।। ১ ।।
নার্সিং হোমের চারতলায় শীততাপনিয়ন্ত্রিত ওয়েটিং এরিয়ায় বসে থাকতে থাকতেই সুমনার ফোন আসছিল। মেয়ে। কিন্তু আওয়াজটা কেটে কেটে যাচ্ছে, নেটওয়ার্কের গণ্ডগোল। জয়া জানালার কাছে গেলেন, লবির এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত কোথাও দাঁড়িয়েও যখন সিগনাল পেলেন না, তখন দুত্তোর বলে লিফটে উঠে পড়লেন। সঙ্গে রুনি, তার হাত শক্ত করে ধরা মুঠির মধ্যে। পরের মেয়ে। আট কি নয়।
নিচে এসে বাইরে দাঁড়াতেই শরতের অভ্যর্থনা। কদিন লাগাতার বৃষ্টির পর আজ আকাশে সত্যি সত্যি একফালি মেঘের মাফলার গলায় জড়িয়ে সূর্যদেব উঁকি দিয়েছেন। আজ সপ্তমী। বৃষ্টি থেমেছে বলে বেলা দশটাতেই অধৈর্য জনতার ঢল নেমেছে শহরের রাজপথে।
একটা গাড়ী মেরামতের দোকানের সামনে চওড়া ফুটপাথের দিক থেকে পাইপের আগায় সাবানজল নিয়ে বুদ্বুদ ওড়াচ্ছে ছেঁড়া জামাপরা একটা বাচ্চা। সম্ভবত পথশিশু। রামধনু রঙের ছোট, মাঝারি মাপের বুদ্বুদগুলি শিমুল তুলোর মত ভাসতে ভাসতে তাঁদের সঙ্গেই পার হয়ে যাচ্ছিল হাজরা রোড। এক আধটা চটপট ফেটে মিলিয়ে যাচ্ছিল হাওয়ায়। কিন্তু তাতে কি... প্রতি মুহূর্তেই নতুনের দল এসেই ছড়িয়ে পড়ছিল একই ভাবে। জনস্রোতের মতই। প্রত্যেকে তার দুঃখ-সুখের নিজস্ব বুদ্বুদে ভেসে চলেছে। যেমন তাঁর নিজের বুদ্বুদটির অভ্যন্তরে এখন শুধু উদ্বেগ ও আশঙ্কা। ছোট জা সুহাসকে আজ দিন দুই হল এই নার্সিং হোমে ভর্তি করতে হয়েছে। পুজোটা এবার হাসপাতাল-ডাক্তারখানা করেই কেটে যাবে মনে হয়। তাও মন্দের ভাল সুমনা আজই এসে পৌঁছবে, দেওরপো বিজুকেও খবর দিতে হয়েছে, বলা তো যায় না।
অথচ, তিন-চারদিন আগেই, তৃতীয়ার দিন ওপরের ফ্ল্যাট থেকে ফোন করে সুহাস বলেছিল, দিদি, খেলাটা শেষ না হয়ে পড়ে রয়েছে। দুটো গুটি ওঠা বাকি এখনো। খেলবে?
মন মেজাজ ভালো থাকলে, দুই জায়ে লুডোর ছক পেতে বসেন। কিন্ত বয়স তো জানান দেবেই। তাঁর নিজের আটাত্তর, সুহাসের বাহাত্তর। তাছাড়া সাপের খেলা এক একদিন শেষ হতেই চায় না, নিরানব্বইএ গিয়ে বার বার সাপের খপ্পরে পড়ে, শেষে ক্লান্ত হয়ে দুজনেই উঠে পড়েন, ঘুঁটিগুলো ওরকমই সাজানো পড়ে থাকে, খেলাটা পরে কখনো শেষ করা হয়, ধীরেসুস্থে। কিস্তিবন্দী খেলার এরকম ব্যবস্থা দুই বুড়িরই খুব পছন্দ।
কিন্তু সেদিন জয়া ফস করে রেগে গিয়েছিলেন, না। তোর সকালেই জ্বর এসেছিল না? শুয়ে শুয়ে থাক। আসলে সুহাসের জ্বরের খবরে উদ্বেগেই ছিলেন। এখন সিঁড়ি ভেঙে এসে লুডো খেলে আবার জ্বর বাড়লে সামলাবে কে! ডেঙ্গু হচ্ছে খুব এপাড়ায়।
সুহাস তখন মিনমিন করে বলেছিল, রাত্রে কি তোমার জন্যও দুটো রুটি করিয়ে নেব? ঝর্ণা আছে এখনো।
—না। অম্বলের জ্বালায় মরছি, আবার রুটি। তোর কাছে প্যানফর্টি থাকলে দুটো বরং ঝর্ণার হাতে পাঠিয়ে দিস তো।
রাতের রান্নার পাট চুকে গিয়েছে অনেকদিন। সকালের রান্নার সাথে একটা দুটো হাতে গড়া রুটি কি সকালের বেঁচে যাওয়া ভাতই গরম করে চালিয়ে নেওয়া। মাইক্রোওয়েভটা সুমনা জোর করে শিখিয়েছিল, তাতেই চালিয়ে নিচ্ছেন। নইলে এই হাঁটু নিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গ্যাসে খাবার গরম করাই কি পোষাতো। তাতেও সবদিন শেষরক্ষা হয় না। ব্যথা বাড়লে সুহাসকে ফোন করেন, সুহাস তুলনায় শক্তপোক্ত, সে এসে সামলে দেয়। মানে কদিন আগে অব্দি দিতে পেরেছে।
উদ্বেগ ছাড়াও আরেকটা কারণে সেদিন মেজাজ খিঁচড়ে ছিল জয়ার। মেয়ে এমনিতে সারা বছরই ব্যস্ত, ফার্ন রোডের ফ্ল্যাট থেকে থিয়েটার রোডের আপিস এই করেই তার সকাল সাতটা থেকে রাত নটা কেটে যায় সারা বছর। জয়া পুজোর এই কটা দিনের জন্য উৎসুক হয়ে অপেক্ষা করে থাকেন, মেয়েটা এ’কদিন এ বাড়িতেই এসে থাকবে, অফিস, যেটুকু না করলে নয় সেটুকু সেরে আবার এ বাড়িতেই ফিরে আসবে...শখ করে রান্না ঘরে ঢুকবেন, নাড়ুও বানানো যেতে পারে কয়েকটা। এর মধ্যেই একদিন সকাল সকাল বেরিয়ে কলেজ স্ট্রীট আর বাগবাজার সার্বজনীন দেখে আসবেন। সুহাসের একটিমাত্র ছেলে, সেও বিদেশে। কাজেই সুহাসকেও টানাটানি করে বের করবেন ঘর থেকে। কটা ঠাকুর দেখে বেড়ালেও যেন মনে হয় বেঁচে আছি।
কিন্তু সেদিন মেয়ে ফোনেই জানালো, অফিসের কাজে ঢাকায় যাচ্ছি, সপ্তমীর দিন সন্ধেয় ফিরবো। কিচ্ছু করার নেই মা, মন খারাপ কোরো না।
—না না ঠিক আছে। তাহলে নাহয় এয়ারপোর্ট থেকে সোজা এখানেই চলে আসিস।
—পাগল হয়েছ? কাপড়জামা আনতে হবে না? লন্ড্রিতে দিয়ে আসতে হবে না ছাড়া কাপড়-চোপড়? তাছাড়া বিজিত আসছে ওই দিন। দুপুরে একসাথে খেতে যাবো বলেছিলাম, অবশ্য যদি সময়মত ফিরি।
জয়া বলতে যাচ্ছিলেন, কয়েকটাই তো ঘন্টা। আমার আলমারিতেও তো শাড়ির অভাব নেই, কিন্তু কিছুই বললেন না। বিজিতের আসাটাই বড় হল, পুজোর দিনে মার কাছে কি আসতে নেই!
মুখে বললেন—তাহলে অষ্টমী-নবমী এখানে এসে থাকবি তো?
মেয়ে কি বুঝলো কে জানে, একটু চুপ করে থেকে বললো, আচ্ছা মা, একটা কাজ করি? বিজিতকে নবমীর দিন দুপুরে তোমার ওখানেই ডাকি? খাবার বানাতে হবে না, দোকান থেকে আনিয়ে নেব। গরম করে নিলেই হবে।
—দেখ, যা ভাল মনে করিস।
মনে মনে বললেন, এবার আর পুজো-টুজো...।
বিজিত অনেককাল আগে সুমনার সাথে একই কোম্পানিতে ইনটার্ন হয়ে ছিল। ছেলেটাকে জয়ার ভালই লাগতো, অন্তত তখন। তারপর সে অন্য চাকরি নিয়ে কোথায় চলে যায়, বিয়ে করে, বিয়ে ভেঙেও যায়... সব খবর জয়া সুমনার থেকেই পেয়েছেন, ছেলেটাও ভালই, কিন্তু তাই বলে বচ্ছরকার দিনে কোথায় মেয়েটার সাথে একটু কথা বলে কাটাবেন তা না, তৃতীয় ব্যক্তির উপস্থিতিতে মেপে মেপে কথা বলে কাটাতে হবে।
তাছাড়া আরেকটা কথা জয়া ঠিক মেয়েকে বলে উঠতে পারেন না—বিজিতের সঙ্গে সুমনার আবার যোগাযোগ হয়েছে জেনে তাঁর অস্বস্তি হচ্ছে। এ কথা জানলে মেয়ের যে কি প্রতিক্রিয়া হবে তিনি ঠিক ভেবে উঠতে পারেন না। মেয়েকে যতটাই চেনেন, ততটাই চেনেন না।
তৃতীয়া এসে গেলেও বৃষ্টির বিরাম ছিল না তখনো, জানালা দিয়ে যেটুকু আকাশ দেখেছিলেন, তা ধুলো পড়া কাচের শার্সির মতন, মলিন। তবে ওই আকাশটুকুই যা এক আছে, পুরোনো বাড়িটা আর নেই... প্রোমোটারের হাতে পড়ে তার নায্য বাটোয়ারা হয়ে এখন বহুতল, ওপর তলায় সুহাস আর তার ছেলের ফ্ল্যাট, নিচের তলায় জয়া আর তার মেয়ের। নগদ টাকাও পাওয়া গেছিল, সুবন্দোবস্তই বলা চলে... সুমনা আর দেওরের ছেলে দুজনে শলা-পরামর্শ করে ব্যবস্থা করেছে।
এই বাড়িতে সুমনার ফ্ল্যাটটা বন্ধই পড়ে থাকে, জয়ার সে দিকে তাকাতে পর্যন্ত ইচ্ছে করে না। সুমনা কিছুতেই তার ফার্ন রোডে নিজের ব্যাঙ্ক লোনে কেনা বাড়ি ছেড়ে এসে এখানে পাকাপাকি থাকবে না। কয়েকবার বোঝানোর চেষ্টা করে জয়া হাল ছেড়ে দিয়েছেন, বেশি চাপাচাপি করতে গেলে মেয়েটা যদি হায়দ্রাবাদ কি ব্যাঙ্গালোর চলে যায়। কলকাতার কিসসু হবে না শুনে তো কান পচে গেল। বিজুর তো গ্রীন কার্ড হয়ে গেল এবছর। আজকাল ছেলেমেয়েদের মতিগতি বোঝা ভার।
দুত্তোর বলে বারান্দায় গিয়ে মোড়ায় বসে পাড়ার পুজোর তোড়জোড় দেখতে বসে গেছিলেন জয়া। ওইটা মুদ্রাদোষ। অপছন্দ হলেই, দুত্তোর।
।। ২ ।।
নার্সিং হোমের সামনে বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলেন জয়া। মেয়ের ফোন অবশ্য তারপর আর এল না। সে হয়তো কাজ গুটোতে ব্যস্ত, কে জানে, তার বুদ্বুদটি বিদেশের মাটিতে কেমন ভাবে ভাসছে। আজই সন্ধ্যার উড়ান। অবশ্য ঘরের পাশের বাংলাদেশকে বিদেশ বলতে যেন কেমন-কেমন লাগে। নিজের চোখে না দেখলেই বা। পূর্বপুরুষের দেশ বলে কথা।
কি করণীয় ভাবতে ভাবতেই জয়া খিদেটা অনুভব করলেন। তাড়াহুড়োয় বাড়ি থেকে কিছু খেয়ে বেরোনো হয় নি। কিন্তু খিদেটা জানান দিতে লেগেছে বেলা দশটা বাজতে না বাজতেই। কিছু একটা খেয়ে না নিলে অ্যাসিডিটি হয়ে যাবে, গলার গোড়ায় জ্বলুনিতে সারাদিন বসে থাকা দায় হয়ে যাবে। মিষ্টির দোকানটা থেকে দুজনের জন্য দুটো করে সন্দেশ নিলেন। দোকানটা অবশ্য জরাজীর্ণ, তাতে বসে খাবার একটা দুটো কাঠের টেবিল, প্লাস্টিকের চেয়ার থাকলেও সেগুলোর বয়স তাদের জেল্লার অভাবেই জানান দিচ্ছে, কিন্তু এখন ওসব দিকে ঠিক তাকানোর মত অবস্থা নয়।
রুনি অবশ্য একটার বেশি খেতে পারল না, সে ব্রেকফাস্ট করেছে, একটাই সন্দেশ, তাও খেলো বেজার মুখ করে। সন্দেশ-রসগোল্লা চকোলেট চানাচুর... কোনো খাবারেই তার বিশেষ আগ্রহ নেই। জয়ার বসার ঘরে বইয়ের আলমারিতে, যেখানে সুমনার ছোটবেলার গুচ্ছেরখানিক বই আছে, সুকুমার সমগ্র, বিশ্বকোষ, টিনটিনের কমিক্স আরো কি কি সব। বাড়িতে যতক্ষণ থাকে, সেই আলমারির সামনে নাওয়া-খাওয়া ভুলে পড়ে থাকে রুনি। মোটা ফ্রেমের চশমার আড়ালে তার চোখ দুটি প্রায় দেখাই যায় না। বাড়িতে যে একটা আট-ন বছরের বাচ্চা রয়েছে কে বলবে!
কিন্তু মেয়েটার চারদিকে একটা নিস্পৃহতার কঠিন, অদৃশ্য আবরণ আছে, জয়া দেখেছেন। বন্দুকের গুলি তেমন তেমন শক্ত দেওয়ালে গিয়ে ধাক্কা মেরে যেমন ফিরে আসে, ঠিক সেরকম একটা পাথরের দেওয়াল যেন। অন্তরঙ্গতা বা নির্ভরতা ব্যাপারটাই যেন তার অজানা। এই তো আজ সকালেও রুনির ব্রেকফাস্ট সাজাতে সাজাতে তার অবাধ্য চুলের গুছি দেখে আর থাকতে না পেরে বলেই ফেলেছিলেন, আজ বেরুনোর আগে তোরটা চুলটা বেঁধে দি। যা ভেবেছিলেন, তাই হল। বেয়াড়া মেয়েটা নড়ল না। মুখে বললো, আমি প্ল্যাট করতে জানি। আমার চিরুনিটা আনা হয় নি। না, ঠিক রাগ হয় নি, বরং মেয়েটার মুখে পাকা পাকা কথায় জয়া মজাই পেয়েছিলেন। তিনি বললেন, তাতে কি, আমি তো একটা দিদা, আমার চিরুনি দিয়ে চুল আঁচড়ে বেঁধে দিচ্ছি। তার আগে ডিম সেদ্ধ খা, হরলিক্স খা, তারপর দেব’খন।
—আমি হরলিক্স খাই না। তোমার চা থেকে একটু দেবে?
—তুমি চা খাও? তোমাকে তোমার বাবা পারমিশন দেয়?
—সুমনা আন্টি এলে দেয়, একটুখানি।
সুমনা বিজিতের বাড়িতে গিয়ে বিজিতের মেয়ের সাথে চা ভাগ করে খায়, শুনে জয়া থমকালেন। সুমনা আন্টি কি ব্রেকফাস্টেই গিয়ে উপস্থিত হয়, না রাতেও থাকে, চা কখন ও কিভাবে শেয়ার করে ইত্যাদি জানবার তীব্র ইচ্ছাকে দমন করলেন মনে মনে। কী জিজ্ঞেস করতে কী বেরিয়ে আসবে কে জানে। আজকাল বিয়ে ছাড়াই কত কিছু হচ্ছে। হজম করতে পারবেন না যখন, কী দরকার তথ্য সংগ্রহ করে।
এখন দোকানে বসে দুটো মিষ্টি খাবার পর একটু চা-চা করছিল প্রাণটা, কিন্তু সকালের সেই কথোপকথন মনে পড়াতে সেই ইচ্ছেটার গলা টিপলেন ।
চতুর্থীর রাত আটটা সাড়ে আটটা নাগাদ যখন রাতের খাবারের জন্য রুটি আর তরকারি বের করে রাখছিলেন জয়া, ঠিক তখনই আবার সুহাসের ফোন এসেছিল।
—দিদি, আসতে পারবে একটু।
—কেন? কি হল ?
—আমার শরীরটা বেশ খারাপ লাগছে, মাথাতেও প্রচণ্ড ব্যথা, ডাক্তার দেখালে ভাল হয়।
জয়ার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। পুজোর জন্য রাস্তা জোড়া প্যান্ডাল, এই রাস্তায় গাড়ি ঢুকবে কি ভাবে? তাছাড়া সঙ্গে যাবার জন্য কাকে পাবেন এই উৎসবের কলকাতায়? চারতলার ঘোষরা বেড়াতে গিয়েছে, উল্টোদিকের কানোড়িয়ারাও নবরাত্রি পালন করতে গিয়েছে বড়বাজারে, তাদের পুরোনো পৈতৃক বাড়িতে... নিরুপায়, হতবুদ্ধি জয়া মেয়েকেই ফোন করলেন, মেয়ে শুনেটুনে খুব শান্তভাবেই বলল — দেখছি।
জয়া নিজের কাছে রাখা চাবি দিয়ে সুহাসের ফ্ল্যাটের দরজা খুলে গিয়ে জ্বর হাত দিয়ে আন্দাজ করার চেষ্টা করলেন, প্যারাসিটামল নিয়ে গেছিলেন, তাই দিলেন, তারপর একটা ব্যাগে সুহাসের মেডিকাল ফাইল, কাপড়জামা, টাকা, কার্ড সব গুছিয়ে নিতে নিতেই মোবাইল বেজে উঠল। একটা অচেনা নম্বর।
—মাসিমা, আমি বিজিত। দশ মিনিটের মধ্যে আসছি।
বিজিত এল বেশ তাড়াতাড়িই। এমবুলেন্স সঙ্গে করেই। কিন্তু সঙ্গে একটা আট নয় বছরের ছোট মেয়েও। হাতে একটা ব্যাগ, তাতে সম্ভবত তার কাপড়-জামা, বইখাতা। চোখে মোটা চশমা, চেহারায় ক্লান্তির ছাপ। বেশ বোঝা যায়, তার ঘুমোতে যাবার সময় অতিক্রান্ত।
জয়ার সপ্রশ্ন দৃষ্টি অনুসরণ করে বিজিত একবার তার দিকে তাকিয়ে ম্লান হাসল, মাসিমা, আমার মেয়ে। আমরা একলাই থাকি তো, তাই ওকে সঙ্গে করে আনতে হল। রুনি, এই দিদাকে প্রণাম কর।
মেয়েটা প্রণাম করবার জন্য নিচু হতেই জয়া যেন সম্বিত ফিরে পেলেন, মেয়েটার চিবুকে যান্ত্রিকভাবে হাত ছুঁইয়ে চুমু দিয়েছিলেন একটা। বিজিতের যে একটা মেয়েও আছে, কই সুমনা বলে নি তো কখনো!
সুহাসের ইসিজিতে কিছু এবনর্মালিটি তেমন ধরা পড়েনি। কিন্তু জ্বর তিন দিনের বেশি বলে ম্যলেরিয়া আর ডেঙ্গু, দুটোরই টেস্ট করার ব্যবস্থা হল। ভর্তি করা ছাড়া উপায় ছিল না। বিজিত জয়াকে আর মেয়েকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে নিজে ফের চলে গেল নার্সিং হোমে।
ডাক্তারি পরীক্ষায় ডেঙ্গু বা ম্যালেরিয়া কোনোটাই পাওয়া যায় নি। কিন্তু সুহাসের জ্বর কমে নি, শ্বাসের একটা কষ্ট, কাজেই সেই থেকে মোটামুটি একই রুটিন চলছে। সকাল হলে জয়া আর রুনি চটপট তৈরি হয়ে নেন। বিজিত এসে ব্রেকফাস্ট করে দুজনকে নার্সিং হোমে পৌঁছে দিয়ে অফিসে চলে যায়। আবার সন্ধের দিকে এসে তাঁদের বাড়িতে ছেড়ে নিজে চলে যায় নার্সিং হোমে। সুহাস, ডাক্তারি পরিভাষায়, অথবা আমলা-ডাক্তারের ভাষায় স্টেবল বাট ক্রিটিকাল। সারাদিন জয়া ঠায় বসে থাকেন, কখনো-সখনো ওষুধ আনতে হলে খোঁড়াতে খোঁড়াতে তাও সেরে ফেলেন।
বইয়ের পাতায় মুখ ডুবিয়ে পাশের চেয়ারটিতে রুনি চুপটি করে বসে থাকে। খুব ম্যাচিওরড মেয়ে বলতে হবে। সারাদিন বসে থেকেও তার কোন বিকার নেই। মুখে কথাটি নেই। বাড়িতেও রুনির কোন দাবিদাওয়া নেই। ছটফটানি নেই। কারো কাছ থেকেই যেন তার কিছু চাইবার নেই।
জয়ার নিজের মেয়ে? নাঃ, সে একদম অন্যরকম। একরোখা, স্বাধীনচেতা, তার চাওয়া এবং আদায় করে নেওয়া—দুই-ই একদম স্পষ্ট, ভানহীন, অসঙ্কোচ। পড়াশুনা, ক্যরিয়ার এগুলো নিয়ে কোন আপস তার চলবে না। বি এ পাশ করেই একটা বিজ্ঞাপন এজেন্সিতে ঢুকেছিল সুমনা। তারপর সব ছেড়েছুড়ে কোম্পানি সেক্রেটারিশিপ পড়া...বহুজাতিক ব্যাঙ্কে যোগ দেওয়া...এইসব করতে করতেই কেটে গেল দশ-বারো বছর। ইতিমধ্যে কর্তা, দেওর দুজনেই ছবি হয়ে গিয়েছেন। সুমনা এখন পঁয়ত্রিশ, আজকের দিনের হিসেবে বিয়ে করার পক্ষে খুব দেরি না হলেও, সে উদ্যোগ নেবে কে? সময় কোথায় তার? জয়ারও শরীর-সামর্থ্য কোনোটাই নেই ...অনলাইন ঘটকালিতেও বিশেষ ভরসা নেই। কাজেই এই ব্যপারটা উদ্যত খড়্গের মত দুশ্চিন্তা হয়ে জয়ার মাথার উপর ঝুলে আছে। সুমনার একটা মনোমত সংসার হলে ভাল লাগত জয়ার।
কিন্তু তাই বলে বিজিতের আনাগোনাটাও তাঁর ঠিক মনোমত ছিল না, বরং বাড়তি উৎকন্ঠার কারণ। দোজবরে শব্দটা মাথায় ঘুরঘুর করে, কাঁটার মত ফুটতে থাকে। তার ওপর আবার আগের পক্ষের মেয়ে...অথচ সুমনা কেমন সহজে বিজিতকেই দায়িত্ব দিয়ে দিল। মনে হয় যেন, মেয়ে আলগা হয়ে গিয়েছে। দেওরপো বিদেশে তার অন্বিষ্টের সাধনায় ব্যস্ত। কর্তারা কেউ নেই। সুহাস হাসপাতালের বিছানায়। এখন তিনি আর বিজিত, অনাত্মীয় দুটি প্রাণী হাসপাতালের পরিভাষায় "পেশেন্ট পার্টি"।
প্রতিদিন বাড়ি থেকে বেরোনোর সময় কর্নার টেবিলে সাজানো, আধখেলা লুডোর ছকটার দিকে তাঁর চোখ পড়ে, আর কিরকম একটা করে ওঠে। ও সুহাস, সেদিন আরেকটু জোর করলে তো পারতিস। আর কি কখনো লুডোর ছক পেতে বসতে পারবো আমরা?
—তুমি কাঁদছো কেন? ওই আন্টিটা কি আর বাঁচবে না? রুনির প্রশ্নে জয়ার রুদ্ধ আবেগ যেন হঠাৎ বাঁধ ভেঙে বাইরে এসে পড়ে, চোখের জল আর বাধা না মেনে টুপ টুপ করে ভোরের শিশিরের মত হয়ে যায়। বিজিতের বিবাহ-বিচ্ছিন্না স্ত্রী নাকি মেয়েটার মেয়েটার কাস্টডি পর্যন্ত চায় নি, ফিরে দেখে নি বেরিয়ে যাওয়ার সময়। একথা সেকথায় বিজিত বলে ফেলেছিল। তা, চাইলে বিজিত কি আপত্তি করতো? করতো না? মায়ের সান্নিধ্যের অভাবেই কি মেয়েটা তাড়াতাড়ি বড় হয়ে পড়েছে?
জয়া অবাক হলেন এই ভেবে যে মেয়েটাকে এখন আর তত বেয়াড়া মনে হচ্ছে না তো! মুখখানিতে যেন কি এক মায়া মাখানো! খুব চেনা!
—ও কিছু না, আন্টিটা খুব কষ্ট পাচ্ছে তো, তাই খারাপ লাগছে। নিজেকে সামলালেন জয়া, মিষ্টির দাম মিটিয়ে জয়া আবার নার্সিং-হোমমুখো হলেন।
।। ৩ ।।
জয়ার রান্নাখাওয়া ঘরসংসার আজকাল বিষ লাগে। ঝর্ণা সুযোগ বুঝে ডুব দেয়। সিঙ্কে বাসনের পাহাড় জমে থাকে। কিন্তু বাড়িতে তাঁর ভরসায় একটা বাচ্চা। তাঁকে উঠতেই হয়। তার মুখের সামনে ঠিক ঠিক সময়ে খাবার ধরতেই হয়।
তবে আজকে বাড়ি ফিরে একটাই স্বস্তি পেলেন জয়া। ঝর্ণা এসে রান্নাটুকু করে, বাসন মেজে রেখে চলে গেছে। একটা চাবি ওর কাছেই থাকে। সুমনার কাছে কিছু বাড়তি সুবিধা পায়, সুমনাকে সমীহও করে তাই। নিশ্চয় জেনেছে, কাল সুমনাদিদি আসবে, সুটসুট করে চলে এসেছে। ডাল রুটি তরকারি গরম করে নিলেন, ফ্রিজে একটা শসা উঁকি দিচ্ছে, স্যালাড না হোক, শসার কুচি একটু নুন দিয়ে তো খাওয়াই যেতে পারে।
সুমনার সন্ধের ফ্লাইটটা কি একটা গোলমাল আছে বিজিত বলেছিল। ওভারবুকিং না কি সব, কাজেই দেরী হতে পারে। সুমনার ইন্টারন্যাশনাল রোমিং নেটওয়ার্কের কি কারণে ঝামেলা করছে, সে আর ফোন করতে পারে নি, বিজিতকে একটা অচেনা নাম্বার থেকে হোয়াটস অ্যাপে জানিয়ে দিয়েছে। টিভিতে পুরস্কার পাওয়া সর্বজনীন পুজোগুলো দেখাচ্ছিল, টিভি চালিয়ে দিয়ে খেতে বসলেন। খাবার পাট চুকতে চুকতে আজ এগারোটা বেজে গেল। নিচে তখন উত্তাল জনসমুদ্র, সপ্তমীর মহানগরীর।
সুহাসকে নার্সিং হোমে ভর্তি করে প্রথম রাতে বাড়ি ফিরে বক্সখাটের গহ্বর থেকে আরেক জোড়া ধবধবে সাদা ওয়াড় পরানো বালিশ আর একটা চাদর বের করেছিলেন জয়া, মশারি টাঙিয়ে তারপর রুনিকে ডেকে বলেছিলেন, চল, আমরা ঘুমিয়ে পড়ি।
রুনি কিন্ত নড়ল না। গম্ভীর মুখে বলল, আমি এই সোফাতেই শোবো।
—সে কি! মশা কামড়াবে যে!
—আমি বাড়িতেও সোফাতেই শুই।
খুব রাগ ধরে গেছিল জয়ার, একে সুহাসকে নিয়ে চিন্তা, তার ওপর এই দুপুর রাতে বেয়াড়া মেয়ের নখরা, কিন্তু মুখে আর কিছু বলেন নি। খুঁজেপেতে একটা মশা তাড়ানি লাগানো হল বটে, কিন্তু ওসবে কেমন কাজ হয় সন্দেহ। গিয়ে শুয়ে পড়লেন, সারা সন্ধের উদ্বেগ আর ক্লান্তির জন্য রাতটা যেমন-তেমন করে কেটে গেল। তারপর থেকে এই ব্যবস্থাই চলছে। জয়ার মনটা খচখচ করে, কিন্তু পরের মেয়ের জন্য উদ্বেগ করা এক কথা, আর তার ওপর জোরজার করা আরেক কথা। জয়া রাগতে গিয়েও থমকে যান। তাছাড়া এক পরের ছেলেরই তো ভরসা এখন। সকাল বেলায় মেয়েটার হাতে-মুখে মশার কামড়ের দাগ আছে কি না দেখার চেষ্টা করেছিলেন, নজরে পড়ে নি কিছু অবশ্য।
।। ৪ ।।
মণ্ডপে ভিড়ের চাপে ক্রমাগত পিছিয়ে যাচ্ছিলেন জয়া। কর্তা, দেওর আর বিজু পুরুষদের লাইনে...তাদের দেখতে পাওয়ার প্রশ্নই নেই। কিন্তু সুহাস? সুমনা? বেশ কিছুটা দূর পর্যন্ত শক্ত করে ধরেছিলেন সুমনাকে, সুহাসও ছিল পাশেই।
কিন্তু কিসের এক প্রবল ধাক্কায় সুমনার হাত তাঁর হাত থেকে বেরিয়ে গেল। সামনের জমি অনেকটা ঢালু, জনতার বেগের সাথে তাল রেখে চলতে না পারলে পিছনের লোকের পায়ের নিচে পড়ে যাওয়ার আশঙ্কায় তিনি চিৎকার করছিলেন, সুমনাআআআ...সুহাআআআআস, আর ক্রমাগত মূল জনস্রোতের বাইরে চলে আসবার চেষ্টা করছিলেন। গলা ভেঙে যাচ্ছে। সুহাস সেই একই তরঙ্গের মাথায় মাথায় ভেসে যাচ্ছে...অথবা বলা ভালো সমুদ্রের ঢেউয়েরই মত সেই উত্তাল তরঙ্গ তাকে তুলে নিয়ে চলেছে কোনো নির্দিষ্ট গন্তব্যে।
এক ঝলক মনে হল সুমনাকে দেখলেন, লাল সিল্কের ফ্রক, কাকে হাত যেন উঁচু করে দেখাচ্ছে জলভরা ফুচকা...ভিড়ের দিকে কোনো মনোযোগই নেই তার। আর ঠিক তখনই যেন সারা পৃথিবী দুলতে শুরু করল। জনতার মধ্যে হাহাকার। দমকলের ঘন্টি শুনতে পাচ্ছেন জয়া অথচ হঠাৎই যেন চলচ্ছক্তিহীন হয়ে গেছেন। ঘন্টা বেজেই যাচ্ছে, কিন্তু ঠিক দমকলের মত না, অনেক মিহি সুরে...হালকা বাজনার মত।
ধড়মড় করে উঠে বসলেন জয়া। লাল সিল্কের ফ্রক সুমনা পেয়েছিল আট বছরের জন্মদিনে। কর্তা প্রথমবার বিদেশযাত্রায় গিয়ে এনেছিলেন।
তবে কি ওটা কলিং বেল ছিলো? সুমনা এলো? কোনো রকমে হাউসকোট জড়িয়ে খোঁড়াতে খোঁড়াতে সদরের ম্যাজিক আই-তে চোখ রাখলেন। কোথায় কি! সব ভোঁ-ভাঁ। তাও দরজা খুলে সেফটি ডোরের পিছন থেকেই একবার ডাকলেন, সুমনা।
নিজের গলাই ফ্যাঁসফেসে শোনালো, কেঁপে গেল শেষদিকটায়। তাহলে তো কলিং বেল নয়!
মোবাইলেও কোনো মিসড কল দেখাচ্ছে না, ল্যান্ড লাইনটা কি তবে বেজে বেজে থেমে গেল! মুশকিল হচ্ছে এই, সেটটাতে কলার আই ডি নেই। কাজেই আবার ফোন আসা অব্দি অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই।
প্যাসেজ থেকে সোজা বাথরুমে গেলেন। বয়সের সাথে এই একটা ব্যাপার খুব জ্বালাতন করছে। দেরী করতে পারেন না কিছুতেই। এইসব বাধ্যবাধকতা নিয়ে যে কিভাবে নার্সিংহোম আর ঘর করছেন তিনিই জানেন।
বাথরুম থেকে ফিরে জল খেয়ে বসার ঘরে গেলেন। আর তখনই চোখে পড়ল দৃশ্যটা। আলো জ্বালানো না থাকলেও ঘরে ঠিক নিশ্ছিদ্র অন্ধকার ছিল না। বাইরের আলো পর্দার ফাঁকফোকর দিয়ে ঘরে ঢুকে একটা মায়াবী আলো-আঁধারি বিছিয়ে দিয়েছে।
রুনি সোফার ওপরে গুটিশুটি মেরে শুয়ে আছে। তাঁর দেওয়া ধবধবে সাদা চাদর, ওয়াড় পরানো বালিশে নয়, স্রেফ একটা কুশনে তার মাথা একদিক কাত হয়ে আছে। পুজোর আলোকসজ্জার একটুখানি ছটা কুন্ঠিতভাবে তার মুখের কিনারা অব্দি এসে অপেক্ষা করে আছে। অন্য ঘরটাতেও গিয়ে শুতে রাজি হয় নি মেয়েটা। বারবার পীড়াপীড়ি করা সত্ত্বেও। বলেছিল, আমার সোফাতে শুতেই ভাল লাগে।
অথচ এখানে মশারি টাঙানোর কোন ব্যবস্থা নেই। জয়া চাদরটা নিয়ে এসে রুনির গায়ে চাপিয়ে দিতে গিয়ে লক্ষ্য করলেন, সোফায় পাতা রুনির নিজের তোয়ালের নিচে কি একটা চকচক করছে।
এতক্ষণে ব্যাপারটা পরিষ্কার হল তাঁর কাছে। রুনির বিছানা ভিজিয়ে ফেলার অভ্যাস আছে। জয়ার নিজেরও ছিল। খুব ছোটবেলায় মাতৃস্থানীয় কারো সাথে শুতে দস্তুরমত লজ্জা পেতেন। বাড়িময় রাষ্ট্র হয়ে যেত, প্রভাতের মাইয়া আবার বিস্না ভিজায়া ফ্যালছে।
অথচ বাবাকেই বা কতটুকু কাছে পেতেন। বাইরের জগতের যুদ্ধ সেরে এসে বাবা একান্নবর্তী সংসারে তাঁর নির্দিষ্ট জায়গায় ঢুকে পড়তেন। পুরুষমানুষের নিজের মেয়েকে নিয়ে আদিখ্যেতা করার রীতি তাঁদের পরিবারে ছিল না। মুশকিলটা হচ্ছে, মায়েরা সেই অভাবটুকু মিটিয়ে দিলে পুরুষমানুষদের নিত্য প্রয়োজনও পড়ে না এসব ক্ষেত্রে। কিন্তু সে তো অন্যদের ক্ষেত্রে। বালিকা জয়ার মা তো দেওয়ালে একটা ছবি, কখনো কারো সান্ত্বনায় আকাশে একটা তারা... বাড়ীর অন্যান্য পাঁচটা মেয়ের সাথে বড় হয়ে উঠলেও আসলে তিনি একলাই। এবাড়িতে এসে সুহাসের সাথেই প্রথম বন্ধুত্বের আস্বাদ পান। রক্তের সম্পর্কের আশ্রয়ে নয়, পাতানো আত্মীয়তায়।
তিনি আর সুহাস বধূবেশে এই বাড়িতে এসে ঢুকেছিলেন ঠিক তিন বছরের ব্যবধানে। পুরোনো আমলের দোতলা শ্বশুরবাড়িটার সামনেই একটা নিমগাছের পাতা ঝিরঝির করে কেঁপে যেত, তার একটা ডালে প্রায়শঃই কাকের বাসা বানানো দেখা যেত। দুই জায়ে দেখতেন, বাচ্চাটা হাঁ করে আছে আর মা-কাক এসে পরম স্নেহে তার লাল-লাল হাঁ-টির মধ্যে খাবারের দলা ঢুকিয়ে দিচ্ছে, বাচ্চাটা বড় হতে থাকলে আস্তে আস্তে একসময় ঠিক বোঝা যেত, ওটা কাকের বাচ্চা নয়। মানে মানুষ মায়েরা ঠিক বুঝতে পারতো, বোকা কাকটা কিন্তু তখনো একই রকম ভাবে খাবার নিয়ে আসতো। দুই তরুণী জায়ে তখন এই নিয়ে কত হাসাহাসি করতেন।
কি করে যে ভুলে ছিলেন!
রুনিও একলা, রুনি জানে। অন্যের বাড়িতে অপ্রীতিকর কিছু না ঘটে তাই চুপিচুপি অয়েলক্লথ পর্যন্ত ব্যাগে বয়ে নিয়ে এসেছে মেয়েটা। তাই জয়া শতবার বলা সত্ত্বেও আলাদা জায়গায়, অয়েলক্লথ বিছিয়ে শুয়েছে যাতে সকাল হলেই দুর্ঘটনার সাক্ষ্য-প্রমাণ লোপ করে দেওয়া যায়।
রুনির চশমাটা সাইড টেবলে উল্টো করে রাখা। পাশেই অসমাপ্ত লুডোর ছক পড়ে আছে, হয়তো সুহাসের অপেক্ষায়। আজ বাড়ি ফিরে লুডো খেলতে চেয়েছিল মেয়েটাও। মানা করেছিলেন। বলেছিলেন রাত হয়ে গেছে। আসলে সুহাসের সাজানো ঘুঁটি, সুহাসের সাথেই খেলাটা শেষ করবেন বলে রেখে দিতে চেয়েছিলেন।
টনটন করছিল জয়ার বুকের ভেতরটা। রুনি এমনভাবে সোফার শরীরে লেপ্টে আছে, ওই সোফা যেন তার মা। শরীরে ক্ষমতা থাকলে মেয়েটাকে কোলে করে নিজের বিছানায় নিয়ে যেতেন। তার বদলে ওর গায়ে চাদরটা বিছিয়ে দিয়ে তার ওপর একটা হাত রেখে, সোফায় হেলান দিয়ে মেঝেতে পা ছড়িয়ে বসে থাকলেন, চোখ থেকে বইতে থাকলো মমতার প্রস্রবণ। রুনি জেগে উঠলে লুডো না হয় ওর সঙ্গেই খেলবেন। তাছাড়া তিনজনেও তো খেলা যায়।
একটা কাক ডেকে উঠলো কি? ভোর হচ্ছে।