বলব কি সেই পড়শীর কথা, তার হস্ত-পদ-স্কন্ধ-মাথা নাই রে…
আরতির এক হাত নিজের উদরে, অন্য হাতে চানঘরের টিনের দরজায় রাখা গামছা নিতে-নিতে সে নতুন পড়শীর কথাই ভাবছিল৷ দেখা তো হবেই সোনা৷ আর তো কটা দিন। ভাবলেই মমতায় ভরে ওঠে তার মন, চোখে জল ভরে আসে৷ অথচ প্রথমে জানতে পেরে সীতারাম বলেছিল, হারামজাদি, শ্লেষ্মায় ঘড়ঘড় করতে করতে তার চোখ প্রায় উল্টে যাচ্ছিল, তখনো তার বুকে পিঠে তেল গরম করে মালিশ করে দিচ্ছিল এই আরতি-ই৷
খ্যাপাবাবার আখড়ার গান ভেসে আসে৷ খাঁচার টিয়াটা সেই থেকে ডেকে যাচ্ছে, ভাত দে গো মা৷ আরতি বলে, যাই সোনা৷ নাঃ, কাজ আছে মেলা৷ খদ্দের এসে জুটবে সকাল সকাল৷ বাউল-বোষ্টম-সাঁইমতের পথিকরা জয়দেব সেরে অজয়ের পার ধরে দু কোশ হেঁটে এখানে, খ্যাপাবাবার বরষি মোচ্ছবের প্রসাদ পেয়ে, তবে দক্ষিণমুখো হবেন ... এটাই রীতি৷ এখনি গিয়ে দোকানে বসতে হবে৷ নইলে বেতো সীতারাম ডাকবে, অ আরতি, একবারটি এধারে এসো দি’নি৷ কয়লার আঁচে চায়ের কেতলি টগবগ করে ফুটবে৷ আরতি গিয়ে উনুনের পিছনে বসে হাতে হাতে চা টা এগিয়ে দেবে, বুড়ো বেঞ্চিতে বসা মানুষজনকে চা দিয়ে, এঁটো কাপ নিয়ে দোকানের পিছনে টিউকলতলায় রাখবে৷ কটাই বা৷ ও আরতি হাতে হাতে করে নেবেখন৷
গেরাম বেড়ি অগাধ পানি, নাই কিনারা, নাই তরণী পারে …
চায়ের সঙ্গে বিস্কুট লাগবে কিনা জিজ্ঞেস করলে কেউ না বলে, কেউ ক পয়সা জানতে চায়৷ সেই মানুষটি বলেছিলেন, ওসব বড়নোকি কি আমাদের জন্য৷ আরতি হাতে ধরিয়ে বলেছিল, নেন একটা, সক্কাল বেলায় বাউল-বোষ্টমকে দিতে আছে৷ তখন কপালে হাত ঠেকিয়ে বলেছিলেন, জয় রাধে প্রেমময়ী৷ ঘোর বর্ষার মধ্যে, অসময়ে এসে পড়ে বড় আতান্তরে পড়েছিলেন৷ আখড়া হাঁটুজলের তলায়, অজয়ের বন্যা তাদের দোকানের ছাঁচতলা অবদি এসে থমকে ছিল৷ রাতে দোকানের মেঝেতেই ভিজে খড়ের ওপর ঠাঁই নিতে হয়েছিল৷ বাদলা হাওয়ার সীতারামের কাশির টানের একটু বাড়াবাড়িই হয়েছিল, সারারাত তাকে মালিশ করে ক্লান্ত ছিল আরতি, কে জানতো চকমকি ঠুকলে ভিজে কাঠেও আগুন ধরে যায় কখনোসখনো! গেছিলো তো। পাঁচমাস হয়েও গেল দেখতে দেখতে।
পড়শী খনেক থাকে শূন্যের উপর, খনেক ভাসে নীরে........
সীতারাম প্রথম যেদিন জানতে পেরেছিল, সেদিনই যা মুখ-খারাপ করেছিল, তারপর থেকে সে কেমন অন্যরকম, রা কাড়ে না, গালি তো নয়ই৷ আবার কখনো-সখনো খেয়াল চাপলে সে রাতে লম্ফের আলোয় নিরাবরণার আরতি করে, তাতে শরীর জাগে না, অথচ বুড়োর কাশির দমক কমে আসে, দেখে দেখে যেন আশ মেটে না তার৷ আরতি লজ্জা পায় ...আঃ হচ্ছেটা কি৷
চানঘর থেকে বেরতে গিয়ে আরতি দেখতে পেল সদ্যাস্নাত উজ্জ্বল শ্যাম, একহারা মানুষটি, অজয়ের চরে কাপড়ের খুঁট ধরে শুকোতে গিয়ে ঠান্ডা হাওয়ার কেঁপে কেঁপে উঠছেন৷ কেশরাশি উন্মুক্ত, ধম্মিল্লবদ্ধ নয়৷ এবারেও এসেছিলেন। এসেই জানতে পেরে আড়ালে ডেকে তিনি বলেছিলেন, সাধনায় পতিত হয়েছিলাম গো রাই, মানুষের ধর্মে নয়৷ যদি মনে করো .... বাসন মাজতে মাজতে আরতির হাতদুটো থমকেছিল একটিবার, ও, সে তবে তোমার কেবল মানুষ-ধর্ম।
আর বুড়ো সীতারাম? এই তো, কালও কেঁদে বলেছে সে - ও বৌ, যাস নে৷ ভগমান এয়েছেন তোর শরীলে৷ চাঁদের সভার মতোন লাগতেচে. আরেট্টু দেখি৷ বুড়োর চোখদুটো থেকে যেন একটা পর্দা সরে গেছে, আলোর মধ্যে অন্যরকমের আলোর মত।
একটা শ্বাস ফেলে চা ছাঁকতে বসে আরতি৷
খ্যাপাবাবার আখড়ায় তখনো গান চলছে - পড়শী যদি আমায় ছুঁতো, যমযাতনা সকল যেত দূরে/সে আর লালন একখানে রয় তবু লক্ষ-যোজন ফাঁক রে৷
(এই সংখ্যায় অরিন্দম গঙ্গোপাধ্যায়-র আরো একটি গল্পঃ 'ঘুমের আঁচল')