• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৭২ | সেপ্টেম্বর ২০১৮ | গল্প
    Share
  • কাঠবেড়ালি : অনিরুদ্ধ চক্রবর্তী


    রাস্তার মাঝেই পড়ে আছে কাঠবেড়ালিটা। নধর দেহ, পুষ্ট লেজ। দূর থেকে দেখলে মনে হবে সে যেন রাস্তা থেকে খাবার খুঁজে নিচ্ছে। কিন্তু কাছে আসতে বোঝা যাবে, তার দেহে প্রাণ নেই। গোটা দেহ অক্ষত। কেবলমাত্র ঠোঁটের কাছে সামান্য থেঁতলান। একটু রক্ত মুখ থেকে এসে পড়েছে রাস্তাতে। রক্ত এখনও টাটকা। বোঝা যায় ঘটনাটা সদ্য ঘটেছে। থমকে দাঁড়ালাম। মান্তুর মুখটা মনে পড়ে গেল। মান্তু খুব কাঠবেড়ালি ভালোবাসত।

    গত রাতে মান্তু মারা গেছে। কানে হেড-ফোন গুঁজে সে কলেজ যাবে বলে পাড়ার রাস্তা পেরোচ্ছিল। তখন একটা বোলেরো তাকে ধাক্কা দেয়। গাড়িটা নাকি অনেকবার হর্ন দিয়েছিল। মান্তু রাস্তার ধারে ছিটকে পড়ে। গতরাতে, প্রায় রাত বারোটার সময় ফোন করে খবর দিয়েছিল সৌমিত্রদা। মান্তু তার একমাত্র সন্তান। কান্নাভেজা গলায় বলেছিল, এখন বাড়িতে কিছু বলিস না। ফোন পাবার পর থেকে আমি আর ঘুমুতে পারিনি। এই এতটুকু থেকে মান্তু আমার কোলেপিঠে মানুষ। বাড়িতে বকা খেলে সে দৌড়ে চলে আসত আমাদের বাড়ি। আমার পিঠের আড়ালে মুখ লুকোত। মায়ের সঙ্গে বিকেলে ছাদে হাঁটত। তাকে আমি কত কাঠবেড়ালি ধরে এনে দিয়েছি। সে যখন আট বছরের, সৌমিত্রদা একটা ভালো চাকরির অফার পেয়ে দিল্লি চলে যায়। সেই থেকে সৌমিত্রদার বাড়ি আমাকেই সামলাতে হয়। আর হ্যাঁ, সেটাই এখন আমার ‘চাকরি’।

    এই যে আমি বাজার সেরে ফিরছি, এটা সৌমিত্রদার বাড়ির বাজার। সেখানে দুটি প্রাণী বাস করে। সৌমিত্রদার বাবা ও মা। তারা একদিন ফ্রিজে রেখে খেতে পছন্দ করে না। তাই আমাকে রোজ বাজার যেতে হয়। জেঠু, মানে সৌমিত্রদার বাবা রোজ বাজার যাবার আগে আমাকে বলে দেয়, আজ কি মাছ হবে। কি সবজি লাগবে সেটা জেঠিমা বলে। এইসব খরচের টাকা মাসের এক তারিখে সৌমিত্রদার একাউন্ট থেকে আমার একাউন্টে ঢুকে যায়।

    আমাকে আজ ও বাড়িতে দেখে জেঠু-জেঠিমা অবাক হয়ে বললেন, তুই এত সকালে? এখুনি বাজার যাবি?

    আমি বলি, হ্যাঁ।

    রাতে ঘুম হয়নি তোর?

    না না, হয়েছে।

    তবে তোর চোখ লাল কেন? কিছু হয়েছে ?

    না না, আজ কি আনব বলে দাও।

    লিস্ট নিয়ে আমি বেরিয়ে পড়ি ভোরের রাস্তায়। জানি এখনও বাজার বসেনি। চাষিরা মাল এনে ফেলতেই পারেনি। আমাদের এখানে মাল আসে বারুইপুরের বাজার থেকে। আর কিছু বিক্রেতা আছে যারা শেওড়াফুলি থেকে সবজি আনে। আমি চেষ্টা করি ছোট চাষিদের থেকে মাল নিতে। ওরা টাটকা জিনিস বেচে। জেঠু-জেঠিমা এমন জিনিসই পছন্দ করে। ফেরার পথে পাড়ার রাস্তার ধারে, এক কৃষ্ণচূড়া গাছের ছায়ার নিচে কাঠবেড়ালির দেহটা পড়েছিল। বোঝা যায় এই গাছ থেকে নেমেই সে পাড়ার সরু রাস্তা পেরিয়ে ওদিকে যেতে চেষ্টা করেছিল। হিসেবের ভুলে চাপা পড়ে যায়।

    আমাকে দাঁড়াতে দেখে আমার পিছু পিছু আসতে থাকা পান্নাও থেমে যায়। সে সকাল হলেই বস্তির ঘর থেকে বেরিয়ে এপাড়া ওপাড়া ঘুরে ঘুরে কাজ খুঁজে বেড়ায়। বাগান, ড্রেন, বাথরুম, ছাদ ইত্যাদি পরিষ্কার করে। লোকে আরও না জানি কি কি কাজ তাকে দিয়ে করিয়ে নেয়। পান্না মুখে আফশোসের শব্দ করে বলল, ইস! কি করে মল্ল এটা খোকনদা? ওই বাইকটায়? মাথা নেড়ে বললাম, না। ওটা যাবার আগেই হয়েছে। ওটা গেছে কাঠবেড়ালিকে পাশ কাটিয়ে। আমি দেখেছি। পান্না উবু হয়ে কাঠবেড়ালির সামনে বসে পড়ল। বলল, মনে হয় সাইকেলের চাকায় গেছে। বাইক হলে মুখটা থেঁতলে যেত। কেবল ঠোঁট চোট পেয়েছে। যা রক্ত তা ঐ ঠোঁটেই। ঐ আঘাতেই শেষ হয়ে গেছে। ইস, সক্কালেই এমন দেখলুম! মনটা খারাপ হয়ে গেল। বলে পান্না রাস্তা থেকে একটা সরু ডাল তুলে নিল। বলল, দাঁড়াও, এটিকে সরিয়ে দিই।

    কাঠবেড়ালির দেহ তুলে নিয়ে আস্তে করে শুইয়ে দিল কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে। দেখলে মনে হবে কাঠবেড়ালিটি গাছ বাইবার প্রস্তুতি নিচ্ছে। পান্না কাজটা করেই হনহন করে চলে গেল। আমি স্থির হয়ে দাঁড়িয়েই রইলাম। পা যেন মাটিতে গেঁথে গেছে। কখন যে নিজেকে সেখান থেকে ছাড়িয়ে জেঠুদের বাড়িতে এলাম, তার আর খেয়াল নেই। আমাকে বাড়ি ঢুকতে দেখেই জেঠিমা বলল, হ্যাঁরে খোকন, আজ তুই সেই যে বাজার গেলি, ফিরলি এই! এত দেরি হল যে?

    দেরি হয়ে গেল? আমি যেন অবাক।

    ঘড়িতে দেখ, ন’টা বাজে। গেছিস ছ’টায়! তোর কি শরীর খারাপ?

    না। শরীর খারাপ কেন হবে?

    হুম! বাড়ি যা এখন। এগারোটায় বেরুতে হবে, মনে আছে তো?

    নিচে নেমে এলাম। আমি নিচেই থাকি। উপরতলাটা জেঠুদের। জেঠুরা আমাদের আপন কেউ নয়। তবে দীর্ঘদিন একত্রে বাস করে আত্মীয় ভাবটা এসে গেছে। ওপার বাংলা থেকে দেশভাগের সময় আমার বাবা ও এই জেঠু অতি অল্প বয়সে তাদের বাবা-মার হাত ধরে চলে আসে। ক্রমে শিয়ালদা স্টেশন, উদ্বাস্তু শিবির, কষ্টের দিন পেরিয়ে সেই দুই কিশোর পরিণত বয়সে জমি কিনে বাড়ি করেন একত্রে। সেই থেকে জেঠুরা উপরে আর আমরা নিচের তলাতে বাস করি।

    জেঠুর দুই মেয়ে, এক ছেলে। মেয়েদের কাছাকাছি বিয়ে হয়েও জীবিকার কারণে সবাই সুদূরের প্রবাসী। জামাই সহ দুজনেই যথাক্রমে হায়দ্রাবাদ ও পুনেতে। পরে সৌমিত্রদাও চলে যায়। সেও আট বছর হয়ে গেল। জেঠুরা সেই থেকে একা। আর তাদের দেখাশোনা করা, হাট-বাজার-দোকান, রেশন-টেলিফোন বিল-গ্যাস বুক, ইলেকট্রিক-জলকল-কাঠ-মিস্ত্রি —ইত্যাদি সব কাজের দায়িত্ব আমার। রান্নার লোক, বাসন মাজার, ঘরদোর পরিষ্কার করার ঠিকে ঝি; কিন্তু এসবও আমাকে সামলাতে হয়, যখন কেউ কাজ ছেড়ে দেয় হুট করে। তখন আবার রান্নার বা কাজের লোক জোগাড় করাটা যে কি ঝক্কি, তা যে না করেছে সে বুঝবেও না। বিনিময়ে মাসের শেষ লগ্নে আমার অ্যাকাউন্টে ঢুকে যায় সাত হাজার টাকা। আমার মাইনে। ভাই বোনে মিলে দেয়। এটাই আমার চাকরি।

    আমি যে প্রথম থেকেই এমন কাঠবেকার হয়ে বসেছিলাম তা কিন্তু নয়। আগে তিনটি চাকরি করেছি। প্রথমটা বালির এক চটকলের ম্যানেজার। সেটি কয়েকবছর পর বন্ধ হয়ে যায়। তারপর বড় বাজারের এক গদিতে কাজে ঢুকি। সেখানেও টিঁকতে পারিনি। এত দুর্নীতি হোত যে কাজ করাটাই অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। তার সঙ্গে নিত্য হিন্দিতে গালাগাল। শেষ চাকরি এক চিটফান্ড কোম্পানীতে। ডাটা প্রসেসরের কাজ। সারদার টালমাটাল অবস্থায় সেটি আচমকাই ঝাঁপ বন্ধ করে দেয়। আমি আবার বেকার হয়ে পড়ি। বয়সও বাড়ছে। আর কে চাকরি দেবে, এই ভাবনায় যখন ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়িয়ে দিন কাটাচ্ছি, তখন সৌমিত্রদা আমাকে প্রস্তাব দেয় তার বাবা মাকে দেখাশোনার।

    সেটা কিন্তু এমনি এমনি হয়নি। সেবার হয়েছিল কি, জেঠিমা বাথরুমে এমন বিচ্ছিরি ভাবে পড়ে যায় যে কোমরে মারাত্মক আঘাত পায়। সে সময় জেঠিমার সব কিছু আমিই করেছিলাম। পরে সৌমিত্রদা যখন পনের দিনের ছুটি নিয়ে এল, আমার কাজ দেখে এত আশ্বস্ত হল যে বলার নয়। এমনকি সৌমিত্রদার বোনেরাও বলল, খোকন যা করেছে, তা আমরাও হয়ত কাছে থাকলে করতে পারতাম না। তখন ওরা তিন ভাইবোন মিলে আমাকে নিয়োগ করে। আর কি আশ্চর্য, ওরা যখন আমাকে এই প্রস্তাব দেয় অত্যন্ত কুন্ঠাভরে, আমি নিজের মনোভাব লক্ষ করে অবাক হয়ে যাই! আমি যেন এমন একটা প্রস্তাবের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। আসলে আমার একটা কাজের দরকার ছিল। চল্লিশ হতে আর বেশি দেরি নেই। যে-কোন কাজ চাই। আমি এক কথায় রাজি হয়ে গেলাম!

    নিচে নেমে নিজের ঘরে ঢুকতেই মা বলল, তুই এতক্ষণ ছিলি কোথা? বাজার করতে কী এত দেরি হয়? সেই কোন ভোরবেলা না খেয়ে বেরিয়ে গেলি। চা-টা পর্যন্ত খেয়ে গেলি না। ফোনও নিয়ে যাসনি যে খবর নোব। তোর কিছু হয়েছে? সকাল থেকেই তোকে কেমন যেন অন্য রকম লাগছে।

    মনে পড়ে গেল, তাই তো! ফোন ফেলে রেখে গেছি, যদি সৌমিত্রদা ফোন করে থাকে? আমাকে না পেয়ে হয়ত...আমার কিছু মাথায় আসছে না। দ্রুত ফোনটা টেবিল থেকে হাতে নিয়ে দেখলাম, না, কোন মিস কল নেই। সৌমিত্রদা ফোন করল না কেন? কি হচ্ছে এখন ওখানে?

    মা আমার আচরণে এমন কিছু দেখেছিল, যা দেখে অবাক হয়ে বলল, তুই এমন করচিস কেন, খোকন? কি হয়েছে?

    কিছু না মা। মান্তুর কথা মনে পড়ে গেল।

    মান্তুর কথা? কেন!

    বাজার সেরে ফেরার পথে দেখি একটা কাঠবেড়ালি রাস্তায় মরে পড়ে আছে। মুখের উপর দিয়ে সাইকেল চলে গেছে।

    আহা রে! মান্তু খুব কাঠবেড়ালি ভালোবাসত। তুই তো খাঁচায় ভরে ওকে দিয়েও ছিলি কয়েকবার। সৌমিত্র কবে আসবে বললি?

    ফ্রেবুয়ারিতে। কেন?

    এলে এবার একটা চাকরির কথা বলিস। পুরুষ মানুষের একটা চাকরি না হলে চলে? কতবার তোকে বলেছি, ওরে বুড়োবুড়ি যখন মরবে তোর কি হবে? সৌমিত্র তখন আর তোকে টাকা দেবে? হাত গুটিয়ে নেবে। উপর তলাটা তালা দিয়ে চলে যাবে। নিজেদের বাড়ি হলে উপরটা ভাড়া দিয়েও কিছু পয়সা আসত। সে তো হবার নয়।

    এই বয়সে আর কে চাকরি দেবে আমায়।

    ওদের ওখানে চাকরির অভাব? চল্লিশ কি আর এমন বয়স? বিকম পাশ তুই, এই বয়সে কত লোক জীবন শুরু করে। সৌমিত্র দিল্লিই গেল চল্লিশে। তবে? না না, আমি আর তোর বারণ শুনব না। এবার ও এলে তোর জন্য একটা যা হোক চাকরির কথা বলব আমি। এখানে চাকরি করা তোর কপালে নেই। হলে এতদিনে হয়ে যেত। তুই বাইরেই চলে যা খোকন। আমি তোর বিয়ে দিতে চাই। তুই যদি এইভাবে জীবন কাটাস, না কেউ তোকে মেয়ে দেবে, আর না আমার বংশ রক্ষা হবে!

    বাইরে গেলে তোমাদের দেখবে কে? আমি তো আর এত মাইনে পাব না যে আমার মত একটা মাইনে করা লোক রেখে দেব।

    সেটা তখন দেখা যাবে। রান্না হয়ে গেছে। তুই কি চান করে খাবি না খেয়ে চান করবি?

    কিছু খাব না।

    বাজারে কচুরি খেয়েছিস?

    না।

    তবে খাবি না কেন? তোর যে কি হয় কিছু বুঝি না। এতটা পথ যাবি, কখন ফিরবি তার কোন ঠিক নেই, সারাদিন পেট কোলে করে বসে থাকা। বলে মা গজগজ করতে করতে রান্নাঘরে ঢুকে গেল। আমি স্নান করতে গেলাম।

