হীরক সংগ্রহ কবিতা; সম্পাদকঃ নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী; আনন্দ; কলকাতা; প্রথম প্রকাশঃ ২০১৭; পৃষ্ঠাঃ ১৫৪; ISBN: 978-93-5040-829-2
সম্পাদক মশাই মহা বিপদে ফেলেছেন।
কী কুক্ষণে ওনাকে বলেছিলুম যে আনন্দ পাবলিশার্স ওনাদের ষাট বছর পূর্তি উপলক্ষে একটি চমৎকার কবিতার বই বের করেছেন; কলেজ স্ট্রিটে সিগনেট প্রেসের দোকানে সেটা পেলাম। (তখনো জানতাম না যে বইটা ইতিমধ্যেই ওনার পড়ার টেবিলে এসে গেছে ক’দিন হল।) ব্যাস – অমনি ফরমান – আপনি এটার ওপর একখানা লেখা জমা দিন।
এদিকে আমি ইঞ্জিনিয়ারিংএর ছাত্র, সাহিত্যের ডিগ্রি-মিগ্রি নেই, অ্যাকাদেমিক মহলে কথা বলার বিলকুল কোনো হক নেই। আছে বলতে কবিতার প্রতি একটা ভালোবাসা, সেই টানে একটু তা-না-না করে রাজিই হয়ে গেলাম।
কাজেই, বন্ধুগণ – নিছক অর্বাচীন কিন্তু নিবিড় কবিতাপ্রেমীর মতামত শুনতে যদি আপত্তি না থাকে, তবে আগে বাড়ুন। নইলে এ লেখা টপকে অন্য কোথা, অন্য কোনখানে গিয়ে উপনীত হন। আগেই বলে দিলাম – পরে কিন্তু দোষ দেবেন না।
****
প্রথমে একটু পোশাক-আশাকের কথা বলে নিই। “পেহেলে দর্শনধারী” বলে কথা!
বইটা বড়ো সাইজের, লাল কাপড়ে মোড়া মলাট – তাতে রুপোলী অক্ষরে লেখা বইটির নাম - “হীরক সংগ্রহ কবিতা”। বইয়ের পাতাগুলি একটু মোটা এবং ভালো মানের, ওলটাতে ভালো লাগে – আঙ্গুলের গায়ে মুচ্ছো যাবে গোছের নয়। অক্ষরের সাইজও বড়ো – পড়তে আরাম। বইটা পড়তে শুরু করার আগে একটু হাতে নিয়ে নাড়া-চাড়া করলেই মনটায় একেবারে মলয় বাতাস খেলে যায়।
আগেই বলেছি, আনন্দ পাবলিশার্স-এর ষাট বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে বইটি প্রকাশিত হয়েছে। সম্পাদনা করেছেন নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী। বস্তুত, একই উপলক্ষ্যে একটি গল্পের সংকলনও প্রকাশিত হয়েছে, সম্পাদনা করেছেন রমাপদ চৌধুরী। যেহেতু ষাট বছর, তাই এতে আছে ষাটজন কবির কবিতা – যাঁদের কবিতা আনন্দ বা তার সহযোগী সংস্থা থেকে হয় বই হিসেবে বা পরবর্তী কোনো সংকলনে বেরিয়েছে। এতে নির্বাচনের পরিধিটা বেশ বেড়ে যায় – কারণ সিগনেট প্রেসও এখন আনন্দবাজারের সহযোগী সংস্থা; আর রবীন্দ্রনাথও এই বইতে স্থান পেয়ে যান। নীরেনবাবু ভূমিকাতে বলেছেন যে আনন্দবাজার থেকে ওনাকে কবিতার বেশ কিছু বই দিয়েছিলো এই উপলক্ষ্যে (আহা – সেই বইগুলোর তালিকাটি যদি দিতেন স্যার, বড্ডো উপকার হতো), তার থেকেই উনি বেছে নিয়েছেন। নবতি-উত্তীর্ণ নীরেনবাবুর পক্ষে সত্যিই খুব বিশদভাবে অজস্র কবিতা পুনরায় খুঁজে বের করে করাটা কঠিন হতো। কিন্তু মানতেই হয়, কবিতা বাছাইয়ের কাজটা অত্যন্ত সুসম্পন্ন হয়েছে। কিছু মতান্তর থাকতেই পারে, কিন্তু সব মিলিয়ে মনোগ্রাহী সংকলন।
কবিতা সংকলন বললে চট করে দুটি বই মনে আসে “আধুনিক বাংলা কবিতা” – বুদ্ধদেব বসুর সম্পাদনা আর “দেশ – সুবর্ণ জয়ন্তী কবিতা-সংকলন” – সাগরময় ঘোষের সম্পাদনা। ধরে নিয়েছিলাম এই বইটির বেশ কিছু কবিতা এই দুটি সংকলনের কোনও একটিতে আছে। দেখে প্রীত হলাম যে তা নয়। যে কবিতাগুলি দেশের সংকলনটিতেও আছে এবং নীরেনবাবুও নিয়েছেন, তা হলো--
-- নজরুলের দুটি কবিতা (“জাগরণী” এবং “কুমারী রাধিকার প্রতি দিদিমা”)
-- বুদ্ধদেব বসুর দুটি কবিতা (“কোনো মালাবার-বাসিনীকে” এবং “ব্লুমিংটন, ইন্ডিয়ানা”; সূচিতে মুদ্রণপ্রমাদ--আছে "ব্লুমিংটনস ইন্ডিয়ানা")
-- হরপ্রসাদ মিত্রর দুটি কবিতা (“চায়ের দোকানে” এবং “খেউড়”)
-- রাজলক্ষ্মী দেবীর দুটি কবিতা (“কাঁকুলিয়া রোডের বেহালাদারকে” এবং “সন্তানেরা”)
-- নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর একটি (“বাতাসি’)
যেহেতু স্বল্পসংখ্যক, তাই অন্য দুটি কাব্যসংকলনের পাশে এ বইটি স্বমহিমায় স্থান করে নিতে পারে।
বইটির একটি লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য হলো নীরেনবাবু এই বইটিকে “ষাটজন কবির শ্রেষ্ঠ কবিতা” করে তোলবার চেষ্টা করেন নি। বাঁচিয়েছেন, কারণ তা করলে বইটি একরাশ বহুপঠিত কবিতার কোলাজ হতো বটে, কিন্তু তাকে নতুন করে পড়বার আগ্রহ থাকতো না। আমার মনে হয়েছে নীরেনবাবু এই বইটিতে কবিদের লেখার একটা নমুনা দিয়েছেন; এমন কবিতা নিয়েছেন, যাতে কবির ঘরানাটা বেশ বোঝা যায়। তাই শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের “অবনী বাড়ি আছো” বা “হৃদয়পুর”-এর মতো বহুলপঠিত কবিতার বাইরে অন্য কবিতা নিয়েছেন। কম বেশি সকলের ক্ষেত্রেই এটা প্রযোজ্য।
কারা আছেন এই বইতে?
শুরু হয়েছে রবীন্দ্রনাথকে দিয়ে। না করে উপায় নেই – কারণ বুদ্ধদেব বসুর লেখা থেকে বলতে হয় “রবীন্দ্রনাথের পরে প্রথম নতুন তো রবীন্দ্রনাথ নিজেই”। রবীন্দ্রনাথের পাঁচটি কবিতা আছে - “দুই পাখি”, “আফ্রিকা”, “দুঃসময়”, “বোঝাপড়া” এবং “প্রথম দিনের সূর্য”। এর মধ্যে “প্রথম দিনের সূর্য” বু.ব. সম্পাদিত “আধুনিক বাংলা কবিতা” বইটিতেও আছে, এবং এই কবিতাটিকে বাদ দিয়ে রবীন্দ্রনাথের আধুনিক কবিতা নিয়ে কথা বলা অসম্ভব। “দুঃসময়” পড়ে আরও একবার শিহরিত হলাম—
“আছে শুধু পাখা, আছে মহানভ-অঙ্গন
ঊষা-দিশাহারা নিবিড়-তিমির-আঁকা--
ওরে বিহঙ্গ, ওরে বিহঙ্গ মোর,
এখনি, অন্ধ, বন্ধ কোরো না পাখা।”
“আফ্রিকা” বহুলপঠিত হওয়া সত্ত্বেও আবার পড়তে ভালোই লাগলো, “বোঝাপড়া”র ওই দুলকি চালের ছন্দের “সত্যেরে লও সহজে”ও বেশ ভালো। প্রশ্ন শুধু “দুই পাখি” কবিতাটি নিয়ে। “দুই পাখি” গান হিসেবে যতটা সফল, কবিতা হিসেবে ততটা কিনা সে নিয়ে আমার একটু দ্বিধা আছে। রবীন্দ্রনাথের গীতিকবিতার উদাহরণ হিসেবে যদি এটা বেছে নেওয়া হয়ে থাকে, তাহলে বলতেই হয় এর চেয়ে উন্নত কবিতা নিঃসন্দেহে রবীন্দ্রভাণ্ডারে ইতস্তত পড়ে আছে।
রবীন্দ্রনাথের পরেই আছেন নজরুল, দুটি কবিতা নিয়ে (“জাগরণী” এবং “কুমারী রাধিকার প্রতি দিদিমা”)। আর তারপর এসে পড়ছেন তিরিশের দশকের কবিরা, যাদের তালিকায় প্রথম নাম সেই উজ্জ্বল নিঃসঙ্গ নক্ষত্রের, যার নাম জীবনানন্দ দাশ। বাদ পড়েছেন মোহিতলাল মজুমদার, যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত ইত্যাদি মাঝামাঝি যুগের কবিরা – তাতে বিশেষ ক্ষতি হয় নি বলেই আমার বিশ্বাস।
বাংলা কবিদের আলোচনার একটা প্রাচীন রীতি হলো “দশক” ধরে কথা বলা। অর্থাৎ পঞ্চাশের দশকের কবি, ষাটের দশক কবি ইত্যাদি। যদিও কবিদের কবিত্বের আয়ু ঠিক দশ বছর নয় আর তাঁদের আত্মপ্রকাশ ঠিক দশকের শুরুতেই হয় না, তবুও মোটের ওপর এই রীতিই আমিও মেনে লিখছি এই প্রবন্ধে।
তিরিশের দশকের কবিরা - অর্থাৎ জীবনানন্দ-সুধীন্দ্রনাথ-প্রেমেন্দ্র মিত্র-অজিত দত্ত-বুদ্ধদেব বসু-বিষ্ণু দে, যাঁদের কল্লোল-কালিকলম-প্রগতির কবি বলা হয়, তাঁরা সবাই প্রায় উপস্থিত। সুধীন্দ্রনাথ বয়েসে এঁদের সমসাময়িক হলেও ঠিক কল্লোল যুগের নন, লেখা শুরু করেছিলেন অনেকটা দেরিতে। আছেন সমসাময়িক বয়ঃকনিষ্ঠ অরুণ মিত্রও – তাঁকেও এই দলেই ফেলা যায়।
আগেই বলেছি, নীরেনবাবু বুদ্ধদেব বসুর যে দুটি কবিতা নিয়েছেন (“কোনো মালাবার-বাসিনীকে” এবং “ব্লুমিংটন, ইন্ডিয়ানা”), সে দুটিই “দেশ – সুবর্ণ জয়ন্তী কবিতা-সংকলন” বইটিতে আছে। পুনঃপৌনিকতা এড়াতে বুদ্ধদেব বসুর অন্য কবিতাও নেওয়া যেতে পারতো – যদিও এ কথা স্বীকার্য যে “কোনো মালাবার-বাসিনীকে” কবিতাটিতে বু.ব.-র স্বাক্ষর বেশ স্পষ্ট দেখা যায়, এবং সেই অর্থে কবিতাটি কবির কাব্যরীতি চিনতে সাহায্য করে। উপরন্তু বোদলেয়ার – যাকে আমরা চিনেছি মূলত বু.ব.-র হাত ধরেই--
“তোমারই হাতের মতো ক্ষীণ পা দুটি তোমার,
তোমার জঘনের ভঙ্গি দেখে রূপসীতমা সুশ্বেতার
ঈর্ষায় বুক ফেটে যায়; ভাবুক শিল্পীর আদরে গড়া তোমার শরীর;
তোমার চামড়ার চেয়েও কালো তোমার চোখ, মখমল-কালো, গভীর।”
সুধীন্দ্রনাথ দত্তর “নান্দীমুখ” কবিতাটি চমৎকার – ওনার কবিতার গম্ভীর ধ্বনিগৌরব সম্পূর্ণভাবে এই কবিতায় আছে--
“তোমার যোগ্য গান বিরচিব ব’লে,
বসেছি বিজনে, নব নীপবনে,
পুষ্পিত তৃণদলে।
শরতের সোনা গগনে গগনে ঝলকে;
ফুকারে পবন, কাশের লহরী ছলকে;
শ্যাম সন্ধ্যার পল্লবঘন অলকে
চন্দ্রকলার চন্দনটীকা জ্বলে।
মুগ্ধ নয়ান, পেতে আছি কান
গান বিরচিব ব’লে।।”
অন্য কবিতাটি (“প্রত্যাখ্যান”) আমার তেমন ভালো লাগে নি, অন্য কবিতা সহজেই নেওয়া যেতো।
বিষ্ণু দের কবিতাদুটি (“কাসান্দ্রা” ও “ভিলানেল্”) নিয়ে কিছু বলবার নেই – ওনার কবিতার পরিচায়ক হিসেবে কবিতাদুটি চমৎকার। বিষ্ণু দের তিন মাত্রার ছন্দের অব্যর্থতায় তীরবিদ্ধ না হয়ে পারি না--
“দিনের পাপড়িতে রাতের রাঙা ফুলে
সে কার হাওয়া আনে বনের নীল ভাষা
জোগায় কথা তাই সোনালি নদী-কূলে।”
অজিত দত্তর কবিতাদুটি (“গুরুজনদের মাঝে” এবং “আকাঙ্ক্ষা”) এবং অরুণ মিত্রের কবিতাদুটি (“শয্যাগত” এবং “ছায়াগলি থেকে বেরিয়ে”) একেবারেই যথাযথ। প্রেমেন্দ্র মিত্রের এতো অজস্র কবিতা থাকা সত্ত্বেও “হিমালয়” এবং “যদিও মেঘ চরাই” ওনার প্রতিভার উপযুক্ত নয়; বরং “মেঘ চরাই” অনিবার্যভাবে শক্তির “এখানে মেঘ গাভীর মতো চরে” মনে করিয়ে দেয়। সঞ্জয় ভট্টাচার্য বাদ পড়েছেন, সে নিয়ে আমি অন্তত মর্মাহত নই; কিন্তু অমিয় চক্রবর্তীকে বাদ দেওয়াটা হয়তো ঠিক হয় নি। রবীন্দ্র-উত্তর যুগের কবিদের মধ্যে রবীন্দ্রপ্রভাব এনার মধ্যে সবচেয়ে স্পষ্ট ছিলো, অথচ নির্বেদভাবে তিনি আধুনিক – বাংলা কবিতার দীর্ঘ যাত্রাপথের তিনি একটি উল্লেখযোগ্য মাইলফলক। "পুষ্পিত ইমেজ" বইটির “উদ্দেশে” কবিতাটি প্রায় “প্রথম দিনের সূর্যের” পরবর্তী অধ্যায় মনে হয়, কিন্তু কি নিপুণতার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের থেকে আলাদা হয়ে গেছেন প্রকাশভঙ্গিমায়। প্রথম লাইনে “ধীরে”র মতো এলিয়ে পড়া শব্দের বদলে বসিয়েছেন “আস্তে” – আর এই একটি শব্দের অপার্থিব ম্যাজিকে কবিতাটার চেহারা একেবারে পাল্টে গেলো--
“আস্তে সূর্যাবর্তে সরে
দিনের অক্ষরে
প্রাণ--
রাঙা ভোর সন্ধ্যাগ্নিতে ধ্রুব অবসান;
দিয়েছিলে এই দিনে অফুরন্ত দান।।”
এবং জীবনানন্দ। নীরেনবাবুকে কুর্নিস – উনি জীবনানন্দের “বোধ”, “আট বছর আগের একদিন”, “বনলতা সেন” – এই ধরনের বহুলপঠিত কবিতাগুলির একটিকে বেছে নেন নি। নিয়েছেন তিনটি কবিতা, যেগুলি জীবনানন্দের লেখনীর ধারাটা স্পষ্ট করে দেয়। “নির্জন স্বাক্ষর” – যেখানে আমাদের প্রথম দেখা হয়েছিলো সেই চমৎপ্রদ পঙ্ক্তিটির--“আকাশ ছড়ায়ে আছে নীল হয়ে আকাশে আকাশে”। বাংলাভাষার নির্ভেজালভাবে হৈমন্তিক কবির হেমন্তর দেখা পাই “যখন ঝরিয়া যাবো হেমন্তের ঝড়ে”-তে। “পাখিরা” কবিতার সেই অতি পরিচিত লাইন--
“ঘুমে চোখ চায় না জড়াতে,--
বসন্তের রাতে
বিছানায় শুয়ে আছি;--
এখন সে কত রাত!
অই দিকে শোনা যায় সমুদ্রের স্বর,
স্কাইলাইট মাথার উপর,
আকাশে পাখিরা কথা কয় পরস্পর।”
এই পাখিরা ওনার কবিতায় বারবার ফিরে এসেছে, এসেছে তীব্র ইন্দ্রিয়বোধের অনেক কবিতার লাইন। এখানেই দেখা মেলে --
“বাদামি-– সোনালি-– শাদা-– ফুট্ফুট্ ডানার ভিতরে
রবারের বলের মতো ছোট বুকে
তাদের জীবন ছিল,--”
অথবা “অনেক লবণ ঘেঁটে সমুদ্রের পাওয়া গেছে এ মাটির ঘ্রাণ,”।
তৃতীয় কবিতাটি “মৃত্যুর আগে”তে এলেন পাড়াগাঁর মেয়ে (এখনো তিনি “অরুণিমা সান্যাল” নন), চুপে দাঁড়িয়ে থাকা চাঁদ – “কোনো সাধ নাই ফসলের তরে;” এবং সোনালি চিল। পড়তে পড়তে আরেকবার মনে হলো কি তীব্রভাবে ইন্দ্রিয়নির্ভর ছিলেন এই কবি – এবং কেন রবীন্দ্রনাথ এই কবিতাটি পড়েই তাঁর কবিতাকে “চিত্ররূপময়” বলেছিলেন:
“দেখেছি সবুজ পাতা অঘ্রাণের অন্ধকারে হয়েছে হলুদ,
হিজলের জানালায় আলো আর বুল্বুলি করিয়াছে খেলা,
ইঁদুর শীতের রাতে রেশমের মত রোমে মাখিয়াছে খুদ,
চালের ধূসর গন্ধে তরঙ্গেরা রূপ হয়ে ঝরেছে দু’বেলা”
তিরিশ পেরিয়ে তথাকথিত “চল্লিশের দশকের কবি”দের মধ্যে দেখি – সমর সেন, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, অরুণকুমার সরকার, নরেশ গুহরা। প্রসঙ্গত দেশ-এর পঞ্চাশ বছরের সংকলনে নরেশ গুহ বাদ পড়েছিলেন, তাঁকে এই বইতে ফিরে পেয়ে খুশি হলাম।
সমর সেন সম্ভবত বাংলা কবিতার প্রথম বিশুদ্ধভাবে শহরের কবি – শহরের সব বিকার, বিক্ষোভ আর ক্লান্তির কবি। “মেঘদূত”এ সেই ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট--
“হে ম্লান মেয়ে, প্রেমে কী আনন্দ পাও,
কী আনন্দ পাও সন্তানধারণে?”
অন্য কবিতাটি “ঘুম” বরঞ্চ একেবারেই অন্য মাত্রার, সমর সেন বলে চিনতে কষ্ট হয় – পোলের উপরে ট্রেন যাওয়ার ধ্বনিটুকু বাদে।
হরপ্রসাদ মিত্রর কবিতাদুটি (“চায়ের দোকানে” এবং “খেউড়”) অন্য সংকলনে আছে, দুটি কবিতাই প্রথম শ্রেণীর। সুভাষ মুখোপাধ্যায় তাঁর অদ্ভুত ছন্দের জাদু আর বিদ্রুপের ভঙ্গি নিয়ে উপস্থিত “লাগসই এবং “সামনেওয়ালা ভাগো” কবিতায়। “সামনেওয়ালা ভাগো”-তে একটা চমৎকার ছন্দের খেলা আছে, সেটা উদ্ধৃত না করে পারছি না--
“ভয় পেয়েছি বিষম ভয় পেয়েছি ভয় ভীষণ
আত্মারাম ছাড়তে চাইছে
খাঁচার ইস-
টিশন”
ইস্টিশন কথাটাকে যে ভাবে ভেঙে একমাত্রা বাড়িয়ে নিলেন কবি – এক কথায় লাজওয়াব।
অরুণকুমার সরকার (“ছায়া”, “দিঘা”) এবং নরেশ গুহর (“অলৌকিক”, “মৌমাছি প্রসঙ্গে”) কবিতাগুলিও চমৎকার। নীরেনবাবু নিজেও আছেন (ওনাকে চল্লিশের দশকের বলেই ধরছি), কিন্তু নিজের কবিতা বাছতে গিয়ে উনি – যাকে বলে “সেফ” খেলেছেন; বেছেছেন “কলকাতার যিশু” এবং “বাতাসি”। দুটি কবিতাই অত্যন্তই ভালো, কিন্তু নীরেনবাবুর কবিতা বলতে প্রথমেই এই দুটি কবিতার কথা মনে পড়ে। অন্য কিছু নিলে ভালো হতো না কি? জগন্নাথ চক্রবর্তীর কবিতা বেশি পড়ি নি, তবে দুটি কবিতাই (“স্বগত” এবং “পরস্পর”) ভালো লাগলো। রাজলক্ষ্মী দেবীর কবিতাদুটি (“কাঁকুলিয়া রোডের বেহালাদারকে” এবং “সন্তানেরা”) পুনরায় না দিয়ে অন্তত একটা নতুন কবিতা দিতেই পারতেন। বিশেষত এই কবিতাটি তো ভোলবার নয়--
“তখন বলবো আমি রাজ্যচ্যুত রাজ্ঞীদের ভাষা---
জানিস আমার সে ছিল এক আশ্চর্য ভালোবাসা
তোর কি ক্ষমতা আছে মিথ্যে করে দিবি সে পাওয়াকে?”
পঞ্চাশের দশকের প্রায় সবাই আছেন – সুনীল-শক্তি-শরৎ-অলোকরঞ্জন-শঙ্খ ঘোষ (ইনিও বিস্ময়করভাবে দেশের পঞ্চাশবছরের সংকলনে ছিলেন না!), স্বগত উচ্চারণের কবি সুনীল বসু, সমসাময়িক বয়োজ্যেষ্ঠ শামসুর রাহমানও। শামসুর রাহমান (“মাতৃডাক” এবং “অতিথি”), অরবিন্দ গুহ (“অদ্বিতীয়” এবং “কানাকড়ি”), অলোকরঞ্জন (“ওল্ড পীপ্ল্স্ হোম” এবং “কবিতার কাজে”) নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন নেই। অনেকদিন পরে অলোকরঞ্জন পড়ে আবার মনে হলো আঙ্গিকের দিক থেকে ইনিই সুধীন্দ্রনাথ দত্তের প্রকৃত উত্তরসূরি--
“একটি মেঘের নাম আবর্তক, সে যদি গর্জায়
সমস্ত নদীর নাম মেঘনা হয়, তারা ফুঁসে ওঠে।
কেউ বলল, একটি সংস্কৃত ছন্দ উপেন্দ্রবজ্রা
তাতে যদি স্তোত্র বাঁধো, কী-শ্রাবণে অথবা শরতে”
শরৎ মখোপাধ্যায়ের “পোকার শরীর” এবং “মূর্খ”ও খুব ভালো নির্বাচন বলে মনে হলো না। সুনীল বসুর “চৌরঙ্গির সেই বাড়ি” খুব ভালো, “জাগুয়ার” ততটা ভালো লাগলো না (খুব বেশি জীবনানন্দ-তাড়িত মনে হলো); শঙ্খ ঘোষ আছেন তাঁর “মূর্খ বড়ো, সামাজিক নয়” আর “হওয়া” নিয়ে। আর ঘোর আপত্তি আছে শক্তির কবিতায় (“মানুষ যেভাবে কাঁদে” এবং “হঠাৎ সুন্দর”), এবং সুনীলের কবিতায় (“নদীর ধারে নির্জন গাছতলায়” এবং “চোখ ঢেকে”)। এই দুই বহুপ্রজ কবির তুলনায় সাধারণ মানের কবিতা কেন বাছলেন নীরেনবাবু, বুঝলাম না।
সুনীল-শক্তির কি বাছতাম আমি হলে? পয়লা নম্বর – আমি এদের দুজনেরই তিনটে করে কবিতা বাছতাম – জীবনানন্দের সঙ্গে এক পর্যায়ে ফেলে। তারপর অনেকক্ষণ কপাল কুঁচকে, অনেক বিখ্যাত কবিতা বাদ দিয়ে বেছে নিতাম শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের “যখন বৃষ্টি নামলো”--
“বুকের মধ্যে বৃষ্টি নামে, নৌকা টলোমলো
কূল ছেড়ে আজ অকূলে যাই এমনও সম্বল
নেই নিকটে--হয়তো ছিলো বৃষ্টি আসার আগে
চলচ্ছক্তিহীন হয়েছি; তাই কি মনে জাগে
পড়োবাড়ির স্মৃতি? আমার স্বপ্নে-মেশা দিনও?
চলচ্ছক্তিহীন হয়েছি; চলচ্ছক্তিহীন।”
বাছতাম “আমি স্বেচ্ছাচারী”--
“তীরে কি প্রচণ্ড কলরব
'জলে ভেসে যায় কার শব
কোথা ছিলো বাড়ি?'
রাতের কল্লোল শুধু বলে যায়---'আমি স্বেচ্ছাচারী।'সমুদ্র কি জীবিত ও মৃতে
এ ভাবে সম্পূর্ণ অতর্কিতে
সমাদরণীয়?
কে জানে গরল কি না প্রকৃত পানীয়
অমৃতই বিষ!
মেধার ভিতর শ্রান্তি বাড়ে অহর্নিশ।”
আর “পরস্ত্রী”--
“যাবো না আর ঘরের মধ্যে অই কপালে কী পরেছো
যাবো না আর ঘরে
সব শেষের তারা মিলালো আকাশ খুঁজে তাকে পাবে না
ধ’রে-বেঁধে নিতেও পারো তবুও সে-মন ঘরে যাবে না
বালক আজও বকুল কুড়ায় তুমি কপালে কী পরেছো
কখন যেন পরে।”
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বেছে নিতাম “মহারাজ, আমি তোমার”--
“মহারাজ, আমি তোমার সেই পুরনো বালক ভৃত্য
মহারাজ, মনে পড়ে না? তোমার বুকে হোঁচট পথে
চাঁদের আলোয় মোট বয়েছি, বেতের মতো গান সয়েছি
দু’হাত নিচে, পা শূন্যে – আমার সেই উদোম নৃত্য
মহারাজ, মনে পড়ে না? মহারাজ, মনে পড়ে না? মহারাজ,
চাঁদের আলোয়?...”
আর, “অন্যলোক”--
“যে লেখে, সে আমি নয়
কেন যে আমায় দোষী কর!
আমি কি নেকড়ের মতো ক্রুদ্ধ হয়ে ছিঁড়েছি শৃঙ্খল?”
আর রাখতাম “একটি কবিতা লেখা”--
“প্রতিধ্বনি তুমি তো স্বর্গের দিকে গিয়েছিলে
কেন ফিরে এলে?”
যাই হোক, এই সব কাটামুণ্ডুর দিবাস্বপ্ন বন্ধ করে বইটায় ফিরে আসি।
পঞ্চাশের দুজন কবি বাদ পড়েছেন – তারাপদ রায় এবং উৎপলকুমার বসু – সেটা সত্যিই তাঁদের প্রতিভার প্রতি ঘোর অবিচার। বিশেষত তারাপদ রায়কে ভুলে যাওয়া অসম্ভব – ওই ধরনের বিদ্রূপ আর ঠাট্টা মেশানো কবিতা আর কেউ লিখেছেন কিনা জানা নেই। ওনার সম্ভবত শেষ কবিতা “রবার” থেকে কয়েকটা লাইন তুলে দিলাম—
“বৃষ্টি ও কুয়াসাভরা শেষরাতে
অশোকনগর, দিল্লী, ঢাকা, ম্যানহাটান, বার্কলে, সিঙ্গাপুর
এলাসিন, টাঙ্গাইল, এসপ্ল্যানেড, কালিঘাট, পণ্ডিতিয়া, থিয়েটার রোড
এক অলৌকিক নোয়ার নৌকো, কিছুটা স্টিমার, ট্রেন, বিমান মেট্রোরেল হয়ে অটোর মতো
এঁকেবেঁকে ভিড় কাটিয়ে
লবণহ্রদের বাড়ির দরজায় এসে দাঁড়ায়
খুব চাপা কন্ঠে কে যেন ভাঙ্গা ভাঙ্গা গলায় বলে,
বড়বাবু জানতে চেয়েছেন,
রবার কি আরও টানতে হবে।
ফিসফিস করে প্রশ্ন করে,
ওহে, এইচ-এ পঞ্চান্ন-
ভেবে দেখেছো
কতদূর এসে গেছ? কতদূর?”
তারাপদবাবুর অভিমান ছিলো যে ওঁর কবিবন্ধুরা নাকি ওঁনাকে কবি হিসেবে গণ্য করেন না। নীরেনবাবু, আপনিও সেই দলে পড়লেন শেষে? আর উৎপলকুমার বসুর স্বপ্নে পাওয়া আঙুল আপনাকে স্পর্শ করলো না?
চলে আসি ষাটের দশকে। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় (“এম আর আই” এবং “সহোদরা”), প্রণবেন্দু দাশগুপ্ত (“পাগল” এবং “ঘুমের ভিতরে হাঁটা”), প্রণবকুমার মুখোপাধ্যায় (“ভাঙনকাল” এবং “তারিখ”) খুবই সুনির্বাচন হয়েছে। দিব্যেন্দু পালিতকে লোকে হয়তো কবি হিসেবে ভুলেই গিয়েছে আজ, তাঁকে মনে করিয়ে দেবার জন্যে ধন্যবাদ। সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিকভাবে মনে পড়লো প্রতিভা বসু তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন সুধীন্দ্রনাথ দত্তর শেষ যাত্রার কথা - যেখানে শ্মশানে দিব্যেন্দু পালিত রুমাল দিয়ে সুধীন্দ্রনাথ দত্তর মুখ মুছিয়ে দিচ্ছেন।
ষাটের দশকে উঠে এসেছিলেন বেশ কিছু মহিলা কবি, তাঁরা প্রায় সকলেই আছেন – বিজয়া মুখোপাধ্যায় (“বেড়াতে এসেছিলেন” এবং “কৈশোর”), কেতকী কুশারী ডাইসন (“কে তুমি?” আর “শিল্পী”), গীতা চট্টোপাধ্যায় (“শ্রীচরণেষু, দিদি” এবং “বিদ্যাসাগর সেতু”) এবং দেবারতি মিত্র (“শ্মশানকালী” এবং “উৎসর্গপত্র”)। দেবারতি মিত্রর অসামান্য উপমা অনেকসময়ই জীবনানন্দকে মনে করিয়ে দেয়--
“লন্ঠন ডুবিয়ে চলে গেল ঢালু জলে।
গলাটেপা মাঝরাত,
আরো ব্যর্থ আরো ছন্ন চোখহীন পদ্মের শিকড়,
ওপরে কোথায় শূন্য?
দমবন্ধ আকাশ জলের নিচে সে এখন মেঘ
একাকিনী।”
নবনীতা দেবসেনকে না পেয়ে দুঃখ পেয়েছি একটু। আনন্দ পাবলিশার্সের কোথাও ওনার কোনো উল্লেখযোগ্য কবিতা কি নেই?
ষাটের দশকের সম্ভবত উজ্জ্বলতম কবি ভাস্কর চক্রবর্তীর “শুধু এইটুকু” আর “সাক্ষাৎকার” ভালো, কিন্তু খুব ভালো মনে হয় নি। এর চেয়ে আরো ভালো কবিতা আছে ওনার।
সত্তরের দশকে সেই অর্থে খুব বিখ্যাত কবি কেউ আসেন নি। একেবারে শেষের দিকে এসেছিলেন যিনি, এবং এখনকার বাংলা কবিতার সিংহাসনেও একমাত্র তাঁরই অধিকার। কিন্তু জয় গোস্বামীর আগে যারা এসেছেন, তাঁদের কথা একটু লেখা যাক।
সুব্রত রুদ্র আছেন “শ্যাওলা” আর “কান্না” নামক দুটি সুন্দর কবিতা নিয়ে। কৃষ্ণা বসু সেই অর্থে নারীবাদী কবি (কথাটা বিশ্রী শুনতে, মানেও ঠিক হয় না, কিন্তু অন্য কিছু কথা ভেবে পেলাম না), তাঁর “ভিতর বাঘিনী” কবিতাটি বেশ ভালো--
“অদ্ভুত আর্তনাদে ভরে যায় রাত্রি চরাচর।
পরদিন তার পরদিন, তারও পরের দিন
বাঘিনী দেখায় খেলা
রিঙ মাস্টারের চাবুক একবার ডানদিকে
আর একবার বামদিকে হেলে –।”
অন্য কবিতাটি “তবু জন্ম-পরবাসী”।
এই সময়ের আরেক খুব ভালো কবি রণজিৎ দাশ “ঠাকুরদার জন্যে পোস্টকার্ড” আর “মানুষ দুর্বোধ্য প্রাণী” নিয়ে উপস্থিত (“কবিপত্নী” কবিতাটা বোধহয় আরও ভালো হতো), আছেন সুধীর দত্ত (“পিত্তল দেবতা হাসে”, “আনন্দ খুঁড়ে”), শ্যামলকান্তি দাশ (“এবারে বাঘ”, “দেখা”) আর বীতশোক ভট্টাচার্য (‘মায়া”, “পথের পাঁচালী”)। বীতশোক ভট্টাচার্যর “পথের পাঁচালী” পড়তে গিয়ে অনুভব করলাম এর মধ্যে কখন বিভূতিভূষণ লেজেন্ড হয়ে উঠেছেন; তাঁর “পথের পাঁচালী” বহুপঠিত, তাই তার উল্লেখ নির্দ্বিধায় ব্যবহার করা চলে। কবিতাটার দুচার লাইন--
“চলেছে পাখি ও পথ, নবীনের মুদ্রা, আর খরগোশের ছুট।
খোকার মৃত্যুর পর ‘খোকা’-ডাক থাকছে কোথাও।
না প্রশ্ন। বিস্ময় নয়। এরা নয় হরিহর, অপু ও কাজল।”
জয় গোস্বামীর দুটি কবিতাই চমৎকার বেছেছেন। একটি বহুল পঠিত “প্রাক্তন” (এখন “চতুষ্কোণ” চলচ্চিত্রর দৌলতে সকলের স্মৃতিতে উজ্জ্বল), অন্যটি “মা আর মেয়েটি”--
“এক পথ ঘুমন্তর পায়ে
এক পথ নৌকার পারানি
এক পথ পালকের গায়ে
মা আমি সমস্ত পথ জানি...”
কবিতাটি শেষ হয়--
“মা আমার এক দীঘি জল
সারা গ্রাম করে ছলোচ্ছল...
‘পোড়ামুখী, দু চক্ষের বিষ
ফের তুই প্রেমে পড়েছিস?’”
শেষ দুটি লাইন পড়ে কি “ইশ্বর আর প্রেমিকের সংলাপ” মনে পড়ে গেলো?
পূর্ণেন্দু পত্রী লিখতে শুরু করেছিলেন পঞ্চাশের দশকেই, কিন্তু তাঁর কবি-পরিচিতি সত্তরের দশকে, তাই ওনাকে সত্তরের দশকের বলেই ধরছি। পূর্ণেন্দু পত্রীর কবিতা নিয়ে নানান বিতর্ক আছে – তিনি “বিশুদ্ধ” কবিতা না লিখে “পপুলিস্ট”, “বাজারি” কবিতা লিখতেন বলে বিজ্ঞ লোকেরা বলতেন; হয়তো এই জন্যেই বাদ পড়েছেন এই সংকলন থেকে। কিন্তু আমরা যারা আশির দশকে বড়ো হয়েছি, আমরা জানি যে “কথোপকথন” কি তীব্র আবেদন রেখেছিলো সেই সময়। নন্দিনী আর শুভঙ্কর আমাদের খুব কাছের মানুষ ছিল সেইসব দিনে। তাই ওনাকে অস্বীকার বোধহয় করা যায় না।
আশির দশকে উঠে আসেন একরাশ কবি – সুবোধ সরকার, পিনাকী ঠাকুর, মল্লিকা সেনগুপ্ত, অনুরাধা মহাপাত্র, চৈতালি চট্টোপাধ্যায়, ইত্যাদিরা। সুবোধ সরকারের কবিতাগুলি ভালো (“সবুজ কবিতা”, “শুধু রুটির জন্যে”) – স্পষ্টভাবে রাজনৈতিক কবিতা হওয়া সত্ত্বেও সার্থক কবিতা, প্যামফ্লেট নয়। পিনাকী ঠাকুরের “চিরহরিৎ” বেশ ভালো – “ছিঁড়ে যাওয়া বিদ্যুতের তার.../ সাদা ও নিষ্ঠুর সালোয়ার” এর স্মার্টনেস মনোগ্রাহী, প্রবালকুমার বসুর “ভিনদেশী গল্প” আর “অনাত্মীয়” ভালই লাগলো। এই সময়ে মহিলা কবিও বেশ কয়েকজন উল্লেখযোগ্য কবিতা লিখেছেন, তাঁরা এই বইটাতেও আছেন - অনিতা অগ্নিহোত্রীর “রংকানা” আর “সন্তানকে”, অনুরাধা মহাপাত্রর “সুদর্শন উড়িতেছে” আর “আনা আখমাতোভার প্রতি বাংলা কবিতা” (আনা আখমাতোভা এক রুশ কবি – স্তালিনের আমলের বর্বরতার প্রতিবাদে লেখা তাঁর “রিকুইম” কবিতাটি মাস্টারপিস বলে গণ্য করা হয়), মল্লিকা সেনগুপ্তর “গণ্ডি” ও “কবিতার জন্মলগ্ন” (আহা – দুটিই চমৎকার), চৈতালী চট্টোপাধ্যায়ের “যৌবন” ও “নলিন সরকার স্ট্রিট” আর তসলিমা নাসরিনের “ভয়” এবং “কষ্টের কস্তুরী”। আর এগোবার আগে এগুলো একটু পড়ে নিই--
“কিছু কিছু কষ্ট আছে
রাত পোহাবার আগে বাতাস মেলায়,
কিছু কষ্টের বাসা বাঁধে
ভালবেসে থেকে যায় পুরোটা জীবন”- তসলিমা নাসরিন
“এপারে ওপারে চলে দড়ি টানাটানি
আশাপূর্ণা লিখেছেন গণ্ডির কাহিনি।
বোভোয়া শিখিয়েছেন গণ্ডি ভাঙা গান
গণ্ডি ভাঙতে গেলে বড় পিছুটান”- মল্লিকা সেনগুপ্ত
“এখনও কবিতা আছে!
তুমি যেয়ো না এখনই,
থাকো।
শেষ জলসহ লেগে থাকো”- চৈতালী চট্টোপাধ্যায়
সবকটিই সুন্দর। তসলিমা নাসরিনের গায়ে যতই নারীবাদী, প্রতিবাদী ইত্যাদি তকমা লাগানো হোক না কেন, আসলে উনি আদ্যন্ত রোম্যান্টিক এক কবি – এই কবিতাতেও এর প্রমাণ রয়েছে।
একটু আগে পরে ধরে আমি শিবাশিস মুখোপাধ্যায় আর সুমন গুণকে নব্বইয়ের দশকের বলেই ধরেছি। দুজনেই আছেন। শিবাশিসের কবিতা (“বাঙালির ইতিহাস” এবং “সীমান্ত যুদ্ধের তালে তালে”) বেশ ভালো, একটা হালকা জয় গোস্বামীর প্রভাব বোধহয় আছে; সুমন গুণের কবিতাদুটি (“শোক” আর “স্বয়ংক্রিয়”) ভালোই। এই সময়ের অত্যন্ত শক্তিশালী কবি যশোধরা রায়চৌধুরীর “মন ভাল নেই” ভীষণ ভালো লাগলো। অসীম নৈপুণ্যে কবি আধুনিক প্রযুক্তি আর শূন্যতাবোধকে একসূত্রে গেঁথেছেন--
“মন ভাল নেই মন ভাল নেই মন ভাল নেই
সব এস এম এস এখন খুলি না কারণ আসে না ঠিকঠাক কোনও
মেসেজ এখন
কাকে বলি এই সত্যিটা, বলো, তুমি তো নীরব, চুপচাপ থাকো,
নীরবতা বড় ভারী মনে হয় ওই পারে, আর এই পারে শুধু
কথা জমে যায়, অনেক কথারা”
কেন জানি না, কবিতাটা মনে হলো বিষ্ণু দের “টপ্পা-ঠুংরি”র উত্তরসূরী।
“সীমন্তিনী মডেল হতে চেয়েছিল”ও খুব ভালো লাগলো – প্রথম লাইনে “অমলকান্তি রোদ্দুর হতে চেয়েছিল”কে মোচড় মারাটা অসাধারণ। সেবন্তী ঘোষের কবিতা (“দুষ্টা” এবং “বহ্নি”) এবং শ্বেতা চক্রবর্তীর কবিতা (“চিতাবতী” এবং “নববর্ষ”) আগে পড়ি নি, ভালো লাগলো। বিভাস রায়চৌধুরীর কবিতা (“একটি নদীর মৃত্যু” আর “শান্ত পাগল একা”) বরাবরই খুব সুন্দর – বিশেষ করে চমৎকার কিছু শব্দবন্ধ বা রূপকল্প ওনার বিশেষত্ব--
“আলো এসে ভোরের ভিতর
শ্বাসকষ্ট ফেলে গেল।”
বা “সকালের অসম্ভব শব”: পড়লেই ভালো লাগে। এই ব্যাপারে বিভাসবাবু জীবনানন্দের উত্তরসূরী।
পৌলোমী সেনগুপ্তর “মেট্রো” ভারি কনটেমপোরারি এবং বরাবরের মতো মনোগ্রাহী--
“তোমার কথা ভাবতে গিয়ে পেরিয়ে গেছি চাঁদনি চক
পাতাল ফুঁড়ে চলেছে ট্রেন, হৃদয় খোঁড়ে নিজের নখ”
এ একটা ছন্দ আছে যেটা ট্রেনের দুলুনিকে মনে করিয়ে দেয়। অন্য কবিতাটিও (“ছবি”) বেশ। মন্দাক্রান্তা সেন আমার খুব প্রিয় কবি, তার কবিতা হতাশ করে নি (“কলঘরে” এবং “মধুকূপী মাঠের গল্প”) – যদিও মধুকূপী ঘাস জীবনানন্দের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীনভাবে জড়ানো।
দু হাজারি দশকের তিনজন কবির কবিতা রয়েছে – বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় (“ঘরপোড়া”, “ফিচারলেখক”), শ্রীজাত (“ব্যাটাচ্ছেলে” আর “ওপরচালাক”) এবং ঋতব্রত মিত্র (“বিকল্প”, “কূট”)। শ্রীজাতর কবিতা পড়তে বেশ ভালো লাগে আমার – হালকা হাওয়ায় অনেক গভীর কথা বলে থাকেন। তবে কখনো কখনো ওনার কবিতা সম্পর্কে একই কথা মনে হয়, যা পূর্ণেন্দু পত্রীর ক্ষেত্রে শুনে এসেছি এককালে। একটা সমর সেন সুলভ ফ্লিপ্যানসি আছে শ্রীজাতর – যেটা অতিব্যবহারে খেলো হয়ে যেতে পারে। ঋতব্রতর কবিতা আমি আগে পড়ি নি, যদিও ইনি “পরবাসী” – অর্থাৎ পরবাসে একসময় নিয়মিত লিখতেন। ভালো লাগলো পড়ে।
আর কি করা যেতে পারতো এই বইটিতে? সেটা বলতে গেলে ভাবতে হয় এই সংকলনটির উদ্দেশ্য কি? আমার মনে হয় আনন্দর ষাট বছর একটা উপলক্ষ্য মাত্র, আসলে এই বইটি বাংলা কবিতার যাত্রাপথের একটা রেখাচিত্র – একটা রোডম্যাপ; রবীন্দ্রনাথ থেকে আজকের কবিতার আগমনের গতিপ্রকৃতি। যদি এই উদ্দেশ্যই ধরে নিই, তাহলে মনোযোগী পাঠকদের আরেকটু মস্তিষ্কপুষ্টির উপাদান দিলে মন্দ হতো না। প্রত্যেক কবিতার নিচে কবে প্রথম প্রকাশ এবং কোন কাব্যগ্রন্থে আছে সেটা দেওয়া থাকলে কবির কাব্যজীবনের পর্যায়টা জানা যেতো, কাব্যগ্রন্থটি খুঁজে বের করে সেই বইয়ের বাকি কবিতা পড়বার আগ্রহ জাগানো যেতো। তাছাড়া এই সংকলন গত ষাট বছরে প্রকাশিত কবিতার একটা 'সাব-সেট'-ই মাত্র কভার করেছে – শুধুমাত্র যাঁরা আনন্দতে লিখেছেন, তাঁরাই এখানে উপস্থিত। যাঁদেরকে “নিরানন্দ” হবার কারণে নেওয়া গেলো না – যেমন বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, বিনয় মজুমদার, প্রণব বসুরায়, তুষার রায়, গৌতম বসু, মহাদেব সাহা, অরুণ চক্রবর্তী, মনীন্দ্র গুপ্ত প্রমুখ কবিরা বা বাংলাদেশের নির্মলেন্দু গুণ, হেলাল হাফিজ, রুদ্র ইত্যাদিরা, এঁদের একটা উল্লেখ থাকলে আগ্রহী পাঠকরা এনাদের কবিতা আলাদা করে পড়ে দেখতে পারতেন। উল্লেখ করা যেতে পারতো যেসব কবিদের স্থানাভাবে নেওয়া গেলো না বা যেসব কবি মাঝখানে দীর্ঘদিন আনন্দ পাবলিশার্স-এর হয়ে লেখেন নি। যেমন খোদ শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের প্রথম কবিতার বই, 'হে প্রেম, হে নৈঃশব্দ্য' গ্রন্থজগৎ থেকে ১৯৬১ সালে প্রকাশিত হবার দীর্ঘ এগারো বছর বাদে আনন্দ থেকে বেরোয় 'প্রভু নষ্ট হয়ে যাই'। শক্তির গ্রন্থপঞ্জিটা অনুসন্ধিৎসু পাঠকরা একবার দেখে নিতে পারেন--ইন্টারেস্টিং লাগবে।
আর সমালোচনা নয়, তর্ক নয়, অক্ষম পিঁচুটিওয়ালা চোখে খুঁত ধরা নয়। এবার কলম বন্ধ করে কফির পেয়ালা নিয়ে কবিতাসমুদ্রে ডুব দেওয়া। তাই আজকের মতো – আলবিদা!!