• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৭০ | মার্চ ২০১৮ | গল্প
    Share
  • আবার আসিব ফিরে : দেবতোষ ভট্টাচার্য


    ।। ১ ।।

    প্যারিসগামী এয়ার ইন্ডিয়া বিমানের যাত্রীদের জন্য ঘোষণাটি শুনেই টলমল পায়ে উঠে দাঁড়াল সুজয়। বিমানে ওঠার এটিই শেষ আবেদন! কোনক্রমে সোফা ছেড়ে উঠে ধীর পায়ে এগিয়েও ধপ করে বসে পড়ল আবার। সেই অসহ্য ঘাড়ের যন্ত্রণাটা হঠাৎ শুরু হল কেন কে জানে। দ্রুত চারিদিক চোখ বুলিয়ে নিল একবার —নাহ, কেউই তাকে সেভাবে লক্ষ্য করছে না। এতদিনের অভিজ্ঞতা, তাই আর আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। বীভৎস যন্ত্রণায় ভেতরে ভেতরে কুঁকড়ে গেলেও মুখে তেমন কোন অভিব্যক্তি ফুটে ওঠে না। তাই বাইরের কারোর পক্ষেই জানা সম্ভব নয় তার এই ভয়ানক কষ্টের কথা। এবার শরীরের সমস্ত শক্তি একত্র করে পায়ে পায়ে বিমানের দরজার দিকে এগিয়ে গেল সুজয়।

    “ওর এই ঘাড়ের যন্ত্রণার কেসটা সত্যি ভারী অদ্ভুত —আমার তো কিছু মাথাতেই আসছে না। ” আবছা নীল আলোয় মোড়া চেম্বারে বসে রিপোর্টগুলো নাড়তে নাড়তে বিস্ময়ের সুরে কথাটা মাকে বলেছিলেন বিখ্যাত স্নায়ুরোগ বিশেষজ্ঞ ডাঃ নন্দী। সুজয় তখন মাধ্যমিক দেবে। সেই কোন ছোট্টবেলা থেকে ঘাড়ের এই অজস্র সুচ ফোটানোর মত যন্ত্রণা তার জীবনে একটা অভিশাপের মত হয়ে দাঁড়িয়েছিল। বাবা শহরের এক মাধ্যমিক স্কুলের অঙ্কের শিক্ষক —কতটুকুই বা আর্থিক সামর্থ্য ছিল তাঁর। তবে মা সরকারী হাসপাতালে নার্স হওয়ার সুবাদে ডাক্তার বদ্যি করা অপেক্ষাকৃত সহজ হয়েছিল। কত যে পরীক্ষা হল তার এই শরীরের ওপর —কিন্তু কিছুই ধরা পড়েনি কোনদিন। শেষমেশ ডাঃ নন্দী তাদের এক মনোবিদের সঙ্গে যোগাযোগ করার পরামর্শ দেন। কিন্তু এবার বেঁকে বসলেন স্বয়ং মা। দিব্যি চলে ফিরে বেড়াচ্ছে ছেলে, কথাবার্তা একদম স্বাভাবিক, পড়াশুনোয় যাকে বলে তুখোড় —ক্বচিৎ কদাচিৎ এই ব্যথাটার জন্য ওকে আর এভাবে টানাহ্যাঁচড়া করার কোন দরকার নেই।

    মায়েরা স্নেহে অন্ধ হলেও এটা ভুল নয় একেবারেই —শুরু থেকেই পড়াশুনোয় নিয়মিত বৃত্তি পেয়ে এসেছে সুজয়। ডাক্তারিও পড়েছে প্রায় বিনা পয়সায়। ধপধপে ফর্সা, হালকা লালচে চুল, খাড়া নাক, লম্বা চওড়া অপূর্ব চেহারার অধিকারী সে —তাই দেখে ডাকনাম সাহেব দিয়েছিলেন দাদু। এই অল্পদিনের মধ্যেই কলকাতায় হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ হিসেবে বেশ ভালোই নামডাক হয়েছে সুজয়ের। আর আজ, প্যারিসের বিখ্যাত মেরী ক্যুরী ইউনিভার্সিটিতে এক বছরের জন্য অত্যাধুনিক হার্ট অস্ত্রোপচার কোর্সে সে মনোনীত হয়েছে। প্রথমবার বিদেশযাত্রার টেনশন তো ছিলই, তার সাথে হঠাৎই শুরু হয়েছে এই ঘাড়ের ব্যথা। বিমানে উঠে নির্দিষ্ট সীটে বসেই শরীরটা এলিয়ে দিলেন ডাঃ সুজয় বোস —চোখ খুলে চাইবারও যেন আর কোন শক্তি অবশিষ্ট ছিল না।

    ।। ২ ।।

    এক চোখ বন্ধ করে ধনুকটার জ্যা মুক্ত করতেই কানের পাশ দিয়ে যেন শিস দিয়ে উড়ে গেল তীরখানা। বেশ রাত্তির হয়েছে, দুর্গের মশালগুলো এক এক করে নিভতে শুরু করেছে। সাবধানে চারিদিক একবার চোখ বুলিয়ে নেয় গ্যাব্রিয়েলা। এই গোটা ফ্রান্সে মহিলা কেন, কোন পুরুষও তীরন্দাজীতে তার সঙ্গে পাল্লা নিতে পারবে না। দাঁপিয়েরের প্ল্যান মোতাবেক এখনো পর্যন্ত সব কিছু বেশ নিখুঁত ভাবেই চলেছে। তবু সাবধানের মার নেই। চতুর্দিকে রাজার গুপ্তচর, সারাক্ষণ নজর রাখছে তারা বাস্তিলের আনাচে কানাচে। প্রথম দিকে বেশ ভয় ভয়ই করত তার। দাঁপিয়ের কিন্তু একেবারেই জোর করেনি —বরং বার বার বিপদের ভয়ই দেখিয়েছে তাকে। কিন্তু দেশের জন্য এই লড়াইতে ভয় পেয়ে পিছু হঠার পাত্রী সে নয়। তার অসম্ভব সাহস ও তীক্ষ্ণ বুদ্ধির ওপর দলের সবার অগাধ ভরসা।

    প্রথম বাধাটা অবশ্য অতি সহজেই পার হয়ে গেছিল গ্যাব্রিয়েলা। ছলছল চোখে রানী মেরীকে শুনিয়েছিল তার দুঃখের কাহিনী। বাবার মৃত্যু হয় সেই ছোটবেলায়, মায়ের কাছেই সে মানুষ। কিন্তু গতকাল মায়ের অকস্মাৎ বিদায় তাকে আজ একেবারে রাস্তায় এনে দাঁড় করিয়েছে। এত লোকে মহান রানীর কৃপায় ধন্য হয়েছে, আর সে পাবেনা তাঁর কৃপাদৃষ্টি? পুরো অভিনয়টা বহুবার দাঁপিয়েরের সামনে অভ্যাস করেছে, তাই সেদিন বেশ বিশ্বাসযোগ্য ভাবেই বলতে পেরেছে রানীকে। শয়তান রানী মেরী এ্যান্তোনেতের চোখও ক্ষণিকের জন্য চিকচিক করে উঠেছিল যেন।

    কিছুদিনের মধ্যেই গ্যাব্রিয়েলা রানীর একদম ডানহাত হয়ে ওঠে। তার ক্ষুরধার বুদ্ধি, অসিচালনায় পারঙ্গমতা, রাজনৈতিক কূটবুদ্ধি ও ফ্রান্সের বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে পুঙ্খানুপুঙ্খ ধারণা রানীর বিস্ময়ের সৃষ্টি করেছিল। বেশ কয়েকবার মেরীর সঙ্গে একান্তে রাজা লুইকে দেখে ছুরিটা বসিয়ে দেবার জন্য তার হাত নিশপিশ করেছে। কিন্তু পইপই করে সাবধান করে দিয়েছে দাঁপিয়ের। রাজা লুই মারা গেলেও তাঁর অনুচর ও বিশ্বস্ত সেনা আবার সিংহাসনে বসাবে তাঁদের বংশধরকে। এই অত্যাচারের শেষ হবেনা। ফরাসীবাসী বাস্তিলের দখল চায়, রাজার শাসনের শেষ দেখতে চায়। গ্যাব্রিয়েলা বরং বাস্তিলের ভেতরের সব খবর দেবার ব্যবস্থা করুক। কোথায় কত সৈন্য আছে, কত কামান আর বন্দুক রয়েছে ভাঁড়ারে, গোপন কক্ষগুলো ও তার বিশদ ম্যাপ, কুখ্যাত জেলের কি অবস্থা —এসব তথ্য চাই।

    পুরনো নানা কথা যেন চোখের সামনে ভেসে ওঠে গ্যাব্রিয়েলার। সে চিরকালই খুব ডানপিটে প্রকৃতির। ছোটবেলায় তো একবার ক্ষেপে গিয়ে দাঁপিয়েরের মাথাই ফাটিয়ে দিয়েছিল। দাঁপিয়ের অবশ্য একেবারে তার বিপরীত —ধীরস্থির কিন্তু বুদ্ধিমান। তাদের সম্পর্কটা ঠিক কিভাবে গড়ে ওঠে বলা মুশকিল। না না, ওসব প্রেম নিবেদন দাঁপিয়েরের কম্মো না। সেই একপ্রকার তার গলায় ঝুলে পড়েছিল। তবে ওদিক থেকেও যে পুরো প্রশ্রয় ছিল তা বলাই বাহুল্য। হেসে ফেলে গ্যাব্রিয়েলা। ছোটখাটো ব্যাপার নিয়েই সে চূড়ান্ত অশান্তি শুরু করে দিত তার সাথে। অথচ তিনি? ভ্রুক্ষেপও নেই কিছুতে — হয় লিখছেন, নয়ত কি লিখবেন ভাবছেন। তার শত অত্যাচারেও কোন তাপ-উত্তাপ দেখা যেত না। তবে গ্যাব্রিয়েলাকে জব্দ করার এক মোক্ষম ওষুধ জানা ছিল দাঁপিয়েরের। সমস্ত কিছু সে ভুলে যেত যখন দাঁপিয়ের ভায়োলিনটা হাতে তুলে নিত। সুরের যেন প্রাণপ্রতিষ্ঠা হত সে হাতে —এমনিই জাদুকর ছিল দাঁপিয়ের। কত নতুন নতুন সুরের যে সৃষ্টি হত! আর সে? মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনত —কখনো খিলখিলিয়ে হেসে উঠত, কখনো যন্ত্রণায় কাঁদত, আর কখনো বা সেই সুরের মূর্ছনায় বিভোর হয়ে কিছু করতেই ভুলে যেত।

    এহেন দাঁপিয়ের যখন এই গুপ্ত দলটি তৈরি করল, সে তো হতবাক। এও কি সম্ভব! তবে এটাও সত্যি — রাজা লুইয়ের অপশাসনে ফরাসীবাসীর সে বড়ই দুর্দিন। তাদের আত্মগরিমা আজ বিলুপ্তপ্রায়। দেনার দায়ে জাতি ডুবছে —চতুর্দিকে খাদ্যের জন্য হাহাকার। অথচ ওদিকে রাজপরিবারের অত্যাচার আর বিলাসবহুল জীবনযাপন। ধীরে ধীরে তাদের দল বড় হয়। একদিন বাস্তিল দখলের প্ল্যান ছকে তারা। দাঁপিয়ের সবার কর্তব্য নিখুঁতভাবে বুঝিয়ে দিয়েছে —সে নিয়েছে গুপ্তচরের বিপজ্জনক দায়িত্ব। হঠাৎই চোখ জ্বালা করে ওঠে গ্যাব্রিয়েলার। হায় দাঁপিয়ের, কবে যে আবার দেখা হবে কে জানে!

    মুহূর্তেই অবশ্য সামলে নেয় নিজেকে — এখন মানসিক ভাবে দুর্বল হয়ে পড়লে সমূহ বিপদ। এতদিন ধরে যা খবর সংগ্রহ করেছে সবই তীরের ডগায় বেঁধে দাঁপিয়েরকে পাঠিয়ে দিয়েছে। ওদিকের খবর তার কাছে এনে দিত দুর্গের এক রাঁধুনি। কিন্তু কদিন ধরে সে আসছে না কেন কে জানে! পরশু খবর নিতে গিয়ে শোনে সে নাকি ভীষণ অসুস্থ। কোন বিপদ হল কি? এইসব অতি গোপনীয় তথ্য অন্য কারো হাতে চলে যাচ্ছে না তো! নীচের ঠোঁটটা অজান্তেই কামড়ে ধরে গ্যাব্রিয়েলা।

    ।। ৩ ।।

    আজ সকালে ঘুম থেকে উঠতে বেশ বেলা হয়ে গেল। মাথাটা বড্ড যেন ভার ভার লাগছে। কিছুটা ধাতস্থ হতেই বুঝতে পারে তার হাতদুটো শক্ত করে পেছনে বাঁধা। কেঁপে উঠল গ্যাব্রিয়েলা —রাত্রে কি খাবারে কিছু মেশানো হয়েছিল? ইস্, ধরা পড়ে গেছে। ঐ রাঁধুনির খোঁজ করতে যাওয়াটা তার খুব ভুল হয়েছে। এসব কাজে একটা ভুল মানেই সব শেষ —দ্বিতীয় সুযোগ কেউ দেবে না। কিন্তু দাঁপিয়ের? তাদের দল? ওদিকে সব কিছু ঠিক আছে তো? ভয়ানক চিন্তায় পড়ে যায় সে। হঠাৎ দড়াম করে দরজা খোলার আওয়াজে চমকে উঠল যেন। রানী মেরী এগিয়ে এসে প্রথমেই কষিয়ে এক চড় লাগালেন। দাঁত চেপে তাকে রাষ্ট্রদ্রোহী বলে বাস্তিলের কারাগারে নিয়ে যাওয়ার আদেশ করলেন। তাঁর ক্রূর চোখদুটোর দিকে জ্বলন্ত দৃষ্টিতে চেয়ে ছিল গ্যাব্রিয়েলা। ধীরে ধীরে এক তীব্র হতাশার বেদনা গ্রাস করল তাকে।

    আন্দাজ সে ঠিকই করেছিল। ঐ রাঁধুনিই কিছু মুদ্রার লোভে এই সর্বনাশটি করেছে। আজ থেকে তার পরিচয় — কয়েদী নম্বর ৮০। কিন্তু আজ হঠাৎ কার গলা শুনতে পেল সে? হে ভগবান! মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল তার। গলার আওয়াজে পরিষ্কার বুঝতে পারে দাঁপিয়ের আছে পাশের সেলে। ভাগ্যের কি নিষ্ঠুর পরিহাস!

    কিছুদিনের মধ্যেই বিচার শুরু হল। সব জানাই ছিল, বিচারের নামে যা হল তা একটা প্রহসন। আগামী পূর্ণিমার রাতে গিলোটিনে হত্যা করা হবে তাদের —জানিয়ে দিলেন ফ্রান্সের সর্বেসর্বা রাজা লুই। রাতের খাবারটা ফিরিয়েই দিল ক্লান্ত অবসন্ন গ্যাব্রিয়েলা।

    ।। ৪ ।।

    ঘুম ভাঙতেই সামনের আয়নাটায় চোখ পড়ে গেল সোফিয়ার। জানলা দিয়ে সোনা রঙের রোদ এসে পড়েছে ঘরে। চোখদুটো বড় বড় করে খানিকক্ষণ অলস ভঙ্গিতে চেয়ে রইল সেদিকে। লোকে বলে তার চোখের দিকে তাকালে নাকি কথা হারিয়ে যায় —এমনি অতল গভীর সে দৃষ্টি। পায়ে পায়ে জানলার ধারে এসে দাঁড়ায় সোফিয়া। ধুর! চতুর্দিকে শুধু বাড়ি আর বাড়ি। আজ রবিবার বলে প্যারিসের রাস্তায় এখনো তেমন লোকজন নেই!

    আনমনে কাঁচের জানলায় দাগ কাটতে থাকে সোফিয়া। মনে পড়ে তার নিজের গ্রাম ফ্লেগিনির কথা। ছোট ছোট টিলার মত পাহাড়গুলো যেন হাতছানি দিয়ে ডাকত তাকে। পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে বাড়িগুলোর চিমনি দিয়ে ধিকিধিকি বেরোত সাদা ধোঁয়ার কুণ্ডলী —তারই আড়ালে সে লুকোচুরি খেলত বন্ধুদের সাথে। মা কপট রাগ দেখিয়ে বলত —তুই আর বড় হলি না!

    কি লাভ বড় হয়ে? ভাবতে থাকে সোফিয়া। ছোটবেলা থেকেই ইউরোপ ও লাতিন আমেরিকার প্রাচীন ইতিহাস, বিজ্ঞান এবং স্থাপত্যকীর্তি তাকে ভীষণভাবে আকর্ষণ করত। তাই সে শেষমেশ আর্কিওলজি নিয়ে পড়তে চলে আসে প্যারিসে। অবশ্য তাদের গ্রামটা এখান থেকে খুব দূরে নয় —মা, বাবা, দাদুরা প্রায়ই চলে আসে। আড়চোখে টেবিলের ওপর নোটটা একবার দেখে নিল সোফিয়া — সকাল ১০টায় ক্যাফে অলিভিয়ায় কফি খাওয়ার নেমন্তন্ন। স্টিভ আজকাল একটু বেশিই নজর দিচ্ছে তার ওপর! ঠোঁটের কোণে একটা অদ্ভুত হাসি এসে পরক্ষণেই মিলিয়ে গেল।

    ।। ৫ ।।

    কদিন হল ব্যথাটা আর হয়নি সুজয়ের। এখানে ইউনিভার্সিটিতে চাপটা বেশ ভালই বলতে হবে। তবে নতুন নতুন জিনিস শিখতে পাওয়ার আনন্দও তো কিছু কম নয়। গত কয়েকদিন পরিশ্রমটা একটু বেশিই হয়ে গেছে। আসলে হার্টের ধমনীগুলো খুব সূক্ষ্মভাবে পরিষ্কার করার নতুন এক পদ্ধতি নিয়ে প্রেজেন্টেশন বানাতে হয়েছে তাদের। ভালই হয়েছে তারটা —প্রোফেসর ম্যাথিয়াস তো খুব প্রশংসাই করলেন আজ। কে জানে এই ধকলেই কিনা, সকাল থেকেই কেমন জ্বর জ্বর লাগছে। ক্লান্ত পায়ে বাইরে এসে দাঁড়াল সুজয়। বেশ রাত হয়েছে —বাইরে পূর্ণিমার আলোয় সব কেমন যেন মায়াবী মনে হয়। এত রাতে ট্যাক্সি পাওয়ার আশা কম। সে অবশ্যি গাঁয়ের ছেলে, দিব্যি হেঁটেই চলে যেতে পারবে।

    খানিকটা চলার পর বুঝতে পারে ভুল করেছে। জ্বরের জন্যই হোক বা এতদিনের ক্লান্তি, তার শরীর আর দিচ্ছে না। পা যেন কিছুতেই ঠিকঠাক পড়ছে না। ঘড়ির দিকে তাকাল সুজয় —রাত দুটো। রাস্তার ওপরেই ফরাসী বিপ্লবের স্মৃতিতে বানানো জুলাই স্তম্ভ —শুনেছে এখানেই নাকি ছিল সেই বিখ্যাত বা কুখ্যাত বাস্তিল দূর্গ। আজ তার কোন চিহ্নমাত্রও নেই। কিন্তু এই রাতেও এখানে হঠাৎ এত লোক কেন?

    চোখ ছোট হয়ে আসে সুজয়ের। সামনে ছায়া ছায়া মত কিছু জিনিস যে নড়ছে তা বেশ বুঝতে পারছে। হাওয়ায় একটা শিরশিরানি ভাব আছে। পরিষ্কার করে কিছু বোঝা না গেলেও অনেক লোকের ব্যস্তসমস্ত উপস্থিতি টের পাওয়া যাচ্ছে। কোন গণ্যমান্য কারো আসার কথা আছে নাকি? এত রাতে! নাকি কোন অনুষ্ঠানের রিহার্সাল এটা। উফ, জ্বরটা ভালোই বেড়েছে। কিন্তু পা যে আর চলছে না — কেউ যেন তাকে বন্দী করে এনেছে কিছু দেখাবে বলে। রাস্তাতেই কাতর হয়ে বসে পড়ে সুজয়। আরে, কি অদ্ভুত ঢোলা ঢোলা পোশাক ওদের! ওরা কি ভাষায় কথা বলছে? ফারসি? কিন্তু ও তাহলে সব বুঝতে পারছে কি করে! মৃত্যু, বিপ্লব, অত্যাচার, হত্যা —এসব কি নিয়ে ফিসফিস করছে যেন তারা। কাউকে ডেকে কি জিজ্ঞেস করবে? হঠাৎই সবাই কেমন সন্ত্রস্ত হয়ে উঠল! কারা যেন ধরে নিয়ে আসছে দুজনকে। ভাল করে দেখার চেষ্টা করে সুজয়। একটি ছেলে ও একটি মেয়ে, বিষণ্ণ মুখ —গায়ে ধপধপে সাদা পোশাক! একের পর এক দৃশ্য অভিনীত হতে থাকে চোখের সামনে। নিজের অস্তিত্বই যেন ভুলে যায় সে একসময়। ভয়াবহ দৃশ্যটি দেখে আর্তনাদ করে ওঠে। গলা দিয়ে কিছুতেই আওয়াজ বেরোয় না তার। জ্ঞান হারায় সুজয়।

    ।। ৬ ।।

    কাল রাত্রেই জেলার এসে মৃত্যু পরোয়ানা শুনিয়ে দিয়ে গেছে। আগামীকাল পূর্ণিমায় রাত্রি দুটোয় গিলোটিনে খুন করা হবে তাদের। হ্যাঁ, খুনই তো! কই ফ্রান্স অধিপতির এত অত্যাচারের তো কোন বিচার হল না! তাঁর কোন অধিকারই নেই অন্যের অপরাধের বিচার করা। ঠাণ্ডামাথায় বিরোধীদের হত্যা করে সরিয়ে দেওয়ার প্ল্যান। কিন্তু তার প্রিয় দেশবাসী! তারা কি তাদের মনে রাখবে? তাদের ছেলেমেয়েদের কি শোনাবে এই আত্মবলিদানের গল্প? নিজের ভালবাসার আগে দেশকে ভালবাসতে শেখাবে তারা? ভুরু কোঁচকায় গ্যাব্রিয়েলা —ব্যাপারটা একটু স্বার্থপরের মত শোনাচ্ছে না! এত কিছু ভেবে তো সে আর দাঁপিয়ের এই কাজে ঝাঁপায়নি!

    আহ দাঁপিয়ের, কোথায় তুমি! মৃত্যু যে শিয়রে, তার আগে কি আর দেখা হবে না তোমার সাথে? জেলারকে মৃত্যুর আগে শেষ ইচ্ছেটা জানিয়েই ফেলে গ্যাব্রিয়েলা —গিলোটিনে মাথা দেবে তারা একসাথে। জানতে পারে তার আবেদন রানী মঞ্জুর করেছেন। বাঁকা হাসি খেলে যায় —পিশাচিনী, তোরও এত দয়ামায়া!

    জেলের কুঠরির মধ্যে দিন রাতের কোন হিসেব নেই। ধপধপে সাদা কাপড়টা পেতেই গ্যাব্রিয়েলা বুঝল সময় উপস্থিত। পোশাকটা পরতে পরতে কি একটু জল এল চোখে? কাঁদবে না সে! দাঁপিয়েরের কাছে কিছুতেই ছোট হতে পারবে না! কে জানে তাকে কেমন লাগছে দেখতে এখন! ইশারায় রক্ষীরা এগোতে বলে তাকে। আরে, ঐ তো দাঁপিয়ের —কেমন টেনে টেনে হাঁটছে। ক্লান্ত শ্রান্ত দাঁপিয়ের বিষণ্ণ হাসল তাকে দেখে। দেশবাসী তাদের কাঁধে যে মহান দায়িত্ব সঁপেছিল তাতে তারা সম্পূর্ণ ব্যর্থ!

    গিলোটিনে মাথা দিয়ে পরস্পরের হাত ধরে থাকে দুজনে। বাস্তিলের চুড়োর ঘড়িতে ঢং ঢং করে যেন মৃত্যুঘণ্টা বেজে উঠল। বিদ্যুৎবেগে নেমে আসছে দুদুটো গিলোটিনের রক্তপিপাসু ধারাল ব্লেড। প্রাণপণে দাঁপিয়েরের আঙুলগুলো নিজের মুঠোয় চেপে ধরে গ্যাব্রিয়েলা। যন্ত্রণাময় মৃত্যু, কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে অনুভব করে দাঁপিয়েরের বলিষ্ঠ হাতের স্পর্শ। যেন তাকে অভয় দিয়ে যাচ্ছে, যেমন করে এসেছে চিরটাকাল।

    মৃত্যুর পরও তাদের হাত আলাদা করা যায়নি —শক্ত হয়ে অদ্ভুতভাবে আটকে গেছিল দুজনের দশটা আঙুল। কেটে আলাদা করার প্রস্তাবে রানী মেরীর সায় ছিল না। শেষমেশ একসাথেই পাশাপাশি কবর দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তারা পাড়ি দিল চিরঘুমের দেশে, একসাথে, হাত ধরাধরি করে।

    ।। ৭ ।।

    ধূম জ্বর এসেছিল সুজয়ের, দিন তিনেক প্রায় অজ্ঞানই হয়ে পড়েছিল। সেদিনের ঐ ভয়ানক স্বপ্নটা চোখের সামনে থেকে যেন যাচ্ছিলই না। হ্যাঁ স্বপ্নই তো! তাছাড়া আর কিই বা হতে পারে? কিন্তু যেটা অদ্ভুত, সব সময়ই মনে হচ্ছিল সে ঐ ছেলে এবং মেয়েটিকে চেনে। ভীষণভাবে চেনে। আসলে নিজে চিরকালই খুব ভাবুক প্রকৃতির, তাই হয়ত তার এরকম মনে হচ্ছে।

    ডক্টর ম্যাথিয়াস খুব বকাবকি করেছিলেন তাকে। ঐ অসুস্থ শরীরে রাত্রে একা বেরোন তার একদমই উচিত হয়নি। পুলিশই সুজয়কে উদ্ধার করে নিয়ে আসে রাস্তার মাঝখান থেকে —আইডেন্টিটি কার্ড দেখে দিয়ে যায় ইউনিভার্সিটিতে। কয়েকদিন ভুগে শরীরটা খুব দুর্বল হয়ে গেছে। কালই মেসে ফিরে এসেছে সে। আজ সকালে একটু বেরোতে ইচ্ছা করল সুজয়ের। কাছেই ক্যাফে অলিভিয়া, এদের কফির বেশ সুনাম আছে। গরম গরম কফি খেলে শরীরটা হয়ত চাঙ্গা লাগবে।

    ।। ৮ ।।

    ব্যাপারটা বেশ খানিকক্ষণ ধরেই লক্ষ্য করছিল সোফিয়া। স্টিভ যথারীতি লেট, এখনো নিশ্চয়ই তিনি ঘুম থেকেই ওঠেননি। বিরক্ত হয়ে এক কাপ কফি আর দুটুকরো ক্রঁয়সা নিয়ে বসেছিল টেবিলে। খবরের কাগজে চোখ বোলাতে বোলাতেই তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় তাকে সতর্ক করে তোলে। এদিক ওদিক তাকাতেই দেখতে পায় ছেলেটিকে —এশিয়ান, হয়ত ভারতীয়ই হবে। ভারী সুন্দর দেখতে —ফর্সা, ভাসা ভাসা দুটি চোখ। চুলগুলো অদ্ভুতরকম লালচে। ছেলেটি একদৃষ্টিতে তাকে দেখছে —কিন্তু চোখদুটিতে যেন ভয়, বিস্ময়, আতঙ্ক ও আরো নানা অভিব্যক্তি মিলেমিশে একাকার। ভারী অদ্ভুত ব্যাপারটা তো!

    স্টিভ এসেই বার কয়েক স্যরি স্যরি বলল। খেতে খেতে একরকম মজা করেই ছেলেটির কথা বলে বসল তাকে সোফিয়া। ঘাড় ঘুরিয়ে স্টিভ দেখে সে এখনো সোফিয়ার দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। রাগে মুখটা লাল হয়ে গেল তার —সোফিয়াই কোনক্রমে নিরস্ত করে। হঠাৎই যেন ব্যস্ত হয়ে উঠে পড়ল ছেলেটি। একইভাবে তাকাতে তাকাতে তাদের টেবিলের পাশ দিয়েই চলে যাচ্ছিল, এই সময়ই স্টিভ এক জঘন্য কাজ করে বসল। টেবিলের তলা দিয়ে বাঁপা-টা হঠাৎ বাড়িয়ে দিতেই অন্যমনস্ক ছেলেটি সজোরে ছিটকে পড়ল। স্টিভের দিকে একবার জ্বলন্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ছুটে গেল সেদিকে সোফিয়া। আস্তে করে হাত ধরে তোলে তাকে, বোঝাই যায় বেশ লেগেছে হাঁটু দুটোতে। ছেলেটি নির্বাক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ —তারপর দুবার মাথা নেড়ে হাঁটতে হাঁটতে মিলিয়ে গেল ফুটপাত ধরে। বিদ্যুৎপৃষ্টের মত দাঁড়িয়ে রইল সোফিয়া —সম্বিৎ ফিরল স্টিভের স্পর্শে। সারা রাস্তা তার সঙ্গে কোন কথাই বলল না সে। স্টিভ অবশ্য কথা দিয়েছে, ছেলেটিকে খুঁজে বার করে ক্ষমা চেয়ে নেবেখন।

    ঘরে ফিরেই বিছানায় শরীরটাকে ছুঁড়ে দিল সোফিয়া। সে ভাবতে লাগল অন্য কথা। খুব ছোটবেলা থেকেই তার খিঁচুনির রোগ, এখন ব্যাপারটা অবশ্য বেশ কমে গেছে। হঠাৎ হঠাৎ কি যে হয় —পাগলের মত হাত বাড়িয়ে খুঁজতে থাকে কাউকে। গোঙাতে গোঙাতে কতবার যে বাবা মার হাতে নখের আঁচড়ে রক্ত বার করে দিয়েছে সে। শরীরের এক প্রচণ্ড অস্বস্তি, কিছু না পাওয়ার অসহায়তা তাকে যেন কুরে কুরে খেত। কিন্তু আজ? ছেলেটিকে হাত ধরে তোলার সময় সারা শরীরে যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল। সে রীতিমত কাঁপছিল। খালি মনে হচ্ছিল এ যেন এক পরম শান্তির স্পর্শ! তাহলে কি এতদিন বুঝতেই পারেনি, অবচেতন মনে কি হাতড়াত সে পাগলের মত!

    একটু ধাতস্থ হয়েই মন স্থির করে ফেলে। ছেলেটিকে খুঁজে বার করতেই হবে। শত হলেও সে তাদের দেশের অতিথি —আজকের এই জঘন্য ব্যাপারটার জন্য ক্ষমা চেয়ে নিতেই হবে তাকে।

    পরের রবিবার ঐ ক্যাফেতেই দেখা পেয়ে গেল। সেও যেন অপেক্ষা করছিল কারও জন্য। তার জন্যই কি? নিজেই গিয়ে আলাপ করল —ঠিকই ধরেছিল সোফিয়া। ছেলেটি ভারতীয়, নাম সুজয় —ডাক্তারির ছাত্র। কিছুদিন এক ইংলিশ ডেইলিতে কাজ করার সুবাদে ভাষাটার ওপর ভালই দখল ছিল সোফিয়ার, তাই কথাবার্তা চালাতে অসুবিধা হল না। কথা বলতে বলতে সুজয় মাঝে মাঝেই যেন খেই হারিয়ে ফেলছিল। বেশ লাজুক মিষ্টি স্বভাব বলে মনে হল ছেলেটির। কি মনে করে সুজয়কে সামনের সপ্তাহে তার জন্মদিনে আমন্ত্রণ জানিয়ে ফেলে। গ্রামের বাড়িতেই পার্টি, গাড়ী পাঠিয়ে দেবে সে। রাত্রে ঐ পাহাড়ে তাদের বাড়ি খুঁজে পাওয়া এই বিদেশীর পক্ষে অসম্ভব। সুজয়ের অবশ্য একটা অপারেশন আছে, তাও চেষ্টা করবে বলল। সোফিয়া জানে, সে আসবে — আসবেই!

    ।। ৯ ।।

    ঠিক রাত্রি বারোটায় সোফিয়ার বাড়িআলোয় আলোকময় হয়ে উঠল। মৃদু সুরেলা সুরে জন্মদিনের গান ভেসে আসতে লাগল উত্তুরে হাওয়ায়। বন্ধুরা সবাই প্রায় এসেছে, স্টিভ তো বটেই। হাসি হুল্লোড় আর খাওয়া দাওয়ায় মেতে উঠল অতিথিরা। হঠাৎই সবাইকে প্রায় চমকে দিয়ে বেজে উঠল ঘরের অন্ধকার কোণে রাখা ধুলোমাখা ভায়োলিনটা। কালো চাদরে মোড়া একজন তা হাতে নিয়ে যেন আদর করছে, তাতে ধীরে ধীরে প্রাণসঞ্চার করছে। সে মহান জাদুকরের স্পর্শে মুহূর্তেই সৃষ্টি হল এক অপূর্ব সুরের, আর তা খুব মোলায়েম ভাবে ছড়িয়ে পড়তে লাগল বিশাল হলঘরে। ধীরে ধীরে তাল দ্রুত হয়। সোফিয়া আর স্টিভ সেই তালে খুশিতে নাচছিল। বার বার দেখার চেষ্টা করলেও সোফিয়া ঠিক বুঝতে পারেনা ঐ চাদরে মোড়া বাজিয়েটি কে! রাত বাড়তে থাকে —পূর্ণিমার থালার মত চাঁদটা যেন দূর থেকে ঘটনার ওপর তীক্ষ্ণ নজর রাখছিল। তালের পরিবর্তন হতে থাকে —মনের না বলা কথাগুলো যেন সুরের মাধ্যমে পরিচিতি পেয়ে চলে। অস্থির হয়ে ওঠে সোফিয়া। একটা চেনা অস্বস্তি আস্তে আস্তে তাকে জড়িয়ে ধরতে থাকে। কোন এক সুদূর অতীতের ডাক শুনতে পায় কানে। মনে হয় এ বাস্তব নয়, এক অদ্ভুত স্বপ্ন —চোখের সামনে সাদা কালোয় নানা অচেনা মুখের আনাগোনা শুরু হয়।

    ঘড়িতে দুটো বাজল, মোড়ের মাথার প্রিন্সটন গির্জায় ঢং ঢং করে শব্দ হল দুবার। ভায়োলিনের সুর কখন যেন হাহাকার করে ওঠে। পাগলের মত মাথা ঠুকে চলে সে এদেয়ালে ওদেয়ালে। কি এত কষ্ট তার? এক অব্যক্ত যন্ত্রণায় যেন মুচড়ে কেঁদে ওঠে রাতের আকাশ বাতাস। কান চেপে ধরে পাগলের মত চীৎকার করে ওঠে এবার সোফিয়া। বুঝতে পারে তার খিঁচুনি আসছে —থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে জ্ঞান হারায়।

    চোখ খুলে প্রথমেই ভায়োলিন-বাদকের খোঁজ করে সোফিয়া। কেউ খুঁজে পায়না তাকে। খালি পায়েই দ্রুত বেরিয়ে পড়ে রাস্তায়। দূরে একটা গাড়ীর আলো দেখতে পায়। এই পাহাড়ের বাঁকগুলো হাতের তালুর মত চেনা, গাড়ীটাকে সহজেই ধরে ফেলতে পারবে। ছুট লাগায় সোফিয়া, পা কেটে কখন যেন রক্ত ঝরতে শুরু করে। পিছনে উদ্বিগ্ন মায়ের গলা এখনো শোনা যায়। উন্মত্তের মত ছুটতে ছুটতে শেষে গাড়ীর একেবারে সামনেই দাঁড়িয়ে পড়ে। প্রচণ্ড জোরে ব্রেকের শব্দ, প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই গাড়ী থেকে ছুটে বেরিয়ে আসে একজন। গায়ে আর তার কালো চাদর নেই। সোফিয়া চেনে তাকে! সুজয়!

    — এক্ষুনি একটা মারাত্মক দুর্ঘটনা ঘটতে চলেছিল! একি পাগলামি! আতঙ্কে চেঁচিয়ে ওঠে সুজয়।

    — বল কে তুমি? একদম সত্যি কথা বলবে!

    অদ্ভুত নেশাগ্রস্তের মত বলে উঠল সোফিয়া! দুহাতে সুজয়ের মুখটা চাঁদের আলোয় ধরে যেন আবার চেনার চেষ্টা করে। তারপর বলে ওঠে

    — মনে হয় আমি তোমায় চিনি। নাহ, চি....ন....তা....ম!

    নড়ে না একদম সুজয়। তার ডাক্তারিবুদ্ধি বুঝতে পারে সোফিয়ার মনে অসম্ভব চাপ পড়ছে! বিপদের গন্ধ পায় সে।

    — এখন এই মুহূর্তে সেসব কথা থাক, বাড়ি চল!

    — নাআআআ! এখনই জানতে চাই আমি। তুমি আমার মানসিক অবস্থা বুঝতে পারছ না।

    — পারছি — আমিও একি অবস্থার মধ্যে দিয়ে গেছি যে একসময়! আলতো করে সোফিয়ার হাতটা ধরে সুজয়।

    — তাহলে বল, বলতেই হবে তোমায়! কেন মনে হল এই মায়াবী ভায়োলিনের সুর আমার শোনা! কিন্তু কবে যে শুনেছি!

    — তোমায় সত্যি বলছি, এ আমি বাজাইনি! তবে যে বাজিয়েছে তাকে তুমি চেনো! এখন তোমায় এসব বোঝাতে পারব না আমি। প্লীজ এবার বাড়ি চল।

    — না! না! শুনতে শুনতে কেন মনে হল, এ আমি বোধহয় আমি নয়, অন্যকেউ! কেন এই সুরের জাদু ডেকে নিয়ে এল তাদের - অজানা অচেনা সব মুখ ভেসে এল আমার চোখের সামনে! এত ভয় যে আমি জীবনে কোনদিনও পাইনি সুজয়....

    আর্তনাদ করে সুজয়কে জড়িয়ে ধরে সোফিয়া। তারপর কাঁপতে কাঁপতে শিশিরে ভেজা ঘাসের ওপরই বসে পড়ে। তার কাতর চোখে যেন হাজারো প্রশ্ন —সে কোন যুগে রয়েছে তাই যে ঠাহর করতে পারছে না। সুজয় বুঝতে পারে এখুনি ঘুমের ওষুধ দেওয়া ভীষণ দরকার। তার হাত দুটো ধরে থাকে বেশ কিছুক্ষণ, তারপর মোলায়েম সুরে বলে —কথা দিচ্ছি, সব কথা বলব তোমায়। বলতে যে আমায় হবেই! কিন্তু এখন বাড়ি চল প্লীজ। তুমি ঠিক সুস্থ নও।

    তার হাতের ছোঁয়ায় শান্ত হয় এবার সোফিয়া — যন্ত্রের মত উঠে গাড়ীতে বসে। গাড়ী মুখ ঘোরায়। কালো চাদরটা ভাল করে সোফিয়ার গায়ে দিয়ে দেয় সুজয়। বাচ্চা অবুঝ মেয়ের মত তার দিকে ঘোলাটে চোখে তাকিয়ে থাকে সে বেশ খানিকক্ষণ। যেন তাকে চেনার এখনো আপ্রাণ চেষ্টা করে চলেছে। না পেরেই বোধহয় ক্লান্ত হয়ে তার কাঁধে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়ে একসময়।

    ঘাড়ের ব্যথাটা কেন জানিনা আবার চিনচিন করে ওঠে। কিন্তু সুজয় আর এই যন্ত্রণাকে অভিশাপ ভাববে না। সে যে বড় ভাগ্যবান! সামনের পাহাড়ি রাস্তাটা ধীরে ধীরে ঝাপসা হয়ে ওঠে।

    ।। ১০ ।।

    দিন এবং রাত নিজের নিয়মেই আসে আর যায়, সোফিয়ার বিছানা থেকে ওঠার অনুমতি নেই। শক্তিও নেই। চোখ বুজতে ইদানীং খুব ভয় করে। কোন প্রাচীন যুগের অচিন মানুষেরা যেন কথা বলে তার সাথে। হাত ধরে পরম যত্নে নিয়ে যায় এক রূপকথার দেশে। কিন্তু সে দেশ যেন বড্ড চেনা। ডাক্তারের দেওয়া কড়া ঘুমের ওষুধ খেয়ে চলেছে গত ১৫ দিন ধরে। বুঝতে পারে, একটা প্রচণ্ড ঝড় বয়ে গেছে তার ওপর দিয়ে। অথচ সবকিছু দিব্যি সুন্দর চলছিল, নির্দিষ্ট ছন্দে — হঠাৎই এই ছন্দপতন তাকে মানসিক ভাবে অত্যন্ত দুর্বল করে দিয়েছে। সে জানে, সব প্রশ্নের উত্তর আছে একজনেরই কাছে। সমস্ত রহস্যের সমাধান করতে পারে সুজয়!

    সুস্থ হয়েই প্যারিসে ফিরে সুজয়ের সাথে ইউনিভার্সিটিতে দেখা করে সোফিয়া। কতদিনেরই বা পরিচয় তাদের। তারা দুই ভিন্ন দেশের, ভিন্ন সংস্কৃতির মানুষ — আপাতদৃষ্টিতে তেমন কোন মিলই নেই। অথচ অল্পসময়ের মধ্যেই সোফিয়া বুঝতে পারে, একে অপরের চিন্তা ভাবনা, পছন্দ অপছন্দ —সবই যেন বহু আগে থেকেই জানা। সে ভীষণ কথা বলতে ভালবাসে, আর অপরজন শুনতে। গল্প করতে করতে কোথা দিয়ে যেন সময় কেটে যায় তাদের। ফরাসী বিপ্লবের সময়কার সেই অন্ধকার দিনগুলোর গল্প বলে সুজয় —নেশাগ্রস্তের মত শুনতে থাকে সে। এদেশেরই মেয়ে সোফিয়া, ফ্রান্সের ইতিহাস তার পড়া। কিন্তু এত কথা সুজয় জানল কি করে! আর কি অসাধারণ তার বলার ভঙ্গিমা —যেন ঐ জগতেই রয়েছে। সব সে দেখতে পারছে তার চোখের সামনে! সিনেমার মত! আর সোফিয়া? বড় বড় চোখ করে গিলতে থাকে সেসব। তার ছটফটানি, বকবকানি সব যেন এক মন্ত্রবলে থেমে যায়। সেও সুজয়ের সাথে চোখ বুজে পাড়ি জমায় সেদেশে, সেইসময়ে।

    সুজয়ের ভাসা ভাসা চোখের দিকে তাকিয়ে এই রহস্যের সমাধানের অনেক চেষ্টা করেছে সোফিয়া। কিন্তু পারেনি। কেন যেন মনে হয়, তারা কারও নির্দেশে আজ এখানে হঠাৎ উপস্থিত —আর অপেক্ষা করে চলেছে সেই তারই পরবর্তী নির্দেশের জন্য। তাদের সম্পর্ক এক গভীর সূত্রে বাঁধা, সেই সূত্র পাহারা দিয়ে চলেছেন স্বয়ং পরম শক্তিমান। অসীম যত্নে, অপার মমতায়। কেউ কারোকে প্রেম নিবেদন করেনি — প্রয়োজনও বোধ করেনি। সেসব যেন বহু যুগ আগেই করা হয়ে গেছে। চলতে চলতে তারা যেখানে থেমে গেছিল, সেখান থেকেই আবার চলা শুরু করেছে। গন্তব্য কারোরই জানা নেই। তবে জানে, সেই পথের শেষে ঈশ্বর অপেক্ষা করে বসে আছেন তাদের জন্য। কারণ এখনো সম্পর্কের সুতোর শেষ গিঁটটাই যে মারা বাকি।

    স্টিভের অবস্থা দেখে বেশ কষ্টই হয় সোফিয়ার। তাকে কি যে বলবে নিজেও জানে না। এটুকুই জানে, সুজয়কে ছাড়া সে বাঁচতে পারবে না। তার কোন অস্তিত্বই নেই। তারা দুজন যেন অন্য যুগ থেকে ফিরে এসেছে —একে অপরের ডাকে সাড়া দিয়ে। কিন্তু কিভাবে? সুজয় কি জানে? বলেছিল যে একদিন তাকে সব বলবে!

    সেদিন সন্ধেবেলা সুজয়ের হাত দুটো ধরে খুব জোরাজুরি করেছিল সোফিয়া। তার গাল দুটো জোরসে টিপে জানতে চেয়েছিল সত্যিই কিছু রহস্য আছে কিনা! ম্লান হেসে মাথা নেড়েছিল সে। সামনেই গুড ফ্রাইডে, ছুটি আছে দুজনেরই। ঠিক হয়েছে সেদিন তারা ঘুরতে যাবে। সুজয়কে নিজের দেশ ঘুরিয়ে দেখাবে সোফিয়া। প্রথমেই যাবে দ্যুভিলে বীচ। তারপর একটা নৌকো ভাড়া করে সোজা চলে যাবে মাঝ সমুদ্রে। সুজয়ের হাতে হাত রেখে শুনবে সেই গল্প। গল্প? সুজয় যে বলল, একদম সত্যি!

    ।। ১১ ।।

    লা প্যারিসিয়ান

    শনিবার, ২৯শে মার্চ, ১৯৮৬

    প্যারিস: আজ ছুটির দিনে এক দুর্ঘটনা ঘটে গেছে দ্যুভিলে বীচে। খবরে প্রকাশ, সকাল ১১টা নাগাদ এক ভারতীয় ডাক্তার ও তাঁর এক এদেশীয় বান্ধবী একটি নৌকা ভাড়া করে সমুদ্র ভ্রমণে যান। সমুদ্রের শান্ত নীল জলে হঠাৎই এক আলোড়ন লক্ষ্য করা যায়। প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণ অনুযায়ী, এক বিশাল হাঙরের খপ্পরে পড়েন তাঁরা। দ্যুভিলে বীচ চিরকালই খুব নিরাপদ —বছরের এই সময়টায় প্রচুর ট্যুরিস্টের সমাগম হয়। তাই এই ঘটনা একেবারেই অপ্রত্যাশিত। উদ্ধারকারী নৌকার ক্যাপ্টেন মিঃ রোম্যালেঁজ জানিয়েছেন, হাঙরটি নৌকা উল্টিয়ে তাদের আক্রমণ করে এবং মুহূর্তের মধ্যে ধড় থেকে মাথাটি বিচ্ছিন্ন করে দেয়। প্রায় একঘণ্টার চেষ্টায় মৃতদেহ উদ্ধার করা সম্ভব হয়। তবে তাদের দুটি হাতকে জড়াজড়ি করে ভেসে যেতে দেখা গেছে বহুদূর পর্যন্ত।

    শেষ খবর পাওয়া অনুযায়ী মেয়েটির মৃতদেহ তার নিকটাত্মীয়ের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। প্যারিসের ভারতীয় দূতাবাস ছেলেটির পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে সমর্থ হয়েছে। পুলিশ আপাততঃ বীচটি সীল করে দিয়েছে।

    ।। ১২ ।।

    পায়ে পায়ে করিডরের খোলা জানলাটার পাশে এসে দাঁড়ালেন প্রোফেসর জোবস্ট। সূর্য ঢলে আসছে, দূরের টিউলিপের বাগানটা শেষ বেলার রোদে যেন স্বর্গোদ্যান মনে হচ্ছে। আরেকটা দিন শেষ। পিছনে হাত দুটো ধরে নিজের ঘরের দিকে ঘুরেও থমকে দাঁড়িয়ে পড়লেন যেন। তিনি নেদারল্যান্ড ইন্সটিটিউট অফ নিউরোসায়েন্সের অধ্যক্ষ, অথচ আজ নিজের ঘরেই ঢুকতে ভয় পাচ্ছেন। কি উত্তর দেবেন তিনি জেনিসের বাবা মাকে?

    কতই বা বয়েস মেয়েটার, এই পাঁচে পড়ল। এই এক মাসে মেয়েটির মায়ায় পড়ে গেছেন ভীষণ ভাবে। আজ থার্মোগ্রাফি করেও তো কিছু ধরা পড়ল না। কোন চিকিৎসাই সেভাবে শুরু করতে পারেননি এখনো।

    বিরক্ত হয়ে জানলাটা বন্ধ করে দিলেন প্রোফেসর।




    অলংকরণ (Artwork) : অলংকরণ : রাহুল মজুমদার
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)