• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৬৭ | জুন ২০১৭ | গ্রম্থ-সমালোচনা
    Share
  • স্পেনের গৃহযুদ্ধ ও ভারতবর্ষ — একটি আলোচনা : রামরতন মুখোপাধ্যায়


    স্পেনের গৃহযুদ্ধ ও ভারতবর্ষ--রবিন পাল; প্রথম প্রকাশ: জানুয়ারী ২০১৭; র‍্যাডিকাল ইম্প্রেশন - কলকাতা; পৃষ্ঠাঃ ১৬০; ISBN: 978-81-85459-38-1

    ম্প্রতি প্রকাশিত 'স্পেনের গৃহযুদ্ধ ও ভারতবর্ষ' গ্রন্থখানিতে রবিন পাল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী অধ্যায়ে স্পেনে অভ্যন্তরীণ অশান্তির জেরে জাতীয় জীবনে অস্তিত্বের যে সংকট দেখা দেয় এবং সেটা কিভাবে ধূমায়িত হয়ে স্পেনে প্রবল এক আলোড়ন তোলে এসব কিছু তিনি বিশদে আলোচনা করেছেন।

    স্পেন সাম্রাজ্যের অতীত গৌরব অস্তমিত হলে ১৯৩৬-এ সেনাপতিদের জুলাই বিদ্রোহ, ফ্রাঙ্কোর আগ্রাসন এবং যুক্তফ্রন্ট সরকারের প্রতিরোধ স্পেনকে করে তুলেছিল সারা দুনিয়ার বাম ও গণতন্ত্রী আকাঙ্খা ও বিবেকের রণাঙ্গন। এ লড়াই ফ্যাসিবাদ ও স্বাধীনতার। কম্যুনিজম ও সভ্যতার লড়াই। ১৯৩৬ সালে পিপলস ফ্রন্ট-এর সমর্থকেরা নির্বাচনে জয়ী হয়। দেশের কলকারখানা জমি ব্যাঙ্ক প্রভৃতি নবগঠিত কাউন্সিলের তত্ত্বাবধানে আনা হয়। জমির মালিক হয় কৃষকেরা। ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে সামন্ত প্রভুরা এবং ধনিক গোষ্ঠী। এদের ষড়যন্ত্রের ভরসাস্থল হলেন জেনারেল ফ্রাঙ্কো আর ফ্রাঙ্কোর পিছনে মুসোলিনি ও হিটলার। অতএব অসম একটি যুদ্ধ আসন্ন হয়ে উঠল। পৃথিবীর সচেতন মানুষেরা ফ্যাসিস্ট আক্রমণ আসছে বুঝলেন। কিন্তু এমতাবস্থায় স্পেনের মাটিতেই ফ্যাসিবাদের ঢেউ রুখতে হবে।

    স্বাধীনতার অহঙ্কারের অনুরণন যেন পাখির মুখে মুখে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে গেল। দিকে দিকে যুদ্ধে যাওয়ার আওয়াজ উঠছে — বাঁচি মরি ফিরব না আর ফিরব না রে। শ্রমিকেরা বসেছে চালকের আসনে, প্রতিটি অট্টালিকার মাথায় উড়ছে লাল পতাকা। ছুটে আসছে লেখক কবি সাংবাদিক। ফ্যাসিস্ট জার্মানি, ইটালি থেকে দলে দলে পলাতক বন্দী সোস্যালিস্ট ও কম্যুনিস্টরা এই সংগ্রামে যোগ দিতে চলে আসছে। তারা বুঝেছিল মাদ্রিদের পরাজয়ের অর্থ কী। 'মনুষ্যত্ব! মনুষ্যত্ব! আজ আমি তোমার দ্বারে ভিখারী। এস স্পেনকে সাহায্য কর।' বলে ডাক দিচ্ছেন রম্যাঁ রল্যাঁ। আন্তর্জাতিক ফ্যাসিজমের বিরুদ্ধে গণতন্ত্র রক্ষার সংগ্রামে স্পষ্ট ও দ্বিধাহীন ছিল রবীন্দ্রনাথের আহ্বান। অতঃপর ভারতে প্রতিষ্ঠিত হল League against Fascism and War-এর শাখা। বহু মানুষ এই যুদ্ধে লড়তে এসেছিলেন রিপাবলিককে বাঁচাতে। এরা ইন্টারন্যাশনাল ব্রিগেড নামে খ্যাত হয়। ৫৪টি দেশ থেকে ৩৫ হাজার ভলানটিয়ার এই ব্রিগেডে অংশগ্রহণ করে। আগত মানুষের এক তৃতীয়াংশ ছিল কম্যুনিষ্ট — প্রায় ৬০,০০০ যোদ্ধা। এই ব্রিগেডে যেমন ছিলেন শ্রমিক কৃষক, কর্মকার, কুম্ভকার তেমনি শিক্ষিত ও মেধাবী মানুষজন। অক্সফোর্ডের ছাত্র জন কর্নফোডের যুদ্ধক্ষেত্রে মৃত্যুকালে বয়স ছিল মাত্র একুশ, র‍্যালফ ফক্স, ক্রিস্টোফার কর্ডওয়েল, গারসিয়া লোরকা স্পেনের রণক্ষেত্রে অকালে প্রাণ দিয়েছেন। দেশ বিদেশের অজস্র মানুষ এসেছিল স্পেন যুদ্ধে লড়াই করতে। ফ্রান্স থেকে এসেছিলেন আন্‌দ্রে মালরো, ডবলিউ এইচ অডেন (ইংল্যান্ড), যুক্তরাষ্ট্র থেকে আর্নেষ্ট হেমিংওয়ে। তাঁর লেখা উপন্যাস 'ফর হুম্‌ দি বেল টোলস্‌' স্পেন যুদ্ধে তাঁর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে রচিত। পরে উপন্যাসটির উপর ছায়াছবি তৈরি হয়।

    এই প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের আবেগ ও ভূমিকার কথা লেখক পূর্বেই বলেছেন। কংগ্রেসের পক্ষ থেকে জওহরলাল ও কৃষ্ণ মেনন একাধিকবার স্পেনের রণক্ষেত্রে গিয়েছিলেন আর গিয়েছিলেন মুলুকরাজ আনন্দের সঙ্গে মহারাষ্ট্রের এক সাধারণ মানুষ গোপাল মুকুন্দ হুদ্দার। তিনি রাইফেল হাতে লড়েছিলেন স্পেনের ইন্টারন্যাশনাল বাহিনীর হয়ে। ভারতবর্ষের উপর এই গৃহযুদ্ধের অভিঘাত নিয়ে আলোচনা কিছু দীর্ঘ হলেও পাঠক পুরনো স্মৃতি ও চিন্তাভাবনা ঝালিয়ে নিতে পারবেন। এ প্রসঙ্গে টুকরো টুকরো অনেক গদ্য পদ্য, জওহরলালের প্রবন্ধ চিঠি, গ্রন্থকারকে লেখা (০৪.১০.৯৬) মুলুকরাজের চিঠি ও তিনটে লেখা পাঠকের কৌতূহলকে চরিতার্থ করবে।

    স্পেনের গৃহযুদ্ধে ন্যাশনালিস্টরা সাহায্য পেয়েছিলেন ফ্যাসিস্ট ইটালি এবং নাৎসী জার্মানি থেকে। জার্মানি, ইটালি পাঠায় সৈন্যদল ট্যাঙ্ক বিমানবহর ইত্যাদি অস্ত্রশস্ত্র। ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স নন্‌ইন্টারভেন্‌শনের খোলসে পরোক্ষে সাহায্য করে ফ্রাঙ্কোকেই। পক্ষান্তরে, জনসেনার অস্ত্রসম্ভার অপ্রতুল, তবু তারা ভাঙা রাইফেল মরচে পড়া তলোয়ার হাতুড়ি ছুরি, পিস্তল ডাণ্ডা পেট্রোলের বোতল নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে ফ্যাসিস্টদের উপর। প্রবল প্রতিরোধ করে ও প্রাণ দিয়ে মাদ্রিদ রক্ষা করেছিল জনসেনারা।

    কিন্তু মাদ্রিদ আত্মসমর্পণ করল প্রায় দু-বছর পরে। ফ্রাঙ্কোর ঘৃ্ণ্য 'পঞ্চম বাহিনী' জয়ের পথ সুগম করে দিয়েছিল। স্পেনের জনসেনা ফিরে গেল। যেতে যেতে বলে গেল — আমরা মরিনি, মরবোও না আবার ফিরে আসব একদিন ...

    ১৯৩৬ এর স্পেনের গৃহযুদ্ধ নিয়ে ইউরোপীয় রাজনৈতিক নেতাদের ভূমিকা এবং আত্মোৎসর্গপরায়ণ মানুষের কথা নিয়ে বিস্তর বই ও প্রবন্ধ লেখা হয়েছে। কিন্তু ভারতবর্ষের বিবেকবান মানুষেরও যে সামান্য হলেও উজ্জ্বল ভূমিকা ছিল শ্রীযুক্ত পালের বইটি মারফৎ আমরা তা জানতে পারি। যতোদূর জানি এই প্রয়াস নিয়ে আজও কিছু লেখা হয়নি। মুলকরাজ আনন্দ সাজ্জাদ জহীর এবং জওহরলাল ও কৃষ্ণ মেননের সক্রিয় প্রয়াসের কথা এখানে যত্ন সহকারে তুলে ধরা হয়েছে। স্পেন-লড়াই-এর ক্ষেত্রে সহায়ক একটি কমিটি ভারতে গড়ে তোলা এবং জনগণকে উদ্বুদ্ধ করার জন্য বক্তৃতা, প্রদর্শনী, বিবরণ, অ্যাম্বুলেন্স প্রেরণকথা যেমন আমরা জানতে পারি, নিরঞ্জন সেন, বিনয় ঘোষ প্রভৃতির লড়াই চলাকালীন প্রসঙ্গায়ন যেমন আছে, তেমনি চিন্তামণি কর প্রভৃতির স্মৃতিতে উঠে আসে শরণার্থী কথা। রবীন্দ্রনাথের আবেদন তো রাবীন্দ্রিক মহানুভবতার পরিচায়ক। প্রকাশিত 'স্পেন' পুস্তিকাটি কিন্তু দুর্লভ সংযোজন। বাংলা কবিতা ও কথাসাহিত্যে এ যুদ্ধ ঢেউ রেখে গেছে। আর আছে বেশ কিছু টুকরো লেখা--যেগুলি থেকে স্পেনের এই গৃহযুদ্ধের তাৎপর্য, সদর্থক ভূমিকা ইত্যাদি আমাদের সামনে তুলে ধরা হয়। এ বইতে স্পেন গৃহযুদ্ধের বিস্তৃত মূল্যায়নের চেষ্টা নেই, কিন্তু যে অজস্র টুকরো লেখা ও চিঠিপত্র ও আবেদনপত্র আছে তার ভিত্তিতে মতামত গড়ে তোলার সুযোগ আছে। বিশেষতঃ বহুদিন আগে ঘটে যাওয়া এই লড়াই যে ভারতীয় জীবনে কিছু ঢেউ তুলেছিল, লড়াই-এর প্রেরণা সঞ্চার করেছিল, চিন্মোহন সেহানবিশের দুটি লেখা থেকে তার পরিচয় মেলে। রুশ বিপ্লব ও সোভিয়েতের অবসান ঘটেছে, স্পেনের গৃহযুদ্ধ বিস্মৃতিতে চলে গেছে। অথচ এসব গরিমা কথার অবিনশ্বরতা অস্বীকার করা আর মনুষ্যত্বের অবমাননা এক কথা। শ্রী রবিন পাল অশেষ পরিশ্রম করে শুধু ভারতীয় তথা বাঙালির প্রতিক্রিয়াকে একত্রবদ্ধ করে, এই যুদ্ধের পরিচয় দিয়ে, গল্প কবিতা উপন্যাসে ও প্রবন্ধে প্রসঙ্গ উল্লেখ করে বাঙালি পাঠককে যে বিগত কালের ইতিহাসের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণে প্রয়াসী হয়েছেন সেজন্য তাঁকে সাধুবাদ জানাই। কতকগুলো দুর্লভ লেখা সন্নিবিষ্ট হওয়ায় বইটির গুরুত্ব বর্ধিত হয়েছে সন্দেহ নেই।

  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments