নভেম্বর মাসের গোড়া। দুর্গাপুজো কালীপুজো সবে শেষ হয়েছে। বাতাসে হাল্কা হিমেল ছোঁয়া। ফ্যান চালানো বন্ধ হওয়ার মুখে। সোফার ওপর হাঁটু মুড়ে বসে লালি উল বুনছিল। কমলা রঙয়ের উলের গোলা দিয়ে একহারা বুনন।
উল্টোদিকের সোফায় অবিনাশবাবু। চোখে গোল্ডেন ফ্রেমের চশমা। হাতে মোটা আইনের বই। হাতের বই মুড়ে পাশে রেখে, চোখ থেকে চশমা খুলে, মুখের সামনে ডান হাত দিয়ে দুবার তুড়ি মেরে অবিনাশবাবু বললেন, এক কাপ চা দাও তো। আদা দিয়ে।
উলের কাঁটা থেকে চোখ তুলে লালি দেওয়াল ঘড়ির দিকে তাকালো। নটা বাজতে পাঁচ। লালি বলল, এত রাতে চা খাবে? আমি তো রুটি করতে উঠছিলাম।
অবিনাশবাবু উলের কাঁটার দিকে আঙুল দেখিয়ে বললেন, এটা কার?
লালি বলল, কার আবার? বনির। কমলা বনির প্রিয় রং। জামাইয়েরটা আগেই শেষ করেছি। শীত জাঁকিয়ে পড়ার আগে ক্যুরিয়ার করে পাঠিয়ে দেব।
—কী যে তোমার হাতে বোনার ব্যামো! ক্যুরিয়ারের পয়সা দিয়ে এমনিই দুটো সোয়েটার হয়ে যায়।
—তা হোক।এ হল নিজের হাতে তৈরি। এর কদরই আলাদা। তত্ত্বের জিনিসে একটু আন্তরিকতা থাকা দরকার।
—পাঁচ বছর হল। এখনও তত্ত্ব?
—দুটো নয়, পাঁচটা নয়, একটা মাত্র মেয়ে। এটুকু আমি করবোই। যতদিন তোমার আয় আছে। বেশি তো নয়, পুজো শীত জামাইষষ্ঠী জন্মদিনে একটু দেওয়া থোওয়া। এতে বাপু মেয়ের মান থাকে। শ্বশুরবাড়িতে, জামাইয়ের কাছে।
—তোমার এবার নাতি হওয়া দরকার। পাঁচ বছর তো হয়ে গেল। আর কতদিন?
—আশিস কী বলছে গো? টাকাটা পেলে চলো একবার বনির কাছে ঘুরে আসি।
—যাবো বললেই কী যাওয়া যায়! অনেকগুলো টাকা। বীরেশকে তিন লাখ দিয়ে ফেললাম। আশিস এখন মুঠো খুলছে না।
লালি নিচু স্বরে বলল, কী করবে এখন? তার গলায় উদ্বেগ।
অবিনাশবাবু চিন্তিত ভঙ্গীতে বললেন, দেখি। সুরেশের সঙ্গেও কথা বলেছি। তারপর গলা ঝেড়ে হাল্কাভাবে বললেন, যাকগে, আর কিছু না হোক বীরেশ-শেফালিকে শেষমেশ ওঠানো তো গেছে। তিন লাখের পরিবর্তে। তুমিও বড় ব্যস্ত হয়ে উঠেছিলে। শেফালিকে কোনদিনই দেখতে পারো না। আজকাল পারুলের সাথেও খারাপ ব্যবহার করছিলে।
—অমন গায়ে পড়া মেয়েছেলে আমার দুচোখের বিষ। শেফালি তোমার গায়ে পড়তো। যখন তখন সেজেগুজে লালিবৌদির নাম নিয়ে অবিনাশদার চোখের সামনে ঘুরঘুর!
—সবই তোমার অলস মস্তিষ্কের কল্পনা। মনগড়া গল্প।
তাই? লালির গলা এবার ধারালো। আর অভির সাথে পারুল? সেইবেলা? তখন কেন ভয় পেলে?
অবিনাশবাবু এইবার চুপ করে যান। একটু থেমে বলেন, ভয় নয়। তিনলাখ টাকা দিয়ে বীরেশকে তুলে ভালোই হয়েছে। এখন প্রোমোটার পাওয়া সহজ হবে। দু-চার লাখ বেশি দামও পাওয়া যেতে পারে। ভাড়াটে-সুদ্ধু বাড়িতে ভাড়াটে তোলার হ্যাপা থাকে। প্রোমোটাররা গাঁইগুঁই করে। তেমন দাম দিতে চায় না। আশিস না নিলে সুরেশ নেবে। সুরেশ না হলে মনোজ আছে। আমার তিরিশ লাখ, বীরেশের তিন লাখ, শেফালিদের সঙ্গে এতদিনের সম্পর্কে চিড় ধরার খেসারত হিসেবে দু-লাখ। মোট পঁয়ত্রিশ লাখের এক পয়সা কমে এ বাড়ি আমি ছাড়ছি না।
লালি বলল, প্রদীপ দত্তদের বাড়িটা তো আটত্রিশ লাখে গেল। আমাদের আর ওদের জমির মাপ সমান সমান।
অবিনাশবাবু বললেন, তা ঠিক। তবে ওদের কর্নার প্লট। ফ্ল্যাট বাড়িতে কর্নার প্লট, খোলা জানালার চাহিদা বেশি।
এতক্ষণে লালি উলের গোলা গুটিয়ে ফেলেছে। উল কাঁটা নীল রঙের গুজরাটি স্টিচের ঢাউস বটুয়ার ভিতর ঠেসে ঢুকিয়ে সে সোফা থেকে পা নামিয়ে উঠে দাঁড়ায়।
অবিনাশবাবু জিগ্যাসা করেন, অভি কবে ফিরবে?
লালি রান্নাঘরের দিকে যেতে যেতে বলে, পরশু।
অবিনাশবাবু স্বগতোক্তি করেন, আর তো তিন মাস। অভিও চলে যাবে। বাড়িতে থাকবো শুধু আমি আর তুমি, দুই বুড়োবুড়ি।
অবিনাশবাবু, অবিনাশ রায়। এ পাড়ায় জন্ম, বড় হয়ে ওঠা, বিবাহ, সন্তানাদি। এখন প্রৌঢ়ত্ব পেরিয়ে বার্ধক্য ছুঁই ছুঁই। এই বাড়ি, যেখান থেকে অবিনাশবাবু দু-পয়সা মুনাফার চিন্তা করছেন, সেই বাড়ি তৈরি হয়েছিল অবিনাশবাবুর দাদু নিখিলেশ রায়ের আমলে। অবিনাশবাবুর বাবা পরিতোষ রায় বাড়িটায় শুধু থেকেছিলেন, স্রেফ থাকা। পরিতোষ রায় তার নিত্য তাসের সঙ্গী পরেশ সাহা অর্থাৎ বীরেশের বাবাকে এ বাড়িতে ভাড়াটে হিসেবে ঢোকান।
পরেশ সাহা ভদ্র পাড়া খুঁজছিলেন। পকেট অনুযায়ী ভাড়া। এক চিলতে রান্নাঘর, বাথরুম, রোদ বৃষ্টিতে মাথা গোঁজার ঠাঁই হলেই তার চলে যায়। ঠিক সেইটুকুই ছিল। বড় শোয়ার ঘরের পাশে এক চিলতে জমি। জমির পর নাতিউচ্চ পাঁচিল। পাঁচিলের ওপাশে টুকরো উঠোন। উঠোন সংলগ্ন দুটো ঘর। অবিবাহিত ন-দাদুর জন্য ভাইপো নিখিলেশ রায়ের তৈরি দরাজ ব্যবস্থা।
পরিতোষ রায় ভাবলেন, ঘর দুটো শুধুমুধুই পড়ে আছে। ভাড়া দেওয়াই যুক্তিসঙ্গত। মাস গেলে দু-চার টাকা উপরি রোজগার। সঙ্গে পালাপার্বণে, আপদে বিপদে চব্বিশ ঘণ্টা বন্ধুর নিশ্চিন্ত উপস্থিতি। ইচ্ছেমত তাসের আড্ডার সম্ভাবনা। পরিচিত, বিশ্বস্ত, নির্ভরযোগ্য প্রতিবেশী। আর কি চাই!
পরিতোষ রায় এবং পরেশ সাহার সামাজিক অবস্থানে ছিল আকাশ পাতাল ব্যবধান। তবুও অন্দরমহলে প্রীতির সম্পর্ক ছিল। এবাড়ি ওবাড়ির রান্নাঘরের মধ্যে প্রায়শই বাটি চালাচালি চলতো। অবিনাশ জানতো কাঁঠালের বীচির চচ্চড়ি মানে খুড়ির রান্না। খাবার সময় পাঁঠার মাংস দেখলে বীরেশও বুঝতো ও-বাড়ির হেঁসেলে আজ মাংস হয়েছে। অবস্থার পরিবর্তন হয় অবিনাশের আমলে। লালির সাথে অবিনাশের বিয়ের পর।
বীরেশ হল স্বভাব বাউণ্ডুলে। আর খুড়ির হাতে সংসারের রাশ চিরকালই আলগা। বীরেশ পড়লো কি পড়লো না, পাশ করলো কি করলো না, সবই যেন ইচ্ছের ব্যাপার। ভাগ্যের হিসেব। খুড়ির যেন তাতে কোন ভূমিকাই নেই। তের বছরের বীরেশ বিড়ি ফুঁকলে শাস্তির পরিবর্তে খুড়ি লুকোতে তৎপর হত। পনেরো বছরের ছেলে স্কুল পালিয়ে সিনেমা দেখতে গেলে খুড়ি তেমন করে রেগে উঠতেই জানতো না। উনিশ বছরের বীরেশ যখন অনাথ আশ্রমের শেফালির প্রেমে পড়ে, ছেলের মনের আকাশ সমান উদারতা দেখে খুড়ির মন প্রশ্রয়ে ভিজে ওঠে।
অবিনাশ এবং বীরেশ পাশাপাশি বড় হলেও পারিবারিক ধারা অনুযায়ী একটার পর একটা পাস দিয়েছে, খানদানি ঘরের মেয়ে লালির সাথে বিয়ে হয়েছে, নিয়মিত কোর্টে প্র্যাকটিস করে। আর বীরেশ হল স্থানীয় মিলের ওয়ার্কার। এখনও অসম পরিস্থিতি। তবু একসাথে খেলাধুলা করে বড় হওয়া। এতদিনের পুরনো প্রতিবেশী। তাই অবিনাশ এবং বীরেশের মধ্যে একটা সম্পর্ক আছে, যার মূল বহু গভীরে প্রোথিত।
বীরেশের বউ শেফালি মেয়েটি খারাপ নয়। দেখতে শুনতে বেশ। খুড়ির থেকে কাঁঠালের বীচির চচ্চড়ি নিখুঁত রাঁধতে শিখে নিয়েছে। কলমিশাকের ঘণ্টও বেশ রাঁধে। দোষের মধ্যে বড় বেশি প্রাণোচ্ছল। প্রয়োজনের অতিরিক্ত হাসিখুশি। কথায় কথায় হেসে গড়িয়ে পড়ে।
রায়বাড়ির সীমানার মধ্যে লালির অনেক আগে শেফালি ঢুকে পড়ে। বীরেশের বাইশ বছর বয়সে বিয়ে হয়ে যায়। শেফালির তখন সতেরো। অবিনাশের মা একজোড়া সোনার দুল দিয়ে বীরেশের বউয়ের মুখ দেখে। বীরেশের সঙ্গে অবিনাশের কোনদিনই সেরকম হৃদ্যতা ছিল না। দুজনের মধ্যে কথাবার্তা হতো তবে তা ছিল কোনাকুনি, সমতলে নয়। এই তলের প্রভেদ অনেকটা ঘুচিয়ে দেয় শেফালি, তার হাসি দিয়ে, সপ্রতিভতার গুণে। পঁচিশ বছরের অবিনাশ নতুন করে বীরেশের দিকে ঘুরে তাকায়। না, বীরেশের দিকে নয়। কৌতূহলটা শেফালির স্বামীর প্রতি। কে সেই পুরুষ যার কাছে শেফালির মত মেয়ে ধরা দেয়?
