সেই বেশ দুষ্টু-মিষ্টি একটা গান ছিল না, ‘খেলবো হোলি, রং দেবো না, তাই কখনো হয়!’ এ যেন তারই প্যারোডি, ‘যাবে ভ্রমণে, ঝঞ্ঝাটে পড়বে না, তাই কখনো হয়!’ সত্যিই তো জীবনে কটা ভ্রমণ আর একদম নিরুপদ্রব, ঝঞ্ঝাটমুক্ত, বিভ্রাটবিহীন, দিলখুশ ভ্রমণ হয়? ভ্রমণে কিছু না কিছু ঝঞ্ঝাট যেন থাকবেই থাকবে। এও যেন খানিকটা সেই দুষ্টু রসিকতাটার মত, ‘বিয়ে করলে, ঝগড়া ফ্রি!’ অর্থাৎ বেড়াতে গেলে, ঝামেলা ফ্রি!’ সে-সব ঝামেলা-ঝঞ্ঝাটকে তুমি কেমন করে সামলাও সে তোমার এলেম!
আমার জীবনে ভ্রমণ নয় নয় করে কম হল না। ছোটবেলা থেকেই স্বপ্ন ছিল নিজের দেশটাকে অন্তত দু’বার ঘুরে-বেড়িয়ে দেখব। এক দেখাতে ফাঁকি থেকে যায়। সবটা ঠিকঠাক দেখা হয়ে ওঠে না। তাই দ্বিতীয়বারের দেখায় সব অপূর্ণতা কেটে যায়। কিন্তু স্বপ্ন দেখা আর স্বপ্ন পূরণ হওয়ার মধ্যে বিস্তর চোখরাঙানি আর রংবাজি রয়েছে। এ বলে তোকে দেখেই ছাড়ব, ও বলে এইটুকু তো জীবন, চাইলেই পারবে নাকি?
সত্যিই তো এই ছোট্ট জীবনে গোটা ভারতবর্ষটাকে দু’বার ঘুরে বেড়িয়ে দেখা চাট্টিখানি কথা! হায়! জীবন এত ছোট ক্যানে?....
প্রতিবছর সময়-অসময়ে রণে-বণে-জলে-জঙ্গলে-পাহাড়ে-সমুদ্রে ঘুরতে ঘুরতে আমার মনটাও কেমন ঘোরাবাজ হয়ে গেছে। ঘরে থাকতে আর চায় না। চার দেওয়াল থেকে ছিটকে ছিটকে বেরিয়ে পড়তে চায়। ‘থাকবো নাকো বদ্ধ ঘরে, দেখবো এবার জগৎটাকে’ — এই পংক্তিটাই যেন আমার জীবনের রিংটোন হয়ে গেছে!
এই দুনিয়াদেখার নেশায় বারেবারে ভ্রমণে যাই। আমার জীবনে ভ্রমণ, না ভ্রমণে জীবন — এও এক দ্বন্দ্বমূলক ভ্রমণবাদ! তাই কাটাছেঁড়া করে দেখতে খুব ইচ্ছে করে — কোনটা সত্য আর কোনটা অলীক!
কত অলীক আশ্চর্য সব ভ্রমণেই না গেছি। সেই সব ভ্রমণে বিস্তর অঘটন ঘটেছে। বারংবার বিভ্রাট ঘটেছে। সে সব স্মৃতি মনে পড়লে আজও বেশ রোমাঞ্চ হয়। বুকের ছাতি ফুলে ফেঁপে ওঠে। আমার ভ্রমণ বিভ্রাটের কিছু গল্প এই সুযোগে বলা যায়। ......
সময়টা ২০০৪। সেবার সপরিবার বেড়াতে গিয়েছিলাম কিন্নর-লাহুল-স্পিতি ভ্যালি। তখন কিন্তু কিন্নর-লাহুল-স্পিতি আজকের মত জনপ্রিয় ভ্রমণসূচী ছিল না। বেশ দুর্গম, বিপদসংকুল বলে খ্যাত ছিল।
কিন্নর প্রদেশের সারহান, সাংলা, ছিটকুল, কল্পা, রেকংপিও ঘুরে আমরা যাচ্ছি স্পিতি উপত্যকার পথে হাজার বছরের পুরানো তাবো মনাস্ট্রি দেখতে। সঙ্গে অদ্ভূতভাবে জুটে গেল আমাদের মতই এক ঘোরাবাজ জুটি। সাহেবের নাম ব্রেন্থ, মেমসাহেবের নাম সিলভিয়া। ওরা এসেছে ইটালির জেনোয়া শহর থেকে। হানিমুন কাপল। দিল্লি, রাজস্থান হয়ে চলে এসেছে কিন্নর-লাহুল-স্পিতিতে। এরপর যাবে লেহ-লাদাখ। সাহেব এক চার্টাড ফার্মের অ্যাকাউন্টেন্ট। মেমসাহেব চাইল্ড সাইকোলজিস্ট।
শালুক চিনেছে গোপাল ঠাকুরের মত ওরা আমাকে বেশ পাকড়াও করে ফেলল। আমি ওদের একদম ঘোষিত লোকাল গার্জিয়ান কাম ফ্রেন্ড হয়ে গেলাম। ওরা আমাদের মতই মধ্যবিত্ত মেজাজের ট্যুরিস্ট। লোকাল বাসে চড়তে চায়। সাধারণ হোটেলে থাকতে পারে। খাওয়া নিয়ে বায়নাক্কা নেই। যাকে বলে সাচ্চা ট্যুরিস্ট। আমি, বউ, মেয়ে আর ওরা দুজন — একদম ফাইভ ম্যান আর্মি হয়ে গেলাম!
ব্রেন্থ দীর্ঘকায়, বলিষ্ঠ সুপুরুষ। একটু লাজুক। সিলভিয়া বিদুষী ও হাসিখুশি মেমসাহেব। মেলামেশায় একদম দিলদরিয়া। বন্ধুত্ব হয়ে গেল চট করে। সিলভিয়া তো আমার দশ বছরের মেয়ে ডুলুংকে ওর হেফাজতেই নিয়ে নিয়েছিল। সানক্রিম লাগিয়ে দিচ্ছে, কেক খাওয়াচ্ছে, বাসে নিজের পাশে বসাচ্ছে — ডুলুংও মেমসাহেব আন্টিতে মুগ্ধ!
রেকংপিও বাসস্ট্যান্ড থেকে সরকারী বাসে আমরা চলেছি তাবোর উদ্দেশ্যে। পথে পড়বে মারলিং পয়েন্ট। সেখানে বাস বদল করতে হবে। কারণ ওটা ধ্বসপ্রবণ এলাকা। বাস যেতে পারে না। এই বাস থেকে নেমে মালপত্র সহ বিপজ্জনক পথটুকু দ্রুত পায়ে হেঁটে অতিক্রম করে ওপারে গিয়ে আবার বাসে উঠতে হবে। সে বাস পৌঁছে দেবে তাবো।
মারলিং পয়েন্ট যথারীতি বাস পৌঁছে থমকে দাঁড়াল। আমরা মালপত্র নিয়ে নেমে এলাম। চোখের সামনে দেখছি ভাঙাচোরা ভয়ংকর রাস্তা। পাহাড়ের ওপর থেকে হঠাৎ হঠাৎ পাথরের চাঁই খসে পড়ছে। ঝরে ঝরে পড়ছে। ধুলো উড়ছে খুব। সেই সঙ্গে চড়া রোদ। সান বার্ন হবেই হবে। ব্রেন্থ আমার কিছু লাগেজ স্বেচ্ছায় কেড়ে নিয়ে বলল, তুমি ফ্যামিলি নিয়ে আস্তে আস্তে এসো, আমি সিলভিয়াকে নিয়ে এগোচ্ছি। বাসে তোমাদের সিট রাখব।
আমি মেয়ে-বউকে নিয়ে হাঁটা শুরু করব, সে সময় বাসের কন্ডাকটর বললেন, আপনার ভারী লাগেজ দুটো রোপওয়েতে তুলে দিন। ওপারে গিয়ে পেয়ে যাবেন।
কথাটা মন্দ লাগে নি। সত্যিই আমার লাগেজদুটো বেশ ভারী। রোপওয়ে মানে একদম সেই প্রাচীনকালের যোগাযোগ ব্যবস্থা। এই পাহাড় থেকে ওই পাহাড়ে দুটো তারের বাঁধনে ঝুলছে একটা মালবাহনের লজঝড়ে ট্রলি। আমি সেই ফ্যাতাড়ুমার্কা ট্রলিতেই কি কুক্ষনেই না তুলে দিলাম আমার দামী লাগেজদুটো। যার মধ্যে আমার সর্বস্ব রয়েছে।
ফ্যাতাড়ুমার্কা ট্রলিতে ভাসতে ভাসতে যাচ্ছে আমার লাগেজ। দুই পাহাড়ের মাঝে গভীর খাদ। অনেক নীচে স্পিতি নদী। মেয়ে-বউকে নিয়ে ঝাড়া হাত-পায়ে দ্রুত হাঁটছি ওপারের উদ্দেশে। হঠাৎ কানে ভেসে এল হৈ হৈ চিৎকার। কুলি-মজদুররা দেখি লাফাচ্ছে, হায় হায় করছে, টুট গিয়া, ছুট গিয়া.... অবাক হয়ে দেখি রোপওয়ের একটা তার ছিঁড়ে গিয়ে ট্রলিটা শূন্যে ঝুলছে, আর আমার দুটো লাগেজও দোদুল্যমান। সে কোনও মুহূর্তে নীচের স্পিতি নদীর গভীর খাদে গিয়ে আছড়ে পড়তে পারে। পড়লেই সব শেষ। টুকরো টুকরো হয়ে ছিটকে ছড়িয়ে হারিয়ে যাবে সব কিছু। আমি একদম নিঃস্ব হয়ে পড়ব। আমার যাবতীয় টাকাপয়সা, রির্টান টিকিট, ভোটার কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, গরম পোষাক সব ওখানে!
এত অসহায় অবস্থা তখন আমি কি করব ভেবে উঠতে পারছি না। খবর নিয়ে জানলাম, ইঞ্জিনিয়ার না আসা পর্যন্ত কিচ্ছু করা যাবে না। সে এসে ছেঁড়া তার জোড়া দিয়ে যদি ঠিক করতে পারে তো ভালো, না হলে এভাবেই ঝুলে থাকবে আমার লাগেজ, আমার ভাগ্য! আর ইঞ্জিনিয়ার যে কখন আসবেন স্বয়ং দালাই লামাও জানেন না!
মেয়ে বউকে নিয়ে তখন আমি আক্ষরিক অর্থেই পথে বসে পড়েছি। হতাশ, বিধ্বস্ত। এমন সময় আবার প্রচণ্ড ঠাণ্ডা হাওয়া বইতে শুরু করল। চোখ-কান-মুখ খোলা রাখা যাচ্ছে না। হু হু করে ঠাণ্ডা বাতাসের ঝাপটা এসে ফাটিয়ে দিচ্ছে চামড়া। মুহূর্তে জায়গাটা ফাঁকা হয়ে গেল। চারপাশের সবাই পালিয়ে গেল। প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় হু হু করে কাঁপছি। আমরা তিনটি প্রাণী ওই বিশাল খাদের কিনারায় নি:সঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়ে ভাবছি, কি হবে আমাদের? বাসও ছেড়ে দেবে। বারবার হর্ন বাজাচ্ছে। এমন সময় ব্রেন্থ ছুটতে ছুটতে এসে আমার কাঁধে হাত রেখে বলেছিল, সুব্রত, ডোন্ট ওরি, উই উইল স্টে হিয়ার উইথ ইউ। প্লিজ ওয়েট, আই অ্যাম্ কামিং ব্যাক উইথ সিলভিয়া। ......
সেই ‘বন্ধুর স্পর্শ’ আমার কাঁধে আজও লেগে রয়েছে। আর সেইদিন থেকে আমার কাঁধ আরও শক্ত, চওড়া, মজবুত হয়ে গেল। আগুনে পুড়ে লোহা যেমন হয়, আমিও সেদিনের অভিজ্ঞতা থেকে অনেক পরিণত হয়ে উঠেছিলাম। সাহসী হয়ে উঠেছিলাম।
সে যাত্রায় সামান্য এক কুলি-মজদুরের অসামান্য বুদ্ধির জোরে ওই ছেঁড়া তারের ঝুলন্ত ট্রলিকে একটু একটু করে এপারে আনা সম্ভব হয়েছিল। সে এক অলৌকিক উদ্ধার কাহিনি। আমি ফিরে পেয়েছিলাম আমার সর্বস্ব। আনন্দে বুকে জড়িয়ে ধরেছিলাম তাঁকে। তাই আজও ভুলতে পারিনি সেই কুলিভাইকে। কালি-ঝুলি মাখা ভুখা এক মজদুর আমার জীবনে সেদিন সে ঈশ্বরের মত এসে উপস্থিত হয়েছিল। তাঁকে আমার প্রণাম জানাই। অভিবাদন জানাই!
বমডিলা থেকে সামান্য দূরে টেঙ্গা চু। চু অর্থাৎ নদী। সেই নদী বৃষ্টির জলে ফুলে-ফেঁপে ভয়ংকর হয়ে উঠে সড়ক পথকে একদম দু’খণ্ড করে দিয়েছে। সড়কপথে এখন আর যাওয়া সম্ভব নয়। আকাশপথে হেলিকপ্টার সার্ভিসও ওয়েটিং লিস্টে। অপেক্ষায় আমার মত বহু বহু মানুষ ও পর্যটক।
বমডিলায় ঘুরে-বেড়িয়ে কাটল বাধ্যতামূলক দুটো দিন। কোনও সমাধান সূত্র যখন পাচ্ছি না, সে-সময় খবর পেলাম ভারতীয় সেনাবাহিনী টেঙ্গা চু-তে উদ্ধারকাজে হাত লাগিয়েছে। ভেঙে দু’ভাগ হয়ে যাওয়া নদীর এপার-ওপারে শক্ত দড়ি ঝুলিয়ে দিয়েছে। সেই দড়ি ধরে ঝুঁকি নিয়ে স্থানীয় মানুষজনরা পারাপার করছে। ওপারে পৌঁছতে পারলেই গাড়ি পাওয়া যাবে তেজপুর-গৌহাটি পৌঁছানোর। কিন্তু ঝুঁকি নিতে হবে। জীবনের ঝুঁকি না হলেও শরীরের ঝুঁকি রয়েছে। যে কোনও মুহূর্তে হাত ফসকে পড়ে গেলে শরীরে আঘাত লাগবে যথেষ্ট।
তবু আমি ঝুঁকি নিয়ে চলে যাওয়ার কথাই ভাবলাম। এভাবে অনিশ্চিত অপেক্ষায় থাকাটাও আর ভালো লাগছে না। কিন্তু আমি ঝুঁকি নিতে চাইলেই তো হবে না। সঙ্গে মেয়ে-বউ রয়েছে। ওদের কথাও ভাবতে হবে।
শেষ পর্যন্ত অনেক দ্বিধা-দ্বন্দ্ব কাটিয়ে মেয়ে-বউ লাগেজ নিয়ে চললাম ভাঙা সড়কের ধারে। টেঙ্গা-চু সব তছনছ করে দিয়েছে। দড়িতে ঝুলে-ঝুলেই সেই নদীকে পেরবো। শুনলাম সেনা জওয়ানরা খুব সাহায্য করছেন। সেই ভরসাটা পাথেয় হল।
সেনা জওয়ানরা আমাদের দেখে কিছুটা বিস্ময় নিয়েই বলেছিল, আপনারা রিস্ক নিয়ে এভাবে যেতে পারবেন?
হ্যাঁ-না কিছুই বলতে পারিনি চট করে। অসহায়ের মত দাঁড়িয়েছিলাম। প্রকৃতি কত সুন্দর তার রূপ কতবার, কতভাবেই না দেখেছি। কিন্তু এমন ভয়ংকর রূপ আগে কখনো দেখিনি।
অনেক ভাবনাচিন্তার পর ঝুঁকি নিয়েই সেদিন দড়ি ধরে ধরে প্রায় ঝুলতে ঝুলতে আমরা টেঙ্গা চু-কে টপকে ছিলাম। আর তার সব কৃতিত্ব ভারতীয় সেনাবাহিনীর। সেদিন তাঁরা আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছিল, সাহায্য করেছিল অনেক। সমস্ত লাগেজ তাঁরাই বয়ে দিয়েছিল। আমার মেয়ে তখন ছোট, ওকে হাত ধরে ধরে পার করিয়ে দিয়েছিল। সেই ভয়ংকর নদী অতিক্রমের শিহরণ ভরা অনুভূতি আজও আমাকে উত্তেজিত করে। উদ্বেলিত করে।
সেই অ্যাডভেঞ্চার শেষ করে যখন ওপারে পৌঁছলাম আরো এক বিস্ময় অপেক্ষা করেছিল। মিলিটারি তাঁবুতে আমাদের দেওয়া হল গরম কফি আর পকোড়া। জীবনে সেই প্রথম খেয়েছিলাম করলার পকোড়া। তিতোর মধ্যেও যে এত মিষ্টি লুকিয়ে থাকে সেই অনুভূতি সেদিন হয়েছিল। তারপর মিলিটারি ট্রাকে করে আমাদের পৌঁছে দেওয়া হল টেঙ্গা বাসস্ট্যান্ডে। মিলিটারি ট্রাকে চড়ার সেই অনুভূতিও এই ভ্রমণে ছিল এক বাড়তি পাওয়া!
তাই সেদিনের সেই জওয়ানদের জানাই আমার শ্রদ্ধা। আমার ভালোবাসা।
ভারতীয় সেনা স্যালুট তোমাদের!
অভিবাদন তোমাদের!....
ভ্রমণ-এর শুরুতেই বিভ্রাট। আচমকা এক দুর্ঘটনা এসে বিপর্যস্ত করে দিল আমাদের। কার্গিল বাজারে সামান্য একটা ঢালু রাস্তা পেরোতে গিয়ে পা পিছলে পড়ে গেল আমার স্ত্রী। সোজা হয়ে আর উঠতে পারে না। পা দুটো বেঁকে- দুমড়ে গেল। টান করা যাচ্ছে না। অসহ্য যন্ত্রণা। হাউ হাউ করে কাঁদছে। কার্গিলের সান্ধ্য-বাজার তখন আমাদের ঘিরে ধরেছে। আমি অসহায়ের মত ভাবছি কি করব? এমন সময় স্থানীয় কার্গিলবাসীরাই এগিয়ে এসে বলল, সামনেই সরকারী হসপিটাল আছে নিয়ে চলুন।
ওরাই গাড়ি ডেকে নিয়ে এল। কোনওরকমে ওকে গাড়িতে তুলে নিয়ে চললাম কার্গিল হসপিটালে। কিন্তু হসপিটাল তেমন পরিচ্ছন্ন নয়। পরিকাঠামোও দুর্বল। যাই হোক ডাক্তারকে দৌড়াদৌড়ি করে কোয়ার্টার থেকে ডেকে আনা গেল। স্থানীয় মানুষজনরাই সব করলেন। ডাক্তার ভালো করে দেখে বুঝে ব্যথার ওষুধ ও ইঞ্জেকশন দিয়ে সেই মুহূর্তে ওকে ঘুম পাড়িয়ে দিলেন।
আচমকা পড়ে গিয়ে লিগামেন্টে আঘাত লেগেছিল। ডাক্তার পরামর্শ দিলেন, কার্গিল হসপিটালে চিকিৎসার সুযোগ তত ভালো নেই, আমি যদি লেহ্ হসপিটালে নিয়ে যেতে পারি তো ভালো হয়।
আমি লেহ্তে নিয়ে যাওয়ার কথাই ভাবলাম। পরের দিন ভোরেই গাড়ি ভাড়া করে ওকে শুইয়ে নিয়ে চললাম লেহ্।
কার্গিল থেকে লেহ্ দীর্ঘপথ। সারাদিন লেগে যায়। রুক্ষ্ম পথ। চারপাশে ন্যাড়া পাহাড়। চড়া রোদ্দুর। কিন্তু এই রুক্ষতার সৌন্দর্য্যও অসাধারণ। মন বিষন্ন। দু:শ্চিন্তা কাতর। তবু আমার পিপাসার্ত দু’চোখ মাঝে-মাঝেই দেখে নিচ্ছিল সেই রুক্ষতার রূপকে। এর অপরূপ-ময়তাকে।
কার্গিলে ডাক্তার বলেছিলেন, পা’কে দু’দিন রেস্ট দিতে পারলে আর ওষুধগুলো খেলে অনেকটা কিওর হয়ে উঠবে। ন্যাচারাল হিলিংও হবে। তারপর একটু একটু করে হাঁটতে পারবে।
পা ভাঙে তো, মন ভাঙে না। মন পবনের নাও, ভুবনে ভাসিয়া ঘুরিয়া বেড়াও। ভ্রমণ এমনই তীব্র এক মাদক। যে একবার সেবন করেছে তার আর নিস্তার নেই। নেশাখোর ঘোরাবাজ তাকে হতেই হবে। এ যেন সেই রবীন্দ্রসংগীতের মত, ‘আমি তোমার সঙ্গে বেঁধেছি আমার প্রাণ, সুরের বাঁধনে’..... এই বন্ধন বড় গাঢ় গভীর, একে ছিন্ন করে বিচ্ছিন্ন হওয়া সহজ নয়।
লেহ্ শহরে দু’দিন থাকার পর আমরা ওকে নিয়ে লেহ্-র দর্শনীয় মনাস্ট্রিগুলো সব দেখে চললাম প্যাংগং লেক। সেখান থেকে একে একে নুব্রাভ্যালি, সোমোরিরি, তাংলাংলা, লাচুংলা, বারলাচালা, সরচু, কেলং হয়ে রোটাংপাস দিয়ে মানালি। সফরসূচী অক্ষত রেখেই সব ঘোরা হল। মানালি থেকে চলে গেলাম শান্ত নির্জনতায় দুটো দিন বিশ্রাম নিতে কুলু উপত্যকায়।
কুলুর বুক দিয়ে বয়ে যাচ্ছে বিয়াস নদী। শান্ত, সুন্দর বিয়াস। একদিন সন্ধ্যায় বিয়াসের জলে দাঁড়িয়ে সূর্যাস্তের মায়াবী আলোয় জলস্পর্শ করে শ্রদ্ধা জানিয়েছিলাম আমি আমার ভাগ্যকে। যে ভেঙেও ভাঙেনি। হেরেও হারে নি। নষ্ট হয় নি আমার সফর, আমার ভুবন দেখার তীব্র আকুতি! এমন সৌভাগ্য ক’জনের হয়!....
তাই ভ্রমণে যতই অপ্রত্যাশিত বিভ্রাট, বিপদ এসে বিচলিত, বিভ্রান্ত করে দিক না কেন, বিভ্রাটগুলোকে আমি আমার মত করে মানিয়ে-গুছিয়ে নিতে পেরেছি। তাই হারতে হারতেও জিতে গেছি!
হে পথ, চিরপ্রণম্য তুমি!
তোমাকে প্রণাম। আমায় তুমি চিরপথিক করে রেখো! .....