‘কালচার স্টাডিজ’ বিষয়টির সূত্রপাত হয়—রিচার্ড হগার্টের ‘দ্য ইউজেস অভ লিটারেসি’[১] (১৯৫৭; বাংলায় বলতে গেলে ‘সাক্ষরতার সদুপযোগ’) বইটি থেকে। বাংলায় বিষয়টির নাম রাখা যেতে পারে ‘সংস্কৃতি-শাস্ত্র’[২]—কিন্তু তৎক্ষণাৎ যে প্রশ্নটা শাস্তরের নাভিমূল ধরে নাড়া দেবে, তা হল বাজারে যত সমস্ত বিদ্যা আর শাস্ত্রে গিয়েছে ছেয়ে, তাদের থেকে এই বিশেষ বিষয়টির ফারাক ঠিক কী? হঠাৎ হগার্ট কি এমন কথা বললেন যাতে একটা নতুন দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি হয়ে গেল আর একটি নতুন পাঠ্যবিষয় তৈরি করার দিকে আমরা এগিয়ে গেলাম? এমনিতে সহজ করে বলা যেতে পারে কালচারাল স্টাডিজ বা ‘সংস্কৃতি-শাস্ত্র’ হচ্ছে এমন একটি উদ্ভাবনী আন্তর্বিষয়—যা ‘ইন্টার-ডিসিপ্লিনারি’ গবেষণা-ক্ষেত্র ও পঠন-পাঠনের জায়গা, আর যেখানে দেখা হয় যে সংস্কৃতি কিভাবে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা, প্রাত্যহিক জীবন, সামাজিক সম্বন্ধ-সমূহ এবং ক্ষমতা-কে তৈরি করে এবং ক্রমাগত বদলাতে থাকে।
বস্তুতপক্ষে, সংস্কৃতি-শাস্ত্রে গবেষণা ও পঠন-পাঠনের মূল ধ্যেয় হল এটা দেখা যে সংস্কৃতির যে দুটি রূপ—একটি, যা মানবিক সম্প্রেষণ এবং সাঙ্কেতিক ক্রিয়াকলাপের ধারক ও বাহক এবং অন্যপক্ষে সংস্কৃতির অন্য পক্ষ যা জীবন যাপনের বিভিন্ন পদ্ধতির ও প্রক্রিয়ার সূচক—এই দুইএর মধ্যেকার সম্পর্কটা ঠিক কী? সমাজ-শাস্ত্র ও মানবিকী বিষয়গুলির ব্যাখ্যা-পদ্ধতির সঙ্গে সাহিত্য, সমাজতত্ত্ব, সম্প্রেষণ-বিদ্যা বা কমিউনিকেশন স্টাডিজ, ইতিহাস, সংস্কৃতিক নৃবিজ্ঞান এবং অর্থশাস্ত্র—এসবের বিশ্লেষণী পদ্ধতির সংমিশ্রণে তৈরী হয়েছে এই ‘সাংস্কৃতিকী’। এই সমস্ত বিষয়ের সীমা ও পরিধির কথাও বলে ‘সাংস্কৃতিকী’ বা ‘সংস্কৃতি-শাস্ত্র’, কিন্তু তারই সঙ্গে ওঠায় অনেক নতুন প্রশ্ন ও মেলে ধরে ইতোপূর্বে অজানিত অনেক সমস্যাকে, যেগুলি ‘আজকের পৃথিবীর’ বা ‘এই সময়ের’ সমস্যা। অন্য সব বিদ্যা ও বিজ্ঞান যেখানে এই সব প্রশ্নের শাশ্বত উত্তর খুঁজবে, ‘সাংস্কৃতিকী’ তা না ক’রে বা তেমন কোনও চিরায়ত ব্যাখ্যা তৈরী না ক’রে চেষ্টা করে এমন নমনীয় সাধনী ও ক্রমবিবর্তিত ব্যাখ্যা-পদ্ধতি খাড়া করার যা দ্রুতবর্তিত পৃথিবীর সঙ্গে তালে তাল মিলিয়ে চলতে পারবে।
আসলে সাংস্কৃতিক জীবন তো শুধুমাত্র সাঙ্কেতিক সম্প্রেষণ বা সম্প্রেষণের সাংকেতিকতা নিয়ে ভাবিত নয়, এ এক এমন ক্ষেত্র যেখানে আমরা নিজেদের জন্য সামূহিক ও সামাজিক করণীয় কাজগুলিকে চিনে-জেনে নিতে থাকি এবং সেগুলির সাহায্যে আমাদের গোষ্ঠীগত পরিবর্তনের সঙ্গে আমরা কিভাবে তাল মিলিয়ে চলব তাও স্থির করতে থাকি। আর এই স্থির করা প্রতি-মুহূর্তিক, কোনও এক বারের স্থির-সিদ্ধান্তে পৌঁছন নয়; অর্থাৎ, সাংস্কৃতিকী সেই সব পদ্ধতিগুলিকে বুঝতে চায় যেগুলির সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের সমাজ ও সমাজবদ্ধ জীব রূপে মানুষজন এবং সমাজের বিভিন্ন শ্রেণী ও গোষ্ঠিরা কিভাবে নিজেদের ইতিহাস, গোষ্ঠিবদ্ধ জীবন ও আগামী দিনের চ্যালেঞ্জ-এর মোকাবিলা করবে তা স্থির করতে চায়।
অন্যপক্ষে, আমরা বিষয়টিকে সংস্কৃতির ‘বিজ্ঞান’[৩] এই আভূষণে যেই কোনো নামিত করতে চাইব, তখনই নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে অথবা তার সত্যের সঙ্গে সম্বন্ধ-স্থাপনের নিরিখে তার অবজেক্টিভিটি-র একটা জোরালো ভূমিকা আশা করা যেতে পারে। অথচ, রিচার্ড হগার্টের ‘দ্য ইউজেস অভ লিটারেসি’[৪] (যা বাংলায় বলতে গেলে দাঁড়াবে ‘সাক্ষরতার সদুপযোগ’) বইটি থেকে পাচ্ছি এই যুক্তি যে কোনো ব্যক্তির ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গি, নিজস্ব জীবনদর্শন এবং প্রায়-আত্মজীবনীমূলক বর্ণন-বিশিষ্টতা—এ-সবই একটা বিরাট স্থান তৈরি করে নিচ্ছে সংস্কৃতি-শাস্ত্রে; অর্থাৎ এখানে সাপেক্ষতা, ব্যক্তি-কেন্দ্রিকতা বা ইন্ডিভিজুয়ালিজম হয়ে উঠছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ, নিরপেক্ষতা নয়। সাপেক্ষতা বা নিজস্ব মতামত, ইতিহাস, জ্ঞান, রুচি অনুসারে কোনো বিষয়কে, ঘটনাকে বা মানুষকে দেখা, বোঝা, জানা নিরপেক্ষ ভাবে দেখার থেকে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। আবার যাঁরা ধরা যাক সাপেক্ষবাদী, অর্থাৎ যাঁরা বিশ্বাস করেন নিরপেক্ষ অবস্থান অসম্ভব, কারণ অনেকেই হয়ত বলবেন যে তাঁরা ভেবে পান না 'একজন সুস্থ বিবেকসম্পন্ন মানুষ কিভাবে নিরপেক্ষ হতে পারেন?', এই মতামত যাঁরা পোষণ করেন, তাঁদের মনে হতেই পারে যে তথাকথিত নিরপেক্ষ যাঁরা, তাঁরাও আসলে আদতে একটা ‘পক্ষ’-ধর।
‘নিরপেক্ষতা’ নিয়ে বাংলাদেশের একজন ব্লগার[৫] লিখছেন ১৯শে জুলাই, ২০১৩-তে: “নিরপেক্ষতা শব্দটা কেমন যেন অবলা অবলা মনে হয়। যেন বিচার বুদ্ধিহীন বালকের নির্লিপ্ত অবাক চোখে নির্বাক চেয়ে থাকার মতো। যার মাঝে কোনো বিবেকের অস্তিত্ব নেই যে যা দ্বারা সে কিছু বিচার করবে। ...নিরপেক্ষতা শব্দটা আসলে পশু সমাজের জন্য সঠিক। মানুষ যখন যুদ্ধে লিপ্ত হয় তখন পশুরা নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে সেটা উপভোগ করে নির্বাক চোখে। ...নিরপেক্ষতাবাদীরা আসলে ... লালিত পালিত হতে থাকে ক্ষমতাধরদের ইচ্ছামতো...।”
বস্তুতপক্ষে, ‘নিরপেক্ষতা’ বাংলায় এসে একটা নঞর্থক শব্দ রূপে নির্মিত হওয়াতে তাকেও কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়। কিন্তু পশ্চিমে বা ইংরেজিতে যেমন ‘সাবজেক্টিভ’ বনাম ‘অবজেক্টিভ’-এর একটা দর্শন রয়েছে, বাংলায় ‘সাপেক্ষ-নিরপেক্ষ’ তার সঠিক অনুবাদ নয়; অবজেক্টিভিটি-র কাছাকাছি বাংলা পারিভাষিক শব্দ হতে পারে ‘বিধেয়তা’। কিন্তু হগার্ট সে-পথ মাড়ালেন না কারণ আমরা যখন যা-কিছু করি, তার পিছনে একটা ‘উদ্দেশ্য’ তো থাকবেই; হয়ত তা আপাতদৃষ্টিতে অকথিত অস্পষ্ট উদ্দেশ্য। অথচ, যে-মানুষদের অক্ষরজ্ঞান আছে এবং যারা অক্ষরগুলি জুড়লে পরে যে শব্দব্রহ্ম তৈরি হতে থাকে প্রতিটি মুহূর্তেই, হয়তো সে-বিষয়েও তাদের জ্ঞান রয়েছে, কিংবা সেইসব শব্দগুলি নিজেদের আত্মপরিজন বন্ধু বেদনা আনন্দ নিয়ে জোড়-বিজোড় হয়ে যে শব্দমালিকার সৃষ্টি করে, সেগুলি থেকেও অর্থের নির্যাস টেনে বের করে আনার মতো ক্ষমতা যাদের রয়েছে, তারা যে কোনো লিখিত পাঠ বা টেক্সট পেলে ঠিক কীভাবে পড়ে বা পড়বে—অর্থাৎ, তুমি ও আমি—আমরা দুজন মানুষ একই কৃতিকে কীভাবে ও কোন কারণে ভিন্ন-ভাবে প’ড়ে-বুঝে থাকি তার রহস্য নিয়ে ভাবতে শুরু করলেন হগার্ট। প্রশ্ন হল নানান জীবনকর্ম, যেমন প্রেম করা, শরীরচর্চা করা, দৈনন্দিন পারিবারিক জীবন-নির্বাহ করা অথবা কর্মজগতের প্রতিদিনের কর্ম-ব্যাপৃতি—এ সবই যেমন পৃথক পৃথক জীবনধর্ম ও জীবনকর্ম, ‘পড়া’টাও তো তেমনি এক ক্রিয়া, নয় কী—যার সঙ্গে জুড়ে থাকে নানান অনুসর্গ, উপসর্গ ও প্রশ্নাবলী। কী পড়ি, কাকে পড়ি (আর কাকে পড়ি না), কখন ও কোথায় পড়ি এবং কেনই বা পড়ি বিশেষ কোনও মানুষের লেখা—এসবই হয়ে ওঠে ব্যক্তিগত সওয়াল-জবাবের অঙ্গবিশেষ।
বুঝতে হবে যে এইসব প্রশ্নের কোনও পূর্বনির্দিষ্ট ‘বিজ্ঞানসম্মত’ উত্তর নেই—হগার্টেরও ছিল না, আমাদেরও নেই। উত্তরগুলি, যা বিভিন্ন মানুষ ভিন্ন ভিন্ন মত অনুসারে দেবে, পরস্পরের পরিপূরকও হতে পারে এবং পরস্পর-বিরোধীও— অনেক সময়ে স্ব-বিরোধীও। আলুর সঙ্গে পেঁয়াজের কিংবা বেগুনের সঙ্গে বিলাতি বেগুনের যেমন তুলনা হয় না, তেমনি মুণ্ডাদের দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে দ্রবিড়দের মিল যে থাকবে না কিংবা ভারোপীয আর্যরা বা কিরাতেরা যে বেশ পৃথক ধরনের দৃষ্টিভঙ্গির পৃষ্ঠপোষকতা করবেন তাতে আর আশ্চর্য কী? এবং যদি চারজন বিশ্লেষক পূর্ণত সাম্যবাদের আদর্শে বিশ্বাসী হন অথচ তাঁরা যদি এই চারটি পৃথক ভাষা-পরিবার ও ঐতিহ্যের প্রেক্ষাপট থেকে উদ্ভূত হয়ে থাকেন, তাহলেও যে তাঁদের বিশ্লেষণ একই খাতে চলবে একথা তাবড় তাত্ত্বিকেরাও হলফ করে বলতে পারেন না। বস্তুতপক্ষে, বাস্তব, সত্য এবং বিশ্বাসযোগ্যতার সঙ্গে অবজেক্টিভিটি-র একটা যোগসূত্র রয়েছে একথা দার্শনিকেরা বলেন যে সাবজেক্টিভিটি এবং অবজেক্টিভিটি এ-দুটি নির্ভর করে যিনি দেখছেন তাঁর অবস্থানের ওপরেও; কোনও মানুষ বা গোষ্ঠী যখন কোনও ঘটনা বা পরিস্থিতির ভেতর থেকে সেই ঘটনাটিকেই দেখেন, তখন দেখার ভঙ্গিতে পক্ষপাত থাকবে এটাই স্বাভাবিক, অথচ সমস্যা হচ্ছে এই যে সেই ঘটনা বা বস্তুটি তো যিনি দেখছেন তাঁর দেখার বা জানার বাইরেও অস্তিত্ব রয়েছে। সত্য তো সত্যই, কেউ দেখুক বা জানুক অথবা না জানুক। এখন যিনি দেখছেন তিনি হয়ত এই ঘটনার মধ্যে এমন কিছু দেখছেন যা অন্যেরা দেখছে না, এই অতিরিক্ত বৈশিষ্ট্য সেই ঘটনা বা বস্তুটির চরিত্রের অঙ্গ হোক বা না হোক। অতএব অবজেক্টিভিটি ব্যাপারটি নিয়ে যে বোঝার বাইরেও অনেক স্থিতি, ব্যাখ্যা, বৈশিষ্ট্য ও কারণাদি থাকতেই পারে, ঠিক সেই জায়গা থেকেই হগার্টের সাপেক্ষ বা সাবজেক্টিভ দৃষ্টিভঙ্গির তর্ক শাণিত হয়ে উঠছে।
সত্যি কথা বলতে কী, অনেক মহান কৃতির জন্ম-কাহিনী কিছুটা বিচিত্র, এবং হগার্টের ‘সাক্ষরতার সদুপযোগ’ তার ব্যতিক্রম নয়; হার্বার্ট রিচার্ড হগার্ট (১৯১৮-২০১৪) খুবই সাধারণ আয়ের একটি পরিবারে লীডস-এর পটারনিউটন অঞ্চলে তিন ভাই-বোনের একজন হয়ে খুবই দারিদ্র্যের মধ্যে দিয়ে বড় হয়েছেন – বাবা ছিলেন একজন সাধারণ সৈনিক যিনি হগার্টের জন্মের এক বছরের মাথাতেই মারা যান; ঠাকুমার কাছে মানুষ হন, কাকিমার উত্সাহে পড়াশোনা করেন ও লীডস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভালো ফল দেখিয়ে সাহিত্যের স্নাতকোত্তর ডিগ্রী পান। পরে নিজেও দ্বিতীয় বিশ্ব-যুদ্ধের সময়ে সেনাদলে কাজ করেন—তবে লেস্টার (Leicester) বিশ্ববিদ্যালয়ে উনি যে দীর্ঘ চোদ্দ বছর (১৯৪৬-১৯৫৯) টিউটর হিসেবে শিক্ষকতা করেন, তখনই ওঁর প্রথম বই বেরয়। পরে ১৯৬২-১৯৭৩ সালে উনি নিজের বিশ্ববিদ্যালয়ে সংস্কৃতি-শাস্ত্রের বিভাগ খোলেন এবং ব্রডকাস্টিং বা সম্প্রচার, প্রকাশনা বিষয়ক গবেষণা, আর্টস কাউন্সিল ও বয়স্ক শিক্ষা বিষয়ক বিভিন্ন বিদ্বৎ-সমাজের সদস্য বা প্রধান ছিলেন তিনি, যেমন রয়াল শেক্সপিয়ার কোম্পানির গভর্নরও ছিলেন। সত্যি কথা বলতে কি, উনি বইটি লেখা শুরু করেছিলেন খেটে-খাওয়া মানুষ ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষের সঙ্গে মিডিয়া, সাহিত্য ও সংস্কৃতির সম্বন্ধের কথা বলতে গিয়ে যেখানে দেখা যায় যে গল্পে, কবিতায়, ম্যাগাজিনের লেখায়, গানে বা সিনেমায় মধ্যবিত্ত মানুষদের জন্য আবেগ-বিহ্বলতা দেখিয়ে ও কিছুটা চোখের জল ফেলেই সবাই থেমে যায়; তাই তাদের অর্থনৈতিক ও প্রতিদৈনিক সংঘর্ষের কথা আলোচনার বাইরেই থেকে যায়—যে বিশাল শক্তিশালী প্রকাশন সংস্থাগুলি বই ও অন্যান্য সঞ্চার মাধ্যমকে কব্জা করে রেখেছে, তাদের এই পাঠক, দর্শক, শ্রোতাদের সেন্টিমেন্টের সুড়সুড়ি দিয়ে নিজেদের ব্যবসা বাড়ানো ছাড়া আর কোনও দায় নেই এই শ্রেণীর মানুষদের জন্য। চিরকাল শোনা গেছে, বলাও হয়েছে যে পড়াশোনা করলেই গাড়ি-ঘোড়া চড়া যাবে, কিন্তু বাস্তবে দেখা গেছে তা নয়, মধ্যবিত্তেরা শুধু কাহিনীর বিষয় হিসেবেই শোভা পান, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক প্রগতির মূল লক্ষ্য তাঁরা নন। হগার্ট যে বইটি লিখে প্রকাশককে জমা দিয়েছিলেন তার সত্যিকারের নাম হতে পারত ‘সাক্ষরতার দুরুপযোগ’, কারণ উনি ধরে ধরে নির্বাচিত কাগজ, প্রকাশন-সংস্থা ও সঞ্চার-মাধ্যমের ব্যবসায়ীদের আক্রমণ করেছিলেন ওই মূল পাণ্ডুলিপিতে যার সুর বদলে দিতে বাধ্য হন পরে সত্যিকারের নামগুলি সরিয়ে, কারণ ওঁর প্রকাশকেরা কোর্ট-কাছারির ভয়ে হগার্টকে কিছুটা পাল্টাতে বলেন। এইজন্য বইটার পুরো নাম পড়লে এই গল্পের কিছুটা আন্দাজ পাওয়া যায়—‘The Uses of Literacy: Aspects of Working-Class Life With Special Reference to Publications and Entertainments’। মজার ব্যাপার হচ্ছে এই দীর্ঘ প্রবন্ধটির মূল ভিত ছিল ১৯৪৬-এ লিখতে শুরু করা ওঁরই একটি অসমাপ্ত উপন্যাসে—যা উনি লেখা শুরু করেছিলেন লীডস-এর শ্রমজীবী মানুষদের প্রতিদিনের জীবনের শব্দ, আস্বাদ, আশংকা, আকাঙ্ক্ষা, দর্শন ও বাচনের ওপর ভিত্তি ক’রে। হগার্টের বিষয়ের অভিনবত্বই নয়, ওঁর ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণের নিজস্ব ভঙ্গি ও শৈলী ছিল আকর্ষণের কেন্দ্র-বিন্দু। মধ্যবিত্ত মানুষের বৃত্ত ও তাদের সমস্যা এবং তারই মধ্যে তাদের সংস্কৃতিক প্রস্ফুরণ এসব তো ছিলই ।
হগার্ট-এর ব্যক্তিগত প্রসংগ থেকে ফিরে আসা যাক ‘সাংস্কৃতিকী’-র কথায়; এই দেখার একটা সমস্যা হচ্ছে এই যে আমরা কি রেমন্ড উইলিয়ামস-এর ‘দ্য লঙ্গ রেভোল্যুশান’ (১৯৬১) থেকে যে বক্তব্য উঠে আসছে তাও এরই সঙ্গে জুড়ে নিয়ে ও মেনে নিয়ে বলব যে শিল্প-বিপ্লব ও গণতন্ত্র-প্রতিষ্ঠার দীর্ঘ আন্দোলনের ইতিহাসের ধারায় এগিয়ে গিয়ে আমাদের মধ্যবিত্ত সমাজের হাতে যে একটা সাংস্কৃতিক বিপ্লবকে তৈরী করা ও চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার রাশ মহাকাল ধরিয়ে দিয়েছেন, তাকে ছেড়ে দিলে চলবে না; বরং দীর্ঘ কাল তাকে জিইয়ে রাখতে হবে, যেখানে জনপ্রিয় গান, সিনেমা, কাগজের থাকবে একটা বিরাট ভূমিকা, জনপ্রিয় সাহিত্যকে হতে হবে আরো বেশি দযিত্বশীল, একই ভাবে যে সামাজিক অন্তর্জালে আমরা জড়িয়েছি আজকের পৃথিবীতে নিজেদের, সেখানেও বজায় রাখতে হবে সৃজনী গতিবিধি? অর্থাৎ কি না, মৃত্যুভয়কেও তোয়াক্কা না করে লিখে যেতে হবে যা মনে করি সুস্থ সাংস্কৃতিক মনোভাব, সেই বিষয়েই। এটা অবশ্য সম্পূর্ণভাবে মার্কসীয় অবস্থান না হলেও ‘নিও-লেফট’ বক্তব্যের অঙ্গ-বিশেষ যেখানে মধ্যবিত্ত শ্রেণীকে সমাজের কেন্দ্র-স্থলে রাখা হয়েছে। কিন্তু সমস্যা হল—যদি বিভিন্ন মহাদেশের অধিবাসী কিছু তাত্ত্বিক ও মননশীল মানুষ নিজেদের মধ্যবিত্ত সমাজের প্রতিভূ বলে ধরে নিয়ে একজোট হয়ে কোনো একটি অবস্থানে আসতে চান, দেখা যাবে তাতেও প্রচুর মতের অমিল হচ্ছে; কারণ মধ্যবিত্তের সংজ্ঞা দেশভেদে ভিন্ন ও সম্পূর্ণভাবে কোনো সময় ও ভৌগোলিক বাসস্থান বিশেষে আলাদা, ফলে সেই তথাকথিত মধ্যবিত্তদের কেতনও উড়বে ভিন্ন ভিন্ন ভাবে তাতে আর আশ্চর্য কী?
দুই ‘ম’, অর্থাৎ ‘ম’ধ্যবিত্ত ‘মা’র্কসবাদী বিশ্লেষকরা সাহিত্যকে যখন এমনভাবে দেখা শুরু করলেন যেখানে প্রাচীনপন্থী সাহিত্য সমালোচকদের হাত থেকে আলোচনার রাশখানি কেড়ে নিয়ে লিট-ক্রিট-দের, অর্থাৎ সাহিত্য সমালোচকদের নিজস্ব তৈরি করা জগৎকে পালটে দিলেন সাহিত্যের সঙ্গে সমাজ-ব্যবস্থা বা রাজনীতি বা মনস্তত্ত্বকে জুড়ে দিয়ে, কিছুটা এমন সময় থেকেই ধীরে ধীরে গ’ড়ে উঠতে শুরু করল সংস্কৃতিশাস্ত্র। এরপর এই নতুন জোড়গুলি বা বিষয়সংযোগগুলি ছড়িয়ে পড়তে লাগলো সাহিত্যের পরিধি ছাড়িয়ে সংগীত, শিল্প, থিয়েটার ও সিনেমার দিকে। তখন ‘সংস্কৃতি’ বলতে কোনো ছুঁৎমার্গী উচ্চবর্গের মানুষের বাইরের জগৎ বা নীচুতলার দিকে তাকিয়ে দেখে ‘ছি ছি, এত্তা জঞ্জাল’ বলে আক্ষেপ করা নয়, কোনটা অপসংস্কৃতি ও কোনটা উপসংস্কৃতি তা দেখা নয়—বরং সৃষ্টিকর্মের ও সৃষ্ট কৃতির পাঠের কোন অঙ্গ নির্মিত হয়েছে সমাজ-রাজনীতি বা অর্থনীতির কেমন ধরনের প্রবণতার জন্য, সেটাই হয়ে উঠল বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সাহিত্যালোচনের প্রাচীন ধ্যান-ধারণা যা অলঙ্কারে ও আভূষণে ছিল কল্পিত ও বিজড়িত, তা ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। যাঁরা সঙ্গীতের জগতেও উচ্চাঙ্গ ও নিম্নসঙ্গীতের ভেদাভেদের তত্ত্বকে খাড়া করে ফেলেছিলেন, এই ঢেউ তাঁদেরও যুক্তির ফাঁক দেখিয়ে দিল।
এই প্রসঙ্গে নিক স্টিভেনসন (২০১৩) একটি প্রবন্ধে লিখছেন যে স্বাধীনতার পক্ষে যে সংগ্রাম আমরা বিশ্ব-জুড়ে জীবিত রেখেছি—যা রাষ্ট্রসংঘে বা দেশগুলির মধ্যে অন্তর্রাষ্ট্রীয় সম্বন্ধের মধ্যে দিয়ে প্রায়ই এশিয়া ও আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চলে দ্বিতীয় বিশ্ব-যুদ্ধের পর থেকে কিছু দিন আগেও সভ্য-পৃথিবীকে ভাবিত করেছিল, সেটিকে রেমন্ড উইলিয়ামস বলছেন একটা ‘মিথক’-এর মতন যাকে টিঁকিয়ে-বাঁচিয়ে রাখতেই হবে মানবতার স্বার্থে। গণতন্ত্রের, স্বাধীনতার ও মূলভূত জন্মসিদ্ধ অধিকারগুলির জন্য যে দ্রোহ বা সংগ্রাম শুরু হয়েছিল আধুনিকতার সূচনা-পর্বে তার ইতিহাস কিংবা বিভিন্ন বিপ্লবের ইতিকথা এখন যেন মিথকের বা মিথের মতনই, কারণ বিগত কালের শোষণ ও অত্যাচারের ইতিহাসের অনেক রকমের পাঠ হতেই পারে এবং এই বিপ্লবের মিথ তারই মধ্যে একটি পাঠ, যা আমাদের বর্তমানের জীবনকে টিঁকিয়ে রাখার জন্য যেমন জরুরি, তেমনই দরকারী ভাবীকালের জন্যেও। কেমন করে সাধারণ মানুষের জীবনও জেগে উঠতে পারে বহুর বা সমাজের বা রাষ্ট্রের স্বার্থে—এই মিথ তারই জন্য একটা জরুরি গল্প। যে কোনও রাজনৈতিক প্রকল্পকে সার্থক করে তুলতে এমন মিথের ও ইতিকথার একটা সার্থক ভূমিকা রয়েছে। লেনিন, গান্ধী, চে গুয়েভারা, হ-চি-মিন্, ফিদেল কাস্ত্রো কিংবা মাও-যে-দং-এর গল্পগুলির মিথক রূপে উত্তরণ এইসব কারণেই প্রয়োজনীয়। যেসব জনপ্রিয় আন্দোলনের নিরিখে রক্ষণশীল মার্কসবাদী প্রশাসনের বজ্র-মুষ্টিও পূর্ব ইউরোপ আলগা করে দিতে বাধ্য করে বা আরো অন্যান্য বহু আফ্রিকার দেশগুলিতে অত্যাচারী শাসকদের উত্খাত করতে সক্ষম হয়, জাতির ও মানবতার স্বার্থেই সেই সাংস্কৃতিক বিপ্লবকে চালিয়ে যেতে হবে—এটাই এই অবস্থানের উপজীব্য। রিচার্ড হগার্ট-এর সঙ্গে সঙ্গে তাই রেমন্ড উইলিয়াম্সের নামও একই সঙ্গে উচ্চারিত হয় ‘সংস্কৃতি-শাস্ত্র’-এর নির্মাতা রূপে।
আবার এদিকে যাঁরা সংস্কৃত-প্রাকৃতের একটা প্রাচীর তৈরি করে ফেলেছিলেন লেখক-বাচক-পাঠকের মানসে, তাঁরা যে কতটা অন্যায় করলেন, যত দিন গেল তা তত স্পষ্ট হতে লাগল প্রাকৃত ও অপভ্রংশে রচিত কাব্যসম্ভাবনার আবিষ্কারের সঙ্গে সঙ্গেই। মজার ব্যাপার হল ভাষাবিজ্ঞানের মতো নাকউঁচু কট্টর শাস্ত্রের পণ্ডিতেরা যে ভাষানির্বিশেষে সর্বজনীনতার পথে হাঁটা শুরু করেছিলেন আবিষ্কারী অভিযাত্রীদের মতো, তার ভিত কতটা নরম তাও যেন এই সময়েই লেওনার্ড ব্লুমফিল্ডের ‘মেনোমিনি ব্যাকরণে’র আদলকে অনেকগুণ এগিয়ে নিয়ে বিচিত্র সব ভাষার ব্যাকরণ রচনার স্বর (যেমন বব ডিক্সনের অস্ট্রেলীয় বিপন্ন ভাষা ড্যিরবাল)[৭] বা য়িদিং[৮], বুমা ফিজিয়ান[৯] অথবা জারাওয়ারা[১০] নিয়ে কাজ বা জেফ পুল্লম ও ডার্বিশায়ারের ব্রেজিলের বিধেয়-প্রধান ভাষা[১১] বা অবজেক্ট-ইনিশিয়াল ও-এস-ভি ভাষা বর্ণনা কিংবা বার্নার্ড কমরির চুকচী ও অন্য সোভিয়েত ভাষা নিয়ে কাজ[১২]) যেন বারবার মনে করিয়ে দিতে লাগল ল্যাংগুয়েজ ইউনিভার্সাল যতটা জরুরি ল্যাংগুয়েজ পার্টিকুলার তার থেকে কম জরুরি নয়। মোদ্দা কথা একটা সর্বজনীন শাস্ত্রীয় উচ্চাঙ্গ ও পরিসংস্কৃত মানদণ্ড গড়ার অবধারণা ধাক্কা খেল সাহিত্যালোচনা, সঙ্গীতবিদ্যা, ভাষাতত্ত্ব—সর্বত্র। বঙ্গদেশে ভাঙার হোতা সব মিলিয়ে মাইকেল, কল্লোল, গিরিশ ঘোষ-নটীবিনোদিনী, প্রমথ চৌধুরীরা, দক্ষিণেশ্বরের গদাধর ঠাকুর এবং অবশ্যই রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথ, কেননা কীভাবে গান ভাঙতে হয়—শাস্ত্রীয়তার প্রাসাদ থেকে ধানী জমিতে পেড়ে ফেলে, কিংবা কেমন করে ছবি আঁকার শাস্ত্রীয় ব্যাকরণে ডেকে আনতে হয় মিতবিদ্রোহ, এক ধরনের কন্ট্রোল্ড অ্যাগ্রেশান—তা ওঁর কাছ থেকেই শিখেছি আমরা। ফলে যখন পরবর্তীতে উদয়শঙ্কর, রবিশঙ্কর, আলি আকবর, বিরজু মহারাজ, জাকির হুসেন কিংবা জ্ঞান গোঁসাই থেকে এ. আর. রহমানেরা মার্গ ও দেশি-র বেড়া ভেঙে ফেলে নানান পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে থাকেন, তখন গেল-গেল রব ফেলে দেওয়ার মতো টুলো পণ্ডিতেরা পর্যন্ত বিস্ফারিত চোখে নবসৃজনকে নির্নিমেষ দেখতেই থাকেন।
এসব কথা থেকে একটি ব্যাপার, মানে সংস্কৃতিশাস্ত্রের একটি চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য স্পষ্ট ফুটে ওঠে—তা হল এখানে কোনো-না-কোনো ভাবে ‘এই সময়’ হয়ে পড়ে গুরুত্বপূর্ণ। বিবর্তন ও তার ইতিহাস দেখা-পড়া-জানার জন্য অন্য বিষয় (যেমন, ইতিহাস বা পুরাতত্ত্ব অথবা ঐতিহাসিক ভাষাবিজ্ঞান) রয়েছে; কিন্তু বর্তমানের পরিধিতে এই সময়ের ফ্রেমে যে-ছবি আঁকা হবে, তার দায় সংস্কৃতিশাস্ত্রের। আজকে যে সামাজিক বৈষম্য, অদ্যতন আন্তর্জাতিক কূটনীতি, এখনকার আওতায় পড়ছে যে ভেদ-বিভেদের রাজনীতি, বর্তমানের অর্থনৈতিক সিদ্ধান্তসমূহ ও তাদের ফলাফল, সমাজে, পরিবারে, ব্যবহারে কিংবা সাহিত্যে, নাটকে, সিনেমায় তাদের পরিণাম—এসবই দেখা ও দেখানো সংস্কৃতিশাস্ত্রের কাজ। যে বিভেদ, বিচ্ছেদ, বিষণ্ণ সংঘাত অথবা যেমন প্রেম, কামিতা, বিকর্ষণ হরহামেশা দেখা যাচ্ছে সিরিয়ালে ও সিরিয়াস জীবনেও—সংস্কৃতিশাস্ত্র ফলানো পাণ্ডিত্যের আড়ালে সেগুলিকে লুকিয়ে চেপে রেখে ভালো ভালো গল্প কথা বলতে চায় না। যদি কৃষকেরা একের পর এক বিনা প্রতিবাদে আত্মহত্যা করতে থাকে আর যদি কবি-লেখক-সঞ্চারমাধ্যম সে বিষয়ে ভাব করে, ‘কই, জানি না তো!’—তাহলে সংস্কৃতিশাস্ত্র জানতে চেষ্টা করে সৃজনমনীষার অমানবিকতার গভীরে কোন রোগ দানা বেঁধেছে। যদি পরের পর মন্দমতি অল্পায়ু অর্ধশিক্ষিত ছেলেপুলেরা কিছু ধেড়ে প্রাজ্ঞ মানুষের কথায় হেলায় জীবন বিসর্জন দেয় এমনভাবে যাতে প্রচুর মানুষ হারায় আত্মজন প্রিয় অঙ্গ বা অঙ্গনখানি, তবে সংস্কৃতিশাস্ত্র জানতে চায় এই প্রবণতার পিছনে লুকানো বঞ্চনা, দ্বেষ, কথা-না-রাখার কাহিনিগুলি।
একথা যে কোনো পাঠিকা তুলতেই পারেন যে হাঁড়ির ও হাল-হকিকতের ব্যাকরণ জানতে চাওয়ার এমন সব ইচ্ছা, ব্যাখ্যা, প্রশ্ন ও জটিলতাকে নিয়ে কোনো শাস্ত্র গড়ে তোলা কি একান্তই দরকার ছিল? থাকলেও, তাকে অ্যামেচার সাংবাদিক বা সন-সনী-খেজ মিডিয়া প্রফেশনালদের হাতে ছেড়ে না দিয়ে কেন একগুচ্ছ সিরিয়াস বিদ্বান তুলে নিলেন ব্যাখ্যাতব্য বিষয় রূপে? বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ী শিক্ষার আঙিনায় এমন বেজন্মা ও খুঁতখুঁতে পরছিদ্রকাতর বিষয়কে না ঢুকতে দিলেই চলছিল না? মানুষের বা অগ্রগতির ইতিহাসে কী এমন ঘটলো যে জন্য আজ সংস্কৃতিশাস্ত্র ধেয়ে আসছে ঐতিহ্যময় সাহিত্য, ইতিহাস, সমাজতত্ত্ব বিভাগগুলির সুখী গৃহকোণে এমনসব অজানা অদেখা তথ্য, তত্ত্ব ও বিশ্লেষণ নিয়ে? এরা কারা যারা গ্রেট ট্র্যাডিশানকে ছোটো ছোটো ঐতিহ্যের পাল তোলা নৌকায় চড়ে ভাঙতে চায়। এই যে ১৮০১-এর শ্রীরামপুর পরীক্ষণাগারে শাসক ও শোষক তৈরির কারখানায় প্রশিক্ষণার্থ, অর্থাৎ ফিরিঙ্গিনাম-উপকারার্থং কিছু বিষয় ও পাঠ্যপুস্তক তৈরি হল, যার বেঁধে দেওয়া গৎ-কে ১৮১৬-র স্কুলবুক সোসাইটি কিংবা বিদ্যাসাগরীয় নবপ্রয়াসও তেমন করে ভাঙতে পারল না—কে তুমি হে বুদ্ধদেব বসু কিংবা নন্দলাল-রামকিংকর যে দুম করে চেনা-জানা বিষয়সমূহ বা পড়ানো-পদ্ধতিকে দেবে বদলে আমূল? আমরা বহু ভেবে যে লিবারেল আর্ট্স তৈরি করেছি যাতে কিছুটা মূলভূত গণিত, কিছুটা চালু ভূগোল, খানিকটা আমাদের মতো করে লেখা ইতিহাস ও সাহিত্যপাঠের জন্য প্রেসক্রিপশন যেখানে বেশ ব্যালান্স করে জসীমউদ্দীন[১৩] ও কামিনী রায়[১৪]-কে রাখা হবে, যেখানে মনে প্রশ্ন তোলে কিংবা সংশয়ের হুল ফোটায় এমন গল্প-কবিতা-নাট্যাংশ বা প্রবন্ধকে সযত্নে বাদ দিয়ে চলা হবে—তার অম্বুজপ্রায় দেয়ালকে ভেঙে ফেলতে এলে তুমি কে হে?—এমন সব প্রশ্ন প্রায়ই শুনতে হয়েছে ও হয় সংস্কৃতিশাস্ত্রকে। পদার্থবিদ্যার যে অমোঘ নিয়মে জল পড়লেই পাতা নড়বে ও গাছের ডাল ঝাঁকালেই এ ফর অ্যাপ্ল ঊর্দ্ধে উত্থিত না হয়ে নিম্নে ধাবিত হবে, তার নিয়মের ব্যতিক্রম শেখাতে চাওয়ার তুমি কে? কবে আমাদের পাঠ্য বইয়ে অমিয়ভূষণ, কমলকুমার, মহাশ্বেতা দেবী বা সৈকত রক্ষিতেরা স্থান পাবেন বা কবে উৎপলকুমার বসু, অমিতাভ গুপ্ত বা রণজিত দাশেরা জায়গা পাবেন তা কে ব’লে দেবে? যে রক্ষণশীল সমাজের মাসি-মামা-মেসোরা বিভিন্ন সাহিত্য বিভাগের ধামা ধ’রে বসে আছেন, যাঁদের পেরিয়ে ঢোকার জন্য প্রতিটি ব্যতিক্রমী লেখাকে গেটপাস যোগাড় করতে হবে, তাঁরা কোন মন্ত্রে চিঁড়ের মত ভিজবেন, সেইটাই হল বড় চ্যালেঞ্জ।
সূত্রনির্দেশ :
[১] Hoggart, Herbert Richard. (1957) The Uses of Literacy: Aspects of Working Class Life. London: Chatto and Windus. Reprinted in 2009 as Penguin Classics.
[২] একটা প্রশ্ন উঠতেই পারে – সংস্কৃতি-শাস্ত্র বা Culture Studies না ‘সাংস্কৃতিকী’ অথবা Cultural Studies? পশ্চিমের বহু বিশ্ববিদ্যালয়ে এই বিষয়টির নাম দেওয়া হয়েছে Cultural Studies।
[৩] সংস্কৃতির বিজ্ঞান লেখা হয় নি, তাও নয়, কেননা হালে ‘ফাউন্ডেশান অফ অ্যানন্থ্রপলোজি’ সিরিজে Percheron Press বা Eliot Werner Publications ২০০৫ সালে ছাপেন লেসলি হোয়াইট-এর যে বইটি তার নাম: 'The Science of Culture: A Study of Man and Civilization’। তবে এই বইটিকেও কলা-বিদ্যারই উদাহরণ বলা যায়, যে অর্থে অনেক ভাষা-বিজ্ঞানের বই বিজ্ঞান বেশি, কলা কম, এটা তেমন নয়।
[৪] Hoggart, Herbert Richard. (1957) The Uses of Literacy: Aspects of Working Class Life. London: Chatto and Windus. Reprinted in 2009 as Penguin Classics.
[৫] http://www.somewhereinblog.net/blog/ark96/29855662
[৬] প্রথমে এটি উত্পাদিত হয় মেসোআমেরিকান অঞ্চলে, অর্থাত কিনা হন্ডুরাস, নিকারাগুয়া ও মেক্সিকোয়, সেখানকার সংস্কৃতি থেকে ছড়ায় ইউরোপে। স্পেনিয়দের হাত ধ’রে তা যায় ক্যারিবিয় সমাজ হয়ে ফিলিপাইনে, এবং তার পর দক্ষিণপূর্ব এশিয়া এবং ধীরে ধীরে সমগ্র এশিয়াতেই ছড়িয়ে পড়ে এই ‘বিলাতি বেগুন’ কিংবা টমেটো।
[৭] Dixon, R. M. W. (1972) The Dyirbal Language of North Queensland (Cambridge Studies in Linguistics, 9). Cambridge: Cambridge University Press.
[৮] Dixon, R. M. W. (1977) A Grammar of Yidiny (Cambridge Studies in Linguistics, 19). Cambridge: Cambridge University Press.
[৯] Dixon, R.M.W. (1988) A Grammar of Boumaa Fijian. Chicago: University of Chicago Press.
[১০] Dixon, R. M. W. (2004) The Jarawara Language of Southern Amazonia, Oxford: Oxford University Press.
[১১] Derbyshire, Desmond & Geoffrey K. Pullum, eds. (1986-88) Handbook of Amazonian Languages, Vols 1-4. De Gruyter, Mouton.
[১২] Comrie, B. (1981). The Languages of the Soviet Union, Cambridge: Cambridge University Press (Cambridge Language Surveys).
[১৩] জসীমুদ্দিন-এর (১৯০৩-৭৬) জন্ম ১লা জানুয়ারি ফরিদপুর জেলার তাম্বুলখানা গ্রামের একজন স্কুল শিক্ষক আনসার উদ্দিন মোল্লা এবং আমিনা খাতুন-এর সন্তান রূপে। পড়াশোনা প্রথমে ফরিদপুর ওয়েলফেয়ার স্কুল, ও পরে ফরিদপুর জেলা স্কুলে, এবং বি. এ. এবং এম. এ. শেষ করেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। তারপর ১৯৩৩-এ কলকাতাতেই ড. দীনেশ চন্দ্র সেনের অধীনে রামতনু লাহিড়ী গবেষণা সহকারী পদে যোগ দেন। পরে ১৯৩৮ থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের অধ্যাপক রূপে যোগ দেন। প্রথম কাব্য-সংকলন – ‘রাখালী’ (১৯২৭) হলেও ওঁর খ্যাতি আসে ‘নকশী কাঁথার মাঠ’ (১৯২৯) থেকে। পরে আরো বেশ ক’টি কাব্য-গ্রন্থ প্রকাশিত হয়: ‘বালুচর’ (১৯৩০), ‘ধানখেত’ (১৯৩৩), ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’ (১৯৩৪), ‘হাসু’ (১৯৩৮), ‘রঙিলা নায়ের মাঝি’ (১৯৩৫), ‘রূপবতী’ (১৯৪৬); স্বাধীনতার পর ছাপা হয় : ‘মাটির কান্না’ (১৯৫১), ‘এক পয়সার বাঁশী’ (১৯৫৬), ‘সকিনা’ (১৯৫৯), ‘সুচয়নী’ (১৯৬১), ‘ভয়াবহ সেই দিনগুলিতে’ (১৯৬২), ‘মা যে জননী কান্দে’ (১৯৬৩), ‘হলুদ বরণী’ (১৯৬৬), ‘জলে লেখন’ (১৯৬৯), এবং সব শেষে ‘কাফনের মিছিল’ (১৯৮৮)। লোক-সাহিত্য বিশেষজ্ঞ রূপে ‘জারি গান’ (১৯৬৮) ও ‘মুর্শিদী গান’-এর (১৯৭৭) সংকলনও বের করেন। প্রকাশিত হয় উপন্যাস ‘বোবা কাহিনী’ (১৯৬৪) এবং চারটি ভ্রমণ কাহিনী: ‘চলে মুসাফির’ (১৯৫২), ‘হলদে পরির দেশে’ ( ১৯৬৭), ‘যে দেশে মানুষ বড়’ (১৯৬৮) এবং ‘জার্মানীর শহরে বন্দরে’ (১৯৭৫)। যদিও পল্লীকবি হিসেবেই ওঁর খ্যাতি, ওঁর বেশ ক’টি নাটকও প্রকাশিত ও অভিনীত হয়েছে – যেমন, ‘পদ্মাপার’ (১৯৫০), ‘বেদের মেয়ে’ (১৯৫১), ‘মধুমালা’ (১৯৫১), ‘পল্লীবধূ’ (১৯৫৬), ‘গ্রামের মেয়ে’ (১৯৫৯), ‘ওগো পুস্পধনু’ (১৯৬৮) ও ‘আসমান সিংহ’ (১৯৮৬), তবে ওঁর আত্ম-জীবনীমূলক গ্রন্থগুলিও খুবই মূল্যবান – বিশেষ ক’রে প্রথম দুটি: ‘যাদের দেখেছি’ (১৯৫১), ‘ঠাকুর বাড়ির আঙ্গিনায়’ (১৯৬১), ‘জীবন কথা’ ( ১৯৬৪) এবং ‘স্মৃতিপট’ (১৯৬৪)।
[১৪] কবি কামিনী রায় (১৮৬৪-১৯৩৩) ব্রিটিশ ভারতের প্রথম মহিলা স্নাতক ছিলেন সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে অধ্যয়নের জন্য এবং সমাজকর্মী এবং নারীবাদী লেখিকা হিসেবে বিখ্যাত ছিলেন; ব্রাহ্মধর্মাবলম্বী, বিচারক ও ঐতিহাসিক চণ্ডীচরণ সেনের কন্যা কামিনীর জন্ম হয় পূর্ববঙ্গের বাকেরগঞ্জের বাসণ্ডা গ্রামে (যা এখান বাংলাদেশের বরিশালে পড়ে) এবং তাঁর স্বামী ছিলেন একজন সিভিলিয়ান কেদারনাথ রায়; এক সময়ে ছদ্ম-নামে (‘জনৈক বঙ্গমহিলা’) লিখতেন; পরে ১৮৮৬-থেকে নিজের কলেজ-এ (বেথুন কলেজ) অধ্যাপনাও করেছিলেন। তিনি নারী শ্রম তদন্ত কমিশন (১৯২২-২৩) এর সদস্য ছিলেন। মাত্র পনের বছর বয়সে তাঁর প্রথম কাব্য গ্রন্থ ‘আলো ও ছায়া’ (হেমচন্দ্রের ভূমিকা সম্বলিত) প্রকাশিত হয় ১৮৮৯; পরে ছাপা উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থের মধ্যে আছে : ‘নির্মাল্য’ (১৮৯১), ‘পৌরাণিকী’ (১৮৯৭),মাল্য ও নির্মাল্য (১৯১৩), অশোক সঙ্গীত (সনেট সংগ্রহ, ১৯১৪), অম্বা (নাট্যকাব্য, ১৯১৫), দীপ ও ধূপ (১৯২৯),জীবন পথে (১৯৩০), প্রভৃতি । অমিত্রাক্ষর ছন্দে রচিত 'মহাশ্বেতা' ও 'পুণ্ডরীক' তাঁর দু'টি প্রসিদ্ধ দীর্ঘ কবিতা। এছাড়াও, ১৯০৫ সালে তিনি শিশুদের জন্য গুঞ্জন নামের কবিতা সংগ্রহ ও প্রবন্ধ গ্রন্থ ‘বালিকা শিক্ষার আদর্শ’ রচনা করেন। ১৯০৯ খ্রীস্টাব্দে কামিনী রায়ের স্বামীর অপঘাতে মৃত্যু ঘটেছিল, যার ছাপ ওঁর কবিতায় পাওয়া যায় । জীবনের শেষ ভাগে তিনি হাজারীবাগে কাটিয়েছেন। ১৯২৯ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক কামিনী রায়কে 'জগত্তারিণী স্বর্ণপদক' প্রদান করে সম্মানিত করেন।
আকর-গ্রন্থ সূচী
Bennett, Tony, Lawrence Grossberg, Meaghan Morris, and Raymond Williams. (2005) New Keywords : A Revised Vocabulary of Culture and Society. Malden, MA: Blackwell Pub.
Grossberg, Lawrence. (1997) Bringing it all Back Home : Essays on Cultural Studies. Durham, NC: Duke University Press.
-----. (2010) Cultural Studies in the Future Tense. Durham, NC: Duke University Press.
-----, Cary Nelson, and Paula A. Treichler. (1992) Cultural Studies. New York: Routledge.
Hoggart, Herbert Richard. (1957) The Uses of Literacy. London: Chatto and Windus.
-----. (1966). Higher Education and Cultural Change: A Teacher's View (Earl Grey Memorial Lecture) University of Newcastle.
-----. (1969). Contemporary Cultural Studies: An Approach to the Study of Literature and Society. University of Birmingham, Centre for Contemporary Cultural Studies, Based on a lecture given to the annual conference of the American Association for Higher Education at Chicago on 20 March 1978.
----- with Janet Morgan. (1982) The Future of Broadcasting. Holmes & Meier.
-----. (1994) Townscape with Figures: Farnham – Portrait of an English Town London: Chatto and Windus.
-----. (1995) The Way We Live Now: Dilemmas in Contemporary Culture. London: Chatto and Windus; Republished as (1997) The Tyranny of Relativism: Cul-ture and Politics in Contemporary English Society (Transaction Publishers.
-----. (2003) Everyday Language and Everyday Life. Transaction Publishers.
-----. (2004) Mass Media in a Mass Society: Myth and Reality. Continuum International Publishing Group – Academi.
Stevenson, Nick. (2013) ‘The Long Revolution in the global age’. Soundings: A Jour-nal of Politics & Culture, 54: 66-76. Retrieved, 8th Jan,16 fr ‘Project Muse’ at http://muse.jhu.edu/login?auth=0&type=summary&url=/journals/soundings_a_journal_of_politics_and_culture/v054/54.stevenson.pdf
Storey, John. (1996) What is Cultural Studies?: A Reader. London; New York: Arnold.
Williams, Raymond Henry. (1958) Culture and Society. London, Chatto and Windus; New edition with a new introduction, New York, Columbia University Press, 1963.
-----. (1961) The Long Revolution. London, Chatto and Windus, 1961. Reissued with additional footnotes, Harmondsworth, Penguin, 1965.