• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৬৪ | সেপ্টেম্বর ২০১৬ | রম্যরচনা
    Share
  • শরতের রূপকথা : অনিন্দিতা চক্রবর্তী


    কালবেলা ঘুম ভাঙলেই শরতের আকাশ, রোদের আলোর স্পেশাল ইফেক্ট, হঠাৎ ভেসে আসা কোন গন্ধ পুজোর কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে রোজ। সেই যে সকালগুলো, যখন শারদীয়ার নানান লেখা পড়ার জন্য উপোস করে বসে থাকা। এখন সেটা উল্টে, গুগলে কবে পাব পিডিএফ! ছোটবেলার আনন্দমেলা, কাকাবাবু, চাচাচৌধুরী, শীর্ষেন্দু, দুলেন্দ্র, আরেকটু এগোলে টিনটিন, মিতিনমাসি। গোগ্রাসে গিলে ফেলা একেকটা বই, নাম ভুলে যাওয়া আরো হাজারো কাহিনির স্রোতে ঘনিয়ে আসত আমাদের পুজোর দিন। বইয়ের গল্প, ঘরের গল্প, খাওয়ার গল্প, পাড়ার গল্প এমন অসংখ্য প্লটে ভরপুর হয়ে আছে আমাদের অনেকের জীবনের কিছু হারিয়ে যাওয়া দিন বা সময়। আমার তো মনে হয়, সব মানুষের জীবনেই একেকটা ইউনিক পুজোর গল্প আছে। তার জন্য প্রবন্ধের সীমানা যদিও ছোট, তবু কিছুটা হলেও সেই ছোঁয়াচটুকু পাওয়া যেতেই পারে। আমাদের মত মনোজীবীরা ওটুকু নিয়েই বেশ সন্তুষ্ট থাকি। ঘুরেফিরে আমাদের দেশে সময় আসন্ন দুর্গাপূজার। প্রতিমার “কাঠাম” অথবা কাঠামো বানিয়ে ফেলে, মূর্তি থেকে দেবতায় পৌঁছে দেবার চলছে জোর ব্যবস্থাপনা। এই প্রস্তুতি কলকাতার মত আর অন্য কোথাও এতটা মনপ্রাণ থেকে, বাণিজ্যিক স্টেটাস বা শৈল্পিক ঐতিহ্যের বঙ্কিম ভাবনায় হয়ত দেখা যাবেনা। সময় বড়ই খারাপ চলছে দেবতাদের। সারা পৃথিবী জুড়েই ধর্ম এখন সর্বংসহা। অসুরেরা প্রযুক্তিনির্ভর নানা পদ্ধতিতে পৃথিবীকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য মুখিয়ে আছে। তবুও এসেছে পুজো। এ পুজো দেবতা না মানুষের, সম্প্রীতির নাকি স্টেটাসের, সর্বোপরি শ্রদ্ধার নাকি অভ্যেসের, কে বলতে পারে!! আজকাল অনুভূতিরা বড়ই শ্লথ হয়ে পড়ছে বোধের শেকড়ে। কত বছর কেটে যাচ্ছে পুজোর সকাল না দেখে। তবু কিছু কিছু সময় আমাদের জীবনে নেশার মত, যতই দূরে যাও না কেন, সে ঘোর কাটতে চায়না সহজে। কোনো কোনো সকালে আকাশ দেখেই সেই নেশা জাগে। আমাদের দেশে যখন শরৎ, সাত সমুদ্র তের নদীর পারে তখন ফল কালারের মরশুম। অনেকটা “আজি নূতন রতনে, ভূষণে যতনে, প্রকৃতি সতীরে সাজিয়ে দাও”... কাকতালীয়ভাবে আমাদের পুজোর প্রকৃতি আর বিদেশের ভূমিতে রঙ বদলের পালা কেমন মিলেমিশে যায়। এখানে রোদের আলো, হঠাৎ ভেসে আসা কোন গন্ধ আমাদের দেশের কোনো খেয়ালি দুপুরকে মনে করিয়ে দেয়। পুজোর পরেই দীপাবলী, অন্ধকার ঘুচিয়ে আলোর বন্দনায় আমরা প্রদীপ জ্বালাই, সেই আলোকে ধরে রাখতে চাই বছরভর। এখানে সেই অনুষঙ্গে খুঁজে পাই হ্যালোয়েন উৎসবকে। ভয় হয়ে যেখানে মানুষ ভয়কে জয় করে, যত ইভিল, প্রেত, রাক্ষস খোক্কস হতে পারে, শিশু বৃদ্ধ সবাই তা সাজে। আর এভাবেই তারা জীবন থেকে অশুভ বার্তাকে মুছে ফেলে। প্রদীপের জায়গায় তারা ব্যবহার করে কুমড়ো বা পামকিন, পামকিন এদেশে তাই হোলি ভেজিটেবল বা জনপ্রিয় খাবার জিনিস। সস থেকে পারফিউম সবেতেই এর বহুল ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। সুতরাং এমন মিল চলতেই থাকে, উৎসব আর প্রকৃতিতে। দুর্গাপুজোকে কেন্দ্র করে বাঙালির যে উদ্ভাস, স্বদেশের বাইরেও বিদেশে তাকে ভিন্ন ঘরানায় ও মেজাজে খুঁজে নেওয়াটা নেহাৎ কম পাওয়া নয়। ফল টাইম শুরু হতে চলেছে, সেপ্টেম্বর থেকে প্রকৃতিতে সেই রঙের মোহনা। পুজো পুজো গন্ধ, স্মৃতির নেশা পেয়ে বসেছে আমাকে। বন্ধুরা ফোন করে সে নেশার পারদ চড়ায়, “পুজোর উইকেন্ডটা কি করছিস... টিকিট কেটে ফেললি?”... “প্যাকেজ কত বলছে, এবারের শিল্পী কারা? ব্যান্ডের কেউ থাকছে কি, ইত্যাদি ইত্যাদি?” নেশার ঘোর কাটে কি কাটেনা কিন্তু ছন্দ কেটে যায়। শরৎকে অনলাইন অনুভব করার প্রক্রিয়ায় নিয়ম করে সামিল হয়ে যাই। একা নই, প্রবাসের আমরা সবাই। আমেরিকাতে ভারতীয় চ্যানেল খুললেই সেখানে কোন শিল্পী কোথায় কবে গান গাইবে তা দেখে পুজোর প্ল্যান করা যায়। এটাই নিয়ম, এটাই সংস্কৃতি। বছরে একবার এমন কিছু না হলে প্রবাসী বাঙালিদের বাঙালিয়ানা দেখাবার সুযোগটাই চলে যেত! আমাদেরও বাসিমুখে বাজার করে কাটাতে হত পুজোর দিনগুলোতে। এখানে বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানে নিয়ম মেনে পুজো হয়। তার বাইরে বেশিরভাগটাই এন্টারটেনমেন্ট। দামী শাড়ি চুড়ি, ব্র্যান্ডেড গহনা, রত্নখচিত ঝলমলে মানুষ, সেলফি, সব মিলিয়ে বেশ একটা মাখো মাখো ভাব দেখতে পাওয়া যায়! এদেশে বিভিন্ন দেশি সংগঠনগুলো পুজোর আমোদকে জিইয়ে রেখেছে বহু বছর ধরে। ফি বছরে তাতে নতুন কিছু যোগ হচ্ছে। সরাসরি প্রতিমার পাশে বা মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তুলে ফেলা যাচ্ছে সেলফি। আমার অনেক পরিচিত বন্ধু আছে যারা শুধু ছবি তুলে একটা মারকাটারি পোস্ট দেবার জন্য সেইসব সংগঠনগুলোর অনলাইন বুকিং খাতায় নাম লেখায়। বিভিন্ন জুয়েলারী দোকানের বিজ্ঞাপনের মডেলের মত ঘরে থাকা সমস্ত গয়না পরে বেরিয়ে পড়ে। সাংবৎসরিক একবার এগুলো ঝালিয়ে নেওয়া প্রয়োজন। একদিক থেকে ভাবতে ভালই লাগে। প্রবাসের পুজো তো এমনি হওয়া উচিত। সময় কোথায় মানুষের! এত কিছুর পরেও উইকএন্ড-এর দুদিনে চার দিনের পুজোকে “ফিক্স” করা, নেহাত কম সাফল্যের নয়। বিভিন্ন স্টেট-এ পুজোর ভিন্ন ভিন্ন সংস্থা তাদের পুজোর দিনগুলোকে ভাগ করে নেয়। আমার নেশার পুঁজি এটুকুই যে আমেরিকাতে প্রচুর পুজো হয়।

    কলকাতা শহরে একযুগের বেশি সময় কাটিয়ে দেবার পরও কোথাও কিছু একটার থেকে যাওয়াকে মিস করেছি। মহালয়ার পর থেকে ক্লাসে মন বসেনা, সেমেস্টারের ভয় কাটিয়ে ম্যাচিং কানের দুলের নেশা তখন উচ্চগ্রামে। পুজো শুরু হওয়ার দশদিন আগে থেকেই গড়িয়াহাটের ক্রসিংগুলোতে উপচে পড়া ভীড়, মলগুলোতে আড্ডা, ফুচকার দোকানে শপিং ফেরত মানুষের লাইন এগুলো না থাকলে আর পুজো কি? বিশেষ বিশেষ রাস্তায় বাঁশের বাঁধন। মানুষের চাঁদোয়া সকাল থেকে রাত, কলকাতার উত্তর থেকে দক্ষিণের রাস্তায়। বিশাল হোর্ডিং-এ দেবতার স্পন্সারদের রমরমা, বিজ্ঞাপনে তলিয়ে যায় যেন গোটা শহর। এ বলে আমায় দেখ, ও বলে আমায়! মানুষ প্যান্ডেল দেখে, শিল্প দেখে, এওয়ার্ড দেখে ঠাকুর দেখার লিস্ট বানায়। এলাকা কাঁপানো প্রতিমার শৈল্পিক সিনোপসিস দেখতে পঞ্চমী থেকে ভীড় শুরু হয়ে যায় সর্বত্র। অপূর্ব সেইসব প্রতিমা, সম্মোহনীতে ভরা দেবীমাতার মায়াময় রূপ। দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে শেষে এক ঝলক হলেও অদ্ভুত এক পরিতৃপ্তি। ম্যাডক্স কিংবা মুদিয়ালিতে পুরনো বন্ধুদের সাথে দেখা, সারারাত এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত ঘুরে ভোর রাতে ঘরে ফেরা, আবার বেড়িয়ে পড়া। অবিশ্রান্ত এমন এক পুজো আমার জীবনে একবারই এসেছে। সেইসব বন্ধু, নির্ভরতা, এক আকাশ স্বাধীনতা, কিছু বিশেষ মানুষের সান্নিধ্য পুজোর দিনগুলোকে উষ্ণ করেছে নিঃসন্দেহে। সেই আনন্দে মিশেছে বড় হয়ে যাবার রং। কলকাতায় পড়তে না এলে পুজোর এই মাহাত্ম্য অধরাই থেকে যেত। কলকাতায় এসে পুজোর জমজমাট পরিবেশ, সীমাহীন আনন্দে “ঠাকুর দেখতে যাওয়ার কনসেপ্ট” আমাকে ভীষণ অবাক করেছিল বলতেই হবে। বাস, ট্রাম, ট্রেন, অটো, সবেতেই নতুন জামার খসখস, পারফিউম, কসমেটিকস এর রোশনাই, দল বেঁধে ওঠা কিংবা নামা, রেস্টুরেন্টের সামনে হাভাতের মত শতলোকের পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা, ঢেঁকুর তুলতে তুলতে ঢেউ হয়ে ঢেউয়ে ভেসে যাওয়া। এসব দেখতে দেখতে কত বছর কাটিয়েছি মনে পড়েনা। কিন্তু বিকল্প খুঁজে পাচ্ছিলাম না কিছুতে। আমাদের সেই বাড়ির পুজোর মত সাধারণ অথচ অকৃত্রিম শ্রদ্ধা ভালবাসার পঞ্চমী থেকে দশমী আর খুঁজে পাওয়া হলনা। এ শহর আমার গল্প শুনতে চায়না। ১৯৪৭ পরবর্তী বাংলাদেশের মানুষের কাছে তাদের দুর্গাপূজার কাহিনি থাকতে পারে, এটা ভেবেই মানুষের কপালে ভাঁজ পড়ে! তাই গল্পদের আগলে রেখেছি দীর্ঘদিন। পুজোর খবরে কিছু একটা থাকে, অনেকটা ছাতিমগাছের বুনো গন্ধের মত, যা শুধু পুজোর সময় পাওয়া যায়। কলকাতায় আলোর ঝলমলে রাস্তায়, লক্ষ টাকার চাকচিক্যে কোন ছেড়ে আসা সময় যদি কুয়াশা হয়, ক্ষতি কি তাতে? আমাদের বাংলাদেশের সেই হারিয়ে যাওয়া পুজোর দিন আর কখনো ফিরে আসবেনা, তবু খড়কুটোর মত তাকে আঁকড়ে ধরে যতটুকু নেওয়া যায়, তাই খুঁজি।

    আমাদের দেশে এখন ধর্ম বিষয়টা সস্তায় বিকিয়ে যাওয়া পণ্যের মত হয়ে গেছে। সেখানে পুজোর কথা তোলা, আর হাস্যাস্পদ হয়ে ওঠা একই বিষয়। ধর্মীয় পরিচয়ে বেঁচে থাকার পরিহাস দিন দিন কেমন যেন জাঁকিয়ে বসছে আমাদের অস্তিত্ব জুড়ে। এ এক সংক্রামক রোগ, যার থেকে পরিত্রাণের উপায় নিশ্চয়ই আছে, কিন্তু আমরা অন্ধকার ঘরে ডিম লাইট জ্বালানোর মতই একে জিইয়ে রাখছি। পুজো আসছে সামনে। সেই স্মৃতিতেই লিখে ফেলা। আমার দেশে সংখ্যালঘু হয়ে যাওয়া মানুষের দলে এসে পৌঁছই পুজোর কথায়। আমাদের দেশে সাধারণ হিন্দু পরিবারে এবিষয়ে জিজ্ঞেস করলে তারা মুখ ফিরিয়ে নেবে। দেয়াল থেকে খুলে নেবে ঠাকুরের বাঁধানো কোনো ছবি। সুতরাং কার পুজো, কেবা দেয়! এত দূরে বসে যা নিয়ে ভাবছি, আমার বাড়ির মানুষেরা সেই নিয়েই এখন সন্ত্রস্ত! যেকোন দিন হতে পারে যা কিছু। আমার নিজের দেশে এখন আর পুজো কেন, আমাদের মত সাধারণ মানুষের অস্তিত্বই যখন নড়বড়ে, দেবতাও মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন সেই সুযোগে। সংকোচে, দ্বিধায় আমার গল্পেরা মুখ লুকোয়। কোথায় নিভৃতে হচ্ছে আমার “আমিত্বের” বিসর্জন! কোথায়, কোন অবকাশে, কোন অন্ধকারের ছায়ায় ঢেকে যাচ্ছে আমার বা আমাদের সেই সম্মিলনের পুজোর গল্পেরা? আমার দেশে মানুষ ধর্মের নামে প্রতিমা ভাঙ্গছে, হিন্দুত্বের চিহ্ন মুছে দিতে যার হাতের কাছে যা কিছু আছে, শিশু বৃদ্ধ যুবক তাই নিয়ে, উদ্যত তারা। কাফেরকে ঝেড়ে ফেলতে হবে বাংলাদেশ থেকে। সামাজিক মাধ্যমে বিশাল বিতর্ক, টিভিতে বিশিষ্ট সমাজবাদী, প্রগতিশীল মানুষের “হিউম্যানিটির” নির্ভেজাল আলোচনা। রিমোট থাকাতে চ্যানেল বদলানো যায়, এই যা সুবিধে, কিন্তু ওরা থাকে আঁধারেই। বেশ কিছু বছর আগেই এই সাম্প্রদায়িক দেখানো, বাড়ানো, হুজুগে সংস্কৃতি আমাদের মনে, সমাজে, দেশে কোথাও ছিলনা। ঢাকা শহরে হুড খুলে রাস্তায় বেরোনোর সময় মনে হতোনা মাথায় কাপড় জড়াতেই হবে। স্কুলে থেকে বাজারে, শপিং-এ, আত্মীয় বন্ধুদের বাড়িতে গেলে কোথাও আমার জাত পিছু পিছু ঘুরে বেড়াতো না। আমাকে কেউ জিজ্ঞেস করত না আমার জাত কি আসলে। সবাইকে সেদিন হাসিয়ে উত্তর দিয়েছি “আমরা সবাই নাকি বাংলা,” আকাঙ্ক্ষিত উত্তর যেখানে হিন্দু বা মুসলিম। পুজোর সময় আমাদের ছুটি হতো মাত্র একদিন। রোজার ছুটির এক মাস ছিল চুটিয়ে মজা করার। আমরা তো এই জানি, মেনেও এসেছি তা। কোন দিন প্রশ্ন হয়নি তা নিয়ে। আমাদের বেইলি প্রিপারেটরির ক্লাসে একা আমি হিন্দু ছিলাম বলেও বেগ পেতে হয়নি বিশেষ। দিনের পর দিন আরবি শিখেছি, কারণ আমার পাশে বসা বন্ধুরা কোনোদিন ধর্ম ক্লাস থেকে বের করে দেয়নি। একদিন হুজুর ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, আমি এই ক্লাসে কি করছি? জানলেন আমি মুসলিম নই, আমার একার জন্য ক্লাস বরাদ্দ ছিলনা। আমাকে তিনি খুব স্নেহ করতেন। মনে আছে আমাদের বাড়িতে সেই হুজুর এসেছিলেন আমার দাদুর কাছে হিন্দু শিক্ষা বই হাতে নিয়ে। আমার জন্য একটি মাত্র হাতে লেখা প্রশ্ন হত ধর্ম শিক্ষার। বেদ কয় প্রকার, রামেরা ক’ভাই, ইত্যাদি প্রশ্ন থাকত তাতে। এর মধ্যে অন্যায় কি! কিন্তু আজকের দিনে হলে আমাকে হয়ত স্কুল বদলাতে হত, অথবা হুজুর মারা পড়তেন। এসব ভাবতে গিয়ে আমার কোথাও সব এলোমেলো হয়ে যায়। আমি আবার মানুষ থেকে হিন্দু হয়ে যাই। আমার প্রগাঢ় ভাবনায় ধর্ম নয় হিন্দুত্ব কোথা থেকে এসে বাসা বাঁধে। পুজোর দিনগুলো এইসময়ের ভাবনায় বারবার ধাক্কা খায়। আমাদের যশোরের ঠাকুরবাড়িতে প্রায় পাঁচশ বছরের পুরনো পুজো এখন বন্ধ। কোনমতে নিয়ম রক্ষার্থে আমাদের সেই পুরোনো পুজোর অভ্যেসকে টিঁকিয়ে রাখতে হয়েছে। সাহস পান না বাড়ির লোকেরা আজকাল, কারা এসে শাসিয়ে যাচ্ছে কানে কানে! তিমি মাছের হা-কার নিয়ে বসে আছে কারা, অদৃশ্য ছায়াময়। যেকোনো থ্রিলার মুভির বাস্তব পট যেন। যে দেশে এখন আমাদের মত মানুষেরা শুধু দীর্ঘশ্বাস ফেলতে পারে। নিজের দেশে নিজের ভূমিতে আমরা হঠাৎ পরবাসী হয়ে গেছি। এ আর নতুন কি সাম্প্রতিক বাংলাদেশে? গত এক বছরে কত প্রতিমা, কত দেবতার খুলি নিয়ে ফুটবল খেলে তৃপ্ত হয়েছে আমাদের মতই মানুষ। কি জানি তারা মাটির মূর্তিতে আসলে কি চেয়ে কি দেখতে পেয়েছে! মূর্তি আর ঈশ্বর, ধর্মবোধ আর হিংসা মিলেমিশে একাকার। এতে নিরাকার স্রষ্টার কি আসে যায়! তাঁর অজাগতিক নির্লিপ্তিই হয়ত অনন্তকালের উত্তর হিসেবে থেকে যাবে। আমাদের কেটে যাওয়া বেশ কিছু সময়ে সম্প্রীতি ছাড়া ধর্ম শব্দটির আর কোনো ব্যাখ্যা ভাবিনি। ঈদের সময়ে, ১লা বৈশাখে, এমনকি দেশের যেকোনো পালাপার্বণে আমরা সবাই খুব আনন্দ করেছি। নির্ভয়ে রমনা বটমূলে গান শুনেছি, টি.এস.সি চত্বরে, শহীদ মিনারে, বেইলি রোডের রাস্তায় হেঁটেছি। সেইদিন থেকে আজকের দিনগুলোর পার্থক্য সময় বদলে দিয়েছে খুব নির্মম ভাবে। শরতের আকাশ যতই ডাকুক, আমার নিজের দেশের সেই রূপ রং রস, সেই অনুভবে আর হয়ত ফিরতে পারবে না। মনে হয় সেদিনের কথা, পুজোতে গ্রামের বাড়ি যাব বলে আমার চার/পাঁচ দিন স্কুল থেকে ছুটি নেওয়া। নতুন জামা কেনা, বাড়ির সবার জন্য উপহারের বন্যা বইয়ে দেওয়া। বাবা মার সাথে সোহাগ কিংবা দিগন্ত পরিবহনে আরিচা ফেরিঘাট হয়ে সোজা মাগুরা। সেখান থেকে বাবা বিশাল টেম্পো ভাড়া করতেন, আমাদের মালপত্র বোঝাই জিনিসগুলো সমেত ঠাকুরবাড়ি পৌছনোর জন্য। সেই রাস্তাগুলোকে এখন গুগল ম্যাপে দেখি। তার উপরে হাত বোলাই, সেই এক ঘন্টার রাস্তার নুড়ি পাথরগুলোকে ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে করে। বাড়ি যাবার রাস্তায় বিরাট এক বট গাছ ছিল, লোক মুখে সবাই জায়গাটিকে “মান্দারতলা” বলত। সন্ধের পরে তো বটেই এমনকি দিনে-দুপুরে সেখানে ডাকাতের ভয় ছিল। মান্দারতলা পেরোনোর আগে মাকে দেখতাম গলায় কাপড় জড়িয়ে বসতেন, আমাদের পিছনে থাকা টেম্পোর পর্দা নামিয়ে দিতেন, সে এক ভয়াবহ ক্লাইমেক্স! শ্বাসরুদ্ধকর ওই জায়গাটুকু পেরোতে প্রায় দশ মিনিট সময় লেগে যেত। তারপর সব স্বাভাবিক। কিছু রাস্তা পেরোতেই বাবা হাত দিয়ে কোন কিছু দেখানোর চেষ্টা করতেন, ওটা নাকি পদ্মবিল, কোন এক সীমানা দেখিয়ে আমার ঠাকুরদার জমির এলাকা দেখানোর চেষ্টা করতেন। বলতেন, তাদের পূর্বপুরুষের এই অঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত হবার কথা। তখন সেগুলো চোখে দেখেছি, বাবার অনুভূতি তখন বুঝে ওঠা সম্ভব ছিলনা আমাদের। মন তখন পুজোর জন্য উৎসুক, কখন গিয়ে পৌঁছব আমাদের বাড়ির উঠোনে। এই তো দেখতে পাচ্ছি উঠোনের চারিধারে বাঁশ আর টিন দিয়ে মুড়ে ফেলা হচ্ছে। বাড়ির মধ্যে হইচই, মহা ধুমধাম। কন্ট্রোল ঘরের বারান্দায় “ফ্যালাজেঠুর” ঢাক, কাঁসর রাখার জায়গা প্রস্তুত হচ্ছে। মণ্ডপ দালানে কচিকাঁচার ভীড়, সিংহের ধারালো দাঁতের আঁচড় পরখ করে দেখছে তারা পরম কৌতূহলে। ইঁদুরের লেজ ধরে কেউবা দিচ্ছে টান। দেবীর পক্ষ থেকে অসুর বধ করতে অসুরের গলায় আঙ্গুল ঢুকিয়ে দিচ্ছে কেউ। পাল কাকু দেবীপ্রতিমার মাটির দেহ সজীব করে তুলছেন এক অনবদ্য শ্রদ্ধার প্রলেপে। হলুদ রঙের ঠাকুর আমাদের। চিরচেনা সেই মায়াবী মুখ তাঁর। তাঁর সন্তানেরাও আমাদের চেনা। প্রতিবছর একই রূপে আমাদের জীবনে আসেন তাঁরা। কোনো জাঁকজমক ছাড়াই আমাদের বাড়ির বনেদী পুজো কত আকর্ষণীয় ছিল সেই সময়। আমাদের পূর্বপুরুষদের বৈদিক নিয়মমতে করা সেই পুজোর রেওয়াজে সব কিছু হত কাঁটায় কাঁটায় নিয়ম মেনে। ভোর হতে না হতেই ফ্যালা জেঠু ঢাক বাজিয়ে জাগরণ করতেন। মায়েরা, কাকিমারা, বৌদিরা ভোরে উঠে ফুল তুলতেন ডালা ভর্তি করে। সূর্য ওঠার আগে পুজোর জল তুলে আনা হত নবগঙ্গা থেকে। সেই ভোর, সেই কাঁসা পেতলের টুংটাং শব্দ, সেই বাড়ির বড়দের শ্বেতশুভ্র ধুতির ভাঁজ, মায়েদের গরদের শাড়ির লাল পাড়, বাড়িময় শতশত লোকের পায়চারী, কেটে রাখা কলাপাতা, পুকুর সমান কড়াইতে নারকেল নাড়ুর কড়া পাকের গন্ধ, সব মিলিয়ে কেমন একটা পুজোর মঙ্গলবার্তা। .... তারপর, তারপর... আমাদের পথ ফুরোতো না এইসব আনুষঙ্গিক ভেবে ভেবে। কখন নামব বাড়ির দরজায়! রাস্তা থেকে দেখা যেত আমাদের বাড়ি। যার কোনো গেট নেই, নামের ফলক নেই। ধলোহরার মোড় থেকে মার্জিন টানলে নারকেল, সুপরি, আম গাছের সারি দেওয়া বিশাল এলাকার বেড়া বাঁধা সীমানা টানা শেষ প্রান্তটিই আমাদের ঠাকুরবাড়ি। এটা একটা স্টপেজ। জানিনা এখন তা কিসে পরিণত হয়েছে! আমাদের বাহন উঠোন স্পর্শ করতেই আশপাশের কাকিমা, জ্যাঠিমা, ছোটবড় নানান মাপের বন্ধুরা ঘিরে ফেলত আমাদের। আমরা নেমেই মণ্ডপ ঘরে উঠে যেতাম ঠাকুর দেখতে। দেবীপ্রতিমার সামনে সেই প্রাচীন ভীড়। এখানে ওখানে জমা মাটি, রং, কল্কে বানানোর কাগজ, শোলার পেপার। বাঁদিকে কুলদেবতার জন্য বানানো হচ্ছে আসন। ভেতর বাড়িতে তখন মহিলা মহলের কাজের তাড়া। পুজোর দিন কটাতে মাকে রাত্রিবেলা শুধু দেখতে পেতাম। বাকি সময় তো কেটে যেত জামাকাপড় কার কটা, কখন কোন জামা পরবো তার হিসেব করে। কত ছোট ছোট ইচ্ছে ছিল তখন। পুজোর চারদিন গ্রামের লোকের জন্য দুবেলা খাবারের ব্যবস্থা হিসেবে নির্ধারিত রান্নাঘর, রান্নার দায়িত্বের জন্য খুঁজে নেওয়া হতো স্পেশাল কাকিমা বা জেঠুদের। ভোগ রান্না করবেন আমাদের মা, জেঠিমা বা পারিবারিক বর্গেই সীমাবদ্ধ মানুষেরা। সকাল হতে না হতেই ভ্যানে করে আসত ইলিশ মাছেরা। মাছ কাটার জন্য সাত আট জন, ধুয়ে দেবার জন্য আলাদা লোক রাখার ব্যবস্থা ছিল। নয় থেকে দশ রকমের খাবার রান্না হত দুবেলা মানুষের খাবারের জন্য। লাইন দিয়ে বসে সকাল থেকেই সবজি কাটতে বসতেন গ্রামের মহিলারা। আমাদের বাড়ির পুজোতে গ্রামের সব মানুষেরা এসেছে, খেয়েছে, থেকেছে। বাবার সঙ্গে সবাই তাদের জাত ধর্মের মোড়ক ছাড়াই কাঁধে কাঁধ রেখে কাজ করে গেছে। পুজোর সময় আমাদের ভেতর বাড়িতে একই সঙ্গে চা পর্বের জন্য সকাল থেকে রাত ন’টা পর্যন্ত পালাক্রমে কেউ অন ডিউটি থাকত। ওই চারদিন কেউ এসে খালি হাতে, খালি মুখে ফিরে যেতনা। চিড়ের ও মুড়ির মোয়া, নারকেল নাড়ু, তিলের ও চিনির নাড়ু, মুড়কি, সন্দেশ, প্যাঁড়া, জিলিপি, চমচম আরো মনে করতে না পারা অনেক মিষ্টি থেকেছে সব মানুষের জন্য। সন্ধে আরতির সময় উপচে পড়েছে গোটা গ্রাম। মণ্ডপের ভেতরে বাইরে সব মানুষের চোখে মুখে দেবীর জাগ্রত শক্তির আরাধনা। মন্ত্রে, ধূপে, কর্পূরের আগুনে, ঢাকের আওয়াজেও যেন সেই বন্দনারই আকুতি। নবমীতে চাল-কুমড়ো বলির অনুষ্ঠান, দশমীর দিনে তর্পণ বিসর্জনে, জলে দেবীর আনত মুখের ছায়া, বাঁধন কাটা, দুর্গা মায়ের বিদায় উপলক্ষ্যে পান্তাকলা, কচুর শাকের প্রসাদ, ঢাকের সুরে প্রচ্ছন্ন বিদায় সব মিলে শেষ গানের রেশটুকুও না রাখা। দুপুরে নিয়ম মেনে প্রতিমা উঠোনে নামানো, মা, জ্যাঠিমারা পারিবারিক ঐতিহ্য অনুযায়ী বিশেষ সাজসজ্জা, নানান অলংকার পরে দেবীবরণ করতেন। আমার মাকে অপূর্ব লাগত সেই সাজে। তাকিয়ে দেখতাম মাকে, দেবী দুর্গার থেকে কোথায় তিনি কম? দিব্যি তো সামলে নিলেন আমাদের জীবনগুলোকে। যাহোক, বাড়ির লোকের হয়ে গেলে গ্রামের মহিলারা বরণ করতেন। আমরা ব্যস্ত হয়ে পড়তাম আড়ং খরচ নিতে। পকেট ভরে যেত আমাদের সবার আশীর্বাদ আর চকচকে নতুন টাকা পেতে পেতে। প্রতিমা ভাসানের জন্য গ্রামের লোক এক হয়ে যেত। প্রতিমা নবগঙ্গার উদ্দেশ্যে যাত্রা করতেন সবার কাঁধে চড়ে। ধলোহরা মোড় ফাঁকা করে দিত স্থানীয়রা, রাস্তার দুপাশে মানুষের ভীড় জমে যেত। সেখানে মানুষেরা থাকত, কোন বিশেষ ধর্মের ছায়ারা নয়। যত্নের সঙ্গে প্রতিমাকে দুই নৌকার মাঝখানের পাটাতনে বাঁধা হত। দেবী যাত্রা করতেন প্রতিবেশী গ্রামের উদ্দেশ্যে বিনোদপুরে। বাবা রবিকাকা ভাইবোনদের সাথে সেই ভাসানের নৌকায় আমরা দু একবার উঠেছি। অন্যথায় বাড়ির বৌদিদিদের সাথে গয়না নৌকায় উঠতে হত, যেখানে কোনো চার্ম ছিলনা। সবাই ধরে বেঁধে রাখত, পাছে জলে না পড়ে যাই। মায়েরা বাইরে বেরোতেন না, ভাসান পরবর্তী পুজোর জোগাড় করতে ব্যস্ত থাকতেন। বিনোদপুর থেকে ফিরে দেবী ভাসানের সময় হয়ে যেত। সেই সময়টা কখনো ভুলবনা। মাঝনদীতে চারদিকে ঢাক বেজে চলেছে, এক সময় সাত পাক ঘুরত ভাসানের নৌকা। টিভিতে দেখেছি কলকাতার বিসর্জনের ছবি, বিসর্জন তো নয়, যেন জিলিপি ভাজা। বাঁশ দিয়ে চেপে চেপে ডুবিয়ে দেওয়া হচ্ছে মূর্তিগুলো। আমাদের ঠাকুর বিসর্জন যেকোনো মানুষের চোখে লেগে থাকবে। সাতপাক ঘুরে স্থির হয়ে যেত নৌকা, আমাদের বুকের ভেতরে ঢিপ ঢিপ! ঠাকুর চলে যাচ্ছেন, আর কয়েক মিনিট, কিছু মুহূর্ত! আস্তে আস্তে বাঁধন খোলা হতো, মন্ত্র পড়ে, দুর্গা স্তবে ধীরে ধীরে দেবীর কাঠামো জলের দিকে নামতে থাকত। সবার চোখে জল, নদীর জল মাথায় দিত সবাই। ফেরার পথে আমাদের বাড়ির গান থাকত, “আমার মা বুঝি কৈলাসে চলেছে/ চণ্ডীমণ্ডপ ঘরখানি রহিল পড়িয়া... ” শেষ হয়ে যেত পুজো। ফিরে আসতাম ঢাকায়। এখন যেমন স্লো মোশনে গুটিয়ে আনছি পুজোর দিনগুলোকে। সেই চণ্ডীপাঠ, ধূপারতি, হোম, ফুল কুড়োনো সকাল, বাড়ি যাওয়া, সব কিছু থেকে সরে যাচ্ছি একটু একটু করে। আমাদের ঠাকুরবাড়ি এখন ক্ষুধিত পাষাণ। কিছু মানুষ থাকে সেখানে, বেঁচে থাকার আনন্দহীনতা নিয়ে। প্রতিবছর আমার পুজোর অ্যালবাম এভাবে দেশ থেকে দেশে খোলে, আর আমাদের বাড়িতে গিয়ে বন্ধ হয়। প্রতিদিনের জীবনে হাজারও বিসর্জন, তবু কোথাও ঢাকের আওয়াজ শুনতে পাই যেন। চমকে উঠি, সাম্প্রতিক দেশের বিচ্ছিন্ন মানসিকতার পটভূমিতে পুজো, ধর্ম, হিন্দুত্ব খড়গ হয়ে মাথায় শান দেয়। “মালাউনের” নাকি ধর্ম থাকতে নেই।... আর কদিন পরেই বরফ পড়বে এদেশে। তখন আবার জমাট বেঁধে যাবে এই অনুভূতি, অসহায়তারা। আবার শরৎ আসবে, আবার অনলাইন পুজো নিয়ে সরব হব, আবার কিছুক্ষণ নেশাগ্রস্ত মানুষের মত বেভুল বিচ্ছেদে পিছনে তাকাবো। বুকের ভেতরে তোলপাড় করে কাউকে শুনিয়ে ফেলবো ঠাকুরবাড়ির হারানো গল্প। কেউ তো শ্রোতা হবে, কেউ তো বলবে, ...এহো বাহ্য, আগে কহ!!



    অলংকরণ (Artwork) : অলংকরণঃ সঞ্চারী মুখার্জী
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments