• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৭২ | সেপ্টেম্বর ২০১৮ | কবিতা
    Share
  • পাঁচটি কবিতা : সুমন চক্রবর্তী


    || অন্যমন ||

    বিছানার কার্নিশে ইতস্ততঃ ঘোরাফেরা করে স্মৃতির রাংতা,
    বালির নদী ভীরু পায়ে হেঁটে পার হই,
    অপেক্ষা করে করে গাল ফোলায় ডাকটিকিট,
    রাত ঠিক শেষ হয়, শুধু আমাদের সব গল্প শেষ হয়না,
    তোমার জন্যে সাধ করে আনা ঝিনুকের আংটি, রোদের ঝিলিক,
    বন্ধক রাখি ধ্রুবতারার ঝিলমিলের কাছে,
    স্বপ্নের ফেরিওয়ালারা মিলিয়ে যায় কোন্‌ সে উদাসী হাওয়ায়,
    লাল কাঁকরের পথ জলে ভেজে, রোদে পোড়ে,
    বর্ণহীন ইতিহাসে লেখা হয় মনখারাপের জানাজানি,
    আমিও মিছিলে পথ হাঁটি, পাতায় জলের লেখা পড়ি,
    কবিতার খাতাখানি লুকিয়ে রাখি দূরবীনের পেছনে,
    সাঙ্কেতিক ভাষারীতি দিয়ে তৈরি করি নিজস্ব কারাগার,
    সোহাগী সোনায় মুড়ে যায় রঙহীন গোধূলির আভা,
    একলা ভেসে বেড়াই, আমি আর আমার অন্যমন।


    || দিগন্ত ||

    বিস্তীর্ণ মেহগনির ঘর মিশে গেছে নীলিমায়,
    মোহনার লক্ষ যোজন দূরে বিবর্ণ নুড়িপাথর পড়ে থাকে,
    ঘষামাজাহীন দিনকাল জেগে থাকে অস্ফুট কথার আশায়,
    ফুলহাতা সোয়েটারে গল্পের পাঁচিল ঘেঁষে অন্যতমা,
    ঘুমভাঙ্গা সকালে গাল জুড়ে শিশিরের অবদমিত চাহনি,
    বন্ধ চোখে, তরঙ্গে লেখা হয় মেঘেদের গান।

    শুকনো বালির উপরে চিকচিকে আস্তিন,
    এক পশলা গল্প আলগোছে মৌন স্নান সেরে নেয়,
    ইতিহাস শব্দহীন অপেক্ষায় থাকে আদিম সন্তানদের মত,
    আকাশের ইস্কুলে, সভ্যতার টার্মিনাসের অঙ্কুরোদগম হয়,
    আগন্তুক চরিত্ররা লং ড্রাইভে পাঠায় আসল কুশীলবদের,
    আরামের কারখানায় হারিয়ে যায় খুব চেনা মুখ,
    ভাষাহীন যন্ত্রণা, কাঁচা শরীরে সোফায় রঙের আরাম মেলে দেয়,
    কালির ভাষা চেনা কলম, অবাধ বাণিজ্য করে,
    বারোয়ারি শরীরে গুঁড়ো-গুঁড়ো আবেগ সম্পর্কের পসরা সাজায়,
    কথার ছদ্মবেশ হার মানে সংরক্ষিত পাণ্ডুলিপির বিরল মৌনতায়।


    || কোনো একদিন ||

    একটা বাড়ি কমলা,
    উপরে ভাসে কিছু ভীতু সাদা মেঘ,
    নীচে শুকনো ধূসর পড়ে থাকে একা,
    আমার বোধহয় রং-বেরংয়ের মনকেমন।

    আমি তাকিয়ে অপলক, চোখে দেখি কারুকার্য,
    আকাশের সীমানায় অবিরাম উল্কাদের আতসবাজি,
    নীল রঙের নদীটা বয়ে চলছে পা ছুঁয়ে,
    সার্কাসের জাদুকর সূর্যকে পেড়ে এনেছে মাটিতে।

    মাথার নীচে গর্ত দুটোয় আলোর রোশনাই,
    রিফিল ভর্তি কথা দিতে মন চায়,
    সূর্য যেরকম রোজ সকালে উঠে পড়ে,
    জমে যাওয়া নদীর উপর শুয়ে দেখবো আকাশ, খুঁজবো জীবনের মানে।

    মুহূর্তে বালির ঝড় চারপাশের কুয়াশা মুছে দেয়,
    থুতনির উপর একটু আঁধার টেনে এগোয় জাহাজ,
    সান্ত্বনার সূঁচ সুতো দিয়ে সেলাই করি নিজেকে,
    মনের মাঝে তখন বিজয়া দশমীর সন্ধে।

    ঘরকুনো অভ্যেসকে পিছু ডাকে সৃষ্টির উন্মেষ,
    পকেটের খাঁজে লুকিয়ে রাখি একগুচ্ছ ছবি।


    || শিকড় ||

    মাঝে মাঝে মনে হয় চিৎকার করি,
    জল হয়ে বয়ে যাই টাইমকল থেকে,
    ক্লক টাওয়ারের ঘন্টার শব্দে ভিজিয়ে দিই নিজেকে,
    লুগার পিস্তলের গুলি ঝরে পড়ুক ঘুমন্ত মৃতদেহে।

    উল বোনে ভীতু ছায়া,
    বেড়ালের ঝগড়ার শব্দেও যায় আসে না কিছু,
    সমস্ত রোম্যান্টিকতাকে চুষে নেয় কোন অশরীরী,
    অসবর্ণ মিলনে ক্ষুণ্ন হয় নিজের অস্তিত্ব।

    অপভাষার শক্ত পাঁচিলে লুকিয়ে রাখি আত্মপরিচয়,
    ফুটব্রিজের তলায় সাঁটানো পোস্টার থেকে লেখারা বেরিয়ে আসে, চিৎকার করে,
    হলদে পক্ষীরাজে ভাসে আলুথালু চুল,
    আপোষের ডাকবাক্সে রোজ একটা করে চিঠি এসে জমে।

    ভালোবাসার মহাকরণে সূর্যাস্ত বাসা বাঁধে,
    সভ্যতা বাঁচে পাশে নিয়ে সবুজ আর আঁকাবাঁকা,
    মেঘের বাড়িতে বন্ধ দরজা খুলে দেয় আকাশ ভর্তি তারা,
    শিকড় উপড়ানো হাত, খুব সাবধানে, নিজের হাত ধোয়।


    || রামধনু ||

    সময় বদলায়, সমাজ স্বাবলম্বী হয়,
    শুধু গরাদের গায়ে হাতের ছাপগুলো লেগে থাকে,
    সেই হতাশা, নিরাশা, ভেজা চোখে তাকিয়ে থাকা,
    দীর্ঘ অপেক্ষা, পরিচিত গন্ধগুলোর, স্নিগ্ধ স্পর্শগুলোর,
    দরজার দিকে তাকিয়ে ক্লান্ত চেয়ার প্রতিদিন কলার ভেজায়,
    জুতোর তলায় লেগে থাকে শুকিয়ে যাওয়া রক্তের দাগ।

    সবাই তো ভালো আছে, আমি কেন দোষী?
    রাষ্ট্র নির্দেশিত পথে না চলে বুঝি অপরাধী,
    চোখের জল কালচে পাতা ভারি করে,
    এ কষ্ট, অন্যায়, বঞ্চনা, বৃথা যাবেনা তো,
    ঈশ্বর মৃদু হাসেন, বলেন,
    দিন বদলাবে, হাসি ফুটবে ভীতু খরগোশের মুখে,
    সময় বদলায়, সমাজ স্বাবলম্বী হয়,
    গরাদের গায়ে হাতের ছাপগুলো তবুও লেগে থাকে।




    অলংকরণ (Artwork) : অলংকরণঃ অনন্যা দাশ
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments