শেষ পারানির কড়ি;সুখরঞ্জন সেনগুপ্ত; প্রথম প্রকাশ: মে ২০১৬ , দীপ প্রকাশন - কলকাতা, পৃষ্ঠাঃ ১০৪; প্রচ্ছদ : অভিজিৎ পাল
প্রথাগত ইতিহাসের আওতায় আসতে সমসাময়িক ঘটনাবলীর লেগে যায় অন্তত কয়েকটা দশক। তার ওপর রাজনৈতিক ইতিহাসের বেশ কয়েক রকমের ভাষ্য আছে। নিদেন পক্ষে জাতীয়তাবাদী আর আন্তর্জাতিকতাবাদী, এই দুই ধারা আছে। ফলে ভারত নামক জাতিরাষ্ট্রটির জাতীয় ইতিহাস-প্রকল্প এখনও উপনিবেশ-বিরোধী আন্দোলনের গৌরবময় দিনগুলি ছাড়িয়ে বিশেষ এগোতে পারেনি। তাই গত শতাব্দীর পাঁচ-ছয়-সাত দশকের উত্তাল রাজনৈতিক ইতিহাসের কথা জানতে ভরসা নানান স্মৃতিকথা। সুখরঞ্জন সেনগুপ্ত ১৯৫০ থেকে ১৯৯১ পর্যন্ত সাংবাদিকতা করেছেন। লোকসেবক, জনসেবক, যুগান্তর ও আনন্দবাজার পত্রিকার পাতায় তাঁর সাংবাদিকতার নমুনা ছড়িয়ে আছে প্রায় চারটি দশক জুড়ে। বিশেষ করে বাংলাদেশ যুদ্ধের পর-পরই সেদেশে গিয়ে প্রায় বছর দেড়েক তিনি যুগান্তর-অমৃতবাজার পত্রিকায় বিশেষ বাংলাদেশ সংবাদদাতার ভূমিকা পালন করেছেন। সুখরঞ্জনের স্মৃতিমূলক রচনা ‘ভাঙা পথের রাঙা ধুলায়’ ইতিমধ্যেই মননশীল পাঠকের মনোযোগ আকর্ষণ করেছে। তাই নতুন করে আবার সুখরঞ্জন যখন লিখলেন ‘শেষ পারানির কড়ি’ তখন তা লেখকের অন্তর্গত কোনো তাগিদেরই বহিঃপ্রকাশ বলে মনে হয়। দেশভাগের একজন প্রত্যক্ষদর্শী নাগরিক হিসেবে সুখরঞ্জন সেনগুপ্তের লক্ষ্য ছিল দেশভাগের আঁতের কথা বলে পরিচিত বইগুলির স্ববিরোধিতা ও তথ্যগত অসঙ্গতি নিয়ে মন্তব্য করা।
বইটি শুরু হয়েছে ১৯৬৯-এ বর্ধমান স্টেশনে লেখকের সঙ্গে বাংলার রাজনীতির এক যুবরাজ সৌম্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাটকীয় মোলাকাতের কাহিনি দিয়ে। সেই সূত্রে তিনি জানিয়েছেন সৌম্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের আত্মজীবনী ‘যাত্রী’-র প্রথম সংস্করণে উল্লেখিত একটি ঘটনার কথা, যা আবার ‘যাত্রী’-র পরবর্তী সংস্করণে বর্জিত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ তখন ট্রেনে বার্লিন থেকে মস্কো যাচ্ছেন। হঠাৎ সামনের কোনো কামরা থেকে ভেসে আসতে থাকল তাঁর নিজেরই লেখা ও সুর করা ‘কান্না হাসির দোল দোলানো পৌষ ফাগুনের পালা’। চমকিত হলেন কবি। প্রথমে ভাবলেন বুঝি নিজেরই অবচেতনে ধ্বনিত হচ্ছে সুর। পোল্যান্ডের এই রেলপথে কেই-বা গাইবে তাঁর গান। কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই ভুল ভাঙল। কোনো বাঙালি গাইছেন বুঝতে পেরে রবীন্দ্রনাথ দোভাষীকে নির্দেশ দিয়েছিলেন গায়ককে তাঁর কাছে আসার এত্তেলা পাঠাতে। তিনিই ছিলেন সৌম্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর। রবীন্দ্রনাথের প্রিয় সৌম্য। গল্প বলার ছলেই লেখক জানিয়ে দিয়েছেন সৌম্যেন্দ্রনাথের সঙ্গে পঞ্চাশের দশকে কমিউনিস্ট পার্টির নেতা মুজফ্ফর আহমেদের বিতর্কের কথা। যদিও সুখরঞ্জন এক্ষেত্রেও সৌম্যেন্দ্রনাথের প্রতি যথেষ্ট ভাবাবেগপূর্ণ থেকেছেন। অর্থাৎ ভাষায় মুজফ্ফর আহমেদের প্রতি বেশ তর্জনীপূর্ণ, যদিও নিজের সিদ্ধান্তের কোনো যুক্তিগ্রাহ্য কারণের উল্লেখ করেননি।
এরপর এসেছে বাংলা ভাষায় লেখা একখানি আশ্চর্য বইয়ের কথা। বইটির নাম ‘তেরো নম্বরে পাঁচ বছর’, লেখক সাদত আলী আখন্দ। এই তেরো নম্বর হল বাংলার পুলিশ ইন্টেলিজেন্সের মক্কা লর্ড সিনহা রোডের তেরো নম্বর বাড়ি। যে বাড়ির প্রতিটি কোনায় লুকিয়ে আছে বাংলার রাজনীতির গোপন ইতিহাস। সেই বাড়িতে লেখক আখন্দ ঢোকেন আন্ডারওয়ার্ল্ড কনফিডেন্সিয়াল ফোল্ডার সেকশনে। তখন বাংলাদেশের সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন তার সর্বোচ্চ পর্যায়ে। আর তিনি যখন সেখান থেকে বিদায় নিলেন তখন বাংলাদেশের সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন হতমান। সুখরঞ্জন এই বইটির হদিশ যেভাবে পেয়েছিলেন সেটাও কম আকর্ষণীয় নয়। বাংলাদেশ যুদ্ধের সময় রোজ ঢাকার ভারতীয় দূতাবাস থেকে ডিপ্লোম্যাটিক ব্যাগ আসত কলকাতায়। ওই ব্যাগেই এসেছিল বইটি। এক্সটারন্যাল অ্যাফেয়ার্স মিনিস্ট্রিকে পাঠানো বইটিতে সিক্রেট ছাপ মারা ছিল। আর সুখরঞ্জন কলকাতার হোম (পলিটিক্যাল)-এর জয়েন্ট সেক্রেটারি কৃষ্ণগোবিন্দ বসুর কাছ থেকে এক রাতের জন্য বইটি ধার নিয়ে এসেছিলেন। সাদত আলী আখন্দের বইতে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের বিবরণে বোঝা যায় তেরো নম্বর কেন ব্রিটিশ আমল থেকেই রাজনৈতিক ভাবে সরকার-বিরোধীদের মোকাবিলা করতে এত গুরুত্বপূর্ণ। ওই প্রসঙ্গে সুখরঞ্জন লিখছেন: ‘ওই মধ্যরাত্রে কলকাতায় একটি অস্পষ্ট বার্তা আসার সঙ্গে সঙ্গে রায়বাহাদুর এন এম [তেরো নম্বরের প্রধান ও ইন্টেলিজেন্স গড়ে তোলার পথিকৃৎ] শেষ রাত্রের মধ্যে কলকাতা ও ২৪ পরগনার ঝানু আই বি অফিসারদের ‘তেরো নম্বরের’ বাড়িতে জড়ো করে ফেললেন। কিন্তু কেউ কিছুই জানেন না। সাহস করে জিজ্ঞেস করতেও পারছেন না। এই সময় রায়বাহাদুর নিজেই জানালেন, সামথিং রং অ্যাট চিটাগাং। নো রেফারেন্স ফ্রম পাহাড়তলী ক্যান্টনমেন্ট। নির্দেশ দিলেন চট্টগ্রামের ফাইল ফোল্ডারগুলি প্রস্তুত করে রাখতে। ওই রাতে আর কোনো সংবাদ পাওয়া গেল না। পরের দিন বেলা একটায় নোয়াখালির পুলিশ সুপার ফেণী থেকে সংবাদ দিলেন, চট্টগ্রামে বিদ্রোহ হয়েছে। এদিকে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ফাইল ফোল্ডার প্রস্তুত হয়ে গেল সূর্য সেন, অনন্ত সিং, লোকনাথ বল, গণেশ ঘোষ সম্বন্ধে।’ এই কর্মতৎপরতাই সম্ভবত ব্রিটিশকে এত বছর ভারত শাসন করার ভিত গড়ে দিয়েছিল।
‘শেষ পারানির কড়ি’র বেশ কিছুটা অংশ জুড়ে স্বাধীন পশ্চিমবঙ্গের প্রথম মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষ ও তাঁর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের বিবরণ আছে। ১৯৪৭-এ মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার চার মাসের মধ্যে কেন প্রফুল্লচন্দ্রকে পদত্যাগ করতে হয়েছিল তার বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন সুখরঞ্জন। বস্তুত কংগ্রেস চিরকালই অভ্যন্তরীণ দলীয় কোন্দলের আখড়া। ৩০. ৪. ১৯৪৭ গান্ধীজি প্রফুল্লচন্দ্রকে চিঠিতে লেখেন —
‘চিরঞ্জীব প্রফুল্ল,
সরদারনে পয়গাম ভেজা হ্যায় কি তুমহারে ক্যাবিনেটমে এক মারোয়াড়ী হোনা চাহিয়ে। বদ্রিদাস গোয়েঙ্কা ইয়া খৈতান। মুঝে লাগতা হ্যায় অ্যাসা করনা উচিত হ্যায়, না করনা অনুচিত হ্যায়।বাপুকা আশীর্বাদ’
কংগ্রেসের সঙ্গে দেশের বৃহৎ পুঁজিপতি বা ব্যবসায়ীদের দহরম-মহরম আজ আর গোপন কোনো কথা নয়। আদর্শবাদী রাজনীতিক প্রফুল্ল ঘোষের মন্ত্রীসভা ভেঙে দেওয়ার পরোয়ানা বেরিয়ে গিয়েছিল জি ডি বিড়লার বাড়ি থেকে। কেননা জি ডি বিড়লাই সর্দার প্যাটেলকে সামনে রেখে প্রফুল্ল ঘোষকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করছিলেন। গান্ধীজির চিঠিতেও কাজ না হওয়ায় প্রফুল্লচন্দ্রের মন্ত্রীসভা ভেঙে দেওয়া হয়।
সুখরঞ্জনের বইতে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হল ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের সঙ্গে মৌলানা আজাদের সম্পর্কের ওপর আলোকপাত। ‘Thrown to the Wolves’ বইয়ে সীমান্ত গান্ধী খান আবদুল গফ্ফর খান লিখেছেন— ওয়ার্কিং কমিটিতে এবং এ আই সি সি-তে মৌলানা আজাদ দেশভাগ ও পাকিস্তান গঠনের বিরুদ্ধে কোনো কথা বলেননি। উলটে সীমান্ত গান্ধীর বিষণ্ণতা দেখে তাঁকে বলেছিলেন— ‘আর মন খারাপ করে কি করবে, তুমি আর তোমার দলবল মুসলিম লিগে যোগ দিয়ে ফেল’। ব্যথিত সীমান্ত গান্ধী তাঁর এতদিনের বন্ধুর কাছ থেকে এমন কথা শোনার আঘাত সারা জীবনে ভোলেননি। আসলে দেশ ভাগের বাস্তবতা, আর তাকে না মানা— এই ছিল কংগ্রেসের সেসময়ের রাজনীতির দুটি অক্ষ। গান্ধীজি স্পষ্টতই দ্বিতীয় শ্রেণির প্রতিনিধি ছিলেন, সর্দার প্যাটেল, জওহরলাল নেহরু প্রমুখ ছিলেন বাস্তববাদী পক্ষে। কলকাতা ও নোয়াখালির দাঙ্গার পর ভারতে হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক যে-অবিশ্বাস আর সন্দেহে পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে তা দূর করতে গান্ধীজি আবারও নিজের মতো করে সত্যের পরীক্ষায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন। তিনি নোয়াখালি গিয়ে সেখানেই থাকতে শুরু করেন। সেই নোয়াখালি আশ্রমেই ১৯৪৭-এর ফেব্রুয়ারিতে ড. রামমনোহর লোহিয়াকে সঙ্গে নিয়ে উপস্থিত হন জওহরলাল নেহরু। ১৯৫৯ সালে যখন মৌলানা আজাদের বই নিয়ে (India Wins Freedom) তোলপাড় হচ্ছে দেশ, তখন সে-বির্তকের আগুনে বারো বছর আগে নোয়াখালি সফরে গিয়ে নেহরুর করা মন্তব্য নতুন করে নিক্ষেপ করেন লোহিয়া। লোহিয়া জানিয়েছিলেন তাঁরা দুজন নোয়াখালি পৌঁছনোর পরদিন আশ্রম ছাড়িয়ে হাঁটতে যান নদীর দিকে। মাটির রাস্তা, কাদাজল, এখানে-ওখানে কচুরিপানা জমে আছে, ধানখেত ভর্তি কাদা। জওহরলাল নাকি হাঁটতে হাঁটতে বলেছিলেন--- ‘রামমনোহর, এখানকার ভৌগোলিক অবস্থানের সঙ্গে ভারতের অন্য জায়গার কোনো মিল পাও? ফেব্রুয়ারি মাসেও এসব জায়গা জলকাদায় ভরা। এই জায়গা ছেড়ে দিলে যদি ভারতের স্বাধীনতা ত্বরান্বিত হয় তাহলে ক্ষতি কী?’ এই মন্তব্য এমনই প্রতিক্রিয়ার জন্ম দেয় যে স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রীকে লোকসভায় বিবৃতি দিয়ে এ-ঘটনার বেশিরভাগ অংশকেই লোহিয়ার স্বকপোলকল্পিত বলে চিহ্নিত করতে হয়। কিন্তু এই মন্তব্যে যে মানসিক স্থানাঙ্ক প্রকট হয় তাকে এড়িয়ে যাওয়া বোধহয় আজ আর সম্ভব নয়। বস্তুত গান্ধীজির নোয়াখালি যাওয়ার সময়েই দেশভাগ হয়ে পড়েছে এ-দেশের ভবিতব্য। সবাই মেনেই নিয়েছেন সে বাস্তবতা। কেবল একজন ব্যতিক্রম। ১৯৪৭-এর মে মাসে দিল্লি স্টেশনে সাংবাদিকেরা যখন জিজ্ঞাসা করেন---‘আপনি কি জানেন দেশ ভাগ হতে চলেছে?’ তখনও গান্ধী বলেন দেশভাগ হতে গেলে তাঁর মৃতদেহের উপর দিয়েই হতে হবে। কিন্তু তা সত্ত্বেও দেশ ভাগ হয়। গান্ধীজির জীবদ্দশাতেই। তিনি তখন কার্যত রিক্ত, নিজের দলের কাছেই পরিত্যক্ত।
সুখরঞ্জনের ‘শেষ পারানির কড়ি’ এমন সব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে স্মৃতি উসকে দেবার মতোই বই। যদিও বইটিতে যথাযথ সম্পাদনার অভাব বেশ পীড়াদায়ক। কয়েকটি ক্ষেত্রে লেখকের আলোচ্য বিষয় বইয়ের মূল উদ্দেশ্যকে পরিপুষ্ট করে না। সহজেই বর্জিত হতে পারত। আর বই যত এগিয়েছে, বিভিন্ন বই থেকে দীর্ঘ উদ্ধৃতি এক ধরনের ক্লান্তিকর গদ্যের জন্ম দিয়েছে। এই বইয়ের লেখাগুলি ‘চতুরঙ্গ’ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছিল, এ তথ্যটি বইয়ে অনুল্লেখিত কেন এটাও বোঝা গেল না।