“ওরে ওঠ, যাবি না পুজোতে?”
“উফ, মা – ছুটিতে এসে কেউ এতো সকালে ওঠে? চা দেবে তো, নাকি?”
“চা হবে না এখন। আমাকে তো রথ টানতে যেতে হবে। ফিরে এসে ওসব হবে। তুই যাবি কি না বল।”
“উফফফ – না, যাবো না! হয়েছে?”
সঞ্জয়ের মা আর কথা বাড়ালেন না। আজকালকার ছেলেরা কলেজে ঢুকে সব লায়েক হয়ে যায়, কথা শোনে না। তাছাড়া দেরিও হয়ে গেছে, বাকিরা রথের সামনে ওঁদের জন্যে অপেক্ষা করছে। সঞ্জয়ের বাবা তো সকালবেলায় চান সেরে তৈরি হয়ে আছেন। দেয়ালে ঝোলানো ঠাকুরের আর অন্য ছবিতে প্রণাম করে দুজনে জোর কদমে হাঁটা লাগালেন পুজোতলার দিকে।
গ্রামের নাম সঙ্গমনের। পুনার থেকে কমবেশি ১৪০ কিলোমিটার দূরে, প্রভারা নদীর ধারে অখ্যাত একটি জনপদ। এখানে প্রভারার সঙ্গে মালুঙ্গি আর মহানুটি নামের আরো দুটি শাখানদী এসে মিলেছে, তার থেকে নাম।
সঙ্গমনের গ্রামের একমাত্র গৌরব এর প্রাচীন হনুমান মন্দিরটি। কতদিনকার মন্দির কে জানে, তবে পুরোনো বটে। বছরে একবার ধুমধাম করে এটাতে হনুমানজয়ন্তী উদযাপন করা হয়। সেদিন পুজো হয়, হনুমানের রথ বেরয়, লোকেরা এ ওর গায়ে আবীর দেয়। ওই একটা দিনেই এই ঝিমিয়ে পড়া বৃদ্ধ জনপদটি মুখে রং-পমেটম মেখে বেশ সেজে ওঠে।
আজ সেই দিন।
সঞ্জয় উঠেই পড়লো। সাতসকালে মায়ের ডাকাডাকিতে ঘুমটাই চটকে গেছে। এদিকে বাড়িতে এখন চা-ও পাওয়া যাবে না। দুত্তোর! বলে পায়ে চটিটা গলিয়ে সঞ্জয় বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়লো। গ্রামের একমাত্র রেস্তোরাঁ-কাম-চায়ের দোকান হচ্ছে মোহনকাকার দোকান। সব্বাইকার গুলতানি মারবার জায়গা। আজকে অবশ্য মোহনকাকা মহা ব্যস্ত থাকবে, কিন্তু চা তো পাওয়া যাবে!
মোহনকাকা সকাল থেকে সত্যিই ব্যস্ত। দোকান ধোয়া চলছে বালতি বালতি জল ঢেলে। এরপর শুরু হবে সকালের জলখাবার বানানো। থালিপীঠ, সাবুদানার খিচুড়ি, কান্দা-পোহা। আজকে বেশি করে তৈরি হবে, রথ টানার পর লোকেরা হামলে পড়বে তো। একটু বেলা বাড়লে পুরনপুলীও তৈরি হবে, আর কোথমির বড়া। তাই সঞ্জয়কে দেখেই খেঁকিয়ে উঠলো “এখন কিছু হবে না, কেটে পড়ো হে!”
“মোহন, চা হবে নাকি?” পেছন থেকে মাস্টারমশাইয়ের গলা শোনা গেল।
মাস্টারমশাইয়ের বয়েস হয়েছে। দীর্ঘদিন গ্রামের একমাত্র স্কুলে মাস্টারি করে অনেককাল হলো রিটায়ার করেছেন। কিন্তু সবাই এখনো মাস্টারমশাই-ই বলে ডাকে ওনাকে। মাস্টারমশাইরা এই গ্রামেরই বাসিন্দা, অনেক পুরুষ ধরে। একরকম এই গ্রামের অভিভাবক ওই মাস্টারমশাইয়ের পরিবার।
“আসুন, আসুন মাস্টারমশাই,” বললো মোহনকাকা। দুটো চেয়ার পেতে দিলো সামনের দিকে। সঞ্জয় বসে পড়লো একটাতে। যাক, মাস্টারমশাইয়ের দৌলতে চা তো পাওয়া যাবে।
“কি রে সঞ্জয়, তোর কলেজ কেমন চলছে? তুই তো ইতিহাস নিয়ে পড়ছিস, তাই না?
“মানে অনার্স নিয়েছি। মাস্টার্সে ইতিহাস বা পুরাতত্ত্ব নিয়ে পড়বো ভেবেছি।”
“বেশ, বেশ।” বললেন মাস্টারমশাই। “তা রথ টানতে গেলি না?”
“না, ওই আর কি। আর মেয়েদের ব্যাপার তো এটা...” বলতে বলতে সঞ্জয়ের মাথায় একটা প্রশ্ন জাগলো। “আচ্ছা মাস্টারমশাই, আমাদের গ্রামে এই মেয়েদের রথ টানার রেওয়াজ কবে থেকে শুরু হলো? এটা তো অন্য কোথাও হয় বলে শুনি নি!”
ইতিমধ্যে চা এসে গেছে, স্টিলের গেলাসে। সঙ্গে ছোট্ট ছোট্ট স্টিলের প্লেটে কলাপাতা বসিয়ে তার ওপর "উপমা"। সঞ্জয় জানে মোহনকাকা "উপমা"টা সকালে বানায় নিজের জন্যে আর নিজের কর্মচারীদের জন্যে। অল্প করে বানায়, দারুণ খেতে হয়।
"উপমা"র প্লেট টেনে নিয়ে মাস্টারমশাই বললেন “তোর প্রশ্নটা আরেকটু গুছিয়ে দি। হনুমান তো চিরকুমার, তার তো কোন রোম্যান্টিক দিকও নেই, তবে আমাদের গ্রামে এই রথটানা সবসময় মেয়েদের হাতেই হয় কেন?”
“কেন?”
মাস্টারমশাই হাসলেন। তারপর বললেন “ইতিহাস পড়বি বলছিস, তার আগে নিজের গ্রামের, পরিবারের ইতিহাস জানবি না?”
“বলুন না মাস্টারমশাই।”
“তবে শোন।” বলে মাস্টারমশাই শুরু করলেন
“সময়টা ১৯২৫। ব্রিটিশ রাজ। তার আগের বছর মহাত্মা গান্ধী ছাড়া পেয়েছেন জেল থেকে; তাঁর নেতৃত্বে বেলগাঁওতে কংগ্রেসের সেশন হয়েছে। চন্দ্রশেখর আজাদ – শচীন্দ্রনাথ সান্যালরা তখন হিন্দুস্তান রিপাবলিকান এসোসিয়েশন তৈরি করে সশস্ত্র সংগ্রামের কথা বলছেন। গোপীনাথ সাহা টেগার্ট সাহেবকে মারতে গিয়ে অন্য এক সাহেবকে মেরে ফাঁসিতে চড়েছেন। আর সেই বছরের শুরুতে যুব-কংগ্রেসের প্রেসিডেন্ট সুভাষ বোস গ্রেপ্তার হয়ে বর্মায়। এইরকম একটা গোলমেলে সময়ে আমাদের গ্রামের ছুতোর মিস্তিরি নামদেব সুতার আমাদের এই হনুমানপূজা উপলক্ষে একটা ছোট্ট বিপ্লব ঘটিয়ে বসলো।”
“কিরকম ?”
“সেবারের রথে হনুমান ছাড়া দু-দিকে দুটো কাঠের ফ্রেমে দুটো ছবি দেওয়া হয়েছিলো। কে করতে বলেছিলো তা জানা নেই, করেছিলো নামদেব। সেই ছবিদুটো ছিলো শিবাজী মহারাজের আর মহাত্মা গান্ধীর!”
“অ্যাঁ? বলেন কি? তারপর কি হলো?”
“যা হবার তাই হলো। নামদেব জেলে গেল। তখনকার ব্রিটিশ রাজের জেল মানে বুঝতে পারছিস তো? দুর্দান্ত মার! রথযাত্রা বন্ধ হয়ে গেল পাঁচবছরের জন্যে । তারপর ১৯২৭ আর ১৯২৮ সালে আবার লোকেরা রথযাত্রা শুরু করতে চেষ্টা করেছিল, পারে নি। পুলিশ তৈরি ছিলো, রথযাত্রা বন্ধ করে দেয়। একবার তো রথ অনেকদূর এসেছিলো, পুলিশ আটকে দেয়। গ্রামের লোকেরাও প্রতিবাদে রথ মাঝরাস্তায় ফেলে রেখে দিয়েছিলো দুমাসের জন্যে। তারপর সরকারী কর্মচারীরা অতিকষ্টে বুঝিয়ে-বাজিয়ে রথ ফেরত পাঠিয়ে মূর্তি আবার মন্দিরে অধিষ্ঠান করানোর ব্যবস্থা করায়।”
“বাবাঃ, দারুণ ব্যাপার তো!”
“হ্যাঁ, এখন গল্প হিসেবে শুনতে দারুণ লাগছে। ব্রিটিশ যুগে এটা করা কম সাহসের কথা নয়।”
“তারপর?”
“১৯২৯। ভারতবর্ষের রাজনীতিতে গান্ধীর পাশাপাশি নেহরু আর সুভাষ তখন উঠে এসেছে – তারা দুজনে ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেন্স লীগের দুই তরুণ সেক্রেটারি। ভগৎ সিং, চন্দ্রশেখর আজাদ এবং রাজগুরুর হাতে স্যান্ডার্সের মৃত্যু হয়েছে। ভগৎ সিং এবং বটুকেশ্বর দত্ত ৮ই এপ্রিল এসেম্বলিতে বোমা মেরে স্বেচ্ছায় ধরা দিয়েছেন, তাদের নিয়ে সারা দেশ উত্তাল। এর ঠিক পরে – এপ্রিল মাসের ১৭ তারিখে এলো আমাদের হনুমান রথযাত্রার দিন।
"এবার পুলিশ কোন চান্স না নিয়ে দিলো ১৪৪-ধারা ঘোষণা করে। মানে কারোর হাতে সেদিন লাঠি থাকলেও সটান গ্রেপ্তার। আর মন্দির থেকে রথে হনুমানমূর্তিটা তোলাই বারণ। বাইরে দড়ির কর্ডন আর গরুর গাড়ি দিয়ে রোডব্লক। তার বাইরে সশস্ত্র পুলিশ, তৈরি। কোন গোলমাল যেন না হয় – ওপরওয়ালাদের কড়া নির্দেশ আছে।
"কিন্তু গোলমাল হয়েই গেল। পুজো শেষ হতেই কোথা থেকে একদল অশিক্ষিত নিচুজাতের মেয়েরা দৌড়ে এলো। তাদের মধ্যে একজন একটা ছোট্ট হনুমানের ছবি নিয়ে রথে লাফিয়ে উঠে সেটা স্থাপন করে দিলো। আর বাকি মেয়ের দল কেউ কিছু বলবার আগেই রথের রশিতে দিলো টান। পুলিশ কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে, এগোলেই এই মেয়ের দল তাদের মুখে চোখে ছুঁড়ে মারছে আবীর-গুলাল।
"প্রথমে গড়গড়িয়ে, একটু বাদে সতেজে রথ এগিয়ে চললো। তারপর এক সজোর ধাক্কায় গরুর গাড়ি ছিটকে দিয়ে কর্ডন ভেঙে রথ তার পথ করে নিলো। তারপর পূর্ণ পরিক্রমা করে রথ ফিরলো মন্দিরে। ওই মেয়েদের কাঁকনপরা হাত ধরেই।
"সেইদিন প্রবল পরাক্রম ব্রিটিশরাজের বিরুদ্ধে একটা ছোট্ট লড়াই জিতে গেল ওই অশিক্ষিত নিরস্ত্র মেয়ের দল। আর সেই থেকে আমাদের গ্রামের রথ প্রথম টানার অধিকার দেওয়া হলো ওই মেয়েদের। আর আমাদের রথযাত্রার নিয়ম হলো এতে প্রথম আরতি করবে আমাদের পুলিশ থানার প্রধান - যাতে কোনদিন তারা ভুলে না যায় যে একদিন তাদের বুলেট-লাঠি-রক্তচক্ষুকে ভয় পায় নি একরাশ তথাকথিত দুর্বল মেয়েরা।"
মাস্টারমশাই থামলেন। তারপর একটু মৃদু হেসে বললেন “আর যে মহিলা ওই রথের ওপর লাফিয়ে উঠে হনুমানের ছবি বসিয়ে ছিলেন, তাঁর নাম জুমবারবাই আউসাক। অতি দরিদ্র অশিক্ষিত এক বিধবা। তাঁর একমাত্র ছেলেকে নিয়ে গ্রামের খান্ডোবা গলিতে থাকতেন। সেলাইয়ের কাজ করে সংসার চালাতেন। ছেলেকে পরে লেখাপড়া শিখিয়েছিলেন, মানুষ করেছিলেন। তিনি নেই, তবে তাঁর পরিবার আজো আছে ওখানেই। বুঝলি কিছু?"
সঞ্জয় মাথা নাড়লো। বুঝেছে। না বুঝে আর উপায় আছে? ওই জুমবারবাই যে ওর নিজের ঠাকুরদার মা! দেয়ালে ছবি আছে তো, যেটায় প্রণাম করে মা বেরয় রথ টানতে। কোনদিন জিগ্যেস করা হয় নি কেন এঁকে প্রণাম করে মা।
চা ফুরিয়ে এসেছিলো। শেষ চুমুকটা দিয়ে সঞ্জয় উঠে দাঁড়ালো।
“আমি আসি মাস্টারমশাই। একবার পুজোতলায় যাই। একটু রথটা টানতে পারলে... দেখি"
মাস্টারমশাই মৃদু হাসলেন।
****
উত্তরকথনঃ এই কাহিনী সম্পূর্ণ সত্য ঘটনা। জুমবারবাই আউসাক সত্যিকারের চরিত্র, ওঁদের পরিবার আজও সঙ্গমনের গ্রামেই থাকে। ওই গ্রামের হনুমানপূজোয় রথ বেরোয় আজো, আর সে রথ প্রথম টানে গ্রামের মেয়েরাই। গ্রামের পুলিশই প্রথম পূজার ডালি চড়ায় এই রথে।
কল্পনা শুধু ওই মাস্টারমশাই আর সঞ্জয়ের চরিত্রদুটি আর মোহনকাকার চায়ের দোকানটি। তবে ওই এলাকায় কলাপাতায় সকালের “উপমা”টা দুর্দান্ত খেতে হয়, এতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই।