—এরপর আবার একটি ছিন্নশির স্পর্শ করলেন তিনি
— পূর্বের মতোই অক্লান্তভাবে
—তারপর যেন নিঃশব্দেই প্রশ্ন করলেন সেই কর্তিত নরমুণ্ডটিকে
—সেই রক্তাক্ত বিদীর্ণমুখটি হয়তো উত্তর দিলো নীরবেই
— সবকথা সংহিত হলো পৃথিবীর অঘোর অন্ধকারে
মহাযুদ্ধের আগের দিন। কৃষ্ণবাসুদেব বেরিয়েছেন এক প্রখর সন্ধানী দৃষ্টি নিয়ে। যুদ্ধকালে তাঁর প্রকল্পিত কর্মকাণ্ডে যেন সামান্যতম সংশয়ের বীজ না স্থান পায় সেই উদ্দেশ্যে।
সদ্য সকালের আকাশভরা আলোর সম্ভারে আসন্ন রক্তাক্ততার বিন্দুমাত্র আভাস নেই। এমন প্রোজ্জ্বল সকালে এক নির্জন বনপথে কোনো এক নব্যযুবার সঙ্গে দেখা হলো বাসুদেবের। যুবকটি দ্রুতপদে অতিক্রম করছিলো সেই গভীর অরণ্যের ঘন ছায়াপথ।
বাসুদেব তাঁর সামনে এসে প্রশ্ন করলেন— "দিনের শুরুতেই এত ব্যস্ততা কিসের যুবক?" নবীন যুবকটি উত্তর দিলো — "ব্যস্ত হবো না? আমাকে যে পৌঁছতে হবে দ্বিপ্রহরের আগেই ওই যুদ্ধক্ষেত্রে।"
"কোন যুদ্ধক্ষেত্রে?"— জিজ্ঞাসা করলেন বাসুদেব।
"কুরুক্ষেত্রে — যেখানে এক মহাযুদ্ধের প্রস্তুতি চলছে — আপনি জানেন না?"
"শুনেছি বটে কথাটা — কিন্তু সেখানে তোমার কি প্রয়োজন?"— সকৌতূকে কথাগুলি বললেন বাসুদেব।
"আমায় যে সেই যুদ্ধে অস্ত্রধারণ করতে হবে" — সাগ্রহে উত্তর দিলো নব্যযুবাটি।
"তাই নাকি? তা কোন পক্ষে?"— যথাকৌতুকেই প্রশ্ন করলেন বাসুদেব।
"আমার মা বলেছেন — যে পক্ষ দুর্বল সে পক্ষেই যুদ্ধ করতে। শুনেছি পাণ্ডব আর কৌরবপক্ষের যুদ্ধ হচ্ছে। তা কারা দুর্বল পক্ষ তা তো জানি না। আপনার কোনো ধারণা আছে এ বিষয়ে?" — যুবকটির এই সরলতায় বাসুদেব বিস্মিত হলেন। তারপর ছদ্মগাম্ভীর্যে উত্তর দিলেন — "এ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া খুব শক্ত। কারণ সবই স্থান-কাল-পাত্রের অধীন। তবুও এই মুহূর্তের বিচারে বলে যায় যে পাণ্ডবরাই দুর্বল। কারণ কৌরবদের সৈন্য সংখ্যা বেশি — তাছাড়া অসামান্য যোদ্ধারা সব কৌরবপক্ষীয়"।
"তাহলে তো আমায় পাণ্ডবপক্ষেই যোগদান করতে হয়। বিলম্ব করে লাভ নেই। আমি তাহলে আসি। প্রণাম নেবেন" — বলেই আবার দ্রুতপদে যাত্রা শুরু করার উপক্রম করলো সে।
যুবকটির এহেন সারল্যে বাসুদেব এবার হেসে বলে উঠলেন — "ও হে যুদ্ধে যাচ্ছো তো তোমার অস্ত্র কোথায় কিছুই তো দেখছি না?"
যুবাটি গম্ভীর ভাবে উত্তর দিলো — "এই যে — এই আমার তিনটি বাণ আর একটি তূণীর।"
বাসুদেব অতি বিস্মিত হয়ে বললেন— "তুমি এই তিনখানি মাত্র তীর নিয়ে অতবড়ো যুদ্ধে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করছো?"
"এই যুদ্ধের জন্য আমার এই তিনটি তীরই যথেষ্ট।" — আরো গম্ভীরভাবে উত্তর দিলো যুবকটি।
"কি ভাবে?" সাগ্রহে প্রশ্ন করলেন বাসুদেব।
যুবকটি অত্যন্ত নির্লিপ্ত ভাবে উত্তর দিলো — "প্রথম তীরটি দিয়ে আমার বধ্যদের চিহ্নিত করবো — দ্বিতীয় তীরটি দিয়ে সেই চিহ্নিতদের বধ করবো — আর শেষ তীরটি নভোমণ্ডলে নিক্ষেপ করবো যাতে এরপর তিনটি তীরই আমার এই তূণীরে ফিরে আসে"
যুবকটির এই উত্তরে বাসুদেব হতবাক হলেন। তারপর এক প্রগাঢ় কন্ঠে বললেন — "তোমার এই আশ্চর্য ক্ষমতার নিদর্শন দেখাতে পারবে যুবক?"
যুবাটি তখনই উত্তর দিলো — "অবশ্যই এবং এই মুহূর্তেই — যদি অনুমতি দেন।"
বাসুদেব সামনের অশ্বথ গাছটির দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে বললেন — "এই বৃক্ষটিকে এখুনি নিষ্পত্র করো দেখি।"
যুবাটি যেন গভীর ধ্যানস্থ হয়ে চোখ বন্ধ করে শরসংযোজনা করলো। এই শরটি নিক্ষেপের পর দ্বিতীয় শরটিও একই নিমগ্নতায় জ্যা-মুক্ত করলো। আর এর পরেই ঘটলো একটি আশ্চর্য ঘটনা। অশ্বত্থবৃক্ষটি নিমেষেই সম্পূর্ন পত্রহীন হলো — আর তারপরেই নিক্ষিপ্ত শরটি বাসুদেবের বাম পায়ের পাশে বৃত্তাকারে প্রবলভাবে ঘুর্ণিত হতে লাগলো। যুবাটি তা দেখে উচ্চৈঃ স্বরে বলে উঠলো — "আপনার বাম পা টি এখুনি ভূমি থেকে ঊর্ধে তুলুন — কারণ ওই পায়ের তলায় আপনার অগোচরে অবশ্যই রয়ে গেছে এক বা একাধিক অশ্বত্থ পত্র।।নয়তো, আপনার ওই পদ বিদ্ধ করে আমার এই শরটি অবশিষ্ট পত্রটিকে নিশ্চিহ্ন করবে।"
বাসুদেব যুবকটির এই কথায় স্তম্ভিত হলেন। কারণ কোনো আকস্মিকতায় নয়, সজ্ঞানে ও সুকৌশলে বাসুদেব ওই অশ্বত্থ বৃক্ষের একটি পত্রকে লুকিয়ে রেখেছিলেন তাঁর বাঁ পায়ের নীচে — যুবকটির ক্ষমতা যাচাই করার জন্য। বাসুদেব এবার উপলব্ধি করলেন যে এই নবীন যুবকটি এক অসামান্য অলৌকিক ক্ষমতা সম্পন্ন যোদ্ধা। মায়াযুদ্ধের যাবতীয় কৌশল তার নখদর্পণে। অতএব যে পক্ষেই এ যোগদান করুক, বিপক্ষকে নিমেষে ধূলিসাৎ করাটা তার কাছে অতি সহজ ব্যাপার।
বাসুদেব তার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে সস্নেহে জিজ্ঞাসা করলেন — "পুত্র! তোমার পরিচয় দিলে না এখনো!" যুবাটি সঙ্গে সঙ্গে মাথা নত করে বললো — "আমি ঘটোৎকচের পুত্র। আমার মায়ের নাম অহলাবতী। আর আমার নাম বর্বরীক। মায়া-যুদ্ধের কিছু প্রকরণ শিক্ষা করেছি। এখন মায়ের কথায় চলেছি কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে। দুর্বল পক্ষের সহায়তা করতে। তারপর আরো বিনীতভাবে সে বললো — "কিন্তু আপনি কে? আপনাকে দেখে এক বিরাটপুরুষ অথচ বড়ো নিকটজন বলে মনে হয়। আমার কথায় কোনো অসংগতি থাকলে ক্ষমা করবেন"। বাসুদেব তৎক্ষণাৎ তাঁর গভীর দূরদৃষ্টিতে এই যুবকের কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে উপস্থিতির পরিণাম কি হতে পারে ভেবে স্তম্ভিত হলেন। কিন্তু তা মুহুর্তমাত্র। তারপর অতি মন্দ্র কন্ঠে তিনি বললেন — "বৎস! আমি কৃষ্ণ বাসুদেব। তুমি আমায় চিনবে না। কিন্তু আমি তোমায় চিনেছি প্রথম দর্শনেই। তোমার জন্মকথা জানো?"
এই কথায় যুবকটি সঙ্গে সঙ্গে নতমস্তকে বলে উঠলো — “প্রণাম প্রভু! আমি শুনেছি আমার মায়ের মুখে। আপনিই আমার মৃতজন্মা দেহে প্রাণ সঞ্চার করে ছিলেন। হে কৃষ্ণ হে প্রভু আমার এতক্ষণের আচরণ ক্ষমা করুন।”
এরপর বাসুদেব তাঁর অতুল মাধুর্যে বর্বরীকের অন্তর মোহিত করে বললেন — "হে নবীন যুবক! তুমি আমার দেখা শ্রেষ্ঠ ক্ষত্রিয়বীর। তোমার অন্বেষণেই আমি এই প্রত্যূষে পথে বেরিয়েছি। কারণ এই মহাযুদ্ধে তুমি অপরিহার্য। তাই তোমার সঙ্গে আমার এই সাক্ষাৎ অবধারিত ছিলো।"
বর্বরীক বাসুদেবকে আবার প্রণাম জানিয়ে বললেন — "আমিও এই যুদ্ধের জন্য উদগ্রীব হয়ে আছি প্রভু। মায়ের কথা মতো যে পক্ষ দুর্বল আমি সে পক্ষেই যোগদান করবো।"
বাসুদেব স্মিত হেসে বললেন — "তোমায় বললাম যে — এই মুহূর্তের হিসেবে পাণ্ডবরাই দুর্বল। কারণ তাদের সৈন্যসংখ্যা কৌরবদের তুলনায় কম। তাছাড়া বরিষ্ঠ মহারথীরা অধিকাংশই কৌরবপক্ষে।" তারপর একটু থেমে বললেন — "তা হলে তোমায় পাণ্ডবপক্ষেই যোগদান করতে হয়। কিন্তু তোমার অসামান্য ক্ষমতায় তো মুহূর্তেই কৌরবরা হীনবল হয়ে যাবে। তখন তো তোমার মায়ের কথা অনুযায়ী তোমায় কৌরবপক্ষে যোগ দিতে হয়। এইবার তাদের হয়ে তুমি তীর ধারণ করে পাণ্ডবদের শক্তিনাশ করবে.. এইভাবে শেষটায় কি হবে ভাবতে পারছো?"
এই কথার উত্তরে বর্বরীক হতবুদ্ধি হয়ে বাসুদেবের দিকে তাকিয়ে রইলো। বাসুদেব বললেন — "পুত্র! এবার ভেবে দ্যাখো তো তোমার এই যুদ্ধের পরিণাম কি। তোমার এই মায়াযুদ্ধের কৌশলে আর তোমার মায়ের কথার মর্যাদা রাখতে গিয়ে একমাত্র তুমিই তো বেঁচে থাকবে যুদ্ধের শেষে। এই কি এক বীর ক্ষত্রিয়ের যুদ্ধের কাঙ্খিত উদ্দেশ্য?"
