আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে গভীরভাবে নিরীক্ষণ করতে লাগলেন অসীমবাবু। চোখের নিচের চামড়াটা কি একটু কুঁচকে গেছে? মুখে নতুন বলিরেখা। চোখটাও কেমন যেন ঘোলাটে লাগছে। একরাশ শঙ্কা নিয়ে মাথার সাদা চুলের ঘনত্ব মাপতে শুরু করলেন তিনি। মনে বড়ো সন্দেহ তাঁর, বুকের মধ্যে ভয়।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজের দুই হাত খুঁটিয়ে দেখতে শুরু করলেন অসীমবাবু। হাতের চামড়াটাও কেমন যেন ঝুলে গেছে। চামড়াতে একটা খসখসে ভাব। নখগুলো একটু কালচে।
মনের সন্দেহটা কাকে বলবেন বুঝতে পারছিলেন না। ওদিকে বেলা বাড়ছে। বাজারের থলেটা হাতে নিয়ে হাসি হাসি মুখে বউয়ের কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন — ‘বলি গিন্নী, কি আদেশ আজ আমার জন্য?’
— ‘বাবা রে, সকাল সকাল এত আদিখ্যেতা কিসের। ঝোলাটা বাইরে বের করে রেখে দিয়েছি। বাজারের লিস্টটাও ওর মধ্যে আছে। দেখে নাও।’
— ‘তোমার কি মনে হয়? আর কত দিন এই শরীর নিয়ে আমি হাট বাজার করতে পারবো।’
— ‘আর কতদিন মানে?’ বউয়ের মুখে একরাশ বিস্ময়।
— ‘বয়স তো হচ্ছে দেখতে পাচ্ছ। পঁয়তাল্লিশে পড়লাম গিয়ে।’
— ‘বয়স! মোটে পঁয়তাল্লিশ বছর বয়স আর কথা বলছ ষাট-সত্তরের বুড়োর মতো।’
— ‘না মানে বলছিলাম কি বয়সটা তো বাড়ছে। দেখো না মাথার চুলগুলো কেমন বেশি সাদা হয়ে গেছে। চোখের নিচের চামড়াটাও একটু ঝুলে গেছে। আর হাতটা দেখো কেমন কুঁচকে গেছে।’
নাকমুখ কুঁচকে অসীমবাবুর গিন্নী একবার ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত দেখলেন।
— ‘আজকাল চোখেও কেমন যেন ঝাপসা দেখছি।’ অসীমবাবু বলেই চলেছেন।
— ‘থামো তুমি। বাজার যেতে না চাইলে গোবিন্দকে পাঠাচ্ছি। অত বাহানা দিতে হবে না।’
বাজারের থলে হাতে নিয়ে অসীমবাবু বেরিয়ে পড়লেন। সত্যি ভয়টা তাঁর অমূলক নয়। মনে হচ্ছে হঠাৎ যেন বয়সটা বাড়তে শুরু করে দিয়েছে। কয়েকমাস আগেও চুল অতো সাদা ছিল না। অথবা এমন খসখসে চামড়া। তাঁর বয়েস বাড়ার হারটা হঠাৎই যেন বেড়ে গেছে। এটা কি কোন অসুখ নাকি তাঁর নিজের মনের ভুল? কার কাছে তিনি গিয়ে বলবেন তাঁর মনের কথা, কে তাঁর সন্দেহ দূর করবে?
স্নান করে অল্প ভাত খেয়ে স্কুলের দিকে রওনা হলেন। এই স্কুলের তিনি ভূগোলের শিক্ষক। আজ ক্লাস নিতে গিয়ে তিনি কয়েকবার অন্যমনস্ক হয়ে পড়লেন। এমনকি ক্লাসের ছাত্রদের হই-হট্টগোল আজ তাঁর মতো কঠোর শিক্ষককে একটুও বিচলিত করলো না।
বিজ্ঞানের শিক্ষক পরিতোষবাবু তাঁর অনেক কাছের বন্ধু। দুপুরে টিফিন আওয়ারে তাঁর সঙ্গে একটু আলোচনা করাই ভালো। হয়তো বিজ্ঞানের শিক্ষক হওয়ার সুবাদে কোনো আধুনিক রোগের খবর দিতে পারবেন।
গভীর মনোযোগ নিয়ে সব শুনে পরিতোষবাবু মাথা নেড়ে বললেন — ‘আজকাল তো অনেক কিছুই হচ্ছে মশাই। বয়স বাড়ার রেটটা হঠাৎ বেড়ে যেতেও পারে। ত্রিশ বছরের একজন মানুষ একবছরের মধ্যে চল্লিশ বছরের মতো হয়ে যেতে পারে। অস্বাভাবিক কিছু নয়।’
— ‘আপনি কি এসব নিয়ে কখনো কিছু পড়েছেন বা শুনেছেন?’ অসীমবাবু উদ্বিগ্ন।
— ‘এখন তো অনেক জেনেটিক রোগ ধরা পড়ছে, যেগুলো রেয়ার কেস হিসেবে ধরা হয় মেডিকেল সায়েন্সে। আমারও সীমিত জ্ঞান। আমি আপনাকে ভয় দেখাচ্ছি না কিন্তু আমার মনে হয় আপনার একবার ভালো ডাক্তারের কাছে যাওয়া দরকার।’
— ‘বলছেন তবে। কিন্তু ডাক্তারবাবুকে কি বলবো। শুনে হয়তো আমাকে পাগল ভাববেন।’
— ‘কি বলছেন মশাই!’ পরিতোষবাবু আশ্বস্ত করে বললেন, ‘ডাক্তারের কাছে সবকিছু খুলে বলা যায়। আর সত্যি হয়তো এমন রোগ আছে, আমরা যার খবর রাখি না।’
চিন্তিত মুখে অসীমবাবু স্কুল থেকে বাড়ি ফিরলেন। তারপর হাত-মুখ ধুয়ে অল্প টিফিন করে সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন। একটু পরে সন্ধে নামবে। তিনি মোহিতবাবুর বাড়ির দিকে এগিয়ে চললেন। তাঁর দাবা খেলার খুব নেশা। তাই মাঝে মাঝেই মোহিতবাবুর বাড়িতে সন্ধেবেলা যান দাবা খেলতে।
মোহিতবাবু বছরখানেক আগে এই এলাকায় নতুন এসেছেন। আগে কোথায় থাকতেন সে ইতিহাস কেউ জানে না। নতুন বাড়ি করে এখানে একাই বসবাস করেন। সঙ্গে শুধু তাঁর বৃদ্ধ চাকর রামগোপাল। সব বিষয়ে অগাধ জ্ঞান মোহিতবাবুর। সুঠাম স্বাস্থ্য। বয়স হয়তো পঞ্চাশের কাছাকাছি হবে কিন্তু নিজেকে খুব যত্ন করে রেখেছেন। তাই অনেক কমবয়সি মনে হয়।
এক আসরসভায় মোহিতবাবুর সঙ্গে আলাপ হয় অসীমবাবুর। তারপর একথা সেকথা থেকে দাবা খেলা। তখনই মোহিতবাবু জানতে পারেন অসীমবাবুর দাবা খেলার নেশা। তারপর একদিন দাবা খেলার আমন্ত্রণ জানিয়ে দিলেন। সেই থেকে প্রায় সন্ধেবেলা মোহিতবাবুর বাড়িতে কয়েকপ্রস্থ দাবা খেলে আর আড্ডা মেরে রাত্রির দিকে বাড়ি ফেরেন অসীমবাবু। মোহিতবাবু অভিজ্ঞ লোক। অনেক জায়গায় তাঁর ঘোরা আছে। মাঝে মাঝে সেই সব অভিজ্ঞতার কথা অসীমবাবুকে বলেন। সন্ধেবেলাটা বেশ ভালই কাটে।
আজও সাইকেল নিয়ে মোহিতবাবুর বাংলো বাড়িতে এলেন অসীমবাবু। বাড়িটা বাংলো টাইপের। সামনে একটা বড়ো বাগান। বড় শৌখিন মানুষ মোহিতবাবু। বাড়িতে কি নেই! নিজের হাতে তৈরি করা বাগান থেকে শুরু করে সেই পুরনো আমলের দামী আসবাবপত্র। সবকিছুই গোছানো।
সামনের বাগান পার হয়ে গিয়ে সদর দরজায় পৌঁছে দেখেন চাকর রামগোপাল রোজকার মতো তাঁর অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে। সাইকেলটাকে দেওয়ালের এক প্রান্তে দাঁড় করিয়ে জিজ্ঞেস করলেন — ‘কি হে রামগোপাল, বাবু বাড়িতে আছেন তো?’
— ‘বাবু আপনার জন্যই অপেক্ষা করছেন। সেই কখন থেকে দাবার ছক সাজিয়ে বসে আছেন।’
ঘরের ভিতরে গিয়ে দেখেন মোহিতবাবু একটা পেপার নিয়ে ইজি-চেয়ারে বসে আছেন। একটা বিগলিত হাসি হেসে অসীমবাবু বললেন — ‘অনেকক্ষণ অপেক্ষায় রেখেছি মনে হচ্ছে। তাহলে আর দেরি কেন। চলুন শুরু করা যাক।’
দুজনে দাবা খেলার ঘরে এলেন। মোহিতবাবু শখ করে একটা দাবা ঘর বানিয়েছেন যেটা একটা ছোট্ট বৈঠকখানার মতো। ঘরের মাঝে একটা মার্বেলের তৈরি বড়ো দাবার ছক। ঘুঁটি গুলো সব হাতির দাঁতের তৈরি বলেই বিশ্বাস। দুই পাশে দুটো মস্ত বড়ো সোফা-চেয়ার। একটা চেয়ার সাদা যেটা দাবার সাদা ঘুঁটির দিকে বসার জন্য। অন্য সোফা-চেয়ারটা কালো যেটা কালো ঘুঁটির খেলোয়াড়ের জন্য। খুব শৌখিন ভদ্রলোক বলতে হবে। সবকিছুরই নিখুঁত ডিজাইন। বড় বড় অয়েল পেইন্টিং। মস্ত পুরনো আমলের আয়না। শিলিংয়ে একটা বড় ঝাড়বাতি যার হাল্কা হলুদ আলোয় সাদা কালোর ওই দাবার ঘরগুলোকে আরও রহস্যময় করে তুলেছে।
অসীমবাবু সাদা ঘুঁটি নিয়ে খেলতে ভালবাসেন। তাই প্রতিবারেই তিনি সাদা দিকটাতেই বসে পড়েন। প্রথম চালটা সাদা দিয়ে শুরু করতে হয়। সাদা ঘুঁটির তাই একটা সুবিধে আছে। তিনি দক্ষ দাবাড়ু। মোহিতবাবুকে প্রায়ই হারিয়ে দেন। যদিও মোহিতবাবু মোটেই খারাপ খেলেন না। অনেকসময় মনে হয় মোহিতবাবু হয়তো ইচ্ছে করে ভুল করে ফেলেন। আর সেই সুযোগের জন্যই তিনি অপেক্ষা করে থাকেন। ‘চেক মেট’ – এই কথাটা বলার মধ্যে যে কি তৃপ্তি সেটা অসীমবাবুই সবথেকে ভালো উপলব্ধি করেন।
আজ কিন্তু তিনি একটু অন্যমনস্ক। সাদা চেয়ারে বসে ঘুঁটিগুলোর দিকে চেয়ে রইলেন। একটু পরেই রামগোপাল প্রত্যেক বারের মতো বড়ো গ্লাসে দুজনের জন্যে লস্যি নিয়ে এলো।
পুরো মনোযোগ দিয়ে তিনি খেলতে পারছেন না। তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে মোহিতবাবু বললেন — ‘কি ব্যাপার, আপনার শরীর ভালো আছে তো?’
— ‘না মানে তেমন কিছু নয়। একটু কেমন দুর্বল বোধ করছি।’ কিছু না বলাই ভালো মনে করলেন অসীমবাবু। কিন্তু তাঁর চোখে মুখে চিন্তার ছাপ মোহিত বাবুর চোখ এড়াল না।
বিচক্ষণ মোহিতবাবু তাঁর দিকে তাকিয়ে আবার জিজ্ঞেস করলেন — ‘আজ আপনি খেলায় অনেক ভুল করছেন। ওই ঘোড়া দিয়ে আপনি অনায়াসে আমার নৌকাটাকে মারতে পারতেন। কোনো কিছু কি আপনাকে বিব্রত করছে?’
একবার মনে হলো বলেই দেবেন মোহিতবাবুকে। কিন্তু তাঁর ভাবনাটা অনেকটা ছেলেমানুষের মতো। তিনি নিজেই এখনো সন্দিহান। তাছাড়া মোহিতবাবু কি ভেবে বসবেন। ঢং ঢং করে বড়ো দেওয়াল ঘড়িতে নটা বাজলো।
রাত্রে বাড়ি ফিরে তাড়াতাড়ি খেয়ে শুয়ে পড়লেন। কাল রবিবার। স্কুল ছুটি। সকালে একবার গঞ্জের বড়ো ডাক্তার বিকাশ সেনের ওখানে যাবেন ঠিক করলেন।
— ‘প্রোজেরিয়া।’ কম্পিউটারের দিকে তাকিয়ে ডাক্তার বিকাশ সেন গম্ভীর মুখে বললেন।
— ‘মেডিকেল সায়েন্সে প্রোজেরিয়া বলে একটা জেনেটিক ডিজিজ আছে যেটা এক্সট্রিমলি রেয়ার। কিন্তু সেটা বাচ্চাদের জন্য। শিশু জন্মাবার পর দ্রুত হারে তার বয়স বাড়তে থাকে। সেটা আপনার এই বয়সের জন্য নয়।’
অসীমবাবুর হাতের চামড়াটার ওপর একটা আঁচড় কেটে তিনি আবার বলতে শুরু করলেন — ‘আপনার পঁয়তাল্লিশ বছরের বয়সের তুলনায় স্কিনটা অনেক বেশি শুকনো আর খসখসে। চোখের তলায় দাগ আর গলায় ভাঁজ পড়তে শুরু করেছে।’
— ‘এর কি কোনো ওষুধ নেই।’ অসীমবাবুর ভয়টা এবার সত্যি হতে চলেছে।
— ‘কিছু রুটিন টেস্ট লিখে দিচ্ছি। ব্লাড আর সুগার টেস্ট গুলো আগে করিয়ে নিন। তারপর দেখা যাক কি হয়। খাবারটা ঠিকমতো খাবেন। আপনার বয়স হয়তো দ্রুত হারে বাড়তে শুরু করেছে। এটা আর নর্মাল প্রসেসে নেই।’
মনে এখন একরাশ দুশ্চিন্তা। বাড়ি ফিরে দুপুরে অল্প ভাত খেয়ে উঠে পড়লেন। কিছুই আর ভালো লাগছে না। ছাদের ওপর একটা নরম মাদুর নিয়ে শুয়ে পড়লেন। তাঁর ছোট ছেলে গোবিন্দ একটা বই নিয়ে চিৎকার করে পড়াশুনা করছে। যযাতির গল্প। গোবিন্দ পড়ছে, ‘পৌরাণিক কালে যযাতি নামে এক রাজা ছিলেন। তিনি পাণ্ডবদের পূর্বপুরুষ ছিলেন।’ অসীমবাবু গল্পটা শুনে যাচ্ছিলেন।
‘একবার অসুরদের গুরু শুক্রাচার্য রেগে গিয়ে তাঁকে অভিশাপ দেন। রাজা যযাতি তখন তাঁর যৌবন হারিয়ে ফেলে বৃদ্ধ হয়ে যান। গুরু শুক্রাচার্য তখন তাঁর অভিশাপ লঘু করে দিয়ে বলেন – রাজা যযাতি তাঁর যৌবন আবার ফিরে পেতে পারেন যদি কেউ স্বেচ্ছায় তাঁর বয়স রাজাকে দান করেন এবং রাজার বার্ধক্য নিজে বরণ করেন।’
অসীমবাবু এবার সোজা হয়ে বসলেন। গোবিন্দ পড়ে যাচ্ছে--
‘রাজার অনুরোধে ছোট পুত্র পুরু শেষ পর্যন্ত তাঁর যৌবন পিতাকে উপহার দেন আর নিজে বার্ধক্য বরণ করেন।’
অসীমবাবুর শিরদাঁড়া দিয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল। কারও বয়স যদি এভাবে গোপনে ছিনিয়ে নেওয়া যায়। কারও জীবনীশক্তি অজান্তে যদি ধীরে ধীরে শুষে নেওয়া যায়। আর সেই দিয়ে যদি অন্য কেউ নিজেকে...
অসীমবাবুর মনটা অস্থির হয়ে পড়লো। তিনি অনেক কিছু বুঝে গেছেন। তাঁর মনের ভয় আর সন্দেহ সব দিনের আলোর মতো পরিষ্কার। এখন শুধু সন্ধে হওয়ার অপেক্ষা।
সন্ধেবেলায় সাইকেলটা নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন তিনি।
আজকে দাবা খেলাটা অন্যরকম হবে। প্রতিপক্ষ মোটেই দুর্বল নয়। দাবা খেলায় হয়তো হারানোটা সহজ কিন্তু এই আশ্চর্য কঠিন খেলায়? বাগানটা পার করে সাইকেলটা রাখলেন। অন্যদিনের মতো রামগোপাল আজও দাঁড়িয়ে ছিল অপেক্ষায়।
— ‘তোমার বাবু কোথায়? বাড়িতে কি অপেক্ষা করছেন?’ কঠিন স্বরে বললেন অসীমবাবু।
— ‘আপনার জন্যই অপেক্ষা করছেন। আপনি ভিতরে বসুন। উনি এই এসে পড়লেন বলে।’
অসীমবাবু দাবা খেলার ঘরটায় এসে পৌঁছলেন। তারপর সাদা সোফা-চেয়ারটার দিকে ধীর গতিতে এগিয়ে গেলেন। একদিকে সাদা সোফা-চেয়ার আর অন্য দিকে কালো চেয়ার। মাঝে বড়ো গোল টেবিল যেখানে দাবা বোর্ডটা রাখা আছে। সোফা-চেয়ার দুটোকে আজ ভালোকরে পরীক্ষা করতে শুরু করলেন। সাদা চেয়ারের পিছনে অনেকগুলো ইলেক্ট্রিক তার কভার দিয়ে ঢাকা। একটা ইলেক্ট্রিক সকেট দিয়ে চেয়ারটা মেইন সুইচের সাথে যুক্ত। সেটার সুইচ অন করতেই একটা যান্ত্রিক শব্দে দুটো চেয়ারই নড়ে উঠলো। অন্যান্য দিনে সুইচগুলো অন করাই থাকতো কিন্তু অসীমবাবু সেটা কখনো টের পাননি। সাদা চেয়ারের মধ্যে থেকে একটা মোটা পাইপ বেরিয়ে গেছে যেটা কালো চেয়ারের সাথে যুক্ত। কালো চেয়ারটার নিচেও অনেক অতি সূক্ষ্ম ইলেক্ট্রিক তারের বিন্যাস। এতদিন দাবা খেলার নেশায় তিনি ভালো করে লক্ষ করেননি।
— ‘কি দেখছেন অসীমবাবু।’ ঘরে ঢুকে ঠান্ডা গলায় জিজ্ঞেস করলেন মোহিতবাবু।
— ‘কিছু না। মনে অনেক প্রশ্ন। তার উত্তর খুঁজছিলাম।’
— ‘খুঁজে পেলেন কিছু।’
— ‘হ্যাঁ মোহিতবাবু। অনেক কিছুই পেলাম।’
— ‘বসুন ওই সাদা চেয়ারে।’ একটা বজ্রগম্ভীর স্বরে মোহিতবাবু আদেশ করলেন। তারপর নিজে কালো সোফা-চেয়ারে গিয়ে বসলেন। কিছুটা হিপনোটাইজড-এর মতো গিয়ে সাদা সোফা-চেয়ারে বসে পড়লেন অসীমবাবু। রামগোপাল এর মধ্যে দুটো বড়ো গ্লাসে লস্যি দিয়ে গেছে।
— ‘শুরু করা যাক তবে। কি বলেন অসীমবাবু? আপনার তো বরাবর সাদা ঘুঁটিই পছন্দ।’
— ‘কিন্তু আমার বয়স। আমার জীবনীশক্তি।’
মোহিতবাবু তাঁকে থামিয়ে দিলেন — ‘আপনাকে আমি সব ফিরিয়ে দেবো। কিন্তু এই শর্তে, যদি আজ আপনি আমাকে দাবা খেলায় হারাতে পারেন।’
দাবার সাদা ঘুঁটির একটু সুবিধে থাকে প্রথম চাল দেবার জন্য। তাছাড়া অসীমবাবু প্রায়দিনই মোহিতবাবুকে হারিয়েছেন। আর এটাই একটা মস্ত সুযোগ নিজের বয়স ফিরে পাবার। সুতরাং এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে কোনও অসুবিধে নেই তাঁর।
খেলা শুরু হলো। আজ প্রতিপক্ষ খুব বিচক্ষণের সঙ্গে চাল দিচ্ছে। আগে যে ফাঁদে সহজেই ধরা পড়তো আজ আর সেটা হচ্ছে না। অন্যদিকে অসীমবাবু নিজেই প্রতিপক্ষের দুটো কালো ঘোড়ার যুগ্ম আক্রমণে দিশেহারা হয়ে পড়ছেন।
— ‘মোহিতবাবু, একটা প্রশ্ন।’ সাদা বড়েটা এগিয়ে দিয়ে অসীমবাবু বললেন।
— ‘হ্যাঁ বলুন।’
— ‘আপনি কি এতদিন ইচ্ছে করেই হারতেন?’
— ‘জীবনে অনেক সময় হারাটা জরুরি হয়ে পড়ে অসীমবাবু।’ মোহিতবাবুর মুখে মৃদু হাসি।
— ‘এই চেয়ার দুটো কি?’
— ‘একটা যন্ত্র যা এখনো সাধারণ মানুষের কল্পনার বাইরে। প্রচলিত সায়েন্স এখনো ওই পর্যায়ে পৌঁছতে পারেনি।’
— ‘এটা কি আপনি আবিষ্কার করেছেন?’
— ‘সেটা জানা জরুরি নয়।’
— ‘চেয়ার দুটো কিভাবে কাজ করে?’
— ‘ওই সাদা চেয়ারটা মানুষের জীবনীশক্তি অ্যাবজর্ব করে। ওর মধ্যে হাজার হাজার সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ইলেক্ট্রিক তার আছে যা মানুষের প্রাণশক্তি বের করে নেয়।’
— ‘আর ওই কালো চেয়ারটা?’ বিস্ফারিত চোখে অসীমবাবু জিগ্যেস করলেন।
— ‘এটা ঠিক তার অপজিট। এই কালো চেয়ারে যে বসে থাকবে সে ধীরে ধীরে ওই অ্যাবজর্বড এনার্জি ফিরে পেতে থাকবে ওই সাদা সোফার সঙ্গে যুক্ত পাইপটার মাধ্যমে। তার সেলগুলো সব সজীব হয়ে উঠবে আর বয়স কমতে থাকবে।’
এরমধ্যে কালোর ঘোড়া সাদার একটা গজ মেরে দিয়েছে। খেলা এগিয়ে চলেছে। কিন্তু আজ অসীমবাবুর একি অবস্থা! তাঁর হাতটা কেমন কাঁপছে। গলাটা যেন শুকিয়ে যাচ্ছে। চোখটা কি আরও ঝাপসা লাগছে। খুব দুর্বল বোধ করছেন তিনি। হাতের চামড়াগুলো কেমন সব শুকিয়ে শুকিয়ে যাচ্ছে। হাতটা আরও ক্ষীণ হয়ে পড়ছে।
— ‘তবে কি আপনি আমার জীবনীশক্তি দিয়ে নিজেকে অমর করে তুলছেন?’ মন্ত্রীটাকে নিজের ঘর থেকে বের করে কালোর নৌকাটাকে টার্গেট করলেন অসীমবাবু।
মোহিতবাবু একটা গজ টেনে এনে নৌকাটাকে গার্ড করে সাদার মন্ত্রীটাকেই উল্টে ধরে ফেললেন। তারপর গম্ভীরভাবে দাবার বোর্ড থেকে মুখ তুলে বললেন — ‘এই যন্ত্র দিয়ে ইচ্ছেমতো কন্ট্রোল করে অন্যের প্রাণশক্তি ছিনিয়ে নেওয়া যায়। গত ছয় মাসে ধীরে ধীরে সেটাই করা হয়েছে অসীমবাবু যাতে আপনি সন্দেহ করতে না পারেন। আপনার বয়স ছয় মাসে দশ বছর বাড়িয়ে দিয়েছে এই যন্ত্র। আপনার কাছে আমি কৃতজ্ঞ। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।’
অসীমবাবুর মাথাটা ঝিমঝিম করছে। মোহিতবাবুকে দাবাতে হারানো মোটেই সহজ কাজ নয় সেটা ভালোই বুঝতে পারছেন। কাঁপা কাঁপা হাতে একটা বড়েকে এগিয়ে দিলেন। হাত পা সব অসাড় হয়ে যাচ্ছে। চামড়া শুকিয়ে হাত দুটো এত ক্ষীণ হয়ে গেছে যেন চেনাই যাচ্ছে না। খুব দ্রুত তাঁর বয়েস বেড়ে চলেছে। আর অন্য দিকে মোহিতবাবু ধীরে ধীরে এক যুবক হয়ে উঠছেন।
খেলা এগিয়ে চলেছে। অসীমবাবু তাঁর মন্ত্রী হারিয়ে ফেলেছেন। কালোর গজ আর নৌকার আক্রমণে তিনি একে একে সব হারিয়ে ফেলছেন। এই ফাঁদ থেকে হয়তো আর মুক্তি নেই। সামনের বড়ো আয়নার দিকে একবার তাকালেন। এ তিনি কাকে দেখছেন! এ কি অবস্থা তাঁর! আয়নায় এক জীর্ণ, শীর্ণ কঙ্কালসার অসীমবাবু।
তাঁর চুলগুলো সব সাদা হয়ে ঝরে পড়ছে। মুখের মধ্যে অসংখ্য বলিরেখা। প্রায় নব্বই বছরের বৃদ্ধ-তে পরিণত হয়ে গেছেন। জোরে জোরে তাঁর শ্বাস পড়ছে। নিঃশ্বাস নিতে খুব কষ্ট হচ্ছে।
কালোর ঘোড়া এসে সাদার রাজাকে ‘চেক’ দিয়েছে। রাজার আর নড়বার জায়গা নেই।
— ‘চেক অ্যান্ড মেট অসীমবাবু।’ সামনে পঁচিশ বছর বয়সী যুবক মোহিতবাবু। চোখে তাঁর ক্রূর দৃষ্টি।
— ‘আ-আপনার আসল বয়েস কত? কয়েক শ নাকি...’ জোরে জোরে শ্বাস নেওয়ার শব্দ।
হা হা করে একটা অট্টহাসি দূর-দূরান্তে ছড়িয়ে পড়লো।
অসীমবাবু সাদা চেয়ারে ধীরে ধীরে ঢলে পড়লেন।