ভূত পেত্নীগণের লম্বা হাত লইয়া বাল্যকাল হইতেই আমার কৌতূহল এবং সংশয়ের অবধি নাই। অতি শৈশবে আমার পিতামহী একটি পুস্তক হইতে গল্প পাঠ করিয়া আমার মনোরঞ্জন করিতেন। পুস্তকের নাম খুব সম্ভবত 'ভূত পেত্নী রাক্ষস খোক্কস'। তাহাতে একটি গল্প এরূপ ছিল: একদা এক গ্রামে এক গৃহবধূর স্কন্ধে পেত্নী ভর করে। তাহার শ্বশ্রুমাতা তাহার নিকট একটি লেবু চাহিলে সে লম্বা হস্তটি বাড়াইয়া প্রাঙ্গণস্থিত গাছ হইতে লেবু আহরণ করিয়া আনে। অতঃপর ওঝা ডাকাইয়া ঝাড়ফুঁক করিয়া সেই পেত্নীকে বধূটির স্কন্ধচ্যুত করা হয়। গল্পটির সহিত বধূর লম্বা বাহুর একটি চিত্তাকর্ষক চিত্রও ছিল। গরাদের ফাঁক দিয়া সে লেবু পাড়িয়া আনিতেছে। আমি কিছুতেই বুঝিতে পারি নাই যৎকালে কার্যের সুবিধা বই অসুবিধা ঘটিতেছে না তৎকালে প্রেতিনীকে দূর করিবার কিবা প্রয়োজন ঘটিল।
বয়স দুই বৎসর বাড়িল। বালিকা আমি কোনো একটি হিন্দি চলচ্চিত্রের একটি সংলাপ শুনিলাম--"কানুনকে হাত লম্বে হোতে হ্যায়"। পূর্বজ্ঞানে জানিতাম ভূত-পেত্নীগণের বাহু দীর্ঘ হইয়া থাকে। চলচ্চিত্রে লেডি জাস্টিসের গান্ধারী-প্রতিভ মূর্তিটিকে আমার পেত্নী বোধ হইতে লাগিল। আমি কল্পনায় দেখিতে লাগিলাম হাতের তূলাদণ্ডটি ফেলিয়া লেডি ভূতনী লম্বা হাত বাড়াইয়া অপরাধীদের প্রয়োজনবোধে এমনকী বলপ্রয়োগ করিয়া ধরিয়া আনিতেছেন। থানা পুলিশ অপ্রয়োজনীয় বোধে বিলুপ্ত হইয়াছে। দুষ্টামির শাস্তিস্বরূপ শিশুদের পুলিশের ভয় দেখাইবার প্রথাও লুপ্ত। আইনের দীর্ঘ হস্ত যে পরিস্থিতি এবং রাজনৈতিক রঙ ভেদে সংকুচিত হইতে হইতে জগন্নাথের ন্যায় হইয়া যাইতে পারে সে জ্ঞান তখন ভবিষ্যতের গর্ভে।
আরো দুইটি বৎসর কাটিল। গৃহে কোনো এক সিদ্ধ পুরুষের আগমন উপলক্ষ্যে প্রবচনের আসর বসিয়াছে। পরিবারস্থ সকলে, আমন্ত্রিত, রবাহূত এবং অনাহুত জনেরা তাঁহাকে ঘিরিয়া বসিয়া জ্ঞানবাণী শ্রবণ করিতেছেন। বালিকা আমি কক্ষের একধারে বসিয়া ঠাকুরের আসনের সম্মুখে রক্ষিত প্রসাদের থালাখানি অত্যন্ত মনোযোগ সহকারে পর্যবেক্ষণ করিতেছি এবং বিচার করিতেছি কি প্রকারে উপরে সাজানো গাঢ় পদ্মরঙা চিনির মঠটি (যেটি দেখিলেও আজিকাল গলা কিটকিট করে) হস্তগত করা সম্ভব। এমন সময় শ্রবণ করিলাম পণ্ডিত পুরুষোত্তম বা অবতারের লক্ষণ হিসাবে দীর্ঘ আজানুলম্বিত বাহুর কথা বলিতেছেন। আমার অন্তরে বড়ই সংশয়ের উদ্রেক হইল। আমি দার্শনিকের মতো গম্ভীর মুখে জিজ্ঞাসা করিলাম হস্ত কতটা দীর্ঘ হইলে তাহার অধিকারীকে অবতার গণ্য করা যাইবে এবং সঠিক কখন হইতে তাহাকে ভূত বলিয়া বিবেচনা করাই বিধেয়। পণ্ডিত আমা হেন অর্বাচীনের সহজ প্রশ্নের মীমাংসাটুকু পর্যন্ত করিতে পারিলেন না। উপরন্তু সমবেত ভক্তদের মধ্য হইতে কাহার যেন আজানুলম্বিত বাহু আসিয়া আমার কর্ণটি পাক দিয়া রক্তবর্ণ করিয়া দিল। তিনি পুরুষোত্তম অথবা অবতার কোনোটাই ছিলেন বলিয়া কিন্তু আমার বোধ হয় নাই। পণ্ডিতকে করা সহজ প্রশ্নটির সদুত্তর আমি অদ্যাবধি পাই নাই। তবে আমার দৃঢ় বিশ্বাস অঙ্কের শিক্ষকদের বাহু অপরাপর সাধারণ মানুষ অপেক্ষা দীর্ঘতরই হইয়া থাকে। অনেক দূর হইতে তাঁহারা কাটাকুটি খেলায় মগ্ন বালক-বালিকাদের কর্ণাকর্ষণ করিতে পারেন। এখন তাঁহাদের মহাপুরুষ বলা হইবে না অন্য কিছু বলা হইবে সে সিদ্ধান্ত বড়ই জটিল।
পরিশেষে বলি শিশুকালে শ্রুত গল্পে ভূত পেত্নীর দীর্ঘ হস্ত আমার প্রযুক্তিগত ভাবে অনেক বেশি কার্যকরী বোধ হয়। এরূপ সুবিধা থাকিলে এক্ষণে আমাকে চা আনিতে পাকশালায় যাইতে হইতো না। ঈশ্বর মানুষ অপেক্ষা প্রেতযোনীকে অধিক যত্নে সৃজন করিয়াছেন।