বর্বরীক বাসুদেবের কথায় বিহ্বল হয়ে উত্তর দিলো — "আপনি আমার কর্তব্য বলে দিন প্রভু।"
বাসুদেব তৎক্ষণাৎ প্রায় আদেশের কন্ঠে বলে উঠলেন — "তাহলে মন স্থির করে বলো বর্বরীক আমি যা আজ্ঞা করবো তা তুমি নির্দ্বিধায় পালন করবে"
বর্বরীক মাথা নীচু করে বললো — অবশ্যই
বাসুদেব অতি শীতলকন্ঠে বললেন — "স্বহস্তে নিজের শিরচ্ছেদ করে সেই কর্তিত মুণ্ডটি আমার হাতে দাও — এখনি।"
বর্বরীক বাসুদেবের এই কথায় স্তম্ভিত হলো।
বাসুদেব স্মিত হেসে বললেন — "ভয় পেয়ো না বৎস।এই কর্মের জন্য যে বিপুল অন্তরশক্তি প্রয়োজন তা আমি তোমায় এখনি প্রদান করছি।"
বর্বরীক ম্লান হেসে বললো — "কিন্তু কেন এই কাজ করতে বলছেন প্রভু?"
বাসুদেব একই ভাবে স্মিত হাস্যে উত্তর দিলেন — "তুমিই আমার দেখা শ্রেষ্ঠ বীর — কৌরব আর পাণ্ডবপক্ষের সকল মহারথ অতিরথদের একত্র করলেও তারা তোমার ক্ষমতার তুল্য নয় — সর্বশ্রেষ্ঠ যোদ্ধার বলিদান দিয়েই এই মহাযুদ্ধের সূচনা হওয়া বিধান রয়েছে — আর তোমার চেয়ে যোগ্যতর কেউ নেই জগতে এ বিষয়ে আমি এখন নিশ্চিত।"
বর্বরীক নতশিরে উত্তর দিলো — "ক্ষমা করবেন প্রভু! আমার এই আচরণের। আমার প্রাণ আপনারই দেওয়া। তাই তা যে কোনো মুহূর্তে নিয়ে নেওয়ার অধিকার আপনারই আছে। আমি দ্বিধাগ্রস্ত নই। কিন্তু অন্য একটা বাসনা ছিলো মনে--"
— "কি বাসনা তোমার আমায় নিঃসংকোচে বলো"
— "কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে কত রথী মহারথীদের রণকৌশল দেখতে পাবো — বড়ো ইচ্ছে ছিলো আমার" — সসঙ্কোচে বললো বর্বরীক।
— "তুমি এখনো বালকমাত্র" — হেসে উত্তর দিলেন বাসুদেব — "তারা তোমার পারদর্শিতার কাছে তুচ্ছ।"
তারপর অতি মন্দ্র কন্ঠে বাসুদেব বললেন — "শোনো বর্বরীক। তোমার অভীপ্সা অবশ্যই পূর্ণ হবে। কারণ তোমার শির তোমার দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হবে মাত্র — কিন্তু তোমার চেতনা লুপ্ত হবে না কখনো — আমি নিজহস্তে তোমার কর্তিত শির সর্বোচ্চ শৃঙ্গে স্থাপন করবো — যেখান থেকে তুমি দেখতে পাবে যুদ্ধের যাবতীয় ঘটনাবলী — ঘোরতম যোদ্ধা হয়েও মানুষের রক্তপাতে তুমি চরম নিষ্ক্রিয় কিন্তু প্রকৃত দ্রষ্টা হয়ে থাকবে চিরকাল"
বর্বরীক এই কথার কি অনুধাবন করলো জানা নেই, কিন্তু সে সোৎসাহে বলে উঠলো — "যথেষ্ট প্রভু! এটাই যথেষ্ট আমার জন্য! আমি এখুনি আপনার আদেশ পালন করছি।"
এইভাবে যথাকার্য সম্পন্ন হওয়ার পর বাসুদেব বর্বরীকের ছিন্ন মস্তকটি নিজহস্তে এক সুউচ্চ পর্বতের চূড়ায় স্থাপন করে কুরুক্ষেত্রের দিকে রওনা দিলেন। একসময়ের শ্রেষ্ঠ মায়াযোদ্ধা বর্বরীক তার শিরমাত্র অস্তিত্ব নিয়ে স্থানুর মতো নিশ্চল হয়ে দেখতে থাকলো ভারতের বৃহত্তম যুদ্ধ কিম্বা কদর্যতম নৃশংসতা।
আঠারো দিনের সমস্ত রক্তপাত যখন শুষ্ক হয়ে গেছে — পাণ্ডবদের অন্তরে তৃপ্তিসুখের বাতাস বইছে — এমত সময়ে তাদের মধ্যেই একটি প্রশ্ন উঠলো — 'এই যুদ্ধজয়ে শ্রেষ্ঠ অবদান কার?' অর্জুন ও ভীম প্রত্যেকেই নিজেদের অগ্রগণ্য মনে করলেন। অন্যান্য পাণ্ডবরাও এ কথায় দ্বিধা বিভক্ত। এমনকি যুধিষ্ঠিরও যথেষ্ট বিব্রত, তাই সবাই বাসুদেবের কাছেই বিষয়টি নিবেদন করলেন। বাসুদেব মৃদু হেসে বললেন — "এসো তোমরা আমার সঙ্গে।"
এরপর তিনি পঞ্চপাণ্ডব কে নিয়ে উপস্থিত হলেন সেই পর্বতের সানুদেশে যার চূড়ায় স্থাপিত রয়েছে বর্বরীকের কর্তিত শিরটি। সেই ছিন্নমুণ্ডের দিকে এগিয়ে এসে বাসুদেব পাণ্ডবদের বললেন — "এনাকে প্রণাম করো — জেনে রাখো ইনি এক অতুলনীয় বীর — মহত্তম ক্ষত্রিয় — আর গোটা যুদ্ধের সমস্ত ঘটনা ইনি যেভাবে দেখেছেন তা কারো পক্ষে সম্ভব ছিলো না।" পঞ্চপাণ্ডব বিস্ময়ে হতবাক হয়ে বর্বরীকের ছিন্ন মস্তকের দিকে তাকালো। আর তখনই শুনলো এক নবীন যুবার কন্ঠ — "প্রণাম বাসুদেব! প্রণাম পাণ্ডুপুত্রেরা!" বাসুদেব বললেন — "বর্বরীক! তোমার যুদ্ধ দেখা হলো?"
— "অবশ্যই প্রভু"
— ”তাহলে এদের একটি প্রশ্নের উত্তর দাও।"
— "বলুন প্রভু।"
— এদের প্রশ্ন — “পাণ্ডবদের এই জয়ে অন্যতম পুরুষটি কে?"
এ কথার উত্তরে বর্বরীক নিরুত্তর রইল। পাণ্ডবেরা সমস্বরে বললো — 'কি হলো? উত্তর দিন'। বর্বরীক নীরবে স্থির দৃষ্টিতে তাকালো বাসুদেবের দিকে। তারপর যেন বদলে গেলো তার দৃষ্টিপাত। বাসুদেব তখনো বর্বরীককে নিরুত্তর থাকতে দেখে বললেন — "কি হলো বর্বরীক? উত্তর দাও"। আর তখনই বর্বরীক উচ্ছ্বসিত হাস্যে বলে উঠলো — "শ্রী কৃষ্ণ বাসুদেব! শ্রী কৃষ্ণ বাসুদেব! শ্রী কৃষ্ণ বাসুদেব! পাণ্ডব দের জয়ের একমাত্র কারণ!" বলতে বলতে সে যেন অট্টহাস্যে বিস্ফোরিত হয়ে উঠলো। পাণ্ডবেরা প্রথমে হতবাক ও তারপর নতশির হলো। কৃষ্ণও যেন মুহূর্তের জন্য নতমুখে কিছু ভেবে নিলেন। তারপর পাণ্ডবদের উদ্দেশ্যে বলে উঠলেন — "এখন তোমরা এখান থেকে যেতে পারো"। এইবার এক আশ্চর্য নীরবতায় বাসুদেব ও বর্বরীক পরস্পর নয়নপথে মিলিত হলেন। বর্বরীকের মুখ তখনো হাস্যময়। বাসুদেব সেই সহাস্য মুখকে উদ্দেশ্য করে নির্বিকল্প কন্ঠে বলে উঠলেন — "এখন তোমার কার্য শেষ বর্বরীক। এবার তুমি নিমগ্ন হও একান্তে।" বর্বরীক বিস্ময়ে হতবাক হলো।কোনোক্রমে সে জিজ্ঞাসা করতে পারলো — "কোথায় প্রভু?" ক্ষণিকের বিপুল নীরবতার পরেই কৃষ্ণবাসুদেবের মন্দ্রকন্ঠে উচ্চারিত হলো — "সম্মুখের বিস্তীর্ণ জলের অন্তরে"। এই কথায় যেন মুহূর্তেই বেদনায় নীল হয়ে গেলো বর্বরীকের হাস্যোজ্বল মুখ। তার মনে হলো — এই কৃষ্ণবাসুদেবই তো তাকে বলেছিলেন — 'তুমি দেহহীন হয়েও আমার আশীর্বাদে সদাজাগ্রত থাকবে', অথচ তিনিই এখন তাকে তার এই অবশিষ্ট অস্তিত্বটিকে বিসর্জন দিয়ে একেবারে লুপ্ত হতে বলছেন! এক গভীর বেদনায় উচ্চারিত হলো তার শেষ কথাগুলি — "প্রভু! আপনার লীলাতেই আমি চিরকালের জন্য স্থানুমাত্র। তাহলে ওই জলরাশিই এসে গ্রাস করুক আমাকে। আর আমি অপেক্ষা করি সেই যথাসময়ের জন্য।" বর্বরীকের কথায় বাসুদেব অতি শান্তস্বরে যেন আত্মকথনের মতো বললেন — "যথার্থ বলেছো তুমি — সময়ের অপেক্ষা — কিন্তু লুপ্ত তুমি তো হবে না — কারণ তুমি যে আমার অভেদসত্তা — তাই চেতনার পথেই থাকতে হবে তোমায় — চিরকাল। "এই কথা বলে নম্রশিরে যেন নগন্য মানুষের মতো সেই স্থান ত্যাগ করলেন তিনি। আর ওই পর্বতের শীর্ষে প্রগাঢ় নীলোপলের মতো স্থির হয়ে রইলো বর্বরীকের ক্লিন্নমুখ — অনাগত জলরাশির প্রত্যাশায়।
এরপর যথাসময় উত্তীর্ণ হয়ে গেলে এক জলোচ্ছ্বাস এলো। আকস্মিক। এবং ভয়ংকর। এই মহাপ্লাবন যেন অতি সহজেই নিমগ্ন করে দিলো সমস্ত দ্বারকানগরী। যার ইতিবৃত্ত সংক্ষিপ্ত হয়েও সীমাহীন।
এর আগেই সেখানকার সমস্ত অধিবাসী — অন্ধক, ভোজ, বৃষ্ণি প্রভৃতি সমস্ত যাদবেরা — কৃতবর্মা সাত্যকি প্রমুখ মহারথী থেকে অজ্ঞাতকুলশীল নগন্য মানুষেরা আত্মজনের রক্তস্রোতে উন্মাদ হয়ে নিমেষেই যেন খেলাচ্ছলেই নির্মূল করছিলো এই বিপুল প্রজন্ম। চরম মাৎসর্য আর অজাচারে মগ্ন হয়ে ওই মানুষজন যেন কোনো অশনিসংকেতে নিশ্চিত করছিলো এই সমূহসংকট। আর যাদবশ্রেষ্ঠ কৃষ্ণ সবকিছু জেনে বুঝেও সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয় হয়ে অবারিত করছিলেন এই মহাপতনের স্রোত।
আর এর পরেই কৃষ্ণনরোত্তম এক অতিতুচ্ছ ব্যাধের তীরের আঘাতে পরিত্যাগ করলেন এই ইহলোক। হয়তো বহুকাল আগের সেই বর্বরীকের আশ্চর্য শরের আঘাতকে মহত্তম মর্যাদা দিতেই তিনি আহ্বান করলেন এই মলিনমরণ। কিন্তু ইত্যাকার যাবতীয় কথামালা সহজেই ভেসে গেলো — জলের উচ্ছ্বাসে — নির্দিষ্ট বিলোপে।
আর বর্বরীক — ঠিক তখনই এই প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের অভিঘাতে তার স্থাপিত মস্তকটি পর্বতের শীর্যচ্যুত হয়ে গড়িয়ে পড়লো সেই জলোচ্ছ্বাসের উপর। এইভাবে বর্বরীকের অন্তিম অনুজ্ঞা ও কৃষ্ণবাসুদেবের বিধেয়বাক্য মিলিত হলো এক সত্যবিন্দুতে। যথাকালে।
এরপর একসময়ে সমস্ত প্রলয় স্তিমিত হয়ে গেলে.... পড়ে থাকে কিছু কীর্তিত অস্তিত্ব...... নির্বিকল্পভাবে....ভবিষ্যতের আলো আর আঁধারের অপেক্ষায়। এইভাবেই বর্বরীকের কর্তিত শিরটিও এক যথাযথ আভাসের অপেক্ষায় ছিলো — অতিবিস্তৃত সময় ধরে।
অমাবস্যার মধ্যরাত্রি। অসংখ্য বৃক্ষে ঘেরা এক প্রকাণ্ড উপত্যকা। প্রতিটি বৃক্ষই যেন সেই বিপুল অন্ধকারে একাত্ম হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নৈঃশব্দ্য আর অন্ধকার যেন পরস্পরকে নিবিড় ভাবে ধরে স্থির হয়ে আছে সেই সমূহ উপত্যকায়। এই বিপুল অন্ধকারে এখানকার প্রকৃতিকে যতটা শান্ত বলে মনে হয় এই ভূমাপ্রকৃতির চরিত্র কখনোই সেরকম নয়। তাই ওই অন্ধকারে হঠাৎ থির থির করে কেঁপে উঠলো সেখানকার প্রতিটি বৃক্ষের সমস্ত পত্রশীর্ষ। এবং সেই কম্পন সঞ্চারিত হয়ে গেলো তাদের শাখাপ্রশাখার ভিতর দিয়ে শিকড়ের শেষপ্রান্তে। অর্থাৎ ভুমিকম্প হলো। এমন ভূকম্প এইসব পর্বতের সানুদেশে বিরল নয়।
এই ভূকম্প হওয়ামাত্রই ওই উপত্যকারই কোনো এক জীর্ণ মন্দিরের রক্তাক্ত আঙিনার এক কোণ থেকে গড়িয়ে এলো একটি ছিন্নশির। গড়াতে গড়াতে এসে সেটি স্থির হলো ওই উপত্যকারই লতাগুল্ম আচ্ছন্ন এককোণে পড়ে থাকা এক পিণ্ডসদৃশ বস্তুর গায়ে লেগে। আর কি আশ্চর্য! গড়িয়ে আসা রক্তাক্ত নরমুণ্ডটির স্পর্শে যেন তখুনি সপ্রাণ ও সচেতন হয়ে উঠলো সেই পিণ্ডাকৃতি বস্তুটি! যা পড়ে ছিলো জড়ের মতো — দীর্ঘদিন ধরে — কালের যথাযথ প্রলেপে। গড়িয়ে আসা ছিন্নমুণ্ডটির স্পর্শ পেতেই যেন অলৌকিকভাবে দীপ্ত হয়ে উঠলো তার লুপ্ত সংজ্ঞা! এবং দেখা গেলো সেটিও একটি কর্তিত মুণ্ড! আর সেই মুখটি অবশ্যই বর্বরীকের!
এক অমেয় অতীত পার হয়ে এইভাবে সচেতন হতেই বর্বরীক তার নিজস্ব মায়াবী আলোয় দেখতে পেলো তার সামনের ছিন্নমুখটিকে। আর তখনই তীব্র বেদনায় বিদ্ধ হলো সে। তার মনে হলো — 'এ মুখ তো কোনো যোদ্ধার নয় — এমনকি কোনো যুবার মুখও নয় — বরং এক ফুলের মতো সুন্দর নিষ্পাপ শিশুর মুখ! একে এইভাবে হত্যা করতে পারলো কে? বর্বরীক একদৃষ্টে সেই মুখের দিকে তাকিয়ে যেন নিঃশব্দে বলে উঠলো — 'এত নৃশংসতা কেন?' সেই পুষ্পসম মুখটি তার মুদ্রিতনয়নে ও অপার নীরবতায় কি উত্তর দিলো কে জানে। আর এরপরেই কি আশ্চর্য মায়াপথে বর্বরীকের ছিন্নশিরটি চলে গেলো তার যথাস্থানে! অর্থাৎ সেই পর্বতশীর্ষে।
বুদ্ধপূর্ণিমার সন্ধ্যা । জ্যোৎস্না যেন চুর্ণ হয়ে ঝরে পড়ছে প্রতিটি মরুবালুকণায়। এবং সেই মানুষটির মুখে। যার জর্জরিত অন্তিম মুহূর্তটি স্থির হয়ে রয়েছে তার দৃষ্টিহীন বিস্ফারিত চোখ দুটিতে। অর্থাৎ এটিও একটি ছিন্নমুণ্ড। কারো দ্বারা কর্তিত হয়ে পড়ে আছে এই বিশাল মরুপ্রান্তরে।
বর্বরীক, শিরমাত্র অস্তিত্বের বর্বরীক নেমে এলো ওই পর্বতশীর্ষ থেকে। নির্ভুলভাবে এসে স্থির হলো ওই কর্তিত মুণ্ডটির সামনে। এবং বর্বরীক বিস্মিত হয়ে দেখলো যে এবারেও এই ছিন্নশিরটি কোনো যোদ্ধার নয় — এবারে এটি একটি শীর্ণ বৃদ্ধের মুখ!
"এই অসহায় দুর্বল মানুষটিও কারো কাছে বধ্য!" — নিজের মনেই বলে উঠলো বর্বরীক। তারপর যেন অতি সন্তর্পণে নিরুচ্চারে জিজ্ঞাসা করলো তাকে — "কি হয়েছিলো বলোতো?" শীর্ণ বৃদ্ধটি শূণ্য দৃষ্টিতে প্রকাণ্ড পূর্ণিমার দিকে তাকিয়ে যা উত্তর দিলো ব্যাপ্ত হলো নিঃশব্দে — ওই জ্যোৎস্নাপ্লুত চরাচরে।
এরপর ঠিক আগের মতোই কি কোনো অলৌকিক মার্গে বর্বরীক তথা বর্বরীকের ছিন্নমুখ ফিরে গেলো তার নির্দিষ্ট স্থানে। সেই পর্বতশৃঙ্গে।
কিন্তু কতক্ষণের জন্য? কারণ এরপর আবার কারো শিরচ্ছেদ হয় এই ব্যাপ্ত বসুন্ধরায়।
যা অবশ্যই কোনো প্রখর যোদ্ধার নয়।
সেটি হয়তো কোনো উচ্ছল কিশোরীর — কারো পাশবিক লালসার শিকার হয়ে — আসন্নসন্ধ্যার অন্ধকারে — কোনো নির্জনপ্রান্তরে — পড়ে থাকে তার রক্তাক্ত ছিন্নমুখ।
কিংবা সেটি হতে পারে কোনো নিষ্ঠাবান প্রৌঢ় শিক্ষকের — এক ধর্মান্ধ পিশাচের বীভৎস সন্ত্রাসের বলি হয়ে — সকালের প্রথম আলোয় — কোনো প্রাচীন গ্রন্থাগারের প্রবেশপথে ঝোলানো থাকে তার কর্তিতমুণ্ডটি ।
এইসব ছিন্নমুখ অতি নিশ্চিতভাবে পরমদ্রষ্টা বর্বরীকের অলৌকিক দৃষ্টিপথে চলে আসে সহজেই।
আর তখন ওই তৎপুরুষ যিনি কিনা শ্রেষ্ঠ বীর অথচ পরমনিষ্ক্রিয় — অতীব ক্ষমতাবান অথচ দেহহীন শিরসর্বস্ব — নিহত অথচ চেতনাসম্পন্ন — তিনি তার যাবতীয় অলৌকিক ক্ষমতাবলে শুধু নেমে আসতে পারেন ওই পর্বতশীর্ষ থেকে ভূমাপৃথিবীর উপর — কেবলমাত্র অন্ধকারে আর অলক্ষ্যে — তার চাক্ষুষ হওয়া ছিন্ন শিরটির সামনে।
এইভাবে — বর্বরীকের ছিন্নমুখ — নিজস্ব বেদনার ঐশ্বর্য নিয়ে — এক আশ্চর্য আবর্তে ঘুরে বেড়ায় — আবহমান কাল ধরে — শুধু আরেকটি ছিন্নমুখের সম্মুখীন হতে — — আর তাকে প্রশ্ন করতে — 'কি হয়েছিলো বলো তো?'
বর্বরীকের এই অঘোর অস্তিত্বের কথা নিভৃতে সংহিত হয় ভাবীকালের ব্যাসায়নের জন্য।