প্রথম পর্ব
কে এই দেবতা যাকে হবিষ্ দিয়ে উপাসনা করি? —হিরণ্যগর্ভ সুক্ত, ঋগ্বেদ ||
ঈশাবাস্যম্ ইদং সর্বম্। যৎকিঞ্চ জগত্যা জগৎ। এই সবের মধ্যে ঈশের আবাস। যা কিছু জগতে গতিশীল।
দাড়িম্ব বৃক্ষের আশ্রয়ে বসে প্রত্যূষ থেকে এইসব তত্ত্ব বোঝাচ্ছিলেন তরুণ ঋষি গৌতম। যে কটি ব্রহ্মচারী গুরুবাক্যের সেবা করছিল তাদের অর্ধেকের চোখ ঘুমে ঢুলছিল। অন্যরা একে অপরকে চিমটি কেটে জাগিয়ে রেখেছিল। গৌতমকে কেউ রাগাতে চায় না। কারণ রাগলে ঋষির দাঁতে দাঁত লেগে মূর্ছা হয়। পায়ে তপ্ত ঘৃত মর্দন করে বাঁচাতে হয়।
কিন্তু কে এই ঈশ, সর্বভূতের মধ্যে যার আবাস? কোত্থেকে সে উদ্ভূত? তার জন্মবৃত্তান্ত কী? সে স্ত্রী না পুরুষ? না কি উভয়? চিমটি খেয়ে একটি দুষ্কুল ছাত্র হঠাৎ চাঙ্গা হয়ে উঠেছে। তূণ থেকে পাঁচ সাতটি প্রশ্নের বাণ বের করে সে উপর্যুপর ঋষির দিকে ছুঁড়ে দিয়েছে। অন্যরাও কৌতূহল দেখিয়ে একটু নড়ে চড়ে বসল।
—শোনো বৎস এইসব জটিল প্রশ্ন কশ্যপমুনিকে গিয়ে কোরো। বেদান্তের মধ্যে এই প্যাঁচগুলি ওনারই অবদান কিনা। খচে গিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন গৌতম। —যখন ছোট ছিলাম তখন সব বুঝব বলে তেড়েফুঁড়ে আমরাও গিয়েছি ওনার কাছে। লাভ হয়েছে লবডঙ্কা। কানে চিরকাল একটু কম শোনেন, প্রশ্ন করলে তো একেবারে বধির। কিসুই বোঝাননি। তারপর মারীচ এইসব রহস্যগুলি তাঁর আশ্রমে বর্জন করেছেন। আমিই গর্দভের মতো এখনও পড়িয়ে যাচ্ছি। আমার পরে কেউ এসব নিয়ে ঘন্ট পাকাবে না। মূল তত্ত্ব হল কী? আত্মা বোঝো, আত্মা?
—মানে প্রাণ?
—না ঢক্কেশ্বর না। প্রাণ তো আজ আছে, কাল বেরিয়ে পঞ্চভূতে বিলীন হয়ে যাবে। আত্মা হল পরমাত্মার একটুকরো অংশ। পবিত্র, নির্গুণ। তার উপর চেপেছে তোমার ষড়রিপু। ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। পারলে, লোভটাকে বের করে দাও। মা গৃধ। আর কামটা যদি কমাতে পারো তো দারুণ। ত্যাগের মধ্যে থাকো। ইহাই বেদান্ত। তোমার জন্য এটুকুই যথেষ্ট।
—কিন্তু আচার্য, সেদিন কশ্যপ যে হঠাৎ আমাদের ডেকে বললেন—ওহে অমৃতের সন্তান তোমরা অমৃতের কথা শিখছো, জানছো তো? মনে রেখো মৃত্যুকে তোমরা অতিক্রম করে যাবে। এটাই বেদান্তের প্রথম ও শেষ কথা।
—বটে? আর কী বলছেন তোমাকে ঋষি?
—গণিত শিখেছি কিনা জিজ্ঞেস করলেন। বললাম যোগ, বিয়োগ, গুণ তিনটেই উত্তম শিখিয়েছেন গৌতম। তখন কশ্যপ হলুদ দন্তপঙ্ক্তির ফাঁক থেকে একটি বদরিকা ফল বের করে বললেন—মনে কর এই হল পূর্ণ। এর থেকে পূর্ণ আদায় করে নিলে কী থাকে? এই বলে বদরিকাটি কপ করে গিলে ফেললেন। আমরাও সহজ হয়ে গেছে ভেবে সমস্বরে বললাম—শূন্য। তখন কশ্যপ বাতাস থেকে একটি বদরিকা সৃষ্টি করে আমাদের দেখালেন এবং মুখ ব্যাদান করলেন। হাসলেন না ভেংচি কাটলেন বুঝতে পারলাম না। বললেন—আরে দূর্ দূর্। ওসব সেকেলে কথা। এখন আর চলে না, এবার নতুন গণিত একটু শেখো। পূর্ণমিদং পূর্ণমদ:, পূর্ণাৎ পূর্ণম্ উদিচ্যতে। পূর্ণস্য পূর্ণমাদায় পূর্ণমেব অবশিষ্যতে। অর্থাৎ ...। থাক আর বললাম না। গৌতমাচার্যকেই জিজ্ঞেস কোরো। আর বোলো এবার একটু মন দিয়ে পড়াতে।
গৌতম হাতের কাছে একটা গাছের ডাল রাখেন। সেটা শক্ত করে ধরতে গিয়ে মট করে ভেঙে ফেললেন। দাঁতে দাঁত লাগতেই যাচ্ছিল—ছাত্ররা হৈ হৈ করে তাঁকে ধরে মুখের ভিতর কাষ্ঠখণ্ডটি সবলে প্রবেশ করিয়ে দিল।
অক্ষি আর হারা দুই বোন। কশ্যপের জ্যেষ্ঠা কন্যা অক্ষিরও দ্বিতীয় রিপু প্রবল। এতক্ষণ ধরে সে গৌতমের বেদান্ত দর্শন শুনে দাঁত কিড়মিড় করছিল। তারপর থাকতে না পেরে এক ঝুড়ি দাড়িম্ব নিয়ে চলে গেছে নদীর তীরে। একটি প্রিয় উপলখণ্ডের উপর বসে নিরালায় ফল দিয়ে উদরের সেবা করবে। যিনি দাড়িম্ব, তিনিই অক্ষি। উভয়ের মধ্যেই ঈশের আবাস। সে যে নদীটির তীরে গিয়ে বসেছে, তার নামও প্রকৃতপক্ষে হারা।
হারা নদীটি শীর্ণ এবং অত্যন্ত গতিমান। তাতেও ঈশ ভর করে আছেন। অক্ষির বাবা বলেছিলেন—যৎকিঞ্চ জগত্যা জগৎ। যা কিছু চলমান তার সবেই ঈশ বিদ্যমান। এর মানে কী? যব, তিল, মাষ বা ব্রীহি নয়, অথচ যে তারাগুলি আকাশে ভ্রমণ করে, সেগুলি ঈশাবাস্য? অক্ষির ছোট বোন হারার মতে বার্ধক্যের প্রলাপ। যার কোনো মানে নেই। গৌতম নিজেও যে কিছু বুঝে উঠতে পারেননি সেটা হয়তো দোষের নয়। কশ্যপের মন্ত্রের মাথামুণ্ডু আছে কিনা অক্ষির নিজেরই সন্দেহ হয়। অথচ তার মধ্যে একটা অদ্ভুত আকর্ষণও আছে। অন্যেরা যখন বলে ইন্দ্র বা সবিতার মন্ত্র, তখন কশ্যপ বলে বসবেন হিরণ্যগর্ভের কথা যার বিষয়ে কেউই কিছু জানে না। সে কি দেব? না অসুর? একটি রহস্যময় পুরুষ বারবার এই মন্ত্রগুলিতে চলে আসে। তার কোনো নাম নেই। কখনো তাকে মনে হয় সমস্ত সৃষ্টির চেয়ে বৃহৎ। কখনো সে জলের মধ্যে দ্রবীভূত লবণের চেয়েও সূক্ষ্ম। অক্ষি যখন একলা থাকে তখন তার মনে হয় এই পুরুষ কি সবার অলক্ষ্যে থেকে তাকে লক্ষ করছে?
অক্ষির বোন হারার আরেক নাম হল বাক্। বাক্ ও অক্ষি, এই দুটি নাম দিয়েছিলেন কশ্যপ তাঁর দুই কন্যাকে। তাদের জন্ম হয় যেখানে সেখানে একটি আরো বৃহৎ ও খরস্রোতা নদী ছিল, যার নাম অক্ষি। তাকে কেউ কেউ আবার বলত চক্ষু। তার জল ছিল স্বচ্ছ ও গভীর, আর তার দুই ধারে ছিল পর্বত। দুর্লভ ফলের গাছ হত সেখানে। শীতঋতুটি ছিল দীর্ঘ এবং মেষচর্মের বস্ত্র ছাড়া জীবনধারণ সম্ভব ছিল না। বাকের জন্মের পর তার নামকরণেরও আগে তার মা সেই শীতঋতুটি সহ্য করতে না পেরে মরে গেলেন। তখন কশ্যপ অভিমান করে শিষ্যদের নিয়ে অক্ষির তীর থেকে চলে এলেন বহুদূরে। অনেকগুলি বিপদসঙ্কুল গিরিপথ পার করে দক্ষিণে এমন একটি উপত্যকায় চলে এল সবাই যেখানে ঋতুগুলি উষ্ণ ও শান্ত। একটি ক্ষুদ্র নদীও পাওয়া গেল, যার আঞ্চলিক নাম হারা। সেই নদীর জলে দাঁড়িয়ে কশ্যপ তাঁর দ্বিতীয় কন্যার নাম দিয়েছিলেন বাক্, হয়ত এই আশায় যে তাঁর নিজের জিভে ঋষিবাক্যগুলি আবার আসা যাওয়া করবে। দু:খের বিষয় তাঁর চক্ষু ও বাক্, দুটি ইন্দ্রিয়ই শনৈ: শনৈ: বিদায় নিচ্ছিল। যাহোক, দলের আর সবাই, শিশুটিকে ডাকতে আরম্ভ করল হারা বলে।
অক্ষির তীর ত্যাগ করার সময় কতকগুলি গোষ্ঠিবিবাদ ও কলহের সূত্রপাত হয়। শীতঋতুটি সকলের অপ্রিয় ছিল না। তাছাড়া মেষপালকদের পক্ষে অক্ষির পাশের তৃণসমৃদ্ধ ভূমিগুলি ছিল বড়ই সুখদায়ক। অনেকে থেকে যায় অক্ষির তীরে। কশ্যপ যেখান থেকে নিজের জীবনের যাত্রা আরম্ভ করেছিলেন, সেই কশ্যপ সাগরের তীর থেকে হারার উপত্যকা পর্যন্ত এইভাবে একাধিকবার গোষ্ঠিগুলি পৃথক হয়েছে।
সেজন্য গৌতম সখেদে মাথাও চাপড়ান। ঋক্ মন্ত্রগুলি অন্যান্য গোষ্ঠিদের উচ্চারণে নাকি বিকৃত হচ্ছে। ফলে দেবপিতৃগণ রুষ্ট, বৃষ্টি উর্ধ্বমুখী হচ্ছেন। গরু ও ছাগলগুলি পীতোদক, জগ্ধতৃণ, রুগ্ন ও জীর্ণ হয়ে পড়ছে। গোচোনা এবং গোময়ের আচারনিষ্ঠ সমাদরে ত্রুটির জন্য শুক্রাণু নির্জীব, রমণীরা বন্ধ্যা। আরও ভয়ের কথা, ঋষিপুত্রদের পুরীষ নিষ্প্রাণ এবং মুত্রও নাকি ভ্রষ্টলক্ষ্য ও তির্যকগতি। হায় কী হবে!
কশ্যপের আশ্রমে এইসব পৌরীষিক আলোচনা যতই বৃদ্ধি পাচ্ছে, কশ্যপ ততই স্বল্পবাক এবং নির্বিকার হয়ে যাচ্ছেন। এদিকে অক্ষি ক্রুদ্ধ হতে হতে একটি ব্যাঘ্রশাবকে পরিণত হয়ে গেছে। তার দুচোখ রাঙা, নাসা স্ফীত ও ক্ষুধা প্রভূত বৃদ্ধি পেয়েছে। হারার ধারণা কোনো না কোনো দিন রাগের মাথায় গৌতমের মুণ্ডে একটি দাড়িম্ব ভাঙবে অক্ষি। এবং সেই সঙ্গে আশ্রমটিও ভাঙবে আরেকবার।
কশ্যপ গৃহে একটি কাঠের শয্যায় আধশোয়া হয়ে ছিলেন। হারা ঢুকতে হাই তুলে বললেন যা—গিয়ে দুটো ডালিম নিয়ে আয় তো! জঠরে অগ্নি এবং বায়ুর সমর আরম্ভ হয়েছে।
—ডালিম পাবো কোথায়?
—কেন? তোর দিদির কাছে। নদীর ধারে। সে খাচ্ছে তো বসে বসে।
—দিদি নদীর ধারে? তুমি জানো?
—দেখতে পাচ্ছি যে?
—কী দিয়ে দেখবে? চোখ তো বন্ধ! গন্ধ পাচ্ছো বোধহয়।
—না না দেখছি। চোখ বন্ধ করলেই সব দেখতে পাই। আমি ঋষি। তোকে বলিনি? জগতে যা কিছু আছে, সবই ওরা আমাকে দেখিয়ে যাচ্ছে।
—ওরা কারা?
কশ্যপ উত্তর না দিয়ে এবার চোখ পাকিয়ে রইলেন।
—সব কিছু দেখাচ্ছে? যৎকিঞ্চ জগত্যা জগৎ?
—আবার কি? আমি তোর মনের ভিতরটাও দেখতে পাই। যেখানে অঙ্গুষ্ঠমাত্র একটা ক্ষুদ্র মানুষ বসে বসে সরল বস্তুকে জটিল করেছে। তোর অন্তরের মানুষ। সারাদিন ধরে বলছে—প্রমাণ দাও, প্রমাণ দাও। তাকে আমি শান্ত হতে বললাম ...।
—দিলেই পারো একটা প্রমাণ।
—দেব? ভয় পেয়ে যাবি।
—ভয় পাবো কেন? তুমি কি অসুর? না যক্ষ?
—অসুরই। কিন্তু অন্যরকম। তুই যা ভাবছিস তা নয়। আচ্ছা প্রমাণ দিচ্ছি। আমি দেখতে পাচ্ছি ওই বন্ধ দরজার বাইরে একটা বাচ্চা অসুর। সে দ্রুত আমাদের দিকে আসছে। তুই এক-দুই করে মনে মনে বারো গোন।
—এক দুই তিন চার ...
বারোর মাথায়ই দরজায় আঘাত পড়ল। হারা গিয়ে দরজা খুলে দেখে আবক্ষশ্মশ্রু একটি পরিচিত মুখ। কশ্যপ সাগর থেকে হারার তীর অবধি ঊর্ণ, চর্ম ও সোমরসের জন্য পীত রেণু নিয়ে আসা যাওয়া করে এই বণিক। এর নাম জরাহন্। লোকে জরা বলেই ডাকে। হা হা করে হেসে সে বলল –তদ্ হবিতু: বৈর্য:। একে বরেণ্যেকে বৈর্য, সবিতৃকে হবিতৃ বলছে, তায় আসুরিক উচ্চারণ। হারা দেঁতো হাসি হেসে বলল—বাবা ভালো নেই। তুমি আরেকদিন এসো। যে পথ দিয়ে এসেছিলে সেই পথেই লাফাতে লাফাতে চলে যাও ঋষি গৌতমের কাছে।
—হোনো বাচাল মেয়ে, তুমি কিছুই জানো না। আমি হাত দিন ধরে হয়ের পিঠে করে লাফাতে লাফাতে এতদূর এহেছি কারণ তোমার পিতাই ডেকে পাঠিয়েছিলেন। এখন এখানেই উপবেহন করব। হয্যা পেলে হাত পা ছড়িয়েও নিতে পারি। তুমি তর্ক না করে কিছু খেতে দাও। মাংহ আর হোম।
স’কে হ’ বলে এই অসুরের বংশধররা। হোম মানে সোমরস। জ'য়ের উচ্চারণ এমন অশ্রাব্য যে কানে আঙুল দিতে হয়। তবে অসুরদের বংশধররা দেখতে সুন্দর। তাদের নাসিকা তীক্ষ্ণ এবং কেশ অনেকসময় পিঙ্গল। জরাহন্ স্বয়ং অবশ্য তেমন কিছু রূপবান নয়। কশ্যপের চেয়েও দীর্ঘ ও ঘন কেশরের মতো চুল আর দাড়ি। মস্তক ও বক্ষ অত্যধিক প্রশস্ত। রোমশ ভুরুর নিচে চক্ষুদুটি বৃকের মতো আয়ত এবং তির্যক। তার হাবভাবের সঙ্গে একটি বুনো বৃষের মিল পাওয়া যায়। কশ্যপ স্বয়ং শয্যা ছেড়ে তড়াং করে উঠে পড়লেন। মনে হল তাঁর সমস্ত বার্ধক্য এক নিমেষে গত হয়েছে।
—যা বলেছিলাম তা এনেছিস জরা?
—নিশ্চয়ই।
হবিষ্ ও যবের চূর্ণের সঙ্গে সূপ এবং ফলের সঙ্গে দধি, এই হল দুপুরের আহার্য। কশ্যপের পাশে বসে জরা বসে আহার করছিল। অক্ষি ফেরেনি তখনও। জরা বলল—কবে যাচ্ছেন তাহলে? আমি কয়েকটি উত্তম অশ্বতর নিয়ে আসব। দু-চাকার শকটও থাকবে। যা কিছু নেবার সব একবারেই নেওয়া যাবে।
কশ্যপ বললেন—বিলম্বের কোনো প্রয়োজন নেই। যথাশীঘ্র আনতে পারো নিয়ে এসো। সম্ভব হলে সাতদিনের মধ্যে আমরা চম্পট দেব।
হারা বিস্মিত হয়ে বলল—কোথায় যাচ্ছো তুমি বাবা?
কশ্যপ স্মিতমুখে বললেন—আমি একা নয়, আমরা সবাই। মানে আমরা তিনজন। আমরা আবার অক্ষির তীরে চলে যাব। তুই, আমি আর অক্ষি।
—আবার অক্ষির তীরে চলে যাব? শুধু তিনজন? আর দলের অন্যরা?
—তারা থাকুক যেখানে আছে। কী অসুবিধে তাদের? গৌতম, মারীচ, অঙ্গিরা এরা সব তো কবিশ্রেষ্ঠ। ঝটিকার বেগে নতুন নতুন মন্ত্র বলে যাচ্ছেন। শিষ্যরা, মেধাবী, মনস্বী। আমি ঋষির দূরদৃষ্টি দিয়ে দেখতে পাচ্ছি এদের বংশধররা হবে অকল্পনীয় কীর্তিমান। আসমুদ্র গোধন ভোগ করবে এরা।
—ধন? তোমার সূক্তের পর গৌতম কী জুড়ে দেন সেটা জানো? কস্য স্বিদ্ ধনম্। মা গৃধ:। ধন কার হবে? লোভ কোরো না। নিজের বংশধরদের অতীব দরিদ্র করে রাখাই এদের উদ্দেশ্য। অক্ষি কেন রেগে থাকে জানো না তুমি?
—অক্ষির মধ্যে অসুরগণ বড় তীব্র। মাঝখান থেকে বলে উঠল জরা। —সে মাংসপ্রিয়। আমাদের মতো। বলে হা হা করে বোকার মত খানিকটা হেসে নেয় সে। তারপর কশ্যপ আর হারাকে চুপচাপ দেখে আবার গম্ভীর হয়ে আহারে মন দেয়।
হারা তার দিকে একবার বিরক্ত দৃষ্টিপাত করে। কশ্যপ বললেন—যে যা চায় করুক। এরা হল ফল আর দুগ্ধের সন্তান। এসব খেয়েই দেখিস সংখ্যায় কত বৃদ্ধি পাবে এবং অনার্যদের সাথে সঙ্গম করে সমগ্র আর্যাবর্ত অধিকার করবে। তারপর তিন সহস্র বৎসর ধরে একনিষ্ঠভাবে গোময়ের সেবা করে জগতে প্রসিদ্ধিও লাভ করবে। আর জরা, তোরা হলি মাংসের সন্তান। তোদের বংশধরদেরও আসমুদ্র প্রভূত ভূমি হবে। তোরা থাকবি কশ্যপ সাগরের দক্ষিণে, পশ্চাৎবর্তে। সেখানে মিত্র ও বৃত্রঘ্ন তোদের সহায় হবেন। তবে তোদের ভাগ্যেও পরে অন্যান্য বিপদ আছে।
—আমরা কাদের সঙ্গে থাকছি? জিজ্ঞেস করে হারা। —আমরা গোময়ভক্তদের দলে না গোমাংসভোজীদের দলে?
—ধীরে ধীরে সব জানতে পারবি। আগে থাকতে সব বললে কাজ পণ্ড হয়ে যাবে। প্রথমে আমরা যাব অক্ষির তীরে।
—কেন? সেখানে কেন?
—সবই বিস্মৃত হলি নাকি? তোদের মা আছে না সেখানে? দাঁড়া, আগে অক্ষিকে নিয়ে আসি। তোরা দুজনে বোঝাবি তাকে। সে যেন যাত্রায় বিঘ্ন না ঘটায়। এই বলে কশ্যপ টান হয়ে দাঁড়িয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।
কশ্যপের বুদ্ধিটি একেবারেই বিনষ্ট হয়েছে। হারা কাঁদো কাঁদো হয়ে যায়। জরাও যেন কশ্যপের এইসব মাথামুণ্ডুহীন কথা শুনে হতভম্ব হয়ে গেছে। মা-মরা মেয়ে হারার করুণ মুখ দেখে তার নিজের চোখেও জল এসে যায়।
—চিন্তা করিস না হারাবতী। সে আশ্বাস দিয়ে বলে। আমার কাছে দুর্দান্ত একটা ওষুধ আছে। যে সর্পকে বৃত্রঘ্ন বধ করেছিল, তার তেল।
—খাবার না মাথায় দেবার?
—দুটোই। রাতে আহারের সাথে এক ষর্ষপ খাইয়ে দিবি। তারপর ঘুমোলে আমি মাথায় মাখিয়ে দেবো। ঋষির মরুৎ ক্ষুদ্ধ হয়ে আছেন। তাঁকে শান্ত করতে হবে।
—তুমিও বাবাকে নিয়ে পরিহাস করছ?
—মিত্রকে সাক্ষী রেখে বলছি। ওষুধটা কাজের। আমি নিজের উপর প্রতিমাসে প্রয়োগ করি তো। নইলে কবে তোর বাবার মত বদ্ধ উন্মাদ হয়ে যেতাম। আমার মরা মায়ের ভূত যে আমি দেখতে পাই। সে আমাকে ডাকে।
গভীরভাবে হতাশ হয়ে চুপ করল হারা।
কিছুক্ষণ পরে অক্ষি ঘরে দপদপিয়ে ঢুকেই জরার দিকে তর্জনী তুলে বলল—জরা তুই বেরো এক্ষুনি। নইলে আমি তোর দাড়ি উপড়ে নেবো।
জরা সত্যি সত্যিই নিমেষের মধ্যে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। এতক্ষণে হারার মুখে একটু হাসি দেখা গেল। সে বলল—ওর উপর ক্ষেপছিস কেন? বাবা ডেকেছে বলেই তো এসেছে।
—ছাই! ও কেন এসেছে জানিস?
—কেন?
—নিজের মরা মা’কে জ্যান্ত করবে বলে।
—অ্যাঁ?
—কশ্যপ সাগরের তীরে বহু লোকের আজও ধারণা বাবার কাছে মৃতসঞ্জীবনী আছে। এই লম্বোদরের মাথায় এটা ঢোকেনি যে, যে নিজের স্ত্রীকে বাঁচাতে পারেনি সে অন্যের মাকে কী করে বাঁচাবে।
—তাহলে তুই বাবাকে বোঝা। আমার কথা তো শুনবে না। তোকে সবাই ভয় পায়।
—কী বোঝাবো?
—এই যে আমরা যেখানে আছি সেখানেই ভালো। আবার শীতের দেশে ফিরে যাবো কেন?
অক্ষি কিছু না বলে বাঁ হাতের চেটোয় মুষ্টিবদ্ধ ডান হাত ঠুকতে লাগল।
—কী হল? কোনো অসুবিধে আছে?
—শোন হারা, আমরা অক্ষির তীরেই যাবো। তবে এই অসুরটাকে যথাশীঘ্র তাড়াতে হবে।
—কিন্তু কেন? এই আশ্রমে কী অসুবিধে তোর?
—দেখতে পাচ্ছিস না এরা বাবাকে মেরে ফেলছে?
—মানে?
—বাবার সূক্তগুলোকে যেমন তেমন ভাবে পরিবর্তন করে দিচ্ছে! ধন সম্পত্তি নিয়ে বাবা কখনো কিছু বলেছে? গোময় নিয়ে? বাবা এদের অমৃতের পুত্র বলে সম্বোধন করেছিল। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এরা হল হবিষ আর পুরীষের পুত্র। এদের সঙ্গে থাকলে কশ্যপের কথা আর কারো মনে থাকবে না। অক্ষির তীরে আমরা নিজেদের আশ্রম আরম্ভ করবো।
—কে চালাবে? বাবা তো বৃদ্ধ ঋষি! প্রায় অন্ধ হয়েও ভাবছে দেখতে পায়। কবি কোথায় পাবি? শিষ্য আসবে কেন?
—তুই বলবি নতুন মন্ত্র। আর আশ্রম চালাবো আমি। কোনো ভয় নেই। আমি তোদের মরতে দেবো না।
অশ্বতরের উপর মাসাধিক যাত্রার পর এমন একটি স্থান পাওয়া গেল যা কশ্যপের মনে ধরেছে। দুদিকে পর্বত। মাঝখানে ক্ষুরধার অক্ষির ধারা। কশ্যপ এর তীরেই বসে একদিন বলেছিলেন—উত্তিষ্ঠত জাগ্রত। প্রাপ্য বরান্ নিবোধত। ক্ষুরস্য ধারা নিশিত্যয়া দুর্গমং পথস্তৎ কবয়া: বদন্তি। ওঠো, জাগো। শ্রেষ্ঠদের কাছে গিয়ে জ্ঞান লাভ করো। এই ক্ষুরের ধারের মতো দুর্গম পথের কথা কি তাঁর অক্ষির তীব্র স্রোত দেখেই মনে হয়নি?
উপত্যকার মধ্যে বেশ প্রশস্ত একটি তৃণভূমি। ওখানেই আশ্রম হোক, ইচ্ছে ছিল অক্ষির। কিন্তু কশ্যপ কিছুতেই সম্মতি দিলেন না। পর্বতের সন্নিকটে একটি সমতল ভূমি দেখিয়ে দিলেন। তৃণভূমিটি অশ্ব ও গরুর জন্য থাকুক। অন্য কারণও আছে। এই পুরো অঞ্চলটি যেন তাঁর বহুদিনের পরিচিত। জরার সঙ্গে যেকটি অসুর ছিল তারাও কশ্যপের স্মৃতি এত সবল দেখে আশ্চর্য হয়ে গেছে।
কশ্যপ ঘোড়া থেকে লম্ফ দিয়ে নামলেন এবং বালকদের মতো ছোটাছুটি আরম্ভ করলেন। ওইখানে বাঁধো ঘোড়া। এইখানে হবে আশ্রম। এই গাছটির নিচে একটি কুয়ো খুঁড়ে ফেলব আমরা। আর ওই বিরাট তৃণভূমিতে? ওখানে কোনও গৃহাদি হবে না? সুন্দর স্থানটি তো!
—ওখানে যা হবে, তা কল্পনাও করতে পারবে না তোমরা। প্রায় শিউরে উঠে বললেন কশ্যপ।
পক্ষকালের মধ্যেই অসুরেরা আশ্রম নির্মাণ করে ফেলল। এমনকি শিষ্যদের জন্য একটি চালাঘর। অসুরদের মধ্যেও ঋত্বিক ও পুরোহিত রয়েছে। তাদেরই কয়েকটি পুত্র আসবে বেদাভ্যাস করতে। কশ্যপ হারাকে তার অর্ধেক দায়িত্ব দিয়ে রাখলেন। অক্ষি এসবের মধ্যে নেই। সে অসুরদের ধামগুলিতে ঘুরে ঘুরে গরু ও ছাগল সংগ্রহ করতে লাগল। কশ্যপ জরাকে নিয়ে তৃণভূমির চারটি কোণে চারটি অতিকায় যজ্ঞের বেদি প্রতিষ্ঠায় সমস্ত শক্তি নিয়োগ করে দিলেন। এত বড় যজ্ঞের বেদি হারা কোনোদিন দেখেইনি। এ কি অশ্বমেধের যোগাড় চলছে নাকি? কশ্যপকে জিজ্ঞেস করায় কশ্যপ অন্যমনস্ক হয়ে বললেন—এখানে এগুলো আগেও ছিল, তোকে বলিনি? আমরা নতুন কিছু করছি না রে। যেখানে বেদি তৈরি হচ্ছে তার তলায় দেখবি মসৃণ পাথরের চাঁই পড়ে আছে। বহুদিন আগে এখানে রাতদিন যজ্ঞ হত। অতিকায় এই বেদিগুলি থেকে অগ্নিদেব কখনো পৃথক হতেন না। সেগুলিই আবার গড়ে তুলছি আমরা।
—তুমি এসব জানলে কী করে? অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো হারা।
—আমি যে ঋষি। ভূত ভবিষ্যৎ সবই দেখতে পাচ্ছি।
হারাবতীর রাগই হচ্ছিল এবার। কশ্যপের এই মাথামুণ্ডুহীন উন্মাদ ক্রিয়াকলাপের মধ্যে আশ্রম চলবে কী করে? কিন্তু মনে এই প্রশ্ন উদিত হতে না হতেই কশ্যপও সটান ঘুরে দাঁড়িয়ে তার নাকে তর্জনী ঠেকিয়ে বললেন—সব শুনতে পাচ্ছি। আমাকে উন্মাদ ভাবছিস তো ?
—হ্যাঁ ভাবছি। অন্যরাও ভাববে। শিষ্যরা হাসবে এসব যদি শোনে।
কশ্যপ নাক থেকে কপালে তর্জনী নিয়ে গিয়ে বললেন—তোরও হবে?
—কী হবে?
—তোকেও ঋষি করে দেবে ওরা।
মাথার যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে হারা ঋষির সান্নিধ্য ত্যাগ করতে বাধ্য হল।
বেদিগুলি দ্রুত নির্মিত হলো। জরা, আসুরিক শক্তিতে সমিধের বিরাট বিরাট স্তূপ করে ফেলেছে বেদিগুলির কাছে। তাদের আসার দেড় পক্ষ পরে একদিন সন্ধেবেলা বেদিগুলিতে জ্বালিয়ে দেওয়া হল আগুন। কশ্যপ একটি একটি করে চারটিতেই হবিষ ঢালতে আরম্ভ করলেন সূর্য অস্ত যাবার সঙ্গে। এর পর থেকে প্রতি রাতে, কাজের পর, জরা আর কশ্যপকে দেখা গেল একটি ঢিবির উপর বসে দণ্ডের পর দণ্ড ধরে সোমরস পান করতে। দৃষ্টি বেদিগুলির দিকে রেখে সেই সঙ্গে প্রহরে প্রহরে উদ্গার। এই একটি বিষয়ে দেব ও অসুর গোষ্ঠিগুলির আশ্চর্য মিল। দেখতে দেখতে অমাবস্যাও উপস্থিত। আর সাতদিনের মধ্যে শিষ্যগুলি এসে পড়বে। হারা মনে মনে স্থির করল, প্রথম বেদাভ্যাস হবে পূর্ণিমার দিন।
অমাবস্যার মধ্যরাতেই হারাকে ঝাঁকিয়ে ঘুম থেকে তুলল অক্ষি। ঘরের ভিতর অতিক্ষুদ্র বর্তিকার স্বল্পমাত্র আলোয় ভূতুড়ে ছায়া। ফিস ফিস করে অক্ষি বলেছিল—উঠে পড় হারা। ওঠ।
—কী হয়েছে? কী?
—বাবা ডাকছে।
—কোথায়? কই আমি তো কিছু শুনছি না।
—আমি পাচ্ছি। আমার কানের ভিতর গলা পাচ্ছি বাবার। কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল অক্ষি।
—তার মানে?
—এই দ্যাখ। কাছে আয়, শোন।
ক্ষুদ্র তৈলাধার থেকে আলো আর ছায়া বিচ্ছুরিত হয়ে পাথর ও মাটি দিয়ে নির্মিত কুটিরের দেয়ালে পড়ে কাঁপছিল। অক্ষি হারার চেয়ে বেশ খানিকটা লম্বা। তার চোখদুটি বিস্ফারিত। দীর্ঘ বাহু দিয়ে সে হারাকে জড়িয়ে ধরে প্রথমে কপালের সাথে কপাল ঠেকাল। তারপর ধীরে ধীরে সে নিজের মুখ ঘোরাতে থাকল, যাতে গালের সাথে ঠেকে যায় গাল। কানের সাথে কান। অকস্মাৎ একট বজ্রের মতো পরিষ্কার ও গমগমে গলা বেজে উঠল অক্ষির কানের মধ্যে। —হারাবতী। আমি কশ্যপ। তোমাদের বাবা।
চমকে গিয়ে হারা প্রায় মাটিতে পড়ে যাচ্ছিল। অক্ষি তাকে ধরে রাখায় বাঁচল সে এ যাত্রা।
—ভয় নেই—চলে এসো আমার কাছে। আবার কশ্যপের গলা।
ভয়ের চোটে হারাবতীরও চোখ বিস্ফারিত হয়ে যায়। বুক ধড়াস ধড়াস করতে থাকে। দিদির থেকে চেয়ে সে অসহায়ভাবে বলে—কেন?
কশ্যপই তার উত্তর দেন।—এলেই দেখতে পাবে। এজন্যেই তো এতদূর আসা।
গভীর রাতেও তৃণভূমিটি আলোয় আলোকিত। চারটি বেদি থেকে লেলিহান আগুনের শিখা উঠেছে। ঝড়ের মতো হু হু করে হাওয়া বইছে সেদিকে। আন্দোলিত গাছের পাতা ও ডাল থেকে একটা সর সর শব্দ উঠেছে সমগ্র উপত্যকায়। সমিধগুলি ফাটছে বিকটভাবে। উঁচু ঢিবির উপর বসে কশ্যপ আর জরা। তাদের হাতের কাছেই সোমের পাত্র। নিচে দুটি শকটের সঙ্গে বাঁধা জরার চারটি অশ্ব চুপ করে দাঁড়িয়ে। কাঁপতে কাঁপতে অক্ষি আর হারা গিয়ে উপস্থিত হল সেখানে। কশ্যপ ইঙ্গিত করলেন বসতে। তারপর আঙুল দিয়ে দেখালেন তৃণভূমির উপরের মহাকাশ। অন্ধকারে সেখানে আকাশগঙ্গার তারা ধূলির উপর পড়েও, অমাবস্যার প্রশ্রয়ে দ্বিগুণ উৎসাহে জ্বল জ্বল করছিল। জরা ও কশ্যপ দুজনেরই চোখ রক্তবর্ণ। হারা দিদির হাত শক্ত করে ধরে রেখেছিল। অলৌকিক প্রহরগুলির মধ্যে বিচরণ করছে মৃত্যুর মতো অবশ্যম্ভাবী একটি উপলব্ধি। কশ্যপ জিভে কোনো উচ্চারণ না এনেও যেন মনে মনে কথা বলছেন তাদের সঙ্গে। কশ্যপ যেমন বললেন—তোর নাম বাক্, কেন জানিস? কারণ তোর মধ্যে আমি রেখেছি বেদ। এবং সঙ্গে সঙ্গে হারাবতীর দুই কানে সমুদ্রের মত মন্ত্রের ঢেউ আছড়ে পড়তে লাগল। এমন সব বাক্য আসতে থাকল যা সে নিজেই জানত না কখনো। কার বা কাদের এই গলা? এরাই কি সেই জাতি যারা প্রথমে বাস করত এই উপত্যকায়? যারা গড়েছিল অতিকায় যজ্ঞের বেদি?
একটি প্রহর অতিক্রান্ত হল। আগুন তেজস্বী হয়েছে। তার গর্জন শোনা যাচ্ছে অক্ষির জলের শব্দের উপর। জরা আরো একটি একটি সোমরসের পাত্র এনে রেখেছিল। হারা বা অক্ষি সেটি স্পর্শও করেনি। কশ্যপ অলসভাবে একটি হাত তুলে মহাকাশের দিকে ইঙ্গিত করলেন এবং ধীরে ধীরে বলতে লাগলেন।
—ওই অন্ধকারের পিছনে একটি পুরুষ আছে, যে কখনো দৃশ্যমান হয় না। অথচ তার মধ্যে দিয়ে আমরা সমস্ত জগৎকে দেখি। সমস্ত জীবের মধ্যে তাকে শুনি, জানি, ধরি, এমনকি ভক্ষণ করি।
—কোনো জীবের মৃত্যু হলে এই পুরুষ তাকে আহার করে, এবং একটি অবয়ব থেকে অন্য অবয়বে নিয়ে যেতে পারে তাকে। কিন্তু এর পিছনে কি কোনো গূঢ় উদ্দেশ্য আছে? এই জগতের সঙ্গে তার সম্পর্ক কীসের? কতদিনের? এসবের উত্তর রয়েছে আকাশের অন্তরালের সেই পুরুষের ভিতরেই। যে নিজেকে সরিয়ে রাখে মানুষের দৃষ্টির অতীত। তমসার ওপারে।
—এটুকু ব্যতীত আমি কিছু জানিনি, বুঝিনি, দেখতে চাইনি। আমার সূক্তগুলি তাই আরম্ভ হয়েছে এই পুরুষকে দিয়ে, এবং শেষ হয়েছে এখানেই। এই জগতে যা কিছু চলমান, তা আমি সবই দেখতে পাচ্ছি, কিন্তু তা আমার কোনোই কাজে লাগেনি। একটি হিরম্ময় আবরণে কার মুখ অপিহিত? আমি পূষনকে বারবার বলেছি সে মুখ আমায় দেখাতে। কিন্তু আমার যাচনাগুলি বিফল ও নির্গ্রন্থক হয়েছে।
—মৃত্যুর পর এই আত্মাগুলি কোথায় যায়? তারা কোথায় বিহার করে? তারা কি এই পুরুষকে কাছ থেকে উপলব্ধি করে? বাক্, দৃষ্টি, শ্রোত্র, স্পর্শের অতীত কোনো ইন্দ্রিয় কি ক্ষণিকের জন্য পায় তারা? তাহলে সেই বোধি ও ইন্দ্রিয় পেতে গেলে আমাদেরও মরতে হবে। মৃত্যুর পথ অতিক্রম করেই একটি নতুন দিশা উন্মীলিত হতে পারে। আর কোনো পন্থা নেই তার সংসর্গে যাওয়ার।
—না কি আছে? কোনো দুরূহ এবং দুর্গম মার্গ ?
—হাঁ আছে। বারোশো বছরে মাত্র একবার আসে এই সুযোগ।
—তোমার মধ্যে সেই পুরুষ আছে। আমার মধ্যে আছে। আছে প্রতিটি অমৃতের সন্তানে। কিন্তু তার জগৎ এই দৃশ্যমান ও অদৃশ্যমান প্রাণীজগতের চেয়ে বৃহৎ। তার যে অংশগুলি আমাদের ধরা ছোঁয়ার অতীত, সেগুলিকে পেতে গেলে তোমাকে আসতে হবে অক্ষির তীরে।
—বারোশো বছরে একটি করে নক্ষত্রযান আসে এখানে। মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে চলে যায় সেই যান। দেহটি যেতে পারে না, কেবল আত্মাটিকে প্রতিবিম্বিত করে তুলে নেয়। কোনো এক নক্ষত্রের আলয়ে, মৃত্যু থেকে অমৃতের রূপান্তর ঘটায় সেই পুরুষ। বারোশো বছরে একবার সেই পুরুষটির সাক্ষাৎ পায় তার একটি বা দুটি পুত্র ও কন্যা। পরে নক্ষত্রযানটি তাদের ফিরিয়ে দেয় অক্ষি নদীরই তীরে। আজ থেকে ষোলো বছর আগে তোদের মতো দুই বোনকে নিয়েছিল সেই নক্ষত্রযান।
অক্ষিকে মড়ার মত শাদা দেখাচ্ছে। কেননা দপ্ করে তাদের চোখের সম্মুখেই আকাশে জ্বলে উঠেছে একটি আলোর বর্তিকা। এবার চারটি বেদির মধ্যবর্তী ভূমিতে একটি নীল রঙের তরঙ্গ নিক্ষিপ্ত হচ্ছে তা থেকে।
কশ্যপ থামছেন না। তাড়াতাড়ি বলে চলেছেন এখন।
—তোদের মা আর জরার মা হলো দুই বোন। তাদের দেহ আমি সৎকার করি এই নদীর তীরেই। শীতে বা জরায়, কোনো ব্যাধিতে বা শস্ত্রাঘাতে মৃত্যু হয়নি সেই দেহগুলির। তারা নবীন ও অক্ষত ছিল। তাদের আত্মাটি কেবল মিলিয়ে গিয়েছিল একটি নীল আলোর স্পন্দ্যমান তরঙ্গে। যা তমসার অতীত থেকে আসা সেই পুরুষের দেহেরই অংশ।
চারটি বেদির মাঝখানে, তৃণভূমির উপর দুটি অতিকায় ছায়ামূর্তি গঠিত হচ্ছিল। অন্তত দুই মানুষ সমান উঁচু, এবং ততোধিক ভারি স্ত্রীলোকের অবয়বদুটি আসছে এবং মিলিয়ে যাচ্ছে বাতাসে।
—ওরা কারা? প্রায় আর্তনাদ করে ওঠে অক্ষি।
জরা দুহাতে দুটি অশ্বের রাশ টেনে ছুটতে আরম্ভ করেছিল। শকটগুলি ঢালু ভূমি দিয়ে গড়াতে শুরু করেছে। কশ্যপও বেগে ধাবিত হলেন তাদের পিছনে।
যে অন্তরীক্ষ থেকে এই সমস্ত কিছু দেখে, সে জানে। অথবা হয়ত সেও জানে না। —নাসদীয় সূক্ত, ঋক্বেদ ||
এই ঘটনার পর চতুর্বিংশতি বসন্ত পার হয়েছে।
হারাবতীর কাছে যারা বেদ পড়তে এসেছিল তাদের মধ্যে একটি ছেলে এসেছে বহুদূর থেকে। তার নাম যাজ্ঞবল্ক্য। আগে সে ভীষণ রোগা ছিল, এখন অক্ষির যত্নে একটু মোটাসোটা হয়েছে। ছেলেটি স্মৃতিধর। হারার ইচ্ছে হয় এই ছেলেটির মধ্যে বেদ রেখে যায়।
এদিকে বয়সের সাথে সাথে অত্যন্ত দ্রুত হারাবতীর দৃষ্টি, শোত্র এবং বাক্শক্তি লোপ পাচ্ছে। মাথার চুলগুলি শাদা হয়ে গেছে। যদিও অক্ষিকে এখনও যুবতীদের মতোই দেখায়। চোখ বন্ধ করলে অবশ্য হারাবতী এখন দূরের দৃশ্য সবই দেখতে পায়। অর্থাৎ কশ্যপের রোগগুলি এক এক করে তার শরীরে এসে বাসা বাঁধছে।
সস্ত্রীক গৌতম কিছুদিন এসে থেকে গেলেন আশ্রম পরিদর্শন করবেন বলে। ছাত্ররা রোদ্দুরে বসে দ্রাক্ষারস পান করছিল। গৌতম হতবাক হয়ে গেলেন। পরে হারাকে ডেকে বললেন—ছি:, এই অকালকুষ্মাণ্ড কুঁড়েদের দিয়ে কোনো কাজ করাও না কেন? এদের বেদাভ্যাস হবে কী করে?
হারা লজ্জিত হয়ে বলল—অধিকাংশ অসুরের ছেলে। কিছু দো-আঁশলা আছে। এরা পড়তেই চায় না। উত্তম ছাত্র আর এই দেশে কোথায় পাবো বলুন। অক্ষির হাতের রান্না ভালো বলে কয়েকটা আসে। উৎকোচ দিয়ে ধরে রাখতে হয় বলত পারেন। আপনি কয়েকটাকে নিয়ে যান না আপনাদের কাছে। তাহলে আমারও ব্যয় একটু কমে।
—এই উল্লুক সঙ্গে নেব? সেটা সম্ভব নয়। তোমরা ধরে দুটো চাঁটি মারো না কেন?
—ক্ষেপেছেন? এদের বাবা, দাদারা পাহাড়ি ভালুকের সাথে কোনো অস্ত্র ছাড়া কেবল দাঁত আর নখ সম্বল করে মল্লযুদ্ধ করে। মায়েরা চিতাবাঘের ল্যাজ ধরে মুচড়ে ছেড়ে দেয়। এদের ঘাঁটানো যায় নাকি?
গৌতমের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল ব্রহ্মচারীদের বাবা-মা’র কাছ থেকে কিছু আদায় করে নিয়ে যাওয়া। এটা শুনে যারপরনাই বিমর্ষ হয়ে গেলেন। এর মধ্যে ছেলেগুলো যাতে শীতের প্রকোপে জ্বরে না পড়ে সেজন্য অক্ষি দৌড়ে এসে সবাইকে যত্ন করে গরম দুধ খাইয়ে পায়ে উর্ণের কোমল পাদুকা পরিয়ে দিয়ে গেল। এসব দেখার পর তাদের শয্যার ব্যবস্থা পরিদর্শন করার উৎসাহ কর্পূরের মতো উবে গেল গৌতমের। দুদিন পরেই নিজের আশ্রমের জন্য মন টিঁকছে না বলে বিদায় গ্রহণ করলেন।
হারা চোখ বন্ধ করে দূর থেকেই দেখতে পেল গৌতম অশ্বতরের উপর বসে যেতে যেতে মাথা নাড়িয়ে গৃহিণীকে বলছেন—না: এরা দেখছি অসুরের অধম হয়ে গেছে। এদেশে আর আসা যাবে না।
যাজ্ঞবল্ক্য ছেলেটি একটু ঘরকুনো। তার শীতবোধও বেশি। সে অধিকাংশ সময় অক্ষির সঙ্গে ছায়ার মতো লেগে থাকে ও ঘরের কাজকর্ম করে। কখন যে সে এতগুলি মন্ত্র মুখস্থ করে ফেলল কে জানে। জিজ্ঞেস করলে বলে—জন্ম থেকে পেয়েছি।
হারা একদিন দুচোখ বুজে দেখতে পেল যাজ্ঞবল্ক্য আহার করতে করতে অক্ষিকে জিগ্যেস করছে, আচ্ছা মরার পরেও কি আত্মার খিদে থাকে?
অক্ষি বলল—অবশ্যই থাকে। কিন্তু সূক্ষ্মশরীরে কিছু ভোগ করা সম্ভব হয় বলে মনে হয় না। যা খাবার এখনই খেয়ে রাখ। আরেকটু চাটনি নে।
চাটনি খেতে খেতে যাজ্ঞবল্ক্য বলল—আচ্ছা আমার শিক্ষা শেষ হবার আগেই যদি হারাবতী মরে যায়? তাহলে আমার কী হবে?
—কেন? তাহলে তুই আমার কাছে রান্না শিখে পাচক হয়ে যাস।
—যা:। এতদূর আসার পর রান্না শিখে বাড়ি যাব? লোকে কী বলবে?
—তুই আমায় বল না কী শিখতে চাস। আমি কশ্যপের মেয়ে না? সব জানি। বাঁচবও অনেকদিন।
—মৃত্যুর পর কী আছে তুমি জানো?
—হ্যাঁ জানি। একটা অন্য জগতে চলে যাবি তুই। সেখানে তোর শরীর হবে দুগুণ লম্বা আর আটগুণ ভারি।
—যা ইচ্ছে উদ্ভট একটা কিছু বলে দিলে, তাই তো? সেজন্যই কেউ তোমাকে কোনোদিন ঋষি বলে না।
—না রে। কশ্যপ সাগরের তীরে সেরকম লোক এই পৃথিবীতেও থাকতে পারে। কোনোদিন যদি যাস তো দেখতে পাবি।
—দেখেছ তুমি?
—সেখানে আমার যাওয়া বারণ।
দূর থেকে এই কথোপকথন শুনতে মধুর লাগছিল হারাবতীর। মরার আগে যে সে যাজ্ঞবল্ক্যকে সহজেই বেদ দিয়ে যেতে পারে, সে কথা অক্ষি বলছে না। অক্ষির মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে কশ্যপ সাগরের তীরে গিয়ে নিজের মা ও বাবার সন্ধান করে। কিন্তু কশ্যপ বারণ করে গিয়েছিলেন। ঋষির বাক্য অমান্য করা সম্ভব নয়। নরম রৌদ্রে এলিয়ে বসে হারাবতী গায়ে গরম শালটা ভালো করে পাক দিয়ে নিল।
যাজ্ঞবল্ক্য বলল—তোমায় একটা কথা বলি অক্ষি। বেদ আমার একটুও মনে ধরে না। কেমন শুকনো শুকনো লাগে। আমি রান্নাটাই বরং শিখি। সেটা বরং একটা কাজের কাজ।
—একশোবার। বলল অক্ষি। তুই মাঝে মাঝে এসে এটাও শিখতে থাকিস। কিন্তু এখন গিয়ে হারাবতীর কাছে বোস। দু একটা অধ্যায় শিখে নে। নইলে সে কষ্ট পাবে।
যাজ্ঞবল্ক্য হারাবতীর কাছে এসে দেখল সে ঘুমিয়ে পড়েছে। সে নিজেও একটা গাছের গায়ে হেলান দিয়ে বসল। এক পেট খাবার পর একটু ঘুমিয়ে নেওয়াই ব্রাহ্মণের ধর্ম। কিন্তু এমন সময় সে চমকে গিয়ে বুঝতে পারল তার কানের মধ্যে সে সুস্পষ্ট হারাবতীর কন্ঠস্বর শুনতে পাচ্ছে। যেন হারাবতী ঘুমের মধ্যেই তাকে বলছে—আয় এখানে বোস।
ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে যাজ্ঞবল্ক্য দেখল নিদ্রার মধ্যেই হারাবতীর ঠোঁটে একটা রহস্যময় হাসি। একটা আঙুল দিয়ে সে গাছের তলাটা দেখিয়ে দিচ্ছে যাজ্ঞবল্ক্যকে।
গল্পটি শুনতে শুনতে গায়ে শাল থাকা সত্ত্বেও অসম্ভব শীতে যাজ্ঞবল্ক্য কাঁপতে আরম্ভ করেছিল।
—আকাশের ওপার থেকে আসা এই নক্ষত্রযানকে আমি চিনেছি। হারাবতী বলেছিল পরে।—একটি নীল আলো বিচ্ছুরিত হচ্ছিল তার গা থেকে।
—আমার দিদি অক্ষি সেখান থেকে দ্রুত প্রস্থান করল। নিশ্চয়ই বাবা তাকে সেকথাই বলেছিলেন। আমার কানে কানে কিন্তু বাবা বললেন—হারা তুই বসে থাক। এই পুরুষটির কাছে গিয়ে তার মুখ দেখে আয়। বারোশো বছর আর কেউ দেখতে পাবে না এই হিরন্ময় পাত্রের আবরণে ঢাকা মুখ।
—বাবার কথামতো বসে রইলাম। নীল একটি আলো আমার দিকে আসছিল দূর থেকে। ক্রমশ তার কম্পনের বিপুল শক্তি আমাকে স্পর্শ করতে থাকল। আমি দুচোখ বন্ধ করে, দুহাতে কান চেপে ধরে মাটিতে শুয়ে পড়লাম। চেঁচিয়ে বলতেও চাইলাম—এই দাহ ধারণ করতে সত্যি আমি পারব না, আমাকে যেতে দাও। কিন্তু সেই তেজোময় রশ্মি ততক্ষণে আমাকে চারদিক থেকে গ্রাস করেছিল। চোখ-কান বন্ধ করেও ভূত, ভবিষ্যৎ ও বর্তমানের প্রত্যেকটি আলোর কণিকাকে আমি একই সঙ্গে প্রত্যক্ষ করলাম। এই আলোর কণিকাগুলিই রয়েছে প্রতিটি মুহূর্তের স্পন্দনে। এগুলিই আত্মা। প্রতিটি শব্দ, যা কখনো উচ্চারিত হয়েছে বা হবে, আমার কাছে একত্রে ও একান্তে এসে ধ্বনিত হয়ে বলল—শোনো, আমি বেদ।
—বেদাহমেতং পুরুষং মহন্তম্, আদিত্যবর্ণং তমস: পরস্তাৎ। এই নীল আলোকের বৃত্তটি আকাশের অপর দিক থেকে এসেছে একটি দেহের সন্ধানে। এই ধামগুলিতে সে বিচরণ করবে আরেকটি ঋষির অপেক্ষায়। এই দহন আমার সহ্য হবে না। আমাকে সে জীবিতই পুড়িয়ে দিয়ে যাচ্ছে। আমার অস্থিগুলি জরাগ্রস্ত হয়ে ভেঙে পড়বে অকালে। আমার দৃষ্টি, শ্রোত্র ও বাক্ও বিনষ্ট হবে অচিরেই।
—আমার মধ্যে দিয়ে এই নীল আলোর তরঙ্গগুলি প্রবাহিত হতে চায়। নদীর মতো। বেদের মতো। বাণীর মতো। আমার মৃত্যুর পরে একে ধারণ করবে আমার দিদি অক্ষি। তারপর তুই। তোর মধ্যে দিয়ে আমি, হারাবতী, প্রবাহিত হয়ে যাবো তোর উত্তরসূরীদের কাছে, যাদের প্রতি তৃতীয়পুরুষের নাম হবে তোর নামে।
—কশ্যপ সাগরের তীরে আমাদের মা ও বাবার কাছে যাওয়ার আর কোনো অর্থ রইল না কেন বুঝলি কি তুই এবার?
যাজ্ঞবল্ক্যের কৈবল্য হঠাৎ দূর হয়েছে। এরকম বিরাট শক্তি ও জ্ঞান গ্রহণ করার ক্ষমতা নেই ধরে নিয়ে সে শরীরের সমস্ত বল প্রয়োগ করে লাফিয়ে উঠল এবং হারার সংসর্গ থেকে পৃথক হতে টেনে লাগাল এক ছুট। হারার শেষ প্রশ্নটি তাই কোনো শ্রোতা ও দর্শক ছাড়াই জলরাশির মতো উঠে আকাশ ছুঁল এবং ফেনার মত ছড়িয়ে গেল তার স্বপ্নের মধ্যে।
কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর, আর কাউকে না পেয়ে সেদিন নিজেকেই এর উত্তর দিয়েছিল হারা।
—কেননা তাদের সবার জীবনের সবকটি মুহূর্ত সঙ্গে নিয়েই আমার মধ্যে প্রবেশ করেছিল—তমসার ওপার থেকে আসা একটি আদিত্যবর্ণ পুরুষ।