।। এক ।।
বীরেন, বাড়ি চল। সন্ধ্যে হল যে!
শ্মশানঘাটের এক প্রান্তে উদ্ধত কাঁধের ভঙ্গিমার মাঝে মাথা ঝুঁকিয়ে বসে থাকা তরুণ জবাব দেয় না।
পূর্ণ এগিয়ে আসে। পিঠে হাত রেখে নরম গলায় বলে, বাড়ি যাবি না, বীরু!
বীরেন্দ্র উঠে দাঁড়ায়। পাশের নিভন্ত চিতার পুরানো আগুন সমস্তটাই যেন ঠাঁই নিয়েছে তার দুই চোখে। সেই আভাতেই যেন আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে তার দুই গালে অবিরাম অশ্রুর দাগ।
পূর্ণচন্দ্র চক্রবর্তী ঘরে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য হাত বাড়িয়ে দেন বন্ধু বীরেন্দ্রনাথ দত্তগুপ্তের দিকে। ঘরের টান যার খানিক আগেই নিঃশেষে ফুরিয়ে গেছে অদূরে দাহ হওয়া মহাশবের দেহাবশেষের মত।
উত্তর কলকাতার এক তেতলার ঘরে টিমটিমে সেজবাতির আলোয় নিজের পঙ্গু ডানহাতটায় তখন বইয়ের ওজন বেঁধে অপর হাতে নাড়াচাড়া করে দেখছে চারু বসু।
নো অ্যাপীল! ডান-হাতের আজন্ম অদৃশ্য তালুটার জায়গায় তাকিয়ে আপনমনেই সে হেসে ওঠে। নো অ্যাপীল, ইনডীড!প্রতিবন্ধী জীবনটাকে অ্যাপীল করে অযথা দীর্ঘায়িত করে কী লাভ? তার চেয়ে যোদ্ধা-হৃদয়ের অধিকারটুকু সদম্ভে ছিনিয়ে নেওয়ার ঔদ্ধত্যে মনোনিবেশ করাটাই বাঞ্ছনীয় নয় কি?
অথবা, জন্মাবধি যা ছিল অদৃষ্টের পরিহাস, তা-ই তো হয়ে উঠতে পারে প্রবল প্রতিপক্ষকে উপহাস করবার সর্বোত্তম মাধ্যম! কোনোরকম শারীরিক অক্ষমতাও যে এ যুদ্ধের ময়দানে একেবারেই বাতিল নয়, সেটাও তো কয়েক ঘন্টা আগেই প্রচণ্ড প্রমাণ হিসাবে বিঁধে গেছে কলকাতার বুকে!
ঘটনার ঘোর এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেনি আইরিশ ওয়ার্ডার ইথান প্রাইস। এমনিতে বাস্তবের কঠিন জমিতে কবিত্ববিলাস দেখলেই তার বিদ্রূপ করবার তীব্র স্পৃহা জেগে ওঠে। ইমপ্র্যাকটিক্যাল লোকজনের প্রতি সে মোটেই প্রসন্ন নয়; দু-চার কথায় স্বপ্নের ফানুসটাকে চুপসে দিয়ে সে আনন্দের চেয়ে বেশি কর্তব্য পালনের স্বস্তি উপভোগ করেই থাকে। কিন্তু আজকের এই প্রবলতর বিদ্রূপের সম্মুখীন হয়ে এ-ক’দিনের ঘটনাকে দুঃস্বপ্ন বলেই কি চালিয়ে দেবে ইথান? নাকি কিছুক্ষণ আগে লুকিয়েচুরিয়ে আরেকটা আশ্চর্য মানুষকে প্রশ্নটা যেমন করেই ফেলেছিল, সেই পরাজয়ের গ্লানিটুকু মেনেই নেবে বীরের মত?
সকাল থেকে দিনটা একইসঙ্গে এমন রুদ্ধশ্বাস ও ক্লান্তিকর যাবে, আন্দাজ করেননি ফ্রেডরিক হ্যালিডে। সান্ধ্যবিলাস-অন্তে কিড স্ট্রীটেপুলিশ কমিশনারের প্রাসাদকূটে তন্দ্রা সত্যই ছুটে গিয়েছে তাঁর।
শহরের পরিস্থিতি আজ টালমাটাল, শোকবিহ্বল, আবেগ জর্জর, এবং কোন এক তীব্র উদ্দীপনায় উজ্জীবিত। এ ঢেউ ফিরে যেতে সময় লাগবে, তিনি জানেন। এলিসিয়াম রো-এর অন্ধকূপে সঞ্জীবনীর জোয়ার আজ; তিনি খবর রাখেন সবই। আসল ঘটনা বহুকাল ফুরিয়ে গেছে ভেবেছিলেন বলেই, আজকের উচ্ছ্বাস তাঁর মর্মমূলে বিঁধছে যেন অনেক বেশিই।
মাইক আন্দাজ করেছিল যদিও। অধস্তন হলেও, তুখোড় বুদ্ধির অধিকারী এই ছেলেটিকে মনে মনে তিনি সমীহ করেন। মাত্র কয়েক বছরের নিয়োগের মধ্যেই একেবারে পথে বা অকুস্থলে নেমে বিপজ্জনক কাজে স্বয়ং জড়িয়ে পড়ে, দুঃসাহসী তরুণ মাইক ওরফে সদ্য-পদোন্নতি হওয়া তীক্ষ্ণধী পুলিশ সুপারইন্টেনডেন্ট চার্লস অগাস্টাস টেগার্ট এ মহানগরের নাড়ীর গতি ইতিমধ্যেই অনুধাবন করেছে অনেকটা। মৃতদেহের মুখ ঢেকে রাখা ও মেইন গেট দিয়ে বেরোতে না দেওয়ার পরামর্শটাও তারই। যদিও তাতেও বাঁধ দেওয়া যায়নি ঘটনায়।
ক্লান্ত কমিশনার হাজার বার দেখা হয়ে যাওয়ার পরও ফের মৃত ব্যক্তির ফাইলটা খুলে ধরেন। হয়তো কোনো হিসেব এখনও মেলাতে পারেননি বলেই। মনে হয়, প্রথম পাতায় জীর্ণ-শীর্ণ ক্ষীণ দৃষ্টি যুবকটির ছবি যেন ব্যঙ্গ করে তাঁকে বলছে ─ শুধু বাইরের দেখার মধ্যে দিয়ে দুনিয়াদারির হিসেব অত সহজে মেলবার নয়!
জাগতিক, সামাজিক হিসেব ওলট-পালট করতেই জন্মেছিল সে। বছর কুড়ি আগে, জন্মাষ্টমী তিথিতে ভূমিষ্ঠ হয়ে পূর্বনির্ধারিত “সর্ব্বতোষ” নামটিকেও কৃষ্ণ-কারা সূতিকাগৃহের বাইরে আসতে দেয়নি।
কানাইলাল দত্ত।
।।দুই।।
চারুচন্দ্র আলতো চাপ দেন ছেলেটির কাঁধে। ইশারা করেন, এই-ই উপযুক্ত সময়।
কিছুটা সংশয়ের মধ্যেই অনভ্যস্ত কাঁপা কাঁপা হাতে বন্দুকটা তুলে ধরেই ফায়ার করে সে।
নাঃ। তার গুলিতে বেলেহাঁসের পালের একটিরও পালকটুকু খসেনি। ত্রস্ত-চকিত হাঁসগুলো কর্কশ শব্দে ছত্রভঙ্গ হয়ে উড়ে যায়।
“হয়েছে না, স্যার”, মাথা নিচু করে ফেলা ছেলেটা কথা শেষ করার আগেই আর-একটা ফায়ার শোনা যায়।
অবাক চোখে ছেলেটা দেখে, তার মাস্টারমশাইয়ের আচমকা উদ্যত আগ্নেয়াস্ত্রের সামনে তীক্ষ্ণ চিৎকার করে পাক খেয়ে পড়ছে একটা উড়ন্ত, আহত পাখি।
সতীশ, নিয়ে এসো।
দ্বিতীয় ছাত্রটিকে শিকার সংগ্রহে পাঠিয়ে ডুপ্লে কলেজের অধ্যক্ষ চারুচন্দ্র রায় ফেরেন নতুন ছেলে কানাইলালের বিমুগ্ধ উদ্ভাসিত মুখমণ্ডলের দিকে।
কথাটা “হয়েছে না” নয়, “হল না”। ইয়ংম্যান, টেন্স নিয়ে আরও ঘষামাজার প্রয়োজন আছে তোমার।
এ-জাতীয় অভিব্যক্তি আশা করেনি চোদ্দ বছরের কানাই দত্ত। প্রায় পুরো ছেলেবেলা পুণায় কাটিয়ে বাংলাটা একটু দুর্বলই হয়ে আছে তার। সহপাঠীদের হাসির খোরাক তার এই কথ্য ভাষা সংশোধনের দায়িত্ব চারুচন্দ্র নিজের বাড়িতে সান্ধ্য পাঠদানের মাধ্যমে স্বেচ্ছায় পালন করে থাকেন। যুগল-ভ্রান্তির লজ্জায় আরও কিছুটা সংকুচিতই হয়ে পড়ে যেন সে।
অধ্যাপক পিঠ চাপড়ে দিয়ে বলেন, নেভার মাইণ্ড। দ্যাট ওয়জ আ ফার্স্ট। য়ু ডিডন্ট ইভন এইম!
তারপর ঝুঁকে পড়ে বলেন, বাট নেভার সে “হবে না!” এইম অ্যান্ড শুট অ্যাজ মাচ অ্যাজ য়ু ওয়ন্ট, বাট নেভার স্টপ শর্ট অফ দ্য গোল!
রু দ্য বেনারস ধরে হাঁটছে কানাইলাল।
আলো পড়ে আসা বিকালে বান্ধব সম্মিলনীর ছেলেদের হাতে প্রতিদিনই বেদম মার খায় ও।
উপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরিচয়টা ভাসা-ভাসা জানা আছে তার। তাঁরই ছোট ভাই নরেন্দ্র দায়িত্ব নিয়ে বক্সিং শেখান ওর বয়সী আরও অনেক ছেলেকে। নতুন এসে ম্যালেরিয়ায় পড়ে ভুগে ভুগে রুগ্নদেহ কানাইলাল এখনও কারোর সঙ্গেই এঁটে উঠতে পারে না ঠিক। তবু মাস্টারমশাইয়ের নির্দেশে তাকে লড়তে যেতে হয়। নরেন্দ্রনাথের ধমকে উঠে দাঁড়াতে হয় প্রতিটা আক্রমণে লুটিয়ে পড়ার অব্যবহিত পরমুহূর্তেই।
মারের মুখে বুক চিতিয়ে দাঁড়ানোটাই আসল হে! নরেনদার বাজখাঁই কণ্ঠস্বর মনের মধ্যে ভেসে এলে এখনও গলা শুকিয়ে যাচ্ছে ওর।
লাঠিয়ালদের সম্রাট ওস্তাদ মোর্তাজার পাঠ বরং সহজ। আঘাত করা নয়, আঘাতের কসরৎ শিখিয়ে দেওয়াটাই তার লক্ষ্য। বঙ্কিমচন্দ্রের লাঠিরউপর প্রবন্ধ পড়েই নাকি চারুচন্দ্র তাঁকে নিয়োগ করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছিলেন।
টনটন করা চোয়ালে হাত বুলোতে বুলোতে পা চালায় কানাইলাল। পথের পাশে ঝোপের মধ্যে থরে-থরে জোনাকির সাঁঝবাতি জ্বলে উঠছে। সাহিত্যের ছলে ইতিহাস পড়ানোর জন্য মাস্টারমশাই অপেক্ষা করে আছেন। দুই সহপাঠী রাসবিহারী আর শ্রীশচন্দ্র বোধহয় এসে গেছে এতক্ষণে।
রাতের বেলা তার বাড়ির পাশে মদ খেয়ে সাহেবদের নিত্যনৈমিত্তিক চিৎকার-চেঁচামেচি দেখে দেখে বিরক্ত হয়ে যায় বাড়ির সকলেই। কানাইলাল সেদিন আর থাকতে না পেরে চাদর গায়ে দিয়ে বেরিয়েই পড়ল। উদ্দেশ্য, বুঝিয়ে-সুঝিয়ে তাদের শান্ত করা। অযৌক্তিক সাহেব-প্রীতি বা ভীতির কোনোটাই তার দুর্বলতা ছিল না।
তিনজনের দলটা তাকে পাত্তা দিল না একেবারেই। কানাই হয়তো ফিরেই আসত, এমন সময় তার দেড়া চেহারার সাহেবটা আচমকা তাকে এক ধাক্কা দিয়ে রাস্তা থেকে সরাবার চেষ্টা করলে।
কী একটা খেলে গেল তার শরীরের মধ্যে। কানাইলাল দ্বিতীয় চিন্তা না করেই বিদ্যুদ্বেগে ঘুরে দাঁড়িয়ে সাহেবের নাক লক্ষ্য করে চালাল এক প্রচণ্ড ঘুঁষি! দুই পাক খেয়ে সাহেব যখন নর্দমায় পড়ে যাচ্ছে,আরও একজন তাকে আক্রমণ করতে এগিয়ে এলে প্রতিবর্ত ক্রিয়াতেই যেন কানাই দুই হাতে তাকে চেপে ধরে নরেন বাঁড়ুজ্জের মার্কামারা প্যাঁচে ধরাশায়ী করে দিল।
সরিষাপাড়া গলির শর্টকাট ধরে হনহন করে হেঁটে যখন ঘরে ফিরছিল, তিন শ্বেতাঙ্গ বীরের চাপা আর্তনাদ, আর কোনোমতে সামলে নিয়ে দৌড়ে পালানোর চেষ্টার আওয়াজ শুনেও সে আর ঘুরে তাকায়নি।
অবস্থার ঘোরটা কেটে যেতে কানাই হঠাৎই টের পেল, তার মধ্যে কোথাও খুব শক্তিশালী একটা মানুষ লুকিয়ে আছে। বান্ধব সম্মিলনীর দাদাদের মতো, অন্যায়ের বিরুদ্ধে দৃঢ়ভাবে একা দাঁড়াতে চাইলে পারে সে-ও!
মাস্টারমশাইয়ের কাছে ছুটে গেল পরদিন সকালেই । গুরুবন্দনা করে অযুত সৈন্যের বল পেল যেন দেহে-মনে।
চারুচন্দ্র শেখাতেন, নেভার আন্ডারএস্টিমেট ইওরসেলফ, মাই বয়!
তাঁর শিকারের সংগ্রহে কানাইলালের অব্যর্থ নিশানার প্রমাণও বাড়তে থাকে দিনে-দিনে।
তারপর থেকে জ্বরে বেহুঁশ কানাইলাল এক ডাকে উঠে চলে যায় পাড়ার খোড়ো চালার আগুন নেভাতে। কোথাও কোনো ঝামেলা দেখলেই ভীমবিক্রমে দাঁড়ায় মাঝে গিয়ে; কার সাধ্য সেই পুরু কাঁচের চশমা পরা, তালঢ্যাঙা শ্যামলা রোগাপাতলা চেহারাটাকে সমীহ না করে! একের পর এক সমিতি গঠন করে নিজের উদ্যোগেই। ইতিহাসে স্নাতক নিলেও, তার প্রকৃত ইতিহাসপাঠ বহাল থাকে চারুচন্দ্র রায়ের লাইব্রেরীতে। পাঠ্যসূচীর বাইরে গিয়ে কণ্ঠস্থ করে বিদেশজোড়া বিদ্রোহের ইতিহাস।
বঙ্গভঙ্গের জোয়ার তখন আছড়ে পড়েছে ফরাসী শাসনাধীন চন্দননগরেও। সমিতির চার-পাঁচটি ছেলেকে নিয়ে বিলিতি সার্কাস স্রেফ লাঠি ঘুরিয়ে বন্ধ করে দিয়ে এল কানাইলাল। পাশাপাশি পিতৃতুল্য মাস্টারমশাইকে মধ্যমণি করে একাই গড়ে তুললে চাকরি-চ্যুত বাঙালী কেরাণীদের সাহায্য-ভাণ্ডার। খাঁটি স্বদেশী উপায়ে অক্লান্ত ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থায় লেগে রইল যতক্ষণ একটিও দুর্যোগের সংবাদ তার কর্ণগোচর হচ্ছে।
স্রেফ মুড়ি আর মোষের দুধ খেয়ে থাকা রোগাভোগা শরীরটার কর্মদক্ষতা দেখে অবাক হয় সবাই। বন্ধু মধুসূদন অবাক হয়ে বলে, দিনরাত্তির এত খাটিস কীভাবে! দুখানা মানুষের জোর রাখিস কোথায় তুই?
কানাই হেসে জবাব দেয়, মনে!
দাদা আশুতোষ দত্ত কখনো-সখনো তার অতিদ্রুত বইয়ের পাতা উলটে যাওয়া দেখে আক্ষেপ করেন। পড়াশুনোটার পাট ওঠালি রে!
গুরুজনদের কথার উপর উত্তর দিতে তার এখনও বাধে। পরীক্ষায় প্রথম বা দ্বিতীয় হয়েই ও-সমস্যাটার সমাধানের ব্যবস্থা করে রাখে কানাইলাল।
নিজের অজান্তেই সে বড় হয়ে যাচ্ছে। দেশের কথা পড়ে পড়ে, দেশের মানুষকে একনিষ্ঠ ভালোবাসার দাবিতে ঝড়ের বেগে কী যে পরিবর্তন অবিরত হয়ে চলেছে তার শরীরে-মনে, তার খবর কি সে নিজেই রাখে?
ভাবলে নিজের মধ্যেই যেন বিমূঢ় হয়ে পড়ে ও। তাই থামতে চায় না। সমস্ত শক্তিটুকু নিঃশেষে কাজের মধ্যে ঢেলে দেওয়ার আগে পর্যন্ত তার ভাববার অবকাশ নেই।
।।তিন।।
মঁসিয়ে তার্দিভেলের প্রাণে বেঁচে যাওয়ার খবর শুনে বিরক্তির ভ্রূকুটি ছড়িয়ে পড়ে কানাইলালের শান্ত মুখমণ্ডলে।
অনেক কষ্টে দুটো বোমা জোগাড় করে মতিদার হাতে তুলে দিয়েছিল কানাই। সেদিন বেনামী চিঠিটা পেয়ে রাত দুটোয় বোড়াইচণ্ডীতলার শ্মশানঘাটে সে হাজির হয়েছিল একাই; সর্বাঙ্গে কালো কাপড়মুড়ি দিয়ে, কোমরে বাঁধা ছোরাটুকু সম্বল করে। বৃদ্ধ-বটবৃক্ষের নীচে শ্রীশ ঘোষের বন্ধু মতিলাল রায়কে দেখে বিশেষ অবাকও হয়নি। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময় তাঁর ক্রিয়াকলাপে মানুষটার ভালোই পরিচয় সে পেয়েছে। তাছাড়া চারুচন্দ্রের বাড়িতে এসে মতিদা একদিন কৌতূহলবশতঃ তাকে জিজ্ঞাসাও করেছিলেন, তোমাদের যা আলোচনা শুনছি, এ কি সত্যি?
