লেখকের জন্ম কলকাতায় ১৯৫৬ সালের জুলাই মাসে; বাবা সেনাবাহিনীর লেফ্টেনান্ট কর্নেল ছিলেন, কিন্তু পরে কূটনীতিবিদের কাজে যোগ দেন। তাঁর ছেলেবেলা কেটেছে পৃথিবীর নানান দেশে--পূর্ব পাকিস্তান, শ্রীলংকা, ইরান এবং ভারতবর্ষে। দুন স্কুলে লেখাপড়া করার পর নতুন দিল্লির সেন্ট স্টিফেন্স কলেজ থেকে ইতিহাসে বি.এ. এবং দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজবিদ্যায় এম.এ.। তারপর তিনি টিউনিসিয়ার রাজধানী টিউনিস শহরে Institut Bourguiba des Langues Vivantes নামক শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান থেকে আরবী ভাষার ডিপ্লোমা পান এবং সেখান থেকে যোগ দেন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে। অক্সফোর্ডের সেন্ট এডমান্ডস হল থেকে সামাজিক নৃতত্ত্ববিদ্যায় ডি.ফিল.। এই কাজের সূত্রে তাকে দীর্ঘ সময় কাটাতে হয়েছিল মিশরের লাতাইফা গ্রামে ক্ষেত্রসমীক্ষার কাজে। ১৯৮২ সালে দেশে ফিরে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা এবং দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস সংবাদপত্রে সাংবাদিকতার ফাঁকে ফাঁকে শুরু করেন তাঁর প্রথম উপন্যাসের রচনা।
অর্থাৎ ইতিহাস, সমাজবিদ্যা এবং নৃতত্ত্বের ত্রিবেণীসঙ্গমে তাঁর সাহিত্য জীবনের শুরু; এবং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে গভীরতর হয়েছে তাঁর সাহিত্যজগতের ইতিহাস-সম্পৃক্ততা। এখনও পর্যন্ত আটটি মহতী উপন্যাস এবং একটি ইতিহাস ভিত্তিক কাহিনি মিলে তাঁর সাহিত্যের প্রধান ধারাটি। কিন্তু এর পাশাপাশি তাঁর প্রবন্ধসাহিত্যের তালিকাটিও দীর্ঘ--সেখানে ঐতিহাসিক, রাজনৈতিক ও নৃতাত্ত্বিক প্রক্ষাপটে তিনি ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ করেছেন পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ঘটে যাওয়া পরিবর্তন ও দুর্ঘটনার। ইতিহাস নির্ধারণ করে সমষ্টির ভাগ্য, সাহিত্যে ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে ব্যক্তির জীবনযাপন। লেখকের একটি প্রিয় বিষয় নৌযাত্রা-- ইয়োরোপিয়দের আগমনের আগেই ভারত ও আফ্রিকার দীর্ঘকালীন বাণিজ্য যোগাযোগ নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করেছেন তিনি। জাহাজ-যাত্রার বিষয়টি ভীষণভাবে ফিরে আসবে সাম্প্রতিক আইবিস ট্রিলজির উপন্যাসে। দক্ষিণপূর্ব এশিয়া নিয়েও তাঁর উৎসাহ অনেক দিনের--কম্বোডিয়ার ইতিহাস নিয়ে প্রবন্ধ লিখেছেন “গ্রন্থ” (Granta) পত্রিকায়--বিংশ শতাব্দীর প্রথমে রাজা সিসোয়াথ থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক পল পট পর্যন্ত; আংকোরভাটের মন্দির ভ্রমণের অভিজ্ঞতা অবজার্ভার কাগজে; বর্মার ইতিহাস এবং সাম্প্রতিক ঘটনাবলীর দীর্ঘ আলোচনা ‘দ্য ন্যু ইয়র্কার’ কাগজে। এই বিষয় নিয়ে ক্ষুরধার বিশ্লেষণ এবং বুদ্ধিদীপ্ত আখ্যানকথন অমিতাভ ঘোষের রচনায় ঘুরে ফিরে আসে।
মৌলবাদও তাঁর প্রবন্ধের বিষয় হয়েছে বার বার--মধ্যপ্রাচ্যে, দক্ষিণ-এশিয়ায় (লুঙ্গি এবং ল্যাঙ্গট, দুই প্রকারের) এবং ১১ই সেপ্টেম্বরের ঘটনার তিনি বিচার করেছেন ঐতিহাসিক পটভূমিতে। বাবরনামার এক নতুন ইংরেজি অনুবাদের আলোচনায় উঠে এসেছে মোঘল সাম্রাজ্যের উত্থানপতন। আর পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে লক্ষ লক্ষ অভিবাসী অথবা ছিন্নমূল মানুষ-- উত্তর-ঔপনিবেশিক যুগে এবং ভুবনায়নের কালে দেশ বলতে কি বোঝায়, সেই বিষয়টি নিয়েও তাঁর গভীর উৎসাহ। অত্যাচারিত, প্রান্তিক মানুষের কথা তিনি তুলে ধরেন প্রবন্ধে এবং পরে সাহিত্যের রসে জারিত হয়ে তাঁরা হন তাঁর কাহিনির চরিত্র।
এবার ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে লেখকের উপন্যাসগুলির সংক্ষিপ্ত আলোচনা
The Circle of Reason ('যুক্তির চৌহদ্দি', ১৯৮৬)
অমিতাভ বাবুর প্রথম উপন্যাস “দ্য সার্কল অফ রিজন” প্রকাশিত হয় ১৯৮৬ সালে। উপন্যাসটি পাঠকের জনপ্রিয়তা এবং সমালোচকের প্রশংসা দুটোই কুড়িয়ে ছিল মুঠিভর। দ্য ন্যু ইয়র্ক টাইমস সংবাদপত্রে অ্যান্টনি বার্জেস নিংশয় সাধুবাদ জানিয়েছলেন তরুণ লেখকের এই প্রথম প্রচেষ্টাকে। উপন্যাসটি লেখা হয়েছিল দিল্লিতে, রৌদ্রদগ্ধ চিলেকোঠার একটি ঘরে বসে।
ভারতীয়দের ইংরেজি ভাষায় সাহিত্যসৃষ্টির জোয়ারটি বেশিদিনের নয়। চল্লিশ-পঞ্চাশ বছর আগেও ভারতবর্ষীয়দের মধ্যে ইংরেজি ভাষায় লিখতেন আর. কে নারায়ণ, মুলকরাজ আনন্দ, খুশবন্ত সিং-এর মতন মুষ্টিমেয় কয়েকজন। যদিও বিদেশী সংস্করণ প্রকাশিত হত তাঁদের গ্রন্থগুলির, তাঁদের পাঠকবর্গের বেশিরভাগই ছিলেন ভারতীয়। এছাড়া ভারতীয় বংশোদ্ভূতদের (অথচ অন্য দেশের অধিবাসী/নাগরিক) হিশেবে ধরলেও বিদ্যাধর সূর্যপ্রসাদ নইপাল-এর মতন দুয়েকটি বিশ্ববিশ্রুত নাম যোগ করা যেতে পারে--তবু সংখ্যাটি একেবারেই বেশি নয়। কিন্তু চিত্রটা সম্পূর্ণরূপে পালটে গেল ১৯৮১ সালে--বম্বেতে জন্মগ্রহণকারী সালমন রুশদি প্রকাশ করলেন তাঁর দ্বিতীয় উপন্যাস--The Midnight's Children ('মধ্যরাতের সন্তানেরা'); ভারতবর্ষের নাম চিরকালের জন্যে খোদাই হল ইংরেজি ভাষার সাহিত্যের ইতিহাসে। ১৯৭৯ সালে প্রকাশিত তাঁর প্রথম উপন্যাস-- Grimus ('গ্রিমাস') অল্পস্বল্প নাম পেয়েছিল, কিন্তু এবার তিনি পেলেন প্রশংসা, যশ এবং পুরস্কারের পর পুরস্কার। এর পর থেকে মোড় ঘুরলো--শশি থরুর, বিক্রম শেঠ, অমিত চৌধুরী, উপমন্যু চ্যাটার্জি, অমিতাভ ঘোষের মতন লেখকেরা এসে দাঁড়ালেন পাদপ্রদীপের আলোয়। শৈলির দিক থেকেও 'যুক্তির চৌহদ্দি' নানাভাবে 'মধ্যরাতের সন্তানেরা'-র উত্তরসূরি। ছড়ানো-ছেটানো ঘটনা ও চরিত্রগুলি দেশহীনতা এবং ছিন্নমূল মানবতার দৃঢ় থিমের বাঁধনে সংহত। তার মধ্যে যাদু-বাস্তবতা এবং অধিবাস্তবতার জারক রস মিশে তৈরি করে প্রকৃত সাহিত্য। তবে রুশদি অনেক সময় শৈলির বাহাদুরি দেখতে গিয়ে জোলো করে ফেলেন কাহিনির গভীরতাকে--কিন্তু প্লট নিয়ে অমিতাভবাবুর মুনশিয়ানা আমাকে আকৃষ্ট করে বেশি।
তবে ইতিহাস এই উপন্যাসের পার্শ্বচরিত্র--মার্গসঙ্গীত এবং ভূগোলের প্রভাব সেখানে বেশি। তিন পর্বের উপন্যাসের প্রথম পর্ব সুরু হয়েছে ঢিমে তেতালায়--কয়েকদশকের গ্রাম্য জীবনের দলিল; কালোয়াতি গানের প্রথম অংশের মতন। দ্বিতীয় পর্বের কাল তিন সপ্তাহ--সেখানে ক্রমশ তাল ও লয়ের গতিবৃদ্ধি। তৃতীয় পর্বের কাহিনি মোটে একদিনের--যেখানে নাটকীয়তম মুহূর্তে সমে এসে উপস্থিত হয় সংগীত। এই ভাবে সত্ত্ব (যুক্তি), রজ: (উদ্দীপনা) এবং তমঃ (বিনাশ) নামের তিনটি পর্বের সমাপ্তি। উপন্যাসের ভৌগোলিক ক্যানভাসটি বিস্তৃত ও বিশাল। আটবছর বয়েসি আলুর মা-বাবা গাড়ি দুর্ঘটনায় মারা গেলে সে কলকাতায় আসে নি:সন্তান কাকা-কাকিমা বলরাম ও তরুদেবীর সংসারে। সেখানে নানা ঘাত-প্রতিঘাতের পর তার দীর্ঘ যাত্রার শুরু--প্রথমে দক্ষিণ ভারতের সমুদ্র উপকূলবর্তী তন্তুবায়দের গ্রামে এবং ফরাসি উপনিবেশ মাহেতে। সেখান থেকে তাড়া খেয়ে প্রাণভয়ে মধ্যপ্রাচ্যের কাল্পনিক দেশ আল-ঘাজিরায়--সঙ্গে এক প্রাক্তন গণিকা জিন্দি-আল-তিফায়া। তারপর উত্তর আফ্রিকা এবং মধ্যপ্রাচ্যের নানান অজানা দেশে সাবলীলভাবে গড়িয়ে যায় কাহিনির স্রোত। লেখকের নিজস্ব ভ্রমণ অভিজ্ঞতা এই উপন্যাসের সাফল্যের একটি প্রধান কারণ--চরিত্রগুলি দেশে ও বিদেশের ভূমিতে সমান স্বচ্ছন্দ ও সক্রিয়, তাই দেশগুলিও কাহিনির অংশ হয়ে দাঁড়ায়।
The Shadow Lines ('ছায়ারেখা' ১৯৯০)
‘দ্য শ্যাডো লাইনস’ উপন্যাসটি তিন দশক জুড়ে এক বাঙালি পরিবারের ঘাত-প্রতিঘাতের কাহিনি--চল্লিশের দশকের উত্তাল ভারতবর্ষ থেকে শুরু করে সত্তর দশকের কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়; সূত্রধরের শৈশব থেকে শুরু করে, শিক্ষাজীবন পেরিয়ে প্রাপ্তবয়স হবার কাহিনি। কিন্তু শেষপর্যন্ত তা হয়ে দাঁড়ায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার প্রতিবেদন। ব্যক্তিগত স্মৃতি এই গ্রন্থের প্রথম ও প্রধান উপজীব্য এবং সেখানে দীর্ঘ ছায়া ফেলেছেন মার্সেল প্রুস্ত। প্রুস্তকে নীরবে সেলাম জানিয়েই লেখক হয়ত কাহিনির সূত্রধরের কোন নাম দেননি।
উপন্যাসটি শেষপর্যন্ত একটি দাঙ্গার প্রতিবেদন হয়ে দাঁড়ায়। লেখক নিজে দাঙ্গার মুখোমুখি হয়েছেন শৈশবে--স্কুল বাসে বাড়ি ফেরার পথে তিনি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা দেখেছেন শ্রীনগর, ঢাকা ও কলকাতার পথে; কাকা-জ্যাঠাদের মুখে রেঙ্গুনের ভারতীয়বিরোধী দাঙ্গার বর্ণনা শুনেছেন ১৯৩০ এবং ১৯৩৮ সালের; মা-বাবা ও আত্মীয়স্বজনের মুখে শুনেছেন ১৯৪৬ সালে জিন্না-প্রণোদিত কলকাতার নির্বিচার গণহত্যার কথা। কিন্তু ১৯৬৪ সালে ঢাকা ছেড়ে কলম্বোতে তাঁর পরিবার বদলি হয়ে আসার আগে সেই শহরের রাজপথে তিনি প্রত্যক্ষ করেছিলেন নৃশংস হিন্দুনিধন। তারপর দু'দশক পরে ১৯৮৪ সালে দিল্লিতে বসবাসের সময় এবং প্রথম উপন্যাসটির রচনাকালে ঘটেছিল ইন্দিরা গান্ধীর হত্যা--যার প্রতিক্রিয়ায় কয়েকদিনের মধ্যে দিল্লি শহরেই হত্যা করা হয়েছিল দু হাজার পাঁচশোর বেশি শিখধর্মী মানুষকে। লেখক এবং আরো একদল হিন্দু মিলে আশ্রয় দিয়েছিলেন শিখ প্রতিবেশীদের। ফলে তাঁদের জীবন সংশয় হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। সেই ঘটনার প্রতিঘাতে লেখকের মনে পড়ে যায় শৈশবের ঢাকার দু:স্বপ্নের দিনগুলি--তখনও তাঁদের গৃহে আশ্রয় নিয়েছিলেন হিন্দু রিফিউজিরা এবং গভীর রাতে তাঁদের গৃহটি অবরোধ করেছিল সশস্ত্র, ক্রুদ্ধ জনতা। সেই সময়েই উপ্ত হয় তাঁর দ্বিতীয় উপন্যাসের বীজ--নানান সংবাদপত্র খুঁজে দীর্ঘ গবেষণায় তিনি উদ্ধার করেন সেই দাঙ্গার বিবরণ।
তাঁর লেখকজীবনের মোড় ফেরানো এই উপন্যাসটির দুটি পর্ব--“দূরে যাওয়া” এবং “ঘরে ফেরা”--কিন্তু ঘর কাকে বলে এবং কোথায় তার অবস্থান তার খোঁজ লেখককে করে যেতে হবে বাকি জীবন--অনেক অভিবাসী মানুষেরই সেই একই ভবিতব্য। প্রুস্তের মতনই তিনি এক স্মৃতির সিঁড়ি বেয়ে পৌঁছে যান অন্য স্মৃতির অলিন্দে, সেখান থেকে আবার পরিক্রমা। ঘটনা তাই সামনে এগোতে পারে না সরলরেখায়--বর্তমান থেকে অতীতে যায়, আবার অতীত থেকে বর্তমানে। কল্পনার রঙ যেভাবে রাঙিয়ে দেয় স্মৃতির অণুকণাগুলিকে এবং নিয়ন্ত্রণ করে তার গতিবধি। সেই স্মৃতিতাড়িত এই উপন্যাসের প্রধান চরিত্র ত্রিদিব। আর মিলিয়ে যায় জাতির সত্তা ও দেশের সীমান্ত। গল্প এগোয় সাবলীলভাবে কলকাতায়, ঢাকায় ও লন্ডনে। অভিজ্ঞতা ঘটে থাকে অতীতে, তারা রয়ে যায় স্মৃতিতে--কিন্তু ত্রিদিব পারেন তাদের কল্পনার রঙে সাজিয়ে নতুন জীবন দিতে এবং তাদের বর্তমান অনুভবে ফিরিয়ে আনতে।
এই উপন্যাসের লেখক, তার অনামা সূত্রধর এবং তার কাকা ত্রিদিব সকলেই ইতিহাসে নিমজ্জিত। ইতিহাসের ছাত্র হিশেবে তাঁর প্রশিক্ষণ এখানে চমৎকার কাজে লেগে যায়। অতীত এবং বর্তমান এক হয়ে মিশে যায় এই উপন্যাসে--
স্মৃতিতাড়িত কাহিনিতে ভারত, পাকিস্তান, ব্রিটেন--হিন্দু ও মুসলমান শৈশব ও প্রাপ্তবয়স্কতা--সব মিলিয়ে বাস্তব ও কল্পনা--সামাজিক দলিল ও রাজনৈতিক কথাসাহিত্য--কোন কিছুকেই আলাদা করে দেখা সম্ভব নয়। এতদিনে রুশদির ছায়া থেকে বেরিয়ে এসেছেন তিনি, কেটেছে যাদুবাস্তবতার মোহ। নিজের অনন্য, অনুপম পথটি খুঁজে নেন তিনি অস্তিত্ব ও আত্ম-স্বরূপতা সন্ধানের এই উত্তর-আধুনিক উপন্যাসে।
The Calcutta Chromosome (কলকাতার ক্রোমোজোম ১৯৯৫)
গ্রন্থটির পুরো নাম “কলকাতার ক্রোমোজোম--জ্বর, ভুল বকা ও আবিষ্কারের উপন্যাস”--সাহিত্যসাধনার কোনো একটি বিশেষ ছকে তার আলোচনা করা কষ্টকর। কাহিনিটি অনেকাংশে কল্পবিজ্ঞান এবং সেই হিশেবে অতিনন্দিত--আর্থার সি ক্লার্ক পুরস্কার এবং কল্পবিজ্ঞানের অন্য অনেক সম্মানীয় পুরস্কারে ভূষিত। গ্রন্থটির মার্কিন সংস্করণ প্রকাশিত হয় ১৯৯৭ সালের শেষ দিকে এবং বেশ কয়েকজন প্রসিদ্ধ পুস্তক সমালোচকের বানানো ১৯৯৮ সালের শ্রেষ্ঠ কল্পবিজ্ঞান গ্রন্থের তালিকায় স্থান পেয়েছিল এই উপন্যাসটি। সেই সঙ্গে গ্রন্থটি আবার অংশত ভূতের গল্প, অংশত গোয়েন্দাকাহিনি, অংশত রহস্য রোমাঞ্চকর রুদ্ধশ্বাস থ্রিলার--সব মিলিয়ে বলতে পারা যায় একটি উত্তর-আধুনিক প্রতিবেদন, যার পটভূমি ভারতবর্ষ এবং কলকাতা শহর। ৪৫টি অধ্যায়ে বিস্তৃত উপন্যাসটি দুভাগে ভাগ করা--প্রথম ভাগের নাম “আগস্ট২০--মশা দিবস”, ১ থেকে ২৩ অধ্যায়; দ্বিতীয় ভাগ “পরের দিন”, ২৪ থেকে ৪৫ অধ্যায়। মূল গল্পটি ১৯৯৫ সালের এই দুদিনের কাহিনি--কিন্তু গল্পের স্রোত সাবলীলভাবে এগিয়েছে পিছিয়েছে অনেক অনেক বার।
গল্পের শুরু ভবিষ্যৎ কালের ন্যু ইয়র্ক শহরে--“লাইভ ওয়াচ” নামে জাতিসংঘের একটি বিশেষ কাজের ভারপ্রাপ্ত এবং NGO সংস্থায়; সেখানে কর্মরত এক প্রত্নতত্ত্ববিদ অন্তর তাঁর কমপিউটারে খুঁজে পেলেন মুরুগন নামে রহস্যময় এক সহকর্মীর পরিচয়জ্ঞাপক অভিজ্ঞান (ID card)--মুরুগনকে শেষ দেখা গেছে ১৯৯৫ সালের কলকাতায়, তারপর থেকে তিনি বেপাত্তা। অন্তর শুরু করলেন মুরুগনের সুলুকসন্ধান এবং জমে উঠল রহস্যময়, উদ্ভট গল্প। বর্তমান উপন্যাসটির শুরু হয়েছে রোনাল্ড রস (১৮৫৭-১৯৩২) রচিত “নির্বাসনে” (In Exile”) কবিতাটির দুটি স্তবক দিয়ে-
“This day relenting God
Hath placed within my hand
A wonderous thing; and God
Be praised. At His command
Seeking His secret deeds
With tears and toiling breath,
I find thy cunning seeds,
O million-murdering Death.”
আমার অক্ষম অনুবাদে--
“আজ এই আমার ঈশ্বর
হাত ধরে দিলেন আমায়
সে এক বিচিত্র বস্তু হায়!
ধন্য হোক আমার ঈশ্বর।তাঁর হাতে অমোঘ বিধান
অশ্রু আর ঘামের নি:শ্বাসে
চাতুর্যের রক্তবীজ ভাসে,
লক্ষ কোটি মৃত্যুর নিধান।”
কে এই রোনাল্ড রস? আর “million-murdering Death” বলতেই বা কী বোঝায়? সেখানেই এই কল্পবিজ্ঞান গ্রন্থের প্রকীর্ণ গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক তথ্য। “কলকাতা শহরে বসে প্রথম নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন কে?”--এই অতিপরিচিত প্রশ্নের সহজ, সর্বজ্ঞাত এবং ভুল উত্তরই আমরা সকলেই জানি। সঠিক উত্তরটি এই উপন্যাসের মূল চরিত্র--গত শতাব্দীর এক উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব, ডাক্তার রোনাল্ড রস--ব্রিটিশ আমলে ভারতীয় মেডিক্যাল সার্ভিসের চিকিৎসক ও গবেষক, যিনি “million-murdering death” অর্থাৎ ম্যালেরিয়া রোগের জীবাণু আবিষ্কার করে রবীন্দ্রনাথের এগারো বছর আগে কলকাতার প্রথম নোবেল পুরস্কার পান। উপন্যাসের কাহিনি অনুযায়ী এই আবিষ্কার এবং তার পূর্বের ও পরের ঘটনাসমুহের মধ্যে এক গভীর রহস্য বিদ্যমান।
কে এই ডাক্তার রোনাল্ড রস? তিনি ঔপনিবেশিক ভারতের এক জটিল, উজ্জ্বল ঝলমলে চরিত্র। স্কটিশ ডাক্তার রোনাল্ড রসের জন্ম ভারতবর্ষের আলমোড়ায় ১৮৫৭ সালে সিপাহী বিদ্রোহের বছরে। বাবা ভারতবর্ষে দখলকারী ব্রিটিশ সেনাবাহিনির জেনারেল ছিলেন। রোনাল্ডের জীবনের স্বপ্ন ছিল লেখক হবার, কিন্তু পরিবারের চাপে পড়ে সেন্ট বার্থোলোমিউ মেডিক্যাল কলেজে নাম লেখাতে হয়। ১৮৮১ সালে ডাক্তারি পাশ করে পিতার পরামর্শমতো ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল সার্ভিসে চাকরিতে যোগ দেন। সারা দেশে তখন ম্যালেরিয়ার করাল ছায়া--এক নিযুতেরও বেশি মানুষের মৃত্যু হত এই মহামারীতে প্রতি বছর। দৈনন্দিন রুগিদের চিকিৎসার দায়িত্ব ছাড়াও ডাক্তার রস মনোনিবেশ করলেন ম্যালেরিয়ার গবেষণায় এবং সেই সূত্রে ১৮৯৪ সালে লন্ডনে গেলেন জীববিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর পড়াশোনার জন্যে। ফিরে এসে নতুন উদ্যমে শুরু করলেন গবেষণা। মশার সঙ্গে ফাইলেরিয়া রোগের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কটি খুঁজতে লাগলেন তন্ন তন্ন করে। সফলতা এলো ১৮৯৭ সালের ২০শে আগস্ট--যখন তাঁর ফাটা কাচের মাইক্রোস্কোপে ধরা পড়ল যে মহিলা এনোফিলিস মশার পাকস্থলীতে এবং ক্ষরণগ্রন্থিতে ম্যালেরিয়ার ভয়াবহ জীবাণু উপস্থিত। পুরো গবেষণাটাই ঘটেছিল কলকাতার পি.জি. হাসপাতালে।
জীবাণুটিকে আবিষ্কার করেই রস-সাহেব ক্ষান্ত দিলেন না। ততদিনে সিনকোনা গাছের খোঁজ মিলেছে এবং কুইনাইন অল্পস্বল্প পাওয়া যেতে শুরু করেছে। কিন্ত দেশের কোটি কোটি মানুষের কাছে কুইনাইন পৌঁছে দেওয়ার সামর্থ্য এবং সদিচ্ছার অভাব ছিল ব্রিটিশ সরকারের। ডাক্তার রস তিন দফা দাওয়াই বাতলালেন--স্থির জলে মশার প্রজনন বন্ধ করা; ওষুধপত্তর ছড়িয়ে মশার নিধন; এবং মশা ও মানুষের মধ্যে ব্যবধান সৃষ্টি করা। তাঁর পদ্ধতি অনুসরণ করে ম্যালেরিয়াকে বশে আনা সম্ভব হল আমাদের দেশে, মালয়ে এবং অন্যান্য অঞ্চলে। একই পদ্ধতি অবলম্বন করে ওয়াল্টার রিড হলুদ জ্বরকে বশে আনলেন কুবা ও মধ্য আমেরিকার অনেক দেশে। সত্যি কথা বলতে কি, ডাক্তার রসের আবিষ্কার ছাড়া পানামা খাল খনন সম্ভব হত কিনা সন্দেহ আছে।
রোনাল্ড বাবুর আরো বিশেষ অবদানগুলি গণিতে ও সাহিত্যে। তিনি নানা গাণিতিক সমীকরণ ব্যবহার করেছিলেন ম্যালেরিয়ার গবেষণায়। সেগুলি রস সমীকরণ নামে খ্যাত এবং এখনও ব্যবহার হয় মহামারী নিরোধে--ফলিত গণিতের নতুন শাখা “প্যাথোমেট্রিক্স”-এ। অন্যদিকে তাঁর রচিত সাহিত্যের গ্রন্থের সংখ্যাও প্রচুর--গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, নাটক ও কবিতা--সেগুলির বিক্রি হত ভালই। তিনি ১৯২৩ সালে আত্মজীবনী লেখেন--বইটি খুব সম্ভবত এখন ছাপা নেই। পশ্চিমের সাহিত্যরসিকেরা প্রায়ই খেদ প্রকাশ করতেন, কেন যে উনি পাণ্ডববর্জিত, নেটিভদের দেশে ডাক্তারি করে বেড়ান? ১৯০২ সালে তিনি চিকিৎসা বিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পান। পুরো সময় সাহিত্যচর্চা করলে সাহিত্য-নোবেল পাওয়াও অসম্ভব ছিল না। শেষ জীবনে তিনি রস ইন্সটিটিউট অফ ট্রপিক্যাল মেডিসিন স্থাপনা করেন। ১৯৩২ সালে ব্রিটেনে এই সদাশয় মানুষটির মৃত্যু হয়।
The Glass Palace ('কাচের প্রাসাদ' ২০০০)
বর্মা আমাদের প্রতিবেশী এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ দেশ। ভারতবর্ষের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ দু হাজার বছরেররও বেশি সময় ধরে। সংস্কৃতভাষী পিউ সাম্রাজ্যের রাজধানী স্থাপিত হয়েছিল দক্ষিণ বর্মার শ্রীক্ষেত্র শহরে খ্রীষ্টপূর্ব প্রথম শতাব্দীতে। অষ্টাদশ শতাব্দীতে ভারতবর্ষ ব্রিটিশের পরাধীন হলেও বর্মা ছিল স্বাধীন। ১৮২৪ সালে শুরু হয় ব্রিটেনের সঙ্গে যুদ্ধ; প্রথম সংঘাতে ব্রিটেন আসাম, মণিপুর এবং আরও কিছু অংশ ছিনিয়ে নিলেও বর্মার বাকি অংশ যুদ্ধ চালিয়ে যায় ৬২ বছর। ১৮৮৬ সালে পুরো দেশটি ব্রিটেনের কবলে আসে। তাদের ন্যায়বিচারের একটি নমুনা--মোঘলসম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরকে (১৭৭৫ - ১৮৬২) দিল্লি থেকে নির্বাসনে পাঠানো হয় রেঙ্গুনে, আবার ব্রহ্মদেশের রাজা মিন থিবাউকে (১৮৫৯ - ১৯১৬) নির্বাসনে পাঠানো হয় বম্বের কাছে রত্নগিরিতে। ১৯৩৭ সাল পর্যন্ত দেশটি ব্রিটিশ ভারতের অংশ ছিল, তারপর তাকে দেওয়া হয় আলাদা অস্তিত্ব। ব্রিটিশদের বিভাজন ও শাসন পদ্ধতি অব্যাহত ছিল ব্রহ্মদেশেও--সেখানে স্থানীয় মানুষদের বদলে চিনে এবং ভারতীয়দের নানান সরকারী সুযোগ-সুবিধা দান করে দীর্ঘকালীন সাম্প্রদায়িকতা এবং সন্দেহ বিবাদের সৃষ্টি করা হয়। সেই বিষবৃক্ষের জের চলছে এখনও--মন, ক্যারেন, রোহিঙ্গা প্রভৃতি উপজাতিগুলির বিবাদে প্রায় গৃহযুদ্ধের মতন অবস্থা।
লেখকের আত্মীয়স্বজনেরা বংশানুক্রমে বসবাস করেছেন বর্মায়, ঘষামাজা কাঠের (টিম্বার) রপ্তানীর ব্যবসা ছিল তাঁদের। শৈশবে বর্মার গল্প শুনেছেন তিনি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানি আক্রমণের ভয়ে রেঙ্গুন ও অন্যান্য শহর ফাঁকা করে প্রায় পাঁচ লক্ষ উদ্বাস্তু (বেশির ভাগ ভারতীয়) পায়ে হেঁটে ভারতের দিকে রওনা হন--ঘটনাটি ‘লং মার্চ’ নামে খ্যাত। এঁদের মধ্যে অনেকেই বাঙালি। মাত্র তিরিশ হাজার মানুষ পৌঁছেছিলেন ভারত সীমান্তে। কবি বিনয় মজুমদার (১৯৩৩-২০১৬) তাঁদের মধ্যে একজন। বাকিদের মৃত্যু হয় পথশ্রমে, অনাহারে, অসুখে বা হিংস্র পশুর আক্রমণে। এই শোচনীয়, করুণ ঘটনাটির বিষয়ে ভারতীয় ইতিহাস ও সাহিত্য উভয়েই আশ্চর্যজনকভাবে নীরব। দেশটি লেখককে আকর্ষণ করে দুটি কারণে--প্রথমটি ব্যক্তিগত-- পারিবারিক স্মৃতিকে কল্পনার রঙে সাজিয়ে পরিবেশন করা--জানতে ইচ্ছা করে চরিত্রগুলির মধ্যে কতজন রক্ত মাংসের মানুষ এবং তাদের জীবনের ঘটনাগুলি কতটা বাস্তব। দ্বিতীয়, দেশটি নিয়ে তাঁর আগ্রহ--দেশটি সভ্যসমাজে থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন এবং তার নাগরিকেরা জঙ্গী সরকারের বুটের তলায় নিস্পেষিত।
কাহিনির শুরু ১৮৮৫ সালে মান্দালয় শহরে রাজা মিন থিবাউএর কাচের প্রাসাদে, সেখানে তাঁর রাণী সুপায়ালাত (১৮৫৯ - ১৯২৫) নানা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত; তাঁর পরিচারিকা ডলি উপন্যাসের এক প্রধান চরিত্র। মাতৃপিতৃহীন এগারো বছর বয়েসি চট্টগ্রামের বালক রাজকুমার এসে পৌঁছয় সেখানে। কিছুদিনের মধ্যে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর কর্নেল স্পাডেন শহরটি দখল করেন এবং রাজপরিবারকে নির্বাসিত করা হয় প্রথমে মাদ্রাজ এবং পরে বম্বের ১২০ মাইল দক্ষিণে রত্নগিরির আউটরাম হাউসে। ১৯০৫ সালে রত্নগিরির কালেকটারের পদে নিযুক্ত হন বেণী প্রসাদ দে ( বয়েস ৪১); তিনি এবং তাঁর স্ত্রী উমা (বয়েস ২৬) জড়িয়ে পড়েন রাজপরিবারের নাটকে। ডলির সঙ্গে উমার বন্ধুত্ব হয়। রাজকন্যারা প্রেমে পড়তে শুরু করেন স্থানীয় যুবকদের সঙ্গে। ডলি ও রাজকুমারের সাক্ষাৎ হয় আবার এবং বিবাহ--এই দম্পতি ও তাঁদের দুই সন্তান নীলাদ্রি ও দীননাথকে নিয়ে কাহিনির আর একটি শাখা। গল্প এগিয়ে চলে ভারতবর্ষে, বর্মা, ইওরোপে, আমেরিকায়, মালয় ও সিঙ্গাপুরে--নানান শাখা-প্রশাখা ও অসংখ্য চরিত্র। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ, দুই দেশের স্বাধীনতা, বর্মার জঙ্গী শাসন, আঙ সান সু-চির গণতান্ত্রিক আন্দোলনের স্রোতে গল্প এগোয় বিংশ শতাব্দীর শেষ অবধি।
মূলত: কয়েকটি পরিবারের শতাধিক বছরের সুখদু:খের কাহিনি হলেও তার সঙ্গে মিশেছে দুটি দেশের জড়িত ইতিহাস এবং ব্রিটিশ শাসনের নৃশংস ও শোচনীয় ফলাফল। কথাসাহিত্যে ব্রিটিশ শাসনের এমন তুলোধোনা এবং গায়ে-জ্বালা ধরানো সমালোচনা খুব একটা দেখা যায় না। লেখক সরাসরি ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে কিছু বলেন না--আসলে তার দরকারই পড়ে না--স্থানীয় মানুষদের সঙ্গে ব্রিটিশ কর্তাব্যক্তিদের আচরণ চোখে আঙুল দিয়ে বর্ণনা করলেই হল, বা সেনাবাহিনীতে ভারতীয় সিপাহীদের সঙ্গে ব্রিটিশ অফিসারদের অহমিকাসর্বস্ব, আত্মকেন্দ্রিক ব্যবহারগুলি দেখিয়ে দিলেই চলবে। পাঠকপাঠিকা বুঝে নেবেন বাকিটা। লেখককে এই অন্তর্লীন ব্রিটিশদের সমালোচনা নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি জানান, “If this is true, then it would have to be said that colonialism has had a pretty easy ride.”
২০০১ সালে লেখক খবর পেলেন যে উপন্যাসটি কমনওয়েলথ লেখক পুরস্কারের জন্যে মনোনীত হয়েছে--খবর পেয়েই তিনি যোগাযোগ করলেন উদ্যোক্তাদের সঙ্গে এবং সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করলেন সেই মনোনয়ন। এর আগে এই পুরস্কার পেয়েছিলেন নয়নতারা সায়গল, শশি থরুর (১৯৯০), অমিত চৌধুরি (১৯৯২), সালমন রুশদি (২০০০) প্রমুখেরা। লেখকের মতে কমনওয়েলথ-এর লেখক কথাটাই অর্থহীন এবং যে দেশগুলিকে নিয়ে কমনওয়েলথ গঠিত সেখানে ইংরেজি ছাড়া অন্যান্য ভাষাতেও উচ্চ মানের সাহিত্য রচিত হয়, সুতরাং কেবল ইংরেজিতে লেখা সাহিত্যের জন্যে পুরস্কার দেবার মানে কী? প্রধানত পৃথিবী-বিস্তৃত ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের গৌরবোজ্জ্বল স্মৃতিকে চিরস্মরণীয় করে রাখা ছাড়া? তিনি একজন ভারতীয় লেখক, যিনি পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে বাস করেন এবং ইংরেজি ভাষায় লেখেন।
The Hungry Tide ('ভাটির দেশ', ২০১৪)
অসাধু সিদ্ধার্থের পাঁচ-বছর ব্যাপী অপশাসনের সমাপ্তি ঘটিয়ে ১৯৭৭ সালে বামফ্রন্ট সরকার শাসন ক্ষমতায় আসে পশ্চিমবঙ্গে। সুশাসনের আশায় স্বস্তির নি:শ্বাস ফ্যালে মানুষ। ১৯৪৭-এর পর থেকেই পূর্ব পাকিস্তান থেকে দলে দলে ছিন্নমূল মানুষেরা আসছেন পশ্চিমবঙ্গে। ধনী ও মধ্যবিত্তেরা রয়ে গেছেন কলকাতার আশেপাশে ও পশ্চিমবঙ্গের অন্যান্য স্থানে আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে এবং অনেক দু:খে-কষ্টে পরিশ্রমে নিজেদের পায়ে দাঁড়িয়েছেন আবার। দরিদ্রদের স্থান হয়েছে ফুটপাথে এবং রেলের প্ল্যাটফর্মে--অনেককে পুনর্বাসন দেওয়া হয়েছে উড়িষ্যা ও মধ্যপ্রদেশের সীমান্তে দণ্ডকারণ্য অঞ্চলে। বিরোধী দলে থাকার সময় বামপন্থীরা নিয়মিত দাবী জানিয়েছেন যে বাঙালি উদ্বাস্তুদের দণ্ডকারণ্য থেকে ফিরিয়ে এনে পশ্চিমবঙ্গে পুনর্বাসন দেওয়া হোক। তাই তাঁরা ক্ষমতায় আসার পর দণ্ডকারণ্য থেকে দলে দলে উদ্বাস্তুরা আসতে শুরু করেন পশ্চিমবঙ্গে। ১৯৭৮ সালের মে মাস নাগাদ তাঁদের মধ্যে প্রায় তিরিশ হাজার মানুষ আশ্রয় নেন সুন্দরবন অঞ্চলের মরিচঝাঁপি দ্বীপে। দ্বীপটি অরণ্য অঞ্চল হিশেবে সংরক্ষিত এবং সেখানে প্রচুর সংখ্যায় মানুষ বসবাস করলে পরিবেশগত সমস্যাও অনেক। ১৯৭৯ সালের জানুয়ারি মাসে দ্বীপটির অবরোধ করা হয়। সেই বছরের ১৪ থেকে ১৬ই মে বলপূর্বক উচ্ছেদ করা হয় উদ্বাস্তুদের। মৃত্যু হয় চার হাজারের বেশি নারী-পুরুষ-শিশুর। পরবর্তী পঁচিশ বছরে মরিচঝাঁপি নামটি বাঙালির চেতনা থেকে মূলত: অপসৃত।
“ভাঁটা” এবং “জোয়ার” (লেখক বাংলা নামগুলিই ব্যবহার করেছেন, সঙ্গে তাদের ইংরেজি অর্থ “The Ebb” এবং “The Flood”)--দুই পর্বে বিভক্ত “The Hungry Tide” উপন্যাসটি এক অর্থে একটি জলজ অ্যাাডভেঞ্চার আবার অন্য অর্থে এক ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিতে প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের জীবনসংগ্রামের কাহিনি। সুন্দরবনে বাস করতেন এক আদর্শবাদী স্কুলশিক্ষক নির্মল ও তাঁর স্ত্রী নীলিমা। তাঁদের আত্মীয় কানাই ছেলেবেলায় কিছুদিন কাটিয়েছিল তাঁদের আতিথ্যে--তিনি এখন দিল্লিতে বসবাসকারী অনুবাদক এবং উদ্যোগপতি। নির্মলের মৃত্যু হয়েছে ১৯৭৯ সালে (মরিচঝাঁপির সমসময়ে) এবং বহুকাল পরে তাঁর রচিত একটি জার্নাল খুঁজে পাওয়া গেছে, সেটি নির্মল রেখেছিলেন কানাই-এর জন্যে। কানাই দ্বিতীয়বার চলেছেন নীলিমার কাছে সুন্দরবনে; ট্রেনে তাঁর সঙ্গে পরিচয় পিয়ালী রায়ের; যিনি জন্মসূত্রে বাঙালি, বড় হয়েছেন আমেরিকায় এবং গবেষণা করেন সেটোলজি অর্থাৎ সামুদ্রিক প্রাণীবিদ্যায়। পিয়ালী ইরাওয়াদি ডলফিন (বৈজ্ঞানিক নাম Orcaella Brevirostris) জীবনযাত্রা নিয়ে অনুসন্ধান করতে চান সুন্দরবনের কাছাকাছি বঙ্গোপসাগরে। স্থানীয় যুবক ফকিরের ডিঙিনৌকায় দুজনে যাত্রা করেন সমুদ্রে।
নির্মল তাঁর শিক্ষকতার চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পরে অপরিচিত এক রমণীর (ফকিরের মা কুসুম) খোঁজে মরিচঝাঁপি দ্বীপে যান এবং জড়িয়ে পড়েন সেখানকার উদ্বাস্তুদের উচ্ছেদকারী আন্দোলনে। পুলিসের গুলিতে মৃত্যু হয় কুসুমের কিন্তু রক্ষা পায় পাঁচ বছরের ফকির। কানাই-এর পাঠ করা নির্মলের জার্নালের দীর্ঘ অংশ এই উপন্যাসের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ--কাব্যময় ভাষা, স্বপ্নময় প্রকৃতির বর্ণনা এবং রিলকের কবিতার উদ্ধৃতির সমারোহে পূর্ণ। আমি যেহেতু বইটি কাগজের পৃষ্ঠায় পড়িনি, কিন্তু ফিরদৌস বামজির কন্ঠে চোদ্দটি এক ঘন্টার সিডি তে শুনেছি--আমার কানে বিশেষভাবে উপভোগ্য এই জার্নালের অংশগুলি।
বর্তমান কালের কাহিনি এগিয়ে চলে কানাই, পিয়ালী আর ফকিরকে নিয়ে। ডিঙিনৌকায় পিয়ালী ও ফকিরের সমুদ্রযাত্রার অপরূপ ভয়ংকর বর্ণনা। সমুদ্রে সাইক্লোন শুরু হলে ফকির দক্ষ হাতে নৌকাটি তীরে নিয়ে আসে গর্জনতলায় এবং সেখানকার উচ্চতম গরান গাছ চড়ে কাণ্ডের সঙ্গে দুজনকেই বাঁধে, ঝড়ের হাত থেকে বাঁচতে। শেষ পর্যন্ত পিয়ালীর প্রাণ বাঁচাতে মৃত্যু হয় ফকিরের। পিয়ালী স্থির করেন তিনি সুন্দরবন অঞ্চলেই পাকাপাকি ভাবে বসবাস করবেন ডলফিন ও অন্যান্য জনহিতকর কাজে। কাহিনির সমাপ্তিকে মিলনাত্মক করার লোভ সামলাতে পারেননি লেখক, সেই কারণে খানিকটা দুর্বল হয়ে পড়েছে ভারত বাংলাদেশ ও সমুদ্রের সীমান্তে, প্রাকৃতিক ও মানবতার ইতিহাসময় এই সুন্দর ও রহস্যময় উপন্যাসটি।
উপন্যাসের চরিত্রগুলি কাল্পনিক, দুটি প্রধান ঘটনাস্থল লুসিবাড়ি এবং গর্জনতলাও তাই (লুসিবাড়ি নামটি কাল্পনিক হলেও সুপ্রযুক্ত। স্যার ড্যানিয়েল হ্যামিল্টন (১৮৬০-১৯৩৯) নামে এক আদর্শবাদী ব্রিটিশ সুন্দরবনে দশ হাজার একর জমি কিনে একটি কমিউন বানিয়েছিলেন। সেখানে তিনি গরীব চাষী ও জেলেদের বিনামূল্যে বসবাস করতে দিতেন এক শর্তে--কোন রকম জাতিভেদ চলবে না। তাঁর স্ত্রীর নাম লুসি, অতএব তাঁর নামে গ্রামের নাম লুসিবাড়ি হতেই পারে। ১৯৩৯ সালে হ্যামিল্টনের মৃত্যু হয়। লেখকের কাকা সতীশচন্দ্র ঘোষ গোসাবায় ড্যানিয়েল হ্যামিল্টন প্রতিষ্ঠিত হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক এবং হ্যামিল্টন এস্টেটের ম্যানেজারের কাজ করতেন। কাচের প্রাসাদের মতন এখানেও পারিবারিক স্মৃতি তাঁর অন্যতম অনুপ্রেরণা।), কিন্তু ক্যানিং, গোসাবা, বা মরিচঝাঁপি প্রভৃতি অঞ্চলগুলির ইতিহাস সঠিক ও বাস্তব। রয়েছে শুভ আর অশুভের দ্বন্দ্ব; বনবিবির সঙ্গে দক্ষিণরায়; উদ্বাস্তুদের সঙ্গে আক্রমণকারী পুলিসের। আর জলের নিকটে যেমন মলিন হয়ে যায় ভারত আর বাংলাদেশের ভৌগোলিক সীমানা, তেমনি পিয়ালী আর ফকিরের ঘনিষ্ঠিতায় মিলিয়ে যায় সামাজিক আর অর্থনৈতিক সীমারেখাও। আর ইতিহাসের কাছে দায়বদ্ধ লেখক বাঙালির সাম্প্রতিক কালের জোর করে ভুলে যাওয়া এক কলঙ্কময় অধ্যায়কে সাবলীলভাবে তুলে ধরেন পৃথিবীর সামনে।
The Sea of Poppies (পপির সাগর ২০০৮)
উনবিংশ শতাব্দীতে চিনের সঙ্গে ইয়োরোপের ঔপনিবেশিক শক্তিগুলির (মূলত: ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স) তুমুল যুদ্ধ হয়েছিল দুবার--ইতিহাসে তাদের নাম “আফিম যুদ্ধ” (The Opium Wars)। প্রথমবার যুদ্ধ চলে ১৮৩৯ থেকে ১৮৪২ সন আর দ্বিতীয়বার ১৮৫৬ থেকে ১৮৬০। দুবারই চিনের পরাজয় ঘটে যুদ্ধে।
ষোড়শ শতক থেকেই ইয়োরোপের সঙ্গে চিনের ব্যবসা বাণিজ্যের শুরু--কিন্তু পণ্যদ্রব্যের আদানপ্রদান প্রধানত: একমুখী। চিনের উৎপন্ন করা চা, রেশমের পোষাক এবং চিনেমাটির বাসনপত্রের প্রচুর চাহিদা ব্রিটেনে; অন্যদিকে চিন পণ্যদ্রব্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ, সেখানে বিশেষ চাহিদা ছিল না ইয়োরোপের পণ্যের! ফলে বিশাল বাণিজ্য ঘাটতি--বর্তমান কালের চিনের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যের মতই। প্রতি বছর ব্রিটেনকে দিতে হত লক্ষ লক্ষ রৌপ্য মুদ্রা।
কিন্তু দুর্জনের কখনও ছলের অভাব হয় না--চিনের মানুষের আফিমের নেশার কথা সবাই জানে। ১৭৭৩ সালে ভারতের গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস (১৭৩২-১৮১৮) সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি আফিমের অন্যায় ও একচেটিয়া বাণিজ্য করবেন, ভারিতীয় চাষিদের দিয়ে জোর করে আফিম চাষ করাবেন এবং তার থেকে ভাল মানের আফিম বানিয়ে বলপূর্বক চিনে রপ্তানি করবেন। চিনের সম্রাটের ক্ষমতা ছিল না জোর করে ব্রিটেনকে বাধা দেবার--প্রথম পঞ্চাশ বছরে দেখা গেল সওয়া কোটি চিনের নাগরিক আফিমের নেশাগ্রস্ত এবং প্রতি বছর ৯০০-টনের বেশি আফিমের সামুদ্রিক যাত্রা কলকাতা বন্দর থেকে চিনের পূর্ব উপকূলের নানান বন্দরে। এই পটভূমিতেই অমিতাভ ঘোষের “পপির সাগর” উপন্যাসের সূত্রপাত--বহু আলোচিত আইবিস (IBIS) ট্রিলজির প্রথম গ্রন্থ। দুটি যুদ্ধেই চিনের পরাজয় ঘটে; ব্রিটেন দখল করে নেয় হংকং বন্দরটি; রমরমা চলে আফিম আমদানীর ও ব্যবহারের সারা চিন দেশে। দুর্বল হয়ে যায় চিং (Qing) রাজবংশ--১৯১১ সালে তাদের পতন ঘটে এবং সান- ইয়াত সেন (১৮৬৬-১৯২৫) এর নেতৃত্বে গড়ে ওঠে জাতীয়তাবাদী সরকার; কিন্তু দমন করা যায় না আফিমের নেশা। শেষ পর্যন্ত ১৯৪৯ সালের কমিউনিষ্ট বিপ্লবের পর চিন থেকে আফিম নির্মূল করেন চেয়ারম্যান মাও সে তুং (১৮৯৩-১৯৭৬)।
পূর্বভারতে নীল চাষ এবং নীলকর সাহেবের অত্যাচার নিয়ে সাহিত্য রচনা হয়েছে, কিন্তু আফিমের চাষ নিয়ে বিশেষ হয়নি--সেই শূন্যস্থানটি পূরণের কাজ শুরু করলেন অমিতাভ ঘোষ। তাঁর কাহিনির শুরু ১৮৩৮ সালে, প্রথম আফিম যুদ্ধ শুরু হবার প্রাক্কালে। স্থান উত্তর প্রদেশের গাজিপুর, যেখানে দিতি নামে এক গৃহবধূ কাজ করে পরিবারের পপির ক্ষেতে, তার স্বামী কাজ করে ব্রিটিশ পরিচালিত আফিমের কারখানায়; দিতি মাঝে মাঝেই স্বপ্ন দেখে উঁচু-মাস্তুল-ওলা এক জাহাজের।
সেখান থেকে ৪০০ মাইল দূরে কলিকাতা বন্দরে নোঙর করে “আইবিস” (IBIS) নামের জাহাজ। জাহাজটির পূর্বের কাজ ছিল আফ্রিকার পশ্চিম উপকূল থেকে কালো মানুষদের বলপূর্বক ধরে বেঁধে ক্রীতদাস হিশেবে আমেরিকার বিভিন্ন অঞ্চলে নিয়ে যাওয়া। এখন সেটি মেরামত করে পরবর্তী যাত্রার জন্যে সুসজ্জিত করা হচ্ছে--“চুক্তিবদ্ধ কুলি”দের (Indentured Labourers) ভারতবর্ষ থেকে নিয়ে যাওয়া হবে মরিশাসের আখের ক্ষেতে কাজ করার জন্যে। সেই কুলি-কামিনদের স্থানীয় হিন্দি নাম “গিরমিটিয়া”--যেটি “agreement” শব্দের অপভ্রংশ। মরিশাস তখন ব্রিটেনের একটি “অপরাধীদের উপনিবেশ” বা penal colony--যেখানে অপরাধী কম পড়লে কর্মী হিশেবে পাঠানো হত গিরমিটিয়াদের।
সমদ্রের অপরূপ বর্ণনা এবং উনবিংশ শতাব্দীর জাহাজি জীবনযাপনের অনুপুঙ্খ; রক্ত-জল করা ডিটেইল সুধী পাঠককে মনে করিয়ে দেবে হার্মান মেলভিল (১৮১৯-১৮৯১) অথবা জোসেফ কনরাডের (১৮৫৭-১৯২৪) প্রবাদপ্রতিম উপন্যাসগুলির কথা; শক্ত মাটির ওপরে ঘটে যাওয়া ঘটনাসমূহও কিছু কম নাটকীয় নয় তার তুলনায়। যদিও তিন খণ্ডের একটি উপন্যাস--ট্রিলজির প্রথম খণ্ডটি পড়ে বলা মুশকিল পুরো রচনাটি কেমন হবে, কাহিনিটি যেন হঠাৎই শেষ হয়ে যায়--চরিত্রগুলির জীবন ও ভবিষ্যৎ তখনও ক্ষীণ সুতোয় খুলছে। ‘পপির সাগর’ হয়ে উঠতে পারে একবিংশ শতাব্দীর এক প্রথম সারির মহতী উপন্যাস-- আইবিস ট্রিলজির প্রথম অংশ হিশেবে। ইতিহাস ও সাহিত্যের দীর্ঘ, জটিল, মধুর সম্পর্কটিকেও জোরালো করতে সাহায্য করবে।
দিতি ছাড়া এই উপন্যাসের অন্য দুটি মূল চরিত্র হল মার্কিন নাবিক জ্যাকারি রিড এবং বাঙালি জমিদার নীল রতন হালদার। জ্যাকারি আমেরিকার বাল্টিমোর বন্দর থেকে এই জাহাজ পরিচালনা করে এনেছেন--তিনি বর্ণসংকর, তাঁর শরীরে কৃষ্ণকায়ের শোণিত, কিন্তু সেই তথ্য তিনি গোপন করেছেন। নীলরতন রকশালির জমিদার, কিন্তু তার পড়ন্ত অবস্থায় তিনি টাকা ধার নিয়ে ছিলেন অসৎ ব্যবসায়ী, আফিম রপ্তানিকারক এবং ভণ্ড ধার্মিক বেনজামিন বার্নহ্যামের কাছ থেকে। তঞ্চকতার মিথ্যে অভিযোগে তাঁর সাত বছরের সশ্রম নির্বাসন মরিচদ্বীপে অর্থাৎ মরিশাসে। বার্নহ্যাম এই কাহিনির খলনায়ক; তাঁর একটি উল্লেখযোগ্য উক্তি, “If it is God’s will that opium be used as instrument to open China to his teachings, then so be it. For myself, I confess I see no reason why any Englishman should abet the Manchu tyrant in depriving the people of China of this miraculous substance”.
আরো অনেক করুণ রঙিন চরিত্রের ভিড় এই উপন্যাসে--ফরাসি যুবতী পলেট, তার বাঙালি বান্ধব যদু, বার্নহ্যামের বাঙালি নায়েব বাবু নবকৃষ্ণ, জ্যাকারির সহকারী সারেং আলি, দিতিকে সতীপ্রথা থেকে উদ্ধারকারী ও তার দ্বিতীয় স্বামী দৈত্যাকার কালুয়া। লেখক মূলত: উনবিংশ শতাব্দীর দুই প্রধান ঐতিহাসিক ও অর্থনৈতিক থিমকে নাটকীয়তা প্রদান করেছেন, প্রথম, চিনের বাজারের জন্যে বাংলা ও বিহারে অর্থকরী ফসল হিশেবে আফিমের কৃষিকর্ম এবং দ্বিতীয়, মরিশাস, ফিজি আর ত্রিনিদাদে ব্রিটিশ জমিদারদের আখের ক্ষেতে হাড়ভাঙা পরিশ্রম করার জন্যে হাজার হাজার চুক্তিবদ্ধ মজুরের রপ্তানী। শিল্পবিপ্লবের পূর্ববর্তী স্কটল্যান্ডকে স্যার ওয়াল্টার স্কট (১৭৭১-১৮৩২) যেভাবে জীবন্ত ও সরব করে তুলেছিলেন তাঁর ঐতিহাসিক উপন্যাসগুলিতে, আশা করি লেখক ব্রিটিশ ভারতের বর্ণনায় তার কাছাকাছি পৌঁছাতে পারবেন। সব চরিত্রগুলি এসে জড়ো হয়ে আইবিস জাহাজে এবং গল্প এগিয়ে চলে--অনেক সংঘাতে ও রক্তপাতের পর যদু, নীল, সেরাঙ আলি, কালুয়া এবং আহ ফ্যাট নামে এক নেশাড়ু চিনে জাহাজ ছেড়ে চলে যায় জেলে ডিঙি চড়ে। সমুদ্রের ঢেউয়ে ঢেউয়ে তারা কোথায় পৌঁছাবে কে জানে? অবশ্যই শুরু হবে আফিম যুদ্ধ এবং কাহিনির সূত্র এগিয়ে চলবে চিন, ভারত ও মরিচদ্বীপে। আমরা অপেক্ষায় থাকবো।
আইবিস ট্রিলজির দ্বিতীয় খণ্ড "The River of Smoke" ('ধূম্রময় নদী') প্রকাশিত হয়েছে ২০১১ সালে--স্থানাভাবে সেই গ্রন্থটির আলোচনা করা গেল না বলে দু:খিত। অন্তিম খণ্ডের নাম "Flood of Fire" ('অগ্নিবন্যা') প্রকাশিত হয়েছে ২০১৫ সালে। এই দুটি উপন্যাস থেকে জানা গিয়েছে আফিম যুদ্ধের ইতিহাস এবং ভারত ও চিনের মধ্যে মানবিক যোগাযোগের অনেক অজানা তথ্য।
দুই দশকের অধিক দীর্ঘ জীবনে অমিতাভ ঘোষ জীবন্ত রূপ দিয়েছেন অসংখ্য চরিত্রকে, ঘোরাফেরা করেছেন তাদের স্মৃতির ও কল্পনার অতলে। সেই সঙ্গে তিনি খেয়াল রেখেছেন ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিত। তাঁর নিজের কথায়, “We are in a moment where the future is still unborn and the past is not quite dead.” ইতিহাস এগিয়ে চলে তার আপন গতিতে, কিন্তু তার অনেক গুরুত্বপূর্ণ অংশ রয়ে যায় অন্ধকারে।
দক্ষ লেখক কল্পনার আলো ফেলে উদ্ভাসিত করতে পারেন সেই অংশগুলিকে। জয়ী মানুষেরাই শেষ পর্যন্ত পৃথিবীর ইতিহাসে লিখতে সমর্থ হয়। লেখকের সৃষ্টি করা চরিত্রগুলিকে প্রধানত পরাজিত মানুষ, ঘরছাড়া এবং দিশেহারা--কিন্তু তাদের দৃষ্টিভঙ্গি থেকেও ইতিহাসকে নতুন করে লেখা সম্ভব। তিনি খুলে দিয়েছেন উপন্যাসের নতুন নতুন দিগন্ত--কখনও তিনি ঐতিহাসিক, কখনও সাংবাদিক, কখনও সমাজবিজ্ঞানী, কখনও বা নৃতত্ত্ববিদ। এবং সব মিলিয়ে তাঁর রচনাবলী সাহিত্য ও ইতিহাসের এক নিপুণ যুগলবন্দী।
অমিতাভ ঘোষের গ্রন্থপঞ্জী:
কথাসাহিত্য
১। The Circle of Reason; প্রকাশ ১৯৮৬
২। The Shadow lines; প্রকাশ ১৯৯০
৩। The Calcutta choromosome; প্রকাশ ১৯৯৫
৪। The Glass palace; প্রকাশ ২০০০
৫। The Hungry Tde; প্রকাশ ২০০৪
৬। Sea of poppies; প্রকাশ ২০০৮
৭। River of Smoke; ,প্রকাশ ২০১১
৮। Flood of Fire; প্রকাশ ২০১৫
নন-ফিকশান
১। In an Antique land; প্রকাশ ১৯৯২।
২। Dancing in Combodia, At large in Burma; প্রকাশ ১৯৯৮।
৩। Countdown; প্রকাশ ১৯৯৯।
৪। The Imam and The Indian; প্রকাশ ২০১২।
৫। Incendiary Circumstance; প্রকাশ ২০০৬।
৬। The Great Derangement: Climate Change and the Unthinkable (2016)
অমিতাভ ঘোষের উপরে লেখা গ্রন্থ
১। Amitav Ghosh, by Anshuman Ahmed Mondal; Manchestar Iniversity Press, Canada; 2007
২। Amitav Ghosh: An Introduction by John C Howley; Foundation Books, New Delhi; 2005