অজয়ের সাথে কলেজে ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল বললে ভুল বলা হয়। আমারই ব্যাচের ছেলে, সুতরাং মুখ চিনতাম, কফি হাউসে দু-একবার এক টেবিলে বসে রাজনীতির আলোচনা করেছি। তার বেশি কিছু নয়। তখন আমি ছাত্র রাজনীতি করতাম। ও-ও করত। তবে ও ছিল আমার বিপরীত দলে। সুতরাং আদায়-কাঁচকলায় না হলেও সম্পর্কটা যে খুব গলায়-গলায় ছিল তা মনে করার কোন কারণ নেই। আর হবি তো হ, আমরা দুজনেই আমাদের ক্লাসের একই মেয়ের পিছনে ইঁট পেতেছিলাম। দুজনের কপালেই ছিল লবডঙ্কা। আমাদের পাত্তা না দিয়ে সে আমাদের এক বছরের সিনিয়র এক দাদার সাথে প্রেম করা শুরু করলো। কলেজ শেষ হওয়ার পরেই আমার সাথে অজয়ের যোগাযোগ শেষ।
হঠাৎ বহু বহু বছর বাদে সেদিন অজয় আমায় ই-মেলে পত্রাঘাত করে জানালো যে সে দেখা করতে চায়। তার বউ কাছেই হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটিতে কী একটা ট্রেনিং নিতে আসছে। আমাদের পুরনো কলেজের ব্লগের কল্যাণে জানতে পেরেছে যে আমি কাছাকাছিই থাকি। তাই ফিরে যাওয়ার আগে সস্ত্রীক আমার সাথে দেখা করতে চায়।
আমিও পুরনো সেই কলেজ জীবনের কথা মনে রেখে লিখে দিলাম ‘চলে আয়’। এ কথা লিখতেও ভুললাম না যে হয়ত পুরনো দিনের কথা আবার জাগানো যাবে। আর একটু হাওয়া দেওয়া যাবে পুরনো দিনের সেই ক্ষতের ওপরে। তবে নুন ছেটানো কভি নেহি।
‘তথাস্তু,’ সে জানাল। ‘হা:-হা:, তোর এখনো সেই দিনের কথা মনে আছে? সেই মেয়েটার কথা, যে আমাদের দুজনকেই লেঙ্গি দিয়েছিল?’
‘তা আর নেই। আমাদের দুজনেরই ভার্চুয়াল প্রেমিকা। মনে মনে ছিল, কিন্তু আসলে ফক্কা। চলে আয়, কথা হবে।’
কাছেই এক হোটেলে ওদের ওঠার কথা। নির্দিষ্ট দিনে সকাল দশটা নাগাদ আমি হোটেলে গিয়ে হাজির। ওদের আমাদের বাড়ি এনে, বিকেলের দিকে একটু এদিক-ওদিক ঘুরে, খাওয়া-দাওয়া করে রাতে আবার হোটেলে ফিরিয়ে দেওয়া – এরকম প্ল্যান।
হোটেলে পৌঁছে দেখি অজয় একা ড্রাইভওয়েতে দাঁড়িয়ে।
‘তোর বউ কোথায়?’ আমার প্রশ্ন।
‘আসছে। ও তো কেমব্রিজে আর একটা হোটেলে আছে। ওখান থেকে আসছে।’
আমি অবাক হয়ে কিছু প্রশ্ন করার আগে সামনে একটা ট্যাক্সি এসে দাঁড়াল। সেটা থেকে টান-টান, বেশ আকর্ষণীয় চেহারার এক ভদ্রমহিলা নেমে আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল – ‘আমার নাম সুদেষ্ণা, অজয়ের বেটার হাফ।’
গাড়িতে যেতে যেতে নানা কথা শুরু হল। জানতে পারলাম যে সুদেষ্ণা সপ্তাহ-দুয়েক এখানে আছে, কিসের ট্রেনিং নিতে। আর অজয় এসেছে গতকাল, দিন-তিনেকের মধ্যেই এখান থেকে একসাথে দেশে ফিরে যাবে।
‘বাঃ, অজয় আগে একথা জানালে তো অনেক আগেই আপনার সাথে আলাপ করা যেতো।’
‘তা সত্যি, কিন্তু অজয় এখানে ছিল না, তাই আমার আগ বাড়িয়ে আলাপ করাটা ঠিক হবে বলে মনে করিনি।’ সুদেষ্ণার উত্তর। তারপরেই বলল—
‘আমাকে আপনি-আপনি করবেন না। আফটার অল তুমি আমার হাসব্যান্ড-এর ক্ল্যাসমেট।’
‘তা ঠিক। কিন্তু তোমরা এত দূরে এলে, কদিন থেকে, এখানে-ওখানে ঘুরে যাও, দেশটা দেখো।’
সুদেষ্ণা কিছু বলার আগে অজয় বলে উঠলো – ‘নারে, পরের বারে হবে। এবার আমায় কলকাতা ফিরে গিয়েই প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ভুটানে ফিরতে হবে। আর ও চলে যাবে দিল্লিতে।’
‘ভুটানে? ভুটানে আবার কি করবি? আর সুদেষ্ণাই বা দিল্লি যাবে কেন?’ আমি একটু অবাক।
অজয় হেসে বলল, ‘আরে, আমি তো ভুটানে চাকরি করছি বহু বছর। থিম্পুতে ভুটানি ব্যাঙ্কিং সিস্টেমের ম্যানেজারী করি। আর ও থাকে দিল্লিতে। একটা ছোটদের লেখা-পড়া শেখানোর নন-প্রফিট অর্গানাইজেসনে চাকরি করে। ওখান থেকেই তো ওকে এখানে ট্রেনিং-এ পাঠিয়েছে।’
সুদেষ্ণা আমার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলে উঠলো – ‘আশ্চর্য হচ্ছ তো। সবাই হয়। আমাদের এই ব্যবস্থা বেশ অনেক বছরের। প্রথম-প্রথম বেশ অসুবিধে হত, কিন্তু এখন একেবারে অভ্যস্ত হয়ে গেছি।’
‘প্রায় ভার্চুয়াল দাম্পত্য?’ কথাটা আমার মুখ থেকে বেরোতেই লজ্জায় একশেষ।
সুদেষ্ণা উত্তর দিল—‘না-না, লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই। আমাদের বিয়ে হওয়ার প্রায় বছর দশেকের পর থেকেই আমাদের এই ব্যবস্থা। আমি তখনো দিল্লি যাইনি। বাকিটা ওর মুখেই শোন।’
অজয় বললো – ‘আমি তখন কলকাতায় এক ব্যাঙ্কে ম্যানেজমেন্ট-এ কাজ করি। মাইনে-টাইনে ভালই। আর আমার ওপরওয়ালাও আমার ওপর বেশ খুশি। তাই হয়তো হঠাৎই ভুটানে যাওয়ার ডাক এলো। ওখানে তখন ব্যাঙ্কিং সিস্টেমের একেবারে রুডিমেন্টারি অবস্থা। আমার দায়িত্ব ও-দেশের ব্যাঙ্কিং সিস্টেমটাকে নিজের পায়ে দাঁড় করানো। কলকাতার কাজটা ঠিকই ছিল। তবে চ্যালেঞ্জ বলে কিছু ছিল না। আর আমার তখন বয়স অল্প। রক্তের বেশ জোর, বুঝতেই পারছিস। তা ছাড়া আমি চিরকালই বেশ একরোখা।
‘তা নয় হোল, কিন্তু তাই বলে তুই ভুটানে ঠেলে উঠবি আর বউ এখানে একা পড়ে থাকবে?’
‘আসলে অফারটা আমার কাছে একটা মস্ত বড় অপরচুনিটি বলে মনে হয়েছিল। তাছাড়া বলেছিল বছর দুয়েকের মামলা। সুতরাং ভুটান—“হিয়ার আই কাম”।’
‘তোর বউ আপত্তি করেনি?’
‘করেছিল, খুবই করেছিল। তবে বছর-দু-তিনের ব্যাপার তো, খুব খারাপ হবে না। তা ছাড়া ছুটি-ছাটায় বাড়ি আসা যাবে। দূরত্ব তো সেরকম কিছু নয়।’
তারপর একটু থেমে বলল-–‘ভুটানের ব্যাঙ্কিং সিস্টেমটা আমার নিজের হাতে করে তৈরি করা বললে বেশি বলা হবে না। কিছু গড়ার একটা নেশা আছে, জানিস তো। আমি সেই নেশায় জড়িয়ে পড়লাম।’
‘তা নয় হল। কিন্তু গড়া শেষ হওয়ার পর তো ফিরতে পারতিস।’
‘তা সত্যি। ফিরে হয়ত আসতে পারতাম। কিন্তু আমার চিরকালই বন-জঙ্গল খুব পছন্দ। ওখানকার শান্ত, নিরুপদ্রব জীবন, আর তার পাশে কলকাতার ইঁট-কাঠের ইমারত, ডিসেলের পোড়া আর দম-বন্ধ করা গন্ধ। ওসব এখন আমি আর চিন্তাই করতে পারি না।’
তারপর একটু থেমে বলল-– ‘সেই শান্ত, পল্যুশন-ফ্রি জীবনের আকর্ষণ আমি তোকে বলে বোঝাতে পারব না। তাই ওখান থেকে আমি বেরোতে পারিনি।’
‘শান্ত, পল্যুশন-ফ্রি জীবন না অন্য কিছু?’—আমার প্রশ্ন।
অজয় হেসে বলল-– ‘না, না, তুই যা ভাবছিস তা নয়। ওখানকার মেয়ে বিয়ে করে যে ভুটানি হয়ে যাইনি তা তো আমার সাথে সুদেষ্ণাকে দেখে বুঝতে পারছিস।’
‘তা পারছি। তবে কয়েক বছরের জন্য কাজ করতে যাওয়া আর থেকে যাওয়ার মধ্যে আকাশ-পাতাল তফাৎ। সুদেষ্ণা আপত্তি করেনি?’
