• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৬৪ | সেপ্টেম্বর ২০১৬ | গল্প
    Share
  • আনুর গপ্পো : নিবেদিতা দত্ত


          নাই বানাই,
    মেল করতে দেরি হয়েছে বলে ‘সরি’ বলেছ,-কাউকে ভালবাসলে সরি বলার দরকার নেই, কেমন! লিখেছ এমন হাট তোমার এখনও অব্দি দেখা হয় নি, তাই মনে মনে ওই থার্সডে মার্কেটে বেড়াতে তোমার বেশ লেগেছে। হ্যাঁ, ওই মার্কেটের নাম-ই হোল তাই। আর জানিয়েছ প্রিন্সটনে হ্যালোইন উৎসবও ভালো করে খেয়াল করোনি। তাহলে এ দুটো ব্যাপারে তোমাকে লিখে ভালোই করেছি। আমি ভাবছিলাম কি জানি তুমি তো কিছু বছর ও দেশে ছিলে, হয়তো তোমার এসব ভাল জানা আছে।

    এই মেলে তোমাকে একটা ঘটনার কথা জানাবো যা হয়তো খুবই সাধারণ কিন্তু আমার মনে তা ভারি দাগ কেটেছে। একবার ভোর সাড়ে চারটেয় তোমার দাদু গেলেন খড়্গপুর থেকে ভুবনেশ্বর কাজের সুবাদে। ওনাকে চা করে দিয়ে রওনা করিয়ে গেট বন্ধ করছি, মুখ তুলে দেখলাম আবছা অন্ধকারে ফিঙে মশাই কেবেলের তারে বসে আছেন। ঘরের ভিতর তখনো খুব গরম অথচ বাইরেটা কি সুন্দর ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা ভাব। তাই ভাবলাম বারান্দায় একটু ঘুরে নিই কিন্তু খানিক পরে বাগানের দিকে চোখ পড়তেই দেখলাম সে এক আরো সুন্দর ব্যাপার! হাল্কা ছাই ছাই রূপোলি পুব আকাশে আলো ফুটছে, তার গায়ে তখনো কটা জ্বলজ্বলে তারা। পশ্চিম দিকে অর্কদের কাঁঠালগাছ আর আমাদের কদমগাছের মাঝামাঝি চাঁদ তখনো সোনালি। বাগানে গাছের, ঝোপঝাড়ের হাল্কা ছায়া পড়ছে মাটিতে। সত্যি বলতে কি মা দুগগার সন্ধি পুজো আমি দেখিনি, সবাই বলেন সে সময়টা মহান। কিন্তু প্রকৃতির এই ঊষা-নিশার সন্ধিকাল কত সুন্দর, কত মহান তা তোর এই ছোটো বয়সে হয়তো বোঝা সম্ভব নয়,-মণি মুক্তোর চেয়ে দামি এই ক্ষণ রেখে গেলাম তোর বড় হয়ে ওঠার জন্য।

    আনু তোকে একবার বিহারের কথা লিখতে গিয়ে বলেছিলাম ভোরবেলার সাদাটে মরা চাঁদের কথা, আর বলেছিলাম গরমকালে আমাদের খুব ভোর ভোর উঠতে হ’ত। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে মা ডাকাডাকি করলেও আমরা দেরি করেই বিছানা ছাড়তাম কারণ দেখছি চাঁদ সাদাটে হয় আরো বেলায়। এইমাত্র বাইরে বেরিয়ে দেখে এলাম চাঁদ ফ্যাকাশে হ’তে শুরু হয়েছেন, ঘড়িতে বাজে পৌনে ছটা। আর বিহারের গরমকালে এই সময়টা অনেকটাই বেলা হয়ে যাওয়া।

    আমার মন উজাড় করা ভালবাসা দিলাম তোমায়।

                                                                —দিম্মা

    স্নেহের

          আন্তাবিল,

    যারা কোনো ধরনের চাকুরি করেন তাদের কাছে তাদের চাকুরিস্থল শুধু কাজের জায়গাই বোধহয়, চারপাশের অনেক কিছুই তাদের চোখে পড়ে না। বা হয়তো সে জায়গাকে বিশেষভাবে দেখার সময় থাকে না তাদের। সব সময়ই তারা বোধহয় ভাবেন কেমন করে আরো ভালভাবে নিজের কাজ করা যায় বা কাজ টিকিয়ে রাখা যায়। কিন্তু আমার মতো ভবঘুরে মন, নেই কাজ মানুষের চোখে আশপাশটা সব সময় অন্যভাবে ধরা দেয়।

    আমি তো মাত্র মাস দুয়েক বার্কলে শহরের ওয়ালনাট স্ট্রীটে থেকেছি। আমি জানি সেখানকার কেউই আমাকে মনে রাখেন নি। কিন্তু ওখানকার টুকরো টুকরো ছবি আমার মনে হঠাত হঠাত ধরা দেয়। ওখানে নিজের মনে ফুটপাথ ধরে বেড়াতাম। কখনো দেখেছি ঘন ঝোপ-ঝাড়ে গোল বাটি দোলনায় কাঠবেরালিবাবু মুখ বাড়িয়ে দেখছেন। মনে পড়ছে বেবে নামে লাল কোট পরা এক মহিলাকে, বয়স তার আমারই মত।(ওখানে আমাকে কেউ হ্যালো বললে আমি তার সাথে নিজে আলাপ করতাম)। একটা ছোট লোম ওয়ালা কুকুরকে ঘোরাতেন। বলেছিলেন উনি একজন কেয়ার গিভার-এক বৃদ্ধার দেখাশোনা করেন।(‘কেয়ার গিভার’ কথাটা কি সুন্দর তাই না আনু? আমরা বলি কাজের লোক, আয়া। আর বাড়ীর মা কাকীমা যারা কাজ করেন না তাদের বলি হাউস ওয়াইফ। ওরা বলে ফ্যামিলি কেয়ার গিভার -কত শ্রদ্ধা আছে কথাটায়)। বেবে খুব অবাক হয়েছিলেন আমি কোনো চাকুরি করি না জেনে।

    আন্দ্রেই নামে এক ভদ্রলোক থাকতেন পার্কের কাছে। দেখা হলে দুটো একটা কথা হ’ত। আমি বিদেশিনি, মন ভরে যেত।

    দেশে ফিরে আনমনে কত কি মনে পড়ে। বাড়ির কাছেই রাস্তার কোণে বিখ্যাত পিট-কফি-শপের কড়া কফির গন্ধ পাই, দেখতে পাই কেউ দোকানের সামনে গিটার বাজাচ্ছেন। ক্রিসমাসের সময় ছিল তখন, সন্ধ্যেবেলা আইসিকলের (বরফের জমা টুকরো) মত দেখতে প্ল্যাস্টিকের আলো, আর টকটকে লাল পনসিটিয়ায় সাজানো দোকানপাট, চোখ জুড়ানো ছোট ছোট সাদা আলোয় সাজা গাছপালা-সব সঅব ফিরে আসে মনে।–বার্কলে আমার কাছে সন্ধ্যাতারার মতই উজ্জ্বল। বা মনের কৌটোয় পুরে রাখা একটা খুব দামি রত্ন, মাঝে মাঝে ঢাকনা খুলে চেয়ে থাকি তার দিকে।

    শুধু বার্কলে কেন, আমাদের খড়গপুরও আমার কাছে পান্নার গহনা পরা এক সবুজ পরী। এখানকার গাছপালা ঘেরা পথঘাট দেখে দেখে আমার আর আশ মেটে না। মনে পড়ে ইলা বসুর গাওয়া অনেক পুরনো এক গানের কলি-তবু তাই কি কখনো হয়, লতা কি পান্না পরে রয়; আহা গানের মাধুরী সুন্দর করে কত না মধুর মিছে কথা। আনাই কথাগুলো কিছুটা অন্যও হতে পারে, তবে তোর কাছে যখন মন উজাড় করে গল্প করি অতো নিখুঁত ঠিকের ধার ধারি না আমি। ভালবাসা জেনো।

                                                                —দিম্মা

    আনু,

    আমি ভাবতেই পারিনি মন-ছবিগুলো তোর এত ভাল লাগবে। লিখেছিস আরো এমন কিছু মেল করে পাঠাতে। বেশ তাই পাঠাচ্ছি। কত কিই তো মনের ঘরে জমা হয়ে থাকে নাড়াচাড়া করি আবার গুছিয়ে রাখি, তোর মত শোনার মানুষই বা কোথায়! আদর জেনো —দিম্মা
    আনু পানু,
    লিখেছিস মনের কথা বলার লোক খুঁজতে বেরোবি আমার জন্য,-তাই কি হয় রে! ও আমার তুই একজন আছিস এই অনেক। জোট বেঁধে আরো কটা ছবি ভিড় করেছে মনে। এই মেলে তাই ওদের কথা বলে নিই।

    যখন বাবা উত্তর বিহারে ছিলো তখনকার কথা। আমি একদিন নরকটিয়াগঞ্জের বাড়ির সামনের খোলা জায়গাটায় আনমনে ঘুরছিলাম। হঠাত ফিরে দেখি নীইল আকাশের গায়ে রূপোলি বরফে ঢাকা হিমালয়ের কোন চূড়ো। সেই যেমন মেলায় ছবি তোলার স্টলে পাহাড় পর্বতের সিনারি দেওয়া পর্দা থাকে অনেকটা ঠিক তেমন-আকাশটা ক্যাটক্যাটে নীল, বরফ যত সাদা হ’তে পারে।–যেন কোনো সদ্য ছবি আঁকিয়ের হাত পাকানোর চেষ্টা। দেখে সেই যাকে বলে থ মেরে যাওয়া তাই হয়েছিল আমার। তখন বয়স ছিল কুড়ি, আজ ষাটে সেই একই চমক লাগে ওই বরফ চুড়োর কথা ভাবলে।

    আমি পুলিশের মেয়ে বলে বাবা বরাবর একটু ভয়ে থাকত। আমাদের বলত কোথাও একা না যেতে। কখন কোন চোর ডাকাত সুযোগ নিয়ে নেয় বলা তো যায় না।–আমি কিন্তু শুনতাম না বাবার কথা। একদিন বাগাহা থানায় বেড়াতে বেড়াতে জলের গর্জন শুনে থানার পিছন দিকে দেখি এক অতি ব্যস্ত হৈ হৈ করে বয়ে যাওয়া নদী। বিশাল বিশাল গাছ নদীটাকে ঘিরে রয়েছে, দিনের বেলাও অন্ধকার। আলো থেকে সেই হঠাত আঁধার বিদ্যুৎ এর আলোর মতই চোখ ধাঁধিয়ে দিয়েছিল। পরেশনাথ পাহাড়ে উঠতে একটা ঝর্ণা দেখেছিলাম। তার জলের আওয়াজে হাজার হাজার ঘুঙুরের শব্দ। সে শব্দ আজো জোরালো হয়ে মনে বাজে।

    দ্যাখ আনাই, মন কত জোরেই না ছুটতে পারে। টেনে নিয়ে চলল আমায় উত্তর বিহার থেকে সেইই সূদূর বার্কলে। আর একবার দাঁড়িয়ে আছি ওয়ালনাট স্ট্রীটের কাছে সি, ভি, এস ফার্মেসির উল্টো দিকের ফুটপাথে। সোজা চরাই ধরে উঠছি রোজ স্ট্রীটের দিকে, সেই যেখানে রোজ আর আর্চ স্ট্রীটের তেমাথা। আর বাড়ির ফাঁকে আরেকবার দেখতে পাচ্ছি রূপোলি বে-এরিয়া। সূর্যের আলো সেখানে সাদা আর জল রূপোলি ছাই রঙের। সেখানেই বছর খানেক আগে মনে হয়েছিল এক ছুট্টে পৌঁছে যাব জলের ধারে। কিন্তু এক পোষ্টমাষ্টারমশাইকে জিগেস করাতে তিনি হেসে বলেছিলেন বে সেখান থেকে অনেক অনেক দূর!

    —এই ছবিগুলো আমার মনে ঝলকে ঝলকে ফিরে আসে। বলতে ইচ্ছে করে ‘দে ফ্ল্যাশ আপন দ্যাট ইন ওয়ার্ড আই/উইচ ইজ দ্য ব্লিস অফ সলিচিউড’।

                                                                —দিম্মা

    আনাই,

    তোকে সরি বলতে মানা করেছি তাই আমিও তা বলতে পারছি না। কিন্তু একটা বড় ভুল তো করেই ফেলেছি। যেটা তুমিই দেখিয়ে দিয়েছ মানে জিগেস করে। এখন তো তুমি অনেক ছোট-ওয়ার্ডসওয়ার্থ পড়াই হয়নি। তাই ‘দে ফ্ল্যাশ আপন দ্যাট ইন ওয়ার্ড আই/উইচ ইজ দ্য ব্লিস অফ সলিচিউড’ কথাগুলোর মানে তুমি বুঝতে পারোনি। যাকগে, লিখেই যখন ফেলেছি মানেটা বুঝিয়ে দিই তাহলেই হবে কি বলো? আনু অনেক সময় অনেক পুরনো সুন্দর ঘটনা সেই অবিকল আমাদের মনে পড়ে যায়। যেন আমাদের মনের ভিতর আর একটা চোখ আছে যা সেই কবেকার ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো আর একবার দেখতে পাচ্ছে। সেই মনের চোখটাকেই বলতে পারি ‘ইন ওয়ার্ড আই’। কবি বলেছেন ‘দে ফ্ল্যাশ আপন দ্যাট ইন ওয়ার্ড আই/উইচ ইজ দ্য ব্লিস অফ সলিচিউড’। মানে মনের চোখ দিয়ে এই দেখা আমাদের একা থাকাকে আনন্দে ভরিয়ে দেয়।
                                                                —দিম্মু
    পুনঃ- এই মন-ছবিদের সাথে আরো দুজন ভিড় জমিয়েছে, যাদের কথা ভেবে তুই খুব মজা পাবি। তখন আমরা ডা্লটনগঞ্জে। আমার বয়স বোধহয় চার কি পাঁচ হবে। মা ঝাঁটা দিয়ে একটা লাল টুকটুকে কুলে লঙ্কা উঠানে ফেলেছিল। দুপুরবেলা পা টিপে টিপে উঠে সেটা চিবিয়ে খেয়েছিলাম, আর তারপর তো বুঝতেই পারছ দিম্মার হাল। টুলের ওপর চড়ে তাক থেকে তেঁতুল পেড়ে মুখে ঘষছি, চিনি খাচ্ছি। শেষে মার পিটুনির ভয়ে এক ছুট্টে বাবার কাছে থানায়। বাবার হাত ধরেই বাড়ি ফিরেছিলাম। আরও বড় বয়সে, তখন কলেজে পড়ি, একবার আমি বাড়ি ফিরছিলাম ছুটিতে। বাবা উত্তর বিহারে। সমস্তিপুরে নেমে ছোটো ট্রেনে কিছুটা যাওয়ার ছিল। তারপরও গাড়িতে আরও দশ মাইল। বাবা আমাকে নিতে এসেছিল একটা অ্যাম্বাসাডার গাড়ি নিয়ে। রাত তখন অনেক, খানিক গিয়ে গাড়ি হ’ল বিকল। বাইরে তাকিয়ে বুঝতেই পারছিলাম দুদিকে ক্ষেত, দূরে হয়তো কোনো গ্রাম। আছে কি নেই তাও বোঝা যাচ্ছে না। বাবা তো ড্রাইভারের মুণ্ডপাত করাতে সে বেচারা ছুটল অদৃশ্য সেই সব গ্রামের খোঁজে। খানিক পরে দেখি দূর থেকে একটা টিমটিমে আলো যেন লাফাতে লাফাতে আসছে। কাছে আসাতে দেখলাম এক চৌকিদার লণ্ঠন ও লাঠি হাতে হাজির।–তার ছোটাতেই আলো ওপর নীচ হচ্ছিল। হুকুম হ’ল তক্ষুনি যেন একটা বয়েল গাড়ির ব্যবস্থা হয়। এল বয়েল গাড়ি- অ্যাম্বাসাডারকে দড়ি দিয়ে বাঁধা হ’ল তার সাথে। তারপর এই অবাক করা ব্যবস্থাপনায় গরুর গাড়ি টেনে নিয়ে চলল আমাদের চার চাকার যান। ভোরের আলো ফুটতে পৌঁছলাম বাড়ি। কি জানি, একটুও বিরক্ত হই নি রে আনু, দারুণ লেগেছিল ব্যাপারটা।
                        —দিম্মা





    স্নেহের

            আনু,

    আজ কত-কত্তদিন বাদে তোমাকে মেল করছি। আমি জানি তুমি অভিমান করেছ, তাই একেবারে চুপ আছো। মামের কাছে জানলাম তুমি নাকি একটা বিড়াল পুষেছ? ‘টম অ্যান্ড জেরি’ না দেখলে নাকি তুমি খেতেই বসো না? তাহ’লে তো তুমি মাসিমণির দলেই হ’লে। আমার দলেও বটে! তা পরের মেলে জানিও কি নাম রাখলে তোমার পুষির। ইচ্ছে থাকলেও আমাদের তো কিছু পোষা হয়ে ওঠে নি।

    সেদিন কি হয়েছে জানো, বিকেল হব হব, আমি মাসিমণির চুল বেঁধে দোব বলে চিরুণি হাতে জানলার কাছে দাঁড়িয়ে আছি। দেখি কি মজার কাণ্ড—পিছনের লনে দুই বিড়ালছানার কি খেলা! চুপি চুপি মাসিকেও ডেকে নিলাম—না দেখতে পেলে সেতো খুবই দুঃখ পেতো। তুমিও বোধহয় পাচ্ছ, কি করব বলো, সে সময় হাতের কাছে ক্যামেরাটা ছিল না। তা দেখি একটা ছাই-ছাই রঙের বিড়ালছানা, খুব সুন্দর মোটা লোম ভর্তি ল্যাজ তার( ওই রঙের মোটাসোটা ভব্যিযুক্ত একটা হুলোও আমি দেখেছি বাগানে ঘোরাফেরা করতে-ও-ই বোধহয় ওর বাবা) আর একটা সাদা কালোতে রোগা পাতলা মত পুষি খেলায় মত্ত। সাদা কালো একটা বড় মেনি বিড়ালও আছে বাগানে। ওদের মা-ই হবে-দুধ খাওয়া নিয়ে খুব ঝটাপটি লাগে ওর সাথে এই দুই ছানার। দেখলাম দুজনে গুড়ুগুড়ু এগোচ্ছে একে অন্যের দিকে, কাছাকাছি হতেই আচমকা এক লাফ, কিন্তু কেউই কাউকে ধরতে পারছে না। লনের উপর কিছু টব ও পাথর বসানো ছিল, তার পিছন থেকে উঁকি মারছে, ভাবটা ‘টু---কি আমায় ধরতে পারে না’ গোছের। অনেকক্ষণ ধরে এই খেলা চলল, তারপর আরও একটু ঘন ছায়া হতেই দুজনে বোধহয় ক্লান্ত হয়ে বেড়ার ফাঁক দিয়ে পাশের বাড়ি চলে গেল। আচ্ছা আজ এই অব্দি কেমন!

                        —দিম্মা

    পুনঃ- আনু, এইমাত্র কমপিউটর থেকে মুখ তুলেই দেখলাম এক ‘চিড়িকদাস’ কাঠবেরালি ল্যাজ উঁচিয়ে পালাল জানলার সামনে দিয়ে। বেশ লাগল।

                                                                —দিম্মা

    আনু ভাইটু,

    অনেক সময় গ্রামের মানুষদের কথাবার্তা আমাদের বাংলা বলা থেকে অনেকটাই অন্যরকম হয়। প্রথমটা তো বিশেষ বোঝাই যায় না, অনেকক্ষণ কথাগুলো মনে মনে নাড়াচাড়া করলে তবে যেন পরিষ্কার হয়। কিন্তু অনেক শব্দ না বোঝা গেলেও কেমন যেন একটা গান বা কবিতার মত মনে হয়। পুরো মানে উদ্ধার করতে পারলে তো বেশ মজাও লাগে। আমাদের সুমিত্রাদিদি বাঙালি, বিহারি না উড়িয়া আমি আজো বুঝতে পারিনি। জিগেস করলে বলে ‘আমি সব বলতে পারি-হিন্দি, বাংলা, উড়িয়া, মাতরু ভাষা’(মাতৃ ভাষা কথাটা ওর মুখে হয়েছে মাতরু ভাষা)।থাকে মেদিনীপুর জেলার দাঁতন গ্রামে। ওর গল্পই করব আজ।

    অগ্রহায়ণ মাসের পুরোটাই ওপরের ঘর থেকে শুনতে পাচ্ছিলাম ভোরবেলা সুমিত্রাদিদি মাথায় বো বাঁধা টুপি পরে উঠোন ধুচ্ছে আর দুই ছেলে বাবাই ,পাখিকে বকাবকি করছে ‘তোমরা পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছ আর দেশে ঘরে সেই রাত তিনটা থেকে কত কাজই না হচ্ছে- ধান কাটা, বিড়া বাঁধা’। —আমার তো আবার সবই জানতে ইচ্ছে তাই জিগেস করেই ফেললাম ‘হ্যাঁরে রোজ সাত সকালে কি অত বকবক করিস?’

    এক গাল হেসে বলে ‘মা দেশে ঘরে, রাত থাকতে, সেই যখন ধ্রুব তাড় পাটে বসে আমরা শু (ঘুম) করে উঠি। ঘরের চারদিকে ছন্না দিয়া ঠাকুরের ফুল আনতে যাই। তাপ্পর রান্না হয় আলুভাজা আর শাক ভাজা। ক্ষেতের মুনীষজন কেউ খায় আলুভাজা দিয়া মুড়ি কেউ বা শাক দিয়া পান্ত। বস্তা ভরে বাসন যায় ক্ষেতে, ঠেক ভরে মুড়ি, বুতলে জল। ক্ষেতে তো সারাদিন ধান কাটা হয়, বিড়া বাঁধা হয়। তাই মুনীষদের জলখাবার দিয়া অবেড়ার মুনীষদের জন্য বড় বড় উনানে রান্না হয় ভাত, কাতল মাছের ঝুল (ঝোল) আর তেঁতুল, মুলা বাগুনের টক।(আহা, শুনেই তো আমার জিভে জল)। আর মা, রাতে শিয়াল থাকতে (থেকে) পাকা ধান বাঁচাতে শু করি (শুয়ে থাকি) শ্যালুর পিছনে’।– কয়েকটা কথা না বুঝতে পারলেও আধো ভোরে অত রকম কাজের ব্যস্ততা যেন একটা গানের মত মনে হচ্ছিল আমার। অনেক ভেবে, সুমিত্রাকে বার বার জিগেস করে বুঝলাম ধ্রুব তাড় হল ধ্রুব তারা, বিড়া কাটা খড়ের গোছা, অবেড়ার মুনীষরা হলেন ওবেলার বা দুপুরবেলার মুনীষজন। শ্যালু হল শ্যালো ওয়াটারের টিউব ওয়েল যা থেকে ক্ষেতে জল দেওয়া হয়। আর ঠেক বড় প্ল্যাস্টিকের থলে।

    জানো আনু, এরপর থেকে রাত তিনটেয় উঠে ট্রেন বা প্লেন ধরার হলে আমার আর কান্না পায় না। কেবল মনে হয় দূরে অনেক দুউরে কারা সব উঠে পড়ে কত কাজেই না ব্যস্ত হয়ে পড়েছে, ওরা আমার সঙ্গী। মনে মনে খালি আউড়ে নিই ‘ধ্রুব তাড় পাটে বসেছেন, ঘরে ঘরে ছন্না দিয়ে রান্না হচ্ছে শাক ভাজা, আলু ভাজা, ক্ষেতে আধো আলোয় কাটা হচ্ছে সোনালি ধান, বাঁধা হচ্ছে বিড়া’।

                 —দিম্মা

    আনাই,

    তোর আগের মেলে জানলাম পুষি দুধ মাছ চুরি করে বলে ওর নাম রেখেছিস চোরু। তা ও নামে কি সাড়া দিচ্ছে তোমার পুষি? আর হ্যাঁ, তোকে লিখেছিলাম আমাদের কেউ পোষা নেই। মনে পড়ে গেল একজন বোধহয় আছে। খড়্গপুরের বাড়ির গেটের বাইরে নালার ওপর যে পাথরের স্ল্যাব ফেলা আছে তার তলায়ই তার বাসা। এক গিরগিটি। রোদ উঠলে মুখ বাড়িয়ে দ্যাখে। বছর খানেক ধরে ওকে দেখছি। আমরা যাওয়া আসা করলে ট্যারা চোখ পাকিয়ে থাকে। ভয় ডর আছে বলে তো মনে হ্য় না। নামী লেখক রাস্কিন বন্ডের ‘হেনরি দ্য ক্যামেলিয়ন’ পড়ার পর ওকে করেছি আমাদের ‘হেনরি’। আদর জেনো
                                                                —দিম্মা

    স্নেহের আনু,

    লিখেছিস আমার হাওয়া তোরও লেগেছে। স্কুল বাসে বসে তোর দেখতে ভাল লাগে ছোটো ছোটো চায়ের দোকানে চা-ওলা কেমন কালো তেবড়ানো প্যান আর ও্রই রকমই একটা কালোপানা মগে চা ঢালাঢালি করছে। আর কিছু লোক দাঁড়িয়ে আছে তাকে ঘিরে, কখন চা ঢালা শেষ হলে ওরা চা পাবে। তুই আমাকে জিগেস করেছিস অমন করে বাড়িতে চা হয় না কেন। বাড়িতে তো অল্প চা হয় কেটলিতে পাতা ভিজিয়ে, সেই চা ঢালাঢালি করলেই তো ঠাণ্ডা! দোকানে তো অনেকটা দুধের চা, তাই তাকে ঢা্লোপুড় করা যায়।

    একদিন নাকি ক্লাস রুমের জানলায় একটা কাক রুটির টুকরো নিয়ে বসেছিল, খুব মন দিয়ে দেখছিল তোর অঙ্ক কষা। তুই দুবার মুখ তুলে ওকে দেখেছিস আর মুখ টিপে একটু হেসেছিস তাই স্যার তোর ডেস্কে স্কেল দিয়ে ঠুকেছেন। দ্যাখ কাকটা কাক্কেশ্বর কুচকুচের কেউ হতেও তো পারে —স্যার হয়তো সেটা খেয়াল করেন নি। তবে কি জানিস কাজের ফাঁকে মুখ তুলে চারপাশটা দেখে নেওয়া কিছু দোষের নয় রে। পৃথিবীটা তো দেখেও আনন্দ! এই তো সেদিন মুম্বাইতে চায়ের দোকানের খোঁজ করতে করতে পৌঁছে গিয়েছিলাম বাবুলনাথ মন্দির। মন্দির তো দেখলাম কিন্তু তার চার পাশের বসতি (মন্দির ঘিরে ছোট ছোট এক কামরা ঘরে তাদের বাস)যেন মুম্বাইয়ের আর এক জানলা খুলে দিল। কত সাধারণ মানুষ থাকে সেই মন্দির ঘিরে। ঝকঝকে মুম্বাইয়ের ওরা যেন কেউ নয়, আবার হয়তো অনেকটাই। আরো একদিন জানলা দিয়ে দেখি সবেদা গাছের তলায় অনেকটা জল জমে আছে, নরম নরম বিকেলের রোদ পড়েছে জলে, কিছু শালিক আর ছাতারে পাখি খুব ঝটাপটি করে চান করছে। আস্তে আস্তে ক্যামেরাটা নিয়ে এসে মনে করছিলাম তোর জন্য একটা ছবি তুলব- ওমা, ওঘর থেকে এসে দেখি ভোজবাজি- সব কটা উড়ে গেছে। তাই আমার মনে হয় এমন সব ছবি একটু দাঁড়িয়ে দেখে নেওয়াই ভাল। তোর আমার মেলের গপ্পো তো এই নিয়েই। তুই আমায় বলবি তোর দেখাগুলোর কথা, আর আমার গুলো আমি বলব তোকে। আমাদের গপ্পের নটেগাছ কোনদিনও মুড়োবে না রে।

                                          আশীস দিলাম,—দিম্মা
    পুনঃ- সত্যি শেষ হওয়ার নয় বোধহয় তোর আমার গপ্পো। কি মনে পড়ছে জানিস —এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে, পাতায় পাতায় হিরে মানিকের টুকরো — দল বেঁধে রাজহাঁসেরা রাস্তা পার হচ্ছে, যেন সব রাজার সেপাই,-শুধু কাঁধে বন্দুকটি নেই- সেই-ই সুদূর ফেলে আসা প্রিন্সটনে।
                                    —দিম্মা


    অলংকরণ (Artwork) : অলংকরণঃ লেখক
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments