• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৬৭ | জুন ২০১৭ | ছোটদের পরবাস | গল্প
    Share
  • জঙ্গলে এক গাছবাবা : সুব্রত সরকার


    চাবাগানের মধ্যে দিয়ে জিপটা ছুটছে। রাস্তার দুধারেই সবুজ সবুজ কত চা বাগান। গরমের ছুটিতে বেড়াতে এসে এই প্রথম জয় চা বাগান দেখছে। খুব আনন্দ হচ্ছে ওর। গাড়িতে মা-বাবা, মাসি-মেসো ও মাসির মেয়ে জুঁই। জুঁই-এরও খুব মজা হচ্ছে চোখের সামনে এত সুন্দর সব চা বাগান দেখে। ও আনন্দে হেসে বলল, জয়দা, চা বাগানে লেপার্ড থাকে জানিস?

    শুনেছি তো। জয় মাথা নেড়ে এমন করে বলল যেন এ আর এমন কি কথা!

    জিপ চালাতে চালাতে ড্রাইভার কাকু এবার বলল, লেপার্ড খুব খতরনাক জানোয়ার আছে। আমাদের বস্তিতে এসে ছাগল মেরে নিয়ে গেছে এক মাস আগে। ...

    ড্রাইভার কাকু নেপালি। কিন্তু বাংলা বোঝে, বলতেও পারে সুন্দর। ড্রাইভার কাকু গাড়ি চালাতে চালাতে অনেক গল্প বলছে।

    আজ সকালেই ট্রেন থেকে নেমেছে জয়রা। ট্রেন একটু লেট ছিল। স্টেশনে নেমেই ড্রাইভার কাকুকে পেয়ে যায়। ড্রাইভার কাকু গাড়ি নিয়ে ঠিক সময়মতই হাজির ছিল।

    স্টেশন থেকে বেশি দূর নয় বনবাংলো। একটা সুন্দর নদী আছে বনবাংলোর পাশেই। নদীর ধারের এই বন বাংলোতেই ওরা দু'রাত থাকবে। চা বাগান শেষ হলেই শুরু হবে জঙ্গল। গভীর জঙ্গল। সেই জঙ্গলের পথ ধরে কিছুটা গেলেই এক পাহাড়ি নদী ফুলপানিয়া। এই ফুলপানিয়ার ধারেই আছে বনবাংলোটা। দারুণ গা ছমছমে নির্জন জায়গা। পুরো ট্যুর প্রোগ্রামটাই মেসো বানিয়েছে। পাঁচদিনের এই ভ্রমণে পাহাড়, নদী, জঙ্গল ও চা বাগান সব দেখতে পাওয়া যাবে।

    আজ আবার জুঁই-এর জন্মদিন। জন্মদিনের কেকও আনা হয়েছে। সন্ধেবেলায় বনবাংলোয় কেক কেটে দারুণ অন্যরকমভাবে জন্মদিন পালন করা হবে।

    চা বাগান শেষ করে জিপ গাড়িটা জঙ্গলের পথে ঢুকে পড়েছে। এই জঙ্গল খুব গভীর। হাতি আছে। হরিণ আছে। লেপার্ড আছে। ড্রাইভার কাকু গাড়ি চালাতে চালাতে এবার বলল। এই জঙ্গলে এক গাছবাবা থাকে। বিশ বছর ধরে গাছে ঘর বানিয়ে আছে। দেখতে যাবেন গাছবাবাকে?

    জয় তো শুনে অবাক। জুঁই অবাক চোখে জয়দার দিকে তাকিয়ে থাকে। মেসো বলল, কুড়ি বছর ধরে এই জঙ্গলে থাকে? সত্যি!...

    গাড়ির গতি একটু কমিয়ে ড্রাইভার কাকু বলল, হাঁ সাব, বিশ বছর ধরে এই জঙ্গলে, গাছে ঘর বেঁধে আছে। ও সাধুবাবা নয়, গাছবাবা। খুব সুন্দর কথা বলে। আমি বহুত টুরিস্টকে নিয়ে আসি, দেখাই। গাছবাবাকে দর্শন করে সবাই খুব খুশি হয়।

    জয় বাবার দিকে তাকিয়ে বলল, বাবা আমি গাছবাবাকে দেখব।

    জুঁইও আবদার জুড়ে দিল, চলো না মেসো গাছবাবার কাছে।

    মা-মাসিও যেতে চায়। ড্রাইভার কাকু গাড়ির গতি পাল্টিয়ে জঙ্গলের মেঠো রাস্তা ধরল। ছায়া-ছায়া, অন্ধকার পথ। বেশ খানিকটা গিয়ে জিপ থামল। ড্রাইভার কাকু বলল, চলুন এবার একটু হেঁটে যেতে হবে।

    জিপ থেকে সবাই নেমে এল। ঘন গভীর জঙ্গল। বেশ গা ছম্‌ছম, ভয় ভয় করছে। আবার ভালোও লাগছে। ড্রাইভার কাকু সবার আগে আগে যাচ্ছে। কিছুটা এসেই পড়ল একটা বিরাট গুঁড়িমোটা ময়না গাছ। সেই গাছের ডালে কি সুন্দর একটা ছোট্ট ঘর। সেখানে পা ঝুলিয়ে উদাসী একটা মানুষ চুপ করে বসে আছে। মুখে একগাল বড় দাড়ি। প্যান্টটা হাঁটু অবধি গোটানো। জামার বোতাম খোলা। মাথায় একটা গেরুয়া পাগড়ি।

    ড্রাইভার কাকু অল্প হাঁক দিয়ে বলল, জী ভাইয়া, ট্যুরিস্ট আয়া।

    গাছবাবা পা দুলিয়ে বেশ আপনমনে বসেছিল। ড্রাইভার কাকুর হাঁক শুনতে পেয়ে একটু হাসল। জয়দের দিকে তাকিয়ে বলল, নমস্তে। নমস্তে। ...

    বাবা-মা, মাসি-মেসো সবাই হাতজোড় করে নমস্কার জানাল। জয় ও জুঁই চুপ করে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে। অদ্ভুত দেখতে এই গাছবাবাকে ওরা দুজন অবাক চোখে তাকিয়ে দেখছে।

    গাছবাবা অত উঁচু ওই ময়না গাছের ডাল থেকে হঠাৎ শূন্যে দু'বার ডিগবাজি খেয়ে একদম ওদের সামনে এসে দাঁড়াল। অবাক করা এই ডিগবাজি। বাবা-মেসো দুজনেই ঘাবড়ে গেছে। মা-মাসি তো ভয়ই পেয়ে গেল। গাছবাবা সবার সামনে দাঁড়িয়ে কি সুন্দর হেসে বলল, দিন-ভর বহুত ট্যুরিস্ট আতা। মুলাকাত হোতা। আচ্ছা লাগতা হ্যায়। কভি কভি সাহেব-মেমসাহেব ভি আতা। আপ লোক কাঁহাসে আতা?

    বাবা বলল, কলকাতা মানে দমদম থেকে আসছি।

    এয়ারপোর্ট কি আশ-পাশ?

    মেসো বলল, নেহি। নেহি ...

    সমঝ লিয়া মেট্রো স্টেশান কা আশ-পাশ মে ...

    মা বলল, নেহি নেহি গোরা বাজার।

    ঠিক হ্যায়। গাছবাবা এবার হেসে বলল, বাচ্চালোক নাম বোল।

    জয় ও জুঁই দুজনেই চটপট নাম বলে দিল।

    গাছবাবা বলল, কোন কিলাসে পড়া-লিখা কর?

    জয় সেভেন, জুঁই ফোর — দুজনে প্রায় একসাথে বলল।

    গাছবাবা বলল, ইস্‌ জঙ্গল বহুত খতরনাক হ্যায়। জঙ্গল মে হাতি, লেপার্ড, হিরণ, সাপ, ভাল্লু সব ভি হ্যায়। লেকিন উস সবকা সাথ মেরি দোস্তি। হা-হা-হা ...

    আপনি কুড়ি বছর ধরে এই জঙ্গলে আছেন কেন? মেসো ভয়ে ভয়েই বলল।

    গাছবাবা একটুও না রেগে বলল, জঙ্গল ভালো লাগে তাই থাকি।

    — ভয় করে না?

    — কিসের ভয়?

    জয় ভাবছিল বলবে, ভূত আছে না জঙ্গলে?

    জুঁই ভাবছিল বলবে, লেপার্ড, হাতি কিছু করে না?

    গাছবাবা এবার ধীরে ধীরে বলল, আমি এই জঙ্গলেই ভালো আছি। জঙ্গলকে আমি খুব ভালোবাসি। জঙ্গলও আমাকে ভালোবাসে।

    একে একা থাকেন কি করে? কি খান?

    যা পাই। তা খাই। ভুখ আমার জাদা নেহি।

    আপনার ওই ছোট্ট ঘরে কি আছে? মা বেশ মজা করেই বলল।

    গাছবাবা হেসে বলল, বহিন জি, কুছই নেহি। লেকিন বহুত আদমি বোলতা হায়, গাছবাবাকো পাস বহুত কুছ হ্যায়। হিরণ কা শিং, ময়ূর কা ডিম, হাতি কা দাঁত। হা-হা-হা ...

    মেসো বলল, রান্না কোথায় করেন?

    করি না তো। গাছবাবা হেসে সুন্দর করে বলল, আমি শুখা খাবার খাই। রান্না খাবার খাই না।

    মেসো এবার বলল, আপনার একটা ছবি তুলব?

    সেলফি? গাছবাবা মজা করে বলল।

    মেসো বলল, ক্যামেরাতে তুলব। সেলফিও তুলব একটা। কোই বাত নেহি।

    ছবি তোলা হল গাছবাবার। সবাই একসঙ্গে দাঁড়িয়ে গাছবাবাকে নিয়ে গ্রুপ ছবি তোলা হল। মেসো আবার সেলফিও তুলল। বেশ হৈ হৈ করে কেটে গেল সময়। বাবা বলল, মদনভাই তুমি খুব ভালো জিনিস দেখালে। এমন গাছবাবা আমরা কোনওদিন দেখিনি।

    এবার টা-টা করে ফিরে যাওয়ার পালা। বাবা মানি-ব্যাগ থেকে টাকা বের করে জয়ের হাতে দিয়ে বলল, গাছবাবাকে দাও।

    জয় জুঁইকে সঙ্গে নিয়ে গাছবাবার দিকে এগিয়ে গেল। একটু ভয় ভয় করেই হাতের টাকাটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল, গাছবাবা এই টাকাটা নিন।

    গাছবাবা তো হঠাৎ রেগে গিয়ে রে রে করে উঠল। হায় ভগবান! বাচ্চালোকের হাত থেকে তো আমি পয়সা নিই না। কভি নেহি। কভি নেহি। ...

    বাবা-মেসো খুব লজ্জা পেয়ে গেছে। মা বলল, জয় টাকাটা তুমি বাবার হাতে দিয়ে দাও। বাবা দিক। গাছবাবা ঠিকই বলেছেন। মাসি কেমন ভয়ে ভয়ে বলল, বাবাজি, ভুল হয়ে গেছে। আপনি টাকাটা নিন। কিছু কিনে খাবেন।

    গাছবাবা গম্ভীর। টাকা নেবেন না। থমথম করছে রাগী চোখ-মুখ। দু'হাত জোড় করে বলল, আমায় মাফ করবেন। ...

    জুঁই জয়দাকে ফিস ফিস করে কি যেন বলল। জয় তা শুনে দৌড়ে এসে কানে কানে মা-মাসিকে বলল। মা-মাসি দুজনেই তখন খুব খুশি হয়ে হেসে মাথা নেড়ে বলল, গুড আইডিয়া। ভেরি গুড। যাও নিয়ে এসো। ...

    জয়-জুঁই ড্রাইভারকাকুকে নিয়ে দৌড়ে গেল গাড়ির কাছে। গাড়ির দরজা খুলিয়ে ব্যাগ থেকে সযত্নে বের করে আনল জন্মদিনের কেকের প্যাকেটটা। তারপর হাসতে হাসতে দুজনে ছুটে চলে এল গাছবাবার কাছে। জুঁই গাছবাবার কাছে গিয়ে বলল, গাছবাবা আজ আমার জন্মদিন! ...

    রাগী, গম্ভীর গাছবাবা এবার আনন্দে হেসে উঠে বলল, বেটি আজ তোমার জনমদিন! বার্থ ডে! হ্যাপি বার্থ ডে! ঠিক হ্যায়, আজ এই জঙ্গলেই তোমার জন্মদিন হোক্‌। কেক কাটো। আমিও খাব! ...

    গাছবাবাই এবার সবাইকে জড় করে ময়নাগাছের নীচে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে জঙ্গলের এই সুন্দর পরিবেশে জুঁইকে দিয়েই কেকটা কাটা হল। সবাই হাততালি দিয়ে বলল, হ্যাপি বার্থ ডে টু ইউ। হ্যাপি বার্থ ডে টু ইউ ...

    গাছবাবা জুঁই-এর মাথায় হাত রেখে অনেক আশীর্বাদ করল। জুঁই-ও গাছবাবার মুখে কেকের একটা টুকরো তুলে দিয়ে বলল, গাছবাবা তুমি আর রাগ করে নেই তো? ...

    হো-হো-হো। গাছবাবা এবার প্রাণ খুলে হাসল। অট্টহাসির এই আওয়াজে কত পাখি ডানা ঝাপটিয়ে উড়ে গেল।

    মা-বাবা, মাসি-মেসো সবাই খুশি। জয়ও হাসছে। এবার ফিরে যেতে হবে। সবাই গাছবাবাকে টা-টা করল। গাছবাবা ওদের গাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে বলল, বহুত আচ্ছা লাগা। ফির মুলাকাৎ হোগা। ...

    ড্রাইভারকাকু গাড়ি স্টার্ট দিয়েছে। ওরা সবাই গাড়ির জানলা দিয়ে টা-টা করছে। এমন সময় হঠাৎ গাছবাবা শূন্যে এক বিরাট ডিগবাজি খেয়ে সেই ময়না গাছের ডালে গিয়ে বসে পড়ল। অবাক করা কাণ্ড। সবাই কেমন ঘাবড়ে গেছে। ভয় পেয়ে গেছে। জয়-জুঁই চুপ করে চেয়ে আছে। গাছবাবা এবার ময়না গাছের ডালে বসে পা দুলিয়ে দুলিয়ে কেমন মুচকি হেসে ওদের টা-টা করতে লাগল! ...

    ড্রাইভার কাকু গাড়ি নিয়ে একটু একটু করে এগিয়ে চলল। মা-বাবা, মাসি-মেসো অবাক চোখে গাছবাবার দিকে তাকিয়েই রইল। হাত নেড়ে টা-টা করা ভুলেই গেল ওরা!

    জয় ফিস ফিস করে জুঁইকে বলল, এই গাছবাবা মানুষ নয়। বনমানুষ! ...

    তুই ঠিকই বলেছিস জয়দা। আমরা দারুণ এক বনমানুষের দেখা পেয়ে গেলাম। জুঁই হাসতে হাসতে বলল।



    অলংকরণ (Artwork) : অলংকরণঃ অনন্যা দাশ
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments