খুব কমন না হলেও, আমাদের জগতে কখনো কখনো, বেশ, বেশ কিছুদূর এগিয়ে যাবার পর প্রোজেক্ট বাতিল হয়ে যায়। হয়তো মূল প্রয়োজনটাই পালটে গেছে, কিংবা বাজেটে আটকাচ্ছে, কিংবা ক্লায়েন্ট কোম্পানিতে ভূকম্প হয়ে গেছে — নতুন ডাইরেকশন নতুন বস নতুন আইডিয়া, কিংবা এগ্রিমেন্টে হঠাৎ কোন ঝামেলা সুপ্ত প্রেমের মত আকস্মিক মাথাচাড়া দিয়েছে...মানে সে কারণ যাই হোক না কেন, মোদ্দা রেজাল্ট হল প্রোজেক্ট বাতিল।
প্রোজেক্ট বাতিল হলে কি শুধুই প্রোজেক্ট বাতিল হয়?
না মশাই, তার সাথে আরো কত কিছু যে হড়পা বানে ভেসে যাবার মত চিরতরে মুছে যায়! এদ্দিনের রাত জেগে বানানো প্রেজেন্টেশনগুলো; ব্রেনস্টর্মিং এর দোহাই দিয়ে হান্ডা হান্ডা কফি গলঃধকরণ করে ক্লায়েন্টের জন্য তৈরি করা ডকুমেন্টগুলো; দুই সিনিয়র ডেভেলপারের মধ্যে জন্মশোধ শত্রুতা হয়ে যাওয়ার স্মৃতিসমন্বিত আনোখা ডিজাইন; সমস্ত কূটকচালির দলিল, সমস্তকাঠি করার ইতিহাসের সাক্ষী গায়গতরে ইমেলের পি এস টি; ক্লায়েন্টের সঙ্গে অলিম্পিক্সের ক্ষিপ্রতায় মল্লযুদ্ধ করে সাইন অফ করানো রিকোয়ারমেন্ট ডকুমেন্ট, রাশি রাশি এক্সেলেন্ট এক্সেল — এ সমস্তই নিঃশেষে বাতিল হয়ে যায়। হঠাৎ করে এই অসীম ইম্পর্ট্যান্ট জিনিসগুলোর দাম এখনকার হাজার টাকার নোটের চেয়েও কম হয়ে যায় — এক্সচেঞ্জেও কেউ নেবে না!
প্রোজেক্ট যদি এই শুরুয়াতের স্টেজে বাতিল হয় তো মন্দের ভাল।কিন্তু যদি কাজ শুরু হয়ে গিয়ে থাকে? যদি ডেভেলপার টিম তাদের হৃদয়-উত্তাপ মিশিয়ে ডিজাইন থেকে কোডে উত্তরণ ঘটাতে শুরু করে থাকে? ধরুন ইউনিট টেস্ট কেস লিখতে গিয়ে কোন স্বভাবসতর্ক বালক আরো দুটো কেস খুঁজে পেয়েছে যা ডিজাইনে মিসিং? জটিল লুপ লিখতে লিখতে ঘাগু সিনিয়র ধরে ফেলেছে বড়সড় কোন হিসেবের গলতা? জীবনে প্রথমবার থ্রেড প্রোগ্রামিং করতে বসা বাচ্চা ট্রেনি এক চান্সে নির্ভুল লিখতে পারার আনন্দে এত খুশি যে তার হুঁশও নেই লাস্ট বাস মিস করে গেছে, বাকি রাতটা ডেস্কে মাথা রেখে কাটাতে হবে? কিংবা ধরুনদুই বন্ধু দুটো কম্পোনেন্ট লিখে জোড়া দিতে গিয়ে আবিষ্কার করেছে পার্ট দুটো আলাদা দিব্যি চললেও একসাথে মোট্টে মিলছে না — একজন মারাদোনার ক্যারিশমায় ফুটবল পাস করেছে তো অন্যজন সানিয়া মির্জার মত টেনিস র্যা কেট বাগিয়ে বসে আছে? তাই নিয়ে দুজনের মান-অভিমান মন-কষাকষি প্রায়-ঘুঁষোঘুঁষি থামাতে এসে টীম লীডের দুজনের থেকে যৌথ অভিযোগের বন্যায় ভেসে গিয়ে পলায়ন, তারপর তাকে প্রাণ খুলে অভিশাপ দিতে দিতে দুজনের গলা জড়াজড়ি করে কোডে পুনর্গমন ও নিখুঁতভাবে খাপে খাপ ইন্টিগ্রেট করে ফেলন।
এই রকম কত দিন কত কাণ্ড পেরিয়ে একটু একটু করে যে পুরো প্রোগ্রাম তৈরি হয়! তার এক একটা টুকরো এক একটা ছোট টিম, বা একেক জনের হাতে গড়ে উঠে, টুকটুক করে পরস্পরের সাথে জুড়ে গিয়ে আস্তে আস্তে আসল অবয়বটা খোলতাই হতে থাকে, যেন দুর্গাদালানে একটু একটু করে একমেটে দোমেটে পেরিয়ে ঠাকুর জীবন্ত হয়ে উঠছেন। সবটুকু জোড়া লাগানোর পর, শেষমেশ পাকা ডেভেলপারের রিভিউ ছাড়পত্র পেলেই, চক্ষুদান সারা।
এর পরের ধাপে ওৎ পেতে বসে থাকে টেস্টিং আর কোয়ালিটি কন্ট্রোল টিম, ছুরি কাঁচি শানিয়ে লালায়িত মুখে, পাতে পেলেই ঝাঁপিয়ে পড়বে। তা হয়তো ধরুন ঘটা করে ঢাকঢোল পিটিয়ে উদবোধন করে, তারাও তাদের কাজ শুরু করে দিয়েছিল। হাঁড়িমুখ টেস্টার কাঁড়ি কাঁড়ি টেস্ট কেস নিয়ে নাকে চশমা এঁটে চেয়ারে সেঁটে বসেছে, তার পিছন দিয়ে নিরন্তর ঘুরঘুর করছে শিশু ডেভেলপাররা। একটা করে কেস পাশ হচ্ছে, টিক পড়ছে, সবুজ রঙের ধাব্বা লাগছে, আর তাদের চোরাচাউনির নিচে ভীরু হাসিগুলো আরেকটু স্পষ্ট হচ্ছে। প্রাজ্ঞ বিজ্ঞ অভিজ্ঞ জনেরা অবশ্য এই বালখিল্যদের ক্রমক্ষীয়মান হৃৎকম্প ও ক্রমহাসমান সাহস দেখার জন্য দাঁড়িয়ে নেই, তারা জানে শুরুর সোজাসাপ্টা কেসগুলো পাশ হবেই,সুতরাং যে যার মত হাওয়া হয়ে গেছে ধোঁয়া নিতে কি ক্যান্টিনে আলু টিক্কি খেতে কি ফোনে বয়ফ্রেন্ডকে দাবড়াতে।
এইভাবে টেস্টিং আগে এগোয়। এক্সেলে মরুবিজয়ের কেতন উড়িয়ে সবুজের আগ্রাসন দেখে স্বস্তিতে ডেভেলপমেন্ট টীমের ম্যানেজার হাফ ডে লীভ নিয়েই ফ্যালে, টেস্টিং টীমের ম্যানেজারের মুখ আমাশা রুগীর মত পার্মানেন্ট বিরক্তি আভা ধারণ করে। তার থেকে লেকচার শুনে শুনে টেস্টাররা দাঁত কিড়মিড় করে করে চোয়াল ব্যথা করে ফেলে। ওদিকে ডেভেলপমেন্ট টীমের বাচ্চাকাচ্চারা ম্যাকডোনাল্ডসে খেতে যাবার প্ল্যান আঁটে, সিনিয়ররা শেয়ার মার্কেটের ধ্যানে মগ্ন হয়।
তারপর তাঁর আবির্ভাব ঘটে।
প্রথম বাগ। ডিফেক্ট লগের প্রথম এন্ট্রি।কাচ্চাবাচ্চারা ম্যাকডোনাল্ডসের প্ল্যান ধামাচাপা দিয়ে ঊর্ধঃশ্বাসে সীটে ফিরে আসে, অভিজ্ঞরা ধীরেসুস্থে শেষ সুখটানটা দিয়ে। ‘কেবা আগে প্রাণ করিবেক দান’ স্টাইলে লোকে ঝাঁপিয়ে পড়ে সেটা সলভ করতে। এদিকে টেস্টারের মুখে ফেসিয়াল করে আসার মত গ্লো ফুটে ওঠে, তার ম্যানেজার আহ্লাদে গুনগুন করে বেসুরো গান গায়।
প্রোজেক্ট যদি তার পরও এগিয়ে থাকে? ধরুন বাগে বাগে ছয়লাপ হয়ে গেছে ডিফেক্ট লগ, ডেলিভারি ডেট একবার পিছোতে হয়েছে, সিনিয়র প্রোজেক্ট ম্যানেজারের সামনে তাই নিয়ে ডেভেলপমেন্ট টীম ম্যানেজার আর টেস্টিং টীম ম্যানেজারের মধ্যে তুমুল ‘বাগ’বিতন্ডা হয়ে গেছে কয়েক দফা, এই নাগাড়ে বাগাড়ম্বরে তিতিবিরক্ত হয়ে সিনিয়র ডেভেলপাররা ‘সবই মহামায়া কি মায়া’ মোডে দনাদ্দন বাগ-বধ করছে, আর ছানাপোনারা নাকানিচোবানি খেতে খেতে টেস্টারদের মুন্ডুপাতের বাসনায় বন্দুক নিয়ে বাগী হয়ে বেরিয়ে যাবে কিনা ভাবছে। ওদিকে টেস্টিং টীমে প্রতিবার এটিএমের লাইনে দাঁড়িয়ে প্রতিবারই টাকা পাবার মত উল্লাস, নেহাত অফিস বলে বগল বাজিয়ে ঘুরে বেড়াতে পারছে না। এই মহা হ্যাপেনিং কালে, ধরুন এক নির্মেঘ বিকেলে হঠাৎ খবর এল, স্টপ প্রোজেক্ট, ক্লায়েন্ট ব্যাঙ্কটি টেক-ওভার হয়ে যাচ্ছে, অল প্রোজেক্ট হল্টেড উইদ ইম্মিডিয়েট এফেক্ট।
আপনার কোন ধারণা আছে, কি বিষণ্ণ হয় সেই সন্ধ্যা?
দুই টিম ম্যানেজার সব ঝগড়া ভুলে গলাগলি করে কোথায় চলে যায় কে জানে। ক্যান্টিনে গোল পাকিয়ে বসা ট্রেনিদের দল আজ চুপচাপ, বলার মত কিছু খুঁজে পাচ্ছে না। জীবনের প্রথম লাইভ প্রোজেক্ট ছিল তাদের। আরেকটু পোক্তরা অমন ছলছল চোখে ঘুরছে না, কিন্তু তাদেরও মুখ শুকনো, প্যালারাম বিশ্বাসের মত সঘন ফোঁস ফোঁস শ্বাস। আজ আর ইভিনিং স্ন্যাক্স খেয়ে আরো দু তিন ঘন্টা বসার জন্য নতুন করে এনার্জি সঞ্চয় করার দরকার নেই, সবাই টুকটাক বাড়ি চলে যাচ্ছে। নিচে নেমে টেস্টারের থেকে কাউন্টার নিয়ে রিং ছাড়তে ছাড়তে সিনিয়র ডেভেলপার হয়তো বলে ফেলে, ইয়ার ঐ পার্টটা না বড্ড ভাল ডিজাইন হয়েছিল, খুব মাথা খাটিয়ে...তাকে শেষ করতে না দিয়ে সায় দিয়ে ওঠে অন্যজন, আরে ইয়ার পতা হ্যায় না, এত চেষ্টা করেও ওটায় কোন ডিফেক্ট পেলুম না, একদম পার্ফেক্ট ছিল!
দুজনেই ভুলে যায় কালও এরকম সময় তারা স্ব স্ব ইয়ারমহলে পরস্পরের মুন্ডপাত করছিল।
এই এতগুলো মানুষের, এত এত ঘন্টার পরিশ্রম, ভাবনা চিন্তা, যত্ন, চেষ্টা, প্ল্যান, সব এক কথায় নেই হয়ে যায়।
এইরকমই, জীবনেও কত প্রোজেক্ট হঠাৎ করে বাতিল হয়ে যায়। কত স্বপ্ন বারবার ঘষে মেজে তাকে তুলে রাখতে রাখতে একদিন হাতের চাপে গুঁড়ো গুঁড়ো ঝরে পড়ে তার ক্ষয়ে যাওয়া ক্ষীণ শরীর; স্ট্রীপে দুটো দাগ দেখে উন্মত্ত নেশার মত যে আনন্দ ছড়িয়ে গেছিল শিরায় শিরায়, তৃতীয় সোনোগ্রাফির পর অপারেশন টেবিলে সেটা নিংড়ে বেরিয়ে যায় রক্তের স্রোতের সাথে; বহু টানাপোড়েনে ধরে রাখতে চেষ্টা করা সম্পর্ক হুশ করে পুরোনো গামছার মত ভাঁজে ভাঁজে শত টুকরো হয়ে খসে যায় ঝরা পাতা বাতাসে।
বাতিল প্রোজেক্টের মতই, সাথে করে কত কিছু যে নিয়ে যায়!
একটা করে প্রোজেক্ট বাতিল হয়, বুকের মাঝে একটা করে সার্ভার ডাউন হয়ে যায়। হাজারবার রিবুট করেও তাকে আর চালু করা যায় না। এইভাবে হৃদয়, ক্রমে, ভাঙ্গা সার্ভারের দমবন্ধ গুদামঘর...তবু আমরা মনে করি বাঁচি!