    আগে জেঠুদের নিয়ে যখন ডাক্তারখানা চেক-আপে নিয়ে যেতাম, বাড়ির নিচে গাড়ি চলে আসত। আমাদের পাড়ারই ছেলে সুকুমার গাড়ি চালাত। ওর নিজেরই গাড়ি। সেকেন্ড-হ্যান্ড কেনা। পরে সেটা বেচে একটা নতুন সুমো কেনে। তারপর থেকে ও আর ছোটখাট ট্রিপে যেতে চায় না। বিয়ে বাড়ি, ডাক্তারের চেম্বার—অনেকক্ষণ ওয়েট করতে হয় বলে ওর আর পোষায় না। ও এখন লম্বা ট্যুর ধরে। দিঘা-পুরী-রাজগীর। অফিস বা ফ্যামিলি টুরে এইসব জায়গায় যেতে ও পছন্দ করে। ফলে আমাদের মোড়ের মাথায় গিয়ে ভাড়ার ট্যাক্সি ধরতে হয়। এইটুকু পথ হেঁটে যেতে হয়। বাড়ি থেকে বড় রাস্তা অবধি।

    উপর থেকে জেঠুদের নিয়ে রাস্তায় নামতেই একটা কাঠবেড়ালি এক দৌড়ে রাস্তা পেরিয়ে গেল। পিছু পিছু আর একটা। কোথায় যাচ্ছে ওরা? কিসের জন্য? জ্যেঠিমা হেসে বলল, কাঠবেড়ালি দেখলেই মান্তুর কথা মনে পড়ে। মেয়েটা এত কাঠবেড়ালি ভালোবাসত। তখন কত কাঠবেড়ালি আসত বাড়িতে। বারান্দা, উঠোনময় তাদের কেবলি আনাগোনা।

    জেঠু বলল, হবে না কেন, সে রোজ মুঠো মুঠো বাদাম দিত যে। ওর বাপ তো বাদামের বয়াম কখনও খালি হতে দিত না। এবারে এসেও সে কাঠবেড়ালির খোঁজ করেছে। তোর মনে আছে খোকন, তুই ওকে কত কাঠবেড়ালির বাচ্চা ধরে দিতিস?

    তোমার মনে আছে একবার একটা গাড়ি যাচ্ছে, এসময় একটা কাঠবেড়ালি রাস্তা পেরুবার চেষ্টা করছিল। আমাদের মেয়েটার বয়স কত তখন? ছয় কি সাত? অতটুকুন মেয়ে, দেখ, সে রাস্তার এপারে দাঁড়িয়ে হাতে ইশারা করল, অমনি কাঠবেড়ালি ঠিক দাঁড়িয়ে পড়ল। রাস্তা পেরুল না। মান্তু কাঠবেড়ালির গতিপথ ঠিক করে দিচ্ছিল। সেদিন যদি কাঠবেড়ালিটা রাস্তা পেরুত, সে মারা যেত নির্ঘাত! গাড়ি চাপা পড়ার হাত থেকে কেমন করে সে একটা কাঠবেড়ালিকে বাঁচিয়ে দিল হাতের ইশারায়।

    হ্যাঁ। সে বড় মজার সময়। আমাদের সুখের সময়। মান্তু আর তার কাঠবেড়ালি নিয়ে কত যে সময় কেটেছে তার কোন ইয়ত্তা নেই। চিলেকোঠায় কাঠবেড়ালির বাসা বাঁধার একচেটিয়া জায়গাই করে নিয়েছিল। বেড়ালগুলো সেই বাচ্চার লোভে কেমন উৎপাত করত মনে আছে তোমার? আমি বললাম, আজ একটা কাঠবেড়ালি গাড়ি চাপা পড়েছে জেঠিমা।

    জেঠু বলল, অনেক সময় কি হয় জানিস, বনের জীব তো, বাতাস লেগেই আবার প্রাণ ফিরে পায়। কত সাপকে দেখেছি, মরা ভেবে ফেলে দিয়েছি, সে আবার বেঁচে গেছে।

    জেঠিমা বললে, সে হল সাপ, ওদের জান আলাদা। কিন্তু কাঠবেড়ালি? সে কি আর প্রাণ ফিরে পাবে? কাঠবেড়ালি হল নরম সরম। একটু ঠেকল কি ঠেকল না, শেষ।

    কৃষ্ণচূড়া গাছটার সামনে আমরা দাঁড়িয়ে গেলাম। যেখানে পান্না কাঠবেড়ালির দেহটা রেখেছিল, সেখানে কিছু নেই। পাতার ফাঁকে যদি ঢুকে যায় দেহটা, বা শুকনো পাতা উড়ে এসে ওকে চাপা দিয়ে দেয়, বোঝা যাবে না কাছে না গেলে। তবে আমার মনে হল, জায়গাটা ফাঁকাই। হতে পারে, কাকে তুলে নিয়ে গেছে। বা কোন বিড়াল। নাকি সত্যিই সে প্রাণ ফিরে পেল বাতাসের চলনে?

    জেঠিমা বলল, কাঠবেড়ালিটা নেই তো রে।

    জেঠু বললে, হুম। জেঠিমা বললে, মান্তু তো ফাল্গুন মাসে আসবে, তখন ওকে আমরা সারপ্রাইস দেব। জেঠু বললে, তা চমকানোই যায়। কিন্তু সেটি কি দিয়ে?

    কি দিয়ে আবার, ওর জন্য একটা কাঠবেড়ালি ধরে এনে। কিরে খোকন, পারবি না আগের মত কাঠবেড়ালি ধরে আনতে?

    সৌমিত্রদা কি করছে এখন? ফোনে বলছিল, কিছুই করা গেল না রে। একেবারে স্পট ডেড! দেহে কোথাও চোট নেই জানিস। কেবল কান দিয়ে একটু রক্ত বেরিয়েছে। অনেকটা নয়, একটু রক্ত, তাতেই সব শেষ। ওর দেহটা যখন আমি দেখি, দেখে অবাক হয়ে গেছিলাম। কোন চোট নেই! যেন সে ঘুমিয়ে আছে। হাসপাতালে নিয়ে যাবার সুযোগটুকুও দেয়নি। শেষ চেষ্টাটাও করতে দিল না। কত করে বলেছি, গান শুনতে হলে বাড়িতে বসে শোন। নিজে মরলি আমাদেরও মেরে রেখে গেলি!

    আমার কি এখন একবার ফোন করা উচিত? কিছুই বুঝতে পারছি না! বেলুড়ের ডাক্তারের কাছে মাসিক চেকআপ করিয়ে ওদের বাড়ি ফিরিয়ে দিতে দুপুর হয়ে গেল। মার হাত থেকে এবার আর ছাড় পাওয়া গেল না। গলা দিয়ে খাবার নামতে চায় না। তবু কিছু মুখে দিতে হল। মা একটা কিছু ঘটেছে বলে আঁচ পাচ্ছে কিন্তু সেটা যে কি হতে পারে, তা ভেবে উঠতে পারছে না। তবে মা সকালের মত আর কিছু জিজ্ঞাসা করল না। আমি যে খাবার টেবিলে বসেছি, এটাই মায়ের কাছে অনেক। কিছুমাত্র মুখে দিয়ে বাইরে চলে এলাম। সোজা কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে। দুপুর হয়ে গেছে। হালকা শীতের আমেজ। ঝিরঝির পাতাদের ফাঁক দিয়ে আমি উপর দিকে তাকাই। দুটি কাক জড়াজড়ি করে বসে। চারিদিক কেমন যেন শান্ত, নির্জন। একফোঁটা উত্তুরে বাতাস নেই। যেন প্রকৃতির জগতে কিছু একটা বির্পযয় ঘটে গেছে।

    আমি পুরো পাড়াটা পাক দিতে থাকলাম। এত নানা জাতের গাছ আছে নাকি আমাদে্র পাড়ায়? শীতেও ফোটে, এমন ফুল গাছ কবে লাগানো হোল, কই আগে তো চোখে পড়েনি! কত ঘুরলাম পাড়াটা, যেদিকে পাড়া শেষ, গাছপালা-ঘরদোর নেই; সেখানে অন্তত পাখি ডাকবে, পাখিরা দল বেঁধে উড়বে বা গাছে গাছে দৌড়বে কাঠবেড়ালি, এমনিই ত হবার কথা। কিন্তু কই, একটা কাঠবেড়ালির দেখাও পেলাম না আমি! তারা সব গেল কোথায়? এই পাড়াকে তারা কি আর বাসযোগ্য বলে মনে করছে না? একটি মৃত্যু তাদের ভাবিয়ে তুলেছে এতটাই যে, একত্রে দল বেঁধে পাড়ি দিয়েছে ভিন্ন কোন আশ্রয়ের সন্ধানে?

    অবশেষে আমি ফিরতে লাগলাম। একটা ঘুম দরকার আমার। দেহ আর চলছে না। পা টলছে। ঘুম থেকে উঠে যেন দেখি সৌমিত্রদা ফোন করে বাড়িতে সব বলে দিয়েছে। আমি আর নিতে পারছি না। শ্রান্ত পায়ে এসে দাঁড়িয়েছি নিজেদের বাড়ির সামনে। অমনি দেখলাম একটা কাঠবেড়ালিকে। আমার পাশ দিয়ে সে সাঁ করে দৌড়ে গেল। অবসন্ন আমি যেন চমকে উঠলাম। আছে, আছে। কাঠবেড়ালি আছে। তারা চলে যায়নি একটি মৃত্যু দেখে। এখন তাকে ডেকে আমি বলব মান্তুর কথা। অন্তত একজনকে বলতে পারব। আমার মনটা হালকা হবে। দু’ চোখে নেমে আসবে গভীর ঘুম। ভেবে আমি দাঁড়ালাম। অমনি পিছন দিয়ে আরও একটা কাঠবেড়ালি ছুটে গেল। তারপর একটা, আবার একটা, আরও একটা...। অবাক হয়ে দেখি, অগুন্তি কাঠবেড়ালিতে ছেয়ে যাচ্ছে আমাদের বাড়ি! তারা উঠে পড়ছে, দোতলায়, ঠিক যেমনি করে আগে উঠত। আমাদের না-ফল-দেওয়া আমগাছটা ধরে, সরু পেঁপেগাছ বেয়ে, কত যে কাঠবেড়ালি পরপর উঠে যেতে থাকল, তা আর আমি গুনতে পারলাম না। হাঁ করে দাঁড়িয়ে দেখতে থাকলাম, কতশত কাঠবেড়ালি ছেয়ে ফেলছে আমাদের বাড়ি! তার সিঁড়ি বেয়ে উঠছে, রেলিং বেয়ে-বারান্দায় হাঁটছে-গড়াগড়ি দিচ্ছে। সেই যে চিলেকোঠায় বাচ্চা দিত, এই দলে কি সেই সব কাঠবেড়ালিরা আছে? যারা মান্তুর মুঠো থেকে বাদাম তুলে নিত, আছে কি তারা? এরা কি তাদের বংশধর যারা আমাদের বাড়ির সামনে নিচু পাঁচিল ঘেরা একচিলতে উঠোনে সর্বদা খেলে বেড়াত?

    জেঠু-জ্যেঠিমা-মা —সকলে দুপুরের ভাতঘুম ভেঙে বাইরে চলে এসেছে। অজস্র কাঠবেড়ালি দেখে বারান্দায় দাঁড়িয়ে তারা সমানে চিৎকার করছে, এই খোকন, বাড়িতে এত কাঠবেড়ালি কেন রে, হ্যাঁ; এত কাঠবেড়ালি এখানে কী করছে? তুই নিচে হাঁ করে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? তুই এদের ডেকে আনলি না কিরে? হ্যাঁরে, একবার মান্তুর সঙ্গে কথা বলব... মান্তু কেমন আছে, সে ঠিক আছে তো—! তুই কোন উত্তর করছিস না কেন?

    আমি এর কি উত্তর দেব? উত্তর দেবে কৃষ্ণচূড়ার নিচে সযত্নে রেখে দেওয়া সেই কাঠবেড়ালিটা। তার আসার সময় হয়ে গেছে। আর ততক্ষণে আমি একটু কেঁদে নিই।

    আমি ল্যাম্পপোস্ট ধরে আস্তে আস্তে মাটিতে বসে পড়লাম।




    অলংকরণ (Artwork) : অলংকরণঃ রাহুল মজুমদার
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments