|| ১ ||
ফিল্ড-ওয়ার্ক সেরে ঋক যখন ফেরে তখন বেলা পড়ে আসে। তাঁবুর সামনে খোলা জায়গাটায় তখন পশ্চিমের বড় গাছটার ঘন ছায়া পড়ে।
সেই ছায়ায় বসে উল বোনে অথবা কুরুশকাঁটা দিয়ে নকশা তোলে রিহানা। আর গুনগুন করে গান করে। পশ্চিম থেকে আসা কমলারঙের রোদ্দুরের আভায় কী ভীষণ নির্জন দেখায় রিহানাকে! এই কমলারঙের রোদ্দুরই ঋককে মনে করিয়ে দেয় আপন গ্রহ থেকে কত দূরে আছে তারা!
দূর থেকে রিহানাকে দেখে ঋকের কেমন একটা ঠান্ডা, করুণাভরা দুঃখ হয়। মনে হয়, ও বড় একলা, বড় অন্তর্মুখী। অথচ রিহানা সব জেনেশুনে স্বেচ্ছায় এসেছে এইখানে, এই দূর গ্রহে।
ঋক কাছে এলেই রিহানা গান থামিয়ে দেয়। হাতের কাজও। উঠে দাঁড়িয়ে হেসে বলে, "তুমি হাতমুখ ধুয়ে নাও, আমি চা বসাই।"
রিহানা সুগৃহিণী, সব কাজ গুছিয়ে করে। ঋকের সমস্ত সুখস্বাচ্ছন্দ্যের দিকে খুব নজর।
ঋকের মাঝে মাঝে অস্বস্তি হয়, মনে হয় এত সেবাযত্ন সে এভাবে ওর থেকে নেয়, পরিবর্তে কী বা দিতে পারে?
হাতমুখ ধুয়ে এসে সেই গাছের ছায়াতেই চেয়ারে বসে ঋক। এখানে দুটো স্থায়ী চেয়ার আর একটা স্থায়ী টেবিল সে বানিয়ে রেখেছে তাঁবু প্রথম খাটানোর দিন থেকেই। আশেপাশের ঝোপঝাড় থেকে ডালপালা আর পাতালতা সংগ্রহ করে এনেই বানিয়েছিল চেয়ার দুটো আর টেবিলটা। রিহানা হাসছিল আর ঠাট্টা করেছিল বটে, কিন্তু খুশিও হয়েছিল।
তাঁবুর রান্নাঘর থেকে ওর নিজের বানানো কুরুশের ঢাকনি দেওয়া কাঠের ট্রে-তে চা আর খাবার নিয়ে বেরিয়ে আসে রিহানা। ডালপালার টেবিলের এবড়োখেবড়ো তলের উপরে সাবধানে ট্রেটা রাখে, ট্রের উপরে দু'কাপ চা আর একটা বড়ো প্লেটে চারটে স্প্রিং রোল।
চা আর সুস্বাদু স্প্রিং রোল খেতে খেতে দু'জনে গল্প করে। ততক্ষণে দিনের আলো মিলিয়ে এসেছে। আকাশে উঠে আসছে গোল একটা চাঁদ। আর একটু পরেই উঠবে আর একটা।
এই গ্রহের সবচেয়ে আকর্ষণীয় ব্যাপার হল এর একজোড়া চাঁদ। পৃথিবীর চাঁদের তুলনায় এরা খানিকটা ছোটো, কিন্তু যখন একজোড়া পূর্ণ বা প্রায় পূর্ণ চাঁদ আকাশে খুব কাছাকাছি থাকে, তখন জ্যোৎস্না বেশ তীব্র হয়। আর সেই জ্যোৎস্না দেখে মাঝরাতে ডাকতে থাকে একদল অচেনা পাখি।
সেইসব জ্যোৎস্নারাতে রিহানা এখনো ভয় পায়। প্রথম যে রাতে এমন হয়েছিল, রিহানা কেমন যেন অসহায়, ভয়ার্ত হয়ে পড়ছিল। ঋককে ঘুম থেকে জাগিয়ে কেমন অদ্ভুত গলায় বলেছিল, "ঋক, ঋক, ওঠো ওঠো। শুনতে পাচ্ছ? পাখিরা কেমন অদ্ভুত ভাবে ডাকছে? এই জ্যোৎস্নায় ওরা পাগল হয়ে গিয়েছে। ঋক, আমার ভয় করছে।" শেষদিকে রিহানার গলা কাঁপছিল অবরুদ্ধ কান্নায়।
তাঁবুর গোল জানালা দিয়ে গোল জ্যোৎস্নার আলো পড়েছিল তাদের তাঁবুঘরের মেঝেতে। কী অদ্ভুত মায়াবী সেই আলো! বাকী ঘরটুকুর অন্ধকারও যেন সেই মায়াবী আলোকে অনুভব করছিল।
রিহানাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে মাথায় হাত বুলিয়ে বুলিয়ে শিশুদের সান্ত্বনা দেবার মতন নরম গলায় ঋক বলেছিল, "ভয় নেই, ভয় নেই। ভয় কীসের? আমি তো আছি। কিচ্ছু ভয় নেই তোমার।"
ঋকের বুকের মধ্যে মুখ গুঁজে রিহানা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিল বালিকার মতন। মাঝে মাঝে কান্নাজড়ানো গলায় বলছিল, "সত্যি, ঋক? তুমি আছো? তুমি থাকবে? তুমি আমাকে একলা অজানা জঙ্গলে ফেলে চলে যাবে না তো?"
ঋক বলছিল, "ছি ছি, এসব কী বলছ বোকা মেয়ের মতন? আমি কেন তোমায় ছেড়ে যাবো? কোথায় যাবো?"
ঋকের এই ভালোবাসা-ছলছল কথা শুনে অঝোরে সে রাতে কেঁদেছিল রিহানা। যেন তার সব পুরনো ভয়ের রাতগুলো যখন তার কাছে কেউ ছিল না ভরসা বা ভালোবাসা দেবার মতন, সেইসব রাতগুলোর ভয় আর একলা কান্নাও সে নিঃশেষ করে দেবে ঋকের বুকে।
সেই আশ্চর্য রাতে পাখিরা ডাক থামিয়ে ঘুমিয়ে পড়ার পরেও অনেকক্ষণ জেগে ছিল ঋক আর রিহানা। প্রাণ ভরে ভালোবাসার পর তারা ঘুমিয়েছিল প্রায় শেষরাত্রে।
রিহানা আস্তে আস্তে ধাতস্থ হয়ে এসেছিল তার পরের রাতগুলোতে। তখন পূর্ণ চাঁদেরা ক্ষয়ে যাচ্ছিল, জ্যোৎস্নাও কমে আসছিল, বাড়ছিল দুই চাঁদের মধ্যের দূরত্বও। সেইসব রাতগুলো আর তত উন্মাদ করে তুলছিল না ওই আশ্চর্য পাখিদের, ওরা ওভাবে আর ডেকে উঠছিল না মাঝরাতে। স্বাভাবিক হয়ে আসছিল জীবনযাত্রা।
সেটা বেশ কয়েকমাস আগের কথা। খোঁজখবর নিয়ে তারা জেনেছিল ঐ জোড়া চাঁদের পূর্ণিমা আসে কয়েক মাস অন্তর অন্তর।
|| ২ ||
আজকের রাতও হয়তো সেইরকমই একটা রাত হবে। চায়ে চুমুক দিয়ে উদীয়মান চাঁদের দিকে চেয়ে থাকে ঋক। এখনও চাঁদ ফ্যাকাশে, তবুও এখনই মায়াবী নীল আভা দেখা যাচ্ছে। রাত বাড়লে জ্যোৎস্না তীব্র হবে।
দ্বিতীয় চাঁদটা যেটা এখনও ওঠে নি, উঠবে আর কিছুক্ষণ পরেই, সেই চাঁদটার আলো সাদা, সেটা এই নীলচাঁদের চেয়ে একটুখানি বড়ো। ওর জ্যোৎস্না তীব্রতর।
চোখের কোণা দিয়ে ঋক রিহানার দিকে তাকায়। রিহানা মাটির দিকে চেয়ে চা খাচ্ছে, সে চাঁদের দিকে তাকায় না পারতপক্ষে। এই দূর গ্রহের অচেনা পরিবেশে অন্য সব কিছুর সঙ্গেই যথাসম্ভব মানিয়ে নিয়েছে রিহানা, কিন্তু এর চাঁদ দু’টিকে একসঙ্গে পূর্ণ অবস্থায় দেখলে সে সইতে পারে না।
ঋক বললো, "রিহানা, আগামীকাল সন্ধেবেলা সেটলমেন্টের কমুনিটি সেন্টারে একটা গেট-টুগেদার আছে, মনে আছে তো তোমার? কাল আমি তাড়াতাড়ি ফিরব। তুমি রেডি হয়ে থেকো। একসঙ্গে যাবো দু'জনে। "
রিহানা অন্যমনস্কভাবে চায়ে চুমুক দিয়ে বলে, "আমার যেতে ইচ্ছে করে না ঋক। ভালো লাগে না, মন লাগাতে পারি না। তুমি যেও। আমি নিজের মতন থাকব যেমন সারাদিনই থাকি। কোনো অসুবিধে হবে না। আমার বরং নতুন কোনো ছবি আঁকা হয়ে যাবে।"
ঋক বলে, "তা বললে হয়? এই এখানে মাত্র এই কয়েকটা পরিবার আছি আমরা, মাঝে মাঝে দেখাসাক্ষাৎ মেলামেশা সামাজিকতা না রাখলে চলে? লোকে ভুল বুঝবে। রিহানা, বেশিক্ষণ লাগবে না, কয়েক ঘন্টার ব্যাপার। লক্ষ্মীটি, তুমি না কোরো না। এমনিতেই তো তোমাকে দেমাকী বলে অনেকে, সেটা তো সত্যি নয়। এরপর অসামাজিক বলতে শুরু করলে কি সেটা ভালো হবে?"
দীর্ঘশ্বাস ফেলে চায়ের কাপ নামিয়ে রাখে রিহানা, আস্তে বলে, "ঠিক আছে, যাবো।" তারপরে কেমন উদাসীন চোখে চেয়ে থাকে দিগন্তের দিকে, মাটির দিকে চোখ নামাতে ভুলে যায়।
নীল চাঁদটি ততক্ষণে উঠে এসেছিল দিগন্ত ছাড়িয়ে আর একটু উপরে। অদ্ভুত নীল আলো এসে পড়েছিল রিহানার মুখে। সেদিকে চেয়ে ঋকের বুকের ভিতরটা শিরশির করে উঠল কেজানে কেন।
নীলাভ জ্যোৎস্নায় কী অদ্ভুত লাগছে রিহানার মুখ! মাঝরাত্রে তীব্রতর নীল জ্যোৎস্নার সঙ্গে ঐ বড় চাঁদটির সাদা জ্যোৎস্না মিশে যখন মাতাল হয়ে যাবে চরাচর, তখন সেই আলোতে কেমন লাগবে রিহানার ঐ নির্জন মুখ?
কল্পনায় সেই মুখ দেখতে দেখতে ঋক ক্রমশঃ তার পরিপার্শ্বের বোধ হারিয়ে ফেলছিল। আশ্চর্য একটা ভয়ের সঙ্গে অপূর্ব একটা ভালোলাগা জড়িয়ে অবশ করে দিচ্ছিল তাকে।
আস্তে আস্তে সন্ধ্যার তরল অন্ধকার গাঢ়তর হয়ে রাত্রির অন্ধকার হয়ে উঠছিল আর জ্যোৎস্না তীব্রতর হয়ে উঠছিল। একসময় দিগন্তে দেখা গেল সাদা চাঁদটির প্রথম আভাস। আস্তে আস্তে শুভ্র চাঁদটিও উঠে আসতে লাগলো দিগন্তকুহেলি ছাড়িয়ে।
সেই অদ্ভুত জ্যোৎস্নায় ঘোরলাগা অবস্থায় চুপ করে বসে রইল দু'জন মানুষ, একজন নীল চাঁদের দিকে চেয়ে, অন্যজন সেই নীলচাঁদের দিকে চেয়ে থাকা মানুষটির মুখটির দিকে চেয়ে। মূর্তির মতন স্থির হয়ে।
|| ৩ ||
পৃথিবী থেকে তিনশো আলোকবর্ষ দূরের এই গ্রহ, যার নাম দেওয়া হয়েছে মীতারান। ট্রানজিট ফোটোমেট্রি আর ডপলার এফেক্ট কাজে লাগিয়ে গ্রহটি আবিষ্কার হয়েছে প্রায় এক শতাব্দী আগে, প্রথমে এর কোনো নাম ছিল না, সংখ্যা আর অক্ষর দিয়ে চিহ্নিত ছিল।
তারপরে সূক্ষ্ম অনুসন্ধানে আবিষ্কার হয় গ্রহটির আবহমণ্ডলে অক্সিজেন আছে, তখনই বোঝা যায় গ্রহে জীবজগতের থাকার মতন পরিবেশ আছে। সেই সময়েই সংখ্যা আর অক্ষরের বদলে গ্রহটির একটি সুন্দর নাম দেওয়া হয়।
তখন থেকেই গ্রহটি বিজ্ঞানীদের মনোযোগ জাগিয়ে রেখেছে। কিন্তু পাঁচ দশক আগে হাইপার-স্পেসে ভ্রমণের প্রযুক্তি করায়ত্ত হবার আগে এত দূরের গ্রহে গ্রহে অভিযান কল্পনা করাও যেত না। কিন্তু এখন শত শত আলোকবর্ষ দূরের গ্রহে গ্রহে যাতায়াত এদেশ থেকে ওদেশ ভ্রমণের মতন সহজ হয়ে গিয়েছে প্রায়।
এই প্রযুক্তিতে ত্রিমাত্রিক দেশকালকে বাঁকিয়ে এক বিন্দু থেকে আর এক বিন্দুতে যাওয়া সম্ভব হয় তাৎক্ষণিকভাবে, মাঝের দূরত্ব অদৃশ্য হয়ে যায়। যে দূরত্ব আলো অতিক্রম করে তিনশো বছরে, সেই দূরত্ব এই প্রযুক্তিতে চলা যান অতিক্রম করে নিমেষের মধ্যে।
এই গ্রহ যে নক্ষত্রকে ঘিরে পাক খাচ্ছে সেই নক্ষত্র আমাদের সূর্যের মতন G শ্রেণীর না, আরো কম উষ্ণতার, কমলা রঙের, K শ্রেণীর নক্ষত্র। তবে গ্রহটি নক্ষত্রের বেশ কাছে, আমাদের পৃথিবী সূর্য থেকে যত দূরত্বে, কেন্দ্রীয় নক্ষত্র থেকে এই গ্রহের দূরত্ব তার চেয়ে অনেক কম। তাই প্রয়োজনীয় তাপ পেতে অসুবিধে হয় না। এই গ্রহের গাছেরা কালচে সবুজ পাতাওয়ালা। কম উজ্জ্বল রোদ্দুরে সালোকসংশ্লেষ করার জন্য ওরা এইভাবে বিবর্তিত হয়েছে।
এই গ্রহে পৃথিবী থেকে প্রথম আসা অভিযানটি ছিল গ্রহ সার্ভে করার জন্য। সেটা চার দশক আগের কথা। তাদের অনুসন্ধানে চমকপ্রদ সব ব্যাপার জানা যায় মীতারান সম্পর্কে।
জানা যায় গ্রহটি যে আবহমণ্ডলে ঘেরা তা প্রায় পৃথিবীর আবহমণ্ডলের মতন, নাইট্রোজেন আর অক্সিজেনের অনুপাত প্রায় পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের মতই।
গ্রহপৃষ্ঠ বিরাট বিরাট মহাসমুদ্রে ঢাকা। মহাসমুদ্রে মাথা জাগিয়ে আছে তিনটি বিরাট স্থলভাগ অর্থাৎ তিনটি মহাদেশ। মেরুপ্রদেশে জমাট তুষার।
পৃথিবীর মতই গ্রহটির ঘূর্ণন-অক্ষ নিজের কক্ষতলে কিছুটা হেলে আছে, তাই গ্রহে ঋতু-পরিবর্তন হয়। মীতারান নিজের অক্ষে একবার পাক খেতে সময় নেয় বাইশ ঘন্টা, অর্থাৎ পৃথিবীর একদিন আর এর একদিন প্রায় সমান। নিজের সূর্যকে ঘিরে মীতারান একপাক প্রদক্ষিণ করে দু’শো দিনে।
এই গ্রহের সবচেয়ে চমৎকার বৈশিষ্ট্য হল হল এর একজোড়া চাঁদ। একটি ঘুরছে অপেক্ষাকৃত কাছের কক্ষপথে, সেটি গ্রহ ঘিরে একবার পাক খেয়ে আসতে সময় নেয় কুড়িদিন। এর প্রদক্ষিণকালকেই গ্রহে একমাস ধরা হয়। এই চাঁদটির জ্যোৎস্না নীলচে আভার।
অন্য চাঁদটি, যার জ্যোৎস্না শুভ্র, সেটি ঘুরছে একটু বড় কক্ষপথে, গ্রহ ঘিরে একবার পাক খেয়ে আসতে এর সময় লাগে পঁচিশদিন। প্রতি একশোদিন অন্তর অন্তর জোড়া চাঁদের পূর্ণিমা আসে। জোড়া চাঁদের অমাবস্যাও আসে প্রতি একশোদিন পর পর।
এইসব চমৎকার ব্যাপারগুলোর জন্যই পৃথিবীর অভিযাত্রীরা মীতারানে আসতে আগ্রহী হয় অনেকেই। প্রথমে ছোটো কয়েকটি অনুসন্ধানী-দল এসেছিল অস্থায়ীভাবে কাজ করতে। তারপরে যখন দেখা যায়, গ্রহটিতে উদ্ভিদজগৎ ও প্রাণীজগৎ থাকলেও কোনো তথাকথিত বুদ্ধিমান জীবগোষ্ঠী নেই, সভ্যতা নেই ---তখন ঠিক হয় এই গ্রহে নির্বাচিত কিছু পৃথিবীবাসী এসে বসতি গড়বে এই গ্রহের জীবজগতের সুরক্ষার সমস্ত নিয়মনীতি মেনে।
সেই অনুসারেই প্রথম পার্থিব বসতি গড়ে ওঠে দেড় দশক আগে। তারপর আস্তে আস্তে দ্বিতীয় ও তৃতীয় বসতিও গড়ে উঠেছে।
প্রথম বসতিটিতে এসেছিল মাত্র ত্রিশটি পরিবার। ছোটোবড়ো মিলিয়ে মোট সত্তরজন মানুষ। দ্বিতীয় বসতি গড়ে ওঠে পঞ্চাশটি পরিবার নিয়ে, মোট লোকসংখ্যা ছিল দু'শ। এরপরে তৃতীয় বসতিটি গড়ে তোলে আরো বেশি মানুষ, সেখানে মোট পাঁচশো মানুষ এসেছিল শুরুতেই।
কালক্রমে নতুন নতুন শিশুরা জন্মায়। এখন এই গ্রহে স্থায়ী জনসংখ্যা প্রায় আড়াই হাজার। তাছাড়া এই ঋক রিহানাদের মতন অস্থায়ী অতিথিরা আছে বেশ ক’জন, যারা কাজের জন্য এই গ্রহে এসেছে, কাজ ফুরোলেই ফিরে যাবে।
ঋক জীববিদ, আরো ভালোভাবে বললে বলতে হয় এক্সোবায়োলজিস্ট। পৃথিবীর বাইরের জীবজগৎ নিয়ে তার গবেষণা। সে এখানে কাজ করে এক বিশেষ প্রজাতির প্রাণীর উপরে। পৃথিবীর জীববিদরা এদের নাম দিয়েছ মিরাং।
এই প্রজাতি ভারী অদ্ভুত, এরা ক্ষুদ্র স্তন্যপায়ী প্রাণী, দল বেঁধে বাস করে গাছের কোটরে বা ঝোপেঝাড়ে। এদের পিঠে একজোড়া করে ডানা আছে, বাদুড়ের মতন চামড়ার ডানা।
কিন্তু এরা উড়তে পারে না বাদুড়ের মতন। অনেকটা উড়ন্ত কাঠবেড়ালিদের মতন এরা ডানা ছড়িয়ে খানিকটা গ্লাইড করতে পারে বাতাসে। ডানাওলা খরগোশের মতন চেহারার এই প্রাণীগুলো এমনিতে খুব নিরীহ।
স্টাডি করতে গিয়ে ঋক প্রতিদিনই এদের নতুন নতুন ব্যাপার জেনে বিস্মিত হচ্ছে। রিহানার সঙ্গে মাঝে মাঝে আলোচনা করে সে তার কাজ নিয়ে, রিহানা মন দিয়ে শোনে।
রিহানা একসময় পড়াশোনা করেছিল নিউরোসাইকোলজি নিয়ে। সেই পথে চলতে থাকলে সে বিজ্ঞানীই হত একদিন, কিন্তু হঠাৎ, একদম হঠাৎই সে সেই রাস্তা পাল্টে অন্য রাস্তা ধরল।
বিজ্ঞান ছেড়ে সে হয়ে গেল সাহিত্যের ছাত্রী। পাশ করে বেরিয়ে সে কিছুদিন কাজ করেছিল নামকরা সাহিত্য পত্রিকায়। একসময় সে কবিতা আর গান লিখতো, সেসব ছাপাও হত। কয়েকটি কবিতার বইও প্রকাশিত হয়েছিল তার।
হবি হিসেবে তার চিরকালই ছিল ছবি আঁকা, উলবোনা, সূচসুতো দিয়ে রুমালে, আঁচলে, টেবিলঢাকায়, পর্দায় নকশা তোলা, কুরুশের কাজ --- এইসব। সনাতনী কারুশিল্প। কোথায় যেন এইসবের সঙ্গে লেখালিখির একটা যোগাযোগ টের পেত সে।
আসলে এও তো সৃষ্টি! যা ছিল না, তাকে নিয়ে আসা। যেকোনো নতুন সৃষ্টিই হয়তো আসলে ভেতরে ভেতরে একই।
কিন্তু হঠাৎ করে লেখালিখি বন্ধ করে দেয় সে একদিন, ঐ হঠাৎ করে বিজ্ঞানের রাস্তা থেকে অন্য রাস্তায় চলা শুরুর মতন। পত্রিকার কাজটা তখনও ছিল তার, কিন্তু সে কাজও আর বেশিদিন ভালো লাগেনি।
সেই কাজ ছেড়ে সে এক বন্ধুর সঙ্গে মিলে শুরু করল ছোটোখাটো একটি ব্যবসা, নিজেদের একটি দোকান। দোকানে একপাশে কফি আর স্ন্যাকস পাওয়া যেত, অন্যপাশে ছিল নানা বইয়ের সম্ভার। দু’পাশেই প্রশস্ত বসার জায়গা ছিল।
এই কফিশপ কাম বুকশপের ব্যাপারটা খুব জনপ্রিয় হয়েছিল। বহু লোক আসতো কফি আর স্ন্যাকস খেতে খেতে বই পড়তে। এই দোকানেই একদিন ঋকের সঙ্গে দেখা হয়েছিল রিহানার।
সেই শুরু। তারপর থেকে ঋক প্রতিদিন যেতে শুরু করে ঐ দোকানে। প্রতি বিকেলে অন্তত ঘন্টাখানেকের জন্য তার সেখানে যাওয়া নিয়ম হয়ে দাঁড়ায়।
রিহানা শুরুর দিকে নিরাসক্ত ছিল, কিন্তু আস্তে আস্তে প্রধানতঃ ঋকের আগ্রহেই বন্ধুত্ব হতে থাকে তাদের।
বেশ কয়েকমাস পর বন্ধুত্ব যখন গভীর হয়েছে, তখন এক সপ্তাহান্তে ঋক রিহানাকে বেড়াতে নিয়ে গেল সমুদ্রতীরে।
সেইখানেই, নারকেলকুঞ্জের ছায়ায় বসে সমুদ্রের অবিশ্রান্ত ঢেউ ভাঙার শব্দ শুনতে শুনতে ঋক রিহানাকে বললো, "আমার নতুন অ্যাসাইনমেন্ট পড়েছে এক এক্সোপ্ল্যানেটে। তিনশো আলোকবর্ষ দূরের এক গ্রহে। সামনের মাসেই যেতে হবে।"
রিহানা সমুদ্রের দিকে চেয়ে বসেছিল। দুরন্ত হাওয়ায় ওর খোলা চুল উড়ছিল। ঋকের কথা শুনে আস্তে আস্তে মুখ ফেরাল সে। কেমন অদ্ভুত বিষন্ন গলায় বললো, "তুমি চলে যাবে? আর দেখা হবে না আমাদের?"
আস্তে আস্তে ওর বড়ো বড়ো কালো চোখ দুটো জলে ভরে উঠছিল।
ঋক থাকতে পারলো না, রিহানাকে জড়িয়ে ধরে ওর ঠোঁটে গভীর চুম্বন এঁকে দিয়ে বললো, "তুমি আমার সঙ্গে যেতে রাজি হলে সব সময়েই দেখা হতে পারে।"
রিহানা অবাক হয়, বলে, "তোমার সঙ্গে যাবো? তা কী করে হয়?? তোমার সঙ্গে কী হিসেবে যাবো?"
ঋক হাসে, বলে, "আমাদের বিয়েটা হয়ে গেলেই হিসেব এক্কেবারে মিলে যাবে। ওখানে বিভিন্ন অ্যাসাইনমেন্টে যারা যায়, সবাই পরিবার সঙ্গে নিয়ে যাবার অনুমতি পায়। তুমি রাজি থাকলে আগামীকালই রেজিস্ট্রি করে ফেলতে পারি আমরা।"
রিহানা বিস্ময়ে গোল-গোল হয়ে ওঠা চোখ নিয়ে চেয়ে থাকে খানিকক্ষণ। তারপরে হাসতে শুরু করে। এরকমভাবে যে বিবাহপ্রস্তাব আসতে পারে, সে কোনোদিন শোনেনি আগে, কল্পনাও করেনি। অথচ রাগ করারও কোনো যুক্তি নেই, ঋকের কথাগুলো এতটাই সৎ আর সরাসরি।
ঋক বুঝতে পারছিল না রিহানার হাসির অর্থ কী। সে খানিকটা উদ্বিগ্ন গলায় বললো, "রিহানা? হাসছ যে? তুমি রাজি নও? "
এবারে রিহানাও আর থাকতে পারে না, ফিসফিস করে বলে "হ্যাঁ, রাজি।"
তারপরেই ঋককে নিবিড় জড়িয়ে ঠোঁটে ঠোঁট মিলিয়ে দেয়।
|| ৪ ||
"ক্র্যাঁও ক্র্যাঁও ক্র্যাঁও..."
নিশাচর পাখির তীক্ষ্ণ ডাকে নৈঃশব্দ চিরে গেল। চমকে উঠে ঋক স্মৃতির সমুদ্র থেকে ভেসে উঠল বর্তমানে। নীল জ্যোৎস্না ততক্ষণে আরো তীব্র, সাদা জ্যোৎস্নাও বেশ জোরালো হয়ে উঠেছে। ঋক রিহানার মুখে পড়া সেই অপার্থিব দ্যুতির দিকে চেয়ে আচ্ছন্ন হয়ে বসে ছিল এতক্ষণ।
রিহানারও ঘোর ভেঙে গিয়েছিল, সে সচকিত হয়ে উঠে পড়ল। ট্রেতে কাপপ্লেটগুলো সব তুলে নিয়ে তাঁবুতে চলে গেল।
সেই রাতে মায়াবী জ্যোৎস্নায় দূরের জঙ্গল থেকে যখন চন্দ্রাহত পাখিদের আকুল ডাক ভেসে আসছিল, তখন রিহানা ঋকের বুকের মধ্যে মুখ গুঁজে দিয়ে চুপ করে শুয়েছিল।
রিহানার মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে ঋক মৃদু গলায় বলছিল, "ভয় নেই, ভয় নেই। এখন তো আমরা জানি, ওরা একটু পরেই ডাক থামিয়ে দেবে। তারপর ওরা ঘুমিয়ে পড়বে। সব ঠিক হয়ে যাবে, সব ঠিক হয়ে যাবে।"
উত্তরে রিহানা ঋককে আরো নিবিড় জড়িয়ে ধরে। সে টের পায় রিহানা অল্প অল্প কাঁপছে। শীত করছে নাকি ওর? নাকি জ্বর আসছে? নাকি শুধুই সেই অদ্ভুত ভয়?
সে বলে, "চাদরটা গায়ে দিয়ে দিই? একটু ছেড়ে দাও, চাদরটা আনি, এই তো পাশের ঝাঁপির উপরেই ভাঁজ করে রেখেছ তুমি।"
রিহানা মাথা নাড়ে দু'দিকে, কাঁপা গলায় অস্ফুটে বলে, "না, তুমি যাবে না। চাদর লাগবে না আমার। তুমি যেও না, প্লীজ।"
"ঠিক আছে, ঠিক আছে, যাবো না। তুমি ঘুমিয়ে পড়ার চেষ্টা কর। দাঁড়াও, একটা গান চালাই।"
ডান হাত বাড়িয়ে সে বিছানার কোণের কাঠের ডাণ্ডায় ঝোলানো ছোট্টো অডিওপ্লেয়ারটা চালু করে দেয় ভল্যুম কমিয়ে। স্নিগ্ধ সুরের ধারা ছড়িয়ে পড়ে তাঁবুঘরের মধ্যে। সেই সুরে আচ্ছন্ন হয়েই মনে হয় ঘুমিয়ে পড়তে থাকে রিহানা।
পৃথিবীর গান ঋককে আবার মনে করিয়ে দেয় সেইসব দিনগুলোর কথা। তাদের মীতারানে আসার আগে আগের সেই আশ্চর্য ক'টা দিন।
তাদের বিয়ের ব্যবস্থা হয়েছিল দারুণ দ্রুততায়, মাত্র তিনদিনের নোটিশে। রেজিস্ট্রি অফিসে সব কাজ হয়ে যাবার পর উভয়পক্ষের সাক্ষীদের নিয়ে একসঙ্গে রেস্তোরাঁয় খাওয়াদাওয়া। উভয়পক্ষের সাক্ষীরা সবাই বন্ধুবান্ধব। শুধু একজন ছিলেন অভিভাবক স্থানীয়, রিহানার বুকশপ-কফিশপের বিজনেস পার্টনার যে বান্ধবী, সিমিয়া, তার মাসীমা।
তো, বিয়ের অনুষ্ঠান বলতে তো এই। তবে সিমিয়া আর তার এক বান্ধবী তানিয়া, এই দু'জনে মিলে রিহানাকে মনের মতন সাজিয়েছিল রেজিস্ট্রি অফিসে আসার আগে।
তারপরেই মীতারানে আসার জন্য তাদের জিনিসপত্র গোছানোর পালা। সেই হিসেবে বলা যায় এই মীতারানেই তাদের মধুচন্দ্রিমা।
পৃথিবীর বছরের হিসেবে চার বছরের অ্যাসাইনমেন্ট ঋকের। সেই সময়ের জন্য রিহানার ব্যবসার দায়িত্ব খুব ভালোভাবেই সামলাবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল সিমিয়া, কারণ ব্যবসা তো তাদের দু'জনেরই।
কিন্তু রিহানা নিজেই তার অংশ সিমিয়াকে বিক্রি করে দিল। বলল, "পিছুটান রেখে যেতে চাই না রে সিমি, নতুন জগতে গিয়ে আমি নতুন হয়ে যেতে চাই।"
ঘুমন্ত রিহানার বালিকার মতন মুখের দিকে চেয়ে ঋকের বুকটা ছলছল করে। এমনিতে রিহানা খুব চাপা স্বভাবের, ঋকের কাছেও সেভাবে নিজের সুখ দুঃখের কথা খুলে বলে না। কিন্তু যে বিষাদ খুব ভারী, একা একা বইতে না পেরে মাঝে সেই ভার লাঘব করার জন্য বলে।
কবিতা হারিয়ে ফেলেছে বলে মাঝে মাঝে দুঃখপ্রকাশ করে রিহানা। সত্যি বহুকাল হয়ে গেল, সে আর কবিতা লিখতে পারে না। সে বলে, "ঋক, কবিতারা আর আসে না আমার কাছে। ওরা আর আসবে না কোনোদিন?"
ঋক বলে, "আসবে, আসবে, নিশ্চয় আসবে।"
সে কথা মনে পড়তেই আস্তে আস্তে ওর মাথার রেশম-নরম চুলগুলোর মধ্যে বিলি দিতে থাকে ঋক। ঘুমের মধ্যেই আরামের একটা শব্দ করে আরো এলিয়ে পড়ে রিহানা। ঋক সাবধানে ওর মাথাটা পাশের বালিশে নামিয়ে দেয়। তারপরে চুলগুলো ঘেঁটে দিতে দিতে চেয়ে থাকে ওর মুখের দিকে।
এইসব সময়ে মাঝে মাঝে তার অদ্ভুত একটা অনুভূতি হয়। মনে হয় এই রিহানাকে সে যেন আগে কোথাও দেখেছে, বহু বহু আগে। অথচ সেই বুকশপ অ্যান্ড কফিশপে দেখা হবার আগে কোনোদিন তো তাদের দেখা হয়নি! তাহলে কেন এমন মনে হয় ওর? কোনো অজানা রহস্য আছে কি এখানে?
রিহানা ঘুমন্ত আর ঋক রিহানার দিকে চেয়ে, তাই দু'জনের কেউই লক্ষ করেনি যে তাঁবুর গোল জানালার বাইরে থেকে উঁকি দিয়ে ওদের দেখছে দু'জোড়া উজ্জ্বল চকচকে কৌতূহলী চোখ।
একজোড়া মিরাং। চুপি চুপি এসে কৌতূহল মেটাচ্ছিল। তারা জানতো না, তাদের প্রজাতির স্ফুটনোন্মুখ বুদ্ধিমত্তার প্রথম লক্ষণ, এই কৌতূহল। তারা বিবর্তিত হচ্ছিল দ্রুত, প্রজন্মের পর প্রজন্মে লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়ে উঠছিল কৌতূহল আর পর্যবেক্ষণ-ক্ষমতা।
একটু পরে, যখন ঋক অডিওপ্লেয়ার বন্ধ করে দিল, তখন মিরাং দু'টি বাতাসে গ্লাইড করে চলে গেল জঙ্গলের মধ্যে।
|| ৫ ||
"মিরাং পূর্ণিমা কাকে বলে জানো, রিহানা?" ঋক প্রশ্ন করে।
ইতিমধ্যে কেটে গিয়েছে এক বছরের বেশি, এই গ্রহের বছর অবশ্য পৃথিবীর বছরের চেয়ে অনেকটাই ছোটো। তবু এরই মধ্যে অনেক আত্মস্থ হয়ে গিয়েছে রিহানা। এখানকার অধিবাসীদের আয়োজিত নানা উৎসব-অনুষ্ঠানেও সে যায় আজকাল ঋকের সঙ্গে।
আজ রিহানা ছবি আঁকছিল, সামনে টুলে বসে চায়ে চুমুক দিতে দিতে ওর ছবি আঁকা দেখছিল ঋক। ঋকের প্রশ্ন শুনে ওর তুলি থেমে যায়।
তুলি সরিয়ে রেখে মুখ ফেরায় রিহানা, ওর চোখে সপ্রশ্ন চাহনি। বলে, "না তো, জানি না। মিরাং পূর্ণিমা! কী অদ্ভুত নাম! কোনো বিশেষ পূর্ণিমা? আর মিরাং সেই প্রাণীরা না, যাদের তুমি স্টাডি করো?"
"হুঁ, একদম তাই। সেইজন্যেই আমার কাছে এত ইম্পর্ট্যান্ট এই ব্যাপারটা। পৃথিবীর মানুষরা যারা এই মীতারানে বাস করছে, তারা লক্ষ করেছে, মীতারানের একজোড়া চাঁদের একটা বিশেষ পূর্ণিমা আসে কয়েক বছর পর পর, তখন নীল চাঁদটা সাদা চাঁদকে ঢেকে দেয়। চাঁদে চাঁদে গ্রহণ। ওই গ্রহণ হতে হতেই ঐ জোড়া চাঁদ পড়ে মীতারানের ছায়ায়। আবারো গ্রহণ। ডবল গ্রহণ বলা যায়। সেই সময়ে দলে দলে মিরাং গিয়ে সমুদ্রে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করে। অদ্ভুত কাণ্ড।"
“ওঃ” বলে অস্ফুট একটা আওয়াজ করে রিহানা চোখ বিস্ফারিত করে ঋকের দিকে চেয়ে থাকে খানিকক্ষণ। তারপর আবার ছবির দিকে চোখ ফেরায়। ওর ছবিতে অপরূপ এক সূর্যোদয় দেখা যাচ্ছে, উদয়-দিগন্তের কাছে মেঘগুলো গোলাপী।
ঋক কথাটা বলে ফেলেই অপ্রস্তুত হয়েছিল, হঠাৎ ওর মনে পড়ে গিয়েছিল রিহানার মা যখন আত্মহত্যা করেন, তখন রিহানা তার কৈশোরে। হয়তো সেই যন্ত্রণার স্মৃতি ফিরে আসে যেকোনো আত্মহত্যার উল্লেখে। এমনিতে ঋক খুব সাবধানে থাকে, কোনোদিন কোনো আত্মহত্যাপ্রসঙ্গ তোলে না।
কিন্তু আজ, উত্তেজনায় ভুল হয়ে গিয়েছে। এখন আর উপায় নেই। কথা চালিয়ে যেতে হবে, থেমে যাওয়া আরও বেশি বিপজ্জনক।
একটু চুপ করে থেকে সে বলে, "কথাটা অবশ্য স্থানীয় কিংবদন্তীও হতে পারে। কোনো সায়েন্টিফিক রিপোর্টে এই ব্যাপারটার উল্লেখ পাইনি। অথচ মিরাং বিষয়েই আমার স্পেশালাইজেশন। হ্যাঁ, মিরাংদের সংখ্যার বেড়ে ওঠা, তারপরে আচমকা কমে একেবারে খুব অল্প সংখ্যক হয়ে যাওয়া, এই ওঠানামার ব্যাপারটা রেকর্ডেড। কিন্তু এই মিরাং-পূর্ণিমার বিশেষ ব্যাপারটার উল্লেখ কোনো রিপোর্টে পাইনি। "
রিহানা তার ছবিতে আলতো তুলি বুলিয়ে রঙ দিতে দিতে বলে, "আজ কী করে তবে জানতে পারলে?"
ঋক বলে, "আজকে স্থানীয় একজন সহকর্মীর সঙ্গে মিরাং পপুলেশন নিয়ে কথা হচ্ছিল। মিরাংদের সংখ্যা খুব বেড়ে গিয়েছে গত কয়েক মাসে। তো, সেই সহকর্মী, তিনি এখানে আছেন একেবারে প্রথম থেকে, দেড় দশক ধরে, তিনি আনমনা হয়ে বলে ফেললেন, ‘সামনেই যে মিরাং-পূর্ণিমা!’ ব্যস, আমিও চেপে ধরলাম ব্যাপারটা কী জানার জন্য। তিনি তখন সব বললেন। তবে এও উল্লেখ করলেন, এ জিনিস সায়েন্টিফিকালি স্টাডি করা হয়নি, স্থানীয় কিংবদন্তীও বলা যায় একে। আরো বহুবার পর্যবেক্ষণ করতে পারলে তবে সায়েন্টিফিক রিপোর্টে যেতে পারে। ব্যাপারটা কয়েক বছরে একবার করে আসে বলে, এর সায়েন্টিফিক স্টাডি সোজা কথা নয়। এই তো প্রথম বসতি তৈরী হবার সময় থেকে আজ পর্যন্ত এই এত বছরে মিরাং-পূর্ণিমা এসেছে মাত্র তিনবার। সামনেরটা হবে চতুর্থবারের মিরাং-পূর্ণিমা।"
ছবিতে রঙ বোলাতে বোলাতেই রিহানা জিজ্ঞেস করে, "কবে? সামনের মিরাং-পূর্ণিমা কবে?"
উত্তেজনা-সংহত গলায় ঋক বলে, "আর মাত্র সাতদিন পরেই। ভাবতে পারো রিহানা? আমাদের এই গ্রহে থাকার সময়ের মধ্যে এরকম একটা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটা খুবই চমৎকার একটা ব্যাপার। ভাবো, পরের মিরাং-পূর্ণিমা যদি আরো কয়েক বছর পরে হতো, তাহলে এর কোনো হদিশই পাওয়া হত না।"
অন্যমনস্কভাবে রিহানা বলে, "হ্যাঁ, খুবই চমৎকার যোগাযোগ। ব্যাপারটা দু'দিক থেকে গুরুত্বের, অ্যাস্ট্রোনমির দিক থেকে আবার বায়োলজির দিক থেকেও যদি এই কিংবদন্তীর মধ্যে সত্য থাকে।"
ঋক এবারে উত্তেজনা পুরোপুরি লুকোতে পারে না, বলে, "একদম ঠিক কথা বলেছ। সেই পূর্ণিমার দিন বিকেল থেকে সমুদ্রতীরে ক্যাম্প বসবে। অ্যাস্ট্রোনমাররা যাচ্ছেন, বায়োলজিস্টরাও যাচ্ছেন। স্থানীয় স্কুলের শিক্ষক শিক্ষিকারা যাচ্ছেন ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে।
“গ্রহণ শুরু হবে সন্ধের ঘন্টাখানেক পর, আস্তে আস্তে নীল চাঁদ ঢাকবে সাদা চাঁদকে, পূর্ণগ্রহণ কয়েক মিনিট, এটা অবশ্য বলয়গ্রাস, সাদা চাঁদের অ্যাঙ্গুলার সাইজ নীল চাঁদের চেয়ে বেশি। ওই চাঁদে চাঁদে গ্রহণ হতে হতেই অন্যদিক থেকে মীতারানের ছায়া পড়তে থাকবে, একসঙ্গেই ওরা ঢুকে পড়বে ছায়ায়।"
রিহানা হঠাৎ তুলি নামিয়ে রেখে পুরোপুরি ঋকের দিকে ফিরে দাঁড়ায়। উৎসাহে তার চোখ জ্বলজ্বল করছে। সে বলে, "আমি সেদিন যাবো সমুদ্রতীরে। ঋক, নেবে আমায় তোমার সঙ্গে?"
ঋক অবাক হয়ে চেয়ে থাকে রিহানার জ্বলজ্বলে চোখের দিকে। চায়ে চুমুক দিতে ভুলে যায়।
কিছুক্ষণ পর আস্তে আস্তে বলে, "তুমি যাবে? কোনো অসুবিধে হবে তো তোমার এই অবস্থায়?"
রিহানা অন্তঃসত্ত্বা, অবশ্য খুবই আর্লি স্টেজ। মাত্র মীতারানের তিনমাস কেটেছে। মীতারানেও পৃথিবীর মেয়েরা পৃথিবীর ২৮০ দিন হিসেবেই গর্ভধারণ করে যদিও মীতারানে সেই সময়টা প্রায় বছর দেড়েক।
রিহানা অল্প হাসে, বলে, "না না কোনো অসুবিধে হবে না।" সত্যিই শুরুর দিকের কিছু অনিবার্য উপসর্গ বাদ দিলে কোনোরকম অসুস্থতাই তার নেই এখন।
এখানকার ডাক্তার মহিলা, ডক্টর মেলিন্দা শোয়ার্জ, যিনি রিহানাকে শুরু থেকেই দেখছেন তিনি খুবই সন্তুষ্ট। প্রোবে যমজ ভ্রূণের ছবি যখন প্রথম দেখা গেল, তখন রিহানা আর ঋকের চেয়েও বেশি খুশি হয়েছিলেন তিনি। মীতারানে এই প্রথম যমজ শিশুর সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। এর আগে মীতারানে যেসব মানবশিশু জন্মেছে, সবাই একক শিশু।
রিহানার দিকে চেয়ে ঋকের মন এখন আশায় আশঙ্কায় দোল খায়। সন্তান জন্মালে হয়তো রিহানা আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠে পুরনো সব দুঃখ একদম ভুলে যাবে। কিন্তু যদি কোনো বিঘ্ন হয়… যদি কোনো অভাবনীয় বিপদ এসে উপস্থিত হয় …
এইসব অনিশ্চয়তা, এইসব ভয় … কে-জানে হয়তো মানবজীবন মানেই এই। সে যত দূরেই যাওয়া যাক না কেন, যত উন্নতই হোক না কেন টেকনোলজি …
তাঁবুর সামনের খোলা জায়গাটায় যেখানে রিহানা ছবি আঁকছিল আর ঋক চা খেতে খেতে গল্প করছিল, সেই জায়গাটার পাশেই যে মস্ত গাছটা, তার ঝুপসি পাতাভরা একটা ডালের উপরে বসে তাদের লক্ষ করছিল একজোড়া মিরাং।
সেই মিরাং দু'টি, অনেক আগের এক রাত্রে তাঁবুঘরের জানালার বাইরে থেকে সন্তর্পণে উঁকি দিয়ে যারা ওদের দেখছিল। সেই তখন থেকেই ওরা লক্ষ করে চলেছে ঋক রিহানাকে। মানুষের ভাষা তারা বোঝে না, কিন্তু ভাবভঙ্গি থেকে বুঝে নিতে পারে অনেক কিছুই।
|| ৬ ||
দেখতে দেখতে এসে গেল দিনটা। সকাল থেকেই ব্যস্ত সবাই। সারা রাতের জন্য সমুদ্রতীরে ক্যাম্প হবে, দুপুর থেকেই একের পর এক দল যাচ্ছে সাগরতীরে। তিনটি বসতিই সমুদ্রতীর থেকে কাছে। ভালো রাস্তাও তৈরি করছেন অধিবাসীরা, গাড়িতে ঘন্টা দেড়েক মতন লাগে।
ঋক আর রিহানা দু'জনে যাচ্ছে বায়োলজিকাল ইনস্টিটিউটের জীপে করে, ঋক নিজেই চালাবে। ওরা ক্যাম্প করবে সমুদ্র-সৈকতের বালির থেকে একটু দূরে উঁচু পাথুরে একটা অঞ্চল আছে, সেখানে।
ক্যাম্পগুলো সবই হচ্ছে সমুদ্রের বালুতীর থেকে বেশ দূরে দূরে, কারণ যুগ্ম চন্দ্রের মহাকর্ষীয় আকর্ষণে যে জোয়ার আসবে, তা ডুবিয়ে দেবে সম্পূর্ণ বালুতীর।
রিহানার স্বাস্থ্যগত নিরাপত্তার ব্যাপারে ঋক অবশ্য খুব হুঁশিয়ার। দু'দিন আগেই ডক্টর শোয়ার্জের অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়েছিল রিহানার জন্য। উনি ভালো করে সব কিছু চেক করে বলে দিয়েছেন কোনো অসুবিধে নেই, রিহানা সম্পুর্ণ সুস্থসবল আছে, ক্যাম্পিং-এ কোনো বাধা নেই।
তবুও একটা খটকা ঋকের রয়েই গিয়েছে। রিহানা স্বাভাবিকের চেয়ে কম কথা বলছে গত কয়েকদিন। অবশ্য মাঝে মাঝে ওর এরকম মিতভাষণের অবস্থা আসে, কেটেও যায়।
গতকাল ঋক যখন ফিরছিল ফিল্ডওয়ার্ক সেরে, তখন তার একটা অদ্ভুত অভিজ্ঞতা হয়। সে দূর থেকে দেখেছে তাঁবুর সামনে গাছের নিচে যে প্রিয় জায়গাটায় বসে রিহানা কুরুশ বোনে, সেইখানেই সে বসে বসে কুরুশ বুনছিল, কিন্তু তার কাঁধের উপরে বসেছিল একটি মিরাং আর হাঁটুর উপরে বসেছিল আর একটি মিরাং। রিহানা একদম স্বাভাবিক ছিল, যেন মা তার দুটি সন্তানকে কাঁধে আর কোলে নিয়ে বসে বসে কুরুশ বুনছে।
ঋক যখন অনেকটাই দূরে, তার পায়ের শব্দ পাবার কথা না, তখনই মিরাং দু’টি কিভাবে যেন টের পেয়ে যায়, দুজনেই লাফিয়ে উঠে বাতাসে গ্লাইড করে জঙ্গলের মধ্যে চলে যায়।
ঋক পৌঁছলে রিহানা একদম স্বাভাবিকভাবে উঠে প্রতিদিনের মতন চা-জলখাবার এনে দিল, গল্প করল, যেন সবই একরকম আছে। ঋক ভাবছিল তাহলে কি সবই তার চোখের ভুল? সে রিহানাকে জিজ্ঞেসও করতে পারছিল না সরাসরি।
এক সময়ে গল্প করতে করতে আলগাভাবে বলেছিল, "আচ্ছা রিহানা, তুমি এখানকার জুলজিকাল পার্কে তো মিরাং দেখেছ আগে। এই তাঁবুর কাছাকাছি কোনো মিরাং দেখেছ কোনোদিন? ওদের বেশিরভাগ বসতিই অবশ্য পাহাড়ের ওপাশে। তবে মাঝে মাঝে একটা দুটো যে এসে পড়বে না তার তো কোনো গ্যারান্টি নেই।"
রিহানা চোখ না তুলেই মাথা নেড়ে না জানিয়েছিল। এই বিষয়ে সে আর কোনো কথাও বলেনি, চা-জলখাবার শেষ করেই চালিয়ে দিয়েছিল পুরনো একটা প্রিয় মুভি।
এখন এই বিকেলে জীপ চালিয়ে ক্যাম্পসাইটে যাবার পথে সেই ব্যাপারটা আবার মনে পড়ছিল ঋকের, মনের মধ্যে অস্বস্তির কাঁটাটা খচখচ করে উঠছিল। পাশে বসা রিহানা কিন্তু ফুরফুরে আনন্দের মেজাজে ছিল, গুনগুন করে গান গাইছিল।
আকাশ ঝকঝকে পরিষ্কার, কমলা রোদ্দুরে দিগন্ত থেকে দিগন্ত পর্যন্ত ঝলমল করছে। মাঝে মাঝেই এ বন থেকে ও বনে উড়ে যাচ্ছে পাখির ঝাঁক। সমুদ্রের দিক থেকে প্রাণজুড়ানো হাওয়া বয়ে আসছে।
দেখতে দেখতে ঋকের মন থেকেও আশঙ্কা দূর হয়ে যাচ্ছিল। এমন সুন্দর দিনে দুশ্চিন্তা করার কোনো মানে হয় না।
যতই সমুদ্র কাছিয়ে আসে, ততই হাওয়ায় পাওয়া যায় সমুদ্রের গন্ধ। তারপরে দেখা দেয় সমুদ্র। আদিগন্ত নীল জলরাশি। ঢেউয়ের পর ঢেউ আসছে আর আছড়ে পড়ছে সৈকতের বালির উপরে, এই সৈকতে বালি হাল্কা লালচে রঙের।
সেই রাঙা বালির উপরে সাদা ফেনার ফুল ছড়িয়ে রেখে ঢেউয়েরা ফিরে যাচ্ছে আবার সমুদ্রে। আর রেখে যাচ্ছে চিত্রবিচিত্র ঝিনুক, বড়ো বড়ো শিরাতোলা সাতরঙা শঙ্খ, ছোটো ছোটো মাছ, জলজ আরো নানা প্রাণী।
রক্তাভ-বেগুণী কাঁকড়ার দল থাকে বালির তলায়, সার বেঁধে ওরা বেরোয়, যেই না কারুর সাড়া পায়, অমনি লুকিয়ে পড়ে বালির তলায়।
ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি বালির উপরে দৌড়াচ্ছে আর তীক্ষ্ণ গলায় ডাকছে। মাঝে মাঝে উড়ছে আর জল থেকে ছোঁ মেরে মাছ ধরছে। যেন নানা প্রাণের নাটক অনবরত অনুষ্ঠিত হয়ে চলেছে সাগরসৈকতে।
রিহানার জায়গাটা সত্যি পছন্দ হয়েছিল। বললো, "ঋক, প্রতিটা ছুটির দিনেই কেন সমুদ্র দেখতে আসি না আমরা?"
ঋক হাসে, বলে, "তুমি তাই চাও? বলোনি তো আগে? তাহলে এখন থেকে আসবো প্রায়ই।"
সৈকত দেখা হয়ে যাবার পর জীপ চালিয়ে ঋক এবারে চললো ক্যাম্প সাইটের দিকে। বেশ উঁচুতে সাইট, বালুতীরের পর পাথুরে একটা উঁচু অংশ, তাও পার হয়ে বড়ো বড়ো নারকেল গাছের মতন দেখতে গাছের সারি। সেই বৃক্ষসারির পাশে জীপ পার্ক করে তারই পাশে তাঁবু খাটালো ঋক।
আধঘন্টার মধ্যে হয়ে গেল সব। তাঁবুর সামনে ফোল্ডিং চেয়ার পেতে বসে তারা দেখলো দূরে নিচে বিছিয়ে থাকা সাগরসৈকত আর বিশাল নীল সমুদ্র।
রিহানা বললো, "কী অপূর্ব জায়গা! বাকি জীবনটা এখানেই থেকে যেতে ইচ্ছে করছে।"
উত্তরে ঋক শুধু হাসে। তার মন থেকে ভার অনেক নেমে গিয়েছে। রিহানা অনেক কথা বলছে, তার মানে ওর মন ভালো হয়েছে।
|| ৭ ||
অস্তদিগন্তে মীতারানের কমলা সূর্যটি ডুবে যাবার সঙ্গে সঙ্গেই বিপরীতে উদয়দিগন্তে উঠে এল নীল চাঁদটি। গোল পূর্ণ চাঁদ, মুহূর্তে মুহূর্তে জ্যোৎস্না তীব্রতর হয়ে উঠতে লাগল সন্ধ্যার অন্ধকার ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে।
তারপর উদয় হল সাদা চাঁদটির। পূর্ণ চাঁদের মায়া ছড়িয়ে সে উঠতে লাগল।
প্রথম চন্দ্রোদয়ের সঙ্গে সঙ্গেই রিহানা আবার স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে। চেয়ারে বসে নীরবে চেয়ে আছে আকাশের দিকে। জোরালো জ্যোৎস্নায় তারারা ক্ষীণ হয়ে গিয়েছে, শুধু খুব উজ্জ্বল কয়েকটি তারা জ্বলজ্বল করছে এদিকে ওদিকে।
সমুদ্র থেকে রহস্যময় এক হাওয়া বইতে শুরু করেছে, সেই হাওয়া গাছেদের পাতায় পাতায় ফিসফিস করছে।
শত শত মিরাং এসে জমা হচ্ছে নিচের সাগরসৈকতে। বাতাসে গ্লাইড করে করে আসছে ওরা, কখনও একটি করে, কখনও দু'টি করে একসঙ্গে, কখনও একসঙ্গে একদল। নীরবে এসে বসছে বালির উপরে।
নীল চাঁদটি সাদা চাঁদকে ঢাকতে শুরু করতেই সমুদ্রের হাওয়া বদলে গেল। মর্মরধ্বনির ভাষাও বদলে গেল। সাদা জ্যোৎস্না কমছে, নীল জ্যোৎস্না আরও রহস্যময় হয়ে উঠছে। সাগরসৈকতের পাখিরা স্তব্ধ হয়ে গেছে। দূরের জঙ্গলের পাখিরা কান্নার মতন ডেকে উঠছে।
অন্যপাশ থেকে মীতারানের কালো ছায়া পড়ে আসতে লাগলো ওদের উপরে। আসলে ওরাই ঢুকে পড়ছিল গ্রহের ছায়ায়।
সমুদ্রের ঢেউ আসছে, যাচ্ছে। আর একটু পরেই আসবে ভরা কোটালের বান। সেই জোয়ার ডুবিয়ে দেবে সমস্ত সৈকত, জল চলে আসবে পাথুরে ডাঙার কাছে।
অসংখ্য মিরাং স্থির হয়ে বসে আছে বালুতীরে, একটুও নড়ছে না। ওরা বসে আছে ওই জোয়ারের জলে ডুবে যাবার জন্য। নীল জ্যোৎস্নায় ওদের শরীরগুলো অদ্ভুত দেখাচ্ছে।
একসময় চাঁদে চাঁদে গ্রহণ সম্পূর্ণ হল। নীল চাঁদটি তখন সাদা চাঁদের বুকের উপরে, শুধু তার নীল দেহ ঘিরে সরু একটা বলয়ের মতন দেখা যেতে লাগলো সাদা চাঁদের অংশ। জোড়া চাঁদ ততক্ষণে অর্ধেকের বেশি ঢুকে গিয়েছে গ্রহের ছায়ায়।
ভীমকল্লোল জেগে উঠল সমুদ্রে। বিশাল বিপুল পর্বতপ্রমাণ ঢেউ ছুটে আসছে। জোড়া চাঁদের টানের ভরা কোটালের বান।
সেই মুহূর্তে চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে ওঠে রিহানা। ওর চোখ জ্বলজ্বল করছে।
ঘোরগ্রস্তের মতন সে বলতে থাকে, "ঋক, ঋক, ওরা ডাকছে আমায়। হ্যাঁ, এখন আমি বুঝতে পারছি ওদের ভাষা। তোমায় আমি বলিনি ঋক, দুই মিরাং-এর সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব হয়েছে, তারা প্রত্যেক বিকেলে আমার কাছে আসে। তুমি ফেরার আগেই চলে যায়। ওরা ডাকছে আমায়। এই কবিতাহীন, দুঃখী দিনরাত থেকে মুক্তি নিয়ে চিরন্তন আনন্দের মধ্যে মিলিয়ে যেতে ডাকছে। আমি আসছি, আমি আ-আ-আ- স ছি ই-ই- ই।"
বলতে বলতে রিহানা মন্ত্রমুগ্ধের মতন ছুটে যেতে থাকে পাথুরে জায়্গাটার দিকে, সেইটুকু ডাঙা পেরোলেই সৈকতবালুকা শুরু।
বিশাল জোয়ারের জল ঢেকে দিচ্ছে গোটা সৈকত। শত শত মিরাং অদ্ভুত কান্নার মতন আওয়াজ করতে করতে ডুবে যাচ্ছে সাগরের জলে।
ঋক এতক্ষণ অডিও-ভিসুয়াল রেকর্ডারে তুলছিল সমস্ত দৃশ্যাবলি ও ঘটনা। রিহানাকে ছুটে যেতে দেখে সে হাতের যন্ত্রপাতি সব ফেলে ছুটে আসে রিহানাকে ধরতে। কিন্তু রিহানা ততক্ষণে প্রায় পৌঁছে গিয়েছে ফুলেফেঁপে ওঠা সমুদ্রের কাছে।
দূর থেকে ঋক শুধু দেখতে পেয়েছিল রিহানার জলে ঝাঁপ মারার দৃশ্যটা। সে "রিহানা আ আ আ" বলে চিৎকার করে উঠে বাঘের মতন লাফ দিয়ে পার হল দূরত্ব, এসে পড়ল পাথুরে ডাঙার প্রান্তে।
তখন পাথুরে ডাঙার প্রান্তে ছলছল করছে জল। আদিগন্ত অশ্রু যেন। চরাচরে অজানা রহস্য থমথম করছে।
"রিহানা আ আ" বলে আর একবার ডাক দিয়ে ঋক ঝাঁপিয়ে পড়ল জলে। দূরে কার যেন একটা মাথা একবার ভেসে উঠেই আবার ডুবে গেল। ঋক সেদিকে সাঁতরাতে লাগল।
দূরের জঙ্গল থেকে ভেসে এল পাখিদের অদ্ভুত ডাক। সমবেত কান্নার মতন সেই ডাক। শুনলেই বুকের ভিতরে তুষার পড়তে থাকে।
গ্রহের ছায়ায় তখন সম্পূর্ণ ঢেকে গিয়েছে চাঁদ দুটি, ছায়ার ভিতরে ফ্যাকাশে রক্তাভ দেখাচ্ছে ওদের। আকাশে নক্ষত্রদল জ্বলজ্বল করছে অসংখ্য প্রহরীর চোখের মতন।
সাঁতার দিতে দিতেই ঋক আর একবার মাথা তুলে দেখার চেষ্টা করল কোথাও রিহানার চিহ্ন দেখা যায় কিনা। কোথাও কিছু নেই।
সে আবার ডাক দিল "রিহানা- আ- আ", উত্তরে ভেসে এল শুধু সমুদ্রের গর্জন আর হাওয়ার আর্তনাদ। আর জঙ্গলের পাখিদের রহস্যময় কান্নার আওয়াজ।
তারপরেই ঋক জ্ঞান হারায়। তার অচেতন দেহ ঢেউ থেকে ঢেউয়ের হাতে হাতবদল হতে হতে ভেসে যেতে থাকে।
সেখানে সমুদ্রের বুকে মাথা জাগিয়ে আছে কালো কালো শিলা, কোনোটা লতাপাতায় ঢাকা, কোনো কোনোটা একেবারে ন্যাড়া।
জোয়ারের ঢেউ অচেতন ঋক আর রিহানাকে এনে ফেলল লতাপাতা ঢাকা একটা বিশাল শিলায়।
|| ৮ ||
ঋক যখন জ্ঞান ফিরে পেল তখন গ্রহণের রাত কেটে গিয়েছে। সে জেগে উঠল ভোরবেলায়, ঠিক যখন উদয়দিগন্তে উঠে আসছে কমলা সূর্যটি।
জ্ঞান ফিরে পেয়েই সদ্য ওঠা সূর্যের আলোয় সে দেখতে পেল রিহানার অচেতন দেহ, তার কাছ থেকে মাত্র কয়েক হাত দূরে। সে উঠে এসে রিহানার পালস দেখল প্রথমে, হ্যাঁ, বেঁচে আছে রিহানা।
হাতির কানের মতন বড়ো বড়ো পাতাওয়ালা একটা লতা ছিল কাছেই। ঋক তার একটা পাতা তুলে গোল ভাঁজ দিয়ে শঙ্কু আকৃতির একটা পাত্র বানিয়ে ফেলল। তারপর সেই পত্রপাত্রে সমুদ্রের জল এনে আস্তে আস্তে জলের ঝাপ্টা দিতে লাগল অচেতন রিহানার চোখেমুখে।
রিহানা জ্ঞান ফিরে পেল কয়েক মুহূর্ত পরেই। চোখ মেলে ঋকের দিকে চেয়ে চুপ করে রইল খানিকক্ষণ, তারপর আস্তে আস্তে ওর চোখে পরিচয়ের আলো ফুটে উঠল। অস্ফুটে বলল, "ঋক।" ঋকের বাড়ানো হাত ধরে উঠে বসল সে।
মীরাং-পূর্ণিমার বিহ্বল, দিশাহারা, ভয়াবহ গ্রহণরাত্রি পার হয়ে সূর্যধোয়া সমুদ্রশিলায় নবজন্ম হল ঋক আর রিহানার। ভোরের আলোয় পাখিরা ডাকছিল, সুরেলা আনন্দে ভরা সেই ডাক, নরম গানের মতন।
ঋক নিজের পোশাকের ভেতরের পকেট থেকে ওয়াটারপ্রুফ প্যাকেটে রাখা কমুনিকেশন ডিভাইস বার করে আনে। খবর দিতে হবে ইনস্টিটিউটে, খবর পেলেই উদ্ধারকারীরা এসে পড়বে।
রিহানা ততক্ষণে অনেকটাই সুস্থ। উঠে বসেছিল তো আগেই, এবারে উঠে দাঁড়াল। তারপরে ফুরফুরে মনে ভোরের তাজা হাওয়ায় পায়চারি করতে শুরু করল। গুনগুন করে একটা গানের কয়েক লাইন গেয়ে ফেলল।
ওদিকে ঋকও ততক্ষণে খবর দিয়ে ফেলেছে ইনস্টিটিউটে, কিছুক্ষণের মধ্যেই উদ্ধারকারী হেলিকপ্টার এসে পড়বে তাদের তুলে নিতে।
গুনগুন করে অচেনা গান গাইতে গাইতে ঋকের কাছে এসে এতকাল পরে এই প্রথম আনন্দের হাসি হেসে উঠল রিহানা। বলল, "ঋক, আমরা দু'জনেই বেঁচে গিয়েছি!"
রিহানাকে আলতো জড়িয়ে ধরে ওর কানের কাছে মুখ নিয়ে ঋক ফিসফিস করে বলল, "দু'জন না, আমরা চারজনেই।"