দিব্যি বেলদীঘির পাড়ের কৎবেল গাছটায় বসে, পা দোলাতে দোলাতে, একটা পচা কৎবেল ফাটিয়ে তার শাঁসটায় এট্টু কালো পাঁকের টাকনা দিয়ে জম্পেশ করে চেটেপুটে খাচ্ছিল স্বর্ণময়ী... থুক্কুড়ি... সন্ন শাঁকচুন্নি। এমন সময় ঐ বৌটি এসেই সব মজা মাটি করে দিল। ভদ্র গেরস্তঘরের বৌ-মানুষ অমন রাতদুপুরে ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ করে কাঁদতে কাঁদতে ঘাটের পানে এলে, একটু কৌতূহল হয় বৈকি। যতই সে প্রেতযোনি প্রাপ্ত হোক গে, এই ক’মাস আগেও তো সন্ন ‘স্বর্ণময়ী’-ই ছিল রে বাপু। নেহাতই বজ্জাত শাউড়ি, আর পোড়ারমুখো হারামজাদা বরটা মিলে ঘুমের ভেতরেই ওর গায়ে হড়হড় করে কেরোসিন ঢেলে, দেশলাই কাঠি ঘষে দিল। একবার যদি টেরটি পেত সন্ন, তাহলে ওদের জারিকেন ভর্তি কেরোসিন তেল ওদেরই গায়ে ঢেলে, মুখে নুড়ো জ্বেলে দিত একেবারে। যাকগে সে সব পুরোনো দিনের কথা ভেবে কী লাভ! এমনিতেও তিনকূলে কেউ ছিলনা সন্নর।
পিসিরবাড়ি লাথিঝাঁটা খেয়ে মানুষ, তবে মুখরা ও চিরটাকালই। পিসেমশাইয়ের বাড়ি আর বন্ধকির ব্যবসা ছিল এই গাঁয়েই। গরিব লোকেরা জমি গয়না বাড়ি বন্ধক রেখে চড়াসুদে টাকা ধার নিত। কিন্তু শেষ অব্দি শোধ করে উঠতে পারত না, আর সুদখোর পিসেমশাই সেগুলো নিজে দখল করত। সন্ন মোট্টে এই অনাচার দু’চক্ষে সহ্য করতে পারত না। তাই পা টিপে টিপে শোবার ঘরে ঢুকে, পিসির আঁচল থেকে চুপিচুপি লোহার সিন্দুকের চাবিটা খুলে, সিন্দুক থেকে বন্ধকী দলিল গয়নাগাঁটি বার করে আনত। দুর্ভাগা লোকগুলোকে যখন ওগুলো গিয়ে দিয়ে আসত ভোররাত্রে, ওদের তখন ভূত দেখার মত অবস্থা হ’ত।
--“তোমাদের সম্পত্তি ফেরৎ দিয়েগেলুম গোওওও... হরিপদ শকুনির নজর থেকে বাঁচ্চে রেখোও-ও-ও।”
বলেই পেছন ফিরে ছুট লাগাত স্বর্ণ, শাড়িটা গাছকোমর করে বেঁধে। এই বেলদীঘিটার পাড় ধরেই ছুটতো পিসির ঘরের দিকে, যেখানে চ্যালাকাঠটা ওর অপেক্ষায় রয়েছে। তা সত্ত্বেও স্বর্ণ এ কাজ করত, পেছনে ফেলে আসা ওই হতভম্ব মুখগুলোয় শান্তির হাসি দেখার জন্যই করত।
বাড়ি ঢুকে দোর দিয়ে পিসির আঁচলে চাবি ফেরত দিয়ে, ভাঁড়ার ঘরের মেঝেয় কাঁথাটা বিছিয়ে চুপটি করে শুয়ে পড়ত। খানিক পরে কমলাবালা মানে পিসির হাঁকডাকে ঘুম ভাঙত।
--“ওরে ও হতচ্ছাড়ি স্বর্ণ! ফের চুরি করলি, ফের! যে থালায় খাচ্চিস তাতেই ছিদ্দর করচিস? বলি, আমার দাদাটাকে তো খেলি! নিজের মা’টাকেও ছাড়লিনি রাক্কুসি, এবার কি আমাদের পালা?”
এরপর কথা বলত পিসের হাত আর উনুনের চ্যালাকাঠ। তা এমন লক্ষ্মীছাড়ি বোঝাকে, কে কতদিন ঘাড়ে নিয়ে বসে থাকবে। পিসি-পিসেও তাই গ্রামেরই আরেক অকালকুষ্মাণ্ড দোজবরে রতন মুদির সাথে বে’ দিয়ে দায় সেরে দিল।
তা প্রথম ক’দিন স্বামীর ঘরে ভালোই কেটেছিল স্বর্ণময়ীর। কিন্তু আস্তে আস্তে সকলের রূপ প্রকাশ পেতে লাগল। মুদির দোকানের চালে কাঁকর, ডালে পাথর, সর্ষের তেলে রেডির তেল, গাওয়া ঘি-তে দালদা, এইসব ভেজালের কারবার দেখে স্বর্ণ তো থ’। বারবার বারণ করতে থাকে রতনকে। রতনের তাতে কচুটা, উল্টে শাউড়ি কথা শোনায়,
--“এই যে লতুন বৌ। বেশি বড় বড় কতা কউনি। ব্যবসার তুমি কি বুজবে শুনি মেয়েছেলে হয়ে। ওসব একটু না মেশালে পরে ঘরে লক্ষ্মীর মুখ দেখব কী করে শুনি? তোমার পিসি-পিসে তো দু’গাছা চুড়ি, সরু হার দিয়েই কাজ সারল।
তুমি বরং নাতির মুখ দেকাও দেকি। আগের বৌটা তো আটকুঁড়িই ম’ল।”
ভেতরে ফুঁসলেও নতুন বৌ, তাই লজ্জায় চুপই ছিল। চিত্তির হ’ল সেদিন যেদিন বাচ্চাদের বেবিফুডের টিনে ভেজাল মেশাতে শুরু করল। এমনিতেই গাঁয়ের দিকে বেবিফুডের বিক্রি কম, তাই চড়া দামে বিক্রি করত রতন। গাঁয়ের লোকের দামী খাবার কেনার সামর্থ্য কম তাই গোটা প্যাকেট না বিক্রি করে রতন প্যাকেট কেটে খুচরো গুঁড়োদুধ, ইনস্ট্যান্ট ফুড, হেলথ ড্রিঙ্ক বানানোর গুঁড়ো, এসব পলিপ্যাকে মুড়ে বেচত। আর গ্রামের লোকের সাধ্য না থাকলেও সাধ যেত ছেলেপিলেকে ওই টিভিতে দেখানো রঙিন বিজ্ঞাপনের পুষ্টিকর জিনিস খাওয়াতে। বেশি লাভের জন্য ওগুলোয় কাঠের গুঁড়ো, ময়দা, যা নয় তাই মেশাতে শুরু করে দেয় রতন আর রতনের মা। একদিন জোর গলায় প্রতিবাদ করে স্বর্ণ। হুমকি দিয়ে বলে,
--“ফের যদি এমনটা করেচো, পুলিশে খবর দেব সদরে গিয়ে।”
সেদিন রাত্রেই ওই দুই পিশাচ মিলে...
যাকগে সেসব কথা, আজ স্বর্ণ নিজেই পিশাচ হয়ে গেছে... সন্ন শাঁকচুন্নি।
কিন্তু এই বৌটার আবার হ’লটা কী! রোজই ঘাটে বাসনের পাঁজা নিয়ে আসে, নাইতে আসে, কাপড় কাচতে আসে। ভারী মিষ্টিপানা মুখটা। সদ্য সদ্য বিয়ে হয়েছে বুঝি। প্রথমদিকে দিব্যি গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে ছাই দিয়ে বাসন ঘষত। যত দিন গেল মেয়েটার গলা থেকে যেন গান উবে যেতে লাগল। গত ক’দিন ধরেই সন্ন দেখছে, মেয়েটার চোখদুটো যেন লাল লাল ভিজে ভিজে। নিজে ভুক্তভোগী তো তাই বিলক্ষণ এসব লক্ষণ চেনে সন্ন। নির্ঘাৎ শ্বশুরবাড়িতে সুখে নেই বৌটা। আহারে মারধোরও করে বোধ হয়।
--“কিন্তু ও কী! ও কী! ও কাঁখের কলসিটায় অমন পেঁচিয়ে দড়ি বাঁধছে কেন রে বাবা! হায় রে কপাল, দড়ির আরেকটা দিক যে নিজের গলায় জড়াচ্ছে!! মরণদশা! এ হতভাগী যে সুসাইড করছে লো!”
আর নিজেকে আটকাতে পারল না সন্ন। সটান গাছ থেকে কালো কালো কংকালসার পা দুটো সোজা ঘাটের চাতালে বাড়িয়ে দিল। তারপর বডিটাও সড়াৎ করে টেনে পায়ের ওপর দাঁড় করিয়ে দিল। রাতদুপুরে আত্মহত্যা করতে আসা বৌটার সামনে একটা ইলাস্টিকের মত কালো কংকাল, তাতে আবার লাল পাড় সাদা কাপড় জড়ানো, আকাশ থেকে এসে দাঁড়ালো। তারপর নাকিসুরে বলে উঠল,
-“ওঁ কীঁ লাঁ মুঁখপুঁড়ী! অঁমন ধাঁরা মঁরার শঁখ কেঁন হঁল শুঁনি? বেঁশ তোঁ গাঁন গেঁয়ে সুঁখে ছিঁলি।”
এরপর বলাই বাহুল্য, কী ঘটল।
জলে ঝাঁপ মারার আগেই মুচ্ছো গেল মেয়েটি। সন্ন তো পড়ল মহা ফাঁপরে। এবার কী করে, মেয়েটা যদি মরে যায়, কিংবা জ্ঞান ফিরলে যদি ফের মরতে যায়। অসহায় মানুষ দেখলেই মনটা বড় কেমন করে সন্নর। সেই ছোটোবেলা থেকে শুরু করে বড়বেলা অব্দি, এমন কী মরার পর এই ভূতবেলাতেও অভ্যেস বদলাতে পারল না।
সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে সন্নর কংকাল খুলিতে একটা বুদ্ধি খেলে গেল। সুড়ুৎ করে ওর নিজের দেহটাকে ধোঁয়ার মত বানিয়ে নিয়ে, সেঁধিয়ে গেল বৌটার শরীরের ভেতর। বৌটার ভেতরে সেঁধোতেই একটু একটু করে সব পরিষ্কার হতে লাগল। মেয়েটার সব স্মৃতি ওরও মাথায় ভর্তি হতে থাকল।
--“ও হরি! এ যে নবা-র বৌ।”
এই যাহ্, উত্তেজনার চোটে যে নামটা ধরতে নেই সেই নামটা বলে ফেলেছে। অবিশ্যি মানুষের দেহে ঢোকার পর ও নাম ধরলে কোনও ক্ষতি নেই। সন্নর এই প্রথম অভিজ্ঞতা মানুষের ভেতর ঢোকার। এদ্দিন শুধু শুনেই এসেছে, কী হয় না হয়।
যাকগে আস্তে আস্তে সব সয়ে যাবেখ’ন। এই যে এতদিন ভেসে ভেসে বেড়ানোর পর নিজের পায়ে দাঁড়াল, এটাই তো ভারী অদ্ভুত লাগছে। কেমন যেন ছোট্ট বাচ্চা যখন প্রথম টলমল পায়ে হাঁটতে শেখে অনেকটা সেরকম।
নবা মানে নবকুমার, সন্নর পিসতুতো ভাই, সে আবার কবে বে’ করল? অবশ্য মরার পর থেকে এই শাঁকচুন্নির গতি প্রাপ্তি অব্দি বেশ কিছুটা সময় সন্নর বিশেষ মনে নেই। কেমন যেন একটা আলো আঁধারির মত ওই সময়টা, ছায়াহীন কায়াহীন সূক্ষ্ম একটা অস্তিত্ব হয়ে আকাশে বাতাসে ছড়িয়ে ছিল। তারপর ধীরে ধীরে একটু একটু করে জমাট বেঁধে বেঁধে এই ভৌতিক দেহ ধারণ করল। আশ্রয় নিল বেলদীঘির পাড়ে এই কৎবেল গাছটায়। দু’চারটে মামদো পেত্নী ইয়ার দোস্ত হয়েছে বটে, সবই ওই অপঘাতে মৃত্যু। একজন বেম্মদত্যি গুরুদেবও জুটেছেন। ইস্কুলের মাঠের গায়ে যে বেলগাছটা আছেন সেখানে থাকেন, ফি গুরুবারে সন্নর মত সদ্য জন্মানো ভূতেদের ভূতসমাজের নিয়মকানুনের পাঠ দেন। তবে সন্ন বেঁচে থাকতেই ইস্কুলের ছায়া মাড়ায়নি, মরে আর কী বিদ্যে শিখতে যাবে শুনি। কিন্তু এখন মনে হচ্চে বেম্মগুরুর ক্লাসগুলো করলে হ’ত মন দিয়ে। মানুষের দেহে ঢোকার সুবিধে অসুবিধেগুলো জানা থাকত। মরুকগে! আর ভেবে কী লাভ।
নবা মনে হয় ওই সময়েই বে’ করেছে যখন সন্ন ত্রিশঙ্কু অবস্থায় ছিল। সন্নও আর মরে ইস্তক পিসির বাড়ির দিকে যায়নি যে জানতে পারবে। বৌটা ঘাটে আসে তাই চোখে পড়ে এই আর কী।
নতুন শরীরে গুটিগুটি পায়ে বৌটার শ্বশুরঘর মানে পিসির ঘরের দিকে রওনা দেয়। কলসিটার গলা থেকে দড়িটা খুলে ফেলে দিয়ে, জল ভরে কাঁখে চাপিয়ে নেয়। গুটিগুটি করে পূবের আকাশটাও ফরসা হয়ে এসেছে।
বহুদিন পর পিসির ঘরে পা রেখে মনটা কেমন আনচান করে সন্নর। এদিক ওদিক দাওয়া, উনুন, ধানের মরাই, তুলসীতলা, সবকিছুর দিকে চেয়ে চেয়ে দেখে। এমন সময় দুম করে পিঠে একটা জোরদার মুড়ো ঝাঁটার বাড়ি পড়ে, আর চেনা গলায় চিল চিৎকার,
--“পোড়ারমুখী রাতদুপুরে ফের ঘুরে এ বাড়িতে ঢুকলি কেন হতচ্ছাড়ি। তোকে বলেছি না, বাপের ঘর থেকে পণের বাকি এক লাখ টাকাটা আনতে না পারলে আর এ বাড়ির ছায়া মাড়াবিনে!”
দুয়ারে সকালে ঝাঁট দিতে বেরিয়েছিল পিসি মনে হয়, তখনই এই বৌ-এর বেশে সন্নকে চোখে পড়ে যায়।
একপলকের জন্য সন্নর মনে হয়েছিল পিসি বুঝি সেই ছেলেবেলার স্বর্ণকেই বকছে, তারপর বুঝলো এ বাক্যবাণ গরিব বেয়াইয়ের মেয়েটার উদ্দেশ্যে। মাথায় আগুন জ্বলে উঠল সন্নর, গোটা গা জ্বলতে লাগল ঠিক সেই দিনটার মত যেদিন রতন মুদি আর তার মা ওকে জ্বালিয়েছিল। শরীরটাকে শক্ত রেখে শুধু ঘাড়টা পেছনদিকে ঘুরিয়ে, চোখের মণিটাকে লাল করে ঘড়ঘড়ে বিকৃত গলায় বলে উঠল,
--“ফেঁর যঁদি আঁমার গাঁয়ে ঝ্যাঁটা ছুঁইয়েছিঁস, তোঁকেই জ্যাঁন্ত উঁনুনে গুঁজে দেঁব।”
পিসির মুখটা বিশাল একটা হাঁ হয়ে আটকেই রয়ে গেল, হাতের ঝাঁটাটা শুধু ঠক করে মাটিতে পড়ে গেল। কোনওমতে পড়ি কি মরি করে পিসি চিৎকার করে দৌড় লাগালো উঠোনের দরজার দিকে। শুধু শোনা গেল,
--“ভ্ ভ্ ভ্ ভূউউউউত! বাঁচাওওও...”
মনে মনে একচোট হেসে নিয়ে, উল্টো পায়ের পাতা ফেলে গটগট করে হেঁটে পিসি-পিসের শোবার ঘরে গিয়ে ঢুকলো সন্ন।
মাথা না ঘুরিয়েও দিব্যি বুঝতে পারছিল, উঠোনের দরজার ওপার থেকে উঁকি দিয়ে বিস্ফারিত চোখে পিসি ওর হাঁটা দেখে ফের দৌড় মারল।
ঘরে ঢুকে দেখে, আজও সেই লোহার সিন্দুকটা পেটে কত লোকের কান্না জমিয়ে গ্যাঁট হয়ে বসে রয়েছে। এক ঝটকায় লোহার দরজাটা উপড়ে আনল সন্ন, পিসির আঁচল থেকে চাবি চুরির আর ওর প্রয়োজন নেই। সব ক’টা দলিল গয়নাগাঁটি বার করে এনে একটা গামছায় পুঁটুলি করে বেঁধে রাখল।
দেহধারণের পর বেশ খিদে খিদে পাচ্ছে সন্নর। রান্নাঘরের দিকে পা বাড়াল। বাহ্ কত্ত কী তরকারি রান্না। সবই এই বৌটাই রেঁধেছে, যার দেহে এখন সন্ন বাসা নিয়েছে। মোচার ঘন্ট, কাতলা মাছের কালিয়া, সোনামুগের ডাল...
খাবারগুলোর গন্ধে গা গুলিয়ে উঠল সন্নর। মানুষের দেহ ধারণ করলেও ভৌতিক অভ্যেসগুলো এত সহজে যায় নাকি। একটা কাঁসিতে পচা পান্তা খানিকটা পড়েছিল, ফেলে দেওয়ার জন্য নাকি ওই বৌটার রাতে খাওয়ার জন্যই রাখা ছিল কে জানে। আহা! বেশ টক টক গন্ধ বেরিয়েছে। ঐটেই গপগপ করে খেয়ে নিল ও। তারপর ফের পিসি পিসের ঘরের পালঙ্কতে গিয়ে গ্যাঁট হয়ে বসে রইল।
পিসে আর নবা দুজনের কেউই বাড়িতে নেই। পিসের বন্ধকী কারবারের সেরেস্তাতেই পড়ে রয়েছে, অনেক বড় দাঁও মেরেছে ফের মনে হয় কাউকে ঠকিয়ে। এইরকম দিনগুলোয় সারারাত হিসেবপত্তর চলে বাপ-ব্যাটায়। পিসি মনে হয় হাঁউমাঁউ করে সেখানেই ছুটেছে। পালঙ্কে শুয়ে শুয়ে পুরনো দিনগুলোর কথা ভাবছিল সন্ন। বাপটা চলে গেল গাড়িচাপা পড়ে, শহরে রোজগারের ধান্দায় গিয়ে। মা-টা পাগল হয়ে গেল, তারপর একদিন হারিয়ে গেল। এর দোর তার দোর, এই মাসির বাড়ি, ওই কাকার বাড়ি ঘুরে, সন্নর ঠাঁই হ’ল শেষে পিসির বাড়িতে। সারাদিন হাড়ভাঙ্গা খাটুনি খাটত মেয়েটা তবুও নেকনজরে এলনা পিসির। তার ওপর মেয়ের আবার পরোপকারের ব্যামো। চ্যালাকাঠ ছাড়া আর কিই বা ছিল ওর কপালে। তারপর ঠাঁই হ’ল রতনমুদির সংসারে। সেখানেও একই দশা, শেষমেষ প্রাণটাই খুইয়ে বসল। স্বর্ণময়ী থেকে স্বর্ণ হয়ে এখন হল গিয়ে সন্ন শাঁকচুন্নি। হায় রে পোড়া কপাল!
সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল সন্ন, এমন সময় বাইরে একটা বিশাল শোরগোল উপস্থিত হ’ল।
--“ওগো শুনচো!! সব্বনাশ হলো গো! তকন থেকে বলচি আমি মিচে কথা কইনি রে বাপু! তা বাপব্যাটায় মানলে তো!”
--“এই ভোররাত্তিরে হিসেবপাতি সেরে একটু গড়াচ্চিলুম সেরেস্তায় তা না কী যে সব পাগলের মত বকবক করে টেনে নিয়ে এলে! কোতায় তোমার ভূত নবার মা, অ্যাঁ?”
--“মায়ের কতা বিশ্বেস করাই ভুল। দেকলে তো বাবা? আগেই বলেছিলুম, কী দেকতে কী দেকেচে, কী শুনতে কী শুনেচে মা!
কতবার বলি এত ভোরে উঠুনি। যা লাগবে কাজ সব বৌমাকে বোলো।”
--“তুই থাম নবা! তোর বৌকে যে কাল বাপের বাড়ি পাটালি পয়সা আনতে, ভুলে গেচিস? সে আবাগীর ওপরেই ভূতে ভর করেচে। আর মরণদশা, এ বাড়িতেই এসে ঢুকেচে সে ডাইনি।”
--“উফ তোরা মা ব্যাটা থামবি? কোতায় তোমার ভূত?”
--“ওই তো শোবার ঘরে। ওগো তুমি যেউনি ওঘরে। মধু গুণীনকে আগে খবরটা পাটালে হতুনি?”
শোরগোলটা দরজার বাইরে এসে দাঁড়ালো, সন্নও রেডি। দরজা খুললো পিসে, পেছনে নবা, আরও পেছনে পিসির মুণ্ডুখানা উঁকি দিচ্ছে। সাথে আরও দু’চারটে কৌতূহলী মাথা, যারা ভোরবেলায় প্রাতঃকৃত্য সারতে বেরিয়েছিল, রহস্যের গন্ধ পেয়ে নাক গলিয়েছে। চৌকাঠ ডিঙ্গোতে গিয়েই একলাফে তিন হাত পিছিয়ে গেল পিসে। নবা বাপকে টপকে ভেতরে যেতে গিয়ে, ‘আইব্বাপ’ বলে পেছন ফিরে লাফ মারল। নাহ্ তেমন কিছু করেনি সন্ন, ওই শরীরটাকে মানে নবার বৌ-এর শরীরটাকে মাটি থেকে তিনফুট ওপরে শূন্যে ভাসিয়ে রেখেছিল, এই আর কী। তাই দেখে তো নবার আর পিসের ভির্মি খাওয়ার জোগাড়। কোনওমতে দরজাটায় খিল টেনে দিয়ে তিন মূর্তিতে ছুটল মধু গুণীনের বাড়ির দিকে।
আর ওদিকে ঐ কৌতূহলী লোকগুলোর কল্যাণে গোটা গ্রামময় রাষ্ট্র হয়ে গেল হরিপদ মহাজনের ব্যাটার বৌকে ভূতে পেয়েছে।
পাড়ার পর পাড়া উজিয়ে লোক আসতে শুরু করল ভূত-গুণীনের লড়াই দেখবে বলে। সন্ন মনে মনে যে একটু ভয় পায়নি তা নয়, এই প্রথমবার গুণীনের সামনাসামনি হবে, একটু তো বুক ঢিপঢিপ করবেই। তার চেয়েও বড় কথা, এই অভাগী বেচারা বৌটার ওপর ভারী অত্যাচার করবে, ঝাঁটা আগুন সর্ষেপোড়া আরও কত কী!
এমন কিছু করতে হবে যাতে বৌটা শান্তিতে বাঁচতে পারে, ফের মাঝরাতে গলায় দড়ি দিতে না ছোটে।
যথাসময় পিসি পিসে আর নবা তিনজন মিলে মধু গুণীন আর তার খান দুই চ্যালাসহ এসে হাজির। ঘরে বসে সন্ন সব শুনতে পাচ্ছিল। মধু হাঁকলো,
--“কিস্যু চিন্তা করবেন নে মা ঠাইরেন। এই মদু গুণীন এসে পড়েচে। ভূত পেত্নী মামদো শাঁকচুন্নি বেম্মদত্যি সব ডরায় আমায়। এমন মন্তর পড়ব, এমন ঝ্যাঁটাপেটা করব, যে পালাতে পথ পাবেনে শাঁকচুন্নির ভূতও।
“কইরে নেপো, কই রে হেদো... শিগ্গির মন্তরপড়া জলটা বাড়ির চারদিকে ঝারা দিয়ে ছড়িয়ে আয় দিকিনি। আগে ঘরবন্ধন করি তারপর ধরব ভূতের ঝি-কে।”
সবাই বড়বড় চোখ করে বায়োস্কোপ দেখার মত চেয়ে রয়েছে, কী হয় কী হয়। মধুর চ্যালারা ঘরের দরজাটা হাট করে খুলে দিয়ে পিছিয়ে এলো। সামনে হোমকুণ্ডের মত আগুন জ্বেলে তাতে মুঠো মুঠো সর্ষে ছুঁড়তে ছুঁড়তে মধু মন্তর পড়তে লাগল,
“মামদো পেত্নী বেম্মদত্যিসেই সাথে হাঁকডাকও শুরু করল,
শাঁকচুন্নির বংশ
ডিড্ডিমাডিং মন্ত্র ফুঁকে
করব তোদের ধ্বংস।”
-“বেরিয়ে আয় বলচি! ভদ্দর ঘরের বৌ ঝি-দের ঘাড়ে ভর করেচিস, এত সাহস তোর? জানিসনে এটা মদু গুণীনের এলাকা? আজ তোকে যমের বাড়ি পাঠাবো শাঁকচুন্নি।”
সন্ন ফিক করে হেসে ফেলে, ভাবে,
--“মরা লোককে যমের বাড়ি পাঠায় যে গুণীন তার সাথে মোলাকাতটা সেরেই আসি।”
ধীরে ধীরে এক গলা ঘোমটা টেনে বেরিয়ে আসে নবার বৌ, হরিপদ মহাজনের বৌমা। দাওয়াতে জমা ভীড়টা এক দু’পা পিছিয়ে যায়। সামনে রুগী পেয়ে মধু গুণীন উচ্চৈঃ স্বরে ফের অং বং চং মন্ত্র শুরু করল সেই সাথে তাণ্ডবনৃত্য। সন্ন ঘোমটার ভেতর দিয়ে দেখে আর মিটিমিটি হাসে। গুণীন ঝ্যাঁটার বাড়ি মারে আর চ্যাঁচায়,
--“বল তুই কে? কেন ধরেচিস এই ভালোমানুষের বৌটাকে?”
সন্ন খলখল করে হেসে, বিকৃত গলার স্বরে বলে,
--“ভাঁলোমাঁনুষ? কেঁ ওঁই নঁবা? পিঁসি পিঁসে যঁকন আঁমায় মাঁরত, চ্যাঁলাকাঁঠটা ওঁই হঁতভাঁগাই তোঁ এঁগিয়ে দিঁত। এঁবার ওঁর বৌঁকে বাঁগে পেঁইচি। রঁক্ত খাঁব সঁবার আঁমি।”
একথা শোনামাত্র কমলাবালা, হরিপদর কানের কাছে আর্তনাদ করে উঠল,
--“এ যে আমাদের স্বর্ণ পোড়ারমুখী গো-ও-ও-ও! এ আমাদের কী বেপদ ঘটল গো!”
মধু গুণীন ফের বলে,
--“অ তুই তবে এ বাড়িরই মেয়ে। যে বাড়িতে খেলি পরলি তাদের সব্বনাশ করতে এয়েচিস? বেরো বেরো বলচি বৌমার দ্যাহ থেকেন।”
সন্ন ঘোমটার তলা দিয়ে চেয়ে দেখে ভিড়ের মধ্যে দু’জোড়া চোখ আতঙ্কে চেয়ে রয়েছে ওর দিকে। সন্নর জীবদ্দশার বর রতনমুদি আর শাউড়ি। মনে মনে সঙ্গে সঙ্গে একটা বুদ্ধি ঠাওরালো সন্ন। বলে উঠল,
--“হিঁহিঁ হিঁ হিঁ! সঁব্বনাঁশ তোঁ আঁমার কঁরেচে, সাঁরা গাঁয়ের লোঁকের কঁরেচে, এঁই হঁরিপদ মঁহাজন। আঁর ওঁই যেঁ দাঁইড়ে রঁয়েচে রঁতনমুঁদি আঁর ওঁর মাঁ, আঁমার বঁর আঁর শাঁউড়ি। আঁমায় ওঁদের খঁপ্পরে বেঁ সজ্জন দিঁল পিঁসি পিঁসে। বাঁচ্চাদের খাঁবারে ভেঁজাল দিঁতে বাঁরণ কঁরেছিঁলুম বঁলে ওঁই দুঁই শঁয়তান আঁমায় পুঁড়িয়ে মাঁরল।”
সব লোক ঘুরে তাকাল ভিড়ের মধ্যে রতনমুদি আর তার মায়ের দিকে। মধু গুণীনও খানিক থমকে গেল। রতনমুদির দোকানের বাচ্চাদের দুধ তো মধুও নিজের তিন বছরের বাচ্চাটাকে কিনে খাইয়েছে। সামনে দাঁড়ানো শাঁকচুন্নি ভর-করা বৌটাকে মারতে কেমন যেন হাত কাঁপল। এই ভূত তাড়ানোর ব্যবসা ছেড়েই দিয়েছিল কবে, নেহাতই হরিপদ মহাজনের কাছে জমিটা বন্ধক আছে তাই ওর ডাকে আসতে হ’ল। একটুখানি কমণ্ডলু থেকে জল সামনের আগুনে ঢেলে তাতটা একটু কমিয়ে দিল।
--“তা তুই এই বৌটাকে ধরলি কেন? ওর কী দোষ?”
--“ওঁর দোঁষ হঁল ওঁ আঁমার মঁত হঁতভাগী। আঁমার পিঁসি পিঁসে ভাঁই মিঁলে ওঁকে পঁণের টাঁকার জঁন্য এঁমন জ্বাঁলাতন কঁরেচে যেঁ আঁজ গঁলায় দঁড়ি দিঁতে গেঁসল। আঁমিই ওঁর ভেঁতর ঢুঁকে ওঁকে বাঁচালুম। নঁইলে আঁমার পাঁশের ডাঁলেই এঁতক্ষণে ঠ্যাং দোঁলাত।”
গুনগুন শব্দ ওঠে ভিড়ের মধ্যে। হরিপদ কমলাবালা আর নবার মনে ভূতের ভয়ের চেয়ে পুলিশের ভয় জাঁকিয়ে বসেছে। রতন আর তার মা ধীরে ধীরে পেছু হঠতে শুরু করেছে।
--“এখন কী চাস তুই তবে?”
--“রঁতন আঁর তাঁর মাঁকে পুঁলিশে দেঁওয়ার ব্যঁবস্থা কঁরুক, ঐঁ হঁরিপদ মঁহাজন। এঁই গাঁমছায় বাঁধা সঁব বঁন্ধকীর জিঁনিস বিঁলিয়ে দিঁক। তঁবেই আঁমি যাঁব, নঁইলে এঁই বৌঁটা মঁরবে আঁর তাঁর দাঁয়ে পুঁলিশ ধঁরবে কঁমলাবাঁলাদেঁর।”
জমিটা বাঁচল, চওড়া হাসি খেলে গেল মধু গুণীনের মুখে। কৃতজ্ঞতার দৃষ্টিতে চাইল ঘোমটার আড়ালের চোখদুটোর দিকে। ভাগ্যিস বেশি মারধোর করেনি বেচারা মেয়েটাকে। গ্রামের লোকগুলোর চোখ থেকেও ভূতের ভয়টা মিলিয়ে গিয়ে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস পড়ল।
তারপর আর কী? সন্ন এই গ্রামেই থাকে, বেলদীঘির পাড়ের কৎবেল গাছটায়। মাঝে মাঝে শহরের জেলে গিয়ে রতন আর রতনের মায়ের বেহাল দশা দেখে আসে। গাঁয়ের মেয়ে-বৌরা ঘাটে বসে কত গপ্পো করে, সে সব শোনে ঠ্যাং দোলাতে দোলাতে। নবার বৌ রোজ ভোরে আসে, পান্তা আর শুঁটকি মাছের ঝাল নিয়ে। সন্নদিদিকে শোনায় হরিপদ আর কমলাবালা কেমন ভালোমানুষ হয়ে গেছে, নবা কত খেয়াল রাখে ওর।
মধু গুণীনের বৌটাও একদিন এসেছিল কোলের ছেলেটাকে নিয়ে, সন্নর আশীর্বাদ নিতে। সন্ন মনে মনে ভাবে, শাঁকচুন্নিরও এত ভাগ্য!