রোদ্দুর ঝরছিল। মুহুর্মুহু।
তীব্র। বড় তীব্র সে রোদ। বাংলার আম কাঁঠালের ছায়ামাখা, ডোবায় চই-চই হাঁস ভেসে বেড়ানো, ভিজে গামছার মত ঘামে জড়ানো জামা গায়ে সেঁটে যাওয়া, পান্তা-দুপুরের মাখোমাখো রোদ্দুর নয় এ। মহারাষ্ট্রের প্রান্তর রুক্ষ, গাছের চেয়ে পথের পাশে পাথর পাহাড় বেশি, আকাশ আগুনঢালা, তাই এখানে রোদও গায়ে জ্বালা ধরানো চিড়বিড়ে ধানী লঙ্কা।
বাস নিজের মনে ছুটে চলেছিল পশ্চিমঘাটের পথ বেয়ে। একা একা মুখ বুজে এতক্ষণ জার্নি করা খুব চাপের। ট্রেনে ২৬ ঘন্টা বাড়ি যেতেই যা বিরক্ত লাগে! তবু তো কলকাতার ট্রেনে কিছু বাঙালি জুটেই যায় যাদের সাথে টুকটাক কথা বলা যায়।
একা আসা ছাড়া তো উপায় ছিল না...
বছরখানেক হতে চলল বোম্বে বাস। কিন্তু মারাঠীটা এখনো একদমই বোঝে না পার্থ, বলা তো দূরস্থান! এদিকে চড়ে বসেছে বোম্বে থেকে পুনে যাওয়ার স্টেট ট্রান্সপোর্টের বাসে, যার রঙ আর ঝড়ঝড়ে চলনের জন্য লোকে বলে 'লাল ডাব্বা'। পানভেল পেরোতেই বাস থেকে শহুরে চেহারা প্রায় উধাও, রঙিন শাড়ি জরি কাচের চুড়ি আর সাদা পাঞ্জাবি, ঢোলা পাজামা, মাথায় গান্ধীটুপি। পাশের সীটটা খালি, ওর প্রিয় একমাত্র ট্রাভেল ব্যাগটা বসে আছে বটল গ্রীন রঙের। তার পাশের সীটের ঝাঁপালো গোঁফওলা মানুষটি বসার সময় কিছু জিগ্যেস করেছিলেন, কিছু না বুঝেই মাথা নেড়েছিল সে। ব্যাস, বসে থেকে সেই যে অকাতরে ঘুমোচ্ছে লোকটা, ওঠার নাম নেই আর।
এ লোকটা নিপাট নিরীহই হবে। কিন্তু কাল থেকে গোঁফ দেখলেই ব্রহ্মতালু জ্বলে যাচ্ছে পার্থর।
মুখ ফিরিয়ে নিয়ে জানলায় তাকায়। এমনিতেও দৃশ্য দেখার মত প্রকৃতিপ্রেমিক সে নয়। আর এখন দেখার মধ্যে আছে খালি ন্যাড়া রুক্ষ পাহাড়ের গা। ঘাট পেরোচ্ছে বাস। রোদ এত কড়া যে বাসের ভেতরেও হলকা লাগে, চোখ জ্বালা করে। কিন্তু সেসব আর ধর্তব্যে নেই এখন পার্থর। কাল অবধিও গরম লাগছিল খুব। এখন শুধুই লেকের জলের ওপর দিয়ে হাওয়া খেলে যাওয়ার কথা মনে হচ্ছে।
এমনিতে, বেড়ানোর শখ ওর নেই। কিন্তু কেন কে জানে, লাঞ্চ পার্টনার বিনোদের মুখে এই পানশেট ড্যামের কথা শুনে অদ্ভুত ভাল লেগে গেছিল সেবার। বিহারের ছেলে বিনোদ পাগলের মত ঘুরতে ভালবাসে, মাসে একবার অন্তত কোথাও যাবেই। মহাবলেশ্বর মাথেরান লোণাভালার মত জনপ্রিয় টুরিস্ট স্পট বোধহয় চষে ফেলেছে, এবার একটু কম নামকরা জায়গা খুঁজে খুঁজে যাচ্ছে।
"বিশাল বড় লেক বুঝলে, আর একদম কেউ নেই, নো হল্লাগুল্লা পার্টি, তুমি বোটে বসে আছ লেকের মাঝখানে আর সূর্য ডুবছে, রঙ ভাসাভাসি লেকের জলে..."
পুরো কবি হয়ে উঠেছিল বিনোদ ফিরে এসে। 'এইটা একবার যেতে হবে', তক্ষুণি ভেবেছিল পার্থ। খুঁটিয়ে জিগ্যেস করে জেনে রেখেছিল কি করে যেতে হয়।
ভোলেনি সেটা। ভুলতে পারেনি।
"আসব স্যার?"
"ইয়েস ইয়েস পার্থ্। তোমার জন্যই ওয়েট করছি তো লাস্ট ফাইভ মিনিটস। দরজাটা বন্ধ করে বোসো প্লীজ।"
"সরি স্যার" কোনরকমে দরজা বন্ধ করে লাল হয়ে ওঠা মুখ নিয়ে চেয়ার টেনে বসে পার্থ। শুধু দেরির জন্য লজ্জায়ই নয়, মিটিং রুমটা চিনত না বলে একটু হন্তদন্ত ঘোরাঘুরি করতে হয়েছে এই ফ্লোরে।
"নাউ পার্থ্, তুমি দেখেছ নিশ্চয় রেটিংগুলো। কিছু বলার আছে তোমার?"
বলার আছে?! মানে, ওটা কোন রেটিং? সমস্ত ক্রাইটেরিয়াতে জাস্ট বেয়ার মিনিমাম? কোনরকমে চলে যায় - এই তার কাজের মূল্যায়ন?
সামনে বসা অরুণ শেট্টির ভারিক্কি, শ্যামলা মুখ, রীমলেস চশমা আর পুরু গোঁফের দিকে চেয়ে রাগটা আপনি কেমন নেতিয়ে পড়ল পার্থর। মিনমিন করে বলল, "আমি তো যথাসাধ্য করছি!"
"আহ বাট য়্যু নীড টু ডু বেটার! এত কম্পিটিশন মার্কেটে, আমাদের কোম্পানি তো উঠেই যাবে তোমরা এক্সট্রা এফিসিয়েন্সি না দেখালে! য়্যু নীড টু বী মাচ মোর অ্যাগ্রেসিভ অন ইয়োর টাস্কস ইয়ং ম্যান!"
বাড়ি ফিরতে ফিরতে রাত দশটা সাড়ে দশটা। প্রায় শনিবারই অফিস আসতে হচ্ছে গত তিন মাস ধরে। ইউজার তাকে ফোনে যে যে পয়েন্ট বুঝিয়েছিল, ফার্স্ট কাট দেখে একদম তার বিপরীত কথা বলল। পুরো পরিশ্রম জলে, এখন আবার নতুন করে লিখতে হচ্ছে সেই কম্পোনেন্ট-টা।
এক্সট্রা এফিসিয়েন্সি এর পরও কী দেখাবে ভেবে পায় না পার্থ। কিন্তু বস, উঁহু, বসের বস বলছেন যখন...
"সো য়্যু উইল ওয়ার্ক অন ইট? ডু বেটার নেক্সট টাইম?"
কী যে ওর থেকে চাওয়া হচ্ছে না বুঝেই, 'ওকে স্যার' বলে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে পার্থ।
শেট্টি ফোন তুলে রাজনকে ডায়াল করেন। পার্থর ইম্মিডিয়েট বস।
"নাহ্ রাজন। আদৌ কিছু বুঝল কিনা বুঝলাম না, সবেতেই তো এগ্রি করে গেল। কীপ আ শার্প আই অন হিম।"
"আবে উল্লু, তুই এসব কিছু শেট্টির বাচ্চাকে বলতে পারলি না? এখন আমাদের কাছে বলে কী লাভ!"
ঝাঁঝিয়ে উঠেছিল শচীন শেভ করতে করতে। পার্থর রুমমেটরা প্রত্যেকেই তৈরি হচ্ছিল বেরোনোর জন্য। শনিবারের সন্ধ্যা। শচীনের স্টেডি গার্লফ্রেন্ড আছে, রাত্রে ফিরবে না জানা কথা। দীপ আর মেহুল তাদের গ্যাং-এর সাথে বার হপিং করবে, ফিরতে ফিরতে ভোররাত। প্রথম দিকে এক দুবার পার্থকেও সঙ্গে নিয়েছে তারা। পার্থর পোষায়নি। মদ খেলেই ওর বমি হয়ে শরীর খারাপ হয়ে একাকার হয়। আর বড্ড আওয়াজ, লোকজন বড় উগ্র অদ্ভুত। ওর মুড়ি-চানাচুর মেখে নিয়ে টিভির সামনে একা বসে পুরোনো হিন্দি মুভি টুভি দেখতে বেশি ভাল লাগে। রুমমেটরা এখন হাসাহাসি করে এ নিয়ে, কিন্তু জোর করে না।
"এত রিয়াক্ট করছিস কেন, পার্থরও তো কিছু ভুল হয়েছে এবার। শোন তোকে যা বলেছি, এর পর থেকে ফোনে রিকোয়ারমেন্ট নিবি না একদম। যা বলবে সব ডকুমেন্টেড চাই, বলে দিবি। নইলে এসব ইউজার..."
চারটে বাছাই খিস্তি উচ্চারণ করে দীপ, সুপার টাইট জীনস নিয়ে ধস্তাধস্তি করতে করতে। গালিগুলো ইউজারকে, না ওকে, নাকি জীনসটাকে, বোঝা যায় না।
পার্থও ভাবে, এত সিনিয়ার লোক যখন বলছে...
তাই ভেবেছিল তখন।
সেটা ছমাস আগের ঘটনা। মিড ইয়ার অ্যাপ্রেইজাল ছিল সেটা।
আর ফাইনাল ইয়ারলি রিভিউটা ছিল কাল।
বাসটা কোথায় যেন দাঁড়িয়েছে। অভ্যাসমত বাথরুমে যাবে বলে নামল পার্থ। তারপর গেল না। ড্রাইভারটা ঘুরে এসে ওকে একই ভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কেমন অবাক চোখে তাকাল। হয়তো ভাবল, গরমের চোটে হিসিও শুকিয়ে গেছে। আখের রস বেচছে বাসস্টপের ধারের দোকানে, দোকানী আশায় আশায় চেয়ে আছে। পার্থর সেটারও দরকার নেই। মৃদু হেসে বাসে ফিরে গিয়ে আবার জানলায় হেলান দেয় সে।
"সোয়ারগেট আলা?"
পাশের গুম্ফবদন ঘুম ভেঙে উঠে বসেছে।
এইটুকু মারাঠি বোঝে পার্থ, মাথা নেড়ে জানায়, না, স্বরগেট স্টপ আসেনি। লোকটা তৎক্ষণাৎ আবার ঘুমিয়ে পড়ে। কী সুখের জীবন এর!
কাল এইরকম সময়েই মিটিংটা ছিল। গতবার প্রোমোশন পেয়েছে, তাই এবারে শেট্টির নিজের কেবিনে। পর্দাটানা জানলা। পা কাঁপে একটু বসতে বসতে। পিছনে ভারী দরজা আপনি বন্ধ হয়ে যায়।
খানিক পরে দরজা ঠেলে পা ঘষে ঘষে বেরোয় এক নীরক্ত জবুথবু ভ্যাবলা চেহারা।
"ওই দেখ টাবলু, ভ্যাবলাটা আসছে। ডাক ডাক!" বেশ চড়া শিস দিতে পারে টাবলু। পার্থ ঘুরে তাকাতে বাধ্য হয়। পাড়ায় পার্থকে কেউ কোনদিন পার্থ বা তার ডাকনাম বুটু বলে ডাকেনি। সেই কোন ছোট থেকে দাদার বন্ধুদের কাছে ওর ডাকনাম ভ্যাবলা। "এই যে চাঁদবদন। বলি পাশের খাওয়াটা কবে খাওয়াবি আর? বছর ঘুরলে?"
টাকা নেই। জেঠু হাতখরচ দেওয়া পছন্দ করেন না। যে ছেলে জন্মেই মাকে খেয়েছে আর স্কুলে ঢুকতে না ঢুকতে বাবাকেও, তাকে যে এদ্দিন ধরে পালছেন পুষছেন এই অনেক। জেঠিমা নাকি মাকে দুচোখে দেখতে পারতেন না, এর ওর মুখে শুনেছে পার্থ। তবু তিনি একটু হুঁশ করে খেতে টেতে দেন ওকে, জ্বরজ্বারি হলে ওষুধ জলপট্টিও করেছেন বার দুই। কিন্তু জেঠু, বাবা রে!
"তাকায় দ্যাখ! সাধে কি বলে ভ্যাবলা!" বিশুদা টাবলুদা দাদার বন্ধু। না, দাদা বললে রাগ করে - ও তো আর কিছু নিজের ভাই নয়! বনিদা। অংশুমান রক্ষিত।
পাড়ার তো বটেই, মহল্লারও সবচেয়ে ঝকঝকে স্টুডেন্ট। লম্বা চওড়া ফরসা চেহারা আর গমগমে গলা জেঠুর মতই। সত্যিই পাশাপাশি দাঁড়ালে কেউ ওদের দুভাই বলবে না।
কোনমতে পরে হবে, আজ টিউশনি যাচ্ছে তো, বলে পালায় পার্থ তখনকার মত।
দা....না, বনিদা ক্যাম্পাসিং-এই চাকরি পেয়ে গিয়ে বাঙ্গালোর। এই তো দুবছর পুরতে চলল গেছে। জেঠিমা মেয়ের খোঁজ করছে। দাদা ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ, বড় কলেজ। ভাল চাকরি না পেলেই আশ্চর্য হত।
পা চালিয়ে হাঁটতে হাঁটতে কর গোনে পার্থ। আট মাস হতে চলল। ছোটখাট একটা কলেজ থেকে বি কম, সেই সঙ্গে সন্ধ্যার কম্পিউটার কোর্স। কোর্সটা কলেজের শেষদিকে শুরু করেছিল পার্থ, যখন বুঝেছিল ক্যাম্পাসিং-এ কিছু হবার চান্স প্রায় নেই। দাদার চেহারা শুধু নয়, ব্রেনটাও তো তার নেই!
তা এটাও শেষ হতে চলল তো। কোন কোম্পানি সেভাবে আসছে না। এরপরটা মাথায় আসে না পার্থর, মাথা নুইয়ে আরো দ্রুত পা চালায়।
"কিচ্ছু করার নেই পার্থ্। তোমায় আগের অ্যাপ্রেইজালে এত ওয়ার্নিং দিলাম তো! ডিডন্ট য়্যু গেট ইট?"
ওয়ার্নিং বলে বোঝেনি পার্থ। সত্যিই বোঝেনি। কিন্তু এত সিনিয়র একজনকে বলবে সেটা?
মাথার মধ্যে টাবলুদা বিশুদা বলে ওঠে, "সাধে কি বলে ভ্যাবলা!"
মুখ নামিয়ে বসেই থাকে পার্থ। ওর দশা দেখে রাজনের বোধহয় মায়া হয়।
"আরে এত ভাবছ কেন! পি আই পি তো তোমাকে পারফর্ম্যান্স ইম্প্রুভ করতেই দেওয়া হচ্ছে! চলে যেতে তো বলা হচ্ছে না। খালি তোমার যে ভুলগুলো হচ্ছে সেটা শিখিয়ে নেবার জন্য।"
একটু থেমে আবার বলে, "তাছাড়া, তিনমাস সময় অনেক সময়। দেখো অন্য কিছু পেয়েই যাবে। মে বী নিয়ার ইয়োর হোমটাউন, আই নো য়্যু আর প্রিটি হোমসিক।"
এতক্ষণ শুধুই শকড হয়েছিল পার্থ। মিনিমাম রেটিং পেয়ে। তাকে পি আই পি, অর্থাৎ পারফর্ম্যান্স ইম্প্রুভমেন্ট প্ল্যান দেওয়া হচ্ছে শুনে। নিতান্ত খারাপ পারফর্ম করলে যেটা করা হয়। কাউকে কখনো পেতে দেখেনি পার্থ। কেমন লাস্ট বয়ের মত লজ্জায় অপমানে নিজের মধ্যে গুটিয়ে যাচ্ছিল সে।
রাজনের এই শেষ কথাটা তার মাথায় হাতুড়ির ঘা মেরে বুঝিয়ে দিল, এটা স্কুলের পরীক্ষা নয়। কোম্পানি তাকে অন্য চাকরি খুঁজে নিতে বলছে।
অন্য চাকরি। চাকরি চলে যাবার নোটিস এটা।
অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটারটা এসে পৌঁছেছিল একটা শনিবার। ইমেইলে। রোজ সেটা চেক করা হয় না পার্থর। রবিবার দেখল, কিছুকাল আগে যে কোম্পানির রিক্রুটমেন্ট ড্রাইভে গেছিল, তারা ওকে সিলেক্ট করেছে ট্রেনি সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে। তবে, কলকাতায় না, বোম্বেতে। স্যালারিটা শুনে বনিদাদা ফোন কাঁপিয়ে হেসেছিল, ওতে তোর বোম্বেতে থাকার খরচটাই কুলোয় কিনা দ্যাখ।
দিব্যি কুলোচ্ছিল কিন্তু। জেঠুর পরিচিত কয়েকজনের ফোন নাম্বার মাত্র সঙ্গে নিয়ে এসেছিল, তাঁদেরই একজন এই শেয়ারড ফ্ল্যাটের খোঁজ দিলেন। ওরই মত আরো তিনজন সফটওয়্যারের ছেলে। চতুর্থ রুমি খুঁজছিল ওরা।
দিব্যি কুলোচ্ছিল। ফ্ল্যাটের শেয়ার দিয়ে, ক্যান্টিনে প্রায় তিনবেলা খেয়ে, বেশি ঝামেলায় না গিয়ে। একটু একটু করে জমছিলও।
টাকা, ব্যাঙ্কে, একটু একটু করে। সেই সঙ্গে জমছিল অফিসে পিজা পার্টির চীজের স্বাদ। দিনে চারবার কফি খাবার অভ্যাস। গোটা তিন ব্রান্ডেড শার্ট। একটা ভাল ঘড়ি - বহুদিনের শখ ছিল।
দাদার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। জেঠু জেঠিমা হাওড়ার বাড়ি ভাড়া দিয়ে পাকাপাকি ব্যাঙ্গালোর চলে যাবে সামনের পুজোর আগেই। পুজোটা এবার তাই কলকাতায় মাসিদের কাছে কাটাবে ভেবেছিল পার্থ। কখনো ঘুরে ঘুরে কলকাতার নামকরা ঠাকুরগুলো সব দেখা হয়নি ওর। আরেকটা বহুদিনের শখ।
তিন মাস। মানে পুজোর অনেক আগেই ও বেকার।
কোথায় ওর হোমটাউন? কোথায়? কোথায় যাবে পার্থ?
পুনের কাছাকাছি এসে গেছে মনে হচ্ছে। পর পর চলে গেছে নিগড়ি, পিম্পড়ি, চিঞ্চোয়ার, হিঞ্জাওয়াডি এসব স্টপগুলো। অনেক লোক নেমেছে। এক দুজন উঠেওছে। তবু বাস এখন অনেকটাই খালি।
এক খাস্তা তরুণ ওর পাশে বসতে এসেছিল। চুলে মোরগঝুঁটি। ব্যাগ তোলেনি পার্থ, শুধু চোখ তুলে তাকিয়েছিল তার বদলে। কিরকম ঘাবড়ে গিয়ে চোখ ফিরিয়ে পিছনের দিকে হড়বড় করে চলে গেল ছেলেটা।
"সোয়ারগেট! সোয়ারগেট!"
কাঠখোট্টা গলায় হাঁকটা দিয়ে ড্রাইভার ইঞ্জিন বন্ধ করে নেমে যায়।
সবাই লাইন করে নামছে। পাশের ঝুলোগোঁফ উঠে যেতে দাঁড়িয়ে হাত টান করে আড়মোড়া ভাঙে পার্থ। অভ্যেস।
ঝুঁকে, পাশ থেকে তার বটল গ্রীন কাঁধের কিটব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে নেয়। হাল্কা। সিদ্ধান্তটা নিয়ে নেবার পর সব কত হাল্কা লাগছে এখন।
"এ ভাউ, ইকড়ে! ইকড়ে!"
গুঁফো লোকটা একটা অটোর পাশে দাঁড়িয়ে ওকে ডাকছে। শেয়ারে যাবার ধান্দা মনে হয়। বড় বড় পা ফেলে একদম পাশে গিয়ে দাঁড়ায় পার্থ। খুব নরম গলায় জানায় ও সিটিতে যাবে না, যাবে পানশেট ড্যাম দেখতে।
লোকটা মুখের ভাঁজ পড়া চামড়ায়, গোঁফের ফাঁকে কৌতুকের হাসি ফুটিয়ে জানায়, সেটা এই অটোতেই যাওয়া হোক, এ ড্রাইভার তার দোস্ত। ধন্যাবাদ জানিয়ে, একবার হাতে হাত ছুঁইয়েই অটোয় উঠে পড়ে পার্থ।
পিছনে কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা চেহারাটা বিস্ফারিত চোখে একবার নিজের হাতের দিকে আর আরেকবার অপসৃয়মান অটোর দিকে তাকাতে থাকে। বিশ্বাস করতে পারে না ওই লড়কার হাত সত্যিই কি এমন বরফঠান্ডা ছিল!
অটোয় গা এলিয়ে বসে পার্থ ভাবে, লেকের জলে সূর্যাস্তের আলো ঢেউয়ে মাখামাখি হবার আগেই ও নিশ্চয় পৌঁছে যাবে।
ওপেন অ্যান্ড শাট কেস। ইন্সপেক্টর রাহানে চোখ বুলিয়েই বুঝেছিলেন কোন ফাউল প্লে হবার চান্স নেই বললেই চলে। ঘরদোর একদম ঠিকঠাক, মানে ব্যাচেলরদের ঘর যেমন অগোছালো হয় তেমনই। কিন্তু ধস্তাধস্তি মারামারির কোন ছাপ নেই।
আর সোফায় জবুথবু বসে থাকা ছেলে দুটো, বা যে ছেলেটা দরজা খুলে দিল, কারো মুখেই কোন ভয় বা ধূর্ততা দেখলেন না। আতঙ্কে, শকে থম মেরে গেছে, কিন্তু সেটা স্বাভাবিক। সারারাত ফুর্তি করে ফিরে যদি দেখে, রুমমেট নিথর পড়ে আছে রান্নাঘরের মেঝেতে, কবজি থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়ে পুকুর হয়ে জমে আছে, তো ওটুকু শক এক্সপেকটেড।
কারণটাও পরিষ্কার। কাল অফিস নোটিস দিয়েছিল। কাজ ভাল হচ্ছে না। প্রচণ্ড ডিপ্রেসড ছিল, রাতে খায়ওনি কিছু মনে হল। তারপর সে ডিপ্রেশন গাঢ় হয়ে চেপে বসেছে আর কী, কবজির শিরায় ছুরি চালিয়ে দিয়েছে। কম সুইসাইড কেস তো দেখলেন না এদ্দিনে। এরকম হুট করেই করে ফেলে লোকে।
তিন বন্ধু বেরিয়ে যাবার পর একা একা গুমরোতে গুমরোতে কখন ব্যালেন্স হারিয়েছে কে জানে। সব এভিডেন্স ঠিকমত প্যাক হচ্ছে কিনা দেখতে দেখতে আপনমনেই মাথা নাড়েন ইন্সপেক্টর। বন্ধু না, আজকের দিনে এরা কেউ কারো বন্ধু না। রুমমেট। নইলে এমন কন্ডিশনে ছেলেটাকে একা রেখে দিয়ে তিনজনে চলে গেল!
সব প্যাক হয়ে গেছে, যা যা ইনফরমেশন ছেলেগুলোর থেকে নেওয়ার ছিল সবই হয়ে গেছে। একবার অফিসটায় কথা বলতে যেতে হবে কিন্তু সে নেহাতই ফর্মালিটি।
শুধু একটাই খটকা রয়ে গেল মনে। একটা ছেলে একবার বলল, যদিও শিওর নয় বলল, তবু .. বলল তার যেন মনে হচ্ছে ওরা গতকাল বেরোনোর আগে ভিক্টিম, কী যেন নাম...হ্যাঁ...পার্থ্ রকশিৎ... যেন একটা ব্যাগে জামা ভাঁজ করে ঢোকাচ্ছিল। একটা বটল গ্রীন রঙের ট্রাভলিং ব্যাগ।
তন্ন তন্ন করে খুঁজেও ফ্ল্যাটে তেমন কোন ব্যাগ দেখতে পেলেন না কিন্তু ইন্সপেক্টর রাহানে।
লেকের জলে সত্যি অপার্থিব আলোর ঢেউ খেলছিল। বোটিং আপাতত বন্ধ। তবে তাতে পার্থর কোন অসুবিধে নেই।
অটোওলা লোকটা ওকে নামিয়েই ফিরে গেছিল। নইলে, এই দৃশ্য দেখে অজ্ঞান হয়ে যেত নির্ঘাৎ। কাঁধের বটল গ্রীন ব্যাগ সামলে, আলতো পায়ে লেকের ঢেউ মাড়িয়ে মাড়িয়ে একটা ছায়াশরীর এগিয়ে যাচ্ছিল লেকের মাঝখানের দিকে। মুখে শখ মেটানোর অনাবিল হাসি।