অবশ্যই আপনারে জিম টিম ইত্যাদি করতে হবে, একজন মানুষের সুস্থতার জন্য এটা দরকার, যখন আপনি সারাদিন বসে বসে কাজ করেন তখন শরীরে স্বাভাবিক রক্ত চলাচলের জন্যও তো ব্যায়ামের প্রয়োজন আছে, এছাড়া দার্শনিক ভাবে দেখতে গেলে আমরা সক্রেটিসের কথাটা দেখতে পারি, তিনি এ-বিষয়ে যা বলে গেছেন তা ইংরাজিতে এমন, ‘নো ম্যান হ্যাজ দ্য রাইট টু বি এন এমেচার ইন দ্য মেটার অব ফিজিক্যাল ট্রেইনিং। ইট ইজ এ শেইম ফর এ ম্যান টু গ্রো ওল্ড উইদাউট সিয়িং দ্য বিউটি এন্ড স্ট্রেংথ অফ হুইচ হিজ বডি ইজ ক্যাপাবল’; তো এখানে আবার অনেকে সন্দেহ করতে পারেন ও প্রশ্ন করতে পারেন এই বলে যে ‘সক্রেটিস যেই কনটেক্সটে কথাটি বলেছিলেন সেই কনটেক্সট কি আর আছে? (আবার এই বলেও দুর্বোধ্য দার্শনিক খোঁচা দিতে পারেন যে দেরিদা বলে গেছেন কনটেক্সটের বাইরে টেক্সট এর কোন অর্থ নাই!) এখন আমাদের শহর এথেনসকে বাঁচাতে যুদ্ধ করতে হবে এবং এর জন্য ফিট থাকার দরকার আছে?’ অর্থাৎ, নিয়ত প্রশ্ন করার থাকলে প্রশ্ন করাই যায় তথাপি এই কথা ধ্রুব সত্য আপনাকে ফিট থাকতেই হবে; এবং তাই বুদ্ধিমানের মত চিন্তা;
আপনাকে কিন্তু খালি বাইসেপ বাড়ানোর চিন্তা করলে হবে না, বাইসেপ, ট্রাইসেপ, লেগ, চেস্ট, ফোর আর্ম, শোল্ডার, ব্যাক সব দিকেই খেয়াল দিতে হবে, আর খেতে হবে সেই অনুপাতে, পাউন্ডে যত ওজন আপনার, প্রতি পাউন্ডে একগ্রাম করে প্রোটিন খাইবেন, আর বেশি হালকা শরীর থাকলে কত ক্যালরি আপনার লাগে তা বয়স উচ্চতা এক্টিভিটি ইত্যাদি তথ্য দিয়ে অনলাইন ক্যালকুলেটরে হিসাব করে বের করবেন এবং এর চাইতে পাঁচশ বা এক হাজার ক্যালরি বেশি খেতে থাকবেন, তাহলে ইনশাআল্লাহ আপনার মাসল হতে শুরু করবে, সাধারণত এমনই হয়, তবে নিউট্রিশন বা পুষ্টিবিদ্যা বিষয়টি বেশ বিতর্কিত তাও মাথায় রাখতে হবে, এবং আরেকটা কথা মনে রাখবেন সমস্ত ব্যাপারটা খুব ধীর, আহমদ ছফা লিখেছিলেন বিপ্লব হলো কৃষ্ণের গরু চরানোর মত, মাসল গেইনও একইরকম, ফলে কুইক রেজাল্টের আশা না করে লেগে থাকুন, এবং লেগেই থাকুন কারণ আপনি ছাড়তে আর পারবেন না, কারণ এটি একটি লাইফস্টাইল বা সুন্দর করে বললে বলতে পারেন জীবনদর্শন;
গল্প বলতে এসে আমি এসব কেন বলছি তা আপনি ভাবতে পারেন, এবং এতে বিরক্ত হওয়াও স্বাভাবিক, তবে খুব যে সম্পর্কহীন কথাবার্তা বলেছি তা মনে হয় না, কারণ আমি এই গল্পের কথক ও প্রধান চরিত্র ফলে আমার চরিত্রের নানা বাঁক ও দিক আপনার বুঝার জরুরত আছে; তাতে গল্প বুঝতে সুবিধা;
সেইদিন রাত এগারোটার দিকে আমি কিছু বেঞ্চ প্রেস, ডাম্বেল প্রেস, ডাম্বেল ফ্লাই মেরে বের হয়েছি জিম থেকে, মনে হচ্ছে বুকের ছাতি কয়েক ইঞ্চি ফুলে গেছে, হেঁটে হেঁটে আসছি বাসায়, পাশে ফলের দোকান, কমলা আপেল আনারস ইত্যাদি ফল সাজানো, ঠেলাগাড়িতে করে কিছু লোক বিক্রি করে হলুদ পাকা কলা, আরো আছে রাস্তার পাশে বিভিন্ন ভেরাইটিজ স্টোর, বেডিং স্টোর যেখানে লেপ তোষক ইত্যাদি বিক্রি করে, নাম মৌরী এন্ড মিতা বেডিং, সামনে এগিয়ে গিয়ে রাস্তার একপাশে একটা ছোট মাজার, ইনি সুদূর ইয়ামন দেশ হতে হযরত শাহজালালের সাথে এসেছিলেন এই বঙ্গদেশে এমনই লেখা আছে ফলকে, তবে তার পাওয়ার সম্ভবত খুব একটা বেশি ছিল না, তাই তার মাজারের শান তেমন নাই, কেবল চারকোনায় জরির কিছু কাপড় লাগানো আর উপরে টানানো শালু, যার কাপড় পুরনো হয়ে উঠেছে; মাজার পেরিয়েই আমি দেখতে পেলাম ছোট একটি জটলা মানুষের, কিছু রিকশাওলা এবং এইমত শ্রেণির লোক ঘিরে কিছু একটা দেখছে, আমি একটু এগিয়ে গেলাম ও দেখলাম যে পুরনো প্যান্ট শার্ট পরা (শার্ট ইন করা) একজন লোক একটি বাচ্চা ছেলের কলার চেপে ধরে আছে, ছেলেটির বয়স হবে তেরো বা চৌদ্দ বছর, ছেলেটির মুখে ভয়ের ছাপ দেখা যাচ্ছে;
আমি দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলাম কী হয়, বুঝে গিয়েছিলাম যে চুরি টাইপের কিছু একটা হয়েছে এখানে, কিন্তু এই ছোট ছেলে কীভাবে চুরিকার্য সমাধা করল তা জানতে বড় আগ্রহ হলো, তাই একজন রিকশাওলার দিকে তাকিয়ে চোখের ইশারায় জিজ্ঞেস করলাম ঘটনা কী; রিকশাওলা জানাল, “এই পোলারে ঐ লোক তার দোকানে রাখছিল। দোকানে একজন কাস্টমার আইছেন। একহাজার টাকা দিছেন। এক হাজার টাকার ভাংতি নাই। তিনি তখন ঐ পোলারে বললেন ভাংতি আনার জন্য কিন্তু পোলা টাকা নিয়া ভাইগা আসছে।”
এই কথা শুনে আমি ছেলেটির দিকে আবার তাকালাম, এবার তার ভয়ার্ত ছাপ আমাকে স্পর্শ করল না বেশি, তার চাইতে অধিক আমার মনে হলো তার দুঃসাহসিক চুরি কর্মটার কথা, এমন গর্দভী চুরি কেউ করে!
আমি দেখলাম ছেলেটির বাপ চলে এলো, বাপের মুখে কালো দাড়ি এবং পরনে খালি লুঙ্গি, বাপকে প্যান্ট শার্ট পরা ভদ্রলোক বলছিলেন কীভাবে তার ছেলে টাকা নিয়ে ভেগে এসেছে, বাপ উত্তেজিত হয়ে ছেলেকে দিল এক চড়, এবং ছেলেটি শব্দ করে কেঁদে উঠল আর আমার মানবিক সত্তা জেগে উঠল, আমি দুই ইঞ্চি বেড়ে যাওয়া বুকের ছাতি সামনে রেখে এগিয়ে গিয়ে বললাম, “এই কী হইছে এইখানে? মারামারি কেন?”
প্যান্ট শার্ট পরা বললেন, “দেখেন ভাই, এই পোলা কাজ করে আমার দোকানে, কিন্তু করছে কী দেখেন, আমার দোকানে আইছেন এক কাস্টমার, তাও মহিলা কাস্টমার, দিছেন এক হাজার টাকা, ভাংতি নাই, আমি দিলাম ওরে ভাংতি আনার জন্য, কিন্তু সে টাকা নিয়ে পলাইয়া আসছে? এইটা হয়, বলেন?”
আমি বললাম, “ঠিক আছে, কিন্তু এখন ওরে মারলে তো আর ঘটনা বদলাইয়া যাইব না।”
ছেলের বাপের দিকে তাকিয়ে বললাম, “আপনে কি ওর বাপ?”
ছেলের বাপ বলল, “জি।”
আমি বললাম, “ওরে মারবেন না। উনারে উনার টাকা ফেরত দেয়া কি হইছে?”
প্যান্ট শার্ট পরা ভদ্রলোক বললেন, “আমার টাকা আমি নিয়া নিছি ওর কাছ থেকে।”
আমি বললাম, “তাইলে তো মামলা শেষ। এখন আপনি কি ওরে আর দোকানে রাখবেন?”
প্যান্ট শার্ট পরা বললেন, “না, ও তো একটা চোর।”
আমি বললাম, “ঠিক আছে। সব মিইটা গেল। চুরির দায়ে আপনি ওরে বাইর কইরা দিলেন। এইটা ওর শাস্তি। চুরির মাল ফেরত পাইলেন।”
ছেলের বাপের দিকে তাকিয়ে বললাম, “আপনার পোলারে শিক্ষা দেন যাতে চুরি না করে। কিন্তু মাইরেন না, মাইরা কেউ কাউরে কিছু শিখাইতে পারে না।”
উপস্থিত সবাই দেখলাম আমার কথা মেনে নিচ্ছে, এটা আমার আত্মবিশ্বাসী ভঙ্গিতে কথা বলা না বুকের ছাতি কয়েক ইঞ্চি বেড়ে যাবার দরুন তা ঠিক বলতে পারি না, আমি একবার ছেলেটার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, চোখে তার কৃতজ্ঞ দৃষ্টি, এমনভাবে তাকাচ্ছে যেন আমি ওকে সাক্ষাৎ যমদূতের হাত থেকে বাঁচিয়ে দিলাম; আমি ওখানে মামলা ডিসমিস করে বাসার দিকে হাঁটা দিলাম; ঘটনাটা নিয়ে ভাবতে ভাবতে হেঁটে আসছিলাম বাসায়, একটা গল্পের প্লট হতে পারে, বেশ মানবিক ব্যাপার আছে, আর মানবিক ব্যাপারে আবেগ-টাবেগ মিলিয়ে মিশিয়ে এক খিচুড়ি যদি করা যায় তাহলে মিডলক্লাস পাঠক বড় আনন্দ নিয়ে পড়বে, এইভাবেই তো হয় আসলে, টুকটাক মানবিক জিনিস ধরে ফেলতে হয় আর বালতি বালতি আবেগ মিশাতে হয়, ঠিক যেমন গরুর দুগ্ধের ব্যবসায়ীরা করে থাকে, আসল মাল অল্প এক বালতি দুধ, আর তাতে পানি দুই বালতি;
আনমনে হেঁটে আসছি, আর যেইমাত্র বাঁশফুল অভিজাত ফুড কনফেকশনারির (মিষ্টি জগতে এক ধাপ এগিয়ে) সামনে এসেছি ঠিক তখনই আমার এক বন্ধু তুষার চক্রবর্তীর আগমন, সে আমার ঠিক সামনে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ অবাক হবার ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকল আর আমার বিরক্তি এবং অস্বস্তি বাড়তে লাগল কারণ আমার এই বন্ধু এক জীবন্ত উৎপাত;
কিয়ৎক্ষণ দাঁড়িয়ে সে মুখ খুলল, “আরে ব্যাটা, বডি তো বানাইয়া ফেলছস, আমি ত চিনতেই পারি নাই, জিমে যাছ নাকি?”
“হ, এই কয়দিন ধইরা যাই।”
“কস কী! কয়দিনেই এই অবস্থা হালায় করছস কী! খাস নি কিছু?”
“আরে কী খামু?”
“আছে না কীসব পাউডার টাউডার ট্যাবলেট।”
“আরে না! ওইগুলা খাওয়ার টাইম আছে নাকি! এমনিতেই যাই আসি আর কী।”
“তাইলে বন্ধু চল তরে কিছু খাওয়াই আইজ।”
তুষার আমার হাত ধরে বলল একথা, আমার অস্বস্তি আরো বাড়ল, কারণ তার সাথে গেলে কিছু পরনিন্দা পরচর্চা শুনতে হবে, এখানে আমি বলছি না যে আমি দুগ্ধে ধৌত তুলসী পাতা যে পরনিন্দা করে না বা শুনে না, দুটাই আমি করে থাকি কিন্তু সময় স্থান ও মুড সাপেক্ষে, এখন যেই অবস্থা, সারা গায়ে ঘাম, বর্তমান অবস্থা প্রেক্ষিতে আমার মূল কাজ হলো বাসায় গিয়ে গোছল করা এবং কিছু খাওয়া, এই অবস্থায় পরনিন্দা শুনব কোন দুঃখে;
আমি তুষাররে বললাম, “বন্ধু মাফ কইরা দে, এই অবস্থায়, এই ঘাম গুম লইয়া আমি কি খাইতে পারি, অন্যদিন কথা হবে, আইজ যাই।”
“আরে যাই কি রে ব্যাটা, বহুত জরুরী কথা আছে তর লগে, আমি ত মনে মনে তরেই খুঁজতেছিলাম।”
“ভাই, মাফ কইরা দে, দেখতেছস তো আমার কি অবস্থা, এই অবস্থায় খাই কেমনে, এখন গিয়া গোছল করতে হইব।”
“আরে ব্যাটা, বইয়া ঠান্ডা খাবি, তেষ্টা পাইছে না? কুক টুক খাবি, ফান্টা খাবি, চল।”
“না দোস্ত আমি কুক টুক খাওয়া ছাইড়া দিছি, সুগার বেশি, ফ্যাট বাড়ে।”
“তাইলে দই খাবি, চল; জরিরে নিয়া কথা আছে, আইজ জরির বিয়া।”
আমি বুঝলাম যে তুষারের হাত থেকে আজ আমার নিস্তার নাই ও বাসায় আগামী এক ঘন্টার মধ্যে যাবার কোন উপায় নাই, যেহেতু তুষারের গল্পের মুখরোচক আইটেম আছে আজ, জরি একটা মেয়ে যার ভালো নাম জেরিন, সে দেখতে খুবই মায়াময় হওয়ার কারণে আমাদের বন্ধুকুলের সবাই তার প্রতি দূর্বল ছিলাম অল্পস্বল্প, এবং তার সম্পর্কিত আলাপ আমাদের মধ্যে প্রায়ই হতো, সবাই দুর্বল আবার সবাই যে একসাথে আলাপ করতে পারতাম তার সম্পর্কে এর কারণ ছিল জরির সাথে আমাদের কারোরই কিছু হবার সম্ভাবনা নাই এ বিষয়ে আমরা নিশ্চিত ছিলাম, ফলে তার প্রতি আমাদের প্রত্যেকের অল্পবিস্তর দুর্বলতা নিজেদের মধ্যে কোন ধরনের বিরোধের কারণ হয়ে দাঁড়ায়নি কখনো, তবে জরির সাথে কিছু হবার সম্ভাবনা থাকলে অর্থাৎ সে যদি নাগালের ভেতরে থাকত তখন এমন হতো না নিশ্চিত, যাইহোক, তুষার যে জরির বিয়ের কথা বলেছিল তা শুনে কারো মনে হতে পারে বোধহয় জরির বিয়ে আজ কিন্তু তা নয়, সে হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাসের নামটি বলেছিল এবং আমার জন্য তা বিভ্রান্তির সৃষ্টি করেনি কারণ আজ জরির বিয়ে উপন্যাসটি আমি পড়েছিলাম, ঐ উপন্যাসে যেমন জরির বিয়ে আর শেষপর্যন্ত হয় না তেমনি তুষারের মজা করে বলা কথাটার মধ্যেই ছিল আসলে জরির বিয়ে হয়নি, কিন্তু ইন্টারেস্টিং কিছু জিনিস হয়েছে;
তুষার আমাকে টেনে নিয়ে গেল বাঁশফুলের ভেতরে, প্রায় এক ঘন্টা খানেক বকবক করে গেল, এবং সে অতি অসাধারণ একজন বাকপটু লোক, আমি শুনেছি অনেক অনেক কাল আগে, যখন ছাপাখানা আবিষ্কার হয়নি, মানুষ গাছের ছাল বাকলে লিখে রাখত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াবলী, তখন লোকে কৃষিকাজ করত, আর দিনান্তে পরিশ্রম শেষে এক বুড়ো জটাধারী বটগাছের নীচে জড়ো হতো সবাই, আকাশে চাঁদ উঠত এবং সহস্র তারকারাজি অযুত ঈশ্বরের নিযুত চোখ হয়ে তাকিয়ে থাকত ধরিত্রীর দিকে, সেই সময়ে মৃদুমন্দ বাতাস বইত উত্তর দিক হতে, উত্তরে ঘনজঙ্গল, জঙ্গলের সকল সবুজ বৃক্ষের পত্রপল্লব ছুঁয়ে আসত সে মধুর গা-শীতল-করে-দেয়া বাতাস, আর বটগাছের নীচে বসা বৃদ্ধ লোকটির সাদা দাড়ি উড়ত সে-বাতাসে, লোকটির চোখ জ্বলজ্বল করে উঠত, বটগাছের পাশে যেসব মশাল রাখা হত তাতে আগুনের শিখাগুলি অদ্ভুতভাবে কেঁপে কেঁপে উঠত, আর সে কম্পমান অগ্নিশিখা দেখা যেত বৃদ্ধের দু’চোখে, এবং বৃদ্ধ গল্প বলে যেতেন, মায়াবী জাদুবিস্তারী এক গল্প, তাতে সমস্ত জনপদ যেন স্তব্ধ হয়ে যেত; আমার মনে হয় সেই বৃদ্ধ লোকটির গল্প বলার গুণ কিছু কিছু মানুষের মাঝে অল্প অল্প করে ছড়িয়ে পড়েছে, যুগে যুগে প্রজন্মান্তরে তা চলে এসেছে, এবং আমার মনে হয় তুষারও তার ছিটেফোঁটা পেয়ে থাকতে পারে; ফলে গল্প শুনতে শুনতে আমার যে বিরক্তি লেগেছিল তা বলছি না, এমন বললে মিথ্যে বলা হয়;
তুষারকে বিদায় দিয়ে আমি বাসায় ফিরে আসি, এসে গোছল করি এবং খাই; অতঃপর কম্পিউটার অন করে ইউটিউবে গিয়ে গান শুনতে শুনতে ভাবছিলাম কিছু একটা করা দরকার, এমন সময়ে কলিংবেল-এর শব্দ আমার কানে আসে, এবং আমি ঘড়িতে তাকিয়ে দেখতে পাই ঘড়ি বাজে একটা একুশ মিনিট; এমন সময়ে কে আসতে পারে ভেবে আমি কিঞ্চিৎ অবাক হই, এবং হেঁটে গিয়ে দরজা খুলি, এবং বের হয়ে গেটের কাছে গিয়ে দেখি গ্রিলের অন্যপাশে দাঁড়িয়ে ঐ ছেলেটি, যাকে চুরি করার অপরাধে ঐ প্যান্ট শার্ট পরা লোকটি কলার চেপে ধরেছিল এবং তার বাবা জোরের সাথে একটি চড় মেরেছিল; আমি ছেলেটিকে দেখে অবাক হলাম ও জিজ্ঞেস করলাম, “কী রে, কী ব্যাপার? এখানে কেন তুই?”
ছেলেটি মুখ কাঁচুমাচু করে বলল, “বাপ আমারে বাইর কইরা দিছে।”
বিরক্ত হয়ে বললাম, “বাইর কইরা দিছে তো এখানে কী?”
ছেলেটি মাথা নীচু করে রইল।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, “নাম কী তর?”
ছেলেটি মুখ তুলে বলল, “তকদির।”
এমন নাম আমি আগে শুনিনি, জিজ্ঞেস করলাম, “এখানে এসেছিস কেন?”
“স্যার, আমার যাওয়ার কুনু জাগা নাই।”
“জাগা নাই তাই বইলা এখানে চইলা আসবি? এইটা কোন কথা হইল? তাছাড়া তর ক্যারেক্টারও তো ভালো না, হাতটানের অভ্যাস আছে। হাতটান মানে কি বুঝস?”
ছেলেটি মাথা দুদিকে নাড়িয়ে জানিয়ে দিল সে জানে না, সম্ভবত স্কুলে যায় না তাই বাংলা ব্যাকরণের বাগধারা পড়তে হয়নি;
আমি বললাম, “হাতটান মানে হইল চুরির অভ্যাস। তর এই অভ্যাস আছে, বাজে অভ্যাস।”
ছেলেটি বলল, “এখন আর নাই স্যার।”
আমি জিজ্ঞেস করলাম, “ঠিক আছে, অন্য কোথাও যা।”
“স্যার, আমি আপনার এইখানে থাকতে আসি নাই।”
“তাইলে কীজন্যে আসছিস?”
“আমি আমার কথা আপনারে বলতে চাই। আমার মনে হইছে আপনারে বললে শুনবেন। এমন আর একজন মানুষও আমার চেনাজানা নাই।”
ছেলেটার এই কথা আমাকে তীব্র আকর্ষণ করল, আমার চোখ চকচক করে উঠেছিল নিশ্চয়ই, যে কাজটা আমি করে থাকি নেশায় সেই কাজের উপকরণ হাতের কাছে এসে এমনি ধরা দিলে মনে আনন্দ জাগে, আমার নেশাটা অতি অবশ্যই কুৎসিত, গল্প লেখা, অন্যের জীবন অল্প অল্প চুরি করে গল্পে নিয়ে আসা, অবশ্যই কদর্যতম কাজগুলির একটি, স্বার্থপর কাজ এবং এই কাজের কর্মী হিসেবে অবশ্যই আমি স্বার্থপর, গল্পের ধান্দা পেলে মানুষের সাথে কথা বলতে থাকি, মানুষের বাচনভঙ্গি খেয়াল করতে থাকি, এবং মানুষগুলিকে নিজের লেখার উপকরণ হিসেবে দেখতে থাকি কেবলই;
ছেলেটিকে আমি বললাম, “ঠিক আছে।”
আমি গেট খুললাম, ছেলেটি ভেতরে এল; আমি তাকে নিয়ে এলাম ঘরে, ছেলেটির পরনে একটি ময়লা পুরনো শার্ট ও পুরনো প্যান্ট, আমার রুমে সে মেঝেতে বসে পড়ল, ঠিক তখনই আমার মনে পড়ল যে আমি অনেকবার লিখেছি মধ্যবিত্তরা কাজের লোকদের বসার চেয়ারে বা খাটে বসতে দেয় না ইত্যাদি, ফলে আমার ভেতরে দ্বিধাদ্বন্দ্ব কাজ করছিল, আমি ছেলেটিকে বললাম, “তুই খাটে বস।”
ছেলেটি বলল, “না স্যার, এইখানেই বসি। অসুবিধা নাই।”
তার যখন অসুবিধা নাই, তখন আর আমি জোরাজোরি করলাম না; ছেলেটার নাক ছিল খাড়া, এবং তাতে আলো পড়ে যেন চকচক করছে আমি লক্ষ করলাম;
আমি আমার কম্পিউটারের সামনে গিয়ে বসলাম, মাইক্রোসফট ওয়ার্ড ওপেন করলাম, মোবাইলের রেকর্ডার অন করলাম এবং ছেলেটির দিকে তাকিয়ে বললাম, “কী বলবি বলতে থাক?”
ছেলেটি ইতস্তত করছিল;
আমি বললাম, “তুই সত্যিই ঐ দোকান থেকে চুরি করছস?”
ছেলেটি বলল, “জি স্যার করছি। উনি আমারে বেতন দেয় নাই, আমি বেতনের কথা বলছি সন্ধ্যায়, উনি দেয় নাই। তাই টাকা নিয়া আমি আসছিলাম।”
“তর বেতন কত?”
“এক হাজার টাকা।”
“তাইলে কি এই মাসের বেতন আর পাস নাই? লোকটা ত টাকা নিয়া গেল?”
“জি পাই নাই।”
“তর বাপে কী করে?”
“রিশকা চালায়।”
“মায় কী করে?”
“মায় নাই।”
“ভাই বইন আছে?”
“আপনা ভাইবোন নাই। সৎ বইন আছে, দুই বছর বয়স।”
“তর সৎ মা আছে?”
“জি আছে।”
“ইস্কুলে যাস তুই?”
“আগে যাইতাম, দুই কেলাস পড়ছি।”
“ছাইড়া দিলি কেন?”
“সৎ মা ছাড়াই দিছে, বাপে স্কুল ছাড়াইয়া দিল।”
“সৎ মা কি তরে দেখতে পারে না?”
ছেলেটি নীরব হয়ে রইল, তার নীরবতা হ্যাঁ বোধক উত্তর দিয়ে গেল;
আমি বললাম, “আমার ধারণা তুই আমারে গুরুত্বপূর্ণ কিছু বলতে আইছস, কিন্তু সেইটা কী?”
ছেলেটি বলল, “স্যার, আমি আইজ চুরি করি নাই, কিন্তু আগে কিছু চুরি করছি।”
“ধরা পড়ছ নাই?”
“জি না।”
“চুরি করছ কেন?”
“আমার বাপের বউ আমারে খাইতে দেয় না, মারে, আমারে বাইরে বাইরে থাকতে হইত, চুরি করতে হইত।”
“তর আসল মায়ের কী হইছে?”
“আরেক বেটার সাথে ভাইগা গেছে, আমার তখন দুই বছর।”
“হুম। কাহিনী কী তর? এইগুলা বলতেই কি আইছস?”
“জি, আমার যে লাইফ, কোন কিছুই নাই স্যার।”
আমি দেখলাম ছেলেটার মুখে হতাশা, আমি তাকে অনুপ্রেরণা দিতে গিয়ে বললাম, “এইভাবে ভাবতে হয় না, সবার লাইফই এইরকম, কিছুই নাই। এই আমারে দেখ, লেইখ্যা-টেইক্কা কিছু করমু বইলা আইছিলাম এই শহরে, কিন্তু নাথিং। তাও চলতে হয় আর কি।”
“আপনেরা বড় মানুষ।”
“বড় মানুষ আর ছোট মানুষ ব্যাপার না। ঘটনা হইল কত লোক ফকিন্নি অবস্থা থেকে বড়লোক হইছে, হইছে না?”
“জি।”
“তুই ও চেষ্টা করলে পারবি। চেষ্টায় কি না হয়।”
ছেলেটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল, তখন আমি ওকে জিজ্ঞেস করলাম, “আর কী আছে তর গল্প বইলা যা।”
ছেলেটা বলল, “আমার বাপের দুই নাম্বার বউয়ের লাইন আছে আরেকটা লোকের লগে। আমরার বস্তিতে থাকে। আমি তা জাইনা ফেলি।”
“এইজন্যই কি তরে দেখতে পারে না?”
“জি।”
“জানলি ক্যামনে?”
“একদিন রাইতে দেখছি। বাপ ছিল না ঘরে। তখন কাশেইম্ম্যা আইসা পুটকী মারে।”
“নিজে দেখছস তুই?”
“হ, ভাবছে ঘুমাইছি। আমি জাগনা ছিলাম।”
“এরপর?”
“এরপর বাপ আইলে বাপরে বইলা দেই। বাপে পিটায়।”
“কারে?”
“তার বউরে।”
“তর বাপে বউরে ছাড়ে নাই?”
“না, আমার বাপ হইল আকাইম্মা। ছাড়ে নাই। উলটা আমারে লাত্থি মাইরা বাইর কইরা দিত।”
“তুই ঐ দোকানে কাজ পাইলি ক্যামনে?”
“ঐ দোকানের মালিক বস্তির লগের বাসায় থাকে। একদিন আমারে দেইখা কইল দোকানে কাজ করবি? আমি রাজী হই। কিন্তু মাস যায় বেতন দেয় না।”
“আর?”
“বিশ্বাস করেন স্যার ঐটা চুরি না। নিজের পাওনা টেকা নেয়া কি চুরি?”
“না।”
“আমি সেইটাই করছি।”
“তা এত লোক থাকতে তুই এইসব আমারে বলতে আইলি কেন?”
“স্যার, সবাই আমারে চোর মনে করছে। খালি আপনার চউখে চাইয়া আমি দেখছি ঐরকম কিছু নাই। আপনার চউখে মায়া ছিল, যেইটা আমি এর আগে কোনদিন দেখি নাই। তাই মনে হইল আপনারে এইসব বইলা যাই।”
ছেলেটার এই কথা শুনে আমি ভিন্নভাবে ওর দিকে তাকালাম এবং ওর প্রতি এক ধরনের মমতা কাজ করল;
আমি বললাম, “তুই আমার এইখানে থাইকা যা, ঠুকঠাক কাজ করলি।”
নতমস্তকে ছেলেটি জানাল, “না স্যার।”
আমি পাশের আলনায় ঝুলানো প্যান্টের পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করলাম, মানিব্যাগের ভেতর থেকে একটি একশো টাকার নোট বের করে ছেলেটির দিকে বাড়িয়ে ধরে বললাম, “এইটা রাখ।”
ছেলেটি দৃঢ়ভাবে বলল, “নিমু না স্যার।”
তার দৃঢ় উত্তর শুনে আমি আর নিতে বললাম না; সে উঠে দাঁড়াল ও আমাকে বলল, “কথা শেষ, এইবার যাব স্যার।”
“এখন যাবি কই?”
ছেলেটি নীরব রইল; আমার ইচ্ছা হচ্ছিল তাকে আবার বলি থাকার জন্য, কিন্তু এটা বুঝতে পারছিলাম যে সে রাজী হবে না, এই অল্প বয়েসের জীবনেই সে কঠিন বাস্তবতার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে, ফলে তার মধ্যে দৃঢ়তা চলে এসেছে, এবং ছেলেটির আচরণ অদ্ভুত কিছুটা আমার মনে হচ্ছিল;
আমি দরজা খুলে দিলাম, সে এগিয়ে গেল; আমি গেট খুলে দিলে সে বেরিয়ে যায়, এবং ধীরে ধীরে মাথা নিচু করে হাঁটতে হাঁটতে অন্ধকারে মিলিয়ে যায়; তার চলে যাওয়া কেমন যেন বিষাদী মনে হচ্ছিল আমার কাছে, রাতের আকাশে তখন বেশ বড় চাঁদ, এদিকে ল্যাম্পপোস্টগুলিতেও বাতি জ্বলছে, রাস্তার দু’পাশের বয়স্ক গাছগুলি চাঁদের আলোকে ছিঁড়ে ভাগ ভাগ করে নিচে ফেলে দিচ্ছে, আর তার ভেতর দিয়ে কেমন অশরীরী ভাবে চলে গেল তকদির, আমার মন খারাপ হয়ে গেল;
জিম থেকে এসে ক্লান্ত ছিলাম, রাত জাগা পোষায় না, সকালে যেতে হয় কাজে; ফলে বিছানায় শুয়ে অল্পক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে যাই সম্ভবত এবং সেই ঘুমের মধ্যে হয়ত অদ্ভুত কিছু স্বপ্ন দেখেছিলাম, তার কিছুই মনে ছিল না যখন সকাল ন’টার এলার্মে ঘুম ভাঙ্গে;
রেডি হয়ে অফিসের উদ্দেশ্যে বের হই, এবং সকাল সকালই আমাদের বিল্ডিং এর কেয়ারটেকার হালিম সরকারের সাথে দেখা হয়, সে পান খাওয়া লাল দাঁতগুলি বের করে হেসে নিয়ে বলে, “কই যান ভাই?”
আমি বলি, “অফিসে যাই।”
হালিম সরকার বলে, “আপনার বাসার লাইট ফাইট কমোডের ফ্ল্যাশ টাশ ভালো তো সব?”
উত্তর দেই, “হ্যাঁ হ্যাঁ, ভালো।”
এই সময়ে, এইসব কথাবার্তার ফাঁকে আমার চোখ যায় আমাদের সামনের বিল্ডিং-এর বারান্দায়; সেখানে দেখতে পাই এস আলম সাহেবের সুন্দরী স্ত্রী বারান্দার টবে লাগানো গাছগুলিতে পানি দিচ্ছেন, তার পরনে ম্যাক্সি জাতীয় পোষাক, লম্বা চুল গড়িয়ে পড়ছে হয়ত কোমরে, আর বিশাল নিতম্ব, যাকে চটি স্টাইলে বলা যায় তানপুরার মত;
আমার চোখ লক্ষ করে তাকায় হালিম সরকার, এবং এস আলম সাহেবের স্ত্রীকে বারান্দায় সেও দেখতে পায়, এবং আমি বিব্রত হই ও হালিম সরকারের দিকে তাকিয়ে কথায় ফিরে আসি; কিন্তু হালিম সরকার আর কথায় নাই, সে বেশ বিকৃত ইঙ্গিত করে আমার দিকে এবং হালকা স্বরে গায়, “গলায় রশি দিয়া আমায় আলগা তাকি টানেরে, আমার বন্ধু মহা যাদু জানে”;
আমি হালিম সরকারকে পিছনে ফেলে দ্রুত হাঁটতে থাকি, কিছু দূর যাবার পর একবার পিছনে ফিরে তাকাই ও দেখতে পাই হালিম সরকার লোভাতুর দৃষ্টিতে এস আলম সাহেবের বারান্দার দিকে তাকিয়ে আছে, এবং এস আলম সাহেবের স্ত্রী টবে পানি দেয়া শেষ করে এসে বারান্দার রেলিঙে হেলান দিয়ে সকালের পরিবেশ দেখছেন; আমি বিরক্ত হই মহিলার আচরণে, আমার মনে হয় প্রভাত পরিবেশের চাইতে পরপুরুষের দৃষ্টি তিনি বেশি উপভোগ করেন;
আমি সামনে একটু এগিয়ে যাই, আর কাকতালীয়ভাবেই যেন এস আলম সাহেবের সাথে দেখা হয়ে যায়, জগিং করতে বেরিয়েছিলেন, ফিরে আসছেন, ভুঁড়িওয়ালা এস আলম সাহেব; সরকারী এঞ্জিনিয়ার এবং যার বউ-ভাগ্য ঈর্ষণীয় বলেই মনে করেন এলাকার পুরুষকুল;
এস আলম সাহেব হাসিমুখে আমার দিকে এগিয়ে আসেন, বা হাতের তোয়ালে দিয়ে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে ডান হাত বাড়িয়ে দেন, হাত মেলান ও কুশল জিজ্ঞাসা করেন; কুশলাদি বিনিময়ের পর আমি হঠাৎ মুখ ফসকে উনাকে জিজ্ঞেস করে ফেলি, “আপনি কি তানপুরা বাজাতে পারেন?”
এস আলম সাহেব জানান, “না, আমি খালি বাঁশি বাজাতে পারি। তবে ঘটনা হচ্ছে আপনার ভাবি গিটার শিখতে চায়। এখানে যে গানের স্কুল আছে ওখানে কি গিটার শেখায়?”
আমি বলি, “হ্যাঁ, ওখানে শেখায়। আপনি খোঁজ নিয়ে দেখতে পারেন কেমন ব্যবস্থা।”
এস আলম সাহেব বললেন, “যাবো যাচ্ছি করে যাওয়া হচ্ছে না। তবে আপনার সাথে যেহেতু আজ কথা বলেই ফেললাম তাহলে আজ আর মিস দেব না। অবশ্যই যাবো।”
এস আলম সাহেব বিদায় জানিয়ে চললেন তার বাসার দিকে; আমি চললাম অফিসের দিকে, যাচ্ছিলাম সেই রাস্তা দিয়ে, যে রাস্তায় কাল রাতে ঐ ছেলেটির চুরির বিচার হচ্ছিল, আজ এখানে তেমন কোন জটলা নেই, অল্প দূরে অবস্থিত একটি চায়ের দোকান; আমি যেহেতু অফিসে যাচ্ছিলাম তাই ওদিকে বা অন্য কোন পাশে সচেতন চোখ ছিল না, তাই প্রথম ডাকটা শুনতে পারি নি, দ্বিতীয় ডাকটা এলো বেশ জোরের সাথে;
“ভাই, ভাই, একটু দাঁড়ান ভাই!”
আমি ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি চেনা নেই জানা নেই এমন একটি লোক; আমার চোখে জিজ্ঞাসু দৃষ্টি ছিল কিন্তু জিজ্ঞাসার আর সময় পাইনি; তার আগেই লোকটি বলল, “স্যার, আপনারে ডাকে।”
লোকটি আঙ্গুল দিয়ে ইশারা করল চায়ের দোকানটার দিকে; আমি ওদিকে তাকিয়ে দেখি একজন পুলিশের ইউনিফর্ম পরা লোক, কালো চশমা চোখে, খুব ভাব নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন;
আমি এগিয়ে গেলাম, পুলিশ লোকটি আমার দিকে তীক্ষ্ণভাবে তাকালেন বলে মনে হলো, এরপর তিনি চশমা খুললেন ও জিজ্ঞেস করলেন, “কাল রাত আনুমানিক এগারোটার দিকে এখানে একটা ছেলেকে চুরির অভিযোগে ধরা হয়। তার বিচার হয়। তার উপর নির্যাতন হয়। আপনি তো দেখেছেন?”
প্রশ্নের ধরন দেখে আমি একটু থতমত খেয়ে যাই, আমার মনে হয় গলা শুকিয়ে আসছে, কেন এমন মনে হয়েছিল বলতে পারি না, হয়ত আমি ভয় পেয়েছিলাম;
উত্তরে বললাম, “জি।”
“আপনি কী দেখেছেন বলুন।”
“আমি দেখেছিলাম একটা লোক ছেলেটাকে ধরে রেখেছে। চুরির কথা বলছে। পরে ছেলেটির বাবা এসে ওকে চড় মারে।”
“আপনার সামনেই মেরেছে?”
“জি।”
“দোকানের মালিক লোকটা কি মেরেছিল?”
“আমার সামনে মারেনি। আমি পাঁচ দশ মিনিট ছিলাম। এরপর চলে যাই।”
পুলিশের লোকটি একটি নোটবুক এগিয়ে দিয়ে বলল, “এখানে আপনার নাম ঠিকানা কনটাক্ট নাম্বার লিখে দিন।”
আমি কথামত লিখে দিলাম ও দেয়ার সময় জিজ্ঞেস করলাম, “কী হয়েছে আসলে?”
পুলিশের লোকটি আমার প্রশ্নকে পাত্তাই দিল না, হাত দিয়ে ধুলো ঝাড়ার মত ভঙ্গি করল এবং চায়ের দোকানটাতে গিয়ে একটা সিগারেট নিল, ধরাল এবং সিগারেট টানতে টানতে চলে গেল, লোকটি চলে যাবার সময় আমি ওর ইউনিফর্মে থাকা নেইমপ্লেট দেখলাম, নাম রবিউল ইসলাম তরফদার;
আমি বেশ অবাক হয়েছিলাম, চায়ের দোকানে কয়েকটি লোক জড়ো হয়েছিল এবং পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদ তারা দেখছিল, সেখানে যে লোকটি আমাকে ডেকেছিল সেও ছিল, আমি এগিয়ে গিয়ে লোকটি বললাম, “কী ব্যাপার?”
লোকটি বলল, “স্যার আমাদের জিগাইতেছিলেন কাইলকার ঘটনা নিয়া। কাইল আমি আপনারে দেখছি ঐ জায়গায়। আপনি যাইতেছেন দেইখা চিইন্না ফেলি ও স্যাররে বলি, আপনে শিক্ষিত মানুষ বুঝাইয়া বলতে পারবেন। আমরা অশিক্ষিত লোক, কী বলি না বলি তার নাই ঠিক।”
আমি বললাম, “ঠিক আছে। কিন্তু কাইল হইছেটা কী?”
লোকটা বলে, “ক্যান? আপনে জানেন না?”
আমি বলি, “না।”
লোকটা বলে, “আপনে যাওয়ার পরে বাপ আর দোকানের লোকটা পোলাটারে বেদম পেটায়। আর একসময় ও হাত ছুটাইয়া দৌড়াইয়া গিয়া ট্র্যাকের নিচে ঝাঁপ দেয়। সব শ্যাষ জায়গাতেই।”
লোকটার কথায় আমি যুগপৎ হতবাক ও বিস্মিত হই, এবং কিয়ৎক্ষণ কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থায় কালক্ষেপণ করার পরমুহূর্তে প্যান্টের ডান পকেট থেকে মোবাইল ফোন বের করি, দ্রুত রেকর্ডিং ফাইলগুলি দেখতে থাকি, গত রাতের ফাইলটিও সেখানে আছে, আমি তা বাজাই এবং অবাক হয়ে লক্ষ করি যে কেবল আমার কন্ঠই শোনা যাচ্ছে, অন্য কোন কন্ঠ নয়;
এই গল্পটি অনেকেরই মনে হতে পারে মিথ্যা, কিন্তু তা কখনোই নয়; শপথ সমগ্র কল্পিত দেবতাকুলের, শপথ এই ধরিত্রীর, আলো বাতাস এবং বয়ে যাওয়া সব নদীসমূহের; আমি যা বর্ণনা করলাম তা অতিশয় সত্য এবং তাতে কণামাত্রও মিথ্যার কোন অবকাশ নাই; সমগ্র ঘটনা, ছেলেটির মুখভঙ্গি, কথাবার্তা এবং তার বিষাদ-বিস্তারী চলে যাওয়া, সকল কিছু আমার স্পষ্ট মনে আছে, এমন স্পষ্ট যে চোখ বন্ধ করলেই আমি এখনো তা দেখতে পাই; এবং এখনো প্রতিদিন ঐ একই রাস্তা দিয়ে আমি জিমে যাই;