জিব্রাল্টার ডাউনটাউন
এবার গরমের ছুটিতে দক্ষিণ স্পেনে বেড়াতে গিয়েছিলাম। সবাই বলল বা: খুব সুন্দর সময়! কিন্তু আমার কপালে সুন্দর সয় না। সারা ট্রিপ প্রত্যেক দিন, প্রত্যেক শহরে, সারা দেশ জুড়ে বৃষ্টি আর বৃষ্টি। একদিন জিব্রাল্টার যাব ঠিক করেছিলাম; ভাবলাম সে জায়গাটা তো স্পেনের অন্তর্গত নয়, হয়তো বৃষ্টিটাও রেহাই দেবে — সেখানেও অবিরল ঝরঝর, ঝিরিঝিরি, ঝমঝম। কিন্তু এতদূর এসে হোটেলে বসে থাকা যায় না। তাই বৃষ্টি মাথায় নিয়েই বেরিয়ে পড়লাম।
স্পেনের মতো সুন্দর দেশ ছেড়ে জিব্রাল্টারে কেন? কী জানি! আমার স্বভাবই হল একটু উল্টোদিকে চলা। যেখানে বেশি লোক যায় না সেখানেই আমার পা দুটো টেনে নিয়ে যায়। তাছাড়া অন্তরীপ, প্রণালী এইসব ভৌগোলিক ব্যাপারগুলো আমায় ভীষণ আকর্ষণ করে। যাই হোক্, স্পেনের রাস্তা ছেড়ে জিব্রাল্টারের দিকে মোড় নিলাম।
জায়গাটা খুবই ছোট্ট। আইবেরীয় উপদ্বীপের দক্ষিণপূর্ব কোণে এক টুকরো ছোট্ট জমি ও একটা ন্যাড়া পাহাড় -- এ-ই হল জিব্রাল্টার। আয়তনে ২-৩ বর্গমাইল (৫-৮ বর্গ কিলোমিটার)। সেভিয়া থেকে মোটরে সুন্দর রাস্তায় মাত্র দু তিন ঘন্টা। কিন্তু ভৌগোলিক ভাবে স্পেনে থাকা সত্ত্বেও জিব্রাল্টার ব্রিটিশ কলোনি। তাই চাই আলাদা ভিসা, কাস্টমস ইত্যাদি।
কেবল কার
আরবী ভাষায় জিব্রাল্টার নামটা এসেছে “তারেকের পাহাড়” (Tarek’s Rock) থেকে। প্রাগৈতিহাসিক সময় থেকেই সেখানে মানুষের বসবাস। এখানে নানা গুহায় প্রাক্-প্রস্তরযুগীয় (Neandertal) মানুষদের আঁকা ছবি পাওয়া গেছে। তারপর জায়গাটা একে একে ফীনিশিয়, কার্থেজ, রোমান ইত্যাদি রাজত্বের দখলে এসেছে। সবশেষে ইসলামের সময় থেকে স্পেনের দখলে। ভূমধ্য সাগরের ঠিক মুখে হওয়ার জন্য জায়গাটার সামরিক ও ব্যবসায়িক গুরুত্ব বেশ। প্রায় তিনশ বছর আগে ব্রিটিশরা যুদ্ধে জিব্রাল্টার করায়ত্ত করে। ট্রাফালগার ও ক্রিমিয়ার যুদ্ধে জিব্রাল্টারের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল।
নেলসন-এর জাহাজের নোঙর
নেলসনের জাহাজের নোঙর এখন জিব্রাল্টারে স্মারকচিহ্ন। সুয়েজ প্রণালী চালু হওয়ার পর জিব্রাল্টার বন্দরে ভিড় আরও বেড়ে গেছে। অবশ্য ইদানীং Brexit-এর পর এর ভবিষ্যৎ নিয়ে তর্কাতর্কি চলছে কারণ জিব্রাল্টারের নব্বুই শতাংশ অধিবাসী ইওরোপীয় ইউনিয়ন ছাড়তে চায় না। গ্রেট ব্রিটেন ছেড়ে দিলে স্পেন তক্ষুনি দখল করে নেবে।
জিব্রাল্টারের সমুদ্রতীরে দাঁড়িয়ে বৃষ্টির মধ্যেও আট মাইল দূরে আফ্রিকা মহাদেশের তটভূমি দেখতে পেলাম। ঘন সবুজ বনানী, মধ্যে মাথা উঁচু মাউন্ট মুসা। মরক্কোর অন্যতম পাহাড়। এভাবে এক মহাদেশ থেকে আরেক মহাদেশের দেখা পাওয়াটা আমার পক্ষে বেশ রোমাঞ্চকর। ইস্তানবুলে বসফরাস সেতুর ওপরেও দেখেছিলাম ইওরোপ ও এশিয়ার সীমান্তরেখা। জিব্রাল্টারেও একটা ব্রীজ থাকলে বেশ হতো।
স্পেনের ভেতরেই এক টুকরো জমিতে ইংরেজি দেখে ও শুনে চোখ কানের একটু আরাম হয়। তবে পাহাড়ের গা-ঘেঁষা ছোট্ট বন্দর-শহরটি সারা বছর নানা দেশীয় ট্যুরিস্টের ভিড়ে ভরপুর। ভূমধ্য সাগরে লাক্সারী Cruise জাহাজগুলিরও প্রিয় বন্দর এটা।
বিখ্যাত রক
জিব্রাল্টারে সবচেয়ে বিখ্যাত ও দর্শনীয় হল The Rock বা পাহাড়। খাড়া গ্রানাইট পাহাড়টা সমুদ্র থেকে সোজা ১৪০০ ফুট উঠে গেছে। শক্তি ও দৃঢ়তার অন্যতম প্রতীক। এই Rock of Gibralter। অনেকেই হয়তো প্রুডেন্শিয়াল (Prudential) কোম্পানির বিজ্ঞাপনে এই পাহাড়ের ছবি দেখে থাকবেন--“Get a piece of a Rock”.
বারবেরির বাঁদর
পাহাড়ের গায়ে রাস্তা আছে — একেবারে ওপরে চূড়া পর্যন্ত ওঠা যায়। আশে পাশে সুন্দর বাংলো-বাড়ি। ওপরে চূড়ার কাছে একটি সংরক্ষিত পার্কে আছে জিব্রাল্টারের বিখ্যাত বাঁদরের দল। প্রায় তিনশ রোমশ বাঁদররা ট্যুরিস্টদের ভয় করে না। রাস্তা জুড়ে লাফালাফি করে। খুব কাছে গেলেও ভয়ে পালায় না। আঁচড় কামড়ও দেয় না। এরা জিব্রাল্টারের জাতীয় প্রাণী। লেজহীন বলে অনেকে এদের “Ape” বলেন। সুদূর অতীতে এরা আফ্রিকা থেকেই সমুদ্র পেরিয়ে এখানে এসেছিল। তারপর বিবর্তনের ফলে এখন একেবারে আলাদা প্রাণী হয়ে গেছে। জিব্রাল্টারের বাইরে আর কোথাও এদের দেখা যাবে না। লন্ডন টাওয়ারের কাকেদের মতই এদের সম্বন্ধেও কিংবদন্তী আছে — জিব্রাল্টার থেকে বারবেরি বাঁদর নিশ্চিহ্ন হলে ব্রিটিশ আধিপত্যও শেষ হয়ে যাবে।
লোমশ বাঁদর
পাহাড়ের মধ্যে প্রায় শ’খানেক ছোটো ও বড় গুহা। প্রাচীনকাল থেকেই সেগুলোয় মানুষের বসবাস। যুদ্ধের বা দুর্যোগের সময় শহরের মানুষরাও এখানে লুকিয়ে থাকে। Gorham (গরহ্যাম) গুহাতে প্রাগৈতিহাসিক আঁকা ছবি পাওয়া গেছে। সেন্ট মাইকেল গুহাটি সবচেয়ে প্রশস্ত ও লম্বা। বিরাট অ্যামফিথিয়েটারের মত জায়গায় শ'খানেক দর্শক আরামসে বসতে পারে। সেখানে কখনও কখনও নাচগান, কনসার্ট ইত্যাদিও হয়। ভেতরে নানা রঙের আলোতে অগুনতি স্ট্যালাকটাইট ও স্ট্যালাগমাইট ঝকমক করে।
গুহার মধ্যে অডিটোরিয়াম
শুধু একদিন মাত্র সময়। তাই বৃষ্টির মধ্যেই এইসব ঘুরে ঘুরে দেখা হল। আবার কবে এদিকে আসব কে জানে!
যাত্রা সময়কাল— মে, ২০১৬