ভোরের দিকে থেমে গিয়েছিল বৃষ্টি। একটু আগেভাগেই সে রওনা দেয় নিউমার্কেটে। শেষ রক্ষা হয়নি, নিউমার্কেটে ঢোকার আগেই শুরু হলো টিপটিপ বৃষ্টি। সে ভেজা শরীরে দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে থাকে। সহকর্মী তখনও এসে দোকান খোলেনি।
দিনভর চলল বৃষ্টি, বিকেলের দিকে প্রকৃতি অন্ধকার হয়ে এলো। আবহাওয়া বার্তায় বলা হয়েছে নদীবন্দরসমূহকে সাত নম্বর বিপদসংকেত দেখানো হয়েছে।
তার মন খারাপ। প্রকৃতির সাথে সঙ্গতি রেখে মন খারাপ, না অন্য কোনো কারণ থাকতে পারে--সকাল পার করে দুপুর, অনন্তর বিকেলে এসেও সে উদ্ঘাটন করতে পারেনি।
ফেরার পথে সে ভিজে গেল। বাসায় ফিরল পায়ে হেঁটে টেনে টেনে — তার হাঁটার ভঙ্গি এমন যে, মনে হয় যেন কাঁধে ভারী পাথর বয়ে নিয়ে বেড়ায়।
অনেকটা হেঁটে ফাঁপর লাগছে, ভেজা কাপড় ছেড়ে চা খেয়ে ছাদে যেতে সাধ হলো তার। সে হাতে ছাতা নিয়ে ছাদে এলো। অবাক হয়ে দেখলো, মেঘ-বৃষ্টির চিহ্নমাত্র নেই। ঝকঝকে আকাশে তারাদের মেলা। সন্ধ্যাতারাকে এতো বড় ও কাছের মনে হলো যেন আঁকশি দিয়ে খুঁচিয়ে তাকে নামিয়ে আনা যাবে। তারারা ওর প্রিয়, ওদের সাথে সমাযোজন করা যায়। ওরা স্থির, একদৃষ্টে তার দিকে তাকিয়ে থাকে। কথা বললে শোনে। কিন্তু বৃষ্টির সাথে সে ভাবের আদান-প্রদান করতে পারে না; বৃষ্টি চঞ্চল, খেয়ালি ও গতিময়। বৃষ্টি শুধু মন খারাপই করে দিতে পারে।
একতলার এই ছাদে দাঁড়িয়ে জীবনের অনেকখানি সময় সে কাটিয়েছে। বাড়ির চেয়ে ছাদটাই তার অধিক প্রিয়। ছাদের একাংশে ডালপালা মেলে দিয়েছে নিচের পাঁচিলঘেঁষা কামিনী গাছ। তার বাবা সরকারি নিম্নপদস্থ কর্মচারী হোসেন আলি আশির দশকে দুইকাঠা জায়গা কিনে একতলা দালানবাড়ি বানিয়েছিলেন। তখন এলাকাটা গ্রাম্য ছিল। একটা খালের ওপর বাঁশের সাঁকো পেরিয়ে আসতে যেতে হতো। খাল ভরাট হয়ে গেছে। এখন সেখানে টেম্পু ও রিকশা চলে।
বাড়ি ঘেঁষে মজা পুকুর, ছড়ানো ছিটানো কয়েকটি গাছ, কতিপয় ইমারত ও টিনের বাড়িঘর।
...তারাদের দেখে মনে পড়ল কেন ওর মন খারাপ। তারারাই কি বলে দিল? গতরাতে সে স্বপ্ন দেখেছে। আবছা-অস্পষ্ট এমন স্বপ্ন না দেখলেও চলত, মাথামুণ্ডু নেই এমন স্বপ্ন দেখে মন ভারী না হলেও চলত। কিন্তু নিগূঢ় কিছু একটা ছিল সেই স্বপ্নে, যা এইমাত্র বলে দিল তারারা। যেমন মন দিয়ে কথা শোনে, তেমনি টেলিপ্যাথিক উপায়ে অনেক খবরাদিও তারারা দেয়।
জলছাপের মত অস্পষ্ট একটা মুখ স্পষ্ট হয়ে ভাসল। এই মুখ সে ভোলেনি; ভোলা যায় না। মস্তিষ্কের কোনো এক স্থানে স্থায়ী জলরঙ হয়ে লেপ্টে আছে। আলোকচিত্রের ডটের মতো, সহস্র অযুত ডট, মস্তিষ্কের হিপোক্যাম্পাসে একত্রিত হয়ে একটা ইমেজ সৃষ্টি করে।
একটা প্রশ্নবোধক চিহ্ন ওর চোখের সামনে দুলতে থাকে....। এক দশক ধরে ঝুলছে।
একটা দুর্ঘটনা। একটা স্বপ্নভঙ্গ। মোটরসাইকেল চালিয়ে এঁকেবেঁকে যাচ্ছিল সে বড় সড়ক ধরে। পেছনে আড়াআড়ি বসা ছিল লিপি। মেয়েটার শখ হয়েছিল গজারিবন দেখার। সেই শখ পুরণ করতেই চলেছিল তারা যান্ত্রিক বাহনে। হঠাৎ নিয়ন্ত্রণ হারায়। যান্ত্রিক যান পিছলে চলে গেল সড়কের ধারে সবুজ ঘাসে। লিপি দিব্যি দুই পায়ে দাঁড়িয়ে পড়ল ঘাসে। কিন্তু মুকিতের ডান পা চাপা পড়ল মোটরসাইকেলের শরীরের ভারে।
একটা ঘণ্টা সেখানে অপেক্ষমান ছিল। তারপর একটা খালি ট্রাক দুইজনকে পৌঁছে দেয় হাসপাতালে।
শেষতক হাঁটুর একটু নিচ থেকে পা কেটে ফেলে দিতে হয়েছিল। এই পায়ে সে ফুটবল মাঠে অসংখ্য গোল দিয়েছিল। অবিশ্বাস্য গতি ছিল তার।
গতি থেমে গেল।
সেই দিনটায় লিপি কেঁদেছিল অঝোরে।
অত:পর কান্না পরিণত হয়েছিল ক্লান্তিতে। বোধহয় মুকিতের চোখেও ক্লান্তি দেখেছিল লিপি। তিনটি মাস হাসপাতালে ছিল। লিপির আগমনে ভাটা পড়ে। জগতের এই নিয়ম ভাঙে, সেই সাধ্য লিপির ছিল না। আর জগতের সেইরকম নিয়ম রক্ষা করাই যেন মুকিতের একমাত্র কাজ হয়ে দাঁড়ায়। একটা নিশ্চল জীবনের বোঝা নিয়ে সে আশাহীন হয়ে পড়ে। তার উদাসীন চোখ, অনিশ্চিত ভবিতব্য তাকে ঠেলে দেয় মনুষ্য সমাজের বাইরে।
হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে সে গিয়েছিল এক বিশেষায়িত হাসপাতালে। সেখানে সে প্রসথেটিক ডিভাইস ধারণের মাধ্যমে আধা মানব আধা রোবটের জীবন বেছে নেয়। যতদূর মনে পড়ে, কৃত্রিম পা সংযোজনের অল্পদিন পরে লিপি একদিন এই বাড়িতে এসেছিল। লিপি সেদিন উৎফুল্ল ছিল। মুকিত ভরসা পেয়েছিল। হয়তো তার পূর্ব জীবনপর্বের কিঞ্চিৎ পুনরুদ্ধারে লিপি আহ্লাদিত হয়েছিল।
মুকিত বলেছিল, ‘ছাদে যাবে?’
‘তুমি ছাদে যেতে পারবে?’
লিপির প্রশ্নে চমকে তাকিয়েছিল মুকিত, তারপর বলেছিল, ‘পারব’।
মুকিত পেরেছিল। আত্মপ্রসাদ অনুভব করেছিল।
সেই সন্ধেয় দু’জন অনেক কথা বলেছিল।
‘তোমার চাকরির কী হলো?’
‘নেই।’
‘এতো ভালো চাকরিটা...। যাক, দু:খ করো না।’
‘আমি দু:খ করছি না। আমার আরেকটা চাকরি হবে।’
‘আরেকটা চাকরি হবে!’ লিপি বিস্ময় প্রকাশ করেছিল।
‘আমি জানি লিপি, তুমি মুখে বলছো না, কিন্তু পদে পদে ইঙ্গিত করছো আমার পঙ্গুত্বের দিকে।’
‘মানে! কীভাবে?’
‘ওই যে, আমার আরেকটা চাকরি হবে শুনে বিস্ময় প্রকাশ করলে।’
লিপি হেসে বলল, ‘কী চাকরি, তাই বলো।’
‘সেল্সম্যানের চাকরি। একটা স্বর্ণের দোকানে।’
‘এমএসসি পাস করে সেল্সম্যানের চাকরি।’
‘তুমি কিন্তু আবার বিস্মিত হলে, লিপি।’
‘হ্যাঁ, হয়েছি। এই চাকরিটা তোমার না করলেই নয়?’
‘না। না খেয়ে-পরে বাঁচব কী করে? চিকিৎসায় সব কড়ি শেষ। এই বাড়িটা অন্তত দোতলা হলেও কিছু ভাড়া পেতাম। কিন্তু তার উপায় নেই। মা’র আর আমার খোরাক জুটবে কী করে?’
চিন্তিত দেখাল লিপিকে। সে একসময় বলল, ‘আজ চলি।’
‘আবার কবে আসবে?’
‘শিগগিরিই আসব।’
আর আসেনি লিপি।
...একদিন তার মধ্যে একটা অশুভ অনুভূতি খেলে গেল। লিপি বদলে গেছে। লিপির বিচরণের অদেখা সময়টুকু মুকিতের অজানা ছিল। মানুষের মন বিজলির গতিতে বদলায়। আর লিপি তো মন বদলাবার অঢেল সময় পেয়েছিল।
আরেকদিন মনে হলো, লিপি শেষবারের মতো এসে ওকে যেন কিছু বলতে চেয়েছিল। মুকিত জিজ্ঞেস করলে হয়তো বলতো। মুকিত জিজ্ঞেস করেনি। সেই সন্ধেয় ছাদে, কামিনী ফুলের গন্ধে কামনা-আবিলতা ওকে গ্রাস করেছিল। লিপিকে মোহনীয় লাগছিল। মনে হয়েছিল, লিপি যেন হারিয়ে যাচ্ছে।
লিপিকে কাছে পেতে সাধ জাগলেও লিপি বসে ছিল একটু দূরে। ওই সামান্য দূরত্বটুকু অতিক্রম করার সাহস মুকিতের হয়নি। শরতের আকাশের মেঘেরা যেন কাশফুলের সাদা রঙের কাছে হার মেনে দূরে সরে যেতে লাগল।
লিপি তো ওর কাছে এসে বসতে পারতো!
মুকিতের মানসপটে গতরাতের স্বপ্ন ডালপালা মেলতে থাকে। কী বার্তা ছিল স্বপ্নটাতে? ঈশপের গল্পের মত গাঢ় ইঙ্গিতপূর্ণ কিছু ছিল কি?
লিপি কেমন আছে, কী করছে--কিছুই জানা নেই তার। লিপি কি কিছু জানে?
‘না, জানে না।’ আকাশের তারাদের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বলল সে। জানতে হলে তাকে এই জীর্ণ বাড়িতে আসতে হতো। একটি দশক পার হয়ে যাবার পরও যখন লিপি এলো না, তখন লিপি ওর সম্পর্কে কী জানে, আর কী জানে না, সেই প্রসঙ্গ অবান্তর, এমনকি অযৌক্তিক।
লিপি তার সঙ্গে যুক্ত হবার পর ভিন্ন মাত্রা পেয়েছিল ঊষর জীবনে। মনে হয়েছিল, মরুদ্যানে ফুল ফুটেছে। পায়ে আরো গতি সঞ্চারিত হয়, সে পরিণত হয় গতিদানবে, একের পর এক গোল দিয়ে যায় সে ফুটবল মাঠে। একটা উঠতি ওষুধ কোম্পানিতে কেমিস্ট পদে চাকরি হয়ে যায়। অফিস থেকে তাকে দেওয়া হয় দ্বিচক্রযান।
ফুটবল খেলে প্রাপ্ত মেডালগুলো দেখতে দেখতে লিপি বলেছিল, ‘তুমি অনেক গুণী। কতো মেডাল, চমৎকার একটা চাকরি। আর আমি সামান্য স্কুল শিক্ষকের চাকরিও পেলাম না।’
‘তুমি স্কুলের চাকরি করতে চাও?’
‘কেন? স্কুলের চাকরি কি খারাপ?’
‘না, খারাপ হবে কেন? আমি জিজ্ঞেস করছি অন্য কারণে।’
‘কী কারণ?’
‘আমাদের এলাকার স্কুলে শিক্ষক নিয়োগ হবে। খেলাধূলার সুবাদে স্কুলের গভর্নিংবডির সভাপতি, সদস্য সবার সাথে ভালো সম্পর্ক। তুমি অ্যাপ্লাই করো।’
স্কুলের চাকরি লিপির হয়নি, সে ইন্টারভিউতে খারাপ করেছিল। সমাজকর্মে মাস্টার্স ডিগ্রিধারী লিপি অংক ও ইংরেজিতে দৃষ্টিকটুভাবে দরিদ্র ছিল।
...লিপির সাথে পরিচয় হয় এই বাড়িতেই। সে সুমনার বান্ধবী ছিল কলেজ-জীবনের। এই বাড়িতে আসত। সুমনা মারা যাবার পরও লিপির আগমন বন্ধ হয়নি। সুমনার শৈশব থেকেই রিউমেটিক ফিভার ছিল। চিকিৎসা তার হতো, কিন্তু চিকিৎসার ধারাবাহিকতা ছিল না; সুমনা ছিল চাপা স্বভাবের মেয়ে। তাছাড়া সে বুঝতো তার বাবা মায়ের দারিদ্র ও সীমাবদ্ধতা। বন্ধুর সংখ্যা ছিল হাতে গোনা। চিরসাথী বাতজ্বর রোগ বাদ দিলে সুমনা ছিল সমানুপাতিক, বুদ্ধিদীপ্ত ও মিতভাষী। মা অসুস্থ হয়ে বিছানা নিলে সংসারের সব দায়িত্ব সে নিয়েছিল। বাবার অন্তর্ধানের পর সংসারের খরচ যুগাতে সে বাসায় ছাত্রী পড়াত।
মুকিত এই বোনটির কথা ভাবে, যে বোনের কারণে সে একের পর এক গোল দিয়ে মেডাল জয় করে নিত। বোনের অস্তিত্ব ওর কাছে ছিল আশা-ভরসার শেষ আশ্রয়স্থল।
সুমনা চলে যাবার পর মাস তিনেক পর একদিন এই বাড়িতে হাজিরা দিয়ে লিপির চোখ-মুখ রাঙা হয়ে উঠেছিল। চাকরির ইন্টারভিউয়ের প্রস্তুতি নিতে মুকিত কিছুদিন যাবৎ বাড়িতে বসে পড়াশোনা করছিল।
লিপি আনত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে ছিল। উধার পেল মুকিতের মায়ের ডাকে। সুমনার বান্ধবী বলে লিপিকে তিনি যারপরনাই স্নেহ করতেন। সেদিনের দৃশ্যটা মুকিতের আজও ভেসে ওঠে, এবং সে হিসেব মেলাতে পারেনা....।
লিপি তার মায়ের পিঠে হাত বুলোচ্ছিল, আর শোক-দু:খে কাতর এক মা লিপির মাথায় হাত বুলোচ্ছিলেন।
মায়ের কাছ থেকে উঠে মুকিতের সামনে এসে লিপি ফের সংকুচিত হয়ে পড়ে।
তারপরই দুই জোড়া ভীরু চোখের দৃষ্টি বিনিময় হয়। উভয়ে উভয়ের চোখের ভাষা পড়ে নিতে পেরেছিল।
একদিন ঘরে ঢুকল মুকিত চেঁচাতে চেঁচাতে, ‘মা গো। হয়ে গেছে।’
‘কী হয়ে গেছে রে!’ বলে শোয়া থেকে উঠতে গেলেন তিনি, পড়ে যাচ্ছিলেন, বিছানার পাশে বসা লিপি ধরে ফেলে।
‘মা আমার চাকরি হয়ে গেছে।’
কথাটা শুনে মা বিড়বিড় করে দোয়া পড়লেন। লিপি আনত হয়ে ঠোঁটে মৃদু হাসি ফুটিয়ে তুলল।
‘আমার দরকার কড়া পাতার এক ঘড়া লাল চা। কিন্তু কে দেবে?’
‘আমি নিয়ে আসছি চা।’ লিপি রান্নাঘরে চলে গেল।
....সেই দিনটা আজও চোখে ভেসে ওঠে। মধুর স্মৃতি; কিন্তু মুকিত এই স্মৃতি চেতন মনে আনতে চায় না, অথচ অবচেতন মন বারবার তাকে সেইসব স্মৃতির গহ্বরে টেনে নেয়।
তারপর এক ভিন্ন দৃশ্যপট তৈরি হলো।
স্কুলের শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় খারাপ করায় লিপি হয়তো লজ্জায় যোগাযোগ করছে না ভেবে মুকিত কিছুদিন নিষ্ক্রিয় থাকল। ব্যস্ত হয়ে পড়ল নতুন চাকরিজীবনে। মায়ের চিকিৎসা, নিজের অস্তিত্ব রক্ষায় এই চাকরি তার জন্য ঐন্দ্রজালিক রক্ষাকবচ।
এক ছুটির দিনে সোৎসাহে-উত্তেজনায় ফোন করল মুকিত লিপিকে। ‘তুমি গজারিবন দেখতে চেয়েছিলে না? আজ তোমাকে নিয়ে সেখানে যাব। যাবে না?’
‘যাব।’
‘তাহলে তুমি রেডি হয়ে থেকো, আমি তোমাকে নিব। প্রথম বেতন পেয়েছি। বাইরে খাবো, তোমাকে গিফট কিনে দেব।’
‘কী গিফট?’
‘তুমি যা চাইবে’।
‘আচ্ছা।’
...তারপর ওরা গজারিবনের দিকে রীতিমতো উড়ে যাচ্ছিল। লিপি আচম্বিতে যেন ধারালো ছুরি বসিয়ে দিল মুকিতের পিঠে— ‘আব্বা-আম্মা আমার বিয়ে ঠিক করে ফেলেছেন।’
মুকিত নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে।
অনেক কথা জমে ছিল ভেতরে। একদিন মনে হলো, কথাগুলো উগরে দেওয়া উচিৎ। কিছু প্রশ্ন ছিল, সেই প্রশ্নগুলোকে লিপিকে সে করবে। ওর দুর্দশায় লিপি হয়তো কিছু বলতে পারছে না। লিপি অনেক বিরতি দিয়ে হলেও হাসপাতালে আসছিল। লিপির আগমন মুকিতের মনে আশার সঞ্চার করত।
যে কথা আর প্রশগুলো জমে ছিল, সেসব অন্ধকার সুড়ঙ্গ-পথ পাড়ি দিয়ে আলোর মুখ দেখতে পায়নি।
লিপি আর আসেনি।
...তারাদের সাথে কথা বলা শেষ। মৃদু হাসি ফোটে মুকিতের ঠোঁটের কোণে। সে বিড়বিড় করে বলল, ‘তোমাদের সাথে আজ অনেক কথা বললাম। তোমাদেরকে যা বলি, তোমরা শোনো, তাই আমার এত কাছের কতিপয় তোমরা, অনেক দূরের হয়েও।’
মায়ের অবস্থা দিনদিন খারাপতর হচ্ছে। স্বর্ণের দোকানের চাকরির সামান্য অর্থে সুষম চিকিৎসা তাঁর হচ্ছে না। এক অক্ষমতাবোধে দিনদিন ম্রিয়মাণ হতে থাকে মুকিত।
...পায়ে চিনচিনে ব্যথা নিয়ে মুকিত সিঁড়ি ভেঙে নামতে থাকে। তার ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি। নামতে নামতে তার মনে হয়, বিবাগী এই জীবনের কোথায় যেন সূক্ষ্ম একটুকরো বিরহী সুখ লুকিয়ে আছে।
এই অচেনা সুখের ঠিকানা কেবল সে-ই জানে; পৃথিবীর আর কেউ জানেনা।