।। ১ ।।
জ্যৈষ্ঠ মাসের শেষ। রোদের তাপ এত বেশি যে খোলা আকাশের নিচে দাঁড়ালে মনে হয় মাথাটা ফেটে যাবে। এ বছর কোন ঝড় বাদল বৃষ্টি কিছুই হয়নি। আবহাওয়া অফিস বলেছে তাপমাত্রা চুয়াল্লিশ ডিগ্রী। সেটা নাকি আরও বাড়বে।
তবে এ রাস্তাটায় ছায়া আছে। বড় রাস্তা থেকে ঢুকে এসেছে এই ইঁটের রাস্তা। চলে গেছে একটা ঢালু টিলার মত জায়গা পর্যন্ত। কয়েক বছর আগেও এ সব জায়গা রোদে পুড়ে খাঁ খাঁ করত। এখন রাস্তাটার দু পাশে কয়েক হাত অন্তর অন্তর গাছ। বেশি পুরনো নয় বলে উচ্চতা মাঝারি গোছের। এখন রোদের তাতে একটু ঝিমিয়ে আছে। বর্ষার জল পড়লেই গা ঝাড়া দেবে — তরতরিয়ে বাড়তে থাকবে।
আজ এই রাস্তায় কয়েকজন গণ্যমান্য লোকের পায়ের ধূলো পড়েছে। গাছ খালি রাস্তার দু পাশেই পোঁতা হয় নি। ঐ দূরের টিলাতে ও লাইনে লাইনে গাছ লাগানো হয়েছে। আগে আগে বর্ষার জল টিলার ঢাল বেয়ে গড়িয়ে চলে যেত। টিলার জমি ছিল বন্ধ্যা। এখন গাছের সারি জল আটকাচ্ছে, টিলার মাটি রসস্থ হচ্ছে। আর কিছুদিনের মধ্যেই জায়গাটা হয়ে উঠবে সবুজ — ফলবে সব্জী, তরিতরকারি। দেখতে এসেছেন জেলার ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব। সাহেব লম্বা, তার সঙ্গের আর্দালি বেঁটে। হাত উঁচু করে সে ছাতা ধরে আছে তার বড়কর্তার মাথার ওপর — সাহেবের মাথায় রোদ না লাগে। সাহেবের সঙ্গে আরও আছে তার পাহারাদার, ব্লকের বি ডি ও। মহকুমা শহরের ব্যাঙ্কের ম্যানেজারও রয়েছে। নাম অরূপ রায়। ছোকরা বয়েস — সমাজসেবা করে মানুষের উপকার করার আগ্রহ এখনও প্রবল। গাছ পুঁতে বন্ধ্যা জমিকে শস্যশ্যামলা করার টাকা এসেছে সরকার এবং ব্যাঙ্ক থেকে। গাছ পুঁতেছে স্থানীয় একটা এন জি ও আর স্বনির্ভর দলের মেয়েরা। তাদের লোকও আছে এই দলের সঙ্গে।
রাস্তার ধারে বসে আছে বুড়ি সুমতি — ওর পাশে ডাঁই করে রাখা শালপাতা আর পাতা জোড়বার কাঠি। বুড়ির বয়েস আশির কাছাকাছি। মুখের চামড়া কোঁচকানো, চোখে দূরের জিনিস দেখতে পায় না, কিন্তু হাত পা ঠিক আছে — চলাফেরা ভালই করতে পারে। নিজের লোকজন কেউ বেঁচে নেই। আগে খেতে পেত না, তারপর বাসন্তী ওকে স্বনির্ভর দলে নিয়ে নেয়। বুড়ি খুব ভাল শালপাতার ঠোঙা আর থালা তৈরি করতে পারে। এখন দলের হয়ে তাই তৈরি করে। যা রোজগার হয় তাতে ওর খাওয়া পরা দিব্যি হয়ে যায়। ভরপেট খেয়ে রাতে শোবার আগে বুড়ি নিজেকে শাপ দেয় — এত বেশি দিন বেঁচে থাকার জন্যে।
আজ বাসন্তী ওকে আগে থেকে তালিম দিয়ে এ রাস্তায় বসিয়ে রেখেছে। ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব বুড়ির কাছাকাছি আসতেই বাসন্তী হাত জোড় করল। বলল, স্যার, সুমতি আমাদের স্বনির্ভর দলে কাজ করে। একটুখানি ওর হাতের কাজ দেখে যান।
বাসন্তী লেখাপড়া বিশেষ কিছু শেখে নি। কিন্তু স্বনির্ভর দলে কাজ করে ও অনেক আদবকায়দা সহবৎ শিখেছে। ও এখন জানে মাননীয় লোকদের সঙ্গে কিভাবে কথা বললে তারা খুশি হন।
সাহেব দাঁড়ালেন। সুমতির দিকে ঘুরলেন। তার মুখে একটু প্রশ্রয়ের হাসি। উনি জানেন এ জাতীয় সফরে এলে এ ধরনের অনুরোধ একটু আধটু রাখতেই হয়।
সুমতিকে আগে থেকেই শেখানো ছিল — ওকে আর কিছু বলতে হল না। অসম্ভব দ্রুত শালপাতা আর কাঠি নিয়ে কাজ করতে লাগল ওর দুই হাত। চার পাঁচ সেকেন্ডের মধ্যে তৈরি হয়ে গেল একটা থালা। ঐ একই সময়ে হয়ে গেল একটা ঠোঙা।
সাহেবের মুখের হাসি মিলিয়ে গেল। দু চোখে ফুটে উঠল মুগ্ধতা। উনি বলে উঠলেন — বাঃ, চমৎকার, তারপর সুমতির দিকে বাড়িয়ে ধরলেন একটা দশ টাকার নোট।
সুমতি ভয়ে ভয়ে তাকায় বাসন্তীর দিকে। বাসন্তী অভয় দেয়, সাহেব খুশি হয়ে বকশীষ দিচ্ছেন তো! নিয়ে নে, লজ্জা কি?
দলটা আবার সামনের দিকে এগোয়। সাহেব একটা গাছের পাতা ধরে দেখলেন। গাছটা একটু ঝিমিয়ে আছে। পাতার সবুজে একটু রুখু রুখু ভাব। একটু বৃষ্টি হওয়ার দরকার — সাহেব বললেন।
বি ডি ও সায় দিলেন, একদম ঠিক কথা স্যার।
প্রত্যেক বছরই তো এ সময়ের মধ্যে বৃষ্টি হয় — অরূপ রায় বললেন। এবারে এত দেরি হচ্ছে কেন কে জানে!
তখনই সামনে থেকে একটা জড়ানো গলায় আওয়াজ এল — হ্যাঁ স্যার, জল না হলে আর কিছু করা যাবে না।
সকলের চোখ ঘুরল সেদিকে। একটা গাছের ছায়া একটু বড়। তার নিচে শুয়ে আছে লক্ষ্ণণ, অর্থাৎ লখা। মাথায় ধূলো, গায়ের জামা খুব নোংরা, চোখ ঘোলাটে — তাতে এখন লালচে ভাব। গা থেকে দেশি মদের কড়া গন্ধ বেরোচ্ছে।
সাহেব কৌতূকের চোখে ওকে দেখলেন। একটা অপদার্থ — ঈশ্বরের একটা বেয়াড়া সৃষ্টি। বাসন্তী ওর দিকে একটা ক্রুদ্ধ চাউনি ছোঁড়ে — হারামজাদা উল্লুক মরেও না। লখা এখন ওর দিকেই তাকিয়ে আছে, মুখে একটা শয়তানির হাসি, খোলা মুখের ভেতর নোংরা দাঁতগুলো দেখা যাচ্ছে। বাসন্তী মুখ ঘুরিয়ে নেয়, সকলের সঙ্গে সামনের দিকে হাঁটে।
আজ বাসন্তীর সঙ্গে ওদের দলের ললিতা এসেছে। চিমটি কেটে কথা বলা ওর স্বভাব। বলল, ইস বাসি, তোর কপালেই এরকম একটা লোক জুটল। ওকে ঘরে ঢুকতে দিস কেন? ঝেঁটিয়ে বার করে দে রাস্তায়।
বাসন্তী উত্তর দেয় না। যদিও মনে মনে ললিতার ওপর চটে। এখন ও একটা দরকারী কাজে এসেছে — ললিতার চিমটিকে মাথায় রাখলে চলবে না। বড় সাহেব, বি ডি ও, ব্যাঙ্কের বাবু, এরা গাছ লাগানো দেখে বড় রাস্তায় ফিরে এসে গাড়িতে উঠলে তবে ওর ছুটি।
বাসন্তী যখন ঘরে ফিরল তখন বেলা দুপুর। মাটির ঘর, টালির ছাদ। পাশেই একটা পুকুর আছে। দু পাড়ে দুটো প্রকাণ্ড গাছ — একটা বেল আর একটা তেঁতুল — ডালপালা মেলে ঝুঁকে পড়েছে পুকুরটার ওপর। একপাশে কলাগাছের সারি। সেজন্যে পুকুর আর তার দু পাড় সব সময়েই একটু ছায়া ছায়া অন্ধকার। জলটাও ঠাণ্ডা, নাইতে খুব আরাম। ঘরে ঢুকে জামা ছেড়ে চান করার জন্যে একটা আটপৌরে শাড়ি গায়ে জড়িয়ে নেয় বাসন্তী। তারপর অনেকক্ষণ ধরে পুকুরের ঠাণ্ডা জলে চান করে। গা মাথা সব গরম হয়ে আছে। রোদের তাত তো বটেই, তা ছাড়া লখার সঙ্গে দেখা হওয়া আর ললিতার চিমটি। বাসন্তী ঠিক বুঝেছে — ওকে হেনস্থা করার জন্যেই লখা ওদের রাস্তায় মাতাল হয়ে শুয়েছিল। ভাগ্যিস বড় সাহেব আর তার সঙ্গের লোকজন জানাতে পারে নি যে ওরা স্বামী স্ত্রী। লখা জানান দিলে কেলেঙ্কারির একশেষ হত। আর ললিতাটা কি কম শয়তান? ওর ঘরের মানুষটা রিকশা ভ্যান চলায়। সংসারে টাকা পয়সা দেয়। বেশ আছে ললিতা। আজ একটা সুযোগ পেয়েই বাসন্তীকে খোঁটা দিল। আরে বাবা দলের সবাই জানে বাসন্তীর মরদ চুলোয় গেছে। সে কথা আবার বলার কি আছে?
ভিজে শাড়ি গায়ে জড়িয়ে বাসন্তী পুকুর থেকে উঠে এল। আজ খুব তাড়া আছে। কালকের ভাত পান্তা করে রাখা আছে। খেয়েই ছুটতে হবে শহরে। ব্যাঙ্কের ম্যানেজারবাবু আজকেই যেতে বলেছেন। ঘরে ঢুকতে গিয়ে ছাগলটাকে চোখে পড়ল। গলার লম্বা দড়ি দিয়ে খোঁটার সঙ্গে বাঁধা। এদিক ওদিক ঘাস খেয়ে বেড়াচ্ছে। স্বনির্ভর দল থেকে টাকা ধার নিয়ে ওটাকে কিনেছিল বাসন্তী। ওর দুধ বেচে কিছু টাকা আসে। এখন ওটাকে উঠোনে তুলে বেঁধে রাখার দরকার। বাসন্তী ওর গলায় বাঁধা দড়ি খোঁটা থেকে খোলে, তারপর সেই দড়ি ধরে জন্তুটাকে টানে। কিন্তু ছাগলটা বেশ মোটাসোটা, গায়েও যথেষ্ট জোর। ও বাসন্তীকে উল্টোদিকে টানতে থাকে। বাসন্তী হাঁপায়। গা থেকে কাপড় সরে গিয়েছে — তা সামলে নেয়। তারপর দু হাতে দড়ি ধরে টানতে টানতে জানোয়ারটাকে উঠোনে তুলে নিয়ে গিয়ে বাঁধে।
ঘরে ঢুকে বাসন্তী মেঝেয় বসে পড়ে দম নেয়। ওর চোখ ফেটে জল আসে। এ সব কি মেয়েমানুষের কাজ? ওর ঘরের লোকটা যদি ললিতা বা রাধার বরের মত হোত! কিন্তু বিয়ের সময়ে লখা তো এরকক ছিল না। ওর মা ছিল না — বাপ তখনও বেঁচে। লরীর খালাসির কাজ করত — একটু আধটু মদ টদ খেলেও সংসারে টাকাপয়সা আনত। তারপর বুড়ো শ্বশুরটা রোগে পড়ে বিছানা নিল — আর বয়ে গেল লখা। নেশা, ভাঙ, মদ, জুয়া। তখন আর ওকে কাজকর্ম দেবে কে? এখন তিন চার দিনে একবার বাড়ি আসে। বাসন্তীর সঙ্গে ঝগড়াঝাটি করে কিছু টাকাপয়সা নিয়ে যায়। শ্বশুর একটা বুদ্ধিমানের কাজ করেছিল। মরার আগে এই বসতবাটি আর তার লাগোয়া জমিটুকু বাসন্তীর নামে লিখে দিয়েছিল। তা না হলে করে লখা ঘর বাড়ি বেচে নেশা করে সব টাকা উড়িয়ে দিয়ে বসে থাকত।
চটপট খেয়ে নিয়ে সাজপোষাক করে বেরিয়ে পড়ল বাসন্তী, ব্যাঙ্কে গিয়ে ধারের কিছু টাকা শোধ দিতে হবে — নতুন ধারের কথাবার্তাও হবে। প্রত্যেক মাসে ওদের স্বনির্ভর দলের মিটিং হয়, সবাই একটা নির্দিষ্ট টাকা জমা দেয়। সেই টাকা আবার জমা পড়ে দলের নামে খোলা ব্যাঙ্কের খাতায়। মেয়েরা সে টাকার থেকে ধার নেয়, সুদটা জমা পড়ে দলেরই খাতায়। ব্যাঙ্ক থেকেও আলাদা করে দলের নামে টাকা ধার নেওয়া আছে। সে টাকা নিয়ে দলের মেয়েরা অনেকেই বিভিন্ন কাজ করে বাড়তি টাকা রোজগার করছে — শোধও দিচ্ছে মাসে মাসে। সেই ধার শোধের টাকাই আজ বাসন্তী নিয়ে যাবে ব্যাঙ্কে।
ব্যাঙ্কে যাবার জন্যে বাসন্তীর সঙ্গী হবে রাধা। বাসন্তী ইচ্ছে করেই আলাদা আলাদা কাজের জন্যে আলাদা আলাদা মেয়েকে নিয়ে নেয়। যাতে সকলেই খুশি থাকে। কোন একজনকে বেশি কাজে ডাকলে বাকিদের মুখ ভারী হবে — ঝগড়া শুরু হয়ে যাবে দলের ভেতর। রাধার বাড়ি যেদিকে বড় রাস্তা সেদিকেই। ও তৈরি হয়েই ছিল। বাসন্তী একবার ডাকতেই বেরিয়ে এল — বাড়ির দরজা বন্ধ করে তালা লাগাল। ওর বর বাড়ি নেই। রাজমিস্ত্রীর কাজ করে। সকালবেলা সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে যায়, ফেরে সন্ধে পার করে। রাধার ছেলেটা ছোট — দু বছর বয়েস। আজ রাধা ওকে নিজের মার কাছে রেখে এসেছে। ছেলেটা কাঁদছিল, চেঁচাচ্ছিল। তা চেঁচাক। শহরে গিয়ে ব্যাঙ্কের বাবুর সঙ্গে দেখা করা বাচ্চা রাখার চেয়ে অনেক বেশি দরকারি কাজ — ইজ্জতের তো বটেই।
রাস্তার ধারে ওদের গাঁয়ের কালিমন্দির। এখন দুপুরবেলায় মন্দির বন্ধ। দরজার একটা কপাটের ওপর একটা বড় টিনের পাত লাগানো। তার ওপর আলকাতরা দিয়ে লেখা — শ্রী শ্রী প্রণবেশ শাস্ত্রী, জ্যোতিষ মার্তণ্ড, তন্ত্র ভৈরব। মাত্র দুই ঘন্টায় তীব্র বশীকরণ, যে কোন সমস্যার গ্যারান্টিসহ সমাধান, বিফলে মূল্য ফেরত। মন্দিরের আদি পুরুত এখন খুব বুড়ো হয়ে গেছে। তার ছেলের নাম প্রণব, সেই এখন পূজারী। কয়েক বছর আগে বাসন্তী একবার এই মন্দিরে এসেছিল মানত করতে। তখনও লখা এরকম বখে যায় নি। বাড়িতেই থাকত, রোজগার করত ঠিকমত। একা আসতে ভরসা পায় নি, রাধাকে সঙ্গে নিয়ে এসেছিল। সন্তানের জন্যে মানত — ছেলে বা মেয়ে যাই হোক। প্রণবেশ অনেকক্ষণ ধরে আশীর্বাদ করেছিল। বাসন্তীর মাথায় আর গালে হাত বুলিয়ে — বিশেষ করে গালে। তারপর বলেছিল, নিশ্চয়ই হবে, কোলজোড়া ছেলে হবে। তবে একরাত মন্দিরে থেকে মায়ের সেবা করতে হবে। সে রাতে মন্দিরেই ভোগ খাবে, বাড়ির কোন খাবার খাওয়া চলবে না।
সাবধান করে দিয়েছিল রাধা। বলেছিল, খবর্দার, ওসবের মধ্যে যাস না। ভোগের সঙ্গে কি না কি মিশিয়ে দেবে, তাই খেয়ে সারারাত অচেতন হয়ে থাকবি। তারপর পেটে যখন বাচ্চা আসবে তখন জানতেও পারবি না বাচ্চার আসল বাপ কে।
ওরা বড় রাস্তার মোড়ে এসে দাঁড়ায়। এ রাস্তায় বাস আসবে — হাত দেখালে এখানেই থামবে। জোরে পা চালিয়ে হেঁটে এসেছে — একটু একটু হাঁপায় বাসন্তী। খাওয়া, বেরোবার সাজপোষাক — এসব তো ঝটপট সারতে হয়েছে। সাজগোজ একটু যত্ন করে করেছে বাসন্তী। চোখে একটু কাজল, কপালে একটা টিপ। শহরে যাবে — যেমন তেমন ভাবে গেলে লোকে পাত্তা দেবে কেন? রাধা একটা ইয়ার্কি মেরে ফেলল, বাসি আজকে যা সেজেছিস — দারুণ দেখাচ্ছে তোকে। ব্যাঙ্কের অপরূপবাবুর তো তোকে এমনিতেই পছন্দ, আজ আবার একটু বেশি মনে ধরে না যায়।
ঠাট্টাটা বাসন্তীর ভালই লাগে, কিন্তু মুখে একটু রাগ দেখায়। রাধার গালে ছোট্ট করে একটা চাপড় মেরে বলে, বাজে বকিস না তো।
হাতঘড়িতে সময়টা দেখে নেয় বাসন্তী। ছাগলের দুধ বেচা টাকা জমিয়ে এই ঘড়িটা কিনেছে। এখন আসবে মা মনসা — সময় প্রায় হয়ে গিয়েছে। এর পরের বাস ফুল্লরা। সেটা প্রায় এক ঘন্টা পরে। শহর প্রায় ঘন্টাখানেকের রাস্তা — বড় দেরি হয়ে যায় মা মনসা ধরতে না পারলে।
দূরে মা মনসা দেখা দিল। বেশ জোরে আসছে। বাসন্তী হাত দেখায়। বাসটা থামল, কিন্তু ওদের থেকে একটু এগিয়ে গিয়ে। ধূলোর একটা ঝাপটা গায়ে লাগে ওদের। ওরা সামনের দিকে দৌড়য় বাসে উঠবার জন্যে। ওর মধ্যেই বাসন্তীর চোখে পড়ল বাসের একেবারে পেছনের তিনটে জানালা জুড়ে একটা বড় রঙচঙে চটকদার বোর্ড। তাতে লেখা — এড্স এবং যৌনরোগ এড়াতে প্রত্যেকবার কন্ডোম ব্যবহার করুন। এক লহমার জন্যে বাসন্তীর মনে এল লখার কথা। লখা নিশ্চয়ই খারাপ জায়গায় যায় না — বাসে উঠতে উঠতে বাসন্তী ভাবল।
মা মনসায় বেশ ভিড়। বসার জায়গা পায় নি ওরা — মেয়েদের সীটগুলোও সব মহিলা আর বাচ্চাতে ভরতি। বাসন্তী একহাতে মাথার ওপরের রড ধরে — অন্য হাতে টাকার ব্যাগটাকে বুকের সঙ্গে চেপে ধরে থাকে। রাধাও ওর ঠিক পাশে দাঁড়িয়ে টাকার ব্যাগটাকে আড়াল দেয়। অনেক সময় পকেটমারের দল বাসে ওঠে। একসঙ্গে চারপাঁচ জন। দু তিনজন মিলে কোন এক মহিলার গায়ে হাত দেয় — একটু ঠেলাঠেলি করে। মহিলা বেসামাল হলেই তার ব্যাগের চেন কেটে টাকাপয়সা তুলে নেয়। আজও একগাদা লোক মেয়েদের সীটগুলোর কাছে ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছে — এদের মধ্যে কে পকেটমার আর কে এমনিই ছোঁক ছোঁক করছে তা বোঝা সম্ভব নয়। বাসন্তী শরীরের পেছন দিকে কয়েকটা হাতের স্পর্শ পায়। অন্য সময় হলে খপ করে সেই হাত চেপে ধরে মুচড়ে দিত। কিন্তু আজ ওর সঙ্গে অনেক নগদ টাকা রয়েছে। এসব করতে গেলে সেই টাকা খোয়া যাবার ভয় আছে। নিরুপায় বাসন্তী মনে মনে সেই সব হাতের মালিকদের গাল দেয়, হারামজাদা আঁটকুড়ীর ব্যাটা — মর্ ব্যাটা মর।
মা মনসার দৌড় শহরের বাসস্ট্যান্ডে এসে শেষ। সব লোক নামল, তাদের সঙ্গে ওরাও নামে। ব্যাঙ্ক এখান থেকে বেশ একটু দূর, সাইকেল রিক্সা নিতে হবে। তখনই ডাক শুনতে পেল, বাসন্তীদি — ও রাধাদি।
ডাকছে লক্ষ্মী। ওদেরই গাঁয়ের মেয়ে। বিয়ে হয়েছে পাশের গাঁয়ে। ওর বর মদন আর ও — দুজনে মিলে বাস স্ট্যান্ডে একটা খাবারের দোকান চালায়। রাস্তার ধারের খানিকটা জায়গা বাঁশের খোঁটা পুঁতে তিন দিক ত্রিপল দিয়ে ঘিরে দিয়েছে — খালি সামনে রাস্তার দিকটা খোলা। ওপরটাও ত্রিপল দিয়ে ঢাকা। একটা বড় টিনের বোর্ড ওপরের ত্রিপলের সঙ্গে তার দিয়ে বেঁধে ঝুলিয়ে দিয়েছে। তাতে লাল রং দিয়ে লেখা — মা তারা ভোজনালয়। এখানে চৌ মিন, ডিম রোল, মামলেট, মোগলাই পরটা সুলভে পাওয়া যায়। লক্ষ্মী আর মদন ওদের খুব যত্ন করে বসাল। বসে খাওয়ার জন্যে গোটাকয়েক লম্বাটে নড়বড়ে টেবিল আর বেঞ্চি পাতা আছে। সেই বেঞ্চিতে বসিয়ে টেবিলে খাবার বেড়ে দিল। দু পিস করে উনুনে সেঁকা পাঁউরুটি আর সকালে তৈরি ঘুগনি — গরম করে। এই সবে খেয়ে এসেছি — ব্যাঙ্কে যেতে দেরি হয়ে যাবে — এসব কথা বলেও ছাড়ান পাওয়া গেল না। এখন দুপুরবেলায় বাসের আনাগোনা কম বলে খদ্দেরের তেমন ভিড় নেই — মদন নিজে সামনে দাঁড়িয়ে থেকে ওদের খাওয়াল। লক্ষ্মী উনুনের সামনে বসে ময়দা মাখছিল। বিকেলে লুচি আলুর দম তৈরি হবে — এখনই কিছু কাজ এগিয়ে না রাখলে পরে আর সামাল দেওয়া যাবে না।
ভোজনালয় থেকে বেরিয়ে এসে ওরা সাইকেল রিক্সায় ওঠে। বারো টাকা চাইছিল — মদন দর করে দশ টাকায় ঠিক করে দিল। এর কমে কোন সাইকেল রিক্সা যাবে না। দুজনে একসঙ্গে উঠলে ওরা একটু বেশি চায় — টানতে পরিশ্রমটাও বেশি হয় তো। বিশেষ করে ওদের দুজনেরই ভগবানের দয়ায় ভর ভরন্ত শরীর। রিক্সায় বসে বাসন্তী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। লক্ষ্মীটার কপাল ভাল। মদনটা কি ভাল ছেলে। দু জনে মিলে একসঙ্গে খেটে বেশ দুপয়সা রোজগার করছে। আগে ওদের ছিল মাটির ঘর, খড়ের চাল। এখন ইঁটের দেয়াল হয়েছে, চাল টালির। শীগগীরই পাকা ছাদ করবে — মদন সেরকমই বলছিল। লখাটা কি এরকম হতে পারত না? আর বাসন্তী তো লক্ষ্মীর চাইতে কিছু কম কাজের নয়। শাড়ির আঁচলের খুঁট দিয়ে চট করে চোখের কোন সাবধানে মুছে নেয় বাসন্তী — চোখের কাজল নষ্ট না হয়। আবার রাধাও দেখে না ফেলে। চোখ মুছছে কেন তা জিগ্যেস করলেই একগাদা কথা বলতে হবে।
বাসন্তী যখন বাড়ি ফিরল তখন বিকেল গড়িয়ে সন্ধে হয়ে এসেছে। খুব খুশি মনে ফিরেছে — ব্যাঙ্কে ওদের কাজ ভালভাবে হয়েছে। অরূপ রায় ওদের চা সিঙাড়া খাইয়েছেন — খুব খাতির করেছেন। ওদের দল একটা নতুন ধার নেবে, সে সব কথাবার্তা পাকা হয়ে গিয়েছে। সে টাকা থেকে কিছু ও নিজেও নেবে — একটা হাতে চালানো সেলাই মেশিল কিনবে। এখন বাসন্তী মেয়েদের জামা কাপড় হাতে সেলাই করে বিক্রী করে। মেশিন কিনতে পারলে আরও কিছু রোজগার হবে। রাধাও কিছু টাকা নেবে। বাড়িতে মুড়ি ভেজে বিক্রি করবে। সুদটা অবশ্য একটু বেশি। তবে ভাল করে খাটলে শোধ করা শক্ত হবে না। এ পর্যন্ত ওদের দল কখনো ধারের টাকা শোধ দিতে দেরি করেনি — সে জন্যেই তো এই ধারটা এত তাড়াতাড়ি পাওয়া যাচ্ছে। অরূপ রায় আরও একটা ব্যবসার খোঁজ দিয়েছেন। শ্রাবণ মাসের মেলাটায় একটা খাবারের দোকান দেবে ওদের স্বনির্ভর দল। মেলাটায় খুব ভিড় হয়। দোকানটা দিতে পারলে প্রচুর লাভ হবে। জেলার বড় সাহেবকে বলে পারমিট করিয়ে দেবেন অরূপ রায়। এ সব ভাবতে ভাবতেই বাড়ির কাছে এসে গিয়েছিল বাসন্তী — চারপাশ অত খেয়াল করেনি। এখন চোখে পড়ল। দরজার বাইরে বসে আছে লখা।
চোখাচোখি হতেই একগাল হেসে উঠে দাঁড়াল। সঙ্গে সঙ্গে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে বাসন্তী। কিন্তু তার মধ্যেই লখাকে ভাল করে নজর করে নিয়েছে। স্নানটান করে এসেছে, পরিষ্কার জামা গায়ে চড়িয়েছে। থাকার ঠেকটা ভালই জুটেছে, সন্দেহ নেই। ঘর খুলবার জন্যে বাসন্তী দরজার তালায় চাবি লাগায়, লখা এসে পাশে দাঁড়ায়। হারামজাদা বাড়িতে ঢুকতে চায়, বোঝাই যাচ্ছে। নিশ্চয়ই আবার টাকা পয়সা চাইবে। বাসন্তী একবার ভাবল এখান থেকেই দূর করে দেয়। কিন্তু কাজটা করে উঠতে পারল না। ভদ্রভাবে থাকলে বাপের ভিটে ওই তো পেত।
ঘরে ঢুকে বাসন্তী আলোর সুইচ টিপল। ওদের গাঁয়ে বিদ্যুৎ এসেছে ঠিকই, কিন্তু তাতে টিম টিম করে একটা আলো জ্বলে — তার বেশী কিছু হয় না। আলো জ্বলল না। মানে এখন বিদ্যুৎ নেই। নতুন কিছু নয় — দিনের মধ্যে দশ বারো ঘন্টা থাকে না। ঘরের কোণে রাখা হ্যারিকেনটা জ্বালল বাসন্তী — দেশলাই এর বাক্স ওর ব্যাগেই থাকে।
তক্তপোশের ওপর জুৎ করে বসেছিল লখা। আলো জ্বললে বাসন্তীকে বলল, তোকে দেখতে দারুণ সোন্দর লাগছে মাইরি।
বাসন্তী উত্তর দেয় না। কঠিন চোখে ওর কান এঁটো করা হাসি মাখা মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।
লখা আবার বলল, মনার খুব পছন্দ হয়েছে তোকে।
মনা লেট এখানকার একজন বড় মাস্তান। বাসন্তী ওকে কখনো দেখে নি, কিন্তু ওর নাম জানে। চোরা চালানের ব্যবসা আছে — দোকানদার ব্যবসাদারদের থেকে তোলা আদায় আছে। দেশি মদ, জুয়ার ঠেক আছে। শোনা যায় ওর নাকি এখন প্রচুর টাকা, পার্টি, পুলিশ, সবাই ওর হাতে আছে। লখা বোধ হয় আজকাল ওর কাছে গিয়ে ভিড়েছে।
বাসন্তী এবার কথা বলল — খুব ঝাঁঝালো গলায় — বাজে বকছিস কেন? তোর চাইটা কি? আর টাকা দেব না বলে দিলাম।
লখা গদ গদ মুখে হেসে দুহাত নাড়ে। বলে, না না তোর থেকে আর টাকা নেব না। আর নেবার দরকার হবে না। মনা তোকে রাখতে চায়। তুই ওর ঘরে গেলে ও আমাকে তিন লাখ টাকা দেবে।
বাসন্তী কথা বলে না। একটা প্রচণ্ড রাগ এখন ওর ভেতর তৈরি হচ্ছে।
লখা আবার বলে, একদিন লুকিয়ে তোকে দেখিয়েছিলাম মনাকে। আমরা গাছের আড়ালে লুকিয়েছিলাম। তুই পুকুরে চান করে উঠে আদুর গায়ে ঘরে গেলি। তোর বডি দেখার পরের থেকেই মনা একেবারে দিওয়ানা হয়ে আছে তোকে নিয়ে বিছানায় উঠবে বলে। তুই ওর ঘরে গেলে ও ওর রাখেল মেয়েমানুষটাকে আমাকে দিয়ে দেবে। তুই একেবারে রাণী হয়ে ওখানে থাকবি। তোকে সোনায় মুড়ে দেবে, টাকাও দেবে যত চাইবি। রাজী হয়ে যা মাইরি। তুই রাজী আছিস এ খবরটা পেলেই মনা আমায় এক লাখ দিয়ে দেবে। আর মাল ডেলিভারি হলেই বাকি দুলাখ — হাতে হাতে।
বাসন্তীর সমস্ত রাগটা এইবার ফেটে বেরিয়ে এল। শুয়ারের বাচ্চা হারামী — বেরিয়ে যা, দূর হ এখান থেকে। সেই সঙ্গে এক পাটি জুতোও ছুঁড়ে মারল লখাকে।
লখার মুখের ভাব বদলে গিয়ে হিংস্র হয়ে গেল। ও ঝাঁপিয়ে পড়ল বাসন্তীর ওপর। ওর হাত দুটো মুচড়ে ধরে ঘরের কোণে ঠেলে নিয়ে যায় লখা। দেয়ালে বাসন্তীর মাথা ঠুকে দেয়। মুখে হিসহিস করে, মাগি তেজ দেখাচ্ছিস? তোর মুখ হাত বেঁধে তোকে মনার বিছানায় দিয়ে আসব। ভেবেছিস আমার তিন লাখ টাকা লোশকান করাবি? দেখাচ্ছি তোকে মজা।
বাসন্তী মেঝেয় বসে পড়ে হাঁপায় — উত্তেজনায়, রাগে, ব্যথায়। ও জানে চেঁচালে কিছু হবে না। পড়শিরা দূরে দূরে থাকে — চিৎকার শুনতে পাবে কিনা সন্দেহ। শুনতে পেলেও কেউ আসবে না — স্বামী স্ত্রীর ঝগড়ার মধ্যে কেউ নাক গলাবে না। বাসন্তীর বুকের কাপড় এখন সরে গেছে — লখা ওর শরীর খাবলায়। তাতে করে একটা হাত ছাড়িয়ে নিতে পারে বাসন্তী। সেই খোলা হাতে ঠেকল মেঝেয় রাখা কাপড় কাটার কাঁচিটা। সেটা তুলে নিয়ে ছুঁচলো দিকটা অন্ধের মত চালিয়ে দিল লখার দিকে।
বাপ্রে বলে বাসন্তীকে ছেড়ে লাফিয়ে ওঠে লখা। খোঁচাটা লেগেছে ওর বুকের ওপরের দিকে — কাঁধের কাছে। রক্তও বেরোচ্ছে বেশ একটু। হাত দিয়ে জখম হওয়া জায়গাটা চেপে ধরে লখা — দৌড়ে ঘরের দরজার কাছে চলে যায়।
বাসন্তী উঠে দাঁড়ায় — ওর চোখে ঝলকাচ্ছে আহত বাঘিনীর রাগ। পরনের শাড়ি খুলে গেছে। ও পরোয়া করে না। এক হাতে কাঁচি, অন্য হাতে মুড়ো ঝাঁটাটা তুলে নেয় বাসন্তী। লখা আর দাঁড়ায় না। শালি মাগি খুন করবে রে — বলে দৌড়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়।
বাড়ির দরজা বন্ধ করে দিয়ে দম নেয় বাসন্তী। তারপর গুছিয়ে কাপড় পরে নেয়। লখাকে আর এ বাড়িতে ঢুকতে দেবে না। দলের মেয়েদের ঘটনাটা জানিয়ে রাখতে হবে। দরকার হলে ওরা সবাই মিলে লখাকে পিটবে। আর সুমতি বুড়িকে নিয়ে আসবে ওর সঙ্গে থাকার জন্যে। মনাকে ও ভয় পায় না। মনা জানে ওর আর ওর স্বনির্ভর দলের সঙ্গে সরকারী মহলে জানাশোনা আছে। ঐ জানোয়ার লখাটা বাড়িতে ঢুকতে না পেলেই হল।
।। ২ ।।
সকালবেলাতেই খাবারের দোকানটার সামনে খুব ভিড়। গরম গরম লুচি, আলুর দম আর সেই সঙ্গে জিলিপী। মেয়েগুলো খাবার বানায় ভাল। তাছাড়া দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে মেয়েদের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে খেলে খাবারের স্বাদটা আরও একটু বেশী ভাল লাগে।
তবে কে ওদের দিকে তাকাচ্ছে তা নিয়ে মাথা ঘামাতে বয়ে গেছে দোকানের মেয়েদের। শ্রাবণ মাসের এই পাঁচ দিনের মেলায় ব্যবসা করতে এসেছে এই মেয়েরা — মোটা লাভ করে বাড়ি ফিরবে ওরা। বাঁশ আর ত্রিপলের অস্থায়ী দোকান — মেলা ভাঙলে খুলে ফেলা হবে। তিনটে বড় বড় কেরোসিনের স্টোভ নীল শিখায় জ্বলছে — তার ওপরে কড়া চাপানো। একটা কড়ায় গরম বনস্পতিতে অনবরত লুচি ভাজা হচ্ছে। একটায় তৈরি হচ্ছে আলুর দম। তৃতীয়টাতে বাসন্তী জিলিপীর বেসন গোলা ছাড়ছে হাত আর আঙুল ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে। কড়ার তেলে পড়ে সেই বেসন হয়ে উঠছে লাল লাল অনেক প্যাঁচের মোটা মোটা গাঁটওয়ালা লোভনীয় চেহারার জিলিপী — তারপর সেগুলোকে গরম চিনির রসে চুবিয়ে দেওয়া। সুমতি জোগান দিচ্ছে শালপাতার থালা আর ঠোঙার। লুচি আলুর দম থালায়। আর জিলিপী দেওয়া হচ্ছে ঠোঙায় — মিষ্টি রসের জিনিসে তেল ঝাল লেগে স্বাদটা খারাপ না হয়ে যায়। জলেরও সুবিধে আছে। পাশেই একটা টিউবওয়েল। সেটার জল তুলে বড় বড় বালতিতে রাখা আছে রান্না আর খাওয়ার জন্যে।
গত কদিন ধরে অঝোর বৃষ্টি হয়েছে। মাথায় হাত দিয়ে বসেছিল বাসন্তী। এত টাকার জোগাড়যন্ত্র — সব জলে যাবে? ভাগ্য ভাল — গতকাল থেকে জলটা ধরে গেছে। মেলার আরও দুদিন বাকী। যেরকম বিক্রী হচ্ছে তাতে সব খরচপত্র মিটিয়ে ব্যাঙ্কের ধার শোধ দিয়ে অন্তত হাজার তিরিশ লাভ করতে পারবে ওরা।
রাত্তিরগুলো একটু অস্বস্তির। দোকানের ঝাঁপ বলতে কিছু নেই — একটা বড় চট সামনের দিকে টাঙিয়ে দোকান বন্ধ করা হয়। দোকানেই মাদুর পেতে ওরা গাদাগাদি হয়ে শুয়ে থাকে। রাতে একটু মাতালের উৎপাত আছে — দোকানের সামনের রাস্তায় চিৎকার চেঁচামেচি হয়। বুড়ি সুমতি গজ গজ করছিল, এতগুলো মোমও মেয়ে এভাবে শুয়ে — মাতালে ঢুকে এলে একটা কেলেঙ্কারী হবে।
বুড়ির কথা একেবারে ফ্যালনা নয়। চটের ঝাঁপ তুলে ফেলা তো এক সেকেন্ডের ব্যাপার। তবে ওরা পাঁচজন আছে — বাসন্তী, রাধা, সেবা, ললিতা আর কল্পনা — সুমতিকে ধরলে ছজন — অন্তত সাড়ে পাঁচ জন। তাছাড়া আছে আলু কাটার ছুরি, বঁটি, বেলন চাকির বেলন, মেঝে পরিষ্কার করার মুড়ো ঝাঁটা। মাতালের ভয় পাবার বিশেষ দরকার নেই ওদের।
সন্ধের দিকে মেলায় বাউলগানের আসর বসে। রাস্তার ওপাশে একটু এগিয়ে একটা বড় সামিয়ানা খাটানো হয়েছে — বড় সাইজের মজবুত ত্রিপল দিয়ে ভাল করে ঢাকা। জোরে বৃষ্টি এলেও জল পড়ে না সেখানে। কাল থেকেই বাসন্তী একটু চুলবুল করছিল গান শোনার জন্যে। আজ সন্ধের সময় দোকান একটু ফাঁকা — আবার খদ্দেরের ভিড় লাগবে রাত আটটা নটা নাগাদ। বাসন্তী রাধাকে বলল, তুই একটু দোকান সামলে দে। আমি এই একঘন্টা গান শুনে আসি।
প্রথম দিকে গানের আসর জমছিল না। যে দু তিনজন গাইতে এল তারা বর্ধমান আর বোলপুরের মধ্যে ট্রেনে কয়েকটা গানই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে গায় — আজও তাই গাইল। দর্শকরা কেউই বিশেষ কিছু টাকা পয়সা দিল না ওদের। তারপর এল একজন বাউল, সঙ্গে হাতে ধরা একটা পাঁচ-ছ বছরের বাচ্চা ছেলে — তার গলার সঙ্গে দড়ি দিয়ে একটা খোল ঝোলানো। বাউল গান ধরে — নদী ভরা ঢেউ, বোঝ না তো কেউ — সেই সঙ্গে বাচ্চাটার দু হাতের চাঁটি পড়তে থাকে তার গলায় ঝোলানো খোলে। একটা মিঠে আওয়াজে ভরে ওঠে জায়গাটা। তারপর আর একটা গান, আরও একটা।
বাউলের গান শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে প্রচণ্ড হাততালি পড়তে লাগল। সেই সঙ্গে টাকার বৃষ্টি। কিন্তু সবই পড়ছে বাচ্চাটার কোলে — বাউলকে কেউ পাত্তা দিচ্ছে না। বাসন্তী একেবারে মুগ্ধ হয়ে বসেছিল। কি আশ্চর্য ঈশ্বরদত্ত ক্ষমতা বাচ্চাটার। ও এগিয়ে গিয়ে বাচ্চাটার হাতে একটা একশ টাকার নোট গুঁজে দিল — সেই সঙ্গে তার দুই গালে দুই চুমু।
দেখা হল পরের দিন সকালে। ওদের দোকানে এসেছে বাউল, সঙ্গে হাত ধরা সেই বাচ্চা। বাসন্তী ব্যস্ত হয়ে উঠে দাঁড়াল। বলল, আসুন, আসুন — কি দেব বলুন।
বাউল বাচ্চার মুখের দিকে তাকায়। বাচ্চা আঙুল দিয়ে জিলিপী দেখায়।
বাসন্তী যত্ন করে খাবার সাজিয়ে দেয় ওদের। জিলিপীর সঙ্গে লুচি আলুর দমও দেয়। দুটো লুচি খেয়ে বাপের হাতের ঠোঙার থেকে জিলিপী তুলে নেয় বাচ্চাটা। ওর আঙুলে লাগা জিলিপীর রস গড়িয়ে গড়িয়ে ওর হাতের কব্জীর দিকে নামছিল — তাই দেখতে দেখতে বাসন্তী জিজ্ঞেস করল, বাউলদাদা, ও কি আপনার ছেলে?
বাউল চোখ অর্ধেক বুজে জিলিপীর গাঁট চিবোচ্ছিল। মুখের খাবার গিলে নিয়ে জবাব দিল, হ্যাঁ গো দিদি।
তারপর আরও আলাপ হল। বাউলের নাম রতন দাস, ছেলের নাম পেল্লাদ। ছেলের মা নেই, বাচ্চা হবার সময়ই মারা গেছে। ওরা থাকে বীরভূম জেলায়, নানুরে। বাপ ছেলেকে নিয়ে মেলায় মেলায় ঘোরে। নিজে গান করে, ছেলে খোল বাজায়।
কি আশ্চর্য বাজানোর হাত এইটুকু বাচ্চা ছেলের — বাসন্তী বলল। ভগবানের দয়া আছে ওর ওপর। তা না হলে এরকম হয় না।
এক সন্নিসী বলেছিল ওর মা ওর ওপর ভর করে — রতনদাস বলল। দারুন ভাল গান গাইত আর খোল বাজাত আমার পরিবার। ভগবান ডেকে নিলেন — কি আর করব। আর সংসার করি নি। তাহলে ছেলের সব ক্ষমতা চলে যাবে। পেল্লাদ বড় হোক। আপনাদের পাঁচজনের আশীর্বাদে ওর নাম হোক, যশ হোক।
বাসন্তী অপলক চোখে পেল্লাদের দিকে তাকিয়েছিল। বলল, হবে, নিশ্চয়ই হবে।
পেল্লাদ তার জিলিপী শেষ করে আঙুল আর হাতের তালু চাটছিল বাসন্তী আরও কয়েকটা জিলিপী বাড়িয়ে ধরল ওর দিকে। পেল্লাদের চোখে শিশুর সরল এবং লোভের চাউনি। কিন্তু ও তাকাল বাপের মুখের দিকে। বাপ মাথা নাড়ল। বাসন্তীর দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ল ছেলেও। আর নেবে না।
বাসন্তী যত্ন করে ধুইয়ে দিল পেল্লাদের হাত। তারপর মুছে দিল নিজের শাড়ির আঁচল দিয়ে। কিছুতেই খাবারের পয়সা নিল না রতনদাসের থেকে। বলল, বাউলদাদা, আবার খেতে আসবেন ছেলেকে নিয়ে।
দলের বাকি মেয়েরা বাসন্তীর ব্যবহারটা নজর করছিল। বাউল ছেলেকে নিয়ে চলে যাবার পর সেবা বলল, ওদের থেকে খাবারের দাম যে নিলি না বাসি, ও টাকাটা তো আমাদের লোশকান গেল।
বাসন্তী এতক্ষণ ওর সঙ্গীদের কথা ভাবে নি। সেবার কথায় একটুখানি থতমত খেল। তারপর আমতা আমতা করে বলল, না — এই বাচ্চাটাকে একটু খাওয়ালাম — ওদের খাওয়ার টাকাটা আমিই তহবিলে দিয়ে দেব।
ললিতা ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসে। বলে, বাপ্রে, এত পীরিত? বাউলের ঘরে গিয়ে ঐ বাচ্চার মা হবি নাকি, বাসি?
বাকী মেয়েরাও মুচকী মুচকী হাসে। বাসন্তী কোন জবাব না দিয়ে নিজের কাজে লেগে যায়। কাজ করতে করতেই পেল্লাদের কথা ভাবে। কি মিষ্টি বাচ্চাটার মুখটা।
আর কিন্তু বাসন্তীর দেখা হল না ওদের সঙ্গে। আজ মেলার শেষ দিন — সন্ধেবেলাতেও দোকানে খদ্দেরের প্রচুর ভীড় ছিল। সেই ভীড় সামাল দিয়ে আর পেল্লাদের বাজনা শুনতে গিয়ে উঠতে পারে নি বাসন্তী। আশা করেছিল বাউলদের আসর শেষ হলে বেশী রাতে হয়তো রতনদাস ছেলেকে নিয়ে খেতে আসবে। বাসন্তী মনে মনে ঠিক করে রাখছিল দোকানের ঝাঁপ একটু বেশী রাত অবধি খোলা রাখতে হবে। দলের বাকী মেয়েরা শুয়ে পড়লে ও একাই খাবার গরম করে বাপ ছেলেকে খাওয়াবে। কিন্তু রাত বারোটা পার হয়ে গেল — দোকান ফাঁকা — ওদের দেখা নেই। তখন ঘুমজড়ানো গলায় রাধা বলল, বাসি, এবার দোকান বন্ধ কর্। ওরা আজ আর আসবে না।
পরের দিন সকালে দোকান ভেঙে বাড়ি ফেরার পালা। অনেক কাজ — এক গাদা নগদ টাকা সামলে রাখা, ডেকরেটারের পাওনা চুকিয়ে তার জিনিস ফেরত দেওয়া, নিজেদের জিনিস গুছিয়ে নেওয়া। একটা ছোট্ট লরীর ব্যবস্থা করেছে বাসন্তী — চলতি কথায় ছোট হাতি। বাসের থেকে খরচা বেশী, কিন্তু নিজেদের মত করে যাওয়া যাবে। আর যাওয়ার পথেই ব্যাঙ্কে টাকাগুলো জমা দিয়ে যেতে হবে — নইলে অত নগদ টাকা রাখতে কোথায়?
তবু ওরই মধ্যে সময় বার করে সামিয়ানাটার ওখানে গিয়েছিল বাসন্তী। যদি ওদের খোঁজ পাওয়া যায়। তখন লোক লেগে গেছে সামিয়ানার বাঁশ আর ত্রিপল খুলে ফেলার জন্যে। ওদেরই একজন বলল, ঐ যে ওই বাচ্চাটা? দারুন খোল বাজায়? ওরা তো কাল রাতেই চলে গেছে। লাস্ট বাস ধরে চলে গেছে।
আর একজন ফোড়ন কাটল, অনেক টাকা পেয়েছে রতনদাস। ছেলের রোজগারে এখন ছমাস বসে খাবে।
আবার শুরু হয়ে গেল শ্রাবণের ঝিরঝিরে বৃষ্টি। বাসন্তী ফিরে এল ভিজতে ভিজতে। ততক্ষণে ওদের ছোট হাতি এসে গেছে। মালপত্র তোলা হচ্ছে। তদারক করছে ললিতা। টাকার বাক্স চাবি দিয়ে বন্ধ করে রাধার জিম্মায়। দু হাতে বাক্স আঁকড়ে ধরে রাধা গিয়ে সামনে ড্রাইভারের পাশে বসল। বাকিরা সবাই মালপত্রের সঙ্গে গাড়ির ছাদখোলা পেছনে। সুমতি বুড়ি পা তুলে গাড়ির উঁচু পাটাতনে উঠতে পারছিল না। সবাই মিলে ওকে হিঁচড়ে টেনে ওপরে তুলে নিল।
।। ৩ ।।
সন্ধেবেলা ঘরে বসে কাজ করছিল বাসন্তী আর সুমতি। বাসন্তীর সেলাই কল এসে গেছে। ও তাতে সেলাই করছিল — মেয়েদের ঘরে পরে থাকার হাউসকোট আর রাতে পরে শোবার নাইটি। বোলপুরের একটা লোকের সঙ্গে বন্দোবস্তো হয়েছে। লোকটা ওকে কাপড় আর রঙবেরঙের সুতো দিয়ে যায় — আবার তৈরি করা মাল নিয়ে যায়। প্রত্যেকটা জামায় বাসন্তী একটা মজুরি পায়। বিদ্যুৎ যথারীতি নেই। হ্যারিকেন জ্বেলেছে বাসন্তী। তাতেও আলো একটু কম হয়ে যায় — সেজন্যে ঘরের দরজা খুলে রেখেছে। পূর্ণিমা সামনে, এখন সন্ধেবেলাতেই চাঁদ উঠছে বড় করে। দরজা খোলা থাকলে ঘরটায় প্রচুর আলো আসে। বাসন্তীর কল খচাখচ চলছে — সুমতি শালপাতার থালা তৈরির কাজে একটু ঢিলে দিয়ে বকর বকর করছে। ওর মরদ নাকি ওকে ঘর থেকে বার করে দিয়ে আর একটা বিয়ে করে এনেছিল। বাসন্তী ওর কথায় কান দিচ্ছিল না। অনেকগুলো টাকার অর্ডার আছে। এটা শেষ করতে পারলেই আর একটা কাজ ধরতে পারবে। সামনের বর্ষার আগে ঘরের ছাদটা পাকা করতে পারলে ভাল হয়। এভাবে চালাতে পারলে হয়ে যাবে মনে হচ্ছে।
ঘরের ভেতর একটা ছায়া পড়ল। একটা লোক এসে দরজার বাইরে দাঁড়িয়েছে। ওরা দুজনেই হাতের কাজ থামিয়ে মুখ তুলে তাকায়। দরজায় দাঁড়িয়ে আছে লখা।
ঘরের ভেতর একটা ছায়া পড়ল। একটা লোক এসে দরজার বাইরে দাঁড়িয়েছে। ওরা দুজনেই হাতের কাজ থামিয়ে মুখ তুলে তাকায়। দরজায় দাঁড়িয়ে আছে লখা।
লখাই প্রথম কথা বলল, ভেতরে আসতে দিবি?
আয় — বাসন্তী বলল।
লখা তবু দরজায় দাঁড়িয়ে। মারবি না তো?
একটু ভয়ে ভয়েই বলল লখা।
বাসন্তী জবাব দিল না। হাসি চেপে গম্ভীর মুখ করে রইল। উত্তর দিল সুমতি — মার খাওয়ার মত কাজ যদি কর তবেই মারবে, নইলে মারবে কেন?
এবার বাসন্তী কথা বলল, ঐ বাক্সে তোর জামা প্যান্ট আছে। নিয়ে পুকুরে যা, চান করে পরিষ্কার হয়ে আয়।
ব্যাপারটা বুঝতে বাসন্তীর অসুবিধে হয় না। মনা ওকে তাড়িয়ে দিয়েছে। কাজ পাচ্ছে না কোথাও — থাকারও জায়গা নেই। তাই ঘুরে ফিরে এখানে এসেছে। ওকে দেখে বাসন্তীর একটু মায়া যে হয় নি তা নয়। কিন্ত ও সেই মায়াকে বাড়তে দেয় না। ও লখাকে একেবারেই প্রশ্রয় দেবে না। একটু বেচাল দেখলেই ঝাঁটা মেরে বার করে দেবে।
লখা স্নান করে পরিষ্কার জামা পরে ফিরে আসে। দরজার কাছে বসে — ঘরের এক কোণে, গুটিসুটি মেরে। আর করুণ মুখে বাসন্তীর দিকে তাকায়।
বাসন্তী বোঝে। সুমতিকে বলে লখাকে খেতে দিতে। ভাত, ডাল আর আলুভাজা। দুজনের মত রান্না করা ছিল। দেখতে দেখতে লখা দুজনের ভাত শেষ করে দিল। বাসন্তী কিছু বলল না। একদিন না হয় পেট পুরে খেয়ে নিক। সুমতি গজ গজ করতে করতে আবার ভাত বসাতে গেল।
খেয়ে উঠে লখা আবার মুখ কাঁচুমাচু করে। বলে, আজ রাতটা থাকতে দিবি? মেঝেয় শুয়ে থাকব। কাল সকালেই চলে যাব।
বাসন্তী ইচ্ছে করে মুখ গম্ভীর করে। ঘরের এককোণে মেঝের দিকে আঙুল দেখিয়ে বলে, ওখানে মাদুর পেতে শুয়ে পড়্। কোন বদমায়েসি করলেই বাড়ি থেকে বার করে দেব। আর কাল সকালেই বিদেয় হবি কিন্তু।
গভীর রাতে বাসন্তীর ঘুম ভেঙে গেল। লখা তক্তপোশে পাতা বিছানায় উঠে এসেছে। বাসন্তীর পাশে। ঘনিষ্ঠ হবার চেষ্টা করছে। বাসন্তীর মনে পড়ল সেই সন্ধেবেলার কথা। লখা ওকে মারধোর করেছিল — বিক্রি করতে চেয়েছিল মনার কাছে।
নিশুতি রাত ঝাঁ ঝাঁ করছে। শোনা যাচ্ছে একটানা ঝিঁঝির ডাক। আজ সুমতি বুড়িটা রান্নাঘরে গিয়ে শুয়েছে। বাসন্তী একবার ভাবল চেঁচিয়ে ওকে ডাকে। তারপরই আবার ভাবল ধাক্কা মেরে লখাকে তক্তপোশ থেকে ফেলে দিয়ে খ্যাংরা দিয়ে পিটিয়ে বার করে দিলেই তো হয়।
কিন্তু কোনটাই করল না বাসন্তী। লখা সাহস পায়, আরও ঘনিষ্ঠ হয়। আর বাসন্তী চোখের সামনে দেখতে থাকে একটা পাঁচ ছ বছরের ছেলে — কপালে বাসন্তীর পরিয়ে দেয়া কাজলের টিপ — গলায় দড়ি দিয়ে ঝোলানো বাসন্তীর কিনে দেওয়া খোল। দক্ষ হাতে খোলে চাঁটি মারে বাসন্তীর ছেলে — শব্দ ওঠে — চাটিম, চাটিম—।