শীতের পর বসন্ত এলো। শীতের শিশির-ভেজা মসৃণ চাদর সরিয়ে আমাদের এই বনাঞ্চল, বাগান মাঠ-ঘাট, পুকুরপাড়ের গাছপালা তার পুরোনো পাতা ঝরিয়ে কচি পাতায় সেজে উঠলো।
শাল জঙ্গল কচিপাতায় ভরে উঠেছে। কুসুম গাছগুলো সেজে উঠেছে কচি পাতায় লাল আবীর ঢেলে। দেখলে মনে হয় জলন্ত অগ্নিশিখা। কেঁদ গাছগুলো নিজেদের সাজিয়েছে কালো শাখাপ্রশাখায় কচি পাতা দিয়ে আলপনা এঁকে। এই অরণ্যের গাছগুলো--মহুয়া, আসন, ছাতিম, পিয়াশাল, বট, অশ্বত্থ, বহড়া, পলাশ, কৃষ্ণচূড়া, শিমূল, কুরচি সকলেই কচি পাতায় সেজে উঠেছে। বাগানের গাছগুলোও, যেমন আম, জাম, কাঁঠাল, সফেদা, ফলসা, জামরুল, কামরাঙা, বোধহয় তাই দেখে পুরোনো পাতা ছেড়ে নতুন পাতায় ভরে উঠলো। ওরা যে এসে পড়বে, গাছেদের ভীষণ তাড়া। বসন্তকাল রঙের মিলনের কাল। গাছ তার শাখায় শাখায় রংবেরঙের ফুল আর মুকুলে নিজেদের সাজিয়ে তুলে ফুলের সৌগন্ধ বসন্তের আকাশে বাতাসে ছড়িয়ে দিলো। আর ওদের খাবারের জন্য ফুলের মধ্যে রাখলো মিষ্টি মধু। ফুলের বর্ণ আর সুগন্ধে ঝাঁকে ঝাঁকে ভ্রমর, মৌমাছি আর পতঙ্গের দল এলো ছুটে। রংবেরঙের ফুলের বাহার দেখে ওদের চোখ ধাঁধিয়ে গেলো। ফুলের সৌন্দর্য দেখে ফুলের উপর বসে এবার ওরা মধুর সন্ধান পেলো। মধু চেটে মুগ্ধ হয়ে আনন্দে ভন্-ভন্ আওয়াজ তুলে এ-ফুলে ও-ফুলে মধু খেলো। গাছেরা এদের নিয়ে কৌশলে পরাগমিলনের কাজটা করিয়ে নিলো। কোন পতঙ্গই কিন্তু এই কাজটার টের পেল না। অথচ জগৎ সংসারে এই পতঙ্গের দল উপকারী পোকা বলে স্বীকৃতি পেল। ভোরের আলো ফুটতে ফুটতে আগের দিনের ফুল ঝরিয়ে গাছগুলি নূতনভাবে সেজে উঠলো। কিছু গাছ ভোরের ফুলের এক বর্ণ, বেলা বাড়ার সাথে সাথে অন্য বর্ণে নিজেকে সাজিয়ে প্রকৃতিতে মেলে ধরলো।
পলাশ, শিমূল, রাধাচূড়া, কৃষ্ণচূড়া, কুরচি ফুলের রং বেরঙের বাহার দেখে রংবেরঙের প্রজাপতির দল প্রকৃতির এই হাটে এসে প্রকৃতিকে আরো রাঙিয়ে তুললো।
বনাঞ্চলের মহুল গাছগুলি দুধসাদা ফুলে ভরে উঠলো। মহুয়া ফুলের গন্ধ ঠিক যেন বাসমতী চালের পায়েসের গন্ধ--আকাশ-বাতাসে ছড়িয়ে দিলো। ভ্রমরা, মৌমাছি, পতঙ্গের দল ঝাঁকে ঝাঁকে ফুলে ফুলে বসে মধু পান করলো। সকলে সেই মধু পান করে নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়লো। পতঙ্গের দল নেশার ঘোরে এই গাছগুলির উপর পাক খেতে লাগলো। মহুয়া গাছে যত দিন ফুল থাকলো, ততদিন সুকৌশলে ওদের নিয়ে পরাগমিলনের কাজটি মহুয়া গাছ করিয়ে নিলো।
