তখন বিকেল। আকাশে হলুদ-কমলা-লাল রঙের সেই আশ্চর্য আভা।
অবিনাশবাবু আশ্রমের দরজা খুলে বেরিয়ে এসে দরজাটা বন্ধ করে দিলেন। ক্যাঁচ করে আওয়াজ হল গ্রিলের গেটটায়।
আজ অবিনাশবাবু গেরুয়া পরেন নি। ধবধবে পাটভাঙা শাদা পাঞ্জাবী আর পায়জামা। আশ্রমের আশেপাশের লোকেরা একটু অবাক হয়েই তাকাচ্ছে। যারা পুরোনো লোক, তারা অবশ্য জানে বছরের এই একটি দিন স্বামীজি গেরুয়া পরেন না। একা একা হাঁটতে যান কোথায় যেন।
একটু যেন অন্যমনস্ক আজ অবিনাশবাবু। তাই বাঁপাশ থেকে দৌড়ে আসা বাচ্চাটাকে প্রথমে দেখতে পান নি। আরেকটু হলেই ধাক্কা লাগতো ওর সঙ্গে। শেষ মুহূর্তে দেখতে পেয়ে ব্রেক কষে থেমে নিলেন অবিনাশবাবু। বাচ্চাটাও কিছুটা পিছলে আশ্চর্যজনকভাবে না পড়ে নিজেকে সামলে নিলো।
অবিনাশবাবু দাঁড়ালেন না। এগিয়ে চললেন। মাথা নিচু, কপালে ভ্রুকুটি। কথা বলতে ইচ্ছে করছে না।
আশ্রমের সামনের রাস্তা ধরে এগিয়ে খানিকদুর গেলে একটা রাস্তা ডানদিকে ওপরে উঠে গেছে। সেটা দিয়ে উঠে গেলে জনবিরল মাঠ, তারপর বড় গাছের জঙ্গল। নিস্তব্ধ। এখানে কেউ আসে না।
জঙ্গলে ছায়া ঘনিয়ে আসছে। উঁচু উঁচু গাছের ছায়া, আর তার আনাচে-কানাচে নীরবতা বাসা বেঁধে আছে। ঘরে ফেরা পাখিদের ডাক এখনো শোনা যাচ্ছে না।
জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে গিয়ে বাঁদিকে একটা সরু রাস্তা বেরিয়েছে। সেটা দিয়ে এগিয়ে, ঝোপঝাড়ের কঠোর আঁচড় সহ্য করে হঠাৎ পৌঁছে যাওয়া যায় এক টুকরো খোলা জমিতে। তার সামনে বিশাল খাদ, খাদের ওপারে দিগন্তজোড়া পর্বতশ্রেণী, আর তার ওপারে বিকেলের রঙে ভরা আশ্চর্য আকাশ।
কারা যেন এখানে একটা বেঞ্চি পেতে রেখেছিলো কোন এক কালে। বোধহয় টুরিস্টরা সূর্যাস্ত দেখবে বলে। এখন জঙ্গলের আড়ালে এই পথটা হারিয়ে যাওয়ায় খুব কম লোকই আসে এখানে। বেঞ্চিটাও তাই ভাঙা। বসা যায় অবশ্য।
অবিনাশবাবু বসে পড়লেন। অনেকটা পথ হেঁটে এসেছেন। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘামগুলো রুমাল বের করে মুছে নিলেন। বয়েস বাড়ছে।
“এসে পড়েছিস! অনেকক্ষণ নাকি?” পেছন থেকে সন্দীপের গলা শোনা গেলো। চিরকালের মতোই প্রাণবন্ত, উচ্ছল। টগবগে একটা জীবন।
“এই তো, এই মাত্র এলাম,” আধখানা ঘাড় ঘুরিয়ে বললেন অবিনাশবাবু। তার মধ্যেই সন্দীপ লম্বা লম্বা পা ফেলে পৌঁছে গেছে ওঁনার কাছে। অবিনাশবাবুর পিঠে একটা জোরালো চাপড় মেরে নিজের লম্বা চেহারাটাকে নিয়ে শাম্মি কাপুর স্টাইলে পেছন দিক থেকে বেঞ্চি টপকে এসে বসলো সন্দীপ, চিরকালের মতন। বেঞ্চিটা নড়ে উঠলো একটু।
একই রকম আছে সন্দীপ, মনে মনে ভাবলেন অবিনাশবাবু। চেহারা একই রকম-–মেদবর্জিত পেটানো পুরুষালী দেহ, মাথা ভর্তি কালো চুল আর চওড়া হাসি--যেটা চোখের কোন অবদি ছড়িয়ে যায়। রঙিন শার্ট, যার বুকের দুটো বোতাম চিরকালের মতোই খোলা আর সারা শরীর জুড়ে প্রাণের উচ্ছ্বাস। টগবগে প্রাণবন্ত একটা জীবন। বয়েস বাড়েনি ওর।
কী করে ওঁরা দুজন এতো ঘনিষ্ঠ বন্ধু হলেন, কে জানে--ভাবলেন অবিনাশবাবু। সেই স্কুলের প্রথম দিন থেকেই ওঁরা একেবারে হরিহর আত্মা। অথচ অবিনাশবাবু চেহারায় এবং ব্যক্তিত্বে একেবারেই ওর উল্টো। নিতান্ত সাদামাটা বিশেষত্বহীন চেহারা, স্বভাবে একটু লাজুক, একটু বেশিই ভদ্র ও মার্জিত--নিপাট ভালোমানুষ যাকে বলে। কাউকে কখনো আঘাত করেন নি, পৃথিবীটাকে ভারী নরম চোখে দেখেন। এই পৃথিবীতে তার উপস্থিতি কেমন যেন নীরক্ত, ফ্যাকাসে, কিছুটা ছায়াময়।
“ওই আশ্রমেই আছিস তুই?” সন্দীপ জিগ্যেস করলো।
অবিনাশবাবু মাথা হেলালেন। সঙ্গে একটু মৃদু হাসি।
“কী যে পাস ওখানে তুই কে জানে। সুন্দরী মেয়েরা সব স্বামীজি, স্বামীজি বলে ঢলে পড়ে, সেটা খুব ভালো লাগে বুঝি?” সন্দীপ বলল।
অবিনাশবাবু মৃদু হাসলেন। সন্দীপের স্বভাবটা একই রকম রয়ে গেছে। কথা বলার লবজটাও।
“দীপু, তুই আর বদলালি না। কেমন আছিস?”
“ওহ--ফার্স্ট ক্লাস। পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরে বেড়াই, এনজয়িং লাইফ। দারুণ আছি রে।"
“সুমনার কী খবর?”
“দারুণ। এখন আবার তার অর্কিডের শখ হয়েছে। আর রান্নার শখ তো ছিলই, সেটা মাইরি পুরো শিল্পের পর্যায়ে চলে গেছে। আজকের ডিমের ডালনাটা যা টান করে বানিয়েছিল না, জাস্ট ভাবতে পারবি না। কাল রাতে আবার মাংসের ঘুগনি করেছিলো, ওপরে কাঁচা পিঁয়াজ আর লেবু দিয়ে... ” সন্দীপের কথা থেমে গেলো।
দুজনে চুপ করে সামনের পাহাড়টার দিকে তাকিয়ে রইলেন। অনেককালের বন্ধুত্ব, তাই স্তব্ধতাও কথা বলে ওঁদের মধ্যে। পাহাড়ের মাথায় তখন রঙের খেলা।
একটু পরে সন্দীপ আবার কথা বলল। এবার ওর গলাটা ভারী।
“বিনু, তুই শান্তি পেয়েছিস, রে? সত্যি কথা বল তো?”
“দিপু... ”
“বল না! পেয়েছিস?”
“পেয়েছি রে দিপু। রাগ, ক্ষোভ, দুঃখের অনুভূতি থেকে মুক্তি পেয়েছি। সেবার মধ্যে, ত্যাগের মধ্যে নিজেকে খুঁজে পেয়েছি। হয়তো তুইও কোনোদিন এই অনুভবটা খুঁজে পাবি... ”
“আমি যে শান্তি পেলাম না রে বিনু। তোর প্রতি করা অপরাধের একটা তীব্র জ্বালা আমার মধ্যে পাক খেতে থাকে অহরহ।"
“তুই কেন ওই কথা বারবার বলিস বল তো! সুমনা বরাবরই তোকে ভালোবাসতো, প্রথম দিন থেকেই। আমাকে বিয়ে করাটা ওর একটা প্রকাণ্ড ভুল। ওর মতো ভীষণ প্রাণোচ্ছল একটা মেয়ে আমার মতন একটা ঠান্ডা মানুষের বউ হয়ে থাকলে চিরকাল অসুখী হয়ে থাকতো। একটাই জীবন আমাদের, এভাবে অপচয় করার কি মানে বল? তার চেয়ে এই অনেক ভালো হয়েছে।"
“তুই বলতে চাস তো আমার ওপর কোন রাগ নেই এই নিয়ে?”
“না রে, নেই,” বললেন অবিনাশবাবু। “ভালোবাসার ওপরে জোর চলে না রে, দীপু। জোর করে পাবার জিনিস সেটা নয়।"
“শুধু তো ভালোবাসা নয় রে বিনু। আমি যে তোকে খুন করতে চেষ্টা করেছিলাম, সেটা কি করে ভুলে যাব? সুমনার প্রেমে অন্ধ হয়ে গিয়েছিলাম আমি। এখনো ওটা দুঃস্বপ্নর মতো আমাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। তুই মিরাক্যুলাসলি বেঁচে গেলি বলে আমার অপরাধ তো আর কমে যাবে না।”
অবিনাশবাবু মাথা নাড়লেন। “একটা ভুলের জন্যে নিজেকে আর কতো দোষী করবি? পারলে একবার মন থেকেতাঁর কাছে ক্ষমা চা। আমাদের অপরাধের জন্যে কি তিনি আমাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখতে পারেন?"
“কী জানি। শাস্তি তো দিয়েছেন তিনি, নিজের হাতে। নইলে এতো করেও আমি আর সুমনা সেই অর্থে তো... সে যাই হোক। তুই শুধু মন থেকে বল যে তুই আমাকে ক্ষমা করেছিস, বিনু। তাতেই আমার হবে। হয়তো তাতেই আমার মুক্তি।"
“আমার ক্ষমায় কী যায় আসে রে! তাঁর কাছে মন থেকে ক্ষমা চা, শান্তি পাবি।"
“তোর জীবনটাও নষ্ট হয়ে গেলো রে আমার জন্যে। কতো সম্ভাবনা ছিলো তোর মধ্যে! তার বদলে তোর জীবনের সব আনন্দ কেড়ে নিয়ে তোকে শুকনো ছিবড়ে করে দিলাম। তাই এই অর্ধমৃত জীবন নিয়ে ওই আশ্রমে পড়ে আছিস।"
“তা নয় রে দিপু। আমি কেন আশ্রমে পড়ে আছি শুনবি? তোকে আমি বলবার অনেক চেষ্টা করেছি... ”
“থাক বিনু। তুই যদি সত্যিই মন থেকে আমায় ক্ষমা করে থাকিস, যদি তুই সুখী হয়ে থাকিস ওই সেবার মধ্যে, আমি তাতেই সুখী। তাতেই আমার শান্তি।"
দুজনেই চুপ করে গেলেন। সামনের পাহাড়ে তখন ছায়া নেমে এসেছে। অন্ধকার। তারারা অনেক দূরে। অনেক কথা অন্ধকারে রয়ে যায়।
সন্দীপ উঠে পড়লো। “তাহলে আজ উঠি। অনেকটা পথ যেতে হবে রে। আবার আসবো।"
“আয়।" অবিনাশবাবুও উঠে দাঁড়ালেন। দুজনের রাস্তা দু দিকে। একটু বাদে সন্দীপের চেহারা মিলিয়ে গেলো অন্ধকারে।
অবিনাশবাবু ফেরবার পথে পা বাড়ালেন। জঙ্গলের ভেতরে অন্ধকার গভীর হয়ে এসেছে। পাখিরা ফিরছে কুলায়। পথ চলতে কষ্ট হয়।
মাথা নিচু করে হাঁটতে হাঁটতে সেই সব দিনগুলিতে ফিরে গেলেন অবিনাশবাবু। তখন উনি ডিসট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট। এর পাশের পাহাড়ের ওপরেই তো ওনার সরকারী বাংলো। সামনে বাগান, সুরকি ফেলা পথ, আর তার সামনে উপত্যকা। পাহাড় থেকে নামবার আঁকাবাঁকা রাস্তা সবুজের ফাঁকে ফাঁকে সাপের মতন হেয়ার-পিন বেন্ড নিয়ে নিচে নেমে গেছে। সেখানেই থাকতেন উনি, স্ত্রী সুমনাকে নিয়ে। সুখের সংসার। সন্দীপ ছিল নিয়মিত অতিথি। অতিথি কেন, পরিবারেরই একজন। প্রায়ই আসতো, থাকতো। অনেক সময় বেশ কদিনই কাটিয়ে যেতো। ওঁর উজ্জ্বল উপস্থিতি দিনগুলোতে যেন আবীর মাখিয়ে দিতো।
সেদিন বিকেলে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে ঢালু রাস্তায় নামতে গিয়ে ওই মারাত্মক হেয়ার-পিন বেন্ডে এসে বুঝেছিলেন ব্রেক ফেল করেছে। সন্দীপের মতো দুর্দান্ত ড্রাইভার না হওয়া সত্ত্বেও স্রেফ কপালজোরে বেঁচে গিয়েছিলেন সেদিন। ঠিকই বললো সন্দীপ--মিরাক্যুলাস।
পাথরে ধাক্কা মেরে গাড়ি থামিয়ে অবিনাশবাবু প্রায় অক্ষত শরীরে বেরিয়ে এসে তিন মাইল হেঁটে গাড়ির মেকানিক মহম্মদের দোকানে গিয়েছিলেন। তারপর তার সঙ্গে তার টোয়িং ভ্যান-এ চড়ে আবার ওই হেয়ার পিন বেন্ডে পৌঁছে বহু কসরৎ করে গাড়িটা নিয়ে এসেছিলেন মহম্মদের গ্যারেজে। মহম্মদ বহুদিনের চেনা লোক, ওস্তাদ কারিগর, অনেকদিন ধরে এই গাড়িটা সামলাচ্ছে। সেই দেখিয়ে দিয়েছিলো যে কেউ গাড়ির ব্রেক-শু ইচ্ছে করে খুলে দিয়েছে।
বিশ্বাস করেন নি তিনি। কিন্তু নিঃসন্দেহ হবেন বলে নিজের ক্লান্ত শরীরটাকে ওই অন্ধকার ঘোরানো রাস্তা দিয়ে হাঁটিয়ে পাহাড়ের মাথায় ঠেলে তুলেছিলেন। আওয়াজ করেন নি একটুও। বাড়িতে না ঢুকে জানলা দিয়ে উঁকি মেরেছিলেন। দেখেছিলেন সুমনা সন্দীপের বুকে মুখ গুঁজে পড়ে রয়েছে। আর সন্দীপ পাথরের মতো মুখ করে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে টেলিফোনটার দিকে। যেন কোনো ফোনের অপেক্ষা। বুঝেছিলেন তখন।
অন্ধকার গভীর হয়ে আসে। অবিনাশবাবুর নিঃশ্বাস দীর্ঘ হয়ে আসছে। পেঁচাদের কর্কশ চিৎকার থেকে থেকে শোনা যাচ্ছে।
সন্দীপকে ক্ষমা করতে পারলেও নিজেকে ক্ষমা করতে পারেন না তিনি। গেরুয়া পরেও সব কিছুর ওপরে উঠতে পারলেন কই? তৃণাদপি হতে পারলেন কোথায়? নতজানু হতে পারলেন না যে আজও।
চোখ জ্বালা করছে অবিনাশবাবুর। গরম নিঃশ্বাসে জ্বলে যাচ্ছে বুকের ভেতরটাও। কারণ সেদিন রাতের অন্ধকারে মহম্মদের দেখিয়ে দেওয়া কায়দায় নিজের বাল্যবন্ধু সন্দীপের গাড়ির ব্রেক-শু খুলে দিয়েছিলেন উনি।
মিরাক্ল বার বার হয় না। একই জায়গায় তো নয়-ই। হয়ও নি।
প্রতিবছর সন্দীপ আসে। এই দিনটাতেই। ক্ষমা চায় ওঁর কাছে। কত বছর কেটে গেলো।
কবে উনি সত্যি কথাটা বলতে পারবেন ওর কাছে? ক্ষমা চাইতে পারবেন ওর কাছে? সুমনার কাছে? নতজানু হয়ে? আরও কতো বছর লেগে যাবে ওনার ক্ষমা পেতে?
জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এলেন স্বামীজি। কাঁটাঝোপের আঘাতে রক্তাক্ত হয়ে। ক্লান্ত পদক্ষেপে।
সামনে এখনো দীর্ঘ পথ চলা বাকি। আবরণহীন। আবছায়াময়। নিঃসঙ্গ।