মাথার ওপরে ফ্যানটা তখন থেকে ঘ্যানর ঘ্যানর করে ঘুরছে। না হয় হাওয়া, না হয় ঘোরার জোর, শুধু আওয়াজেরই জোর। সেই কথায় বলে না, ফুটো কলসির আওয়াজ বেশি, তা এ হয়েছে সেই গোত্তর। যত না কাজ দেয় তার থেকে বেশি দেয় আওয়াজ। গরু দুধ দিলে না হয় তার লাথি সহ্য করা যায় কিন্তু শুধু শুধু গরুর লাথি সহ্য করে কে?
এই এক চিলতে ছিটে বেড়ার ঘরে ফ্যানটা মানান না বেমানান সেটা ঠিক করে কে! একটা পুরনো, কবে রঙ করা হয়েছে দেখে বোঝা যায় না, রঙ চটা সেকেলে ধরনের ফ্যান। তার ঝোলানোর রডটাও বেশ ছোট। অবশ্য নীচু ছাদের ঘর, রড ছোট না হলে হাত তুললেই তো হাতে লাগত। তা হোক, অসীমার খুব ইচ্ছা ছিল একটু লম্বা রডের, বেশি লম্বা নয় ওই সাধারণ যেমন হয় আর কি! ছোটো রড হলে কেমন যেন কোল কুঁজো, ঘাড়ে-গর্দানে লাগে। বেশ ছিমছাম মনে হয় না। কিন্তু ওদের বাড়িই তো নীচু। এখানে লম্বা রড লাগিয়ে কী আর হবে!
বেশ কয়েক বছর ধরেই গরমটা ভালোই পড়ছে। যদিও ছিটে বেড়ার ঘরে সিমেন্টের বাড়ির মত গরম হয় না ঠিকই, তবু দুপুর বেলা আর রাতের বেলা যেন বেশ অসহ্য লাগে আজকাল। তাই চিন্তা হয়, মানুষটা এই দুপুর বেলা গরমে বাইরে বাইরে থাকে, কতটা কষ্ট হয়। সেদিন কথায় কথায় অসীমা বলছিল, তোমার এই দুপুরবেলা খুব কষ্ট হয়, নাগো?
--তোমাদের মত সুখের শরীর তো নয়, মোমের মত একটু গরমে গলে যাব। কষ্ট না করলে দক্ষিণ হস্ত কি আর এমনি এমনি মুখে উঠবে? তাছাড়া এখন এই বয়সে যদি না কষ্ট করি দাঁড়াব কি করে, বয়সকালে কি হবে? আজ না হয় দুটো পেট চিরকাল কি এমনি থাকবে? সংসারটা বাড়বে না?
বলতে বলতেই মানুষটা কোথায় যেন হারিয়ে যায়, দুচোখে কোন এক সুদূরের স্বপ্নের ছবি ভেসে ওঠে। আর তার সুবাস ভাসিয়ে নিয়ে যায় অসীমার রঙিন মনটাকে এক স্বপ্নের জগতে।
সত্যি সত্যি কী খুব মোমের শরীর অসীমার। সেই ভোর ভোর উঠে কত কাজ থাকে সংসারের। হলেই বা দুজনের সংসার। সকাল সকাল বেরিয়ে যাবে মানুষটা, কোথায় কোথায় ঘুরবে, কোথায় খেতে পাবে, তাই সেই চিন্তাটা মাথায় আছে না? তাই ভোর ভোর উঠে কাপড়চোপড় কেচে ঘর উঠোন ঝাড়ু দিয়ে তাড়াতাড়ি রান্না বসিয়ে সব সারতে হয়। সামনে বসিয়ে মাথার দিব্যি দিয়ে পেট ভরে খাইয়ে তবে পাঠায় অসীমা, তারপর টিফিন বেঁধে দেয় সঙ্গে। বলে, দুপুরে খিদে পেলে একটু বসে ছায়ায় জিরিয়ে খেয়ে নিও। সময়ে খাওয়া হলে তবেই তো শরীর চলবে।আর শরীর চললে সব চলবে। গোবিন্দ বলে তুমি তো আমায় খাইয়ে খাইয়েই মেরে ফেলবে।
--বালাই ষাট। ওরকম কথা মুখে আনতে আছে। ঠিকমত খাওয়াদাওয়া না করলে কাজ করবে কী করে?
একটা ছোট্ট 'হুঁ' দিয়ে চুপ করে গোবিন্দ।
বিয়ের পর পরই এই বাড়িতে উঠে এসেছিল গোবিন্দ নতুন বউকে নিয়ে। হাসতে হাসতে বলেছিল, এই হল আমাদের নতুন ফ্ল্যাট।
ফ্ল্যাট না হোক, এমনি বাড়িটা ভাল। আসলে এক মালিকের এক উঠোনের এদিকে ওদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বেশ কয়েকটা ছিটে বেড়ার ঘর। একটা কল আছে এককোণে। একটু ওপাশে রাস্তার ধারে টাইমকলও একটা আছে। যেটা খুশি ব্যবহার করা যায়। ছিটে বেড়ার ঘর বটে তবে জায়গা আছে ভালোই। রান্নাও করা যায় এককোণে। একপাশে তাদের নতুন চৌকি। গোবিন্দ এটাকে বলে পালঙ্ক। মজা করে কথা বলতে পারে বটে মানুষটা। এসেই ছোট্ট এই ঘরটা নিজের মত করে সাজিয়ে নিয়েছে অসীমা, যেমনটি ও দেখে এসেছে মায়ের সংসারে। একটা সস্তার আলনা কিনেছে--তাতে দুজনের কাপড়-জামা পরিপাটি করে ভাঁজ করা। খাটের পাশে একটা চেয়ার টেবিল, তার ওপরে ওদের দুজনের একটা ছবি। একটা ফুলদানি আর দু একটা টুকিটাকি, কিন্তু গোছানো। ঘরের দরজা দিয়ে ঢুকেই একটা ছোট্ট জুতো রাখার র্যাক। গোবিন্দকে বলা আছে, ঘরে ঢুকে আগে জুতো ছেড়ে র্যাকে রেখে হাত পা ধুয়ে তবে যেন ঘরে অন্য জিনিষে হাত দেয়।
ঘরের এক কোণে একটা ঠাকুরের জায়গাও করেছে। রোজ সকালে আর সন্ধ্যায় একটু ফুলজলও দেয়। বেশ একটা লক্ষ্মীশ্রী এনে ফেলেছে ঘরটায়। গোবিন্দ তো দেখে খুব খুশি, বলে, তুমি যে এখনই পাকা ঘরণী হয়ে উঠেছ। এত শিখলে কোথায়?
রোজ সকাল নটা-সাতচল্লিশের লোকালটা ধরে ও কোলকাতায় যায়। সঙ্গে বউ টিফিন গুছিয়ে দেয়। এ নিয়ে একটু গর্বও বোধ করে। এতকাল তো ছিল বাউণ্ডুলে, মা-বাবা তো কবেই মরেছে। কাকার সংসারে মানুষ। তা সে কাকাও একদিন নেশার ঘোরে গালাগাল দিয়ে দিল তাড়িয়ে। তারপর এখানে ওখানে ঘুরে এই ফেরি করার কাজই করে চলেছে। কোন কাজই তো শেখার মত শেখা হয়নি। মাঝে কিছুদিন হোটেলের কাজ করেছিল। কিন্তু মালিক কাস্টমার সবাই বড় গালাগালি করে। ভাল লাগেনি। তারপর এক ডেকরেটরের সাথে শাগরেদি করেছিল কিছুদিন। একদিন ঘুমিয়ে পড়েছিল বলে খুব মেরেছিল সে। আর ও রাস্তা মাড়ায়নি। রাস্তার ধারে বসে যখন ভাবছে কি করি কি করি, তখনই মাথাটা খুলে যায়। হাতে যা পয়সা ছিল তাই দিয়ে কিছু লজেন্স কিনে মেলায় ফেরি করেছিল। প্রথম দিনই ভাল বিক্রি হয়েছিল, ওর খরচ উঠেও ভাল লাভ ছিল। তারপর আর ফিরে তাকাতে হয়নি। প্রথম প্রথম জিভে একটু জড়তা ছিল, আড় ভাঙ্গতে কদিন সময় লেগেছিল। তারপর অন্যান্য কায়দা-কানুনগুলো পাকা ওস্তাদদের কাছে শিখে নিয়েছিল আস্তে আস্তে। একটা জিনিস ও শিখেছিল, যাই করো পোশাক-আশাক যেন নিটোল পরিপাটি থাকে। সেই থেকে ও বেরোনোর আগে স্নান করে পরিচ্ছন্ন পরিপাটি পোশাক পরেই রোজ বেরোয়।
অসীমা বাঁকা চোখে মজা করে বলে, এত সাজগোজ কিসের জন্য, কেউ দাঁড়িয়ে আছে নাকি?
