• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৬৪ | সেপ্টেম্বর ২০১৬ | গ্রম্থ-সমালোচনা
    Share
  • ভ্রমি বিস্ময়ে : সুনন্দন চক্রবর্তী


    ভ্রমণসমগ্র মোহনলাল গঙ্গোপাধ্যায়; সম্পাদনা: শ্রীকুমার চট্টোপাধ্যায়; প্রথম প্রকাশ: বইমেলা ২০১৬, দে'জ পাবলিশিং - কলকাতা, পৃষ্ঠাঃ ৩৭৬; ISBN: 978-81-295-2706-6

    ব কবিতাই না কি পুনর্লিখিত কবিতা। এলিয়ট বলবেন ভালো কবিদের হাড়ের মধ্যে পুরোনো কবিরা বাস করেন। এভাবে দেখলে আমাদের সবারই অস্তিত্ব জাতিস্মর। আমরা যেন নানা স্মৃতি-বিস্মৃতির তন্তুজালে আটকে থাকা উজ্জ্বল পতঙ্গ। শ্রীকুমার চট্টোপাধ্যায় একটি মহৎ কাজ করেছেন। এই তন্তুজালে তিনি একটি রশ্মি যোগ করেছেন যার ফলে আমাদের জালে-বদ্ধ জীবন একটু ঝলমল করে উঠতে পারে। কাব্য ছেড়ে খোলসা করে বললে শ্রীকুমার মোহনলাল গঙ্গোপাধ্যায়ের ভুলে যাওয়া তিনটি অপূর্ব বেড়ানোর গল্পকে আবার গণস্মৃতিতে যুক্ত করে দিয়েছেন। "ভ্রমণসমগ্র" প্রকাশ করে দে'জ পাবলিশিং আমাদের কৃতজ্ঞতাপাশে বদ্ধ করেছেন।

    শেষ বাক্যটা লিখে মনে হল অল্প সময়ের মধ্যে বাঁধা পড়ার রূপক বড়ো বেশি ব্যবহার করে ফেলছি। সেটা কি শরৎ ঘেঁষে গেরস্ত মন ছটফট করে ওঠে বলে? নাকি মোহনলাল গঙ্গোপাধ্যায়ের নামের সঙ্গে আমাদের ছেলেবেলার মনের উড়ানের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ আছে বলে? শ্রীকুমার, হারিয়ে যাওয়া মনটি আমার ফিরিয়ে তুমি আনলে আবার।

    বইটা যেহেতু আপনারা পড়বেন সেটা সম্পর্কে আমি বেশি বলব না। আর শ্রীকুমার চট্টোপাধ্যায় সম্পাদকের দায়িত্ব অত্যন্ত সুচারুভাবে পালন করেছেন। লাফা-যাত্রা খুঁজে বের করার গল্প থেকে শুরু করে অন্যান্য লেখার পশ্চাদপট ইত্যাদি নিয়ে তিনি চমৎকার একটি পরিচিতি দিয়েছেন বইগুলোর। আর যুৎসই সব টুকরো-টাকরা নিয়েছেন মোহনলালের মূল রচনা থেকে যা নিঃসন্দেহে পাঠকদের কৌতূহল এবং আগ্রহকে উদ্দীপিত করবে। আমি দু-চারটে আশ কথা পাশ কথা বলি।

    ইতিহাসের কিছু শান্ত, সুনিবিড় ছায়াময় কোনা থাকে তারুণ্য যেখানে উপচে পড়তে পারে অনাবিল। মোহনলালের ভ্রমণ তেমনি এক অপাপবিদ্ধ দেশ। আমি খুব কম ভ্রমণকাহিনী পড়েছি যা এত নিষ্পাপ, যে কল্প-রাজ্যে যাত্রা এত স্বচ্ছন্দ। এই নির্ভার, লঘুচরণ, খোলা হাওয়াই তো সমস্ত ভ্রমণার্থীদের প্রার্থিত। তবে মোহনলাল বেড়ানোর একটা নতুন ঘরানার কথা বলেছেন। যেখানে বেড়ানো মানে উড়োজাহাজ, জাহাজ, ট্রেন, বাস, মোটরগাড়ি করে উর্দ্ধশ্বাসে যতটা পারা যায় বিখ্যাত সৌধ এবং 'স্পট' দেখে ফেলা নয়। যেখানে বেড়ানোর বিনিময় মূল্য কেবল পকেটের পয়সার উপর নির্ভর করে না। বরং যেখানে বেড়ানো মানে প্রকৃতি-পড়ুয়ার দফতরে অনিয়মিত হাজিরা। গত শতাব্দীর ইউরোপীয় তরুণদের দুটি প্রিয় ব্যসন — ট্রেকিং এবং হিচ হাইকিং — মোহনলালের অনবদ্য অনুবাদে চরণিক-যাত্রা আর লাফা-যাত্রা।

    বিদেশে পড়তে গিয়ে প্রথম গ্রীষ্মাবকাশে যখন চরণিক হয়ে ওঠার প্রথম পাঠ নেবেন মোহনলাল ইউথ হোস্টেল আন্দোলনের বয়স তখনও তিরিশ। হয়ত এটা-ও মোহনলালের কাহিনীর নিষ্কলষুতা-র একটা কারণ। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর ক্রমশঃ আবিষ্কৃত হবে এশিয়া এবং দক্ষিণ আমেরিকা ব্যাকপ্যাকারদের জন্যে। কিন্তু মোহনলালের ভ্রমণ একটা ছোট্টো জানালা পূর্ব ইওরোপের মনোরম গ্রামদেশ এবং প্রায়-গ্রাম ছোটো ছোটো শহরগুলো ঘুরে দেখার। তার নিকষ দীর্ঘদেহী বন, স্ফটিকস্বচ্ছ ঝর্ণা, বুনো বেরি আর সাধাসিধে আতিথেয়তার মায়া বারে বারে যাকে ফিরে পেতে হবে এমন এক স্বর্গের অধিকার। এমনকি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ষোলো বছর বাদে আবার যখন চেকোস্লোভাকিয়া যাবেন মোহনলাল ('পুনর্দর্শনায় চ') তখনও তার ইতিহাসের উপর রাশান ট্যাঙ্কের দাগ পড়ার সাত বছর বাকি। কমলালেবুর রঙের মতো এমন নরম রোদওয়ালা দুনিয়া আমরা আবার কবে দেখতে পাব কে জানে।

    ব্যক্তিগত কাহিনী সম্পর্কে অসম্ভব নীরব মোহনলাল। তাই তাঁর চেকোস্লোভাকিয়া পুনর্দর্শনের বৃত্তান্তের অনেকটা ভিতরে যাবার পরে পাঠক বুঝতে পারবেন মোহনলালের স্ত্রীও ওই-দেশেরই লোক। জায়মান সমাজতন্ত্রের যে তাজা হাওয়া রবীন্দ্রনাথের ভালোলাগা আকর্ষণ করেছিল মোহনলালের অভিজ্ঞতাও তার প্রতিধ্বনি। এগুলিও এমন কতগুলো আখ্যান যা বার্লিন-প্রাচীর পরবর্তী বিশ্ব থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে। এই সমগ্রটি পুনরুদ্ধার করার জন্যে শ্রীকুমার চট্টোপাধ্যায়কে ধন্যবাদ।

  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments