সকালে বারান্দার গাছগুলিতে জল দিতে দিতেই একদিন ব্যাপারটা প্রথম লক্ষ্য করেছিল সুনন্দা।
রোজ সকালের এই সময়টায় তার মনে হয়, সে আর রবি যেন একটি গাছ-গাছালি ভরা দ্বীপে এসে পৌঁছেছে, আশেপাশে কেউ কোথাও নেই। সেই দশবছর আগে যেমন তারা ইম্ফল থেকে জীপ নিয়ে হাজির হয়েছিল লোগটাক হ্রদে, সারাদিন নৌকো করে ভাসমান দ্বীপগুলিকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে ঘুরে এসেছিল। স্থানীয় লোকেরা সেগুলিকে ফুমদি বলে, প্রকৃতির অদ্ভুত খেয়ালে সেখানে শুধু জলজ গাছপালাই না, আছে জৈব অবশেষে সমৃদ্ধ কালো মাটি, ছোটখাটো প্রাণী...মানুষের বসবাস। নাতিশীতোষ্ণ মুম্বাই শহরতলীর দশতলায় পত্রপল্লবে সুনিবিড় এই ব্যালকনি কেন জানি তাকে সেই দ্বীপমাতৃক জীবনের কথা মনে পডিয়ে দেয়।
হাল্কা শীতের কটা দিন বাদ দিলে মুম্বাই-এর এই শহরতলীতে প্রায় সারা বছরই কোকিল ডেকে যায়। রাস্তার ওপারের কদম গাছগুলি থেকে আচমকা ট্যাঁ ট্যাঁ করে ডাকতে ডাকতে উড়াল দেয় টিয়ার ঝাঁক, মনে হয় যেন কতকগুলো গাছের পাতাই বুঝি পাখি হয়ে উড়ে গেল। সামনের বাদাম গাছটার কোটরে কাঠবিড়ালির বাসা, দেয়াল বেয়ে তারা ওঠানামা করে আর থেকে থেকে তীক্ষ্ণ ধাতব আওয়াজে জাতভাইদের সতর্ক করে দেয়। আহারের সন্ধান আর ঘাতক শিকারীর আক্রমণের থেকে বেঁচে ফেরার অভ্যাসে তাদের দিনচর্যার সময়ের খোপগুলি ভরে থাকে। গাছেদের জীবনযাপনেও একটা রুটিন আছে। অভ্যাস আছে। বেঁচে থাকার, ফুল আর নতুন পাতার যোগান দিয়ে যাওয়ার একটা তাগিদ আছে। বনসাইয়ের বটের শাখা ছেঁটে দিলেও নতুন রাস্তায় ফের জীবনের অঙ্কুর তুলে ধরে। শোক নেই, নেই শূন্যতার বোধও। দিনের একটা নির্দিষ্ট সময়ে তারা তেষ্টার জলের জন্য উন্মুখ হয়ে থাকে। গাঢ় বেগুনি আফ্রিকান ভায়োলেটের ঠিক নিচেই শুভ্র পাপড়ির পীস লিলি, আর হলদে-সবুজে মেশানো ড্রাকানিয়া সাতসকালে সুনন্দার হাতের জলের ঝারির, স্প্রে-বটলের থেকে তেষ্টার জল, তেরচা হয়ে আসা মিঠেকড়া রোদ্দুরের নিয়মিত যোগানে আশ্বস্ত বোধ করে। এই কাজটা অবশ্য কয়েকবছর আগে রবিই নিজে করতো।
প্রতিদিন সকাল সাড়ে সাতটায় অফিসে বেরোবার আগে চা খেয়ে স্নান সেরে, শাড়িটি নিখুঁতভাবে পরে সে বারান্দায় আসে। পিছন ফিরে হয়তো একবার রবির ছবিটির দিকে তাকায়। ছবিটা লিভিংরুমে ঠিক এমন জায়গায় ঝোলানো, যে বারান্দায় রাখা তার গাছগুলিকে যেন সে দেখতে পাবে। রবির শান্ত পরিতৃপ্তিমাখা সেই নিঃশব্দ হাসিটিই সুনন্দার অভ্যাসের দ্বীপ। অনেক ঝড়-ঝঞ্ঝা পেরিয়ে সেখানে এসে পৌঁছেছে সুনন্দা।
অথচ রবির অসুখ ধরা পড়া থেকে চলে যাওয়া পর্য্যন্ত তিনচারটে বছর যেন একটি দীর্ঘমেয়াদী দুঃস্বপ্নের মত কেটেছে। বিপ্লব তখন সবে সেকেন্ড ইয়ার। তার পড়ার খরচ, চিকিৎসার খরচ, নতুন বাড়ির ঋণের কিস্তির এর ভাবনা নিয়ে ব্যতিব্যস্ত কিভাবে যে কেটেছে দিনগুলো। সেও ছিল আরেক রকম অভ্যাস। বিপ্লব শহর ছাড়তে হবে বলে ক্যামপাস থেকে পাওয়া চাকরিটাতেও জয়েন করে নি। সুনন্দা যে আপত্তি করে নি, তা নয়, কিন্তু ছেলে যখন তাও না যাবার সিদ্ধান্তে অনড় থেকে গেল, তখন যেন একটু স্বস্তিও অনুভব করেছিল সে।
আসলে কি একটা বিপন্নতায় সে বিহ্বল হয়ে পড়েছিল, যেন তিনজনে একে অপরকে ছুঁয়ে থাকলেই তাদের এই সুখের বুদ্বুদটি অটুট থেকে যাবে, এমন একটা ভিত্তিহীন ভরসা তাদের যেন চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। পুরো দেড়বছর চাকরি না করে বসে ছিল বিপ্লব। তারমধ্যেই রবি চলে গেল। অথচ বিপ্লবকে সেই যেতেই হল, এবার আর পুনে নয়, বরং আরো দূর, ব্যাঙ্গালোর। তাও কত সুপারিশ, কত ধরাধরি...সদ্য গ্রাজুয়েটদের সব সময়েই বাজার ভাল, বসে থাকা গ্রাজুয়েটদের চেয়ে। শেষ অবধি সুনন্দা তার নিজস্ব অভ্যাসের দ্বীপে।
যে রবি কোনোদিন একটা আঙটিও হাতে রাখতে পারতো না, তার ছবিতে চন্দনকাঠের চোকলার মালা দেখে সুনন্দার কেমন একটা অস্বস্তি হয়, কিন্তু এবার বিপ্লব মাইসোর থেকে এই মালাটা নিয়ে এসে বাপকে পরিয়ে গেছে, সুনন্দা খুলে ফেলতে পারে নি। সত্যি বলতে কি ছবিতে মালা ছাড়া ফ্ল্যাটের কোথাও রবির চলে যাওয়ার কোনো চিহ্নই নেই। জুতোর শেল্ফে তার জুতো, বিছানায় রবির দিকের বালিশ, বাথরুমে তোয়ালেটি পর্যন্ত সুনন্দা সরায় নি। আলমারিতে রবির কাপড়জামা, রবির তোলা ছবির এ্যালবাম, ক্যামেরা, দেয়ালে টাঙানো বাদ্যযন্ত্রগুলি...সব যার যার নিজের জায়গায় আছে। সবকিছু ঝকঝকে তকতকে, যেন কালই রবি এসে বলবে, তোয়ালেটা দাও তো, চানটা সেরে নিই।
ছেলে চাকরিতে জয়েন করার পর এবারই প্রথম একটানা আট-দশদিন ছুটিতে এসেছিল। কিছুটা সময়, কটা দিন, বেশ লঘুভার, প্রজাপতির মত উড়ে গেছিল। ছেলেও বাপের মতই গান পাগল, সমানে তার বন্ধুরা আসছে, ধ্রুভ্ ড্রামার, সন্দেশ একটা ব্যান্ডে লীড গিটারিস্ট, ছেলে ফ্ল্যাটের দেওয়ালে টাঙিয়ে রাখা রবির তারযন্ত্রগুলি ঘাঁটছে, কখনো সারিন্দায় ঝংকার তুলছে...সুনন্দা অনেকদিন বাদে রান্না করছে সাতআটজনের খাবার...ভাল লাগে নি তা নয়, কিন্তু বারান্দায় প্রতিদিনের সেই নিভৃতিটুকু মিস করছিল খুব।
ছেলের চোখেও তার এই অস্থিরতাটুকু এড়ায় নি, এর মধ্যেই বিপ্লব একসাথে ফিল্ম দেখতে গিয়েছে জোর করে, বাজার করতে বা মলে কেনাকাটা করতেও যেতে চেয়েছ। তাছাড়া, প্রতিবেশী মহিলাদের সাথে একটু বিকেল বা সন্ধেয় হেঁটে আসতেও পরামর্শ দিয়েছে। কিন্তু সুনন্দা চোখ কপালে তুলে বলেছে, বাবান, আমি দিনে আটঘন্টা অফিসে কাটাই, আমার কি বাড়ি ফিরে নিঃশ্বাস ফেলবার সময় থাকে! মোদ্দা কথা, তাকে তার রোজকার স্বেচ্ছা-প্রত্যাহার থেকে নড়ানো যায় নি একচুলও।
চার-পাঁচটা ষোলোতলা টাওয়ারের মাঝখানে ডিম্বাকার জমিতে ক্লাবহাউস, জিম, বাচ্চাদের খেলার, স্বাস্থ্যান্বেষীদের হাঁটার জায়গা নিয়ে, এই হাউসিং কমপ্লেক্সটা বেশ বড়। গেটে সিকিওরিটি আছে, আছে দর্শনার্থী এলে ভিডিওফোনে যাচাই করে নেবার ব্যবস্থাও। এর বাইরে মানবিক আদানপ্রদান খুব সীমিত। অন্যের ব্যপারে অহেতুক নাক-গলানো তো নয়-ই, বরং খানিক শীতল। তাকিয়ে থাকার প্রশ্ন নেই, চোখাচোখি হলে কিছু হাই, হেলো, প্রতিবেশীর ছোট বাচ্চাকে দেখে, সো সুইট জাতীয় ছুঁড়ে দেওয়া আলগা মন্তব্যেই সামাজিকতার সমাপ্তি। ভারতবর্ষের নানা প্রদেশ থেকে জড়ো হওয়া অতি-স্বচ্ছল মানুষজনের আদবকায়দায় বিশেষ বৈচিত্র্য নেই। বাড়িগুলির নামও খুব গালভরা, নানান বিদেশি ফুলের নামে--ল্যাবার্নাম, পিটুনিয়া, ড্যাফোডিল ইত্যাদি।
বিপ্লব ফিরে যাওয়ার চার-পাঁচদিন পরে একদিন সকালে সুনন্দা প্রথম লক্ষ্য করল ঠিক উল্টো দিকের টাওয়ারটি, অর্থাৎ হিবিসকাসের দশতলার বারান্দায় এক নীল পাঞ্জাবি-পরা চেহারা। তিনিও বোধকরি গাছেই জল দিচ্ছেন। তা দিতেই পারেন, কিন্তু তারপর সুনন্দা সবিস্ময়ে লক্ষ্য করলো যে তাঁর প্রতিদিনের রুটিনে এই সময়টিই বরাদ্দ হয়েছে জল-সিঞ্চনের জন্য।
অর্থাৎ সেই সকালের স্নিগ্ধ, সোঁদা গন্ধের কুঞ্জে কাটানো সুন্দর সময়টির একটি ভাগীদার জুটে গেছে কোনো ভাবে। পিছন ফিরলেও কোথায় একটা অস্বস্তি, যেন একজোড়া এক্স-রে চোখ তার ভেতরটা পড়ে ফেলতে চাইছে।
--এ তো ভারি জ্বালা হল দেখছি। নিজেকেই নিজে বলেছিল, কিন্তু তারপর নিজের মনে হেসেও ফেলেছিল। এই কমপ্লেক্সটা নতুন। এখনো লোকজন একটু একটু করে শিফট করছে। সবগুলো ফ্ল্যাটে লোক আসে নি। ইনিও বোধকরি নতুন, কদিনে এখানকার হাল-হকিকত দেখলে নিশ্চয় শুধরে যাবেন। আর তাছাড়া উল্টো দিকের বারান্দা হলেও কেউ তো আর সত্যিই গায়ের ওপর শ্বাস ফেলছে না! মাঝখানে তো অগাধ সমুদ্রের মত সেই ডিম্বাকৃতি খোলা জায়গা। তার দুই প্রান্ত বরাবর টাওয়ারদুটো তো নদীর দুই পারের মত। আর তিনিও তো তাঁরই গাছে জল দিচ্ছেন। তবে কি সুনন্দা নিজেই এক পিটপিটে বুড়ি হয়ে যাচ্ছে! নিজেকেই একটু দাবড়ে দিয়েছিল সুনন্দা।
কিন্তু অস্বস্তির খচখচানিটা যে তার মনের গহনে কোথাও থেকেই গেল তাতে সন্দেহ নেই। সুনন্দা এটাও লক্ষ্য করেছে যে নীল পাঞ্জাবি গড়নে, উচ্চতায় রবিরই মত। উচ্চতার জন্যই বোধহয়, ইনিও রবির মত একটু ঝুঁকেই হাঁটেন। গাছপালার শখ তো দেখাই যাচ্ছে। শুধু দুইপক্ষের সময়জ্ঞানটা সেই রবি ঠাকুরের গানের কুহু আর কেকার মত যদি আলাদা হত! সুনন্দার অফিসে বেরোনর থাকে, কাজেই সময়টা তার দিক থেকেও পাল্টানো গেল না কোনমতেই।
মাসখানেক এই নীরব অসোয়াস্তি ভোগ করার পর সুনন্দার মনে হয়েছিল যে একবার খোঁজ নেওয়া দরকার। প্রতিবেশীদের সাথে খেজুরে আলাপের সম্ভাবনা না থাকলেও, এই বহুতলের খোপে খোপে যন্ত্রের মত একঘেয়ে ছন্দে চলা সংসারগুলির অন্ধি-সন্ধি যাদের শ্রমের তৈল-সিঞ্চনে চলমান, তাদের প্রত্যেকে এক একজন গেজেটিআর। এই বহুতলের অদূরে একটা বসতি। আরেকটা জগৎ। সেখান থেকে ওরা প্রতিদিন সকালে আসে, সুন্দর করে পরা একটু চকরা-বকরা ঝলমলে শাড়ি, কপালে টিপ, হাতে সবুজ চুড়ির গোছা। সিকিওরিটিতে কার্ড দেখিয়ে ঢুকে পড়ে ওরা ভাগ হয়ে যায়, এ টাওয়ার থেকে সে টাওয়ারে বাড়ি বাড়ি নির্দিষ্ট কাজগুলো সেরে ওরা যখন ওদের ঘরের পথ ধরে, তখন প্রায় বেলা প্রায় পড়ে আসে। রোদে লালচে আভা দেখা দেয়।
যেমন সুনন্দার জন্য আসে শালিনী। পুরোনো মানুষ, সুনন্দারা এ বাড়িতে উঠে আসা থেকে ও এখানে কাজ করে আসছে। খুব পরিচ্ছন্ন। সিন্থেটিক শাড়ি, ম্যাচিং ব্লাউজ, কাজে নামার আগে শাড়ির কুঁচিগুলো একটু উঁচু করে নেয় শুধু। তারপর কাজ ও মুখ দুটোই একসাথে চলে। ফ্ল্যাটের একটা চাবি ওর কাছেই থাকে। কখনো-সখনো সুনন্দার তাড়াতাড়ি বেরতে হলেও শালিনী নিজের সময়মত কাজ করে চলে যায়। এদের কাছেই প্রায় সবাই একে অন্যের খবর পেয়ে যান, নতুন কেউ বসবাস করতে এলে সে খবরও রটে যায় মুখে-মুখে।
শালিনীকে দেখিয়েছিলেন, মানুষটা কে রে? খুব গাছের শখ বুঝি!
শালিনীর কপালে পাথর-বসানো টিপটা ঝিকিয়ে ওঠে, তো চিত্র বনাওতে তাঈ, পেন্টার আহে। ঘরি পুষ্কল ঝাড়ে লাবুন ঠেবলা। (দিদি, উনি ছবি আঁকেন, পেন্টার। বাড়িতে অনেক গাছ লাগিয়েছেন) তারপর গলা নামিয়ে বলেছে, তুমি বললে বিশ্বাস করবে না দিদি, একদম রবি সাবের মত দেখতে ওনাকে। সুনন্দা আর কথা বাড়ায় নি। কারণ সেটাও ছড়িয়ে পড়তে সময় নেবে না বেশি, এ জানা কথা। ল্যাবার্নামের দশতলার দিদি হিবিসকাসের দশতলার সাহেবের কথা জিজ্ঞেস করছিল... যাচ্ছেতাই ব্যপার হবে একটা।
চিত্রকরকে যে রবির মতই দেখতে, সেটা জানার পরের দিন সকালটা এল অন্যরকম হয়ে। বিরক্তির বদলে কৌতূহল। নীল পাঞ্জাবিকে অনুপ্রবেশকারীর বদলে ঠিক অতিথি বলে মনে না হলেও অবাঞ্ছিত বলে নস্যাৎ করতে বাধল। বারান্দায় গাছে জল দিতে একটু বেশি সময়ও নিল সেদিন।
একটু দাঁড়িয়ে নীল পাঞ্জাবিকে একবার ভাল করে দেখার চেষ্টা করল। অনেকটাই দূর, খালি চোখে ঠাহর করা অসম্ভব। একটা হ্যান্ডিক্যাম আছে, তার ভিউ ফাইন্ডার দিয়ে জুম করে দেখা যায় অবশ্য, কিন্তু ঠিক তখনই যদি ওদিকেও তিনি বায়নোকুলার বাগিয়ে বসে থাকেন! এরকম ধরা পড়ে যাওয়া ভারি লজ্জার ব্যপার হবে। অশোভন।
নিজের একটু পরিবর্তনের প্রয়োজন বুঝতে পেরে, অনেক সঙ্কোচ অগ্রাহ্য করে সে একদিন নিচে যায়। রবির শুশ্রূষার প্রয়োজনেও বটে, তাছাড়া সারাদিন আপিস করে সুনন্দার আবার এতটা সময় নিচে কাটাতে কোন ইচ্ছাই করে নি কখনো। কাজেই মুখচেনা থাকলেও গৃহবধূদের এই সান্ধ্য আড্ডায় তার একটু আজব লাগে। মিসেস মালহোত্রা ও তাঁর সমবয়স্কা আরও কয়েকজন মহিলা রোজ সন্ধেবেলা সংসারের দাবি মিটিয়ে নেমে আসেন, খোলা জায়গাটায় তাঁরা হাল্কা হাঁটাহাঁটি ও সমানুপাতে পরনিন্দা-পরচর্চায় ঘন্টাদেড়েক কাটিয়ে দেন। মিসেস মালহোত্রার ছেলে বিদেশে, তাদের বিয়ে-থাওয়াও মিটে গিয়েছে, বাড়িতে সবসময় দুটো কাজের লোক, কাজেই তিনি বেশ জাঁকিয়ে রসিয়ে সান্ধ্য আড্ডা পরিচালনা করেন। প্রথমদিন ভালই লাগে, ছুটকো-ছাটকা খবরের টুকরো, একটি সদ্য-তরুণী মা তার বাচ্চাকে প্র্যামে বসিয়ে নিয়ে এসে গল্পে মজে যায়, বাচ্চাটা তারস্বরে কেঁদে উঠলে মেয়েটি আবার প্র্যাম নিয়ে হাঁটতে থাকে। মিসেস মোরে ঘরে বানানো মিষ্টি নিয়ে এসে সবাইকে খাওয়ার জন্য পীড়াপীড়ি করেন। কিন্তু পরপর কয়েকদিন যাবার পর সুনন্দা বুঝতে পারে যে এটা একটা রুটিন করে কাঁটা-চিবোনোর মত ব্যপার হয়ে যাচ্ছে। স্মল টক বেশিক্ষণ তার পোষায় না, একটু পরেই সে আনমনা হয়ে যায়...আলগা কথাবার্তায় সে ঠিক জুড়ে যেতে পারে না কোথাও...পুদিনার চাটনির রেসিপি থেকে হীরের দোকানে মাসে মাসে কিটির স্কীমে জমিয়ে গয়না কেনার কৌশল, কোনোটাই তাকে টানে না। তাই পার্কটা ঘিরে একটা চক্কর দিয়ে আসে। তারপর কোনো একটা কাজের ছুতো করে কেটে পড়ে।
ঘরে ফিরে সাফসাফাই নিয়ে পড়ে সে। ঘরের আনাচে-কানাচে জমে থাকা ধুলো খুঁজে খুঁজে বের করে, রান্নাঘরের মশলার কৌটো বদলায়, বসার ঘরের শেলফ, টিভি ক্যাবিনেট দিনে পাঁচবার মোছে, রবির ছবি থেকে মালাটা খুলে রাথে, যাতে বারবার কাপড় দিয়ে ঘষে সাফ রাখতে সুবিধে হয়। রবির ছবিতে কি প্রশ্রয়ের হাসি দেখা যায়? এবার সন্ধ্যার আধো অন্ধকারেও একবার বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায়...আছে, আছে, এবারেও কেউ আছে, শুধু আলোর অভাবে তিনি নীল পাঞ্জাবিই কিনা, ঠিক বোঝা যায় না। সুনন্দার মনে পড়ে, সেদিন মিসেস কুলকার্ণি কিছু বলছিলেন তাঁর প্রতিবেশির ব্যপারে...সামথিং ভেরি আনফরচুনেট অর আনইউজুয়াল...উনি তো হিবিসকাসেই থাকেন...কোন ফ্লোর, সেটা অবশ্য সুনন্দার মনে পড়ছে না ঠিক। আচ্ছা, আনইউজুয়াল মানে কি? সত্যিই কি কেউ থাকে সে বাড়িতে ? নিজের প্রিয়জনের গাছপালার দেখাশুনা করে? তাদের মতই একটি পরিবার, যার একজন ছবি?
হয়তো রবি নয়, সেখানে সুনন্দাই ছবি? আর রবি রোজ সকালে তার ছবির সামনে একবার দাঁড়িয়ে তারপর গাছে জল দেয়? ফ্ল্যাটের দেওয়ালে সুনন্দার দোতারা, সারিন্দা ঝোলে? রবি গাছে জল দিয়ে দশটা পাঁচটা আপিস যায়? ধুর, এরকম হয় না কি আবার, তাছাড়া শালিনী তো বলেইছে, উনি একজন আর্টিস্ট। অবশ্য সুনন্দাও ছবি আঁকতো এক কালে, কিন্তু সে নেহাতই শখে। সে কি একটা দিগন্তজোড়া আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে পড়েছে কোনোভাবে?
আরেকটা কথা মনে পড়াতে সে নিজেও অবাক হয়ে গেল খুব। দেওয়ালে রবির যে ছবিটা টাঙানো আছে, সেটা মোটেই সাম্প্রতিক নয়। রবি ছবি তুলতে ভালবাসত, ক্যামেরার পেছনে থাকাই তার পছন্দ ছিল বরাবর। কাজেই রবি চলে যাওয়ার পরে তার তেমন কোনো ভাল ছবি তাদের এলবামে খুঁজে পায়নি সুনন্দা। হয়ত তার ল্যাপটপে, ক্যামেরার স্মৃতিতে খুঁজলে পাওয়া যেতে পারতো, কিন্তু তখন অত সময় না থাকায় তাদের যুগলের কোনো একটা ছবি থেকে রবির মুখটা বড় করে প্রিন্ট করে নেওয়া হয়েছে।
অসুখের সময় রবি অনেকদিন দাড়ি কাটেনি, মুখখানাও চুপসে গিয়েছিল, বড় বড় প্যাচের মত দাগ দেখা দিয়েছিল চামড়ায়...নাঃ সেটাও রবির মুখ বলে মানতে চায় না সুনন্দা। শেষযাত্রার সময় তাই রবির কোনো ছবিই সে তোলে নি, তুলতে দেয় নি।
তাহলে কোন রবির মুখখানা চিরকালের...এই ভাবনা তাকে তোলপাড় করে দেয়। বক্সখাটের খোপ থেকে হাঁচোড়-পাঁচোড় করে বের করে সবকটা এলবাম ...বসার ঘর, শোবার ঘরে সর্বত্র খোলা এলবাম দেখে শালিনীর চোখ কপালে...আবার চালু করা হল ল্যাপটপ, খোলা হচ্ছে ক্যামেরা...নাঃ রবি কোথায়....এই তো তাদের সিমলার বাগিচার ছবি, এই মুকুটমণিপুরের, এই বীরভূমের টেরাকোটা মন্দির...সুনন্দা, রবির ভাই, তার বৌ, তাদের ছোট ছেলে মেয়েরা বিপ্লব, রণি, টুকু...সবাই আছে, রবিও আছে সর্বত্রই, ক্যামেরার পেছনে...কিন্তু যে মানুষটার সাথে এতদিনের বসবাস, তার মুখটা খুঁজে পেতে এত অসুবিধা হবে, স্বপ্নেও ভাবে নি সে। আসলে রবির থাকাটাই কি ওইরকম ছিল? তবে কি রবির চাইতে তার জগৎ, তার গান, তার পীস লিলি, তার ফাইকাসের বনসাই এইসব নিয়েই ছিল তাদের ঘরকন্না? এখনো তো ওয়ার্ডরোব খুললে রবির প্রিয় দাভিদফ কোলোনের গন্ধ পায় অথচ মানুষটার একটা ঠিকঠাক ক্লোজাপ ছবি নেই কোথাও!
তাহলে নীল পাঞ্জাবিকে সামনাসামনি দেখলে কোন রবির সঙ্গে মিলিয়ে দেখবে সে! শুধুই মুখের আদল? উজ্জ্বল চোখদুটি? গলার স্বর? একটা কথা অবশ্য ঠিক। রবির উপস্থিতিতে একটা বিশেষ মুহূর্ত থাকত। এই কথা বলছে, ট্রিভিয়া, আর কি। এদিকে হাতে করে যন্ত্রের কানে প্যাঁচ দিচ্ছে। তারপর একটা সময় হঠাৎই সে যন্ত্র সুরে বেজে উঠল, এমন তীব্র, স্পষ্ট সে বেজে ওঠা যে চারপাশের গুঞ্জন অবান্তর হয়ে এল। রবির হাতই কথা বলে উঠছে।
কিংবা মেঘালয়ে তোলা রবির সেই ব্লু-বটল প্রজাপতির অদ্ভুত সুন্দর ছবি। সেই ভালো লাগাটুকুই রবি। কিন্তু তাতে কি মন ভরে। রক্তমাংসের রবির জন্য সুনন্দার পাগল পাগল লাগে। বিপ্লবকে ফোন করে, জানিস তোর বাবার একটা ছবিও খুঁজে পাচ্ছি না।
--এলবামে দেখো, ঠিক পাবে। তখন ব্যস্ততার মধ্যে আমি খুঁজতে পারিনি। আমি দশেরার সময় গেলে মেমরি স্টিক থেকে ডাউনলোড করে দিতে পারবো।
--না না, আমি দেখেছি। নেই, কোথাও একটা ছবি রেখে যায় নি তোর বাবা।
নিজের গলাই অস্বাভাবিক তীব্র শোনাল কি! একটু অপ্রতিভ লাগে তার। বুঝদার ছেলে চুপ করে থাকে খানিক, তারপর বলে, ইটস ওকে মা, সব ঠিক হয়ে যাবে। আগে যেমন রোজ বিকেলবেলা নিচে যাচ্ছিলে তেমনি যাও আবার। রোজ কিছুক্ষণ মালহোত্রা আন্টিদের সাথে কাটালে ক্ষতি কি। আর...আমি কি আসবো দু-তিন দিনের জন্য? গলায় এত শ্লেষ্মাও জমেছিল, গলা ঘড়ঘড় করে ওঠে, সামলে নিয়ে বলে, না না, তার দরকার নেই। তুই দশেরাতেই আসিস।
--মিসেস মিত্রা, মিসেস মিত্রা, আপ য়ঁহা কৈসে?
মিসেস কুলকার্ণির ডাকে হুঁশ ফেরে সুনন্দার। আজকেও আড্ডায় একবার নিয়ম-মাফিক হাজরির পর পার্কটায় একটা-দুটো চক্কর দিয়েই নিজের ঘরে ফিরে যাবে বলে সে রওনা দিয়েছিল। লিফ্টে দশের বাটন টেপবার সময়েই মনে হচ্ছিল প্যানেলটা উল্টো দিকে এল কেমন করে! লিফট থেকে অভ্যাসবশে নিজের দরজার দিকে এসে ব্যাগের থেকে চাবি বের করতে গিয়েও সামনের দরজায় কোনো নেমপ্লেট নেই দেখে থমকে যায়। তাদের দরজায় তো মিত্রা’জ লেথা আছে, রবির পছন্দসই ফন্টে! ওর অপ্রস্তুত মূর্তি দেখে কি মায়া হল মিসেস কুলকার্ণির? উনি বলছিলেন আপ কেয়া উন্হে পেহচানতে হ্যায়? উনকা মিস্টার মশহুর আর্টিস্ট হ্যায়। মিহির মুরুডগাঁওকর, নাম সুনে হোঙ্গে আপ। বলা বাহুল্য, সুনন্দা শোনে নি।
সহসা কোনো উত্তর যোগালো না তার মুখে। সুনন্দা বুঝতে পারে যে সে নিজের টাওয়ার ল্যাবার্নামের দিকে না গিয়ে উল্টো দিকের টাওয়ার হিবিসকাসের দশতলায় এসে পড়েছে। যদি ভুল করে কলিং বেল টিপে দিত তাহলে কী হত! নীল পাঞ্জাবি দোর খুলত? রবির হমশকল ? না রবিই? কোন রবি? তার কুড়ি-বাইশের প্রথম ও শেষ ক্রাশ রবি? না তার সন্তানের বাবা রবি? না কি রোগ-যন্ত্রণা-জর্জর তিক্ত-অবুঝ রবি? না কি সারিন্দা হাতে আচমকা, ইয়ে সুনো, বলে ওঠা সদাহাস্যময় রবি? আর সে নিজে? দেওয়ালে ম্যারেজ ফোটো থেকে ব্লো-আপ করা এক সদ্য তরুণী কি নিজের প্রতিবিম্বকে দেখে বলে উঠত, এসেছিস, আয়, আয়?
--মেরে সে, লগতা হ্যায় গলতি হো গয়া, এর বেশি কথা যোগালো না সুনন্দার মুখে। মিসেস কুলকার্ণি হাসছিলেন, ভুল হুয়া তো কেয়া হুয়া, আইয়ে হমারে সাথ আজ রোটি তোড়িয়ে। সহৃদয় হাসি।
--বহোত শুক্রিয়া, পর আজ নহি, ফির কভি জরুর আউঙ্গি, বলে লিফটের অপেক্ষা না করে সিঁড়ি দিয়ে একেবারে চার পাঁচতলা নেমে এসে তারপর লিফটের বোতাম টেপে সুনন্দা। তার শরীর তখন উত্তেজনায় থরথর করে কাঁপছে।
বাড়ি ফিরে সে রাতে ধুম জ্বর এল সুনন্দার। জ্বরের ঘোরে একটা স্বপ্ন ফিরে ফিরে আসছিল বারবার...অনেক দূরে কোথাও বে়ড়াতে গিয়েছে তারা তিনজন...দেড় বছরের বিপ্লব রবির কাঁধে...দূরে তুষারমণ্ডিত হিমালয়? না! এ তো সেই ভাসমান দ্বীপের হ্রদ। ডিঙিটা একটি দ্বীপের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, একটু একটু দুলছে আর কুয়াশা এসে দিগন্তরেখা অব্দি মুছে দিচ্ছে...রবির হাতটা জড়িয়ে ধরে রবির দিকে তাকাতেই একটা হাহাকার যেন এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিয়ে গেল তাকে। রবির টি-শার্টের ওপরে গলা থেকে মাথা পর্যন্ত স্রেফ জমাট কুয়াশা। মুখ নেই তার।
সকালে বার বার বেল বাজিয়েও সাড়া না পেয়ে শালিনী চাবি খুলে ঢুকে দেখে সুনন্দা ভূমিশয্যায়। অসংলগ্ন বকে যাচ্ছে...বন্ধ চোখের কোল বেয়ে শুকনো জলের দাগ। সে-ই গিয়ে ডেকে আনল প্রতিবেশীদের, খবর দিল বিপ্লবকে, হাসপাতালে নিয়ে গেল।
হাসপাতাল থেকে টানা দশদিন পরে ছাড়া পেল সুনন্দা। স্ট্রেস রিডিউস করার সুপরামর্শ নিয়ে বাড়ি ফিরে এল। ছেলে এবার কোনো আপত্তি শোনে নি। লম্বা ছুটি নিয়ে এসে বাড়িতে ছিল। ঘরের টুকটাক সমস্ত কাজ ছেলে একলা করেছে, সুনন্দাকে বিছানা থেকে উঠতে দেয় নি। অনেকদিন বাদে সুনন্দার গাছে জল দেওয়ার রুটিনে ছেদ পড়ল। ছেলে সে কাজটাও করেছে নিজে থেকেই। ওই একটু অভাববোধই তার থেকে গেল। কিন্তু অনেকখানি স্বস্তিও। তাছাড়া এবার স্বাতী এসেছিল বেশ কদিন। মেয়েটির কথা শুনেছেন নানা সূত্রে, ছেলে বুদ্ধিমানই বলতে হবে, এই সুযোগে মার সাথে মার হবু বৌমার আলাপ করিয়ে দিল সেবার অছিলায়। ওষুধপত্র খাওয়ানো, ধরে ধরে হাঁটানো...রোগির সেবাযত্ন দুজনে মিলে করল তারা, রাত্রে তাকে বাড়িতে ছেড়ে দিয়ে আসতো বিপ্লব।
সুনন্দার ভালই লাগল যে ওরা দুটিতে একটি দ্বীপ হয়ে উঠছে। ছেলে থাকতে থাকতেই একদিন স্বাতীর বাবা-মাকে নেমন্তন্ন করে খাওয়ানোর ইচ্ছে প্রকাশ করেছিল সুনন্দা। ছেলে আর শালিনীর সাহায্য নিয়ে সে কাজটাও একদিন সেরে ফেলল। বিয়ের কথাবার্তাটা পাড়ার মত সুযোগ আর কি। ছেলের ছুটি ফুরিয়ে এল ততদিনে। সুনন্দাও আস্তে আস্তে নিজের রুটিনে ফিরে যাচ্ছে। রবির ছবি, যথারীতি, এবারেও পাওয়া যায় নি, খোঁজাই সম্ভব হয়নি।
শালিনী মাঝখানে হুট করে ডুব দিয়ে দিল। চার-পাঁচদিন। অথচ কালকেও ব্যালকনি থেকে তার কচি কলাপাতা রঙের শাড়ির ঝলক দেখেছে সুনন্দা, এই সে সিকিওরিটি গেট দিয়ে ঢুকছে, এই পাশের উইং-এর দিকে যাচ্ছে তার বারান্দার দিকে চোরা চাউনি হেনে, এদিকে মোবাইলে তাকে ধরা যাচ্ছে না, যান্ত্রিক কন্ঠস্বর বলে যাচ্ছে, তুম্ চ দ্বারা ডায়াল কেলেলা নাম্বার উত্তর দেত্ নাহি।
বিপ্লবকে কাল রাতে ব্যাঙ্গালোর চলে যেতে হয়েছে আচমকা। আজ শালিনীকে চেপে ধরবার জন্য একদম তৈরী হয়ে ঠিক পৌনে আটটাতে নিচে নামতেই মিসেস মালহোত্রার সঙ্গে দেখা। শালিনী তাঁর বাড়িতেও কাজ করে। শালিনীর কথা জিজ্ঞেস করতেই তিনি বললেন, আরে পুছিয়ে মত, এই ক্লাসের লোকগুলো কথনো শুধরোবে না।
শালিনী নাকি বেশি পয়সা পাবে বলে হিবিসকাসের মুরুডগাঁওকরের বৌ-এর সারাদিনের দেখাশোনার কাজ নিয়েছে, পুরনো কাজগুলোতে সময়ই দিতে পারছে না। সুনন্দার হতভম্ব অবস্থা দেখে দয়াপরবশ হয়ে উনি জিজ্ঞেস করলেন, মিসেস মিত্রা, আপনি জানতেন না? ওঁর পত্নীর তো এলঝাইমার কা বীমারী চল রহা হ্যায় আজ কই সাল। বহোত দিনোসে বহ কিসিকো পহচানতি নহী, উনকা মিস্টার কো ভি নহি।
সুনন্দা চোখ বোজে। কল্পনা করার চেষ্টা করে এলঝাইমারের কোন গোপন সঙ্ঘারামে বন্দী মিসেস মুরুডগাঁওকর প্রাণপণ কি সঙ্কেত পাঠিয়ে যাচ্ছেন, বুঝতে চাইছেন পৃথিবীর, প্রকৃতির লিখন। কিন্তু তাঁর মন আর পৃথিবীর মাঝখানে এক অসমর্থ শরীরের সীসের দেওয়াল যেন প্রতিহত করে দিচ্ছে সেইসব চিন্তার তরঙ্গকে।
--কিন্তু সে তো আজ অনেক দিন হল ভুগছেন, আজ নতুন করে আর কি হল!
--তাঁর দেখাশোনা তো হাজব্যান্ডই করতেন এতদিন। কিন্তু কদিন হল তাঁকেও হাসপাতালে দিতে হয়েছে।
--সে কি! কেন!
--ওনার একটা স্ট্রোক হয়েছে। সকালে একজন বাঈ তাঁকে পার্কিং লটে পড়ে থাকতে দেখে সকালে কাজে আসবার সময়। এত সিকিওরিটি ক্যামেরা, এত ওয়াচম্যান চারদিকে ঘুরছে, তবুও মেয়েটারই চোখে পড়ল। ভাবুন তো!
সুনন্দা চোখ বন্ধ করে একটা লম্বা শ্বাস নিল। লোগটাক হ্রদের সেই ভাসমান ফুমদিগুলোর ছবি ভেসে আসে। দুটি দ্বীপ কি বড় কাছাকাছি চলে আসছিল পরস্পরের? একটি বাস্তব, অন্যটি... না দুটিই সমান্তরাল?
আর বেশি জিজ্ঞাসা করে না সুনন্দা। খোঁজ নিলে হয়ত জানা যাবে উনিও মনের ভুলেই আসছিলেন ল্যাবার্নামের দিকেই।