বীরেশের বিয়ের মাস ঘুরতেই অবিনাশ হয়ে গেল শেফালির অবুদা। শেফালির হাতের কাজ ভালো। সে রক্ষাবন্ধনে নিজের হাতে তৈরি রাখী অবুদার হাতে বেঁধে দেয়। তারপর আলতো ঠেলা দিয়ে খিলখিল করে হেসে বলে, বাউণ্ডুলে বীরেশ। আপদে বিপদে পাশে থেকো।
অবিনাশ রাখীর দিকে তাকায়, তারপর শেফালির দিকে। খিলখিল শব্দ কর্ণকুহর ভেদ করে মনে অনুরণন তোলে। নেশা ধরে যায়। অবিনাশ পুতুলের মত মাথা হেলায়। শেফালির আঁচল, পায়ের গোছ, নাকের পাটা, ঈষৎপুরু ঠোঁট সবই যেন মাদলের বাজনা বাজায়। অবিনাশের মাথা টলমল করে ওঠে। খেই হারিয়ে যায়। সে দোতলা থেকে পায়ে পায়ে মাটিতে নেমে আসে। বীরেশের কাঁধে হাত রাখে। বীরেশ অবাক চোখে তাকায়। সামান্য সরে যাওয়া বুকের আঁচল কোমরে শক্ত করে জড়িয়ে শেফালি মুখ রাখে দরজায়। অবলীলায় বলে, মুড়ি মেখেছি অবুদা। সঙ্গে লংকার পকোড়া। একবাটি খেয়ে যাও। আদা চায়ের সাথে।
অবিনাশ ঢোকে। নেশার ঘোরে।
কিসের নেশা? বিপদে রক্ষা করার? শেফালিকে?
রাখীর দিব্যি যে! প্রতিশ্রুতি-বদ্ধ।
তা শেষ রক্ষা আর হল কই!
প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের ভূমিকা শুরু হয় অবিনাশের বিয়ের পর পরই। রায়বাড়িতে লালির প্রবেশের সাথে। শেফালির সাধারণ রূপের পাশে লালি ছিল প্রকৃত সুন্দরী। তার সাথে বনেদী রক্ত। লালির বুঝে হাসি, মেপে কথার সামনে শেফালির গায়ে পড়া হাসি চোখে ঠেকত। বীরেশ দূর থেকে লালিকে সমীহের নজরে দেখতো।
শেফালি ছিল বুনো ফুল। আদিম মাদকতা। লালি যেন জাপানী ইকেবানা। কেটে কুটে, মাপে মাপে, খাপে খাপে। লালি শেফালিকে দূর করেনি। আবার জড়িয়েও ধরেনি। অনেক চেষ্টা করেও শেফালি কোনদিন লালিদির তলে পৌঁছতে পারেনি। লালির ব্যবহারে ছিল দয়া, দাক্ষিণ্য, করুণা। এক নিষ্করুণ ব্যবধান।
নতুন বউ লালির সামনে বেপরোয়া শেফালি মস্করা করে, পাঁচ বছরের পরিচিতির জোর খাটিয়ে, তার অবুদার গায়ে ঠেলা মারতে যেত। লালির নিষ্পলক দৃষ্টির অনুচ্চারিত দূরত্বের সামনে শেফালির উদ্যত হাত থমকে পড়ত। ভেতরে ভেতরে গুটিয়ে যেত বুঝি।
সে তখন অবুদাকে ছেড়ে লালিবউদির দিকে মন দেয়। লালির কাছে উল কাঁটা নিয়ে বসে। লাল সোয়েটারের প্যাটার্নটা তুলে দিতে অনুরোধ করে। ও-পাড়ার দত্তকাকিমার জন্য লালিবৌদির চিলি চিকেনের ভূয়সী প্রশংসা করে রেসিপি চায়।
লালি খুব সহজেই নিজেকে শেফালির থেকে কয়েক ধাপ উঁচুতে বসিয়ে নিয়েছিল। লালির কাছে শেফালি খুব সুবিধে করতে পারেনি। তাই বলে অবুদার ওপর তার এতদিনের বিস্তারিত প্রভাবও সে অত সহজে হাতছাড়া করার পাত্রী নয়। সেই কথাই লালি রান্নাঘরে যাওয়ার আগে অবিনাশকে বলে গেল, শেফালি ছিল গায়ে পড়া মেয়েছেলে।
তা লালিকে শেফালি কম জ্বালায়নি। অবিনাশদের বাড়িতে তিনখানা শোয়ার ঘর, বৈঠকখানা, রান্নাঘর, বাথরুম, কুয়োতলা। ওদিকে দুটো ঘর নিয়ে ভাড়াটেদের সংসার। শোয়া, বসা, রান্না। শেফালি উঠোনে আসতো কাপড় মেলতে, চুল শুকোতে, রোদ পোহাতে, বৃষ্টির আকাশ দেখতে। উঠোন থেকে দূরে, জানালার গরাদে, আলো আঁধারে বীরেশের মুখ দেখা যেত। সে লালির দিকে তাকিয়ে আছে, সসম্ভ্রমে, ড্যাবড্যাবিয়ে।
শেফালি এবং বীরেশ, দুজনের উপস্থিতিই ছিল লালির জন্য অস্বস্তিজনক। লালি সে-কথা অবিনাশকে বলেছিল। তবে ঘর পাল্টানো হয়নি। দু নম্বর ঘরে পঙ্গু শাশুড়ি। শ্বশুরকে এইসব মেয়েলি ভালোমন্দের কথা বলা যায় না। তিন নম্বর ঘরটা বড়ই ছোট। লালির বিয়ের খাট সে ঘরে আঁটবেই না। তাছাড়া জানালার পাশে এক চিলতে জমিতে, ন-মাসের ভরা পেটের মত, ফুলে ভরা একটা ঝাঁকড়া গন্ধরাজ গাছ ছিল। গন্ধরাজ অবিনাশের বড় প্রিয় ফুল। ঝরঝর ঝরিছে বারিধারার রাতে গন্ধরাজের সৌরভটুকু অবিনাশ কিছুতেই হাতছাড়া করতে চাইত না।
তাই লালিকে সারাজীবন মেনে নিতে হয়। সয়ে যেতে হয় তিরিশ বছর। সুন্দরের পাশে অসুন্দরকে, ভালোলাগার পাশে না-ভালোলাগাকে, প্রিয়র সাথে অপ্রিয়কে। লালিবউদি ডাক দিয়ে, সটান গেট খুলে, শেফালি সেজেগুজে হাজির হয়ে যেত। বৈঠকখানায়। আইনের বই হাতে তখন অবিনাশ সেখানে বসে। নিষ্পলক চোখে, অনুচ্চারিত দূরত্ব বজায় রেখে, হিম হিম বুকে লালি শেফালির খোঁপায় আধ-ফোটা গন্ধরাজের কুঁড়িটিকে দেখতো। লালির দৃষ্টি অনুসরণ করে শেফালি বেপরোয়া হাসিতে উচ্চকিত হয়ে উঠত। তারপর কি মনে পড়ে যেতে, লালিবউদির অনুকরণে মৃদু গলায় বলতো, গন্ধরাজের দুটো ডাল আমাদের উঠোনে নুয়ে। তারই একটা থেকে এই আধফোটা কুঁড়ি।
শেফালির কথা শেষ হওয়ার আগেই লালি নরম হেসে বলতো, তাতে কী? গাছ ভর্তি কত! একটা কুঁড়ি বৈ তো নয়! তার আবার কৈফিয়ত। বসো।
অবিনাশের দিকে ফিরে বলতো, তুমি অভির ঘরে যাও। এখানে মেয়েলি বকবকানিতে তোমার আইনি পড়ায় অসুবিধে হবে।
অবিনাশ উঠে যেত। হয়তো শেফালির দিকে চাইতোও না। কিন্তু গন্ধরাজের কুঁড়ি ছুঁচ হয়ে লালিকে খোঁচা মারত। শ্যামলা শেফালির ভরা শরীরের সাথে ফুলে ভরা গন্ধরাজ গাছ মিলেমিশে একাকার হয়ে উঠত।
সেই পাঁচবছর, যে পাঁচবছর শেফালি একা ছিল, নাতিউচ্চ পাঁচিলের ওপাশে, ঝাঁকড়া গাছটার তলায়, গন্ধরাজের সৌরভে। সেই পাঁচবছরের গল্প শোনার তৃষ্ণায়, জানার নেশায় লালির বুক ছটফট করতো। কিন্তু উপায় ছিল না। বাক্সে সাজানো ছিল প্রতিবছরের একটি করে রাখী, সম্পর্কের শিলমোহর। শেফালির নিজের হাতে তৈরি রক্ষাকবচ। প্রতিশ্রুতির আবেদন। আপদে বিপদে পাশে থেকো। বিয়ের পর প্রথম বর্ষাঋতু থেকেই লালি রক্ষাকবচ ছিঁড়ে ফেলার ক্ষেত্র তৈরি শুরু করে। হোলো, তবে অনেকখানি সময় কেটে গেল। এই যা।
রাতের খাওয়া শেষ। অবিনাশ ও লালি দুজনেই শুয়ে পড়েছে। ঘরে মিহি রাত-আলো। মোড়ের মাথায় এখনও রিক্সার হর্ন, গাড়ির আওয়াজ। সাদা দোতলা বাড়িটা থেকে রক মিউজিকের ভারী শব্দ ভেসে আসছে। পাঁচিলের ওপাশের দুটো ঘরে নিকষ অন্ধকার। সামনের সরু বারান্দায় এক মাসের ঠাসা ধুলো। উঠোন জুড়ে শুকনো পাতা, উড়ে আসা দোমড়ানো মোচড়ানো কাগজ, পলিথিনের টুকরো। পঞ্চাশ বছর বসবাসের পর বীরেশরা চলে গেছে। নতুন আস্তানায় কেমন আছে বীরেশ? গৌরী, পারুল, শেফালি? অবিনাশের বুক হুহু করে ওঠে। শেষমেশ অবুদা তুলে দিল শেফালি-বীরেশকে, রায়েদের নিরাপত্তা থেকে। নিরাপত্তা কি একতরফা ছিল?
যাই হোক, অবিনাশও আর পারছিল না। বন্ধুত্বসূত্রে বাড়ি ভাড়া দেওয়া। বাজারের তুলনায় চিরকালই কমভাড়া। পরেশ সাহা মাসের এক তারিখেই বন্ধু পরিতোষ রায়ের হাতে ভাড়া বাবদ টাকা গুনে দিয়ে দিতেন। অর্থের কারণে বন্ধুত্ব বা সম্মান নিয়ে কোনদিন টানাটানি বাঁধেনি। বীরেশের আমলেও একরকম চলছিল। প্রতিমাসে না হলেও বীরেশ শেষপর্যন্ত বকেয়া ভাড়া মিটিয়ে দিত। আজ সাতবছর হল বীরেশদের মিলে লক আউট। বীরেশ এটা সেটা করে, শেফালি জোড়াতালি দিয়ে সংসার চালায়। ভাড়ার টাকা অনিয়মিত। নিয়মিত হল ধার নেওয়া। বীরেশ অবিনাশের কাছে, লালির কাছে শেফালি। খাতায় সই করে। এছাড়াও আছে, অবিনাশের থেকে শেফালি। অফিস থেকে ফেরার পথে, লালি বাপের বাড়ি গেলে। বীরেশের চোখ এড়িয়ে, লালিকে ফাঁকি দিয়ে।
অবিনাশ মুখ বুজে করছিল। একসাথে বড় হওয়া, এতদিনের প্রতিবেশী। কিন্তু তারও তো রোজগার বন্ধ হওয়ার মুখে। অবসর প্রাপ্তির পরের কথা তো ভাবতে হয়। বাড়ির অবস্থা তথৈবচ। মেরামত প্রয়োজন। মেরামত করতে টাকা দরকার। ফ্ল্যাটের যুগ। প্রোমোটারদের রমরমা। মন্দ কি! সঙ্গে হালফ্যাশনের নতুন ফ্ল্যাট। লালিরও খুব শখ। জানালায় গরাদের বদলে গ্রিল, ছড়ানো দালানের চাইতে হাওয়ায় ভেসে থাকা ঝুলবারান্দা। অবিনাশ কিছুদিন ধরে ভাবছিল। ইন্ধন জোগালো লালি। অভি আর পারুলকে নিয়ে।
অবিনাশের বিয়ের বছর ঘুরতেই লালির কোলে এসেছিল বনি। তার পাঁচ বছর বাদে অভি। শেফালির কিছুতেই কিছু হচ্ছিল না। অনেক মানত ডাক্তার-বদ্যি করে বিয়ের বারো বছর পর গৌরী হয়। গৌরীর ছয় বছর পর পারুল। পারুল হল হুবহু শেফালি, চেহারায় ও স্বভাবে। বাড়ন্ত বুক, খিলখিল হাসি, বেপরোয়া চালচলন। যখন তখন অভিদা, অংক কষতে আসা, গানের সিডি চাওয়া, বই ধার নেওয়া। শেফালি কী মেয়েকে একটু এগিয়ে দেয়? লালি সেরকমই বলে। গায়ে পড়া মেয়েছেলে! পারুলকে সামনের দরজায় ‘না’ বলে দিলে সে মেয়ে পিছনের জানালায় মুখ বাড়িয়ে ‘অভিদা’ বলে হাঁক পাড়ে। পারুলের হাবভাব দেখে অবিনাশের বুক কেঁপে ওঠে। সাহাদের মেয়ে। না, এটা সে পারবে না। কোনমতেই না। সে মনস্থির করে ফেলে।
অবিনাশ সন্ধ্যাবেলায় বীরেশের কাছে যায়। বাড়ি ছাড়ার প্রস্তাব নিয়ে। অবিনাশের প্রস্তাব শুনে বীরেশ হতভম্ব, পারুল অপমানে লাল। শুধু শেফালি বেজে ওঠে, অভিমানে।
—ভালো প্রস্তাব অবুদা। চলে যাবো। গত পনেরো বছর এই ঘরে তোমরা হাত লাগাওনি। না কলি করেছ, না জানালা দরজায় রঙ। আরশোলা টিকটিকি ইঁদুরের জ্বালায় নাজেহাল হয়ে মরি। মাঝে মাঝেই বিঘৎসমান বিছে বেরোয়। সাপখোপের ভয়ে অস্থির হয়ে থাকি। প্রতি সপ্তাহে কাঁচি চালাই, খুরপি ধরি, বাড়ির সামনের উঠোনে দুবেলা ঝাড়ু দিই। এটা জেনে রেখো যে আমরা আছি বলে তোমরা নিশ্চিন্তে আছ।
বীরেশ বাউণ্ডুলে হলেও স্বভাবে শিষ্ট। খুড়ির প্রকৃতি পেয়েছে। সেই বীরেশও উঁচু গলায় শেফালিকে ধমকে ওঠে, কী যা তা বলছো?
শেফালি আবার বলে, যা তা? যা সত্যি তাই বলছি। লালিবউদি সবসময় অহংকারে মটমট করে। অবুদার ভাবখানা যেন নিজে স্বয়ং ভগবান, দয়ার সাগর। হ্যাঁ, হাত পাতি। ধার চাই। পয়সা নিই। লালিবউদি নেয় না? মেয়ে দূরদেশে চলে গেছে। লালিবউদি বনির জন্য কেঁদে আকুল। আমি সেলাই ফেলে সারাদুপুর তার পাশে বসে মন ভোলাই। বনির শাড়িতে ফলস লাগানো, ব্লাউজে বোতাম বসানো, পরদার নিচে হেম দেওয়া, সবই তো সেই শেফালি। অভি এঞ্জিনিয়রিং পড়ে, বাড়ির বাইরে থাকে। হঠাৎ প্রয়োজন পড়লে, সেই পারুল।
এক প্যাকেট পাঁউরুটি এনে দিবি? এক আঁটি পান? অম্বলে বুকটা জ্বলে যাচ্ছে, এক পাতা ডায়ভল এনে দে সোনা।
বীরেশ, আজ আমার মঙ্গলবার। তোমার দাদা ফল আনতে ভুলে গেছে। বেশি না, শুধু একটা পাকা পেঁপে এনে দাও যদি।
অবিনাশ চুপ করে যায়। বীরেশের চোখ মাটির দিকে। শেফালির জিভের উষ্ণতা ঘরের আর্দ্র হাওয়ায় তাপ ছড়ায়। অদূরে রঙচটা দেওয়ালে মোটা টিকটিকি উচ্চস্বরে বলে ওঠে, ঠিক ঠিক ঠিক।
অবিনাশ উঠে পড়ে। বীরেশের হাতে চাপ দিয়ে বলে যায়, তাহলে ওই কথাই রইল।
কথামত কালীপুজোর পরপর ওরা খালপাড়ে চলে গেছে। অবিনাশের তিন লাখ আর খুড়ির খানকয়েক গয়না বেচে সেখানে একটা ঘর কিনেছে।
আশিস এলো ডিসেম্বরের শুরুতে। ধৈর্যের টাগ অফ ওয়ার চলছিল। কে জেতে। বিজয়ীর কথার দাম বেশি। পরিকল্পনা মত অবিনাশ পঁয়ত্রিশ লাখ দাম চাইল। আশিস তিরিশ লাখের ওপর এক পয়সা দিতে রাজি নয়। অনেক দর কষাকষির পর তেত্রিশ লাখে রফা হল। কথা হল পনেরো দিনের মধ্যে আশিস টেন পারসেন্ট অ্যাডভানস দিয়ে যাবে।
লালি আনন্দে ডগমগ। নিশ্চিন্তে গাঁটের পয়সা খরচ করে বনির সাথে একঘণ্টা ফোন। অ্যামেরিকার বনির খাল পাড়ের গৌরীকে নিয়ে অসীম কৌতূহল। পাশাপাশি বড় হওয়ার জন্য বনির মনে গৌরীর প্রতি একটা টান, ভালোবাসার বা কৌতূহলের।
—শেফালির কি শখ! এবার বুঝুক —
— কেন মা?
— যা দেখে তাই চাই। অনাথ আশ্রম থেকে এক কথায় খুড়ি বাড়ির বৌ করে এনেছিল। চোখের সামনে রায়দের দেখে সাহাদের সামান্য সংসারে ওর মন টিঁকত না। শেফালির বড় লোভ, বড় উচ্চাকাঙ্ক্ষা!
— কেন, কেন?
— আমাকে কি বলে জানিস? লালিবউদি, তোমার কত চেনাজানা। গৌরীর জন্য জামাইয়ের মত একটা ছেলে দাও না, পড়াশোনা জানা বড় ঘরের। গৌরী বনিকে নিজের দিদির মত ভালোবাসে।
ও-প্রান্তে বনির গলায় হাল্কা হাসি। সে বলে — গৌরী গ্র্যাজুয়েশনের পর বিএড করছিলো। শেষ হয়েছে?
— হয়েছে। এখন একটা মন্তেসারিতে ঢুকেছে। সামান্য মাইনে।
— পারুলের খবর কি? বেশ দেখতে হয়েছে।
— শেফালি সেটা ভালোই জানে।
এবার বনির শব্দ করে হাসি।
— তোমার মাথা খারাপ। সেইজন্যই কি ওদের তুলে দিলে?
— টাকারও দরকার ছিল। আজকাল প্রোমোটারদের জমি বাড়ি দিলে অনেক পয়সা।
— অ্যাডভানস দিয়েছে?
— না। পনেরো দিনের মধ্যে দেবে বলেছে।
পনেরো দিন পেরিয়ে একমাস। আশিসের টিকি নেই। জানুয়ারির শেষে আশিস না বলে দিল। আশিসের ‘না’ বলায় অবিনাশ একটু দমে যায়, বিরক্ত হয়। কিছুদিন সব স্থগিত রাখে।
সেদিন রবিবার। বাইরের ঘরে অবিনাশ খবরের কাগজ হাতে বসে। কাজের মেয়ে মঞ্জু ছিল রান্নাঘরে। হঠাৎ মঞ্জুর উঁচু গলা শোনা যায়, কী ইঁদুরের রাজ্যি হয়েছে জ্যেঠিমা! ইঁদুর মারার বিষ দাও। কল পাতো। যত রাজ্যের ছুঁচো ইঁদুর কি তোমার ঘরে!
গেট খুলে ধোপা ঢুকছিল। কাপড়ের গাঁটরিটা সামলাতে সামলাতে বলল, এদিকটায় কী বড় বড় ঘাস হয়েছে! দুটো চারটে বিছুটিগাছও আছে।
অবিনাশের ছুটির দিনের তাল কেটে যায়। সে হাতের খবরের কাগজ টেবিলে মুড়ে রেখে বাইরে বেরোনোর জন্য তৈরি হয়। বেরোনোর আগে লালিকে বলে যায় যে ফিরতে দেরি হবে। সে সুরেশের সাথে দেখা করে তবে ফিরবে।
সুরেশ এলো পরদিনই। ঘুরে ঘুরে, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পুরোটা সুরেশ দেখল। রঙ চটা দেওয়াল, ছাদের কড়ি-বরগা, জানালায় মেহগনি কাঠের খড়খড়ি। জমির জ্যামিতিক অবস্থান, বাস রাস্তা, বাজার থেকে দূরত্ব। অবিনাশ সুরেশের চকচকে চোখ খেয়াল করে। ঝোপ বুঝে কোপ। প্রদীপ দত্ত আটত্রিশ লাখ নিয়েছে। অবিনাশ সাঁইত্রিশ লাখ দাম হাঁকাল। অবিনাশকে আশ্চর্য করে সুরেশ ছত্রিশ লাখে বাড়ি নিতে রাজি হয়ে যায়।
খুশিতে লালির ফেটে পড়ার অবস্থা। সে কোনদিনই অবিনাশের পৈতৃক সম্পত্তিকে গুরুত্বের নজরে দেখেনি। দেরি হলেও আজ মনে মনে স্বীকার করে, বাবা বিয়েটা খোঁজখবর নিয়েই দিয়েছিলেন।
সুরেশের সাথে চুক্তি হল, এপ্রিলের মধ্যে টেন পারসেন্ট অ্যাডভানস দেবে। জুনে ফিফটি পারসেন্ট ডাউন পেমেন্টের পর কাজ শুরু হবে। বাড়ি ভাঙা থেকে নতুন ফ্ল্যাট, দশ মাসের প্রোজেক্ট। বাকি ফরটি পারসেন্ট কাজ শেষ হওয়ার পর। এছাড়া দেবে দুটো ফ্ল্যাট। হাজার স্কোয়ারফিটের। মুখোমুখি। দোতলায়।
তিনলাখ টাকা আরও বেশি দাম। লালি আবার বনিকে এক ঘণ্টা ধরে ফোন করে।
— তোর বাবা বলেছে, এইবার আমরা সত্যি অ্যামেরিকা বেড়াতে যাব।
— দেবে তো শেষমেশ? আশিসের মত না করে!
— না রে। ছেলেটা ভালো। বাড়ি ওর পছন্দ হয়েছে।
— মা, তুমি আড়ালে সবসময় দাদুকে নিষ্কর্মা বলতে।
— কী করি বল! দেখতে গেলে কথাটা তেমন মিথ্যে নয়। জমি কিনে বাড়ি করেছিল তোর বাবার দাদু নিখিলেশ রায়। তোর দাদুর ছিল শুধু তাসের নেশা। ওই তাসের কারণেই বীরেশরা এ বাড়িতে ঢোকে। গায়ের পাশে উৎপাত। সারাজীবন শেফালির জ্বালা সহ্য করলাম।
— ছাড়ো তো কাকিমার কথা। দেখো, ফ্ল্যাটের মেটিরিয়াল যেন ভালো দেয়। বাবাকে বলবে মেটিরিয়াল লিস্টে সুরেশের সই নিয়ে নিতে। যাক বাবা, সামনের বার নতুন ফ্ল্যাটে হাত পা ছড়িয়ে এনজয় করা যাবে।
— সেইজন্যই তো ফ্ল্যাট নেওয়া। দক্ষিণ খোলা দুটো ফ্ল্যাট। হুহু করে হাওয়া। একটাতে আমরা দুজন, অন্যটাতে তালা দেওয়া। যখন যে আসবে সে থাকবে, তুমি বা অভি। আমাদের অবর্তমানে ভাগ বাঁটোয়ারাতেও সুবিধে হবে। একটা তোমার, একটা অভির। তোমার অবশ্য শ্বশুরের দোতলা বাড়ি আছে। জামাই তো এক ছেলে।
— সে তো অভিও শ্বশুরের সম্পত্তি পাবে। এক মেয়ে দেখে অভির বিয়ে দিও।
— তাই দেবো। ছেলে এঞ্জিনিয়ার। তিনবছর চাকরি করলো। বিদেশ যাচ্ছে এমবিএ করতে। দোতলা বাড়ির একমাত্র মেয়ে দেখে ছেলের বৌ আনবো।
সুরেশ কথা রেখেছে। অ্যাডভানসের টেন পারসেন্ট দিয়ে গেছে। অবিনাশ নিশ্চিন্ত। বাড়ি বিক্রির কাজ শেষ।
লালির এখন অপেক্ষা। আর কয়েক মাস পরেই নতুন ফ্ল্যাট, নতুন প্রতিবেশী। সবই ঝকঝকে তকতকে। গতকাল মঞ্জু চেঁচাচ্ছিল। লালি নিজেও দেখেছে। বাড়ির সামনের ঘাসগুলো বড্ড বড় হয়েছে। শেফালিদের উঠোন আগাছায় ভর্তি। বেড়ার পাশে বুনো ঝোপগুলো মাথা চাড়া দিয়ে বেড়ে উঠেছে। লোক ডাকলেই কেটে দিয়ে যাবে। আর লালির তহবিল থেকে কড়কড়ে কতকগুলো নোট পাখা মেলে উড়ে পালাবে। তবে ডাকবে কে? অভি তো চলে গেছে। সে আর অবিনাশ শুধু। অবিনাশকে দিয়ে তো আদ্দেক কাজ হয় না। এই যেমন, পাঁউরুটি ফুরোলে দোকানে যাওয়া, তেলেভাজার পর ডায়ভল, দুটো পান বেশি খেলে অসময়ে পানপাতা, মঙ্গলবারের টাটকা ফল। লালির আজকাল মঞ্জুই ভরসা। তবে মঞ্জুরও চাহিদা বেড়ে গেছে। কথায় কথায় লালির কাছে ধার চায়। ভরসার বিনিময়ে দাক্ষিণ্য! কি সাহস মঞ্জুর! লালিকে মুখ নাড়া দেয়। এই সেদিন কেমন সাত কথা শোনালো!
শেফালি বৌদিদের ওঠালে কেন?
ওরা বাপু তোমাদের বাগান জমি পরিষ্কার রাখতো।
প্রতি সপ্তাহে নিজে হাতে আগাছা কাটতো। সকাল বিকেল ঝাড়ু দিত।
লালির আর সহ্য হয়নি। বলেছিল, তুই ঝাড়ু দিলেই পারিস!
মঞ্জুর জবাব, মাইনে বাড়াও। দিয়ে দেব। রোজ। দুবেলা।
লালি আর ঘাঁটায়নি। আর তো কটা দিনের মামলা। সুরেশই আগাছা ওপড়াবে। বাড়ি ভাঙবে। নতুন দেওয়াল গাঁথবে।
লালি মনে মনে ভেবে রেখেছে, নতুন ফ্ল্যাটে নতুন কাজের লোক রাখবে। মঞ্জুকে আর নয়। মঞ্জু বড্ড মুখরা আর সাহসী, ঠিক শেফালির মত।
সাহসীই বটে। গতকাল অত বড় বিছেটাকে কেমন মারলো! আধ হাত লম্বা লালচে কমলা রঙয়ের! রান্নাঘরের পাশের ছাইদানায় কিলবিল করছিল। কোথা থেকে এসেছিল কে জানে! মঞ্জু চিৎকার করেছিল তবে ভয় পায়নি। মঞ্জুই এক গামলা গরম জল বিছেটার শরীরে ঢেলে দেয়। বুক ওলটানো মরা বিছেটাকে দেখে লালির শরীর ঘেন্নায় গুলিয়ে ওঠে।
পনেরোই জুন থেকে মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে। তিরিশে জুনের মধ্যে সুরেশের পঞ্চাশ পারসেন্ট দেওয়ার কথা। সুরেশ জানিয়ে দিল, হবে না। সে পারবে না তিরিশে জুনের মধ্যে। কাজ শুরু করতে দেড় মাস দেরি হবে। অবিনাশ দমে গেল, চিন্তিত হল। তবে মনোজের কাছে গেল না। অবিনাশকে সুরেশের জন্য অপেক্ষা করতেই হবে। টেন পারসেন্ট যে নেওয়া হয়ে গেছে! এবং খরচাও হয়েছে, অভির টিকিট নিতে।
সকাল থেকে টানা বৃষ্টি চলছে। সন্ধে গড়িয়ে বাইরে এখন ঘুটঘুটে অন্ধকার। বিকেল থেকে অবিনাশের তিনপ্রস্থ চা হয়ে গেছে। টেবিলের ওপর পড়ে থাকা কাপে চায়ের শুকনো মোটা দাগ। লালি সোফায় পা তুলে বসে আছে। তার হাতে কুরুস-কাঁটা, কপালে বিরক্তির ভাঁজ। কবে যে সুরেশ টাকা দেবে! বাড়ির কাজ শুরু হবে!
উল্টোদিকে চশমা চোখে অবিনাশ। তার হাতে খোলা রামকৃষ্ণ কথামৃত। সে বই পড়ছে কি পড়ছে না বোঝা দায়। তার মুখ কালো থমথমে।
অবিনাশ গিয়েছিল প্রেশারের ওষুধ কিনতে। কম্পাউন্ডার ছেলেটি খবরটা দেয়। বীরেশ সাহার ডেঙ্গু হয়েছে, সাঙ্ঘাতিক অবস্থা।
লালিকে না জানিয়েই অবিনাশ ছাতা মাথায় খালপাড়ে চলে গিয়েছিল। সাহায্যের মন নিয়ে। কিন্তু শেফালির বেপরোয়া ঔদ্ধত্য! এক কাপ চা অবধি দেয়নি। জ্বরে অচৈতন্য বীরেশ মড়ার মত শুয়েছিল। মেয়ে দুটো জ্যেঠুর সামনে পর্যন্ত আসেনি। অবিনাশ আর পকেটে হাত দেয়নি। গম্ভীর মুখে বেরিয়ে এসেছিল।
লালি বলল, কলতলা জুড়ে ঘিনঘিনে কেঁচো। ঢুকতে বেরোতে গেটের পাশে কেন্নোর আন্ডি। আর পারা যাচ্ছে না।
অবিনাশ শুনলো তবে উত্তর দিল না। সেও নিরুপায়। সময়রেখা পুরোটাই নির্ভর করছে সুরেশের ওপর।
লালি আবার বলল, ওদিকটা আগাছায় ভরে গেছে। উঠোনের ঘাসগুলো হাঁটু-সমান উঁচু। লোক ডাকিয়ে পরিষ্কার করা দরকার।
এতক্ষণে অবিনাশের মুখে তেতো হাসি। সে বলে, তুমি তো সারাজীবন শেফালিকে গাল দিলে।
সাথে সাথে লালির গলায় ধার, মানে?
— মানে ওদিকটা শেফালি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখত। বিনি পয়সায়। কোনদিন ঘুরে দেখারও দরকার পড়েনি।
— নিজে বাস করতো তাই সাফ রাখতো। তোমার বাড়ি পরিষ্কার করে সমাজসেবা করত না।
— ওই হল। তোমার প্রয়োজন তো মিটে যেত।
এবার লালির বাঁকা হাসি। সে বলে, শেফালির জন্য তোমার এত দরদ কেন? আজ তিরিশ বছর ধরে দেখছি। শেফালির হয়ে তোমার লড়াই।
লালির কথায় অবিনাশ সন্ত্রস্ত হয়ে ওঠে, একটু যেন টান টান। সে ঋজু গলায় বলে, শেফালি নয়। বীরেশ। পরেশকাকু ও খুড়ির একমাত্র সন্তান। তাছাড়া চোখের সামনে মেয়ে দুটো জন্মালো।
লালি ঝাঁঝালো স্বরে বলে ওঠে, তাহলে ওঠালে কেন? সুরেশেরও পয়সা দেওয়ার নাম নেই। বাড়ি তো ভেঙে পড়ার উপক্রম। পকেটের পয়সা দিয়েই সারাতে। নিজেরটুকু আর ভাড়াটেদেরও। আমিও ইঁদুর বিছের উপদ্রব থেকে বাঁচতাম।
অবিনাশ হতাশা ভরা গলায় বলে, বীরেশদের উঠিয়েছি তোমার পরামর্শে, তোমার কথার জ্বালায়। তাছাড়া আমিও তো রিটায়ার্ড হতে চলেছি। পয়সার সত্যি প্রয়োজন আছে।
দুজনেই চুপ করে যায়। গ্র্যান্ডফাদার ক্লকে বাজে, টিক টিক টিক।
আবার ঝেঁপে বৃষ্টি আসে। দুরন্ত হাওয়ায় পরদাগুলো ফুলে ফেঁপে ওঠে। খোলা দরজা জানালার পথে প্রবল বৃষ্টির ছাঁট ঘরে ঢুকে পড়ে। কুরুস কাঁটা রেখে লালি তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়ায়। সে ক্ষিপ্রগতিতে বৈঠকখানার জানালা দরজার পাট ভেজায়। তারপর অভির ঘর বনির ঘর হয়ে শোয়ার ঘরে ঢুকে সুইচ টিপতেই উজ্জ্বল আলো চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। শোয়ার ঘরের জানালার দিকে পা বাড়িয়েই লালির গলা চিরে তীক্ষ্ণ আর্তনাদ বেরিয়ে আসে। লালির আর্তনাদ শুনে অবিনাশ হন্তদন্ত হয়ে ছোটে শোয়ার ঘরে। সে শোয়ার ঘরের পরদা ঠেলে ভেতরে ঢুকে দেখে, লালির মুখে হাত চাপা আর চোখে রাজ্যের আতঙ্ক। লালির চোখ অনুসরণ করে অবিনাশের দৃষ্টি চলে যায় জানালার পাশে ঘরের কোনে। সেখানে এক মোটা কালো দড়ির পাক। মেঝের কম্পন, হঠাৎ আলোর ঝলকানিতে পাক খুলতে শুরু করেছে। প্রায় ছ-ফিট লম্বা। কালো দড়ি বুকে ভর দিয়ে মাথা তুলছে। আধ হাত লম্বা, বিঘৎখানেক চওড়া। ডায়ে বাঁয়ে সামান্য হেলছে দুলছে। লিকলিকে চেরা জিভ ঢুকছে বেরোচ্ছে।
লালি ফিসফিস করে বলে, কোথা থেকে এলো?
অবিনাশ নিঃশব্দে জানালার দিকে তাকায়। প্রবেশপথ সুস্পষ্ট। ন-দাদু, খুড়ি, বীরেশ, শেফালির প্রতিদিনের ব্যবহৃত উঠোনের ওপর দিয়ে, এঁকে বেঁকে, নাতিউচ্চ দেওয়াল পেরিয়ে, জানালার গরাদ বেয়ে ঘরের মেঝেয়। তারপর চুপচাপ এককোণে।
লালির মনে চিন্তার দুরমুশ —
শেফালিকে বার করতে গিয়ে এ কি বিপদ ঘরে এসে ঢুকলো!
গন্ধরাজ কুঁড়ির ছুঁচ যে বিষদাঁতের কামড়ের থেকে ঢের ভালো ছিল!
নিষ্ফল আক্রোশে হাতের আঙুল মুষ্টিবদ্ধ করতে করতে লালি বোঝে, অবুদার দেওয়া নিরাপত্তার ঘেরাটোপ থেকে শেফালি চলে গেছে। তবে যাওয়ার সময় বেপরোয়া শেফালি তার চিরকালের জ্বালানে স্বভাবমত সাথে করে নিয়ে গেছে লালির নিরাপত্তাটুকুও।
পরিত্যক্ত উঠোনে, বাগানে, ঝোপঝাড়ে বাসা বেঁধেছে ছুঁচো, ইঁদুর, বিছে, কালো দড়ি।
লালি অবিনাশের নতুন প্রতিবেশী।