবে শুধু বিবাহিতা মেয়ে আর জামাইদের। শুনে দিদির আর আমার খুব রাগ হল। রাগের ঠেলায় দুজনে সারাদিন এপাড়া ওপাড়া ঘুরে বেড়ালাম, সারাদিন কিছুই খেলাম না। বৌদিরা অনেক সাধাসাধি করল। কিছুই হল না।

    দিদি খিদেয় বেশি কাতর হয়ে পড়ত। সবার খাওয়াদাওয়া হয়ে যাবার পর, একফাঁকে রান্নাঘরের বেড়ার ফাঁক দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখল রান্নাঘরে আমাদের ভাত ঢাকা দেওয়া। তখন দিদি আর আমি এক ফন্দি আঁটলাম।

    তখনকার দিনে এঁটোর বিচার ছিল খুব বেশি। রান্না খাওয়ার পর গোবর জল দিয়ে প্রতিদিন রান্নাঘর নিকোনো হত। সেদিন খাওয়াদাওয়ার পর যখন সবাই দিবানিদ্রায় মগ্ন, তখন দিদি আর আমি বাঁশের দরজা ফাঁক করে ঘরে ঢুকে ঢাকা দেওয়া খাবার খেয়ে নিলাম। তারপর উঠোন থেকে শুকনো বালি কচুপাতায় করে এনে ছড়িয়ে দিয়ে তাতে ডানহাতের পাঁচ আঙুল একত্রিত করে কুকুরের পায়ের ছাপ আঁকলাম ঘরের মেঝেতে। দরজা থেকে খাওয়ার জায়গা পর্যন্ত এই চিহ্ন এঁকে রাখলাম। ঘরের বারান্দার মাটির মেঝেতে আমাদের দুই বোনের নাম লিখে তার নীচে লিখলাম, আমরা মরে গেছি।

    কুকুরের যে চারখানা পা আর পায়ের ছাপ যে সেভাবেই পড়বে সে বিষয়ে কিন্তু কোন খেয়াল ছিল না। অতএব সহজেই বৌদিদের কাছে ধরা পড়ে গেলাম। আঙুলের ছাপ আর বারান্দার মাটিতে লেখা নাম দেখে বাড়িতে হাসাহাসির ধুম। অগত্যা বাবা ষষ্ঠীতে আমাদেরও কাপড় কিনে দিলেন।

    আষাঢ় মাসের রথযাত্রা বা শ্রাবণের ঝুলন আমাদের বাসস্থানের কাছাকাছি বড় একটা হত না। তাই দেখার সৌভাগ্যও হয়নি। আমরা পঞ্জিকার রথের ছবি ছাড়া কিছুই দেখিনি। তবে এই রথের সাতদিন নানারকম ব্রত অনুষ্ঠান হয়েছে বাঙালির ঘরে ঘরে। কারণ বড়দের কাছে শুনতাম রথের ব্রত রথাইচণ্ডী পালন করলে যে পুণ্যসঞ্চয় হয় সেই পুণ্যের ফলে নাকি আমৃত্যু দৈহিক সচলতা বজায় থাকে।

    আষাঢ় যায় শ্রাবণ আসে। বাংলার ঘরে ঘরে আষাঢ়ের সংক্রান্তিতে বসত মনসার আসন। মনসার এই আসন স্থাপিত হওয়ার পর থেকেই শুরু হত প্রতিদিন পাড়ার কোন এক বাড়িতে ‘মনসামঙ্গল’ পাঠ। এই পাঠের আসরে পাড়ার সমস্ত গিন্নিরা দুপুরে আহারের পর এসে যোগ দিত।

    আমার মায়ের ছিল দ্বিজ বংশীদাস রচিত ‘পদ্মাপুরাণ’। সুন্দর সুরেলা গলায় মা যখন পাঠ করতেন আমরা মুগ্ধ হয়ে শুনতাম। শুনে শুনে পদ্মাপুরাণের ঘটনাবলী আমাদেরও মুখস্থ হয়ে গেছিল।

    শ্রাবণ মাসের শেষের দিকে শুরু হত মনসা পূজার প্রস্তুতি। দিনপনেরো আগে থেকে আরম্ভ হত সাচিঘট তৈরির কাজ। এই সাচিঘট আমরা (ছোটরা) নিজেরাই তৈরি করতাম। বাঁশের ডগার দিকের সরু অংশের আড়াই ইঞ্চি টুকরোর একদিকের গিঁট সমেত রাখা হত। আরেক দিক থাকত ফাঁকা। একে বলে বাঁশের চুঙ্গি। এঁটেল মাটিকে ভাল করে পিষে চুঙ্গির সারাগায়ে লাগিয়ে নাকমুখ এঁকে দুপাশে মাটি দিয়ে তৈরি দুটি সাপের ফণা লাগানো হত। চুঙ্গির মাথার ওপর থাকত সাপের ফণার ঢাকনা। রোদে শুকিয়ে নানাবিধ রং দিয়ে চুঙ্গির গায়ের নীচের দিকটা চিত্রিত করে তৈরি হত সাচিঘট। প্রত্যেকটি সন্তানের মাকেই মনসা ব্রত করতে হত। ব্রতীপিছু একটি করে সাচিঘট দিতে হত। জ্যেঠামশাই নিজে হাতে তৈরি করতেন মনসার মূর্তি। নিষ্ঠাসহকারে মায়েরা পূজার নানারকম উপচার তৈরি করতেন। দুধ শুকিয়ে ক্ষীরের নাড়ু, বরফি তৈরি করতেন, খই ভাজতেন, চিঁড়ে কুটতেন ঢেঁকিতে। মনসা পূজায় বলি হত পাঁঠা, আখ এবং চালকুমড়ো। পূজার দিন দুই তিন আগে হাট থেকে পাঁঠা কিনে আনা হত। এই পাঁঠা নিয়ে আমাদের কী হুল্লোড়! ওদিকে অচেনা জায়গায় এসে পাঁঠার আর ডাক বন্ধ হয় না। রাশিকৃত কাঁঠালপাতা খেয়েও তার ব্যাঁব্যাঁ চলছেই। শুধু আমাদের বাড়িতেই নয়, প্রায় প্রতি বাড়িতেই পাঠার ব্যাঁব্যাঁ ডাকে তখন রাতদিন সবাই অতিষ্ট হয়ে উঠতেন।

    পূজার দিন মাঝখানে দেবীমূর্তি বসিয়ে দুইপাশে লাইন করে বসানো হত সাচি ঘট। এই সাচি ঘটের চুঙ্গিতে পুরে দেওয়া হত চাল, মূর্তির সম্মুখে পদ্ম কিংবা শাপলাপাতা পেতে সাজিয়ে দেওয়া হত নানা ফল, তরকারি - যেমন আস্ত মিষ্টিকুমড়ো, চালকুমড়ো, শশা, তাল, লেবু, ফুটি, বাতাবিলেবু ইত্যাদি। মূর্তি সাজিয়ে দেওয়া হত নানারকমের ফুলের মালায়। নৈবেদ্য, আর নানা উপচারে ঘর ভর্তি হত। পাকা ফল আর নানারকম মিষ্টি, উপচারের গন্ধে ঘর ভুরভুর করত। বাইরে প্রচণ্ড বৃষ্টি। এত বৃষ্টি হচ্ছে যে কাছের কথা কাছেই শোনা যাচ্ছে না। উঠোনে কাঠগড়ায় পাঁঠা বলি হচ্ছে। তিনচারখানা কাঁসরের শব্দ, ঘন্টা আর শঙ্খধ্বনির সঙ্গে বৃষ্টির শব্দ মিলিয়ে বলির পাঁঠার আর্ত চীৎকার ঢাকা পড়ে যেত।

    পরদিন মূর্তি বিসর্জন দেওয়া হত নদীতে। কলাগাছের ভেলা তৈরি করে, সাচিঘটসহ মূর্তি নিয়ে নদীতে যেতেন জ্যাঠামশাই। আমরাও শঙ্খ বাজাতে বাজাতে চলতাম জ্যাঠামশাই-এর সাথে ভেলায়। কী মজার ব্যাপার, বাঁশের লগি ঠেলে মূর্তি সহ ভেলা নিয়ে যাওয়া হত মাঝ নদীতে। সারা গ্রামের সব বাড়ির পূজিত মূর্তি নিয়ে এইভাবে ভেলায় বা নৌকা করে নিয়ে গিয়ে মাঝ নদীতে বিসর্জন দেওয়া হত। সে বড় অপূর্ব দৃশ্য! এখনও চোখ বুজলে সেই দৃশ্য দেখতে পাই শ্রাবণ সংক্রান্তির দিনে।

    শ্রাবণের শেষ, ভাদ্রের আগমনে নদীতে জল যেন আর ধরে না। আশেপাশে যত নিচু এলাকা জলে পরিপূর্ণ হয়ে সমুদ্রের আকার ধারণ করেছে। বেত্রাবতী নদী আজ যেন তার নিজস্ব খেই হারিয়ে ফেলেছে। তার কালো স্রোত বর্ষায় গেরুয়া রূপ ধারণ করেছে। কোথা থেকে গাছ, ডালপালা, বিরাট বড় বড় কচুরিপানার চাঁই, স্রোতের টানে তরতর করে ভেসে চলেছে। তখনকার দিনে নদীপথে বড় বড় ব্যাপারীর নৌকা (সওদাগরী) বিভিন্ন জিনিস নিয়ে আসত সওদা করতে। সে নৌকা আকৃতিতে বিশাল। বিক্রি করার জিনিসের মধ্যে থাকত সাগরগঞ্জ আলু (রাঙা আলু), বিভিন্ন রকমের শুকনো মাছ, বিভিন্ন জায়গার বিখ্যাত মাটির হাঁড়ি কলসি।

    একসময় এই ব্যাপারীর নৌকা নিয়ে আসত ঘরবাড়ি তৈরির কাঠ। শাল, সেগুন, গরানের বিশাল বিশাল টুকরো একসঙ্গে বেঁধে শিকল দিয়ে নৌকার সাথে জুড়ে নদীর স্রোতে ভাসিয়ে নিয়ে আসা হত। তবে নদীপথে এই কাঠ বেচাকেনা আমরা দেখিনি। কারণ আমাদের সময় রেল যোগাযোগ ভালভাবেই স্থাপিত হয়ে গেছিল। সওদাগরী নৌকোর চলাচল দেখেছি বটে, কিন্তু তাতে কাঠ বাদে আর সবই আসত।

    আর একটি মজার খেলা ছিল নৌকোদৌড়। দেশে সে নৌকাদের বলা হত ‘দৌড়ের নাও’ (অর্থাৎ দৌড়ের নৌকো)। সে এক অদ্ভুত দৃশ্য। নৌকোর দু’ধারে ষোলজন করে বত্রিশজন মাল্লা দাঁড় বাইত। নাওয়ের কানায় জল ছুঁইছুঁই। মাঝখানে চারটি খুঁটির উপর একটি রঙবেরঙের নকশা করা চাঁদোয়া। চাঁদোয়ার নীচের দিকে ঝুলত নানারঙের কাগজের মালার ঝালর। চাঁদোয়ার দু’পাশে বসা বাজনদারেরা। মাঝখানে সাদা ধবধবে ফরাসের উপর গড়গড়ার নল মুখে নিয়ে তাকিয়া হেলান দিয়ে বাবু বসে আছেন। সম্মুখে সুসজ্জিতা নৃত্যরত বাইজি। পাড়া থেকে বাজনার শব্দ শুনে পড়িমরি করে সবাই ছুটে যেতাম নদীর ঘাটে। চোখের নিমেষে তীরবেগে ছুটে চলে যেত সেসব নৌকা। এক নজর দেখেই আমরা বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে যেতাম।

    আমাদের গ্রামের প্রতি বাড়ির সম্মুখ দিয়ে সর্বসাধারণের চলার জন্য সরু পথ চলত দিগন্তবিস্তৃত ধানজমির দিকে। সেই বিস্তৃত ধান জমির পর ছিল পূর্বকথিত সড়ক। সড়কের পূর্বদিকে ছিল চাঁদপুরী বিল। গল্প কথায় শুনেছি চাঁদ সওদাগর বাণিজ্যে যাওয়ার সময় তার নৌবহর নিয়ে নাকি এই চাঁদপুরী বিল পথেই স্রোতস্বিনী বেত্রাবতীতে ঢুকে ছিল। অবশ্য গল্পের গরু তো গাছেও চড়তে পারে! এই চাঁদপুরী বিলের মনোহর রূপে এককালে আমরা মুগ্ধ হতাম।

    আমাদের অঞ্চলে কৃষিজাত পণ্যের মধ্যে পাট ছিল উল্লেখযোগ্য। যে পাট জন্মাত আমাদের অঞ্চলে তাকে বলত শোনপুরি পাট। পাঁচ-ছ’হাতের অধিক (অনুমান) লম্বা হত একেকটি পাটের চারা। সেই অনুপাতে মোটা হত যথেষ্ট পরিমাণে। একেকটি গাছ থেকে মোটা একেক গোছা সাদা ধবধবে পাট বের হত।

    পাট কাটার পর নালা আর চাঁদপুরী বিলের জলে পাটের চারাগুলিকে দীর্ঘদিন ভিজিয়ে রেখে দিত। তারপর তুলে এনে কাঠি আর পাট আলাদা করে পাটকাঠি আঁটি বেঁধে মাঠের বিস্তীর্ণ এলাকায় রোদে দিত শুকানোর জন্য। আমরা তখন দলবল নিয়ে এই পাটকাঠির আঁটির নিচের ছড়ানো দিকে ঢুকে লুকোচুরি খেলতাম। কিন্তু এই সোনার ফসল পাট দিয়ে কী হচ্ছে বা সে’সব কোথায় যাচ্ছে সে বিষয়ে খোঁজ রাখার বয়স আমার তখনও হয়নি। কিন্তু দৃশ্যগুলি মনের পটে ধরা আছে।

    গ্রীষ্মের প্রচণ্ড তাপে চাঁদপুরীর বুকে ক্রোশের পর ক্রোশ এলাকা নিয়ে সৃষ্টি হত মরীচিকা। ভাদ্রের শেষে আশ্বিনের আগমন বার্তা পৌঁছোত ধরিত্রীর আকাশে বাতাসে। বর্ষার জলে পরিপূর্ণ চাঁদপুরী বিলের টলটলে পরিষ্কার জলে তখন আকাশের নীলিমা ধরা দিত। মেঘমুক্ত আকাশে পূর্বদিগন্তে শরতের কুয়াশাবৃত ক্ষীণ সবুজ রেখার গাছগাছালির মাথায় উপর দিয়ে প্রকাশিত হত পূর্ণিমার চাঁদ। ভরাযৌবনা চাঁদপুরী বিল দীর্ঘদেহী শোনপুরী পাটের আব্রুমুক্ত হয়ে আকাশের চাঁদের প্রতিবিম্বকে বক্ষে ধারণ করে শান্ত স্নিগ্ধ স্থির হয়ে আকন্ঠ চন্দ্রসুধা পানে নিমগ্ন রয়েছে মনে হত। বিলের জলের বুকে চাঁদের প্রতিবিম্ব দেখে মনে হত যেন “চাঁদ হেরিছে চাঁদমুখ তার সরসীর আরশিতে।”

    উত্তরের মৃদু হিমেল হাওয়ায় তরঙ্গিত জলে কম্পমান চাঁদের প্রতিবিম্ব এক অপূর্ব শোভার সৃষ্টি করত। মাঝে মাঝে দু একটি জেলে ডিঙিও দেখা যেত। চাঁদপুরী বিলের জলে রাতের আঁধারে মাছ ধরতে আসত যারা তাদের জাল ফেলার শব্দ আসত কানে। হেমন্তের শুরুতে চাঁদপুরী বিল তার অতুলনীয় রূপকে ঢেকে নিত কচিঘাস আর ঝোপঝাড়ের আস্তরণে। শুকনোর সময় চাঁদপুরীর জল সম্পূর্ণ শুকিয়ে ঘন ঝোপঝাড়ে ঢেকে যেত। ঘাসের লোভে বিলের বুকে চরে বেড়াত অসংখ্য গরুছাগল। সূর্যাস্তের পর বিলের বুকে শুরু হত আলেয়ার খেলা। এই আলেয়াকে দেখা যেত স্পিরিটের আগুনের মত। খানিকটা জায়গা জুড়ে জ্বলে উঠত এক নীলাভ আগুন। খানিক বাদে হুশ করে উপরের দিকে উঠে কেরোসিন লম্ফের মত হয়ে এদিক ওদিক ছুটে বেড়াত। মনে হত ভূতুড়ে আলো ঘুরে বেড়াচ্ছে শুকনো বিলের এখানে-ওখানে। আশ্চর্য ব্যাপার, কাছাকাছি মানুষের উপস্থিতি হলেই সেই আলো মিলিয়ে যেত। আমাদের ধারণা ছিল এসব ভূতের বাতি, এই ভূতের তো একবার কোজাগরির রাতে সশরীরে দর্শনই পেয়েছিলাম, সে কথায় পরে আসছি। এ প্রসঙ্গে লিখতে গিয়ে বহুদিন আগে শোনা এক গল্প মনে পড়ে গেল।

    রাতের বেলায় গ্রামের সব বাড়ি থেকেই দেখা যেত দূরে সড়কপথে আলো হাতে পথিকের চলা। দক্ষিণ থেকে উত্তর দিকে হ্যারিকেনের মতো আলো হাতে ঝুলিয়ে জনাকয়েক লোক প্রতিদিন একই সময়ে হেঁটে যেত তাদের গন্তব্যে। কারা এরা? আমার বাবার তখন যুবক বয়স। বাবার সমবয়সী কিছু যুবক একত্রিত হয়ে স্থির করল যে এই আলোর রহস্য উদ্ধার করবে তারা। দেখবে কারাই বা প্রতিদিন বেশি রাতে হ্যারিকেন হাতে নির্দিষ্ট সময়ে দলবদ্ধ ভাবে হেঁটে যায়। কাজেই, একদিন সারা গ্রামের সমবয়সীরা সব একত্রিত হয়ে গভীর রাতে রওনা দিল সেই আলোর সারির দিকে। রাত তখন দুটো হবে। তারা আলোর পিছনে ধাওয়া করল। এত লোকের দল যতই আলোর দিকে এগোচ্ছিল আলোও ততই সড়ক ছেড়ে পূর্বদিকে বিলের ভেতরে পিছিয়ে যাচ্ছিল। এই দেখে অভিভাবকদের ডাকাডাকিতে সবাই ফিরে এল। সকলে ভেবে নিল এও এক চলমান আলেয়া।

    তবে যতদিন ওদেশে ছিলাম ততদিনই দেখে এসেছি একইভাবে নির্দিষ্ট সময়ে এই আলেয়ার যাতায়াত, আমরা খুব ছোটবেলায় একে বলতাম ‘ভূতের বাতি’।

    নদীর ধারে যেখানটায় বহুকাল থেকে মৃতদেহ দাহ করা হত সেই সব জায়গায় কোন কোন সময় সূর্যাস্তের আলো-আঁধারি বেলায় আলেয়া দেখা যেত। ফলে, দিনে সেখানে নির্ভয়ে ঘুরে বেড়ালেও রাতে সেখানে যেতাম না। ছোটবেলায় দৃঢ় বিশ্বাস ছিল ভূতেরাই সন্ধের পর এই ভাবে আলো জ্বেলে ঘুরে বেড়ায়। কখনও নিভছে, কখনও জ্বলছে, কখনও ছুটে চলেছে এদিক থেকে ওদিকে। আবার কোন কোন সময় দেখা যেত পাশাপাশি দুটো আলো একটা আরেকটাকে বারবার এদিকে আর ওদিকে ডিঙোচ্ছে। দূর থেকে দেখে মনে হত যেন বাচ্চাছেলে দু’হাতে দুটি কাঠিতে আগুন ধরিয়ে নিয়ে এদিক ওদিক বার বার দেওয়া নেওয়া করে খেলা করছে।

    আশ্বিন মাসে, বিশ্বকর্মা পুজোর পর থেকে দুর্গাপ্রতিমা তৈরির কাজ পুরোদমে চলত। ‘খট্টারম্ভ’ বা ‘কাঠামো পুজো’ আরো আগেই হয়ে যেত। মূর্তির কাঠামোর গায়ে খড় বাঁধা থেকে আরম্ভ করে, সাত বার মাটির প্রলেপ দান, রং করা ও প্রতিমার চক্ষুদান পর্যন্ত সব ঘটনারই সাক্ষী থাকতাম আমরা। তখনকার দিনে পুজোয় জামাকাপড়ের এত ঢালাও দেওয়া নেওয়ার বা প্রতি ঘরে প্রত্যেকেরই কাপড়-চোপড়ের এত বাহুল্য ছিল না। তবে সামর্থ্য অনুযায়ী কোন কোন ক্ষেত্রে হয়েছেও বৈকি। যাদের জামাকাপড় কিছুই হত না, তাদেরও আনন্দ উৎসাহের ঘাটতি ছিল না কো্নো।

    পূজার সাতদিন আগে মহালয়া। ছোটবেলায় মহালয়ার তাৎপর্য আমাদের জানা ছিল না। তাছাড়া বর্তমান সময়ের মত এত রেডিও, টেলিভিশান বা মাইকে প্রচারের কোন ব্যবস্থা ছিল না (এসবের নামই জানা ছিল না)। আমার মনে পড়ে মহালয়া দেখতে কেমন জিজ্ঞেস করেছিলাম দিদিকে। দিদি তখন আমাকে বানিয়ে বানিয়ে মহালয়ার রূপ বর্ণনা করে শুনিয়েছিল। বড় বড় চোখ করে শুনেছিলাম দিদির বর্ণনা।

    মহালয়ার অমাবস্যার পর শুক্লাপ্রতিপদ। কারো কারো আবার প্রতিপদকল্পে ঘটস্থাপন হত। প্রতিপদ থেকে ষষ্ঠী পর্যন্ত চলত চণ্ডীপাঠ। তারপর নিয়মানুসারে পূজা হত তিনদিন। আমাদের গ্রাম থেকে আটক্রোশ দূরে ছিল রাজবাড়ি। তখন বড়সড় জমিদারদের কোন কোন স্থানের রাজা বলে অভিহিত করা হত। এই রাজবাড়িতে হত প্রতিপদ কল্পে পূজা। দ্বাদশ পণ্ডিত প্রতিপদ থেকে ষষ্ঠী পর্যন্ত করত চণ্ডীপাঠ। ষষ্ঠীতে পূজা হত বেলতলায়। যে বাড়িতে পূজা হত সে বাড়িতে পূজামণ্ডপের সংলগ্ন বেলগাছের তলা ঘিরে বাঁধান চাতাল থাকত। বোধনের দিন হত প্রতিমার চক্ষুদান এবং এই চক্ষুদানের পর প্রতিমার মুখ কাগজের ঠোঙা দিয়ে ঢাকা দিয়ে রাখা হত। সপ্তমীর সকালে হত নবপত্রিকার স্নান ও স্থাপন, প্রতিমার মুখের ঢাকা উন্মোচন ইত্যাদি নানা নিয়ম অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে শুরু হত দুর্গোৎসব।

    পূজামণ্ডপের সম্মুখভাগে মস্ত বড় আঙিনা জুড়ে তৈরি হত রচনা। সারা আঙিনা জুড়ে বড় বড় বাঁশ পুঁতে, এই বাঁশের উপরি অংশে চৌকো করে চারদিকে ঘিরে বাঁশের কাঠামো করে তার মধ্যে ঝুলিয়ে দেওয়া হত নানারকম শস্য সম্ভার যেমন--কলার কাঁদি, নারিকেল, মানকচু, ধানের ছড়া, সুপারির কাঁদি ইত্যাদি। সপ্তমীর ঊষালগ্নে নানারকম বাদ্যসহকারে যেমন কাঁসর, ঘন্টা, শাঁখ, জয়ঢাকের তুমুল বাদ্যে প্রতিমাকে জাগানো হত। প্রাণপ্রতিষ্ঠা করা হত। পুজোর এই তিনদিনই সকাল বেলায় হত বাল্যভোগ। মেয়ে মায়ের কাছে এসেছে অতএব মা তার আদরের মেয়েকে সকালবেলায় একবার নানারকম আনাজ সেদ্ধ দিয়ে, ভাত ঘি তেল কাঁচা লঙ্কা সহ সাজিয়ে দিত বাল্যভোগ।

    বাল্যভোগের পর শুরু হত নিয়মানুসারে পূজানুষ্ঠান। নানাবিধ ভোগ, নৈবেদ্য, উপচার, ধূপধুনার গন্ধ, সমবেত মহিলাকন্ঠে গীত, পুরোহিতের মন্ত্রোচ্চারণ, চণ্ডীপাঠ, সব মিলিয়ে, এক স্বর্গীয় আনন্দের অনুভূতিতে ভরে যেত মানুষের মন। পরিবেশ হয়ে উঠত আনন্দমুখর। দুর্গাপূজায় প্রত্যহ বলি হত একাধিক পাঁঠা। সেই সাথে বলি হত আখ, চালকুমড়ো। কোন কোন সময় পাঁঠা বলির সংখ্যা এত বেড়ে যেত যে নালা কেটে রক্ত বের করতে হত। হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে সারি দিয়ে দাঁড়িয়ে দেখত বলির দৃশ্য। এখন সে দৃশ্য মনে পড়লে, বিভীষিকা মনে হয়। কোন কোন সময় হত মোষ বলি (যদি কারো মানত থাকত)। এই মোষ বলি এক বীভৎস দৃশ্য। এতবড় একটা জানোয়ারকে এক কোপে বলি দিত। মোষ বলির কাঠগড়া (হাড়িকাঠ) ছিল অন্যরকম। আকারে মস্ত বড়। বিরাট, ভারী একটি খাঁড়া। এই খাঁড়ার দুই পিঠে দুইটি বড় বড় চোখ খোদাই করা থাকত। আমরা এই চোখ দেখলে খুব ভয় পেতাম। পূজার দ্বিতীয় দিনে, অর্থাৎ অষ্টমী পূজায় বলির সংখ্যা থাকত সব থেকে বেশি। বহুসংখ্যক পাঁঠাকে গলায় দড়ি বেঁধে পুকুর থেকে স্নান করিয়ে এনে সারিবদ্ধভাবে রচনার বাঁশের সাথে ফুল বেলপাতার মালা পরিয়ে কপালে সিঁদুরের টিপ পরিয়ে বাঁধা থাকত। এদের কী করুণ কান্না তখন!

    মোষবলির সময় পাঁঠাদের মত একই পদ্ধতিতে মালা সিঁদুর পরিয়ে বেঁধে রাখা মোষকে এনে, চারটে পায়ে মোটা কাছি দড়ি লাগিয়ে পিছন দিক থেকে জনা তিরিশ লোকে টেনে ধরে রাখত। সামনের দিকে নাকদড়ি লাগিয়ে দুই দিকে টান রেখে কাঠগড়ায় ফেলে গলাটা আটকিয়ে দিয়ে, ঘাড়ে লম্বা একটি বাঁশের লাঠি দিয়ে ঘি আর হলুদ একত্রিত করে খুব জোরে অনবরত পিষে চামড়াকে শিথিল করা হতো। তারপর শঙ্খ-ঘন্টা-কাঁসর বাদ্যসহ তুমুল জয়ধ্বনি সহকারে এককোপে বলি হয়ে যেত বিরাট শক্তিশালী প্রাণীটি। সে যে কী বীভৎস দৃশ্য! বিরাট বড় একটি মুণ্ডহীন দেহ মাটিতে পড়ে খানিক পা ছোঁড়াছুঁড়ির পর ক্রমশ আপনিই নিস্তেজ হয়ে যেত। চতুর্দিকে রক্তে একাকার। বাড়ির কর্তা কলার খোলে করে কিছু রক্ত তুলে নিয়ে গিয়ে পুকুরের জলে বিসর্জন দিত। তাতে বুঝি অশুভ শক্তির বিনাশ হল। বহুকাল থেকে পুরুষানুক্রমিকভাবে এই ধারা বা নিয়ম চলে আসছিল।

    দুর্গাপুজো, কালীপুজো বা যেকোন পুজোতেই, পুজোর পর সমবেত কন্ঠে গীত গাওয়া হত। ভিন্ন ভিন্ন পুজোয় সেই পুজোর বিষয় নিয়ে। দুর্গা কিংবা কালীপূজায় গাওয়া হত মালসী। প্রাচীনদের মধ্যে ‘মিনা’দের গানের গলা ছিল। তাঁরা নিমন্ত্রিত হয়ে আসতেন পূজাবাড়ি, জনা পাঁচ ছয় মহিলা একত্রিত হয়ে বসে গাইতেন দেবতাদের লীলা বিষয়ক সব গীত। একেকজনের সুর এত সুন্দর আর এত শ্রুতিমধুর ছিল যে যেকোন মানুষ তা মোহিত হয়ে শুনত। আমার মা আর জ্যেঠাইমাও চমৎকার মালসী গাইতেন।

    গীতের বিষয়ের দু একটি নমুনা দিই-

    ষষ্ঠীর দিনের গান

    শঙ্করী মা তোর স্বর্ণপুরী
    ত্যাজি কেন বিল্বমূলে
    শঙ্করী...
    আমার মা এখন আসিবে
    মা বলে ডাকিবে
    মা বলে তোষিবে
    বসিবে কোলে
    এখন বিল্বমূল ছেড়ে উমা গো
    বস শিবের বাসে
    না হয় বস দাশরথীর হৃদয় কমলে শঙ্করী...
    সপ্তমী দিনের গান-
    শারদ সপ্তমী ঊষা গগনেতে প্রকাশিল
    দশদিক আলো করি
    দশভূজা মা আসিল
    সিংহ পৃষ্ঠে ভবরানি
    গুহ গজানন বাণী
    সঙ্গে নিয়ে নারায়ণী
    আমার দশভুজা মা আসিল
    শারদ সপ্তমী ঊষা...
    অষ্টমীর দিনের গান
    বসিলেন মা হেমবরণী হেরম্বকে নিয়ে কোলে
    বসিলেন মা...
    কোলে ব্রহ্ম
    হেরিয়া জনম সফল মানি
    বসিলেন মা...
    নবমীর শেষ দশমীর ঊষালগ্নে গিরিরানির আবেদনঃ
    গিরিরাজ তুমি দেখ রে আসি
    মলিন হয়েছে শশী
    মায়ের ঐ চন্দ্রবদন হয়েছে মলিন
    মা ভয়েতে হতেছে কাতর
    মলিন হয়েছে শশী...
    সপ্তমী অষ্টমী তিথি, নবমী গেল বইয়া গো...
    কাল দশমী পাইয়া আকুল হইয়া
    কান্‌ছে কত গিরিরানি
    উমা কোলে লইয়া

    ছোটবেলার কথায় ফিরে আসি। একবার করেছিলাম এক কাণ্ড, শুধু আমি নয়, আমরা অনেকে মিলে। তখন শরৎকাল। গাছে গাছে শিউলির মহাসমারোহ। সাজিতে আর শিউলি ধরে না। একদিন সব মেয়েরা মিলে নারকেল পাতার নরম কাঠিতে জড়িয়ে শিউলির মালা গেঁথে গলায় হাতে তো পরলামই, তারপর কানের ফুটোয় সুতো দিয়ে গাঁথা মালার দুল পরলাম।

    ঘন্টাকয়েক কানে ফুলের দুল ঝুলিয়ে ঘোরাঘুরি করলাম, এই ঘোরাঘুরির ঠেলায় ফুল ছিঁড়ে উধাও, কানে সুতো ঝুলছে। অন্যরা যারা পরেছিল তাদের তো কানের সুতো খোলা গেল, আমার কানে সুতোর গিট শক্ত হয়ে বসে গেল। কিছুতেই খোলা গেল না। কদিন যেতে কান পেকে লাল। সচরাচর কারো কাছে যাই না পাছে কানে হাত দেয়। শেষমেশ দিদি গিয়ে মেজদাকে সব বলল। মেজদা ভুলিয়ে কাছে ডেকে বলল, “আয় তোকে মিনে করা হাঁসদুল এনে দেব।”

    লোভে পড়ে কাছে আসতেই দু’তিন জন মিলে চেপে ধরে কানের সুতো কেটে দিল। পরে অবশ্য বড়দিনের ছুটিতে মেজদা ঝোলা হাঁসদুল এনে দিয়েছিল।

    (ক্রমশ)



    অলংকরণ (Artwork) : অলংকরণঃ সঞ্চারী মুখার্জী অলংকরণঃ রাহুল মজুমদার
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments