• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৭১ | জুন ২০১৮ | ছোটদের পরবাস | গল্প
    Share
  • ঋভুর বদলে যাওয়া : অনন্যা দাশ


    সেদিন একটু ভয়ে ভয়েই স্কুলে গেল ঋভু। ক্লাসে যে কি হবে কে জানে ভাবতে ভাবতে। আসলে ঋভু ক্লাসের দুষ্টু ছেলেদের মধ্যে একজন। পড়াশোনায় তার একেবারেই মন নেই আর যত রকম হাবিজাবি কাজ করায় ঋভুর জুড়ি নেই! হোমওয়ার্ক না করা, ক্লাসে টিচারদের উল্টোপাল্টা প্রশ্ন করে বিরক্ত করা, স্কুলে ইঁদুর নিয়ে আসা এই সব করতেই তার ভাল লাগে!

    ওদের অঙ্কের শিক্ষিকা গুপ্ত ম্যাডাম বেশ কড়া। টিচারদের মধ্যে একমাত্র তাকেই একটু ভয় পায় ঋভু। কিন্তু ওর যে কি মতিভ্রম হয়েছিল--গত সপ্তাহে অঙ্কের খাতায় টেস্টের সময় ছবি এঁকে রেখে দিয়েছে ঋভু! আজ ম্যাডামের সেই খাতা ফেরত দেওয়ার কথা। ঋভু জানে এবার শুধু ওর গার্জেন কলই হবে না, ম্যাডাম আগেই বলেছেন ওর ওই-সব বদমাইশি চললে, ওকে স্কুল থেকে বার করে দেওয়া হবে প্রিন্সিপালকে বলে। ঋভু এমনিতে বকুনিকে ভয় পায় না। বকুনি তো সে সব সময় খাচ্ছে! মা, বাবা, টিচাররা সবাই তো ওকে সব সময় বকছেন কিন্তু স্কুল থেকে বার করে দিলে একটু মুশকিল হতে পারে! এটা ভাল স্কুল। বাবা তো স্পষ্ট বলে দিয়েছেন হয় একেবারে বাজে স্কুলে পড়তে হবে আর ভাল স্কুলে পড়তে গেলে এক ক্লাস নিচুতে ভর্তি হতে হবে। সেটা শোনার পর থেকেই ঋভুর মনটা একটু দমে গেছে। শেষে ওকে কিনা ওর ভাই ঋজুর সঙ্গে এক ক্লাসে পড়তে হবে? ঋজুর বন্ধুরা সবাই ওর সহপাঠি হয়ে যাবে! উফফ, আর ভাবতে পারে না ঋভু!

    ক্লাসে গিয়ে অবশ্য যে খবরটা পেলো তাতে কিছুটা আস্বস্ত হল সে। তমোজয় বলল, “জানিস গুপ্ত ম্যাডামের রিকশা থেকে পড়ে গিয়ে পা ভেঙ্গে গেছে। ম্যাডাম এখন তিন মাস স্কুলে আসতে পারবেন না!”

    স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল ঋভু! যাক বাবা! তাহলে আর ওকে কেউ স্কুল থেকে বার করে দেবে না! এখন তিন মাস নিশ্চিন্ত! তিন মাস বাদে যখন উনি ফিরবেন তখন ব্যাপারটা ওনার আর মনেই থাকবে না!

    ক্লাস শুরু হতেই প্রিন্সিপাল স্যার এসে হাজির। ওনার সাথে চশমা পরা লম্বা মতন একজন ভদ্রলোক। প্রিন্সিপাল স্যার গুপ্ত ম্যাডামের পা ভেঙ্গে যাওয়ার কথাটাই বললেন।

    আর বললেন, “ইনি হলেন সুবোধ দত্ত। যতদিন না মিসেস গুপ্ত ফিরছেন ইনি তোমাদের অঙ্ক শেখাবেন।”

    সারা দিনটা ভালই কাটল ঋভুর। শেষের পিরিয়েডে নতুন স্যার এসে বললেন, “ইন্টার-স্কুল কুইজ কন্টেস্টের জন্যে কালকের মধ্যে নাম দিতে হবে। আমি তো কাউকে চিনি না তাই গুপ্ত ম্যাডামকে জিজ্ঞেস করে তোমাদের ক্লাস থেকে দুজনের নাম নিয়েছি। যাদের নাম ডাকব তারা গিয়ে প্রিন্সিপালের অফিস থেকে কুইজের বই নিয়ে নিও।”

    তারপর হাতের কাগজটার দিকে তাকিয়ে বললেন, “যাদের নাম রয়েছে তারা হল শৌর্য বাগচি আর অর্চিষ্মান ঘোষ। তোমরা যাও বই নিয়ে এসো।”

    নাম শুনে ঋভু তো চমকে উঠল! আরে অর্চিষ্মান ঘোষ তো তার নাম! আর সে তো জন্মেও কুইজ কম্পিটিশানে অংশগ্রহণ করেনি!

    সে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “স্যার, মনে হয় কিছু একটা ভুল হয়ে গেছে! ওটা অর্চিষ্মান নয় তমোজয় হওয়া উচিত ছিল!”

    স্যার হাতের কাগজটার দিকে আরেকবার তাকিয়ে বললেন, “নাহ, আমি চশমা পরি বটে কিন্তু দেখতে অতটা ভুল তো হবে না। এখানে স্পষ্ট লেখা রয়েছে অর্চিষ্মান ঘোষ! তমোজয়ের পুরো নামটা কি?”

    “তমোজয় হালদার।”

    “তাহলেই দেখো, এখানে পুরো নামটা লেখা রয়েছে, অর্চিষ্মান ঘোষ! যাও যাও, আর দেরি কোরো না, বই নিয়ে এসো। এর পর ছুটির বেল পড়ে যাবে।”

    “কিন্তু স্যার তমোজয় তো আমার থেকে পড়াশোনায় অনেক ভাল। ওই কুইজে ভাল করবে!” ঋভু মিনমিন করে বলল।

    “আমার তো আজকে তোমাদের সাথে প্রথম দিন তাই কে কি রকম করবে তা তো আমার পক্ষে বলা সম্ভব নয়। প্রিন্সিপাল স্যারের কথা মতন আমি তোমাদের টিচারকে ফোন করি। যিনি তোমাদের সবাইকে চেনেন তিনি যাদের নাম দিয়েছেন তাদেরকেই যেতে হবে। শৌর্য দত্ত আর অর্চিষ্মান ঘোষ!”

    আর কি করবে ঋভু, অগত্যা প্রিন্সিপালের অফিসে বই আনতে যেতে হল ওকে। স্যার ওদের হাতে একটা ধুমসো মোটা বই ধরিয়ে দিয়ে বললেন, “তোমরা সবাই আমাদের স্কুলের প্রতিনিধি হয়ে যাচ্ছো! দেখো তোমাদের স্কুলের সম্মান আর সুনাম যেন সব সময় বজায় থাকে। এই কুইজ কন্টেস্টে আমরা কোনদিন হারিনি! প্রতি বছর ঝলমলে ট্রফিটা আমাদের স্কুলেই আসে। এইবারও যেন তাই হয়। কালকে একটা প্র্যাকটিস রাউন্ড হবে স্কুলে।”

    বাড়ি ফিরে এটা সেটা করতে করতে বিকেলটা চলে গেল। ঋজু জিজ্ঞেস করল, “দাদা হোমওয়ার্ক করবি না?”

    “নাহ, হোমওয়ার্ক নেই!” বলে ওকে কাটিয়ে দিয়ে টিভিতে ক্রিকেট ম্যাচ দেখতে বসে গেল ঋভু।

    পরদিন স্কুলে লাঞ্চের পরই শুরু হয়ে গেল কুইজ কন্টেস্ট। ঋভু তো কিছুই পড়েনি তাই সে কোন রকমে একটা কি দুটো প্রশ্নের উত্তর দিতে পারল!

    কিন্তু ব্যাপারস্যাপার দেখে তো ঋভুর মাথায় হাত! এত বড় সড় একটা রাজসূয় যজ্ঞে কিনা গুপ্ত ম্যাডাম ওর নাম দিয়ে দিলেন! এটাতে তো ফাঁকিবাজি করা যাবে না মোটেই! অন্যরা সবাই পড়বে আর ঋভু না পড়লে কোন উত্তর দিতে পারবে না, তখন হেরে গেলে সবাই বলবে যে ঋভুর জন্যেই স্কুল হেরে গেল! দোষটা ঋভুর ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া খুব সহজ হয়ে যাবে! নাহ, ঋভু সেটা হতে দেবে না! আর যে কটা দিন সময় আছে তার মধ্যে যা করার ওকে করতেই হবে!

    সেদিন বাবা অফিস থেকে ফিরে অবাক হয়ে বললেন, “একি! আজ সকালে সূর্য কোন দিক দিয়ে উঠেছিল খেয়াল করা হল না তো! উল্টো দিক দিয়েই উঠেছিল মনে হয়! ঋভুবাবু পড়াশোনা করছেন!”

    ঋভু শুনে শুধু বলল, “হুঁ!”

    ঋভুর এখন দুষ্টুমি করার সময় নেই! সে কিছুতেই কুইজ কন্টেস্টে হারার দোষ নিজের ঘাড়ে নেবে না! তাই সে মন দিয়ে পড়ছে আর পড়ছে আর পড়ছে!”

    এদিকে আরেকটা গণ্ডগোল হয়েছে, কুইজ কন্টেস্টে যেতে না পেরে তমোজয়ের ভারি মন খারাপ। প্র্যাকটিস রাউন্ডে ঋভু খারাপ করায় সে সুযোগ বুঝে স্যারকে গিয়ে ধরল, “স্যার, অর্চিষ্মান মহা ফাঁকিবাজ, ওর দ্বারা কিছু হবে না! প্রতিবার আমিই যাই, আমারই ওটাতে যাওয়ার কথা! আপনি ওকে বাদ দিয়ে আমাকে নিন স্যার, না হলে আমাদের স্কুল হেরে যাবে!”

    স্যার তো মহা সমস্যায় পড়লেন। প্র্যাকটিসে অর্চিষ্মান ভাল করেনি ঠিকই কিন্তু ওদের টিচার আবার ওর নামটাই দিয়েছেন!

    স্যার কিছু বলছেন না দেখে তমোজয় বলল, “আপনি ঠিক না করতে পারলে আমাদের দুজনের মধ্যে পরীক্ষা নিয়ে দেখুন!” ওর দৃঢ় ধারণা ছিল যে ওই জিতবে।

    ওর কথা শুনে ঋভুর ভারি রাগ হল। সে গত কয়েকদিন ধরে প্রচুর পড়ে চেষ্টা করছে আর এখন তমোজয় বলে কিনা সে যেতে চায়!

    ঋভুর মোটা বইটা হাতে নিয়ে স্যার বললেন, “ঠিক আছে আমি তোমাদের দুজনকেই পাঁচটা করে প্রশ্ন করব। যে বেশি প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবে সেই যাবে।”

    ক্লাসের সবাইকে চমকে দিয়ে ঋভু বেশি প্রশ্নের উত্তর দিয়ে ফেলল! তমোজয় তো থ! তার মুখ মাছের মতন খুলছে বন্ধ হচ্ছে!

    স্যার বেশ রাগতভাবেই বললেন, “আমি আর এই বিষয় নিয়ে কোন কথা শুনতে চাই না! অর্চিষ্মানই যাবে! এবার তোমরা অঙ্কের বই আর খাতা বার করো!”


    ##

    কুইজ কন্টেস্টে ঋভুদের স্কুলের জিততে কোন অসুবিধা হয়নি। ঋভু তাকে জিজ্ঞেস করা সব প্রশ্নের উত্তর দিয়েছিল। আর এখন কুইজ টিমে ওর স্থান বাঁধা হয়ে গেছে! সে আর দুষ্টুমি করে না, মানে সময়ই পায় না। ওকে কেউ কিছু বললে হেসে বলে, “নাহ, ভাল ছেলে হয়ে থাকতে ভালই লাগছে তাই ভাল হয়েই আছি!”

    তিন মাস পর মিসেস গুপ্ত ফিরে আসার পর অন্য টিচাররা তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, “আপনি কি করে জানলেন অর্চিষ্মান কুইজে এত ভাল করবে? সে তো এক নম্বরের বিচ্ছু ছিল!”

    মিসেস গুপ্ত মুচকি হেসে বললেন, “সেটা কি আর আমি জানি না! অঙ্কের টেস্টে খাতায় অঙ্ক করার বদলে ছবি এঁকে দিয়েছিল! তাই ওকে সায়েস্তা করার জন্যে আমি ওর নামটা কুইজের জন্যে দিয়েছিলাম। দেখছিলাম ওকে কোন দায়িত্ব দিলে ও কি করে। ও যদি না পারত তাহলে তো অন্য কাউকে নেওয়াই যেত, কিন্তু আমাদের সবাইকে অবাক করে অর্চিষ্মান সফল হয়েছে বলে আমি খুব খুশি!”



    অলংকরণ (Artwork) : অলংকরণঃ লেখক
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments