রবীন্দ্রনাথের 'মানভঞ্জন' গল্পে গিরিবালা যখন অন্দর ও রান্নাঘর থেকে প্রকাশ্য মঞ্চে এসে দাঁড়ালো সেই মুহূর্তটি আমাদের ইতিহাসে অসম্ভব তাৎপর্যময়। একথা সত্য যে গিরিশ ঘোষ যখন শাহরিক বিনোদনের মাত্রা খুঁজেছিলেন তখন এর কোনো প্রত্যক্ষ গুরুত্ব আমরা খুঁজে পাইনি, কেননা নটী বিনোদিনী ও অন্যান্য মহিলা চরিত্ররা মোটামুটিভাবে পাতাল থেকে আসা রমণী। কিন্তু যখন বাংলা ছবি চল্লিশের দশকে পৌঁছালো, বলা ভালো তিরিশের দশক যখন সবাক হল তখন থেকে আমরা দেখলাম যে আস্তে আস্তে আমাদের আকাশে নক্ষত্র আসছেন এবং সেই নক্ষত্রের মধ্যে পথিকৃৎ এবং প্রধান হলেন পুরুষ মহারাজকুমার প্রমথেশ চন্দ্র বড়ুয়া এবং নারীদের মধ্যে কাননবালা। আজকে বরং নারী নক্ষত্রদের কথাই একটু বলা যাক।
বিষ্ণু দে যতই বলুন 'কলম্বাস আবিষ্কৃতা বিদেশিনী মহাশ্বেতা স্নানশয্যা বাহু আর কদলীদলিত উরু বৃথাই নাড়ালে' - প্রয়াত সাংবাদিক এন. কে. জি.-র কাছে শুনেছি ১৯৩৩ সাল থেকেই কলকাতার ইংরিজি সংবাদপত্রগুলি নিয়মিত সিনেমা আলোচনার কলাম খোলেন। নির্মলবাবুর করা প্রথম বিদেশী সিনেমার সমালোচনা হল মেরিলিন ডিয়েট্রিসের 'ব্লু অ্যাঞ্জেল'। মেরিলিন ডিয়েট্রিসের মুখে সেই অবিস্মরণীয় গান 'ফলিং ইন লাভ এগেন' তখন শিক্ষিত শহুরে যুবকের মুখে মুখে ফিরত।
এই রবীন্দ্রনাথের 'মানভঞ্জন' নিয়ে মধু বসুরা ছবি করলেন। সেই ছবিতে নায়িকা ছিলেন শ্বেতাঙ্গিনী ললিতা দেবী অর্থাৎ মিস বনি বার্ড। বাংলা ছবিতে নারীর আগমন তবু এত সুষম ছন্দে ছিল না। ছায়াছবি যেহেতু নিজেই আমাদের শ্যামল, সুন্দর সামন্ততান্ত্রিক জীবনে একটি আধুনিকতার পত্তন, আর সেই আধুনিকতা যন্ত্র-নির্ভর, সুতরাং নানারকমভাবে পর্দানসীন এবং অসূর্যম্পশ্যা নারী যে পর্দায় প্রতিফলিত হতে থাকল তা উনিশ শতকের পরিপ্রেক্ষিতে মস্ত একটি বিপ্লব। যদিও বম্বেতে আমাদের কাহিনি ছবির আদিপুরুষ দাদাসাহেব ফালকে ও কলকাতায় ধীরেন গাঙ্গুলী এবং অবশ্যই বসু পরিবার মধু ও সাধনা - নিজেদের স্ত্রী-কন্যাদের প্ররোচিত করেছিলেন, এরকম দৃষ্টান্ত নামে মাত্র। সাধারণত অ্যাংলো ইন্ডিয়ান মহিলারাই সিনেমায় আসতেন। বাকি যারা নটী ছিলেন তারা সবাই দুরূহ দারিদ্রের মধ্যে থেকে উঠে আসা 'পতিতা' রমণী।
নির্বাকযুগের গোড়ায় কলকাতায় নায়িকা হিসেবে সবচেয়ে নাম করেছিলেন পেসেন্স কুপার। কমপক্ষে তিরিশটি ছবির নায়িকা হয়েছিলেন তিনি। সে যুগে গ্রাম থেকে শহরে আসা নতুন নাগরিক চলচ্চিত্রকে ভাবত একধরনের প্রদর্শনশালা। নারীরা স্বভাবতই ভ্রাম্যমান অবজেক্টস অন ডিসপ্লে। আর এই শহুরে লোকনাট্যে নায়িকাদের শরীরী বিভঙ্গটুকুই ছিল যথেষ্ট। যেমন মিস গহর। ১৯১০ সালে লাহোরে তার জন্ম। নিয়তি তাকে টেনে নিয়ে এল কলকাতায়। মাত্র ৯ বছর বয়েসে বিল্বমঙ্গল (১৯২১) ছবিতে অভিনয় করার জন্য। পরে চন্দুলাল শা তাকে বক্স অফিসের রাণী করে তোলেন। তার জনপ্রিয়তা এতদূর পৌঁছেছিল যে সে যুগে, সেই ১৯২৯ সালে, তিনি গ্ল্যামার সাম্রাজ্ঞী মিস সুলোচনাকে ৭৫১ ভোটে হারিয়ে দেন। অবাক হতে হয় যে সুলোচনার মাইনে বম্বের গর্ভনরের থেকেও বেশী ছিল। সুলোচনার আসল নাম রুবী মেয়ার্স। তিনিই বিশের দশকে সর্বোত্তমা।
কিন্তু এই গল্পগুলি ব্যতিক্রম। তাদের যৌবনান্তে অনিবার্য পরিনতি ছিল নিষ্ঠাবতী আশ্রিতা হিসেবে মন্দিরে সেবার্চনা। যেমন ১৯২২ সালে চূড়ান্ত সফল ছবি 'বিষবৃক্ষ'তে যিনি কমলমনির ভূমিকায় অভিনয় করেন সেই নীরদাসুন্দরী - হতভাগ্য জন্ম, বস্তির জীবন। যাতে বিয়ের পর কোথাও পালাতে না পারেন সেজন্য নাম কা ওয়াস্তে বিয়ে হয়েছিল রূপোর আমপাতার সঙ্গে। তারপর অভিনেত্রী জীবন। অবশেষে নটী বিনোদিনী বিষয়ে যেমন রামকৃষ্ণ কাহিনি, নীরদাসুন্দরীকেও কৃপা করেন সারদামনি।
শব্দ এল। চরিত্রলিপি ভরাট করতে শুরু করলেন উমাশশী, মেনকা দেবী বা যমুনা বড়ুয়া। কেননা শব্দের যুগে ফিরিঙ্গি মেয়েদের দাপট থাকতে পারে না। স্থানীয় ভাষায় তাদের দখল ছিল না, ফলে তাদের বিদায় নিতে হয়। দেবকী কুমার বসুর (১৯৩২) 'চণ্ডীদাস' ছবিতে উমাশশী দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিপরীতে অভিনয় করার পরই আমাদের বাঙালি নায়িকাদের জমি তৈরি হয়। উমাশশীর মধ্যে সেই নিম্নবর্গীয় দৃঢ়তা ছিল যা মধ্যযুগের বৈষ্ণব পদাবলীর বাইরে রাণী ধোপানির মধ্যে এক অন্যরকম তাপ সঞ্চার করে। বোঝা যাচ্ছিল বাইরের রাজনীতি গান্ধীজির 'হরিজন' সংলাপের সূত্রে মধ্যযুগ আধুনিক যুগের সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময় করে গেল। বাংলা সাহিত্যের প্রভাবে কিছুটা সমাজ অতিরিক্ত পরিসর সিনেমাতেও দেখা দিল। প্রেম আমাদের সামাজিক আঙিনায় ছিল না। ১৯৩৮ সালে দেবকী কুমার বসু পরিচালিত 'বিদ্যাপতি'-তে স্তব্ধ উচ্ছাসে আমরা দেখলাম একটি নক্ষত্র আসে : সে 'অনুরাধা'। কানন দেবী হয়ে উঠলেন আমাদের মায়া কাননের ফুল। এই প্রথম আমরা বুঝলাম যে অন্য অভিনেতাদের মধ্যে একজন তারা কিভাবে অন্যরকমভাবে কাজ করে। উপরন্তু কাননদেবীর সম্পদ ছিল তার অনন্য কণ্ঠ। এবং সেই যুগে যখন প্লে ব্যাক পদ্ধতি উন্নত হয়নি তখন কাননদেবী যেমন রূপে তেমন কণ্ঠে বাঙালি পুরুষের চোখের মণি হয়ে উঠেছিলেন সেটা বলতে কোনো দ্বিধা নেই। একদিকে নিষ্পাপ কৌমার্য অন্যদিকে দগ্ধ বাসনা - এর অন্তবর্তী কোনো স্তরে কাননদেবীর সুদূর দৃষ্টি যেন নায়ককে ছাপিয়ে নায়িকাকে প্রতিষ্ঠিত করে। কাননদেবীর গলায়, মেক আপের মধ্যে, সেই গুন ছিল। পশ্চিমী সমালোচক বেলা বালাজ খেয়াল করেছেন যে একটি বিধুর বিষন্নতা যেন স্বাক্ষরিত হয়ে আছে। 'মুক্তি', 'শেষ উত্তর', 'রাজলক্ষ্মী ও শ্রীকান্ত' প্রায় সব ছবিতেই কাননদেবী চরিত্রের বাইরে উপচে পড়ে নিম্নরেখ হতে থাকেন। তিনি এমন এক সময়ের প্রতিনিধি যখন মুখ আলাদাভাবেই দর্শনীয় ছিল। চল্লিশ দশকের শেষ থেকে আমাদের পারিবারিক সীমারেখার মধ্যে যখন রোমান্টিকতার নতুন অর্থ পাওয়া যাচ্ছে তখন কাননদেবীর কপালের 'অনুরাধা' টিপ সেই সময়ের শিল মোহর। কাননদেবী সেদিক থেকে বাঙালি নারীকে স্বর্গ থেকে মর্ত্যে নিয়ে এলেন। আর হয়ে উঠলেন চরিত্র অতিরিক্ত দ্রষ্টব্য। শুধু পদ্মশ্রী বা ফালকে পুরস্কারের জন্য নয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রী স্বয়ং কৃষ্ণ মেনন তার অনুরাগী ছিলেন বলেও নয়, দশ বছর বয়েসের যে বালিকা কাননবালা ম্যাডান কোম্পানীতে সামান্য কটি টাকার বিনিময়ে জীবন সঁপে দিয়েছিলেন এবং প্রথম ছবিতেই প্রতারিত হয়েছিলেন তার পরবর্তী উত্থান সম্ভবত এজন্যই যে প্রমথেশ, দুর্গাদাস প্রমুখ নায়ককে সামনে রেখেও তিনি প্রমান করতে পারেন যে Woman is more mythic than man as both subject and object. She is naturally more of a star than a man. কাননদেবী দেখাতে পেরেছিলেন যে যৌথ পরিবারতন্ত্রে মহিলাদের নিতান্ত যতিচিহ্নের বাইরে একটি স্বতন্ত্র অস্তিত্ব আছে এবং তাদের জীবন একভাবে পুরুষকে পুর্নগঠিত করতে পারে। নিঃসন্দেহে বলা যায় কাননদেবী শুধু একজন সফল অভিনেত্রী নন তার জীবনে নানা বর্ণ বিচ্ছুরণে তিনিই আমাদের প্রথম স্টার নায়িকা।