আমার প্রশ্নে সুদেষ্ণা নিজেই মুখ খুলল-– ‘সে আর করিনি। সেটাই তো স্বাভাবিক। প্রথমে ওর প্যাশনে বাধা দিতে চাইনি। কিন্তু দু বছর কাটিয়ে যখন চারে পড়ল তখন আমি কান্না-কাটি, চেঁচামেচি কোনো কিছুরই বাদ রাখিনি। তবে তাতে কোন লাভ হয়নি।’
আমি গাড়ি চালাতে চালাতে ওদের এই আশ্চর্য দাম্পত্যের কথা শুনছি আর অবাক হচ্ছি। খেয়ালই নেই কখন বাড়ির রাস্তায় ঢুকে পড়েছি। সুতরাং আমাদের কথোপকথন আপাতত মুলতুবি। কিন্তু আমার মনের মধ্যে খচখচানিটা রয়েই গেল। অজয় বউ-টউ ছেড়ে কোথায় এক পাণ্ডববর্জিত দেশে একা-একা পড়ে আছে। আর বউটা পড়ে আছে আর এক প্রান্তে, আর এক দেশে। আচ্ছা, এদের ছেলেপুলে হয়নি! হলে তারা কোথায়? এসব কথা কি জিজ্ঞাসা করা যায়! তাই প্রশ্নগুলো নিজের কাছে তুলে রেখে বাড়িতে ঢুকলাম।
বাড়িতে ঢুকে আমার বউ মালার সাথে আলাপ-পরিচয় হতে হতে লাঞ্চের সময় এসে হাজির। খেয়ে নিয়ে আমি আর অজয় পোস্ট-লাঞ্চ মৌজ করছি, আর সুদেষ্ণা ও মালা নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা চালাচ্ছে। অজয় দেখি ঝিমোচ্ছে, আর আমার কান পড়ে আছে মেয়েদের কথাবার্তার মধ্যে। খুব শীঘ্রই দেখলাম তারা নিজেদের মধ্যে কথায় মত্ত – যেন কতকালের চেনা।
যেসব কথা পুরুষের সাথে পুরুষের আলাপে অথবা ছেলের সাথে মেয়ের কথায় জানা যায় না মেয়েদের নিজেদের কথাবার্তায় তা বেশ সহজেই উঠে আসে। যে কথাটা আমার মনের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছিল, সেটা খুব সহজেই সুদেষ্ণা ও মালার আলাপের মধ্যে বেরিয়ে এলো। আমি কান পেতে শুনতে থাকলাম।
মালার প্রশ্নে সুদেষ্ণার জবাব—‘আমি থাকি দিল্লি আর অজয় ভুটান। আমরা দুজনে দু-জায়গায় কাজ করি। ওই প্রথমে ভুটানে কাজ নিয়ে যায়। আর ওখানে নিজের ইচ্ছায় থেকে গেছে।’
এই জবাবে মালারও আমার মতোই অবাক হয়ে একই প্রশ্ন-– ‘এইভাবে সংসার চালানো যায় না কি! আমি হলে তো কবে ডিভোর্সের মামলা ফাইল করে দিতাম। থাকো তোমার কাজ নিয়ে। আমার জীবনটা তো কিছু ফেলনা নয়।’
‘সত্যি কথা। আমার মাথায়ও একই কথা এসেছে। প্রথম দিকে রাগে-দু:খে আমার প্রায় পাগল হওয়ার অবস্থা। কী, না আমার ওখানকার শান্ত জীবন ভালো লাগে! আমাকেও কলকাতার পাট উঠিয়ে ওখানে থাকার কথা বলেছে।’
‘তুমি তা চেষ্টা করেছো?’
‘করিনি আবার। কয়েক মাস ওর সাথে ছিলাম। আমি পাক্কা শহরের মেয়ে। ওই জায়গায় থাকা যায়! কোন চেনা মুখের দেখা পাওয়া যায় না, নেই কোন সিনেমা-থিয়েটার। তখনো কম্পুটার-ইন্টারনেটের যুগ আসেনি। তাই বাড়িতে বসে যে সময় কাটাবো—তারও কোন উপায় নেই। একেবারে দম বেরিয়ে আসার উপায়।’
‘তবে অজয় যা কথা বলছে তা ঠিক। শহরের জীবনের প্রতি ওর একেবারে কোন টান নেই। বন-জঙ্গলের মধ্যে আধা জংলি হয়ে দিব্বি আছে। আমায় বলে কিনা ওখানে থাকো!’
তারপর একটু ইতস্তত: করে বলল-– ‘ইতিমধ্যে জানতে পেরেছি যে আমাদের মেয়েকে নিয়ে আমি প্রেগন্যান্ট। সুতরাং এই অবস্থায় ভুটানে গিয়ে থাকার কোন প্রশ্নই হয় না।’
‘আমি হলেও তাই করতাম। তোমার বাচ্চা হবে কলকাতায়, আর অজয় থাকবে ভুটানে। এতো ভারী মজার ব্যবস্থা।’
‘না-না, তখন ও একটু ঘন-ঘন কলকাতায় এসেছে। আর তারপর আমার মা এসে পড়লেন দিল্লি থেকে। বেশ কয়েক মাস ছিলেন। শেষে আমাকে সামলাতে গিয়ে আমার মা-বাবারই না ডিভোর্স হয়ে যায়!’
সুদেষ্ণা মনে হল বেশ ইমোশনাল হয়ে পড়েছে। একটু সামলে নিয়ে কান্না-ভেজা গলায় বললো-–‘মানুষ বড় আশ্চর্য জীব। সবই সহ্য করে নেয় ইভেনচুয়ালি। আমার ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। মেয়েকে প্রায় একা-একা বড় করেছি। অজয় টাকা-পয়সা দিয়ে, মাঝে মাঝে এসে বাবার কাজ করেছে। কিন্তু কাছে থাকেনি।’
অজয়ও দেখি তার ভাত-ঘুম থেকে উঠে পড়েছে আর আমার মত আমাদের দুই বউয়ের আলাপ শুনছে। ইতিমধ্যে দেখি মেয়েরা তাদের ফোন খুলে ছবি দেখতে আর দেখাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে – আমাদের ছেলের ছবি আর ওদের মেয়ের নানান ছবি।
‘একটা বিয়ার খাবি না কি?’ অজয়কে জিগ্যেস করি।
‘নারে, অসময়ে বিয়ার খেলে একেবারে ঘুমিয়ে পড়বো। তার চেয়ে চল বেরোনো যাক। তোদের শহর-টহর গুলো দেখে আসি।’
কিন্তু সুদেষ্ণা ও মালা তখনো গভীর আলাপে ব্যস্ত। আমরা যে ওদের কথা শুনছি তা ওরা বেশ ভালোভাবেই জানে। কিন্তু তাতে ওদের কোন আপত্তি আছে বলে মনে হল না।
‘বিয়ের আগে আমি যাদবপুর থেকে এমএ করেছিলাম পলিটিকাল সায়েন্সে। এ-নিয়ে যে কিছু করব তা কোনদিন ভাবিনি। রিয়া যখন ছোট ছিল, তখন তাকে বড় করা ছাড়া অন্য কিছু করার কথা চিন্তাও করতে পারিনি। কাজের লোক আর আমি, মাঝে মাঝে অজয় আসে।’
‘আমি হলে কখনোই পারতাম না।’—মালার মন্তব্য।
‘পারা ছাড়া কোন উপায় আমার ছিল না। তবে রিয়াকে বড় করতে আমার বিশেষ কষ্ট করতে হয়নি। ও বড় ভালো মেয়ে, আমার কথার কোনদিন অবাধ্য হয়নি। পড়াশুনোয় ও বেশ ভালো ছিল চিরকাল। তাই স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে ভালো কলেজে চান্স পেতে কোন অসুবিধেই হয়নি।’
এই অব্দি বলে সুদেষ্ণা একটু থামলে আমি বলে উঠলাম-–‘বা:, শেষ পর্যন্ত তোমার কষ্ট কিছুটা কমলো তাহলে।’
সুদেষ্ণা হেসে ফেলল-–‘তোমরাও তাহলে আড়ি পেতে শুনছ? তোমার ভাষায় আমাদের ভার্চুয়াল দাম্পত্যের কথা?’
আমি লজ্জিত হয়ে বললাম-– ‘না, না, আড়ি পাতিনি। তবে তোমাদের কথা শুনে আশ্চর্য হচ্ছি। মালা যদি কোন কারণে এত বছর বাপের বাড়ি থাকে, তাহলে আমি কবে অন্য মেয়ের খোঁজ করবো।’
আমার কথায় মালা একেবারে খ্যাঁক-খ্যাঁক করে উঠলো।
‘আর তুমি যদি করতে তাহলে আমি দু-বছরও অপেক্ষা করতাম না। নতুন বর খুঁজে নিতাম।’
আমাদের এই উত্তেজিত আলোচনার মধ্যে অজয় দেখি আশ্চর্যরকম ভাবে নির্বিকার। সুদেষ্ণা সবাইকে থামিয়ে দিয়ে বলে উঠলো-–‘এখানেই শেষ নয়। তবে একটু চা খাবো। বকে-বকে গলা শুকিয়ে গেছে।’
চা এলো, তার সাথে অল্প টা-ও। আবার শুরু হল সুদেষ্ণার জীবনকাহিনি।
‘মেয়ে কলেজ যাওয়া শুরু করতেই আমার এক অন্য জীবন শুরু হোল। এতদিন রিয়া কি খাবে, কি পরবে, স্কুলের রেসাল্ট কেমন হবে, ভালো কলেজে চান্স পাবে কি না ইত্যাদি নিয়ে চিন্তা করতে আর তার ব্যবস্থা করতে করতেই দিন কেটে যেত। নিজের জন্য চিন্তা করার কোন সুযোগই থাকত না।’
‘যুগ যুগ ধরে আমাদের মেয়েদের জীবনকাহি্নির কোনই পরিবর্তন হয়নি—কি বলো?’ – মালার উক্তি।
‘ঠিক বলেছ। বাচ্চা জন্ম দেওয়া থেকে মানুষ করা—সব দাযিত্বই মেয়েদের। যাই হোক, রিয়া কলেজ যাওয়া শুরু করতেই দেখি আমার সারা দিন কিছু করার নেই। কেমন পাগল-পাগল লাগত। শেষে ঠিক করলাম আমার এমএ ডিগ্রিটার সদ্ব্যবহার করার সময় এসেছে। তবে আমার মত মাঝবয়সের বুড়ি তো চাকরি চাইলেই পেতে পারে না। বেশ কিছুদিন চেষ্টার পর হাল প্রায় ছেড়ে দিয়েছিলাম। হঠাৎই এই চাকরিটা জুটে গেলো। মনে হোল ভালই চাকরি। তবে তা দিল্লিতে।’
সুদেষ্ণা একটু থেমে আবার শুরু করলো।
‘ডিসিশন নিতে খুব কষ্ট হচ্ছিল-– মেয়ে একা থাকবে কলকাতায়, আর আমি দিল্লিতে। নিজেকে বড় সেলফিশ বলে মনে হচ্ছিল। তবে আমার মনের অন্য দিকটা বলছিল—নিজের জন্যে তো কোনদিন কিছু করোনি। এবার সেই সুযোগ এসেছে। শেষ পর্যন্ত তারই জিত হোল।
‘অজয় কিছু বলেনি?’
‘কি আর বলবে। সত্যি কথা বলতে কী কিছু বলার মুখ ওর ছিল না। তবে মেয়ের জন্য কলকাতায় একটা ভালো হোস্টেলের ব্যবস্থা ও না করলে আমার একার পক্ষে সম্ভব হতো না।’
‘থ্যাঙ্ক ইয়্যু। এট লীস্ট আই গেট সাম ক্রেডিট ফর ব্রিংগিং আপ মাই ডটার।’-–অজয় মন্তব্য করলো।
স্বামীর দিকে অনুকম্পার দৃষ্টিতে তাকিয়ে সুদেষ্ণা বলল-– ‘হ্যাঁ, সাম ক্রেডিট তো বটেই। যাই হোক। আমার সুবিধে হল মা-বাবা দিল্লিতে থাকেন। তাদেরও বয়স হয়েছে। তাই তাদের দেখাশুনো হবে আবার চাকরিও হবে। ওদের সাথেই থাকি। ব্যবস্থাটা মন্দ নয়। ছুটি-ছাটায় কলকাতায় মেয়ের সাথে দেখা করি। সেও আসে ক্বচিৎ-কখনো। এইভাবেই পাঁচ বছর কেটে ছয়ে পড়েছে।’
‘আর তোমাদের মেয়ে এখন কী করছে?’-– আমার প্রশ্ন।
‘মেয়ের কলেজ শেষ হয়ে গেছে। আমি চেয়েছিলাম ও হায়ার স্টাডিজ করুক দিল্লি এসে। কিন্তু আজকালকার মেয়ে তো। ও আর পড়েনি। কলকাতায়ই একটা চাকরি পেয়েছে। শুনছি নাকি এক বয়ফ্রেন্ডও জুটেছে। তার জন্যই বোধহয় কলকাতা ছাড়তে চাইছে না।’
মালা ওর মুখের কথা লুফে নিয়ে বলল—‘আমাদেরও প্রায় একই অবস্থা। আমরা তো চিরকালই জেনে এসেছি কলেজের পর হায়ার স্টাডিজ-এর কথা। কিন্তু আমাদের ছেলেটা তো সে পথ মাড়াতে আদৌ উত্সাহী নয়। আসলে যুগটা পাল্টেছে। আমাদের সেটা মানতে কষ্ট হয়।
আমি বলে উঠলাম-– ‘তা সত্যি। যাইহোক, তোমরা যে তিনজন তিন জায়গায় থাকো, তোমাদের দেখা হয় না মাঝে-মাঝে?’
দেখি অজয় আর সুদেষ্ণা মিটিমিটি হাসছে। তারপর সুদেষ্ণা বলে উঠলো-– ‘এ ব্যাপারে আমরা যুগের সাথে তাল মিলিয়ে এক্কেবারে আপ-টু-ডেট। এক্কেবারে হাই-টেক।’
‘তার মানে?’ আমার অবাক প্রশ্ন।
‘আমাদের দেখা হয় স্কাইপে। দিন-সময় ঠিক করা আছে, সপ্তাহে একদিন আমরা স্কাইপে মীট করি।’
অজয় সুদেষ্ণার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলল-– ‘আমরা ট্রুলি গ্লোবাল ভিলেজার। আমি থিম্পু, সুদেষ্ণা দিল্লি, আর রিয়া কলকাতা – কিন্তু আমাদের কোন অসুবিধেই নেই। কম্পুটার স্ক্রিনে দেখতে পাচ্ছি, শুনতেও পাচ্ছি। একেবারে ভার্চুয়াল মীটিং।’
‘সে কি রে?’ আমি এখনো ঠিক মানতে পারছি না।
‘আরে এই ইন্টারনেটের ব্যবস্থা কয়েকবছর আগে থাকলে আমার বউ-মেয়েকে রেখে একা ভুটানে থাকার গিল্ট সহ্য করতে হত না। খুব খারাপ ব্যবস্থা নয়।’
‘আসলে আমরা এদেশে থেকেও মনে-প্রাণে এতটা গ্লোবাল হতে পারিনি। এখনো সপ্তাহে-সপ্তাহে ছেলের ফোন না এলে কি যেন হয়নি মনে হয়। আর মাস দুয়েকের মধ্যে একবার বাড়ি না এলে মনে হয় আমাদের এম্পটি নেস্টার দিনগুলো সত্যি-সত্যিই ফাঁকা হয়ে গেছে। অবশ্য সে খুব বেশি দূরে থাকে না। তাই স্কাইপ-মিটিং-এর এখনো প্রয়োজন হয়নি।’—মালার মন্তব্য।
‘সে তোম়াদের ছেলে কাছে থাকে বলে। কিন্তু আমাদের এ ছাড়া উপায় কি?’ –-অজয়ের উত্তর।
আমি ভেবে চললাম—আসলে নেসেসিটি-ই হচ্ছে মাদার অফ ইনভেনশন। তাই ওদের পক্ষে এই ভার্চুয়াল পন্থায় সম্পর্কটা এইভাবে জিইয়ে রাখা ছাড়া কোন উপায়ই নেই।
এদিকে আমাদের কথা বলতে-বলতে বাইরে বিকেল এসে গেছে। সুতরাং আমাদের আলোচনা মুলতুবি রেখে সবাই গাড়িতে উঠলাম। বস্টন-কেমব্রিজ-এর এদিক-ওদিক ঘুরে রাতের দিকে ওদের হোটেলে নামিয়ে দিলাম।
আবার কবে দেখা হবে কে জানে। আমি কৌতুক করে অজয়কে বললাম -– ‘আরে, আমাদের কলেজের সেই প্রেমিকার কথা আদৌ হল না।’
তাতে অজয়ের কি হাসি—‘কোই বাত নেহি। আমদের অন্ধের যষ্টি স্কাইপ আছে। ফিরে গিয়েই স্কাইপে তোর সাথে যোগাযোগ করবো। তখন এ-ব্যাপারে মোলাকাত করা যাবে। এদিকে সেই মেয়েটা যেখানেই থাকুক তার হেঁচকি দিতে দিতে প্রাণ যাবে বোধহয়।’
স্কাইপে যোগাযোগ রাখার প্রমিস করে ওদের হোটেলে রেখে আমরা বাড়ি ফিরে এলাম।
আমরা আমাদের কথা রেখেছি। মাসে-মাসে হয় না, কিন্তু বছরে তিন-চারবার স্কাইপে অজয় আর সুদেষ্ণার সাথে ভার্চুয়াল আড্ডা হয়। এখন মনে হয় বেশ তো ব্যাপার। সত্যিই কাছাকাছি না থাকলে এ ছাড়া উপায় কি। ভাবতে ভাবতে ‘পথের পাঁচালী’-তে সর্বজয়ার সেই উদগ্রীব হয়ে অপুর চিঠির জন্য অপেক্ষা করার কথা মনে পড়ে গেল। বিজ্ঞান আর তার প্রযুক্তির কল্যাণে আজ তার কোন প্রয়োজনই নেই। বাড়িতে আছে ল্যাপটপ আর হাতে আছে স্মার্টফোন। সুতরাং দূরত্বটা কি কোন ব্যাপার না কি!
বউকে কৌতুক করে বললাম-– ‘এ রকম টেকনোলজি থাকলে কালিদাসকে আর মেঘদূত লিখতে হত না।’
মালা কিন্তু এ কথা একেবারে কানেই নিল না। একেবারে খ্যাঁক-খ্যাঁক করে বলল—‘বাজে কথা এক্কেবারে বোল না। এই যে আমাদের ছেলেটা মাঝে মাঝে বাড়ি আসে, তখন কত কথা হয়। বডি ল্যাঙ্গুয়েজ বলে কি কোন কথা নেই? সেটা কি তোমার কম্পুটার স্ক্রিনে সম্ভব?’
তা সত্যি। এ দেশের অনেক ছেলের মত অরিত্র রাঁধতে খুব ভালবাসে। মনে পড়ে গেল আমাদের ছোট বয়সে বাড়ির রাঁধুনি ঠাকুর ছাড়া ছেলেরা রাঁধছে সে কথা চিন্তাই করা যেত না। বন্ধুরা জানতে পারলে মেয়েলি বলে খেপিয়ে মারতো। আর এ দেশে ব্যাপারটা মোটেই তা নয়। আমি নিজে রাঁধতে জানি না, কিন্তু আমার অনেক পুরুষ বন্ধুকে তাদের রান্না নিয়ে গর্বের কথা শুনেছি। গ্যারির সংসারে ওর বউ ইভা তো আদৌ রাঁধে না। সব রান্না তার স্বামী করে।
অরিত্র বাড়িতে এলে মাকে নানান রান্না করে খাওয়ায়। নিজেকে ‘গুর্মে সেফ’ বলে মনে করে তার গর্বের অভাব নেই। আমাদের বন্ধুরা বলে-–তোমরা সত্যিই লাকি। আমাদের ছেলেমেয়েরা থাকে অনেক দূরে দূরে। টেলিফোনে কথা হয় মাঝে মাঝে। তারা তাদের জীবন নিয়ে স্বাভাবিকভাবেই ব্যস্ত। তাদের সাথে কদাচিৎ দেখা হয়। আর রান্না করে খাওয়ানো তো দূর অস্ত। আমি জিজ্ঞাসা করেছি-– ‘কেন স্কাইপে যোগাযোগ রাখো না কেন?’ অজয় আর সুদেষ্ণার উদাহরণ দিয়েছি। কেউ বলেছে এ আবার নতুন কি। আমরা তো কয়েকবছর ধরে স্কাইপেই যোগাযোগ রাখি। এটা না থাকলে কি যে করতাম কে জানে!
অন্যদিকে কেউ কেউ আবার ভার্চুয়াল কম্যুনিকেশনের অপকারিতা সম্বন্ধে বলেছে।
‘অপকারিতা?’—আমি অবাক।
‘তা ছাড়া আর কি বলা যায়। আমাদের বন্ধু সৌরভ আর মাধুরী থাকে ফ্লোরিডাতে আর ছেলে আর তার বউ থাকে অরিগনে। তাদের একটা ছোট বাচ্চা মেয়ে আছে। প্রতিদিন সন্ধেবেলা সৌরভ আর মাধুরী ছেলে-বউ কাজ থেকে ফেরার পর তাদের বাচ্চাকে ভার্চুয়াল বেবি সীটিং করে স্কাইপে। বাচ্চাটাকে ক্রিবে রেখে তার সামনে কম্প্যুটার খোলা থাকে, আর তার মা-বাবা রান্না-বান্না নিয়ে ব্যস্ত থাকে। সেদিনও তাই চলছিল। হঠাৎ কীভাবে বাচ্চাটির একটা পা রেলিং-এর ফাঁকে আটকে গেছে।
‘সে কি! সে তো ভারী ডেঞ্জারাস ব্যাপার!’
‘ডেঞ্জারাস বলে ডেঞ্জারাস। রান্নাঘরে একজস্ট ফ্যানের আওয়াজে বাচ্চার মা-বাবা বেশ কিছুক্ষণ কান্নার আওয়াজ, আর তাদের ভার্চুয়াল বেবি-সীটার মা-র কম্প্যুটারে চিত্কার শুনতে পায়নি। তারপর টনক নড়তে দেখে এই অবস্থা। আর কিছুক্ষণ এইভাবে থাকলে কি হত কে জানে!’
‘সত্যিই ডেঞ্জারাস। আমাদের সৌভাগ্য যে শীগ্গির আমাদের এই ভার্চুয়াল লিভিং-এর সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছি না। তবে ভবিষ্যতে কি হবে তা বলা মুশকিল।’
‘ইয়ু আর লাকি।’ বন্ধুর উত্তর।
সেদিন অরিত্র বাড়ি এসেছে। কোন কারণে এবার আসতে একটু দেরি হয়েছে। এই নিয়ে ওর মায়ের অভিযোগের কোন অভাব নেই। আর আমি বোঝাতে চেষ্টা করেছি-–‘আহা, কাজ থাকলে কি করবে। কাছেই তো থাকে, এর পরের বার না হয় তাড়াতাড়ি আসবে।’ কিন্তু মায়ের মন কি তাতে শান্ত হয়? তবে এখন ছেলেকে পেয়ে খুব খুশি।
অরিত্র বাড়িতে আসার সঙ্গে সঙ্গেই যথারীতি রান্না করার ধুম পড়ে গেছে। আসলে যে এপার্টমেন্ট-এ ও থাকে সেটা বেশ ছোট, আর সেখানে হাত-পা ছড়িয়ে রান্না করার কোন সুযোগ নেই। তাই সে বাড়ি এসে তার প্যাশন চরিতার্থ করতে নানান রান্না করে, সাজিয়ে-গুছিয়ে খাওয়ায়, আর তার মা তার সাথে তাল দিয়ে যায়। তাই ছেলের ফরাসী-ইটালিয়ান কুইজিনের সাথে-সাথে শুক্তো, আমের অম্বল ইত্যাদিও থাকে। এই শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে কারোর আপত্তি নেই।
সেদিন খাওয়া-দাওয়ার পর অরিত্র কথাটা পাড়লো – আমার কাছাকাছি থাকার পাট এবার ফুরোলো। ‘আই ফীল স্যাড, বাট আই হ্যাভ নো চয়েস।’
আজকালের বাজারে ব্যাপারটা যে প্রায় অবশ্যম্ভাবী তা জানতাম। কিন্তু এর জন্য মন প্রস্তুত রাখা মুশকিল।
‘কোথায় যেতে হবে? কতদিনের জন্য?’ –-তার মা’র উদ্বিগ্ন প্রশ্ন।
‘চায়না। আওয়ার কম্পানি ওয়ান্টস ট্যু হ্যাভ এ মেজর ফুট-প্রিন্ট দেয়ার।’ কত বছর এক্ষুনি বলা মুশকিল। তবে ওখানে গেলে আমার কেরিয়ারের সিগনিফিক্যান্ট উন্নতি হবে।’
আমরা দু-জনেই চুপ। অরিত্র হাওয়াটা একটু বুঝে নিয়ে মুখ খুললো।
‘মম-ড্যাড, ডোন্ট ওয়ারী। উয়ী উইল বি ইন টাচ ভায়া স্কাইপ।’
আমি হতবাক।
‘স্কাইপ? স্কাইপে কি রান্না করা যায়, বা সেই রান্না খাওয়া যায়!’ এই বলে মালা চোখের জল চাপতে-চাপতে উঠে অন্য ঘরে চলে গেল।
সেদিন রাতে ঘুমোবার আগে মালা বললো—‘আমাদের অবস্থা কিন্তু তোমার কলেজের সেই বন্ধুদের থেকে একটু ভালো। ওদের তিনজনের ভার্চুয়াল লাইফ। আমরা অন্তত: দুজনে কাছে আছি।’
এই বলে আমার বউ অনেকদিন আগের ভুলে যাওয়া ভঙ্গিতে আমায় জড়িয়ে ধরে ঠোঁটে একটা ছোট্ট চুমু এঁকে দিয়ে বলল –
‘এটা কিন্তু ভার্চুয়াল নয়, বুঝলেন স্যার!’