• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৭০ | মার্চ ২০১৮ | গল্প
    Share
  • রাসমনির সংসার : শুভলক্ষ্মী ঘোষ


    —“একি! কি হয়েছে? মুখের এমন অবস্থা হোল কি করে রাসমনি? আয়, আয়; এইখানটায় বোস আগে। দাঁড়া, ডেটল আনি।” শর্মিলা ফার্স্ট-এড বক্স আনতে ভিতরে ছুটলেন। রাসমনির চোখের কোলে কালশিটে, ঠোঁট কেটে গিয়েছে অনেকটা, থুতনির কাছটায় চাপ বেঁধে রক্ত, চেহারাখানা উসকোখুসকো, শাড়ি-ব্লাউস ফাটা, হাতে গলায় আঁচড়ের দাগ।

    রাসমনি, শর্মিলার বাড়ি ঠিকে কাজ নিয়েছে বছর পাঁচেক হল। শর্মিলা কলেজে পড়ান। বিয়ে-থা করেন নি। ৭৫০ স্কোয়ার ফিটের ওয়ান বেডরুম ছোটো ফ্ল্যাটে একা থাকেন। বাড়িতে কাজ কর্মের বেশি চাপ নেই। রাসমনি সকাল সকাল এসে হাতে হাতে রান্নার জোগাড় করে দেয়, তারপর কাপড় কাচা, ঘর মোছা সেরে ন’টার মধ্যে বেরিয়ে পড়ে। শর্মিলা জল-খাবার খেয়ে কলেজে বেরোন সাড়ে ন’টা নাগাদ। বাড়ি ফিরতে ফিরতে সন্ধে ছ’টা সাত’টা বাজে। তারপর পরীক্ষার খাতা দেখা, ক্লাস নোটস বানানো, অল্প কিছুক্ষন টিভি, গান শোনা, বা গল্পের বই--এই ভাবে রাত্তিরটুকু কেটে যায় গড়িয়ে গড়িয়ে। বাড়িতে কথা বলার মানুষ বলতে ওই রাসমনিই। রাসমনির বয়স বছর তিরিশেক, কালো, ছিপছিপে, টানা টানা বড় বড় চোখ, একমাথা ঘন কালো চুল, হাসলে একদিকের গজদাঁত দেখা যায়, কথাবার্তা স্পষ্ট। প্রথম দিনই কেন জানি শর্মিলার ওকে ভারি পছন্দ হয়ে গিয়েছিল। রাসমনি বলেছিল ওর বর ভ্যান-রিক্সায় শাকসবজি বিক্রি করে। চারটে বাচ্চা। — “ছেলেমেয়েগুলো সেয়ানা হইছে গো দিদি, বরের একার পয়সায় আর টানতি পারবুনি, বড় দুটোরে ইস্কুলে ভর্তি করিছি, বই খাতার খরচ, ইস্কুলের মাইনে ... ক’টা বাড়ি রান্নার কাজ নিতি পারলি আমার বড় সুবিধে হত গো--”

    কদিন কাজ করার পরই শর্মিলা বুঝল, রাসমনির গুণ আছে অনেক। বড় একটা কামাই করে না, করলেও আগে থেকে খবর দিয়ে যায়, রান্নার হাত ভালো, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, কাজে যত্ন আছে, হাত-টান নেই, সংসারের খুঁটিনাটি, রোজকার কি লাগবে, না-লাগবে নিজে থেকে খেয়াল রাখে। শর্মিলাকে কলেজের কাজ সামলে বাড়ি ফিরে আর কোনো ঝক্কি পোহাতে হয় না। সব মিলিয়ে সুবিধেই হয়েছিল।