--হ্যাঁ সবাই কি আর তোমার মত? আর কেউ তাকায়ই না। অবশ্য একটাকে সামলাতেই আমি কাৎ, আবার আর একটার কথা তো ভাবতেই পারি না।
--যাক, তাও ভাল।
অসীমা মুচকি হাসে।
গোবিন্দ একদিন আবিষ্কার করেছিল ওর গানের গলা ভাল, অন্তত লোকে তাই বলেছে। সেদিন থেকে ও গানটাকে ব্যবসার কাজে লাগিয়েছে। না, গান গেয়ে ভিক্ষে ও করে না। তবে ও শুরুতেই একটা গান ধরে--শুনেই লোক ওর দিকে তাকায়। তখনই শুরু হয় ওর আসল ব্যবসা। যাই নিয়ে আসুক ওর গুণমুগ্ধদের কাছে ঝটপট বিক্রী হয়ে যায়। ট্রেনে ফেরি করে ও। রোজ ওর বাঁধা ট্রেন আছে। ওদের ইউনিয়নের তরফ থেকে সব ঠিক করা আছে, কে কোন ট্রেনে, কোন জিনিস বেচবে। এক জিনিস এক কম্পার্টমেন্টে দুজন বেচবে না। সবাই সবায়ের সঙ্গে তাল মিল রেখেই চলে। কিন্তু ও জানে ওর গানের গলা আর ব্যবহারের জন্য লাইনে ওর বিক্রী বেশি। এটা তো যার যার নিজস্ব ক্ষমতা। কারোর কিছু বলার নেই। তুমি পারো ওর মত গান করো না, কে বারণ করছে?
আর এই গানই তো ওকে মিলিয়ে দিয়েছে অসীমার সঙ্গে। সেবার পুজোর সময় ও প্ল্যাটফর্মে গান গাইছে, কী যেন, হ্যাঁ মান্না দের একটা গান। মান্না দের গান গাইতেই ওর ভাল লাগে বেশি, ওর গলায় খোলেও ভাল। আর তখনই অসীমারা সব বন্ধুরা মিলে পুজোতে ঠাকুর দেখতে বেরিয়ে নেমেছিল স্টেশনে। গান শুনে চমকে তাকিয়েছিল অসীমা, তখনই হঠাৎ এক চাহনিতেই চিড়িক করে বিদ্যুতের শিহরণ খেলে গিয়েছিল গোবিন্দর শরীরে। তারপর কখন কী করে কী যে হয়ে গেল, সে সব যেন অনেকখানি স্বপ্ন অনেকখানি বাস্তব - সব মিলে মিশে একাকার।
তবে বিয়ের আগে গোবিন্দ অসীমাকে সব বলেছিল, দেখ আমার এই অবস্থা। কিছুই নেই আমার। চালচুলো, আত্মীয়স্বজন কেউ নেই। একটা জিনিস অসীমার খুব ভাল লেগেছিল, গোবিন্দ মিথ্যে কথা বলে না, মিথ্যে জিনিসটা ও পছন্দই করে না। কোন জিনিস নেই তো নেই তা নিয়ে চাহিদা দুঃখ লুকোছাপা কিছু নেই। বলে, সবার কি সব থাকে, যদি আমার ভাগ্যে থাকে কোনদিন না কোনদিন এমনিই হবে। আর এই চাহিদাশূন্য বলেই ওর মধ্যে একটা বেশ সুখী সুখী ভাব মুখেচোখে খেলা করে যায়।
অসীমার কিসে ভাল হবে, কিসে খুশি থাকবে ও কিসে কষ্ট কম হবে, এই চিন্তা সব সময় গোবিন্দর মাথায় ঘোরে। কখন একটা ফিতে বা রঙিন চুড়ি, কখনও বা একটা বালতি বা হাঁড়ি। সবটি লক্ষ করে, কী হলে বউয়ের একটু সুবিধা হবে কাজের। সেদিন এনেছে একটা নাইলনের মশারি।
বলে এই গরমে সুতির মশারিতে বড় গরম করে, তাই না ? এই নাইলনের মশারিতে হাওয়া খেলে ভাল। হাল্কাও বটে। অসীমা বলে, তা ঠিক। তবে কী না ঘরে হাওয়া ঢোকার ঐ তো এক জানালা। তাও সামনে দেওয়াল থাকার জন্যে হাওয়া আসে না। দেওয়ালটা না থাকলে বেশ হত।
কথাটা শুনে অবধি গোবিন্দর মাথায় অন্য একটা কথা ঘুরতে শুরু করেছে।
কদিন সব সময়েই ও আনমনা থাকে। অসীমা জিজ্ঞাসা করলে বলে, নতুন একটা কথা ভাবছি।
--কিসের কথা?
--না, ঐ ব্যবসার কথা।
কিছু আর কথা এগোয় না।
এরপর একদিন বেলাবেলিই গোবিন্দ বাড়ি এসে হাজির, অসীমা তখনও দিবানিদ্রা দিচ্ছে খেয়েদেয়ে। হঠাৎ ওকে দেখে ভূত দেখার মত চমকে উঠল। কি ব্যাপার, শরীর-টরীর ঠিক আছে তো? কিন্তু গোবিন্দকে তো বেশ খুশিখুশিই দেখাচ্ছে।
মাটিতে রাখা একটা বড় বাক্সর দিকে গোবিন্দ দেখিয়ে বলে, কী বলো তো এটা?
--কি?
--বলোই না।
--কি করে জানব?
--দেখ। বলে বাক্সটা খুলে বের করে একটা ফ্যান, সিলিং ফ্যান।
দেখে তো অসীমা আনন্দে আটখানা।
--বাবাঃ, আমাদের বাড়িতে ফ্যান! কার কাছ থেকে এনেছ? কত দাম? কোথায় পেলে? প্রশ্নের বন্যা বইয়ে দেয়।
গোবিন্দ দেখে আর মুচকি মুচকি হাসে।
বলে, তোমার গরমে খুব কষ্ট হয় বলছিলে, তাই নিয়ে এলাম। পরিচিত এক ভদ্রলোককে বলে রেখেছিলাম। উনি বলছিলেন, নতুন ফ্যান কিনবেন। আমি বলে রেখেছিলাম, পুরনোটা আমাকে দেবেন। তা উনি অল্প কিছু নিয়ে দিয়ে দিলেন। আমিও নিয়ে ভাবলাম অসময়ে এসে তোমাকে একটু চমকে দিই। তাই চলে এলাম।
অসীমার মুখটা চকচক করে উঠল খুশি আর আনন্দে।
ভাল কথা পাঁচ কান হতে তো আর দেরি হয় না। আর পাঁচবাড়ি ঘুরে সোজা বাড়ির মালিকের কানে উঠল কথাটা।
পরদিন সকালবেলায় তখনও গোবিন্দ কাজে বের হয়নি, খেতে বসেছে সবে।
মালিক খালি গায়ে ধুতি পরে দাঁত মাজতে মাজতে এসে দরজায় ডাকতে আরম্ভ করে, গোবিন্দ আছ নাকি? গোবিন্দ---
--কি হল, সকাল বেলায় বেটা ডাকাডাকি করে? গলা নামিয়ে গোবিন্দ বলে।
বাইরে বেরিয়ে এসে বলে, হ্যাঁ, বলুন।
--না, শুনলাম নাকি ফ্যান এনেছ? তা বাপু আমার তো ভাড়া ওই একটা লাইটের জন্য বলা আছে। তার বেশি তো তুমি নিতে পারো না। এখানে যত ঘর ভাড়াটে আছে সবারই ওই এক ব্যবস্থা। সবারই ঐ একটা লাইটের কথা, তোমাকে যদি আর একটা ফ্যান লাগাতে দিই, আর সবাই কী বলবে?
তারা তো আর বানের জলে ভেসে আসেনি। সবাই তখন একই আবদার ধরবে। আমি তখন যাই কোথায়? সেটি তো বাপু হবে না।
--এর জন্যে আপনি আবার কষ্ট করে আসতে গেলেন কেন? আমিই যেতাম ডেকে পাঠালে?
--না না তার আর কী হয়েছে। আমি এলামই না হয় তোমার বাড়ি, নিজেরই সব লোক তোমরা। কি, আসতে নেই?
--হ্যাঁ সে তো ঠিকই, এ সব আপনার নিজেরই তো বাড়ি। সব সময়ই আসতে পারেন।
--হ্যাঁ, আমিও সেই কথাই বলছি। এলামই না হয়। তবে বাপু ঐকথাই রইল। একটা লাইটের বেশি দেওয়া মুশকিল ওই টাকায়।
--সে কেন? ফ্যানের জন্য আমি বাড়তি টাকা দেব। আমি তো বলিনি দেব না।
--সে বাপু অনেক ঝামেলা।
--কেন?
--ঐ গরমে নাহয় ফ্যান চালালে - টাকা দিলে। এর পর একটু ঠান্ডা হলে বলবে, ফ্যান চালাচ্ছি না। টাকা দেব না। এখানে তো সারা বছরই গরম, কোনদিন চালাবে কোনদিন চালাবে না সে আমি খেয়াল রাখব কী করে? দিনে হয়ত চালালে না, রাতে চুপি চুপি চালালে। এই দেখে তারপর সব বাড়িতে তাই করুক। আর আমি সব কিছু লাটে তুলে মাসে মাসে লোকসানের কড়ি গুনি। না বাপু সেটি হচ্ছে না। ও ফ্যান এখানে লাগানো যাবে না।
বলতে বলতে মালিক পিছন ফিরে হাঁটা দিলেন।
সকালবেলা কাজে বেরনোর আগে এইসব কথা কাটাকাটি গোবিন্দর পছন্দ হল না। কী বলবে না বুঝতে পেরে একটু চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল।
পিছন থেকে অসীমা সব শুনছিল। মালিক পিছন ফিরতেই অসীমা গোবিন্দকে বলে,
--ঘরে এস আগে। ঠান্ডা মাথায় খেয়ে নাও। আসার আর সময় পায়নি।
তারপর স্বগতভাবে বলে, মানুষটা সারা দিনের জন্য বেরোচ্ছে, খাওয়াও হয়নি, নিজের কথাটাই বড় হল, কারোর সময় অসময় দেখার দরকার নেই। কেন রে বাবা ফেরার পর সন্ধেবেলায় আসতে কী হয়েছিল!
আর কোন কথা হল না। মেজাজটা একটু খিঁচড়ে গেল গোবিন্দর। শখ করে ফ্যানটা আনা বউয়ের জন্য, তার প্রথমেই এই ফ্যাকড়া কার ভাল লাগে।
কিছু না বলে গোবিন্দ ব্যাগটা নিয়ে বেরিয়ে গেল।
সন্ধেবেলা ঘরে ফিরে একটু জলখাবার খেয়ে ঠান্ডা হবার পর অসীমাই পাড়ল কথাটা।
--আমি বলি কী, এ বাড়িটা ছেড়ে দাও, চল অন্য কোথাও চলে যাই।
--কেন? কী হয়েছে? কেউ কিছু বলেছে নাকি? মালিক আবার এসেছিল নাকি? গোবিন্দ একরাশ প্রশ্ন ছূঁড়ে দেয়।
--না, কেউ কিছু বলেনি। ঐ সকালে মালিক অত কথা বলছিল, তাই বললাম।
--না, ঠিক করে বল তো, আমার দিব্যি। নিশ্চয়ই কেউ কিছু বলেছে।
--ঐ সামনের বাড়ির মাসীমা, সকালে মালিকের সঙ্গে কথা হচ্ছিল, তাই শুনেছে বোধ হয়, বলছিল।
--কি বলছিল?
--একটু ঠেস দিয়ে দিয়ে বলছিল, এখানে কারোর ঘরে তো ফ্যান নেই তাই। আমাদের ফ্যান এসেছে শুনে গা জ্বলছে আর কি!
--বলুকগে। কারোর খাইও না পরিও না। আমার ক্ষমতা আছে, আমার বউয়ের জন্য ফ্যান এনেছি। কার কী বলার আছে?
--আসলে ঐ যে তুমি একটু আমায় ভালবাস, তাতেই সব চোখ টাটায়।
--ও-সব ছাড়। কেন যাব এখান ছেড়ে? ওদের কথায়? মালিক বলেছে, তার সঙ্গে বোঝাপড়া আমার। লোকের তাতে কী?
--কি বলবে মালিককে?
--ঠিক আছে, একটা ফ্যানের জন্য যা লাগে বাড়তি দেব, শুধু গরমের জন্য কেন, সারা বছরের জন্য দেব। নিক না। ভারী বাড়িওলা হয়েছে। ব্যাটা কিপটের জাসুস।
--পুরো বছরের জন্য দেবে? সে তো অনেক টাকা! আমরা তো গরমের দু-তিন মাস চালাবো। বাকি মাসের জন্যেও বাড়তি টাকা গুনব?
--কি আর করা যাবে? আলাদা মিটার তো নেই? আলাদা মিটারওলা বাড়ি নিতে গেলে আরো অনেক বেশি ভাড়া। তার চেয়ে এই ব্যবস্থাই ভাল। আর তাছাড়া এখন শীতই বা পড়ে কই। মোটামুটি সব সময়ই গরম থাকে। আর টাকা যদি দিই সারা বছরই চালাবো। কম দরকার থাকলেও চালাবো।
মালিকের কিছুই বলার থাকবে না। আর অন্য সবাইয়ের কথায় থোড়াই কেয়ার করি। যার যা খুশি বলুক। কান না দিলেই হল। মা বলত, লোকে হিংসা করা ভাল, আহা যেন কেউ না বলে।
--দেখ, মালিক আবার কী বলে।
--যাই দেখি ব্যাটার সাথে কথা বলে আসি।
সারা বছরের জন্য কিছু বেশি দিয়ে, অর্থাৎ মোটের উপর ভাড়াটা কিছু বাড়িয়ে তবে রাজি করিয়ে এসেছে গোবিন্দ।
আসলে এই ঘর, এই জায়গাটা ছাড়তে ওর মন ঠিক সায় দিচ্ছিল না। এখান থেকে ষ্টেশনটা খুব কাছে, হাসপাতাল, বাজার সব খুব কাছে। একটা ছোট স্কুলও আছে, আজ না হোক, কাল তো দরকার হবে। ওর মনের ভেতরটায় আলোর ঝলক খেলে যায়। এই ফ্যানটা যে তার সেই অগ্রিম স্বপ্নের পদক্ষেপ সেটা কি অসীমা বুঝেছে? কে জানে।
যাক ফ্যান চলছে ভালই। এরপর দিন যায়, রাত কাটে নির্দিষ্ট আহ্নিক গতি আর বার্ষিক গতির নিয়মে।
ফ্যানের পরবর্তী স্বপ্নে গোবিন্দর সঙ্গে অসীমা সামিল হয়েছে খুব স্বাভাবিক নিয়মেই। তার ফল সারা পৃথিবীতে যা হয় গোবিন্দর ছোট্ট সংসারেই বা তার অন্যথা হবে কেন। তৃতীয় প্রাণের আবির্ভাব ঘরের আরো একটু জায়গা নিয়েছে। অসীমার কাজ বেড়েছে, ক্লান্তি বেড়েছে। সঙ্গে সঙ্গে গোবিন্দরও আয় বাড়ানোর চেষ্টায় পরিশ্রম বাড়াতে হয়েছে।
পুরনো ফ্যান, চলতে চলতে বিদ্রোহ করতে শুরু করেছে। শুরু হল ক্যাঁ ক্যাঁ দিয়ে, তার পর কোঁচ কোঁচ। এখন তো হাওয়া একেবারেই কমে গেছে। সাথে উপরি পাওনা হয়েছে ঘ্যানর ঘ্যানর আওয়াজ। ছেলেটা যে ঘুমোবে তা ঘুমোয় কী করে এই গরমে সারাদিন।
রোজ গোবিন্দকে বলছে অসীমা, ওটা সারাও, নাহলে ঘুমোনো যাচ্ছে না। বাচ্ছাটাকে নিয়ে নাজেহাল অবস্থা।
গোবিন্দও 'আজ সারাবো কাল সারাবো' করে গড়িমসি করছে, আসলে সারাতে দিলেই এখন একগাদা টাকা গচ্চা, সেটা তো অসীমাকে বলা যাচ্ছে না। তাহলে এখুনি শুনিয়ে দেবে অনেক কথা। বাচ্চাটা হতে এখন খরচা যে কতটা বেড়ে গেছে সেটা তো আগে ধারণাই ছিল না।
খরচা যেমন এক ধাক্কায় বাড়ে, সংসারে আয় যে অত সহজে বাড়ে না, এই সহজ সত্যটা কী করে বোঝানো যায়। তাই সবসময় মাথাটা কেমন ভার হয়ে থাকে।
গোবিন্দ দুচোখে বিরক্তি নিয়ে ফ্যানটার দিকে তাকায়। কী কুক্ষণে ফ্যানটা কিনে ঘরে ঢুকিয়েছিল। একবার ভাবে সারানো টারানো নয়, বরাবরের মত ফ্যানটাকে দূর করে দিয়ে আসবে। গঙ্গায় ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে আসবে একেবারে। এক দৃষ্টে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আবার মায়া হয়। ভাবে, থাক। ওই প্রাণহীন বস্তুটাও তো ওরই মত। শরীরে দেয় না। তাও দিন রাত ঘুরে যাচ্ছে। যতটুকু হাওয়া দিতে পারে দিচ্ছে। থাক গে, যেমন আছে।