এই হাটে এত মধুর ছড়াছড়ি। একদল ফুলচুষী (টিকেলস্ ফ্লাওয়ার পেকার) পাখি। আর এলো মৌচুষী বা মধুকয়া (পার্পল সানবার্ড) পাখির দল। এরা এদের তীক্ষ্ণ ঠোঁট দিয়ে ফুলের উপর উড়ে উড়ে নানা ভঙ্গিমায় ফুলের মধু খেলো। মধু এদের প্রধান খাবার। এরা উইচ উইচ করে ডাকতে ডাকতে হাট মাতালো। গাছ তার পরাগ মিলনের কাজটা এদের দিয়েও করিয়ে নিলো। বোঁটা থেকে ফুল খসে পড়লে, প্রকৃতির সৌন্দর্য কিছুটা হারাবে সেই কারণে খুব সতর্কভাবে মধু খেলো।
বাঘ-মৌরা এত আহারের সন্ধান পেয়ে আমগাছে চাক বাঁধলো। ক্ষুদে মৌ-রা ঠিক করলো গাছের কোটরে বাসা বাঁধবে। পতঙ্গরা মধু খেয়ে পুষ্ট হলো। এরা গাছের ছালের ফাটলে, পাতার নিচে আনাচে কানাচে ডিম পাড়লো। কিছু পতঙ্গের দল নিরাপদ জায়গা খুঁজে পিছনের পা দুটি ব্যবহার করে মাটি সরিয়ে গর্ত করে বাসা বানালো। পতঙ্গটা ডিম পেড়ে ধীরে ধীরে বাচ্চার জন্ম দিলো। বাচ্চার আহারের জন্য যতবার বাসা থেকে উড়ে গিয়ে পোকা ধরতে বাইরে গেলো, ততবারই সামনের পা দিয়ে মাটি সরিয়ে গর্তের মুখ বন্ধ করে একটা চিহ্ন এঁকে গেলো। যাতে ফিরে সে ওর প্রবেশদ্বারের সঠিক সন্ধান পায়।
কীটপতঙ্গ খাওয়া পাখির দল প্রকৃতির এই হাটে এসে পড়লো। ফিঙে, দোয়েল, বুলবুলি, টুনটুনি, ডাহুক, বসন্তবৌরি, বেনেবৌ, হাড়িচাঁচা (ট্রিপাই) আর জলচর পাখিরাও সাথে এলো। গয়ার, বালিহাঁস, মেটে হাঁসেরা যোগ দিলো। বকেরা এদের পিছু এলো। এদের আগমনে ও কলরবে প্রকৃতির এই হাট জমে উঠলো। শালিক, ঘুঘু ডাক পড়লো। দীঘির পাড়ের বকুল গাছে বসে কোকিল পাখিটা কুহু কুহু সুরে ডাক পাড়লো। কাক ওর ফন্দিতে পা দিয়ে ওর পিছনে ধাওয়া করলো।
প্রকৃতির এই বৈচিত্র্যে হাট জমে উঠেছে। শিকরা পাখিটা উড়তে উড়তে উঁকি মেরে দেখে গেলো বাঘ-মৌমাছির মৌচাকে মধু রয়েছে। এরা এতো ধূর্ত যে মধুর সন্ধান পেলে ডানার ঝাপটায় মৌমাছি সরিয়ে নিমেষে খাবলা মেরে মৌমাছির চাক ভেঙে নিয়ে পালায়। (এদের স্থানীয় নাম টিকরা)।
এখানে আর এক বৈচিত্র্য, শীতঘুম কাটিয়ে ব্যাঙেরা গর্তের থেকে থপ্ থপ্ করে বেরিয়ে পড়লো। সাপও শীতঘুম কাটিয়ে আহারের খোঁজে ব্যাঙের পিছু নিলো। বেজিও এদিক ওদিক ঘুরে সাপটার পিছু নিলো। বহুরূপীটা সাপটাকে দেখে গাছের মগ ডালে উঠে ঘাড় নাড়তে লাগলো। দেখে মনে হল, সাপের উদ্দেশ্যে বলবার চেষ্টা করছে দেখ তোর কি হয়। ও ঘাড় নাড়লে হবে টা কী? প্রকৃতির এই হাটে এ তো খাদ্য আর খাদকের সম্পর্ক। এদের দেখে কাঠবিড়ালিটা নিজের আত্মপ্রত্যয়ের উপর ভর করে, সজনে গাছের মগডালে উঠে সজনে ফুল খেতে ব্যস্ত থাকলো।
মাকড়সারা এ গাছ থেকে অন্য গাছে জাল বুনে পোকা ধরার ফন্দি আঁটলো। ফল খাওয়া পাখিদের মধ্যে টিয়ার দল আগে এসে কাঠঠোকরাদের তৈরি বাসা দখল নিল। কাঠঠোকরারা অন্য গাছে উড়ে গেল। এই হাটেই অন্য চিত্র দেখা গেল। গেছো ইঁদুরটা আমের মুকুলগুলো ওর ধারালো দাঁত দিয়ে কেটে কেটে মাটিতে ফেলতে লাগলো। এই অ-লক্ষ্মীপানা দেখে লক্ষ্মী-পেঁচাটার গা উঠলো জ্বলে। সেই রাগেই যেন দিনের বেলায় লুকিয়ে থাকা জায়গা থেকে বেরিয়ে এসে ইঁদুরটাকে আঘাত করলো। লক্ষ্মী আর অলক্ষ্মীর লড়াই হলো। প্রকৃতির এই হাটে অলক্ষ্মীর বিনাশ হলো।
সন্ধ্যে এলো নেমে। আকাশে বাদুড় আর চামচিকের আনাগোনা। বাদুড়ের দল আকাশে উড়ে উড়ে দেখে গেলো ফল হতে কত বাকি। চামচিকেরা এখানে এত খাবার দেখে রাতের আকাশে উড়ে শিকার ধরে খেলো। জোনাকিরা নিজেদের মিটি মিটি আলো জ্বালিয়ে প্রকৃতির এই হাটে ঘুরতে ঘুরতে মহুয়া গাছের উপর এসে দেখলো ভ্রমরা-পতঙ্গের দল মহুয়া ফুলের মধু খেয়ে বেহুঁশ হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে ফুলের পাপড়ির উপর।
জোনাকিরা ওদের আলোয় আরো দেখতে পেলো গাছের তলায় পড়ে থাকা হরেক ফুলের পাপড়ি খেয়ে খরগোশ আর তাদের শাবকদের এই প্রকৃতির হাটে কী আনন্দ উৎসব! রাতের প্রকৃতির নি:স্তব্ধ ভাঙতে মাঝে মাঝে ঝিঁঝিঁ ডাক পাড়লো। মধ্যরাতে খটাশ আর খেঁকশিয়ালের আগমনে টের পেয়ে ডালে বসা ঘুমন্ত পাখিরা ভয়ে ডেকে উঠলো। রাতের পাখিদের সাথে পেঁচারা সুর মেলালো। প্রকৃতির এই হাট দিনে রাতে সমান সচল। রাতের নিশাচর পাখিদের ডাক ক্রমশ থিতিয়ে এলে দিনের পাখিদের কলরবে ভোর হলো।
শিশিরভেজা ফুল নিয়ে গাছেদের দিন শুরু। সকালের সূর্যের আলোয় বন-অঞ্চল চিক্ চিক্ করে উঠলো। পাখিরা ধরলো গান । প্রকৃতির এই হাটে কেনা-বেচা নেই। আছে শুধু প্রকৃতির এই সৃষ্টিকে ধরে রাখা। পাখিদের প্রেমিক-প্রেমিকা বাছাই নিয়ে কিচির-মিচির কিচির-মিচির! কেউ কেউ সহজে তার জীবনসঙ্গী পেয়ে বাসা বাঁধতে পছন্দমতো গাছকে বেছে নিলো। বাবুইরা তালগাছ, খেজুরগাছকে বেছে নিলো। বুলবুলিরা ফলসা গাছে বাসা বানাবার জন্য মনস্থির করলো। কেউ কেউ গাছের কোটরে বাসা বাঁধলো। এত খাদ্য--এর মধ্যে ঘর বেঁধে বাচ্চাকে বড়ো করে অন্যত্র উড়ে যেতে হবে। নচেৎ কালবৈশাখীর উন্মাদ তাণ্ডবে এদের জীবনের সবকিছু ওলট-পালট।
পাখিদের মধ্যে ব্যস্ততা বেড়ে গেল। কেউ কেউ প্রেমিকাকে সঙ্গী করে বাসা বানাবার কাজে মন দিলো। ফিঙে পাখিরা ঘাস লতা-পাতা দিয়ে গোলাকৃতি বাসা বানাতে লাগলো। বাসা বানাবার সময় শিকার করার সময় খুবই কম। তাই এরা সহজে শিকার ধরার নতুন পন্থা নিলো, বাসা বানাবার ফাঁকে গরু-মহিষের পিঠে কিছুক্ষণ বসে থাকে। গরু-মহিষের খুরের আঘাতে ঘাস-বনের থেকে ফড়িং, পোকামাকড় ছিটকে বেরিয়ে এলে এরা ছোঁ মেরে সহজে শিকার ধরে খায়। ফিরে গিয়ে আবার সত্ত্বর বাসা বানাবার কাজে মন দেয়।
ধনেশ পাখিটা উড়ে গিয়ে একটা কাঠঠোকরার বাসা দখল নিলো। অনেক অঙ্গভঙ্গির পর স্ত্রীপাখির সাথে মেলামেশায় তাকে বশীভূত করে কোটরে ডিম পাড়াতে বসালো। পুরুষ পাখিটা তখন কাদামাটি এনে গর্তের মুখ বন্ধ করে স্ত্রীপাখিটাকে বন্দী করলো। আর একটা ছোট ফুটো রাখলো, পুরুষ পাখিটা ওই ফুটো দিয়ে খাদ্য সরবরাহ করলো। ডিম থেকে বাচ্চার জন্ম হলে তারপর দেওয়াল ভেঙে স্ত্রীপাখিটিকে মুক্তি দিল। বসন্তের ওই প্রকৃতির হাটে পাখিদের প্রেমিক-প্রেমিকা বাছাই নিয়ে কতই না বৈচিত্র্য।
বাবুই পাখিদের বাসা বানাবার শিল্পকলাই সম্ভাব্য প্রেমিকাদের মুগ্ধ করে। যে পুরুষপাখিটার বাসা সবথেকে সুন্দর হবে তাকেই বেছে নেবেন প্রেমিকাটি। এরজন্য স্ত্রী-পাখিদের মধ্যে কতই না লড়াই হলো।
পুরুষ ময়ূর পাখিটি পেখম তুলে নেচে সঙ্গীনির হৃদয় জয় করে নিলো। পুরুষ নীলকন্ঠ পাখিটি আবার শূন্যে ডিগবাজি খেয়ে নানা কসরত করে স্ত্রী পাখির মন নিলো কেড়ে। এদের মধ্যে একটি পাখি--সে প্রেমিকার মন পাবার জন্য কতই না অঙ্গভঙ্গি করলো। কেউ তার ডাকে সাড়া দিল না। বাধ্য হয়ে সে একটা আমগাছ বেছে তার এডাল ওডাল ঘুরে শেষে একটা নরম পচা ভাঙা ডালে বাসা বানাবার সিদ্ধান্ত নিলো। ডালের অবস্থান এমন জায়গায় যেখানে কাল-বৈশাখীর পশ্চিমী ঝড় ঐ গাছের মোটা কাণ্ডের আড়ালে বাসাকে সম্পূর্ণ সুরক্ষিত রাখবে। মনে হলো পাখিটা বাস্তুতন্ত্র মেনে বাসা বানাবার স্থান নির্বাচন করলো। শক্ত ঠোঁট দিয়ে ঠুকরে ঠুকরে বাসা বানাতে শুরু করলো। পচা ডালের শুকনো ছাল ঠোঁট দিয়ে ঠুকরে ঠুকরে ফেলতে লাগলো। কারণ ঐ ছালের তলায় অনেক বিষাক্ত পোকার বাস, ঐ বিষাক্ত পোকা বাচ্চাদের ক্ষতি করতে পারে সেই কারণে প্রথম থেকেই সতর্কতা। ধীরে ধীরে বাসার একটা রূপ এলো।
পাখিদের ডাকে আবার ভোর হল। পাখিটা আমগাছের মগডাল থেকে নেমে এলো; মনে এতটুকু শান্তি নেই। খাওয়া-দাওয়া ছেড়ে নিখুঁতভাবে বাসা বানাতে হবে। এই সুন্দর বাসা দেখে নিশ্চিতভাবে প্রেমিকা মুগ্ধ হয়ে, প্রেমিক রূপে ওকে বরণ করবে। সারাটা দিন খেটেও বাসাটা তৈরি করতে পারলো না। নিশ্চিতভাবে জানতেও পারলো না বাসা তৈরির পরেও এই রঙিন বসন্তে প্রেমিকার দেখা পাবে কিনা? ডালে বসে ম্রিয়মাণ মন নিয়ে কত জোড়া জোড়া প্রেমিক ও প্রেমিকাদের দেখলো। আর ওদের মিষ্টি মধুর গান শুনলো।
প্রকৃতির এই রঙ্গমঞ্চে এতো রূপ, এতো সৌন্দর্য, এতো অফুরন্ত খাবার, এতো মিষ্টি মধু। আর প্রেমিকাদের মন পেতে কতই না সুচতুর কৌশল। পাখিটা ডালে বসে এও দেখলো, কোকিল পাখিটা প্রেমিক পেল। কিন্তু প্রকৃতি বাচ্চা ফোটানোর বা বাচ্চা বড় করার দায়িত্ব অপরের হাতে দিলো। আর পুরুষ পাখিটা কুহু কুহু সুমধুর গানে সুরে তার স্ত্রীর মন ভেজানোর চেষ্টা করলো। স্বামীর কন্ঠের গান শুনে স্ত্রীর মন কিছুটা ভিজলো। আর প্রকৃতির এই হাটে এসে আর সকলে ওর গান শুনে মুগ্ধ হল। কি কারণে পাখিটা এত সুন্দর গান গাইলো। তার বিচারে প্রকৃতির হাটে কেউ দেখলো না। আবার গাছের মগডাল থেকে বিরামহীনভাবে ডেকেই যেতে লাগলো। এবার কন্ঠস্বরের মধ্যে একটু অন্য সুর মেলালো। ডাক পড়লো বুক-বুক বাওইচ্, এই ডাকে একটা স্ত্রীপাখি এসে আমগাছের ডালে বসলো। পুরুষ পাখিটা স্ত্রী পাখিটাকে গোল করে প্রদক্ষিণ করতে লাগলো, আর বাওইচ্, বাওইচ্ করে ডাকতে লাগলো। হয়তো বলতে লাগলো, তোমার জন্য নীড় আছে নিরালায় সম্পূর্ণ সুরক্ষায়।
দুজনে বাসার কাছে এলো, পুরুষ পাখিটি কন্ঠ থেকে কতই না নতুন নতুন সুর তুলে গান শোনাতে থাকলো, কিন্তু দুর্ভাগ্য—তার কোন সুরই স্ত্রী পাখিটির মনকে নাড়া দিল না। শেষে স্ত্রী পাখিটা উড়ে চলে গেল।
ধীরে ধীরে সন্ধ্যা নেমে এলো। আজ পূর্ণিমা চাঁদের আলোয় বসন্তের প্রকৃতির এই হাট মোহময় হয়ে উঠলো।
মধ্যরাতটাকে ভোর ভেবে পাখিরা ডেকে উঠলো। পাখিটা সারারাত নিজের বাসায় কাটিয়ে, ভোর হওয়ার সাথে সাথে বাসা থেকে বেরিয়ে বাসাটাকে ঠুকরে ঠুকরে আরও সুন্দর ও আকর্ষণীয় করবার জন্য দিনভর চেষ্টা করতে লাগলো। বাসাটার এবার দুটো প্রবেশদ্বার হয়েছে।
তৃতীয় দিনের মাথায় বাসার কাজ সম্পূর্ণ করে, পাখিটা আমগাছের মগডালে উঠে আবার বুক-বুক আওয়াজ তুলে অবিরাম বসন্তের আকাশে বহুদূরে ভেসে যেতে লাগলো। শেষ বেলায় ওর আহ্বানে সাড়া দিয়ে প্রেমিকা রূপে একটি পাখি গাছের মগডালে বসলো।
মগডাল থেকে দুজনে নেমে এলো বাসার কাছে। প্রেমিক পাখিটা কতই না অঙ্গভঙ্গি করলো, আর গলা থেকে কত রকমেরই আওয়াজ তুলে প্রেম নিবেদন করলো। প্রেমিকা পাখিটা ডালে বসে নি:শব্দে বাসার দিকে তাকিয়ে থেকে কি ভাবলো, তারপর ওর সাথে ঘর বাঁধার স্বপ্ন ত্যাগ করে উড়ে গেল। প্রেমিক পাখিটা বাসায় প্রবেশ করে ঠোঁট বাসার বাইরে বের করে চুপ করে বসে রইলো। হয়তো ভাবলো প্রকৃতির এই বসন্তের হাটে ওর ঘর বাঁধার স্বপ্ন চুর-চুর করে ভেঙে দিয়ে গেল ওই প্রেমিকা পাখিটা। প্রেমে আঘাত খেয়ে নিজের প্রতি বিতৃষ্ণায় কোথা থেকে কাদা মাটি এনে বাসার মুখ দুটি বন্ধ করে বসন্তের আকাশে পাখিটা নিরুদ্দেশ হয়ে গেল। ধীরে ধীরে সন্ধ্যা নেমে এলো।