পরবাস: ফিল্ম এবং সাহিত্য এই নিয়ে বলছিলেন...
বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত: আমার কাছে সিনেমার কোন দায় নেই সাহিত্যের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ার। সাহিত্য সাহিত্যের মতো থাকতে পারে, সিনেমা সিনেমার মতো বেড়ে উঠতে পারে।
পরবাস: আবার সাহিত্যের কাঠামোটা ব্যবহৃত হতেই পারে--
বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত: নাও হতে পারে।
পরবাস: আপনার ছবিতে অনেকবার হয়েছে... মানে অন্য কারোর গল্প নিচ্ছেন আপনি।
বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত: কিন্তু সে গল্প থেকে বেরিয়ে এসেছি আমি বারবার। তার জন্য আমাকে অনেক সমালোচনাও শুনতে হয়েছে। পৃথিবীতে কোন বড় পরিচালক সাহিত্যের সঙ্গে সিনেমাকে জড়িয়ে ফেলেননি। এদেশে যারাই এটা করতে গেছেন তারাই ... সত্যজিৎ রায় করেছেন ঠিকই কিন্তু সত্যজিৎ রায় পেরেছিলেন। আর কারো পক্ষে সম্ভব হয়নি।
পরবাস: আপনার ছবি তো আত্মজৈবনিকও হয়ে পড়েছে কখনো কখনো?
বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত: হয়ে পড়েছে...
পরবাস: ‘লাল দরজা’তে কিছু কিছু জায়গায়...
বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত: আমার সমস্ত ছবির মধ্যেই যেটা তোমাকে বলছিলাম ম্যানিপুলেটেড ইমেজ ছিল না। নিজের তৈরি ইমেজ। নিজের জীবন দিয়ে দেখা, তৈরি করা যে-ইমেজগুলো সেগুলো রিফ্লেকটেড হয়েছে। সেগুলো এসেছে। কোথাও কোথাও আমার নিজের জীবন ছুঁয়ে গেছে। কিন্তু কোনটাই তো আমি নই। সিনেমা সিনেমাই রয়ে গেছে। দ্যাখো যেটা তোমাকে বলছিলাম দেশে-বিদেশে প্রচুর খ্যাতি পেয়েছি। বহুবার শ্রেষ্ঠ ছবির সম্মান পেয়েছি, যেটা সত্যজিৎ রায় ছাড়া আর কেউ পাননি এদেশে। বিদেশে প্রচুর সম্মান পেয়েছি। বেস্ট ডিরেক্টরের সম্মান পেয়েছি ভেনিসে। কিন্তু আমার বার বার মনে হয়েছে যে সাহিত্যের পুরস্কার বা সিনেমার পুরস্কার দুটি ক্ষেত্রেই তা পুরস্কৃতকে কখনো কখনো বিপথে চালিত করে। সে-ব্যাপারে আমি খুব সজাগ ছিলাম। ফলে এখনো যখন ছবি করতে যাই... এই সোহিনীই বলছিল… ধর আমার আগের আগের ছবি আনোয়ার কা আজব কিস্সা। ক্যামেরাম্যান ছিল এক স্প্যানিশ। এই দ্বিতীয়বার কাজ করল আমার সঙ্গে। ওর সঙ্গে আলাপ হয়েছিল স্পেনেই। তো ও কাজ করতে এল, একটা ঘটনাচক্রে ওকে আমি নিয়েও নিলাম। তো ও বলত এবং আরও অনেককে আমি বলতে শুনেছি এত ইয়ং ফিল্ম মেকার দেখিনি। কেন এরা বলত, কেন এরা বলে এখনও। যেমন ধরো যখন আমি শেষ ছবি ‘টোপ’ করছিলাম তখনও। এর পরের বার আমি গিয়ে কি করব জানি না। কারণ ‘টোপ’-এর পর আমার শরীরটা সত্যিই খুব খারাপ হয়ে গেল, ভেঙে গেল খুব। কিন্তু খিদেটা রয়ে গেল।
পরবাস: কিন্তু আপনি তো কখনও নিজেকে রিক্রিয়েট করেননি...
বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত: রিক্রিয়েট করার দরকার হয় না।
পরবাস: না। আপনার ছবি তো একটার থেকে অন্যটায় গিয়ে অনেকটাই অন্যরকম হয়।
বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত: হ্যাঁ, এটাও তো। ওটা আমি... কেন হয়েছি জানো তো। কারণ আমি কখনোই মনে করিনি যে পুরস্কার গুণ বিচারের মাপকাঠি হতে পারে। কখনোই মনে করিনি পুরস্কার আমার মনস্কামনা পূর্ণ করেছে। কখনোই মনে হয়নি পুরস্কার আমি চেয়েছিলাম। পুরস্কৃত হয়েছি, ভুলেও গেছি, কিন্তু খিদেটা আমাকে তাড়া করে বেড়িয়েছে। এই তাড়া খেতে খেতে আমি বারবার নিজেকে ভেঙেছি, বদলেছি। এমনকি এমন একটা সময় বদলাচ্ছি যখন মানুষ প্রায় বদলায় না। এই মুহূর্তে আমি বদলাচ্ছি। আমি যে পরের ছবি করছি সাদিকের গল্প, একদম হাল আমলের একটা গল্প। একটা ইয়াং বাচ্ছা ছেলের লেখা, ওর ভাবনাচিন্তা নিয়ে। সেটা মূল থেকে আমি অনেকটা বদলাচ্ছি ছবির কারণে।
পরবাস: সেটা কি সাদিক যে মহল্লাটা নিয়ে গল্প লেখেন সেই অঞ্চল নিয়ে না তার বাইরে?
বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত: না, ওই মহল্লায়।
পরবাস: আচ্ছা ‘উত্তরা’তে যে বাচ্ছা ছেলেটা ওটা কি আনারাতে বা খড়গপুরে একা থাকতে ভালোবাসে সেই বাচ্ছা বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত?
বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত: কিছু পরিমাণে। কিন্তু যেটা বলছিলাম ক্রিয়েটিভ মানুষের না নিজের সঙ্গে লড়াইটা, সার্চটা কখনো থেমে থাকে না। থেমে থাকা উচিত নয়। তুমি ভাবো রবীন্দ্রনাথের কথা। সব পাওয়ার শেষ পাওয়া হচ্ছে সাহিত্যে নোবেল । সেটা উনি পেলেন, খুব বাজে লেখা লিখে অবশ্য। যাই হোক পেলেন তো। এখন যদি কেউ নোবেল পেত, তার অন্তত এক ডজন লেজ বেরোত। রবীন্দ্রনাথের লেজ গুটিয়ে গেল। উনি একা বসে ভাবতে শুরু করলেন, তার কয়েকবছর পর, যে কি হবে আমার। পাঠক কি পড়বে আমার লেখা? এই ভয় থেকে উনি ছবি আঁকতে শুরু করলেন। আর একটা মিডিয়ামে যেতে চাইলেন। দু’হাজারের বেশি ছবি এঁকে ফেললেন। পৃথিবী জুড়ে সেই ছবি দেখানো হল এবং আমি মনে করি ভারতবর্ষে পেন্টিং-এর ইতিহাসে আধুনিকতার জন্ম দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। সেটা আমাদের গগনেন্দ্রনাথ নন আরো অনেকেই নন। এই যে নিজেকে ভাঙা, নিজেকে প্রশ্ন করা তা কখনো কখনো বয়েসটা বাড়তে দেয় না। রবীন্দ্রনাথ যখন ছবিগুলোকে আঁকছেন তখন ৭০ পেরিয়ে গেছেন। আর কি সব ছবি! মানে কিভাবে সে সব ছবি তৈরি হয়েছিল! ভাবা যায় না। আমি মনে করি ক্রিয়েটিভ যে সোর্সটা, এটার মুখগুলো বন্ধ করে দেওয়া উচিত নয়। সেগুলোকে আসতে দিতে হয়। আসতে না দিলে বিপত্তি হচ্ছে তুমি সময়টাকে ধরতে পারবে না। আসতে না দিলে বিপত্তি হচ্ছে তুমি সময়ের থেকে অনেক পিছিয়ে পড়ো। কেননা, সময় কিন্তু নির্মোহ। সময় ছুঁড়ে ফেলে দেয়, একদম একেবারে আস্তাকুঁড়ে ফেলে দেয়। আস্তাকুঁড়ে না যাওয়ার জন্য প্রতিটি মুহূর্তে নিজের সঙ্গে লড়াইটা করতে হয়। এবং লড়াইটা তুমি যদ্দিন বজায় রাখবে তোমার খিদেটা থেকেই যাবে। নতুন কিছু করার। আমার যেটা সমস্যা হচ্ছে, আমি কোন কিছুতে খুশি হই না, সুখী হই না। আমি আমার লেখালিখি নিয়ে খুশি নই। আমি আমার সিনেমা নিয়েও খুশি নই, তৃপ্ত নই। এই অতৃপ্তি ভাগ্যিস আছে। আছে বলেই নতুন সৃষ্টি শুধু হচ্ছে না, আমার বেঁচে থাকাটা কখনো বোরিং হচ্ছে না। খিদেটা এর জন্য দায়ী।
পরবাস: আন্দ্রেই তারকোভস্কি আপনার খুব প্রিয় পরিচালক?
বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত: তারকোভস্কি আমার খুব প্রিয় পরিচালক। কিন্তু তুমি যেমন বলতে পারো না যে শুধুমাত্র জীবনানন্দ দাশের এই কবিতাটি বা শুধুই জীবাননন্দ দাশ। আর কোন কবি নেই, তা তো তুমি বলতে পারো না। তেমন তারকোভস্কি একা নন। তারকোভস্কি একজন অসামান্য ফিল্মমেকার। একজন ক্রিয়েটিভ মানুষ কখন অসামান্য হয়ে ওঠে জানো, যখন তার নিজস্ব ভঙ্গি এমন একটা ভাবে মূর্ত হয় যেটা অনন্য, যা আর কখনো দেখা যায়নি। তারকোভস্কির ছবি দেখতে দেখতে আমার মনে হয়েছে এর ছবি দেখা যায়। বাইরে ফিরে এসে তুমি আবার তারকোভস্কি দেখতে পারো। হাজারবার দেখতে পারো, তুমি ক্লান্ত হবে না। কিন্তু আমার সবচেয়ে প্রিয়, সবচেয়ে প্রাণের পরিচালক লুই বুনুয়েল। দেখ লুই বুনুয়েল তারকোভস্কির আগের তো, এমন একটা অসাধারণ সময়ে জন্মেছেন, লুই বুনুয়েল ছবি শুরু করেছেন ৩০-এর দশকে।
পরবাস: আ শিঁয়ে আন্দালু যখন বেরলো...
বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত: সে তো আরো আগে। দালির সঙ্গে করলেন। ডাডা মুভমেন্টের সাথে জড়ালেন। ডাডা মুভমেন্ট থেকে বেরিয়ে এসে সাররিয়ালিস্ট মুভমেন্টের সঙ্গে জড়ালেন। এবং গোটা ইওরোপ জুড়ে সাররিয়ালিস্ট মুভমেন্ট তখন সাংঘাতিক স্ট্রং। কে নেই সেখানে! হয় কি জানো, এই ধরনের জায়গায় থাকলে যে সমস্যা তৈরি হয়, সেটা হচ্ছে ছাঁচটা তৈরি হয়ে যায়। যে ছাঁচ দালি তৈরি করেছিলেন পেন্টিং-এ। সাররিয়েল যে ছাঁচ। সে ছাঁচটা কিন্তু এমনই একটা জিনিস হল অনুকরণ করেছেন অনেকে কিন্তু সেটা অনুকরণীয় ছিল। আবার অনেকে অন্যরকম করে সেভাবে এগিয়ে গেছেন। কিন্তু বুনুয়েলের একটা অসম্ভব শক্তি ছিল এই ছাঁচে না পড়া। মানে বুনুয়েল এমন ছিলেন ছাঁচে ঢাললে ছাঁচ থেকে বেরিয়ে আসতেন।
পরবাস: ছাঁচভাঙা মূর্তি আর কি....
বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত: থার্টিসের কথা ভাব যখন... শুরু করলেন তখন বুনুয়েলের সামনে কিন্তু কোন দৃষ্টান্ত ছিল না। আর ডাডাইস্টরা কিছু কিছু ছবি করেছিল। কিন্তু ওই এক্সপেরিমেন্টাল, ভ্রুণেই যার মৃত্যু হয়েছিল বলা যায়। কিন্তু আমার কাছে বুনুয়েল এ-কারণে ভীষণ ইমপরট্যান্ট যে, কত ক্ষমতাধর মানুষ ছিলেন যে উনি ওই ছাঁচে না পড়ে সম্পূর্ণ নিজের মতো... দেখো আমরা যখন লেখালিখি শুরু করেছি বা যখন সিনেমা শুরু করেছি তখন আমাদের সামনে অনেকগুলো জিনিস ছিল। অনেকেই এটাকে মেনে নিয়েছে। অনেকে ওর মতো করে করেছে। কিন্তু বুনুয়েল যখন ছবি করতে শুরু করলেন তখন তাঁর ধারেকাছে কেউ ছিল না। এটা কিন্তু বিশাল একটা কৃতিত্বের কথা। আর একটা কথা হচ্ছে যে-দীক্ষা তাঁর সাররিয়ালিস্টদের সঙ্গে থেকেই হয়েছিল সেটা হল রিয়ালিটিকে অন্যভাবে এক্সপোজ করা। কিন্তু এক্সপোজ করতে গিয়ে সাররিয়ালিস্টরা কি করলেন, রিয়ালিটি থেকে অনেক দূরে বেরিয়ে গেলেন। আমরা বুঝতে পারলাম ওটা রিয়াল নয়। যেমন দালির ছবিতে তুমি দেখো যখন গাছের ডালে ঘড়ি ঝুলছে তুমি বুঝতে পারো ইট ইজ নট রিয়াল। সাররিয়াল। কিন্তু বুনুয়েল যেটা করলেন সারফেস লেভেলে একেবারে রিয়ালিটিকে আঁকড়ে ধরা একটা ছবি। আস্তে আস্তে ভাঙছেন। আস্তে আস্তে ভাঙছেন। তারপর তোমাকে এমন একটা জায়গায় নিয়ে যাচ্ছেন বুনুয়েল, যে তুলনা করা যায় না। আমি মনে করি যে সাররিয়ালিস্টরা নিশ্চয়ই ভীষণভাবে প্রভাব ফেলেছিল ওঁর জীবনে। অসম্ভবভাবেই প্রভাব ফেলেছিল তা না হলে অনেক ছবিই উনি তৈরি করতে পারতেন না। কিন্তু সে প্রভাব কখনোই অন্যের মত নয়, নিজের মত করে উনি প্রভাবিত হয়েছিলেন। নিজের মত করে ভেঙেছিলেন। যেমন বুর্জোয়াজি, ওই ছবিটার নাম যেন কী?
পরবাস: দ্য ডিসক্রিট চার্ম অফ দ্য...
বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত: ডিসক্রিট চার্ম-এ তুমি ডিনারের দৃশ্যটা ভাবো। ভাবা যায় না, কিন্তু সমস্ত দৃশ্যটাই আনরিয়াল। দেখে তোমার একদম মনে হবে রিয়াল। এই যে একটা অদ্ভুত ব্যাপার রিয়ালিটির মধ্যে আনরিয়ালকে ঢুকিয়ে দেওয়া, এটা কিন্তু খুব কম পরিচালক করতে পেরেছেন। প্রথমে করেছিলেন লুই বুনুয়েল এবং অসামান্য দক্ষতায়। আমি তারপর অনেকের ছবি দেখেছি। গোদার আমার অন্যতম প্রিয় পরিচালক। কিন্তু এই জিনিস আমি কারো কাছে পাইনি। যারা গতানুগতিকতার বাইরে দাঁড়িয়েছিলন, গোদার তাঁদের মধ্যে অন্যতম। একদম নিজের মতো করে গোদার ছবি করেছেন। কিন্তু এই জিনিসটা অদ্ভুত একটা জিনিস, যেটা বুনুয়েল করে গেছেন। সেই সময় আর একটা জিনিস ছিল মনে রাখতে হবে, সেই সময় আর গোদারের সময়ের তফাতটা কোথায় ছিল মনে রাখতে হবে। সে সময় কিন্তু স্টুডিও-র সিনেমার যুগ। কলকাতায় যেমন নিউ থিয়ের্টাস। ওইরকম থিয়েটার কোম্পানিগুলো ছিল হলিউডে। ওর রাজত্ব সাংঘাতিক। সেখানে একটা জিনিস তোমাকে করতে হত, দর্শক ধরে রাখা। তুমি যদি দর্শক না ধরে রাখতে পারলে ওইখান (সিনেমা) থেকে তোমাকে বিদায় নিতে হবে। ভয়ংকর একটা ব্যাপার ছিল।
পরবাস: মানে ইন্ডাস্ট্রির কিছু terms থাকছে আরকি, এখানে মানতে হবে সেটা।
বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত: হ্যাঁ, সেটা মেনে তোমাকে ছবি করতে হবে।
পরবাস: আমার অনুমান ছিল যে তারকোভস্কির মিরর এবং স্টকার আপনার খুব পছন্দের ছবি হবে। দুটোতেই অসামান্য লিরিসিজম পাওয়া যায়, যেটা আপনার ছবিতেও পাই।
বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত: হ্যাঁ, দুটোই আমার খুব পছন্দের। স্টকার আমি দেখেছি বুঝতে পেরেছো। স্টকার দেখার গল্প শুনলে তুমি অবাক হয়ে যাবে। স্টকার দিল্লিতে আমি দেখতে গেলাম। সে বছর প্রথম তারকোভস্কির নাম লোকে শুনল। দিল্লিতে তারকোভস্কির রেট্রোস্পেকটিভ হচ্ছিল।
পরবাস: ৮০-র দশকে নাকি?
বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত: ৮৬-এইরকম হবে। মারা গেছেন সে-বছর। তার ছ-সাত মাস পরে দিল্লিতে প্রথম শো হচ্ছে। তখন ফেস্টিভ্যাল খুব বড় আর ভালো ফেস্টিভ্যাল ছিল। এবং দিল্লিতে সেদিন মানে সাংঘাতিক ঠান্ডা। প্রায় মাইনাস-ফাইনাসে চলে গেছে। ভোরবেলা উঠে আমি কোনরকমে বাস-টাস ধরে হলে পৌঁছে...
পরবাস: আপনি কি তার আগে বিদেশে দেখেছেন তারকোভস্কি?
বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত: না, ফার্স্ট তারকোভস্কি দেখছি। আসলে মুশকিল কি তারকোভস্কি তো মাত্র চারটে না পাঁচটা ছবি করেছেন। মারা গেলেন তো ৫০ না ৫২ বছর বয়সে ক্যানসারে। তখন তারকোভস্কি কিন্তু অত ফেমাস নন। কিন্তু কনফিডেন্স সাংঘাতিক ছিল জীবিত অবস্থায়। যখন এডিট করছেন শেষ ছবি ‘স্যাক্রিফাইস’, হাসপাতালের বেডে বসে বলছেন এরপরে এই সিনটা রাখো...
পরবাস: স্টেটের একটা কনফ্রনটেশন ছিল ওঁর সঙ্গে...
বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত: হ্যাঁ, দ্যাখো তারকোভস্কির প্রথম ছবি ‘স্টীম রোলার অ্যান্ড ভায়োলিন’, ওটা দেখে, তখন মস্কোতে ছিলেন সার্ত্র, ভীষণ ভালো লেগেছিল। উনি বেরিয়ে এসে তারকোভস্কিকে বলেছিলেন তোমার ছবি আমার ভীষণ ভালো লেগেছে। তারকোভস্কির প্রথম ছবি ‘ইভান দ্য টেরিব্ল’ ভেনিসে বেস্ট ফিল্ম অ্যাওয়ার্ড পেয়েছিল। তখন ভয়ংকর সমালোচনা শুরু হয়। যে তুমি বিক্রি হয়ে গেছ। মানে ওঁর বিরুদ্ধে সাংঘাতিক অবস্থা হয়, ভীষণ ঝামেলাময় জীবন। তো উনি তখন সার্ত্রকে লিখলেন যে তুমি কি কিছু করতে পারো আমার জন্য। এই অবস্থা চলছে আমার। বন্ধুরা পাশ থেকে সরে যাচ্ছে। রাশিয়াতে ওঁর বিরুদ্ধে যা তা রিভিউ হচ্ছে। ছবিটাকে নস্যাৎ করে দেওয়া হচ্ছে। এমনকি বিদেশেও কিছু সমালোচক গালাগাল দিতে শুরু করেছে। সার্ত্র বললেন ঠিক আছে।
পরবাস: বুদ্ধদা একদম আমাদের কাছাকাছি সময়ে কিম কি-দুক-এর ছবি ভালো লাগে আপনার?
বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত: দেখ কিম কি-দুকের ছবি ভালো লাগে। খারাপ লাগে তো আমি বলব না, কিন্তু ‘আয়্যাম নট ম্যাড অন কিম কি-দুক’। মানে বুনুয়েল, এরা যেভাবে দিনের পর দিন ঘুম কেড়ে নিয়েছে। আমার মনে আছে ডিসক্রিট চার্ম অফ বুর্জোয়াজি দেখে আমি রাতের পর রাত ঘুমাইনি। তুমি যে কথা দিয়ে শুরু করেছিলে যে একবার তো দেখতে পাচ্ছি। আমি দোকানে গিয়ে তো কিনতে পারছি রসগোল্লাটা। এই জিনিসটা, কিমকি-দুকের ছবি দেখে ভেসে যাইনি আমি। এরা আমাকে ভাসিয়ে নিয়ে গেছেন। এঁরা যেভাবে আমাকে ভাসিয়েছেন এবং বুঝিয়ে দিয়েছেন যে ‘ওনলি সিনেমা ক্যান গো বিটুইন পোয়েট্রি অ্যান্ড মিউজিক’। মাঝখানে ঢুকে যেতে পারে সিনেমা।
পরবাস: পৃথিবীর যে-কোন জিনিসের তো একটা end আছে। যেমন ধরুন আমাদের সাহিত্যের কথা যদি আমি বলি আখতারুজ্জামান ইলিয়াস বলতেন বারবার যে নভেল-টভেল শেষ হয়ে গেছে। আর হবে না পৃথিবীতে। ফিল্মের কোন end আছে বলে আপনার মনে হয়?
বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত: না, আমি এই কথাই বিশ্বাস করি না। তাহলে তুমি শুধু নিজের প্রয়োজনের জন্য নয় সামনের যে দীর্ঘ জন্মগুলো অপেক্ষা করে আছে তাকে অপমান করছো। তুমি জানো না, আমি তো আবিষ্কার করলাম সাদিককে। কেউ আমাকে সাদিকের কথা বলেনি, একজন বলেছিল, সোহিনীর এক বন্ধু। পপুলার নয়, বহুপঠিত নয়। কিন্তু পড়ে অবাক হয়ে গেলাম।
পরবাস: আচ্ছা যারা দুই বাংলাতে ছবি-টবি বানায় তাদের অনেকেই তো আপনাকে ডিভিডি দেয়, আপনাকে ডাকে ছবি দেখার জন্য। আপনি যান?
বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত: দেখো কখনো কখনো যেতে হয়। আঘাত করতে পারার একটা ক্ষমতা থাকা দরকার তো। তুমি যদি কাউকে না রেকগনাইজ করো, না করাটা অনেক সময়ে আঘাতের পর্যায়ে পড়ে। তো আমি গেছি, কিন্তু আমি অ্যাভয়েডও করি এবং এখানে কোথাও কোথাও আমাকে মিথ্যের আশ্রয় নিতে হয়। যেমন দেখেছি/ দেখতে আরম্ভ করেছি…. মানে চাল টিপলে বোঝা যায় তো একটা চাল টিপলে বোঝা যায়। ফলে ওই…
পরবাস: শেষ ভালো লেগেছে এইরকম বাংলা ছবি কিছু মনে পড়ছে আপনার? নিজের ছবি বাদ দিয়ে আমাদের সমসাময়িক যারা ছবি করছে? কারুর নাম বলতে চাইবেন?
বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত: নিজের ছবি যদি ভালো লাগত তাহলে আমি বেঁচে যেতাম। নিজের ছবি ভাল্লাগে না।
পরবাস: কারোর নাম আপনি বলবেন? কারোর ছবির জন্য আপনি অপেক্ষা করছেন?
বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত: না, আমি তোমাকে খুব ফ্র্যাংকলি বলি, এখন যারা ছবি করছেন অসম্ভব খারাপ। মানে সেগুলো সিনেমা হচ্ছে না।
পরবাস: প্রদীপ্তর ছবিটা কি ভালো লেগেছিল আপনার?
বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত: অ্যাক্সেপ্টেব্ল। তো মুস্কিল হচ্ছে যে নতুন ছবি যা হচ্ছে তা অসম্ভব খারাপ।
পরবাস: এটা লিখব?
বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত: হ্যাঁ, হ্যাঁ আমি বলছি তোমাদের লিখতে অসুবিধে কোথায়? অসম্ভব খারাপ মানে কিছু হচ্ছে না, সত্যি কথা বলতে কী। কোথাও পৌঁছচ্ছে না ছবিগুলো। নিজেরাই আওয়াজ করছে। এবং আজকাল তো তুমি জানো কাগজে পয়সা দিয়ে খবর ছাপা যায়।
পরবাস: শ্যুটিং-এর দিন থেকে শুরু হয়ে যায় সেগুলো...
বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত: হ্যাঁ! সেগুলো খুব ভালভাবে করছে, নিপুণভাবে করছে। সিনেমাটা করতে পারছে না।
পরবাস: এবং কখনো কখনো চমকপ্রদ সব আইডিয়া আসছে, কিন্তু সে আইডিয়া তো ক্যারিই করা যাচ্ছে না, পাঁচ মিনিটও ক্যারি করা যাচ্ছে না, এরকম হচ্ছে।
বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত: মুস্কিল হচ্ছে যে, এটা বলা দরকার, আমি যখন বলতে পারছি লেখাটা দরকার। তা নাহলে খুব মুস্কিল আছে। মানে এরা সিনেমার চেয়েও নিজের প্রেমে আপ্লুত। তাই সিনেমাটা অনেক দূরে সরে গেছে এদের থেকে।
পরবাস: অনেক ধন্যবাদ বুদ্ধদা।
(শেষ)