—আজ কি রং ধরবি তুই?
—দাঁড়া ... কাল ছিল আকাশী, পরশু হলুদ। তার মানে আজ আবার হলুদ রিপিট। তুই?
—আজ বুধবার তো। তাহলে কচি কলাপাতা সবুজ।
গলিপথে হেঁটে আসতে এ আমাদের রোজকার বাজি ধরার খেলা। আমার আর সীতাংশুর। জিতলে অটোর ভাড়াটা লাভ। যে হারবে তাকে দুটো ভাড়াই মেটাতে হবে। গলি যেখানে শেষ, বড় রাস্তায় পড়ার মুখে সাদা পাঁচতলা বিরাট ফ্ল্যাটবাড়ি —রাজহংসী। ময়দার কল ছিল। বন্ধ হয়ে গেল। ক'বছর পোড়ো হয়ে রইলো। মাতাল জুয়াড়ীদের ঠেক। তারপর সব ভেঙে গুঁড়িয়ে বাড়ি উঠল। আমাদের এদিকে এটাই প্রথম। দোতলার পুবদিকের বারান্দার তারে টাঙান সালোয়ার কামিজের রং নিয়ে আমাদের রোজকার বাজি ধরার খেলা। জিতলে অটোর ভাড়াটা বাঁচে। হারলে ডবল গচ্চা। হিসেবে লাভ-ক্ষতির পাল্লা প্রায় সমান। আজ দুজনেই হেরো। আজ বাসন্তী শাড়ি। —ওহোঃ কাল তো সরস্বতী পুজো গেছে।
তখন একুশ বাইশ। কলেজের শেষ ধাপ। বয়েজ স্কুলের জন্ম মুখচোরা। মেয়ে দেখলেই কপালে ঘামের বিন্দু। কলেজের তিন বছরেও বদল তেমন কিছু না। রাজহংসীর দোতলার পুবের ফ্ল্যাটের বারান্দায় শুকোতে দেওয়া কামিজের রংটুকু শুধু আমাদের টগবগে উত্তেজনার রসদ। একমাত্র। নতুন এই খেলাটায় নেশার মতো আচ্ছন্ন।
এক একটা তলায় চারটে করে ফ্ল্যাট। পাঁচতলা। কুড়িটা পরিবার। বাচ্চা দশ বারোটা। কোণের ছোট পার্কে দিনভর হৈচৈ, ছুটোছুটি, দোলনা, স্লিপ। পাঁচ-ছ' জন দু'বিনুনী, স্কার্ট ব্লাউস টিউনিকের স্কুলের মেয়ে। তার ওপরে সব মিলিয়ে হয়তো ছয় সাত জন। মুখগুলো আবছা ওদের —ঝলকে দেখা শুধু। পুবের বারান্দায় সালোয়ার কামিজ কার? ধাঁধার মতো। সমাধানহীন একমাত্র লুকোচুরি খেলা আমাদের।
চেটেপুটে মজাটুকু আমরা দুজন। সীতাংশু আর আমি। মাঝে মাঝে যেন খুব সিরিয়াস আমরা। প্রায় খাতা পেন্সিল নিয়ে ইন্টিগ্রালের প্রব্লেম যেন। স্কুলের শেষ ক্লাশ বা কলেজের শুরু এরকম তো ছয় বা সাত। শাড়ি একজন কি দুজন। আমাদের কলকাতা একশো তিপ্পান্ন জিনস শার্টে সাহসী নয় তখনও—আমাদের একুশ বাইশ। সীতাংশু বলে ওই লম্বা বেণীই, আমি শিওর। আমার মনে কাঁধ পেরোন, ক্লিপে আটকানো ঝাঁকড়া চুল। আমরা যখন দেখতে পাই ওদের তখন কলেজ ফেরত সন্ধে। আবছা। রতনদার স্টেশনারিতে বা সাজাবো যতনের সামনে চুলের ক্লিপ কি ইমিটেশন। হাসাহাসি, দরাদরি। পাশ কাটিয়ে যেতে গিয়ে আমাদের চোরা দৃষ্টি। রতনদার দোকানে হারিকেনের আলোয় ওদের লম্বা ছায়া দেওয়ালে। কসমেটিক্সের দোকানের লালচে কম পাওয়ারের আলোয় সব অস্পষ্ট। সত্যি মিথ্যের লাইনটা ভেঙেচুরে একাকার। ক্লু ছড়িয়ে থাকত। আমরা ইচ্ছে করে দেখেও যেন না দেখে পাশ কাটাতাম। আমাদের দর্জির দোকানে মাপ দিয়ে করানো শার্ট ট্রাউজার, পাড়ার সেলুনে কাটা প্যাতানো চুল, সাদামাটা রেজাল্ট, কম্পিটিটিভের কোচিংএর জীবনে ঐটুকু রহস্যের রোমান্স জিইয়ে রাখতেই চাইতাম আসলে।
হারিয়ে গেল সব কবে যেন। বাবার রিটায়ারমেন্ট, দিদির বিয়ে, চাকরির পরীক্ষা। দুবারের চেষ্টায় একদম নীচু তলার সরকারি চাকরি। মফস্বল টাউন। সীতাংশুর ব্যাঙ্ক—অন্য স্টেট। আমার তালেগোলে হাল্কা কেজো প্রেমের মতো কিছু একটা। স্বাতী অন্য সেকশন, একই অফিস। আমার মাঝারি মাপের জীবনে ঠিকঠাক। ওদের বাড়ির লোকই ঠিকানা নিয়ে কলকাতায় বাড়িতে কথাবার্তা ইত্যাদি। যেমন হয়।
সীতাংশুর একটু গণ্ডগোল ছিল শুরুতে। বিয়ের পর হানিমুনে লখনৌ। তার আগেই গাজিয়াবাদে ব্যাচেলর্স ওয়ান রুমড থেকে ফ্যামিলি কোয়ার্টার। একটু গুছিয়ে নিয়ে—যাওয়াটা ট্রেনে এ. সি. থ্রী টায়ার। ফেরার টিকিট ফ্লাইটের। —জাস্ট একটু ঘ্যাম নেওয়া, বুঝলি। একেবারে যে পাতি লোকের সঙ্গেই বাকিটা তা বোঝার আগে এটুকু। বিরিয়ানি, ফুল, আতর সব গন্ধ মিশে ঘন হয়ে আটকে ছিল রিসেপশনের হলে। সিল্কের পাঞ্জাবীতে ঘামে আর খুশিতে চকচক করছিল সীতাংশু। হাসছিল খুব।
আমি আর স্বাতী এই সুযোগে আগ্রা। হানিমুন বললে তাই। বিয়ের বছর ঘুরেছে তত দিনে। সীতাংশুর বিয়েটাকে ধরে প্রথম বেরোন। সীতাংশু চাইছিল একসঙ্গে লখনৌ। স্বাতী রাজি হল না। ফিরে কদিন যোগাযোগ ছিল না তেমন। ফোনে সামান্য হুঁ হাঁ। মাস খানেক পর হঠাৎ একদিন। ধ্বস্ত, বিভ্রান্ত। বাজপড়া গাছের মতো সীতাংশু। শুনলাম সব তখনই।
'ফিরতি পথে লখনৌ থেকে দিল্লী এয়ারপোর্টে নেমে শিখা এই একটু বলে টয়লেটে ঢুকলো হ্যান্ড লাগেজটা নিয়ে।—বড় দুটো স্যুটকেস নিয়ে আমি সামনে দাঁড়িয়ে আছি তো আছি ই। অরেঞ্জ সাদা ফুলছাপ সালোয়ার দেখলেই দৌড়ে গেছি। পাগলের মতো লাগছিল। পুলিশই বোঝাল। এরকম কেস নতুন নয়।'
জল গড়িয়ে পড়ছিল সীতাংশুর গাল বেয়ে, গলা বেয়ে শার্টের কলারের প্রান্ত অব্দি। তিন বছরের মাথায় চৈতালীকে বিয়ে করল কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়ে।
এর মধ্যে কলকাতায় দু তিন বার। পুরোন পাড়ায় একসঙ্গে। হাসতে হাসতে —আমি হাল্কা গোলাপী, তুই? —আজ বুধবার তো, তাহলে শ্যাওলা সবুজ। লাল টকটকে কামিজ ঠাট্টা করেছে আমাদের দুই বন্ধুকে।
মা চলে গেল একদম হঠাৎ। দিদি ফোন করলো রাতে নার্সিং হোমে ভর্তি করে। আমি সমস্ত রাত ছটফট করে ফার্স্ট ট্রেন ধরে ভোরবেলা। স্বাতী একটু বেলায় মুনিয়াকে নিয়ে। সীতাংশুর পৌঁছতে বিকেল হল। ওকে সোজা শ্মশানেই আসতে বলে দিলাম। দু দিনের বেশি থাকতে পারবে না। চৈতালীর অ্যাডভান্সড স্টেজ। যে কোন সময়ে পেন উঠতে পারে। রাতের ফ্লাইট, সন্ধে নাগাদ রওনা দিলেই হবে। দুপুরে খাওয়ার পর গলি পেরিয়ে বড় রাস্তার মোড়ে আমরা দুজন। বরাবরের মতো।
— আজ বুধবার তো, আমি তাহলে গাঢ় বেগুনী। সীতাংশু বলেছিল।
—অরেঞ্জ সাদা ফুলছাপ। আমি কি কিছু না ভেবেই? হঠাৎ?
পকেট থেকে দোমড়ানো নোটটা বের করে আমার মুঠোয় গুঁজে সীতাংশু আর একবারও ফিরে তাকায়নি।
সেই শেষ দেখা আমাদের।