    সকালে এসেই রাসমনি নিজের আর শর্মিলার জন্য দু’কাপ চা’এর জল বসায়। তারপর চা খেতে খেতে রাজ্যের বকবক শুরু করে--দেশের বাড়ির কথা, সেখানকার দু-ফসলা চাষের জমি, পুকুরের মাছ, আম বাগান; বাচ্চাদের কথা, তদের স্কুলের কথা, বর কবে মাইনের টাকা কেড়ে ওকে মারধোর করেছে, কবে আবার মদ খেয়ে রাত্রিবেলা বাড়ি এসে ছেলেপুলেগুলো ঘুমলো কি ঘুমলো না সে হুঁশ নেই ... গা’এর কাপড় টেনে খুলে বুক-পিছন “ডোলতে” শুরু করেছে, কোনদিন আবার টাইম-কলের জলের লাইনে কোন বাড়ির বউএর সাথে কী নিয়ে ঝগড়া, কোন কাজের বাড়িতে কে কাকে মুখ ঝামটা দিয়েছে, ইত্যাদি ইত্যাদি। শর্মিলা ল্যাপটপে কাজ করতে করতে মাথা নেড়ে হুঁ-হাঁ করেন, মাঝে মধ্যে বিরক্তও হন — সকালবেলাটা এভাবেই গুনগুন করে নানান কথায় নিজের মনে এগোতে থাকে। একে অন্যকে ঘিরে কিছুটা সুখ-দুঃখের সময় ভাগ করে নেওয়া, সাথে অল্প মান-অভিমান, বকাবকি, রাগারাগি; শর্মিলার দিনে দিনে রাসমনির উপর বড্ড মায়া পড়ে গিয়েছিল।

    রাসমনিকে যত্ন করে ওষুধ লাগিয়ে দিতে দিতে শর্মিলা জিজ্ঞেস করলেন—“এবার বল তো, এমন কাণ্ড বাঁধালি কী করে? আবার ঝগড়া করেছিস? বর মারধোর করেছে? ইস, কতটা কেটে গিয়েছে রে ঠোঁটটা--”

    —“আর বোলোনি গো দিদি, আমার কপাল পুইড়েছে। হারামজাদা, মাগীবাজ বর... শালা বে করেছে আবার।”

    —“কি যা তা বলছিস তার মাথামুণ্ডু নেই? তুই জানলি কি করে, হ্যাঁ? খোঁজ নিয়েছিস ঠিক করে?

    — "হ্যাঁ দিদি... বেশ ক’মাস ধরি শুনছিলুম, সে মাল নাকি ইস্টিশানের উল্টোদিকে পাটোয়ারী পাড়ায় কোন মেয়েছেলের কাছে ঘোরাঘুরি করতি লেগেছে। তো সে ছোঁকছোঁকানির ধারা তো আর আজকের নয়, বিয়ের পর থিকে অমন চলন দেখে আসতিছি, এভাবেই তো চার চারটে বাচ্চা বিয়োলাম--” রাসমনি ডুকরে কেঁদে উঠল।

    —“আহ, কান্নাকাটি করিস না... তারপর?"

    —"তাপ্পর আর কি গো দিদি, আমি পেত্থোমটায় কথা কানে নেই নি। সোয়ামি, সে সারাদিন যে ভাগাড়ে ঘুরে বেড়াক, রেতের বেলায় ঠিক বাড়ি ফিরে আসত। মাল খাক, কিল-চড় মারুক... ঘরের লোক, ঘরে ফিরে আসতিছে, আমি তাই আর কিছু গা করতুম নি। কিন্তু গেল রোববার থিকে সে ঘাটের মড়া আর ঘরে আসে না! কি জ্বালা বল দিকি! ঘরে চার চারটে ছোটো ছেলেমেয়ে, বাপ আসতিছে না দেখি কান্নাকাটি জুড়ে দিছে... আমি তাই কদিন খোঁজ খবর নিয়ে আজ পাটোয়ারী পাড়াতে গেসলুম। যেয়ে দেখি সে আবাগীর বেটা ঝুপড়ি নেছে ওই মেয়েটারে নে ফুর্তি করার জন্যি! আমি যেয়ে চেল্লামেল্লি করাতে, আমাকে এমনধারা মারলে... বললে কিনা ঘরে ফিরবে না, ওর সংসারে নাকি আর মন নেই! রোগা, প্যাংলা করে একটা বাচ্চা মতন মেয়ে ...বুক, পাছা কিস্যু ওঠে নি...তার সাথে শুয়ে কি সুখ বল দিকি?” রাসমনি কাপড়ের খুঁটে চোখ মুছল।

    —"এ আবার কেমন কথা? স্ত্রী-সন্তানের কোনো দায়িত্ব নেবে না বলছে? তুই থানায় খবর দে তো। চল, এক্ষুনি চল... চল, আমি তোর সাথে যাচ্ছি। নিজের বউ থাকতে অন্য একটা বাচ্চা মেয়ের সাথে একসাথে রয়েছে--এটা ক্রাইম। তুই চল থানায়, তারপর দেখ তোর বরের কি অবস্থা হয়।”

    —"না না দিদি; ও কাজ কোরো নি। যদি বা লোকটার কোনোদিন বাড়ি ফেরার গরজ হয়, আমি থানায় গেলি সে আশাও থাকবে নি গো--”

    —"এই তোদের এক দোষ, বুঝলি! তোরা মার খেয়ে মরে যাবি, তবু স্বামীর নামে পুলিশে রিপোর্ট করবি না। তাহলে আর কি! পড়ে পরে মার খা আর কান্নাকাটি কর।”

    —"তুমি আমার জ্বালা বুঝবে নি গো দিদি। তোমার ঝাড়া হাত-পা, বে-থা করলে নি... সংসারে যে কি যন্তন্না সে তুমি কি বুঝবে!”

    —“বেশ বললি যা হোক! ভাগ্যিস করি নি। বেঁচে গিয়েছি--”


    ***


    এরপরের দু-তিন মাস এইভাবে কাটলো। রাসমনি কাজে এলে শর্মিলা নিয়মিত ওর বাড়ির খবর নেন। কলেজ থেকে ফিরতি পথে বাচ্চাগুলোর জন্য ফল, বিস্কুট, দুধের প্যাকেট, যখন যেমন পারেন কিনে আনেন। রাসমনি নিতে চায় না — “কেন তুমি রোজ রোজ এত্ত কিসু কিনি দেবে গো দিদি? আমার সোয়ামি ঘর ছাড়ছে বলি? আমি একা ঠিক সামলি নিতি পারবো, দেখো। আরো তো দু’বাড়ি কাজ নিছি, আমার চলি যাবে...।” শর্মিলা ধমক দেন — “তোমাকে বেশি কথা বলতে হবে না রাসমনি। আমি তোমার থেকে বয়েসে বড়, যা দিচ্ছি নিয়ে যাও। তোমার বাচ্চারা কি আমার কেউ নয়? অদ্ভুত সব কথা বার্তা!”

    রাসমনি খাবারগুলো নিয়ে বিড়বিড় করতে করতে বাড়ি চলে যায়। শর্মিলার ভারি কষ্ট লাগে দেখে, ওইটুকু মেয়ে, একা হাতে সংসার সামলাচ্ছে, চার চারটে বাচ্চা। নাহ, পরের মাস থেকে মাইনেটা বাড়িয়ে দেওয়া যাবে না হয়--

    রবিবার রাসমনি এলো অন্যদিনের থেকে একটু বেশি বেলা করে। হাঁফাতে হাঁফাতে ঘরে ঢুকেই শর্মিলার সামনে হাউ হাউ করে সে কি কান্না--

    —"আরে আরে! হলটা কী? কি মুশকিল--উফফ! আরে কাঁদছিস কেন? কি হয়েছে বলবি তো? নাহলে বুঝব কি করে--”

    —"দিদি গো... ওই খানকি মাগীটা নাকি পোয়াতি হইছে? আমাকে ও পাড়ার শিবানীর মা আজ খবর দিলে, সে মেয়ে নাকি ঘর ভাসায়ে দিচ্ছে বমি করি!”

    —"হয়েছে তো বেশ হয়েছে, তোর তাতে কী?”

    —"ও দিদি, মানুষটা কি তাহলি আর ঘরে ফিরবে নি?”

    —"তুই এখনো সেই আশায় বসে আছিস রাসমনি? তিন-চার মাস হতে চললো তোর বর তোর সাথে যোগাযোগ রাখে না, তুই এরপরেও ভেবে রেখেছিলি, যে সে লোকটা তোর সংসারে কোনোদিন ফিরবে?”

    —"ভেবেছিলুম গো দিদি, মিথ্যে বলব নি, ভেবেছিলুম পুরুষমানসের মন, এক মেয়েছেলে তে কদিন মজে থাকবে? গতরের সুখ মিটে গেলি ফেরত আসবে ঠিক। নিজের বাচ্চাগুলোরে ছেড়ে কি সে থাকতি পারবে বেশিদিন? আমি সত্যিই এমন ধারা ভেবেছিলুম গো। কিন্তু সে হারামজাদা যে সেইখানে আবার করি সংসার পেতি বসবে সে আর কে জানতো!”

    —"পই পই করে সেদিন বলেছিলাম রাসমনি, থানায় চল, রিপোর্ট করি, তো না--সেসব তো তুমি করবে না! এখন ভোগো, আর কি। শোন্‌, ভালো কথা বলছি, এসব নিয়ে চিন্তা করা ছাড়। তোর বর যা করছে করুক। তুই নিজের খেয়াল রাখ, বাচ্চাগুলোকে ভালো করে মানুষ কর। সেরম দেখলে তোর আমি আবার বিয়ে দে,। কিই-ই বা এমন বয়েস তোর, এত সুন্দর দেখতে তোকে, তোরও তো জীবনে কিছু ইচ্ছে আছে, সখ-আহ্লাদ আছে--আবার নতুন করে সংসার শুরু করবি তেমন হলে। কত হয় এরকম, একদম ভাবিস না।”

    —"ঠিক বলেছ গো দিদি, আর ভাববুনি। এ লোক শালা বিয়ে করা ইস্তক আমার জীবনটারে নরক করে দিলে। মর মর, ওলাওঠা হয়ে মর সব, মরে রেহাই দে, আমার হাড় জুড়োক।” রাসমনি কপাল চাপড়ায়।


    ***


    এমনিভাবে দেখতে দেখতে আরো কয়েকমাস কেটে গেল, রাসমনি এর মধ্যে আরো তিন-বাড়ি ঘরমোছার কাজ নিয়েছে, তাই শর্মিলার ওখানে এখন ও আরো ভোর-ভোর চলে আসে। তাড়াতাড়ি কাজ সেরে বেরিয়ে যায়। একদিন সকালে রাসমনি এক গাল হাসি নিয়ে কাজে এল। — “কি রে?... আজ খুব খুশি যে? ছেলেমেয়েগুলোর রেজাল্ট বেরিয়েছে বুঝি?”

    —"না গো না... ভালো খবর আছে একখান... সে মেয়ের নাকি এখন তখন দশা।”

    —"কার? কোন মেয়ে?”

    —“আরে ওই আমার সতীন মেয়েছেলেটার গো। বাচ্চা বিয়োনোর সময় হইছে না! শরীরে নাকি এক্কেরে রক্ত নেই, ডাগতার আশা দিতে পারছে না।” রাসমনি খিল খিল করে হেসে উঠল।

    —"বাহ, চমৎকার। ওদিকে একটা মেয়ে মরতে বসেছে, আর তার জন্য তুমি খুব আনন্দ পাচ্ছ?”

    —”পাবু নি? কত্ত মানসিক করিছি জানো? ওই মেয়েছেলে আর ওর বাচ্চাটা ম'লে আমি বাবার থানে খিচুড়ি ভোগ দোবো... ষষ্ঠীতলায় যেয়ে দণ্ডি কাটবো। মর শালি... মর। আমার সোয়ামিটারে বশ করে নেছিলি যেমন, এখন দেখ কেমন লাগে? তুই, তোর বাচ্চা, দুটোই মরবি--আমার এতখানি চোখের জল কক্ষনো ফেলা যাবে নি।” রাসমনি দু হাত জোড় করে কপালে ঠেকাল।

    —“আহ, রাসমনি, এমন করে বলতে নেই, ছিঃ। আর, তোমার বরটাকে তো কই এমন অভিসম্পাত দিচ্ছ না? সে কি ধোয়া তুলসী পাতা?"

    — “না গো দিদি, ওই ছোটোলোকটার জন্যিও ভাবা আছে। সতীনটা ম'লে, বরটা যদি ঘরে ফেরে, আমি ঠিক নাথি মেরে ওকে দূরদূর করে তাইড়ে দোবো, তুমি দেখি নিও। শালা, খানকি মাগীর ব্যাটা, নষ্ট চরিত্তির, ঢ্যামনা লোক একখানা... এতগুলো মাস কেটি গেল, একদিনের তরে বাচ্চাগুলোরে দেখতি মন গেল না! বেঁচে আছি কি মরে গিছি, সে খবর নিতি এল না! ওই জানোয়ারটারে আমি আর পুষব? অনেক শিক্ষে হইছে আমার। বেশি ঢলামি করতি এলি দোবো বঁটির কোপ বসিয়ে, বাপ হওয়ার শখ জম্মের মতো ঘুচি যাবে।”

    সেদিনের পর থেকে প্রায় সপ্তাহখানেক কেটে গেল, রাসমনি আর কাজে আসে না। কেন, কী হয়েছে, কোন খবর নেই। শর্মিলা খুব দুশ্চিন্তায় পড়লেন। শরীর-টরির খারাপ হল নাকি! বৃষ্টিটাও কদিন ধরে আর কমছেই না, বাচ্চাগুলো অসুস্থ হয়ে পড়ল? যা জ্বরজ্বারি চলছে চারদিকে! রাসমনি তো না বলে কামাই করার মেয়ে না, কাউকে দিয়ে একটা খবরও সের'ম হলে পাঠিয়ে দেয় সব সময়। মেয়েটা না এলে সকালটা বড় ফাঁকা লাগে। শর্মিলার কথা বলার মানুষ কম। রাসমনির অনর্গল বকবকানি, পাড়া-বেপাড়ার উটকো খবর, এর-তার নিন্দে… ওই অবিশ্রান্ত অর্থহীন কথাগুলো শর্মিলার বার বার মনে পড়ে যায়। মেয়েটা না এলে বাড়িটা খাঁ খাঁ করে বড্ড। সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে একদিন সকাল সকাল শর্মিলা রাসমনির বস্তির দিকে রওনা দিলেন, সেদিন আর কলেজ গেলেন না, সাথে রান্নাবান্না গুছিয়ে নিলেন কিছু। কে জানে রাসমনিটা কি অবস্থায় আছে! এমন না বলেকয়ে বাড়িতে বসে থাকার মানুষ তো সে নয়!


    ***


    শর্মিলাদের কমপ্লেক্স ছাড়িয়ে মাঠের পাশ দিয়ে সরু গলি, মিনিট দশেক মতো হাঁটা পথ; তারপর ট্রাম গুমটি পার হয়ে শনি মন্দিরের ধার ঘেঁসে আরো পাঁচ মিনিটের রাস্তা। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছে, চতুর্দিকে কাদা, জমা জল, নোংরা প্যাকেট, তরকারির খোসা, ময়লা সব এদিক ওদিক ছড়ানো। এমন জায়গায় থাকলে শরীর অসুস্থ হবে না তো কি! মুখে শাড়ির আঁচল চাপা দিয়ে শর্মিলা তাড়াতাড়ি হাঁটা শুরু করলেন। মোড়ের মাথায় ইলেকট্রিকের দোকানে রাসমনির নাম বলতেই দোকানের ছেলেটা লাইনের শেষ মাথার ঝুপড়িটা দেখিয়ে দিল।

    ছোটো একচালার ঘর। সামনে কোনোরকমে একটা মাটির বেদী বানিয়ে তুলসীতলা, পুঁই আর কুমড়ো লতা দরজার পাশ দিয়ে বেয়ে বেয়ে চালে উঠেছে। উঁকি দিয়ে দেখলেন ঘরের মধ্যে টুলে ডাঁই করে রাখা গুচ্ছের কাপড়-চোপড়, পাশে কোমর-সমান উঁচু খাট, তার তলায় সংসারের যাবতীয় জিনিস--হাঁড়ি, কলসি, ডেকচি, চালের বস্তা, নীল রঙের প্লাস্টিকের ড্রামে রাখা জল, তেলের টিন, ঝুড়িতে আলু, পেঁয়াজ, আধফালি কুমড়ো, গোটা কয়েক পটল। ঘরে টিম টিম করে একটা ছোটো বাল্ব জ্বলছে। একটা ভাঙ্গা তিনচাকার সাইকেলে রাসমনির মেজছেলেটা সামনে ঘোরাঘুরি করছিল। --“হ্যাঁ রে, মা কোথায়?”

    --“উই তো হোথায় ... যাও না, যাও।” বলে ঘরের দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে এক ছুট্টে সে ছেলে কোথায় চলে গেল।

    শর্মিলা কাপড়চোপড়, বাসনপত্রের পাহাড় ঠেলে ঘরে ঢুকতে যেয়ে থমকে গেলেন। ঘরময় নাইলনের দড়ি টাঙানো, তাতে তিন কোনা করে কাটা ফিতে দেওয়া প্যান্ট, ছোটো ছোটো জামা, ন্যাতা, তোয়ালে শুকোতে দেওয়া। একপাশে তোলা উনুনে জল গরম হচ্ছে, রাসমনির কোলে সবে জন্মেছে একটা ছোটো বাচ্চা, পাশে বড় মেয়ে সাবিত্রী, মন দিয়ে কাঁথা সেলাই করছে। শর্মিলা আর বিরক্ত করলেন না, দরজা থেকে আস্তে আস্তে বাইরে বেরিয়ে এলেন। পাশের ঝুপড়ি থেকে, উল্টোদিকের ফ্ল্যাটে কাজ করে কল্পনার মা; শর্মিলাকে দেখতে পেয়ে এগিয়ে এলো — “কে গো? দিদি নাকি? ও মা, কী ভাগ্যি আমাদের?”

    খাবারের ঝোলাটা ওর হাতে ধরিয়ে শর্মিলা জিজ্ঞেস করলেন—“কল্পনার মা, বাচ্চাটা কে গো?”

    —“ওমা! তুমি জানো না? সে আর বোলোনি! নাটক, পুরো নাটক। গেল শুক্কুরবার রাসমনির সতীনটা হাসপাতালে বাচ্চা হতে যে ম'লো। ওইতো হাড় জিরজিরে রোগাভোগা শরীর, এত ধকল সইবে! বরটা পোয়াতি অবস্থায় ডাগতার দেইখেছিল কিনা সন্দ... এ সময় ঠিকমত দেখাশুনা, খাওয়াদাওয়া, কত কি লাগে; সে যা হোক, ও-পাড়া থেকে শিবানীর মা রেতের বেলা আমাদের এসে খবর দিলে যে ‘বডি’ বাড়ি আনা হইছে, ছেলে হইছে একখানা, সেও নাকি ভারি রুগ্ন, কেজি খানেক ওজনও হয়নি নাকি। ডাগতার কয়ে দিসে যে এ ছেলেরও বাঁচা মুস্কিল!

    "আমরা তো রাসমনি কে বললাম, তোর মানসিক ফললো বলে... যা, গে খিচুড়ি চড়া। তো সে মেয়ের কি জানি কি মনি হল, সব শুনি দুম করি দোর বন্ধ করি চলল ওই বাড়ি। আমিও পিছন পিছন বাচ্চা গুলোরে নে ছুটলুম। যেয়ে দেখি, ওর সোয়ামিটা মাথায় হাত দে বসে। মদ গিলে গিলে চেহারার আর কিস্যুটি নেই, বউটা মাটিতে শোয়া, পেটখানা ঢিপির মতো উঁচু, চোয়াল ভাঙ্গা, কন্ঠার হাড় বেইরে শরীরখানা মেঝের সাথে মিশে আছে, পাশে ন্যাকড়ায় জড়ানো বিড়ালছানার মতো বাচ্চাটা। মা-র বুকের দুধ পায়নি বলে কি চিল চিৎকার করতিছে... গলাখানা চিরে যাওয়ার জোগাড়। বাপটা কাউকে ছুঁতে ওবধি দিচ্ছে না। সবাই কত করি বলতিছে ছেলেটারে এট্টু জল খাওয়াতি... তো সে-লোকের কোনোদিকে কান নেই। ঘর দোরের যা অবস্থা হই রইছে, নালা-নর্দমা তার চে ঢের ভালো!

    "আমাদের রাসমনি খানিক দাঁইড়ে দেখল। তারপর কী বলব গো দিদি--রাসমনির এমনধারা চেহারা আমরা জম্মে দেখিনি! সোয়ামিটারে যা নয় তাই গালমন্দ করি বলে কিনা কচি বউটারে না খাইয়ে, ওষুধপথ্যি না দিয়ে দিনরাত অত্যাচার করি খুন করিছে, এখন বাচ্চাটারে মারার তাল! তারপর বরটার চুলের মুঠি ধরে কিল, চড়, লাথি ... সে কি মার মারলে, নিজের চোখি না দেখলি বিশ্বাস যাবেনি গো! তারপর যে মেয়ে ওই সতীন বউ-ব্যাটাকে তুলে এত শাপ-শাপান্ত করতো, সেই মেয়ে ওই রোগা ছেলেকে বুকে তুলে গায়ের কাপড় জইড়ে সোজা নিজের ঘরে নে এল। সোয়ামিটারে আবার বলে এল, যে সে কিনা যে চুলোয় থাকবে থাক, কিন্তু ও ছেলে নাকি এখন থিকে ওর কাছেই থাকবে। বরটা ভ্যাবলা হয়ে তাইক্যে থাকল খানিক... মুখ দিয়ে রা কাড়ল নি। বলেন দিকি কী কাণ্ড! চার-চারটে বাচ্চা, নিজেরাই খেতে পরতি পায় না ভালো করি, তারমধ্যি আবার ওমনতরো একটা রোগাভোগা ছেলে... কোন মানে আছে? কত বললুম, কিন্তু সে কিছুতেই বুঝলো নি। আজকের দিনে দাঁইড়ে কেউ এমন হুট-পুট করে কাজ করে? কতবার সাধলুম, তোর কপাল ফিরেছে রে রাসমনি, বরটারে ঘরে নে যা, বাচ্চাটা কে ক’দিন পর চুপি চুপি আশ্রম বা মন্দির-টন্দির কোথাও একটা দে এলেই হবে। পরে সোয়ামিকে বাচ্চাটা মরে গেচে বা অমন একটা কিছু বলে দিলেই হল। এমনিতেই তো যা চেহারার দশা, এ ছেলে বেশিদিন বাঁচলে হয়! কি দিদি ঠিক বলি নি? তা সে মেয়ে শুনলে তো সে কথা? চিরটাকাল ওই অমন ধারা, জানেন তো? যা গোঁ ধরবে, সেইটিই নাকি ঠিক! বরটা তো সেইজন্যি ছেড়ি পালাল... এমনি এমনি নাকি! বেয়াক্কেলে মেয়েমানুষ; আপনিই বলুন, আপনাদের এত পড়াশুনা, আপনাদের তো বিচার-বিবেচনা আমাদের থিকে অনেক বেশি। তাই না, বলেন? ----- ও দিদি...... কোথায় চল্লেন? এই দ্যাখো কাণ্ড!... দিদিইই...একটু চা খেয়ে যাবেন নি?... এত দূর থিকে এলেন... এ ঝোলাটায় কি আছে? হাতে দিয়ে গেলেন ক্যানে? রাসমনিরে দে দোবো নাকি?... ওওওও দিদি???"

    শর্মিলা দূর থেকে ইশারা করে পা চালালেন তাড়াতাড়ি। ততক্ষনে গলি পার হয়ে বড় রাস্তায়; সামনে এখন অনেকগুলো কাজ। সুতির জামা কিনতে হবে, সাথে গুঁড়ো দুধ, সেরিল্যাক, একটু বেশি করে ফল, গায়ে মাখার সাবান, মালিশ করার তেল, নরম দেখে তোয়ালে, ঝিনুক, বাটি, চামচ, ভিটামিন সিরাপ। একজন ভালো পেডিয়াট্রিশিয়ানের সাথে অ্যাপয়েন্টমেন্ট---

    শর্মিলা ছাতা বন্ধ করে ব্যাগে ঢোকালেন। বৃষ্টি থেমে গিয়েছে। নীল পরিষ্কার আকাশ, আর তাতে পেঁজা তুলোর মত এক তাল মেঘ বেয়ে ঝকঝকে শরতের রোদ নেমে আসছে।




    অলংকরণ (Artwork) : অলংকরণঃ রাহুল মজুমদার
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments