কবিতার পুরুষ;সম্পাদনা : অমিতাভ দাশগুপ্ত; প্রচ্ছদ: গৌতম রায়; প্রথম প্রকাশ: ডিসেম্বর ১৯৬৯; প্রকাশকঃ অধুনা, পকেটবুক সিরিজ-২; ISBN: নেই
“পত্রপাঠ অয়শ্চক্রে ঘণ্টা বাজে ঋতুবদলের :বাংলা কবিতার নাভির পাতালে গুম হয়ে যাওয়া যুবকেরা সারি বেঁধে উঠে আসে “কবিতার পুরুষ” বইয়ে। যুবতীর গ্রীবে শোভে গুঞ্জামালা। শব্দব্রহ্মের ছিলাটান শায়কবিদ্ধ সুঠাম মেরুদণ্ড এই কবিদের সামান্য লক্ষণ। তাঁরা কেউ কেউ আজো অমলিন কবিতায়, কেউ কেউ রোদ্দুর হয়ে আছেন! মোট বিরাশি জন কবির একশ’ পাঁচটি কবিতা নিয়ে সংকলন গ্রন্থ “কবিতার পুরুষ”। সংকলক স্বয়ং কবি অমিতাভ দাশগুপ্ত (১৯৩৫-২০০৭)। সংকলন বিষয়ক কথনে তিনি বলছেন, “আসলে নির্বাচনের প্রশ্ন সরাসরি এসে গেছে। আমাদের সশস্ত্র আধুনিকতা চাই। আহ্বানের যোগ্য অসংখ্য কিরাত চাপা ব্যগ্র ঠোঁটে দাঁড়িয়ে, অন্ধকার ইতিমধ্যে তরুণ বাইসনে ভরে গেছে—আর দাঁতাল সময়ের বিরুদ্ধে সটান হয়ে দাঁড়ানোও তো শ্রেণী-সংগ্রাম। বাঁচার একটা শর্ত হয়ে উঠুক কবিতা। ...”
‘সংবাদপত্রের স্তম্ভে বেশ কিছু জায়গা ছেড়ে দিও।’"
জন্মসাল অনুযায়ী (১৯১৯ থেকে ১৯৪৬ পর্যন্ত) কবিদের গ্রথিত করা হয়েছে এই সংকলনে। সেখানে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী কবিদের পদচারণে বাতাস হয়েছে বুলেট। আধুনিকতার পরতে পরতে মিশে থাকা যে অমঙ্গল চেতনা চুঁইয়ে এসেছিল পশ্চিমী জগৎ থেকে তার বিস্ফোরণ ঘটেছিল বাংলা কবিতাজগতে মূলত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কিছু আগে পরে সময় থেকে। এমনকি রবীন্দ্রনাথ এ সময় ইউরোপের পছন্দের কবিপুরুষের তালিকা থেকে অনেকটাই নঞর্থক দূরত্বে অবস্থান করছেন। খোদ রোমান্টিসিজম থেকে মুক্তির আকাঙ্ক্ষায় যে সাবজেক্টিভ অ্যালিয়েনেশন বিশ্বের কবিদলের মর্মগত সাধনার বস্তু হয়ে উঠেছিল, এই কবিতার পুরুষ সংকলনের কবিতায় তার ছাপ সুস্পষ্ট। এই বইয়ে প্রথা-মাফিক রবীন্দ্রনাথ, কিম্বা রবীন্দ্রপরবর্তী কবিগোষ্ঠীর কোনো ভূমিকাই নেই। সমস্তটাই স্বাধীনতা পরবর্তী এবং ছয় দশকের আগুনে-সময় ও রাজনীতির জটিল জঠরের সেঁক-তাপে জর্জরিত। আর যে-দুই নারীর যে-দুটি কবিতা স্থান লাভ করেছে তারা সটান শিরদাঁড়ায় স্বতন্ত্র! “এইতো এখু্নি রাতের শিফটে/ অন্ধকারের চাঙড় খসিয়ে/ দিনে ফিরলাম ভোরের লিফটে—/ মুঠোতে রাত্রি তখনো শাবল।” [‘জ্বলে যেতে হবেঃ পুড়ে যেতে হবে’; কবিতা সিংহ]
বেশিরভাগ কবিই লিট্ল ম্যাগাজিন আন্দোলনের সারথী; ফলতঃ অমেয় তাঁদের প্রমত্ত আবেগ। ভাষা-ছন্দের মুদ্রা বদলের দলিল হয়ে উঠেছে কবিতার পুরুষ। যদিও সবটাই কালোত্তীর্ণ একথা বলা ঠিক হবে না। আর রসোত্তীর্ণতার প্রসঙ্গে যাচ্ছি না, কারণ বেশিরভাগ কবিতাই রসপরিণতিকামী কাব্যপাঠক মনকে আঘাত করেছে তীব্র অভিঘাতে, সেখানে মনের মধ্যে অন্ধকার, জেলখানার গরাদের থমথমে অস্বাভাবিক সশঙ্ক অস্তিত্ব।
বইয়ের প্রচ্ছদে আছে মুষ্টিবদ্ধ হাত। ঠিক সেই বিপ্লবের স্বপ্নে আর বাস্তবে একাকার কবিতাবলীর অবগাহন কবিতার পুরুষ। ফিরে দেখা সময়ের ভাপ এসে নাকে লাগে কবি তালিকা দেখলে। ১৯১৯-এর অমোঘ সুভাষ মুখোপাধ্যায় থেকে ১৯৪৬-এর জাতক পার্থপ্রতিম কাঞ্জিলালের মাঝে দু’মলাটে ধরা পড়েছেন মণীন্দ্র রায় (জন্ম-১৯১৯), বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৯২০), চিত্ত ঘোষ (১৯২০), মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায় (১৯২১), অরুণকুমার সরকার (১৯২২), নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী (১৯২৪), জগন্নাথ চক্রবর্তী (১৯২৪), রাম বসু (১৯২৫), অরুণ ভট্টাচার্য (১৯২৫), কৃষ্ণ ধর (১৯২৬), রাজলক্ষ্মী দেবী (১৯২৭), লোকনাথ ভট্টাচার্য (১৯২৮), সিদ্ধেশ্বর সেন (১৯২৮), অরবিন্দ গুহ (১৯২৮), শান্তিকুমার ঘোষ (১৯২৮), সুনীলকুমার নন্দী (১৯৩০), শরৎকুমার মুখোপাধ্যায় (১৯৩০), গৌরাঙ্গ ভৌমিক (১৯৩২), শঙ্খ ঘোষ (১৯৩২), আলোক সরকার (১৯৩২), তরুণ সান্যাল (১৯৩২), শঙ্করানন্দ মুখোপাধ্যায় (১৯৩২), অমিতাভ চট্টোপাধ্যায় (১৯৩২), যুগান্তর চক্রবর্তী (১৯৩২), কবিতা সিংহ (১৯৩২), শক্তি চট্টোপাধ্যায় (১৯৩৩), অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত (১৯৩৩), শঙ্কর চট্টোপাধ্যায় (১৯৩৩), আনন্দ বাগচী (১৯৩৩), স্বদেশরঞ্জন দত্ত (১৯৩৩), শিবশম্ভু পাল (১৯৩৪), মোহিত চট্টোপাধ্যায় (১৯৩৪), শোভন সোম (১৯৩৪), সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় (১৯৩৪), সুরজিৎ দাশগুপ্ত (১৯৩৪), অমিতাভ দাশগুপ্ত (১৯৩৫), সমরেন্দ্র সেনগুপ্ত (১৯৩৫), বিনয় মজুমদার (১৯৩৫), মানস রায়চৌধুরী (১৯৩৫), সুধেন্দু মল্লিক (১৯৩৫), তুষার চট্টোপাধ্যায় (১৯৩৫), তারাপদ রায় (১৯৩৬), উৎপলকুমার বসু (১৯৩৬), গৌরীশঙ্কর দে (১৯৩৬), প্রণবেন্দু দাশগুপ্ত (১৯৩৬), দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায় (১৯৩৬), শান্তি লাহিড়ী (১৯৩৬), সত্য গুহ (১৯৩৬), বাসুদেব দেব (১৯৩৬), মণিভূষণ ভট্টাচার্য (১৯৩৬), সামসুল হক (১৯৩৬), মলয়শঙ্কর দাশগুপ্ত (১৯৩৭), আশিস সান্যাল (১৯৩৮), তুষার রায় (১৯৩৮), চিন্ময় গুহঠাকুরতা (১৯৩৮), রত্নেশ্বর হাজরা (১৯৩৮), বেলাল চৌধুরী (১৯৩৮), অরুণাভ দাশগুপ্ত (১৯৩৮), তুলসী মুখোপাধ্যায় (১৯৩৮), শুভাশিস গোস্বামী (১৯৩৮), শিবেন চট্টপাধ্যায় (১৯৩৯), শৈলেশ্বর ঘোষ (১৯৩৯), বঙ্কিম মাহাত (১৯৩৯), মৃণাল দত্ত (১৯৪০), পুষ্কর দাশগুপ্ত (১৯৪০), পবিত্র মুখোপাধ্যায় (১৯৪০), শঙ্কর দে (১৯৪১), গণেশ বসু (১৯৪১), প্রদীপ চৌধুরী (১৯৪১), অঞ্জন কর (১৯৪১), দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায় (১৯৪১), অরুণেশ ঘোষ (১৯৪২), শান্তনু দাস (১৯৪২), সুবো আচার্য (১৯৪২), অনন্ত দাশ (১৯৪৩), কালীকৃষ্ণ গুহ (১৯৪৪), শামসের আনোয়ার (১৯৪৪), বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত (১৯৪৪), ভাস্কর চক্রবর্তী (১৯৪৫) এবং অমিতাভ গুপ্ত (১৯৪৬)। বইটির অপ্রতুলতা এবং অনেকানেক কবিদের বর্তমান পাঠকের কাছে অপরিচিতিই এত লম্বা কবি-তালিকা দেওয়ার সমূহ কারণ।
বহু কবিতাই এক্সপেরিমেন্টাল ছন্দ ও রীতির অনুশীলন, কোনো কবিতায় ফবিজমের (Fauvism) জীবনানন্দীয় প্রভাব, কিন্তু আত্মীকরণে অপ্রয়াসী--“হেমন্ত গিয়েছে ফ’লে; রক্তমাংসের স্তম্ভে সোনা খড়ে পাখি বাসা করে/ প্রাচীর পোস্টারে জ্বলছে বিশাল হস্তাক্ষর রক্ত ও সবুজে, দেখে শুনে/ রুটি ও যৌনের তল্পি বহনের দায় মুক্ত হয়ে যেতে হয়/ তাৎক্ষণিকের জন্যে, আস্তাবলে লাল রং দুরন্ত ঘোড়ার জাগে/ উড়বার আওয়াজ ...” [‘জন্মের দ্যোতনা জাগছে আলোকলতায়’; সত্য গুহ]
অনেকেই রক্তে মজ্জায় মাংস মেদে সুকবিতা। “জটিল স্বপ্নের বাক্স বারবার খোলে, বন্ধ হয়;/ কিছুই বুঝিনা মানে, কোনোদিন পাঠাবে মর্মর/বটের প্রধান শাখা? আলোকিত হবে কি সময়?/ আতংকে, অদ্ভুত ঘুমে কোনোক্রমে পোহায় প্রহর।” [‘এই আছে, এই নেই’; গৌরীশঙ্কর দে] কিম্বা,
“এখন নদীর মুখে রক্তপাত/ রক্তহীনতায় ভুগছে/ দীর্ঘদিন সবুজ গাছেরা/ কবরের মাটি ছুঁয়ে ছুটে আসা কংকাল শিশুর/ আন্দোলিত কৃষ্ণ হাতে/ কোটি বছরের হিম তুহিন শীতল।” [‘বাঁশীতে ফুঁ দিলে’; শিবেন চট্টোপাধ্যায়]
বোদল্যেয়র কথিত ‘an oasis of horror in a desert of ennui’, (যাকে আবার আবু সয়ীদ আইয়ুব লোকোত্তর নেতিমার্গে চূড়ান্ত উত্তরণের কালো চশমার মতো বানিয়ে তোলা মনে করতেন,) তেমন ভাবের কবিতা এই সংকলনে সমধিক, “থোরাই কেয়ার করি আমি কেননা স্বর্গীয় মাংস আমি খেয়েছি/ আমার জ্ঞান-বুদ্ধি ধ্বংস করে মনুমেন্টের মত উঠে যায় কবিতা/ আমার বিকার হলে সত্যি কথা বলি—আমি এক দেবদূত দেখি/ রকেটের আঘাতে খুলে পড়ে তারা—ক্ষিধে পেলে টেনে নিয়ে যায়/ যেখানে আমার অন্ত্রের নালী ভরে ওঠে মানুষের ভালবাসা—” [‘আমি ক্ষুধার্ত’, শৈলেশ্বর ঘোষ] এবং ক্লেদ, “এই জীবনের মধ্যে নৃমুণ্ডের মত চাঁদ ও বসন্ত নিভে যায়/ পৃথিবীর পুণ্যফুল ঝরে যায় আমার সামান্য স্পর্শে/ এই দীর্ঘ অভিশাপ জীবনের—/ জ্বলন্ত জীবন এসে নিরীশ্বর ভাষা তোলে/ ‘বলো, মানুষের চূড়ান্ত বাস্তব কিরকম বলো’/ আমি সামান্য কাতর হেসে শব্দ ভুলে যাই/ দেখাই নারীর সিফিলিশ কিভাবে মিশে গেছে আমার ভালবাসায় ...” [‘টেরিলিন টেরিকট/তিন’; সুবো আচার্য]; আবার ওষুধের গন্ধ-মাখা আধুনিকতা ভালো না লাগা কবির কোন কবিতায় বেজে ওঠে গাঢ় অনুভূতির কোমল নিষাদ, “অন্য কোনো রক্তক্ষরণের চিন্তা/ তাকে কোমল পাখির মত পিষ্ট করি/ অন্ধকার মাঠে/ তাকে কুয়াশার জলে বিদ্ধ করি ... চিৎকার করে বলি—‘আমি এই পৃথিবীর/ কেউ নই, আমি এই বাড়িঘর চুরমার করে/ একদিন ফিরে চলে যাবো’।” [‘রক্তের ভিতরে বাড়িঘর’; কালীকৃষ্ণ গুহ]-–এই যে জীবনকে প্রত্যাখ্যান, ক্ষয়-নিঃস্ব জাগতিকতার প্রতি বমনোদ্রেক, পোষিত ঘৃণা এসব বাংলা কবিতার বাঁক বদলের ঘৃষ্ট-চিহ্ন। অস্থিরতা, অনিত্যের সপাট চাপড়ে ভাঙাগড়ার প্রক্রিয়াজাত উচ্চারণের আঁতুড় “কবিতার পুরুষ”। স্বস্থ সুশান্তির আত্মপ্রতিষ্ঠা সেখানে অপ্রাপ্য। জীর্ণতা, মালিন্য আর অন্ধকারের প্রকোপে জ্বরাচ্ছন্ন সময়ের কবিতার পাথুরে প্রত্নাভাসের মধ্যে সহসা পাতা উল্টোতে হেসে উঠল এক টুকরো দিন,
“বারে বারে ট্রেন এসে থামে
উতল জংশনে
কি জানি, কে নামে?
দ্বিপ্রহর নিদারুণ জুন
আপ না ডাউন?
আমার হৃদয়ে নেই সুখ
ক্যালেন্ডার মিথ্যুক মিথ্যুক!”[‘উতল জংশন’; জগন্নাথ চক্রবর্তী]