কানাই সরল চোখদুটি সরাসরি তাঁর চোখে স্থিরনিবদ্ধ করে। কী আলোচনা বলো দেখি?
গোয়ালন্দ স্টেশনে ঢাকার ম্যাজিস্ট্রেট, অ্যালেন সাহেবকে তোমরাই —
অনুজপ্রতিম নিরীহধাঁচের ছেলেটা হঠাৎ হো-হো করে হেসে ওঠায় অপ্রস্তুতে পড়েন মতিলাল। তাঁর বিপ্লব-ধারণা তখনও গণসংগঠন থেকে নরমেধে গিয়ে পৌঁছায়নি। কোনোমতে বলেন, এ যে স্বপ্ন!
দমকা হাসির বেগ সামলে কানাই উত্তর দেয়, আহা অমন স্বপ্ন যেন রোজ-রোজ দেখতে হয় এবার থেকে!
কানাইলালের অট্টহাস্যের একটা মোহময় বৈশিষ্ট্য ছিল।
কয়েক মাস আগে বিজয়া দশমীর সন্ধ্যায় সন্ন্যাসীর ছদ্মবেশে বারীন ঘোষ বোড়াইচণ্ডীর ঘাটে এসে দেখা দেওয়ার পর মতিলাল-গোষ্ঠীর কর্মপন্থাও বদলে গেছে। মেয়র তার্দিভেলের স্বৈরাচার চন্দননগরকে কীভাবে বৃহত্তর ইংরেজ শাসনেরই অংশ করে তুলছে, মতিলাল তাঁদের বিগত অধিবেশনের ঘটনা তুলে কানাইকে বুঝিয়ে বললেন সে-রাত্রে। যদিও নতুন করে বোঝানোর কিছু ছিল না হয়তো। সাহায্যে সম্মত হল সে।
নিবেদিতার কথা শুনেছ মতিদা?
জ্যোৎস্নায় ঝিলিক দিয়ে ওঠে চশমার কাঁচের পিছনে কানাইলালের চোখ।
তিনি বলেন, England yields nothing without bombs!
দুটি বোমা জোগাড় করে হস্তান্তর করে দেয় কানাই, আবারও এক মধ্যরাতে সেই শ্মশানের নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে এসেই।
নিক্ষেপকারীর ভুলেই সম্ভবতঃ বোমা ফাটেনি। মতিদার কাছে আজ সে কাজের পরোক্ষ বৃত্তান্ত শুনে বিরক্তিটা চেপে রাখতে পারে না মিতভাষী কানাইলাল।
পালানোর দিকে মন থাকলে আর বোমাটা ঠিক করে ছুঁড়বে কেমন করে!
মতিলাল জবাব দিতে পারেন না। কানাই পুনরায় বলে, কাজটা শেখাও, মতিদা। মিশন একশো ভাগ সাকসেসফুল করা চাই, ফাঁকা অ্যাটেম্পট দেখে দেখে বাংলাদেশ ক্লান্ত হয়ে গেল! বিপ্লবীর আবার এত পালিয়ে যাওয়ার তাড়া কীসের?
বি.এ. পরীক্ষাটা শেষ হতেই চাকরী খোঁজার নাম করে কলকাতায় চলে এল কানাইলাল।
“বন্দেমাতরম্”এর ঋষিপ্রতিম সম্পাদক শ্রীঅরবিন্দ ঘোষ ও তাঁর ভাই বারীন্দ্রকুমারের সঙ্গে সংযোগ হওয়ার পর তার কাজের গতি বেড়ে গেছে।
মুরারীপুকুরের বাগানে জপ-তপ-প্রাণায়াম শিখতে উৎসাহ নেই, জোর গলায় জানিয়ে দেয় সে প্রথমেই। তত্ত্বাবধায়ক উপেনদা অবশ্য তাঁর ভাইয়ের মত মেজাজী মানুষ নন, অবাধ্যতাকে স্নেহভরেই সামলান, নরেন বাঁড়ুজ্জের ট্রেডমার্ক আণ্ডারকাট্ ঝাড়তে আসেন না। তিনি বার দুয়েক নানা অছিলায় বাড়ি পাঠিয়ে দিলেও অচল পয়সার মত একরোখা কানাই ফেরৎ আসে। চট্টগ্রামে কুলির কাজ করতে পাঠানো হয়; কানাইয়ের দৃষ্টিশক্তিতে বাধে।
অনেক পরখ করার পর শেষমেশ একটা “বড় কাজ”-এর দায়িত্ব দেওয়ার পরেই দুদিন অন্তর অসুস্থ হয়ে পড়তে থাকে কানাইলাল।
হাওয়া বদল করো হে! বারীন ঘোষ উপদেশ দেন। প্রফুল্ল চাকীর সঙ্গে মজঃফরপুরে মিশনে পাঠানোর জন্য কানাইয়ের বদলি হিসেবে মেদিনীপুর থেকে আরেকটি ছেলেকে ইতিমধ্যেই পেয়ে গেছেন তিনি।
পলিটিক্যাল মার্ডারের সুযোগটা এইভাবে ফস্কে যাওয়ায় আফশোসের সীমা থাকে না তার। কী করে বারীনদাকে বোঝায়, শরীর যতই বিদ্রোহ করুক, কাজে সফল না হয়ে পালিয়ে সে আসত না কোনোমতেই! সে জানে মিশন ফার্স্ট, এসকেপ ইজ নট এসেনশিয়াল!
বিফলমনোরথ কানাইলালের নতুন ঠিকানা হয় পনেরো নম্বর গোপীমোহন দত্ত লেনে। বোমা তৈরির খাসমহলে হাতে-কলমে শেখার সুযোগ পেয়ে কিছুটা উৎসাহ ফিরে পেল যেন সে।
সে সুখ অবশ্য সইল না বেশিদিন।
৩০শে এপ্রিল, ১৯০৮। মজঃফরপুরে কেনেডির ফিটনে ফাটল কলকাতার বোমা। অল্পের জন্য আবারও পার পেয়ে গেলেন অত্যাচারী ম্যাজিস্ট্রেট কিংসফোর্ড।
ঠিক তার পরেই মুরারীপুকুর থেকে চৌত্রিশ জনের সঙ্গেই গ্রে স্ট্রীটের বাসা থেকে শেষরাতে বিনা কারণে গ্রেপ্তার হলেন অরবিন্দ ঘোষ।
দোসরা মে গোপীমোহন দত্তের গলির আস্তানা তছনছ করে দিয়ে আরও জনাকুড়ি ছেলের সঙ্গে আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে পুলিস রাজকীয় অভ্যর্থনা করল কানাইলালকে।
।। চার ।।
বিশেষ বিচলিত হওয়ার কারণ তখনও দেখেনি কেউই। চুয়াল্লিশ ডিক্রীর অংশে তিন-চারজন করে একত্রে থাকে ছেলের দল। ছেলেদের গানে-গল্পে-আড্ডায় আলিপুর জেল দিন রাত একটা ছোটোখাটো উৎসবমণ্ডপের মত হয়ে উঠেছে। প্রচ্ছন্ন প্রশ্রয় দেন উপেনদাও, মাঝে-মধ্যে বন্ধু দেবব্রত বসুকে ধরেন গান শোনানোর জন্য। সে সময় অবশ্য কেবল গাম্ভীর্য আর নীরবতার।
কমবয়সীরা বিনোদনের নিত্যনতুন ফন্দি খুঁজে নেয়। একগাছি দড়ি দিয়ে কখনো সারাদিন ঘুমোতে থাকা কারোর পা দুটি বেঁধে দেয় একসাথে। কানাইলাল মধ্যরাতে কারোর বালিশের তলা থেকে বিস্কুটের টিন খুঁজে বার করে। তার ফুর্তির সশব্দ বহিঃপ্রকাশে অরবিন্দর ঘুম ভেঙে গেলে তাঁর হাতে খানকতক চোরাই বিস্কুট গুঁজে দিয়ে অবস্থা সামাল দেয় নিজেই।
এমন নিরুপদ্রব দিনযাপনের মধ্যেই কোথাও একটা ছন্দপতন হল। নিজেদের কাজ ফুরিয়েছে, তাই যাবতীয় কৃতিত্ব দেশবাসীকে জানিয়ে দিয়ে যাব— এই মর্মে স্বীকারোক্তি শুরু করলেন বারীন্দ্রকুমার!
কী চান বারীনদা? প্রবল অসন্তোষ ঘনিয়ে ওঠে কানাইয়ের মনে। নিয়ম, মন্ত্রগুপ্তি, এতকাল এইসব শিক্ষা দেওয়ার পরে এখন এমনি অকুণ্ঠ দম্ভে ধুলোয় মিশিয়ে দিচ্ছেন সব? সকলকে নিয়ে ভরাডুবি হলে আন্দোলনের ভবিষ্যৎটাই বা কী হবে?
শ্রীশ ঘোষ এসে জেলের পরিস্থিতি দেখেশুনে গেছে। রাতের অন্ধকারে গা মিশিয়ে মতিলাল রায়ের বাড়িতে ঢুকে সংবাদ দেয় সে। অনতিবিলম্বেই দাদার বন্ধুর পরিচয়ে অফিসফেরত আলিপুর জেলে দেখা করতে আসেন মতিলাল।
কানাই তাঁর হাত চেপে ধরে বলে, জেলে পচে মরার জন্য এ-পথে আসিনি মতিদা! কয়েকটা সেফ হাউজের বন্দোবস্ত করতে পারো? আমরা পালাব।
মতিলাল সন্দিহান হন।
বারীন্দ্র জানেন? অরবিন্দ? দেবব্রত?
কানাই রুখে উঠে বললে, তাঁদের মনে কি চলছে তা তাঁরাই বোঝেন। আমি ও-খেয়ালে তাল মেলাতে আর পারব না। আমার মত আর যারা আছে, তাদের নিয়ে জেল ভাঙব।পারো তো আমাদের আশ্রয় দিও।
কানাই ভুল আন্দাজ করেনি। অপ্রসন্ন হয়েছে দলের অন্য অনেকেও, নিয়তির খেলার মধ্যে নিজেকে সঁপে না দিয়ে পালানোর ইচ্ছেটাই তাদের মধ্যেও মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে।
অশোক তো সোজাসুজি বলেই বসে— স্রেফ রোখের মাথায় নিজেদের কীর্তি প্রচার করে লাভের চেয়ে ক্ষতিই যে হচ্ছে বেশি, সে হুঁশ কি ওঁর আছে?
সব আশঙ্কা সত্যি করেই নিত্যনতুন ধরা পড়তে থাকে আরও অনেক ছেলে। তারা সবাই যে দলের পূর্ণকর্মী, তা-ও নয়। সামান্য যোগাযোগের অছিলায় অতি-সতর্ক পুলিস তাদের তুলে আনে। এমনি করেই জেলে নতুন আবাসিক এসেছিল একজন। শ্রীরামপুরের নরেন্দ্রনাথ গোস্বামী।
তার বাগ্বিন্যাসের তেজ দেখবার মত। জমিদারবাড়ির ছেলে হয়েও তার এই দেশপ্রেম এবং কর্তব্যনিষ্ঠার কথাবার্তা শুনতে ভালই লাগে সকলের। মাসখানেক সে তার কথার দাপটেই মাত করে রাখে জেলচত্বর। আমার বাবা মোকদ্দমা করে করে বুড়ো হলেন! সদর্পে ঘোষণা করে নরেন গোঁসাই। পুলিস আমার কিচ্ছু করতে পারবে না।
কিন্তু ক্রমশঃ তার আচার-ব্যবহারে কেমন একটা উলটো সুর দেখতে পায় কানাইলাল। জেলের পরিবেশ অতি তেজী মানুষেরও মন ভেঙে দিতে পারে, এই ভেবে স্তোক দেয় সে নিজেকে।
হৃষিকেশের কাছে একদিন খোশগল্প করতে আসে নরেন। কথাচ্ছলেই জানতে চায়, সংগঠনের অন্য শাখাগুলি কোথায় আছে। সমস্যার গুরুত্ব অতটাও হয়তো বোঝেনি হৃষি কাঞ্জিলাল। নেহাৎই ছেলেমানুষি খেয়ালে হাস্যকর সব নামঠিকানা বানিয়ে গম্ভীর মুখে উপস্থাপনা করে গোস্বামীর সমীপে। বাংলার লাট অ্যান্ড্রু ফ্রেজারকে গুপ্তসমিতির প্রধান পৃষ্ঠপোষক বলে ঘোষণা করা অরবিন্দের সেই রসিকতাটা শুনেই তার কৌতুকপ্রিয়তা জাগরূক হয়েছিল সম্ভবতঃ।
ঘটনার চারদিন পর, তেইশে জুন পুলিস এসে সে-সব তথ্য যাচাই করতে চায়। তার কল্পিত নামগুলি ডিটেকটিভ শামসুল আলমের মুখে শুনে বজ্রাহত হয়ে যায় হৃষিকেশ।
মীরজাফর! খবরটা ক্ষুদিরামের বোমার মতই ফেটে পড়ে আলিপুর জেলের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। নরেন গোঁসাই রাজসাক্ষী হয়েছে!
।। পাঁচ ।।
“অ্যাপ্রুভার” — শব্দটা তীরের মত বিঁধে যায় কানাইয়ের মস্তিষ্কে। বারীনদা নিজেকে বাঁচাতে চাননি। মামলার মূল লক্ষ্য দাদা অরবিন্দকে ইনক্রিমিনেট করতে বিন্দুমাত্র সাহায্য করেননি তিনি। এদিকে নরেন গোঁসাই স্বার্থপরের মত নিজের নিরাপত্তার বিনিময়ে আরও সর্বনাশের দিকে ক্রমে ক্রমে ঠেলে দিচ্ছে সকলকে। এ কারাবাস আর ইহকালে শেষ হবে কি কারোর? সন্দিহান সকলেই। কিন্তু নরেনকে বোঝানোর উপায় নেই। সহকর্মীদের মুখোমুখি হতে পারবে না বুঝে নবলব্ধ সুবিধা কাজে লাগিয়ে সে হাসপাতালের ইওরোপীয়ান ওয়ার্ডের সাচ্ছল্যে আশ্রয় নিয়েছে।
তার মাস্টারমশাই — চারুচন্দ্র রায়কে মিথ্যে অভিযোগে জড়িয়ে জেলের মধ্যে টেনে এনেছে গোঁসাই। উল্লাসকর বিবৃতি দিয়েছিল নির্দোষ মানুষগুলিকে বাঁচানোর জন্য, কিন্তু ব্রিটিশ আশ্রয়ের লোভে উন্মত্ত নরেন অসংখ্য নিরপরাধ, মামলার সঙ্গে সম্পূর্ণ সম্পর্করহিত মানুষগুলিকে টেনে এনে নিজের মূল্য আরও বাড়িয়ে নিতে চাইছে। সঙ্কেতলিপিতে ইন্দুভূষণের কোড-নেম “চারু” দেখেই সে অভিযোগের আঙুল তুলে দিয়েছে ডুপ্লে কলেজের অধ্যক্ষের দিকে। পরিবারকে ছেড়ে এই প্রবীণ বয়সে দেবতুল্য মানুষটিকে কারাবরণ করে নিতে হয়েছে। একটা অন্ধ রাগ কানাইয়ের মাথার মধ্যে ছিঁড়েখুঁড়ে খায় । এর শেষ কোথায়? এর পর কি অরবিন্দকেও...
সময় বয়ে যাচ্ছে। আলিপুর জেলের মধ্যে তার গতি বড় ধীর, বিরস, নিষ্ফলা। কিন্তু রাজসাক্ষীর সহায়তায় পুলিশের কাজ এগিয়ে যাচ্ছে অনেক দ্রুত। পনেরোই অগস্ট। মজঃফরপুর জেলে ক্ষুদিরামের ফাঁসির খবরটা চারদিন পরে এসে পৌঁছায় কানাইদের কাছে। একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ে তার। বারীনদা শেষমুহূর্তে মত না বদলালে ওই জায়গায় যাওয়ার কথা ছিল তারই।
প্রহরা বেড়ে গেছে আগের চেয়ে। জেলর যোগেন্দ্রনাথ ঘোষ প্রায়ই প্রকাশ্যে দুঃখ করেন তাঁর চাকুরীজীবনের শেষলগ্নে এহেন ঝামেলার কথা ভেবে। অরবিন্দকেই শুনিয়ে যান— যা সমস্ত দস্যি-দামাল ছেলে! একজনেই খালি হাতে তিনটে লোককে মেরে বেরিয়ে যাবে।
এখনও একখানা সেলে কয়েকটি করে ছেলে থাকে। তবে একমাত্র সদা-উচ্ছল উল্লাসকর ছাড়া, বাকি সকলেরই অবস্থা ম্রিয়মাণ। কয়েকদিন আগের হাসি-গান-উচ্ছ্বাস কেমন একটা স্তিমিত হয়ে পড়েছে চোখের উপর এ হেন বিশ্বাসঘাতকতায়। কানাইলাল সব দেখে। মাস্টারমশাইয়ের স্থান আলাদা সেলে; চুয়াল্লিশ ডিক্রির ডর্মিটরি ‘সরকারী হোটেল’ব্যবস্থায় ছেলেছোকরাদের সঙ্গে তাঁর দেখাসাক্ষাৎ প্রায় নেই। বড় একটা আসেনও না বাইরে। অন্তর্মুখী হয়ে পড়েছেন এই আচম্বিত আঘাতে। সবই বুঝতে পারে সে। কী যেন একটা অবসাদ এসে গ্রাস করে তাকেও।
সেলের দরজার আর একটু কাছে সরে আসে কানাইলাল। বৃষ্টি শুরু হয়েছে। রিমঝিম ফোঁটা বাইরের মাটিতে পড়ে কাদার মত ছিটকে আসে গায়ের কাছে। তা আসুক। এ-ও বাইরের জিনিস। মুক্ত পৃথিবীর মাটি। অথবা তাও হয়তো নয়। কী-সব এলোমেলো ভাবছে কানাই! নিজেকেই ধমক দেয় ও। এই পবিত্র ধূলিকণাও আজ পরাধীনতায় ক্লিষ্ট বলেই তো সে গরাদের এপারের জীবনটা বেছে নিয়েছে। কিংবা বেছে নেয়নি। তার কথা ছিল আরও, আরও কাজ করবার। নেহাৎ ভাগ্যের দোষেই আজ —
নাঃ। চিন্তা হল শত্রু। একাকীত্বের ভবিষ্যতে এইসব দুর্ভাবনা মাথার মধ্যে স্বতন্ত্র কণ্ঠস্বর হয়ে এসে পাগল করে দেবে তাকে। কানাইলাল জানে। তাই একরকম জোর করেই এইসব চিন্তাকে মাথা থেকে সরিয়ে নিজের ছেলেবেলার কথা ভাবতে থাকে। অন্ততঃ কিছুটা সময়ও যদি...
শুয়ে পড়ল সে মেঝের উপরে। ঝমঝমে বৃষ্টি। অন্ধকার বাইরেটার দিকে তাকিয়ে ভাবতে চেষ্টা করল এমনি কোনো মেঘলা দিনে পুণায় আর্য মিশনের জানালা থেকে সহপাঠী ছেলের দলে মিশে জল কাদা মাঠে বড়দের হইহই দৌড় ঝাঁপ খেলাধুলো দেখবার কথা। আজন্ম রোগে-ভোগা শরীরটা তার বৃষ্টি ভেজার জন্য উপযুক্ত নয়। জীবনের একটা বিরাট সময় ঘরের বিছানায় শুয়ে শুয়েই কেটে গেছে তার। স্কুলেও খেলাধুলোয় সুবিধে করতে পারেনি। স্বভাবতঃ মুখচোরা সেই ছেলেটারও কেমন করে এক দামাল বন্ধু জুটে গিয়েছিল।
বিষ্ণুগণেশ পিংলে। খাঁটি মারাঠী ক্ষাত্রতেজ তার চেহারায় এবং কথাবার্তায় ঠিক্রে বেরোত যেন। ওইটুকু বয়সেও অনেক গল্প শোনাতে জানত সে। গল্প হলেও সত্যি ঘটনা। নিরুপদ্রব ছাত্রজীবনের সময়টা তার ভরে ছিল চারিদিকের ঘটনা নিয়ে রাগ, দুর্ভাবনা আর চাপা জেদে। তার সঙ্গে আরও কিছু ছিল কি? কানাই বুঝতে পারে না, এই জীবনপণ করে দেশ বদলানোর লড়াইয়ের যে লক্ষণ তার মনে ফুটে উঠেছে, তারও কি ছাই-চাপা আঁচ কিছু ছিল বিষ্ণুর বুকের ভেতরেও?
বড় সুন্দর বাল্যস্মৃতির ভাগীদার বিষ্ণুর উজ্জ্বল চোখ দুটি মনে পড়তে আপনমনেই ম্লান হাসে কানাই। সেখানকারই এক শিক্ষক স্নেহভরে বলতেন, বিষ্ণু আর কানহাইয়া একই ভগবানের অবতার- আলাদা করবার উপায়টি নেই কারোর।
মেঘগর্জনে চিন্তাসূত্র ছিন্ন হওয়ার উপক্রম দেখে একটু অসন্তুষ্ট হয়েই যেন পাশ ফিরে সেলের অন্ধকার সীলিংএ চোখ রাখে কানাইলাল। সত্যিই, ফিরে ফিরে কৃষ্ণনামকেই যেন বন্ধু পাওয়া তার ভাগ্যে লেখা ছিলচিরকাল। এখনও সেলের ওধারে অঘোরে ঘুমোচ্ছে কৃষ্ণজীবন সান্যাল। ডুপ্লে ছেড়ে অধ্যক্ষের সুপারিশে মর্টন স্কুলে পড়তে চলে যাওয়ার আগে রাসবিহারী বোস তার গোকুল-গৃহে গিয়ে মা ব্রজেশ্বরীর হাতে খেয়ে এসেছে কতবার। ছায়াসঙ্গী শিরে-শয়তান─শ্রীশচন্দ্র ঘোষের কথাও না বললেই নয়! সহপাঠী মধুসূদন। লাঠিখেলায় চির-বিপক্ষ গিরিধারী।পুণায় প্রতিবেশীর ছেলে বনোয়ারী। দামোদর। বালকৃষ্ণ। বাসুদেব...
প্রচণ্ড শব্দে বাইরে বাজ পড়ে। ধড়মড়িয়ে উঠে বসে কানাইলাল।
ভাবতে ভাবতে মনের ভুলে এ কোন্ আবর্তে গিয়ে পড়ল সে?
ঠাণ্ডা হাওয়ার দমকটা আসতেই অনুভব করে, তার সর্বাঙ্গ ঘামে ভিজে উঠেছে।
বাসুদেব!
বিদ্যুচ্চমকের মতই শেষ তিনটি নামের ইতিহাস মনে পড়ে গেছে তার।
।।ছয়।।
বাসুদেব। বাসুদেব হরি চাপেকর।
চোস্ত্ ইংরেজিতে বিষ্ণুর গড়গড়িয়ে বলে যাওয়া সেই ইতিহাসের আলেখ্যর মধ্য থেকে বড় দুই দাদা দামোদর আর বালকৃষ্ণের আদরে আগলে রাখা দুরন্ত বাসুদেব যেন স্বয়ং এসে দাঁড়ায় কানাইলালের চোখের সামনে।
ব্রিটিশ মহারাণীর অভিষেকের ডায়মণ্ড জুবিলির বছর সেটা।
মারাঠা-প্রদেশে প্লেগ-দমনের নামে কালেক্টর র্যান্ড-এর মস্তিস্কপ্রসূত, দরিদ্র মানুষের উপর সেই নির্যাতন, কিশোরী-যুবতীদের উপর সেই অভাবনীয় বর্বরতা, কোনো সভ্য দেশের সভ্য সমাজের ইতিহাসে আগে কোনোদিন হয়েছিল কি?
সুসভ্য ব্রিটিশ সিংহের দেওয়া সুপরিকল্পিত যন্ত্রণায় দীর্ণ মহারাষ্ট্রের লজ্জানিবারণ করতে সেদিন এগিয়ে এসেছিল তিনটি তরুণ। মহামাঈর পূজারী দামোদর চাপেকর দেবীপ্রতিমার আসনতলের নিরাপত্তায় মজুত করেছিল আগ্নেয়াস্ত্র। মরণ-অভিসারে সঙ্গী হয়েছিল প্রিয় বন্ধু বিনায়ক রাণাডে; না, নিশানা অভ্যাস করে যায়নি তারা। নিশ্চিত মৃত্যুর মতই ঝাঁপিয়ে পড়ে লক্ষ্যবস্তু র্যান্ড আর লেফটেন্যান্ট আয়ার্স্ট— দুই নরকের কীটের বুকের উপর নল ঠেকিয়ে ট্রিগার টেনেছিল।
দামোদর ধরা পড়ে যায় অচিরেই। মেজ ভাই বালকৃষ্ণ তখন পলাতক। ছোট ভাইটিকে এই আগুন নিয়ে খেলতে না দেওয়ায় সে ছিল বড়দার মতই অঙ্গীকারবদ্ধ। কিন্তু অদৃষ্টের ফের! কার যেন সহযোগিতায় হঠাৎই ধরা পড়ে গেল সে-ও।
সামান্য খোঁজ খবরেই বাসুদেবহরি বার করল মীরজাফরদের পরিচয়। তারপর কারোর সমর্থনের অপেক্ষা না করেই পলাতক রাণাডের সঙ্গে সতেরো বছরের দুঃসাহসী কিশোর সশস্ত্র হাজির হল দুই বিশ্বাসঘাতকের দোরগোড়ায়। দুটি বুলেটে দুই দাদার হয়ে সফল প্রতিশোধ নিয়ে বন্দী হল একসাথে।
বাসুদেব! আজ আমার কাছে কেন?
বিষ্ণুর কণ্ঠেই যেন উদ্ধত জবাব আসে।
No one else is responsible! I did not wait for instructions; I did what my heart said was right! Yes, a traitor must die!
কানাইলালের ভিতর পর্যন্ত কেঁপে ওঠে অন্তরাত্মার এ-হেন স্পষ্ট নির্দেশে। পরিণতি? পরিণতি! কী আশ্চর্য, অপরিণামদর্শী কানাইলাল কি হঠাৎ স্থিতবুদ্ধি হচ্ছে? কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ার আগে বিপদের ভয় কবেই বা করেছেও!
তফাৎ বোধহয় এ-ই, সেদিন পর্যন্ত তার কার্যকলাপ ছিল নেতাদের আজ্ঞাধীন। আজ তার কারোর কাছে কোনো নতি স্বীকারের বন্ধন নেই। এ সিদ্ধান্ত তার একার।
পরিণতি? উত্তর ভেসে আসে এক দশকের ওপার হতে।
Honourable Justice! Please order them to hang me twice! Otherwise how would I know, which murder am I rewarded for?
কিশোর-কণ্ঠে পাঞ্চজন্য বেজে উঠল যেন।
কানাই স্পষ্ট দেখতে পেল, বিচারক, বিচারব্যবস্থা, ইংরেজশাসনের অহমিকাকে এক অট্টহাস্যে ধুলোয় মিশিয়ে দিল এক অষ্টাদশবর্ষীয়।
দর্পহারী বাসুদেব!
মনস্থির করে কানাইলাল। এবার তার পালা।
মামলা শুরু হয়েছে। বৈচিত্র্যের সন্ধান পেয়ে একটা দমকা বাতাস ফের ঢুকে পড়েছে প্রেসিডেন্সী কারা-কন্দরে। বেড়াতে যাওয়ার মত আনন্দে হইহুল্লোড়ে সেপাইদের সঙ্গে ভাব জমিয়ে আদালতে হাজিরা দিতে যায় ছেলেরা। তাদের প্রতি যেন কিছুটা স্নেহই তৈরী হয়েছে উর্দিধারীদের মনেও। জুতো ছাড়া আর কোনো কিছুতেই অতিরিক্ত তল্লাশি বা পাহারা তারা ছেড়েই দিয়েছে।
কোর্টে গিয়ে নর্টনের হাস্যকর সওয়াল ও বার্লির বিচারের প্রহসন দেখে কেউ বা মজা পায়, কেউ বা গভীর মনোযোগ দিয়ে সেই সুযোগে উজ্জ্বল আলোয় বই পড়ে নেয় খানিকটা। রাজযোগ থেকে ইওরোপীয় সাহিত্য--কোনো কিছুই বাদ যায় না।
“টোমার বিস্ওয়াস কী আছে?”
“ডু ইউ রিমেম্বার? প্লী-জ? ইহাদের কারো-কে চিনিতে পারেন?
“সিট ডাউন, ব্যারিস্টার চ্যাটার্জী! উই ওয়্যার গেটিং অন নাইসলি বিফোর ইউ কেম!”
আদালতে কৌঁসুলি আর বিচারকের হাস্যোদ্দীপক যুগলবন্দী জেলে ফিরে নানা অঙ্গভঙ্গী-সহ নকল করে দেখায় উল্লাসকর। সঙ্গে তাঁদের কোটের মাপ থেকে মাথার প্রস্থ-–সবকিছু নিয়েই মনোজ্ঞ আলোচনায় মেতে থাকে বোমার আসামীরা। চশমার ফাঁকে প্রসন্ন কৌতুকে উজ্জ্বল হয়ে থাকে কানাইলালের চোখদুটিও।
জেলর যোগেন ঘোষ অবশ্য তাতে ভোলবার পাত্র নন। বুকানন সাহেব শেষবারের মত জেল পরিদর্শন করে যাওয়ার পরেই শরীরচর্চা করা দামাল ছেলেগুলির উপর কড়া প্রহরার ব্যবস্থা করতে কর্মচারীদের উপর তম্বি শুরু করেন তিনি।
কয়েক মাস পরে ভালোয় ভালোয় পেনশনটা নিয়ে ছুটি পেলে বাঁচি বাবা! রাউন্ডে এসে স্বগতোক্তির ঢঙেই সকলের কর্ণগোচর করে যান যেন!
এরা কখন কী কাণ্ড ঘটিয়ে বসবে, তখন সামলাবে কে? নেতৃস্থানীয়দের উদ্দেশ্যে প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিয়ে শুকনো মুখে প্রস্থান করেন ঘোষমশাই।
সর্দিকাশিতে ভুগতে ভুগতে জুলাই-শেষে আলিপুর জেলে ট্রান্সফার হয়ে আসা হাঁপানির রুগি মেদিনীপুরের সত্যেন ছাড়া অসুস্থতায় কানাইলালের সঙ্গে টক্কর দেওয়ার সামর্থ্য কারও নেই। প্রায়ই হাসপাতালে থাকেন তিনি। নরেন গোঁসাই স্বীকারোক্তিতে তাঁর বংশপরিচয় সহ ক্ষুদিরামের সঙ্গে আত্মিক সংযোগ—সবই প্রকাশ করে দিয়েছে ইতিমধ্যে। নিভৃতে যোগাযোগ হল দুজনের। ফলে দেখা গেল, সত্যেন্দ্রনাথ বসুর অসুস্থতা কিছুটা বেড়েই গেছে পরদিন থেকে।
পরের সুযোগেই ওয়ার্ডারের কান বাঁচিয়ে মতিলাল রায়ের সঙ্গে আবার কথা বলে কানাই।
দুটোই চাই, মতিদা। দুটো।
মতিলাল বলেন, পালাচ্ছ কবে, ঠিক হল? আর এর মধ্যে দিয়ে দু’খানা আমি নিয়েই বা আসি কীভাবে! তার চেয়ে বরং—
কানাই অধীর হয়ে বলে, আমি আর পালাবার কথা বলছি না। তবে বিশ বছর জেল খাটার আগে অন্যভাবে আমি নিজের ছুটি করিয়ে নেব। কেন যে চাইছি সে কথা তুমিও জানো। মিথ্যে সময় নষ্ট করলে ক্ষতির মাত্রা আরও বেড়ে যাবে। সত্যেনদা বলে-কয়ে আইনের একটা ফাঁক বার করেছে। আর দেরি হলে কিন্তু অরবিন্দও...
মতিলালের প্রতিক্রিয়াটা দেখেও যেন না দেখে কানাই বলতে থাকে, চন্দননগরে তোমাদের শ্রীশ ঘোষকে জানাও। সার্জেন্টরা আমাদের বেশ ভরসা করে, বইপত্র আর-যা-কিছু চোখের সামনে দিয়ে আনি, এখন আর তল্লাশ করে না। শ্রীশ ঠিক খাবারের মধ্যে দিয়ে পাঠিয়ে দেবে। ও-ই পারবে। আর দেরি কোরো না!
মতিলাল পিছিয়ে আসেন। এ অসম্ভব!
তুমি শিরেকে বোলো মতিদা। কানু তার কাছে শেষবারের মত দুটো উপহার চেয়েছে।
কানাইলালের দু’চোখে তখন আগুন জ্বলছে।
।।সাত।।
বিকেলের দিকে সত্যেনের হাঁপানির টানটা আবার হঠাৎ করে বেড়ে যাওয়ায় আশঙ্কিত হয়ে পড়েন সেলের সঙ্গী শৈলেন্দ্র বক্সী। অ্যাসিস্ট্যান্ট ডাক্তার বৈদ্যনাথ চ্যাটার্জী জরুরি ডাকে এসে পরীক্ষা করে বলেন,হাসপাতালে যাওয়ার ছাড়পত্র দিতে তিনি রাজি আছেন।
দরকার নেই! কষ্ট করেই কথাগুলো উচ্চারণ করেন সত্যেন্দ্র।অরবিন্দর নিষেধ। এই অবস্থায় ইংরেজের কোনো দাক্ষিণ্য আমরা নেব না!
শৈলেন আকাশ থেকে পড়েন। চ্যাটার্জীর ঊর্ধ্বতন ডক্টর ডেলী আইরিশম্যান। শক্তসমর্থ দুরন্ত ছেলেগুলির প্রতি কিছু বিরূপ হলেও, হাসপাতালে তাঁর রোগীদের যথেষ্ট সহৃদয়তার সঙ্গেই চিকিৎসা করে থাকেন, একথা সর্বজনবিদিত। হাসপাতালের আরাম নিতে গররাজি হয়ে অরবিন্দ সম্পূর্ণ সুস্থ হওয়ার আগেই সেলে ফিরে এসেছেন, এ-ও তাঁর জানা। কিন্তু এই কয়দিনে সকলের থেকে প্রায় আলাদা হয়ে যাওয়া ধ্যানমগ্ন মানুষটি কখন এমন নির্দেশিকা জারি করলেন, বুঝে উঠতে না পেরে জমায়েত সঙ্গীসাথীদের দিকে তাকান।
উপেন বন্দ্যোপাধ্যায় এগিয়ে আসেন। ‘ইতি গজ’র মত নিম্নস্বরে জানান, সে-রকমই একটা কথা হয়েছিল বটে। এখন সত্যেন যদি যেতে না চায়...
এর মানে কী? সংযুক্ত সেলে ঢোকার মুখেই এহেন উক্তি শুনে জেলর যোগেনবাবু ধমকে ওঠেন। আমার আন্ডারে বিনা চিকিৎসায় প্রিজনার মরবে? তা হলেই আমার পেনশনটি ষোলোকলা মাটি করার ব্যবস্থা পাকা হয় আর-কি! ও-সব চলবে না। ডাক্তারবাবু, আপনি একে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসার ব্যবস্থা করুন। যা হোক করে আমায় এই ঝামেলা থেকে নিষ্কৃতি দিন তো।
হৃষিকেশ কোথা থেকে এসে খবর দেয়, ও দিকে কানাইয়ের ভয়ানক পেটে ব্যথা। আমি এখানকার খোঁজ দিতে গিয়ে দেখি মেঝেতে পড়ে ছটফট করছে।
সে-ও হাসপাতালের যত্নআত্তি চায় নাকি? বাঁকা সুরে দরজার পাশ থেকে মন্তব্য ছুঁড়ে দেন হেমচন্দ্র।
নিয়ে যাও, নিয়ে যাও ওকেও। বিরক্ত যোগেন ঘোষ হাত নেড়ে নির্দেশ দিয়ে অবশিষ্ট চাকুরিজীবন ও পেনশনবিধির মুণ্ডপাত করতে করতে দ্রুতপদে বেরিয়ে যান।
কানাইয়ের আজ জন্মদিন— ঘরের বাকি সকলের কাছে একটা সাফাই গাওয়ার মত বলে হৃষিকেশ, সকালবেলা বাক্স ভরে অনেক কিছু দিয়ে গেছে, তাই খেয়েই হয়তো...
কথাটা সত্যি। ইংরিজি মতে তার এককুড়ি পূর্ণ হয়েছে সবে সেইদিন।
বাক্স থেকে অসবর্ন ৩৫০টা বিকেলেই বার করে সত্যেনের জিম্মায় দিয়ে রেখেছিল। এখন নরেন বাঁড়ুজ্জেদার পাঠানো আর.আই.সি. ৪৫০ বোরের জন্মদিনের উপহারটা নিজের কম্বলের তলায় সাবধানে লুকিয়ে হসপিটাল যাত্রা করল কানাইলাল।
হাসপাতালে ভর্তি হয়েই সত্যেনের স্বাস্থ্যের কিছু উন্নতি দেখা গেল। এবং এই অপরিসীম শারীরিক কষ্ট যাতে পুনরায় সহ্য করতে না হয়, তার জন্য নরেন গোঁসাইয়ের সঙ্গে আলোচনা করে রাজসাক্ষী হওয়াটাই রাতারাতি স্থির সাব্যস্ত করে ফেললেন তিনি। দুজনে মিলে যুক্তি করে এজাহার দিলে সাক্ষ্য জোরদার হবে, আর নরেনের বক্তব্যের অসংলগ্ন দিকগুলোও শুধরে যাবে সেইসঙ্গে।
সন্দেহের কোনো অবকাশই নেই। বিপ্লবী দলের সঙ্গে সত্যেনের সংযোগ ইতিমধ্যেই প্রমাণ হয়ে গেছে; এ অবস্থায় গোঁসাইয়ের মহাজন-পন্থাটি নেওয়াই তাঁর পক্ষে বুদ্ধিমানের কাজ হবে।
একত্রিশে অগস্ট, সকালবেলাই পাকাপাকি সাক্ষ্যের বয়ান ঠিক করার জন্য নরেনের সাক্ষাৎপ্রার্থী হলেন সত্যেন্দ্র।
ইওরোপীয়ান ওয়ার্ড থেকে নরেন গোঁসাই বেরিয়ে আসছে খোশ্মেজাজে। দোতলার বারান্দা থেকে দেখলেন সত্যেন, গোঁসাই আজ একা নয়। সতর্ক ওয়ার্ডারটি হিগিন্স আর লিন্টন নামে দুই বিশালবপু ইংরেজ কনভিক্টকে তার সঙ্গে সঙ্গে পাঠিয়ে দিয়েছে।
র্যাপার মুড়ি দিয়ে কানাইলাল বেরিয়ে এসেছে সামনের খোলা চত্বরটায়। প্রমাদ গোণেন সত্যেন। মোটা কালো চাদরটার নীচে ডান হাত ঢুকিয়ে দেন। যে কোনো মুহূর্তে—
না। কানাই কোনো কাঁচা কাজ করেনি। লিন্টন কিছু দূরে দাঁড়িয়ে পড়ে তার সাথে সৌজন্য বিনিময় করলে। হিগিন্সকে পাশে নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠে আসছে নরেন গোঁসাই। সিঁড়ির মুখেই তাকে আটকান সত্যেন্দ্র। হিগিন্সকে হাসিমুখে সম্ভাষণ করে বলেন,কথা বলতে বলতে একটু হেঁটে আসা যাক!
গোঁসাইকে উসকে দিয়ে এগিয়ে যান সত্যেন। পিছু পিছু আসছে নরেন, তাঁর মতিবুদ্ধির প্রশংসা করতে করতে। দেহরক্ষী দুটিও কিঞ্চিৎ অন্যমনস্ক হয়েছে। সত্যেন স্বাভাবিকভাবেই তার কথার জবাব দিতে দিতে হাঁটতে থাকেন উঠোনের মাঝখান লক্ষ্য করে।
মুখ তুলে হঠাৎই নরেনের নজর পড়ে কানাইলালের দিকে। আপাত-অন্যমনে তারই দিকে ক্ষিপ্রপদে এগিয়ে আসছে কি ও? সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে সত্যেনের দিকে চায় সে।
সত্যেন কাষ্ঠ হেসে বলেন, হয়তো ও-ও আমাদের মতো...
কথাটা শেষ হয় না। ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের অশনিসংকেতেই সত্যেনকে ধাক্কা দিয়ে একটা চিৎকার করে প্রাণভয়ে ছুটতে শুরু করে নরেন গোঁসাই। কোনোমতে টাল সামলে নিয়ে চাদরের তলা থেকেই সত্যেন্দ্রনাথ ফায়ার করেন। পলাতক দেহটা হোঁচট খেয়েও ছুটতে থাকে ইওরোপীয়ান ওয়ার্ডের সংযোগস্থল লক্ষ্য করে।
তার পিছনে এসে সত্যেনের পথরোধ করে দাঁড়ায় হিগিন্স। কিন্তু সে কয়েক মুহূর্তের জন্যই। কানাইলালের প্রথম বুলেট তখন তার হাতের পাঞ্জায় নির্ভুল নিশানায় গিয়ে বিঁধে গেছে।
ঘটনার আকস্মিকতায় লিন্টন কিছুটা হতচকিত হয়ে পড়েছিল। সাফল্যে স্থিরপ্রতিজ্ঞ কানাই প্রবল আক্রোশে ছুটতে শুরু করেছে ততক্ষণে। দ্বার-সংযোগস্থলের প্রহরীকে এক ধাক্কায় ছিটকে ফেলে সাক্ষাৎ মৃত্যুর মত গোঁসাইয়ের পিছু ধাওয়া করে সে।
গুলির শব্দ শুনে বেরিয়ে আসা জেলর একটা বেঞ্চের তলায় আত্মগোপন করেছেন সেই মারমূর্তি-দর্শনমাত্র। অ্যাসিস্ট্যান্ট জেলর, সুপারইনটেন্ডেন্ট এমারসনের চিৎকারে ভ্রূক্ষেপ না করে ছুটতে ছুটতে আরেকবার ট্রিগার চাপে কানাই। লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়।
য়ু ডিডন্ট ইভন এইম, মাই বয়!
লিন্টন পাগলা ষাঁড়ের মত ছুটে আসছে পিছন থেকে। মিশন ফার্স্ট! লক্ষ্যে মনঃসংযোগ করে কানাই। পরের গুলির আওয়াজটার সঙ্গে হুমড়ি খেয়ে পড়া নরেনের আর্তনাদ মিশে যায়।
পিছন থেকে লিন্টন জাপটে ধরে মাটিতে ফেলে দেয় কানাইকে। তার পুরু চশমা ছিটকে পড়েছে চোখ থেকে। নরেন উঠে পড়েছে। আতঙ্কে ভর করেই অমানুষিক শক্তিতে উঠে দাঁড়িয়ে টলতে টলতে সে বেরিয়ে যাচ্ছে রিভলভারের সীমার বাইরে। কানাইয়ের দৃষ্টি আবছা হয়ে গেছে।
বাট নেভার সে “হবে না!”
তার ঝাপসা দৃষ্টিও বলে দেয়, লক্ষ্যভেদ এ বার অব্যর্থ।
নিঃশেষে লুটিয়ে পড়া চেহারাটার দিকে চেয়ে একটা লম্বা শ্বাস নেয় সে। লিন্টনের বাহুবেষ্টনী তখন তাকে দ্বিগুণ আকর্ষণে মাটিতে মিশিয়ে দিয়েছে।
বিনা প্রতিবাদে খালি পিস্তলটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে আত্মসমর্পণ করে কানাইলাল দত্ত।
।।আট।।
কনডেমড সেলে গীতা আর কর্মযোগটা নিয়ে এলেও, চশমা ফেরত পেতে কিঞ্চিৎ পরিশ্রম করতে হয় তাকে। ওটার অভাবে সেদিন দেখা করতে আসা বড়দা আর মতিদাকেও সে প্রথমটায় চিনতে পারেনি।
মা জানেন? দাদাকে জিজ্ঞেস করেছিল সে। ওয়ার্ডারদের অনুনয় বিনয় করে সরিয়ে দাদা আশুতোষ দত্ত তখন গরাদের ফাঁক দিয়ে তার ডান হাতটা দুই হাতে সবলে আঁকড়ে ধরে রেখেছেন।
ব্রজেশ্বরী দেবীর কথা দ্বিতীয়বার জিজ্ঞেস করতে গ্লানিবোধ হয় তার। বাড়ি ছাড়ার আগে তাঁকে “চাকরী করতে যাচ্ছি” বলে আসার সজ্ঞান মিথ্যাভাষণটা পীড়া দিচ্ছে এখনও।
মতিদা এগিয়ে এসে বলেন, মামলার খবর শ্রীশই একদিন জানাতে গিয়েছিল। সে বললে, গোঁসাইয়ের কথা শুনে মাসিমা রাগে কাঁপতে কাঁপতে বলছিলেন, মরণ হয় না ওর? কেউ নেই ওকে জন্মের মত চুপ করিয়ে দেয়?
মায়ের ইচ্ছা! কপালে যুক্তকর ঠেকায় কানাইলাল। বুক থেকে একটা ভার নেমে যায় যেন।
মতিলাল গলা নামিয়ে বলেন, একটা কথা বলবে ভাই? পিস্তলের একটা গুলিও নিজের জন্য রাখলে না কেন?
ফাঁসির আসামী হো-হো করে হেসে ওঠে। চিরাচরিত সেই অট্টহাস্যে কেমন যেন বিমূঢ় হয়ে পড়েন গরাদের এপারের মানুষদুটি।
কানাই হাসতে হাসতে বলে, ব্যাটা যদি বেঁচে উঠত কোনোমতে? মিশন আগে, না এসকেপ?
এবারও কোনো জবাব দিতে পারেন না মতিলাল।
জেরা থেকে অবশ্য সহজে রেহাই দিতে চাননি অফিসাররা।
কার আদেশে? মিস্টার ঘোষ? জুনিয়র ঘোষ? অরবিন্দ? অরবিন্দ?
কানাই বেশ উপভোগ করে ব্যাপারটা। সে জানে, গোঁসাইয়ের জবানবন্দী প্রত্যয়িত হলে শ্রীঅরবিন্দকে ফাঁসানোর জন্য এতদিনের প্রাণান্তকর চেষ্টায় কৃতকার্য হয়ে যেত পুলিশ তথা সরকার। কৌঁসুলি নর্টনের জীবনের লক্ষ্য-মোক্ষ এক হত। ওই ক্রস-একজামিনেশনের পথ নিজের হাতেই রুদ্ধ করেছে সত্যেনদা আর সে!
আমার বিবেকের আদেশ! ঠোঁটের কোণে আলগা হাসি ফোটে তার। মনে পড়ে, বাসুদেব চাপেকরও এমনটাই বলেছিল।
মৌখিক জেরার পরিসর টপকে যায় অচিরেই।
পিস্তল কে দিয়েছে? কোথা থেকে পেলে?দুটো পিস্তলই একই সঙ্গে এসেছে? আমরা খুঁজে তো বার করবই। মিথ্যে নিজের শরীরকে কষ্টটা না-ই বা দিলে?
মারের মুখে বুক চিতিয়ে উঠে দাঁড়ানোর শিক্ষা তো সে কৈশোরেই পেয়েছে। বিচলিত হয় না সফলকাম বন্দী। প্রস্তুত হয় পরবর্তী আঘাতের জন্য।
কে দিয়েছে রিভলভার?
মুখের হাসি অটুট রেখে কানাইলাল তার পুরোনো জবাবের পুনরাবৃত্তি করে।
ক্ষুদিরামের প্রেতাত্মা!
আদালতে বিচার-পর্ব শেষ হতে লাগে মাত্র দু’দিন। বিশ্বাসহন্তার শাস্তি মৃত্যু—এ ছাড়া আর কোনও কথা বলে না কানাই। কেবল সত্যেন্দ্রের প্রসঙ্গ উঠতে জানিয়ে দেয়— হি ওয়জ প্রেজেন্ট, বাট নট ইনভলভড। বলা বাহুল্য তা সত্ত্বেও দুজনেরই ফাঁসির হুকুম দিতে পিছপা হননি মহামান্য আদালত।
গোঁসাইয়ের সুষুম্নাকাণ্ড ভেদ করে কানাইলালের গুলি প্রবেশ করার অনেকদিন আগেই দাদা আশুতোষ তাকে জামিনে ছাড়াবার চেষ্টা করতে এসেছিলেন। কানাই দৃঢস্বরে সেদিন তাঁকে বলেছিল, সহকর্মীদের ফেলে কোনো অতিরিক্ত সুবিধা সে নেবে না।
প্রাণদণ্ডাজ্ঞা প্রাপ্ত আসামীর জন্য ঊর্ধ্বতন আদালতে আবেদন করার প্রথা আছে। সত্যেন্দ্রনাথের আবেদন হয়ে গেছে। এবার কানাইলালের পালা। ডক্টর আশুতোষ দত্ত উঠে দাঁড়ান।
নো অ্যাপীল!
কাঠগড়া থেকে দৃঢ়কণ্ঠে ভেসে আসা দুটি অশ্রুতপূর্ব শব্দে নিস্তব্ধ হয়ে যায় সমগ্র আদালত।
কানাইলাল প্রতিটা কথা স্পষ্ট করে উচ্চারণ করে আবার।
There SHALL be no appeal!
দাবানলের মত ছড়িয়ে পড়ল খবরটা। মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত আসামী বিচারব্যবস্থা নামক প্রহসনের সাহায্য নিতে অস্বীকার করেছে!
পাথর হয়ে গেল সারা শহর। ইংরেজের দুর্ভেদ্য প্রাসাদের মধ্যে দেশদ্রোহীকে শাস্তি দিয়ে সদর্পে ফাঁসির দড়িটা গলায় টেনে নিচ্ছে যে কুড়ি বছরের ছেলেটা, সে কি সত্যই তাদের মতই মানুষ?
অরবিন্দের ‘শিখাময়ী’ ভগিনী নিবেদিতা চিঠিতে লিখলেন বন্ধু-দম্পতিকে — সাক্ষাৎ গীতা-মূর্তি দর্শন হয়েছে তাঁর। মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে তরুণ কৃষ্ণ-কণ্ঠে প্রশ্ন উঠেছে, কে-ই বা হন্তা, কে-ই বা হত? আবেগে রুদ্ধ হয়ে আসে তাঁর কলমখানি।
আরও একটি মানুষ ছাত্রসমীপে সংবাদটা পেলেন। তিনি প্রফুল্লচন্দ্র রায়। বিপ্লবীদের পূর্ণ সহমর্মী, তাদের কর্মকাণ্ডে চিরকালের সহায়ক বিজ্ঞানাচার্যের মুখে কিন্তু কোনো বিস্ময়ের অভিব্যক্তি ফুটল না। হাসতে হাসতে তিনি ছাত্রদের উদ্দেশ্যে বললেন, “শ্যাল” আর “উইল” ব্যবহারের তফাৎটা ওই ছোঁড়া শিখিয়ে দিয়ে গেল হে!
জেলের মধ্যে ব্রাহ্ম সত্যেনকে আশীর্বাদ করতে এসেছিলেন আচার্য শিবনাথ শাস্ত্রী। সাক্ষাৎ-অন্তে অনুরোধ করে সহচর ভদ্রলোক বললেন, কানাইকেও একটিবার —
কথাটা শেষ করতে দেন না বৃদ্ধ। সরাসরি প্রত্যাখ্যান করে বলেন, না!
সহচর থমকে দাঁড়ায়। প্রবীণ মানুষটি মাথা নেড়ে বলেন, ওই পিঞ্জরাবদ্ধ সিংহটিকে আশীর্বাদের যোগ্যতা অর্জন করতে হলে আমায় আরও বহু জন্ম তপস্যা করতে হবে। সে পুণ্যফল আমার আয়ত্তের বাইরে এখনও!
।।নয়।।
ছেলেটার হাসিভরা মুখ, অখণ্ড মনোযোগে নিবিড় অধ্যয়ন, নজর এড়ায় না ওয়ার্ডার ইথান প্রাইসের। বিরক্ত হয় সে। কনডেমড সেলের আসামীর দিনে-দিনে চেহারার জ্যোতি বেড়ে যাওয়ার লক্ষণটা তার কাছে বেমানান ঠেকে খুব। সেদিন খুনটা করার পর সবাই মিলে ঘিরে ধরে মেরে অজ্ঞান করে দিয়েছিল ছেলেটাকে। ম্যালেরিয়ার রোগী; প্রবল জ্বর উঠে গিয়েছিল দেখে ডাক্তার ডেলী কুইনাইনের বন্দোবস্ত করেছিলেন। ওই অবস্থাতেও ডাক্তারকে প্রত্যাখ্যান তো করলই, সেবার সেরে ওঠার পর থেকে জন্মের মত রোগ-বালাই যেন ঘুচেও গেল তার।
গুড মর্নিং, মিস্টার প্রাইস!
রুটিন চেক-আপে ওজন মাপতে যাওয়ার সময় দুদিন পরে মরতে যাওয়া ছোকরার এহেন সাধুসন্তের মত অমায়িক ভাবভঙ্গিটা পছন্দ হয় না ইথানের। ঠান্ডা মাথায় নরহত্যাকারীর আবার...
নতুন পরিমাপ দেখে ততক্ষণে চক্ষুস্থির তার। রায় বেরোনোর আগের চেয়ে আসামী কানাইলাল দত্তের ওজন ষোলো পাউন্ডের কিছু বেশি বেড়ে গেছে।
আই মাস্ট সে, আই হ্যাভ নেভার বীন বেটার! হা-হা করে হেসে ওঠে ছেলেটা।
সেই অট্টহাস্য দেখে ব্রহ্মাণ্ড জ্বলে যায় যেন তার। গলায় একটা অবহেলার সুর ফুটিয়ে ইথান বলল, ডু য়ু রিঅ্যালাইজ য়ু আর গোঈং টু বি হ্যাঙ্গড টিল ডেথ, থ্রী ডেইজ লেটার?
আশ্চর্য, অদ্ভুত হাসিটা সংযত করতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে ওকে! কোনোমতে সামলে নিয়ে বলে, দ্যাট মাস্ট বী একজ্যাক্টলি হোয়াই দিস ইজ হ্যাপেনিং!
আর সহ্য করা চলে না! অ্যাবাউট টার্ন করে চলে যাওয়ার সময় দাঁতে দাঁত ঘষে ইথান বলে, দেখে নেব ফাঁসির সময় তোমার এই হাসিমুখ কোথায় থাকে!
মতিলাল রায় দেখা করতে এসেছিলেন আবারও। কানাই তাঁর কাছে আবদার করে বসে, আমার শ্মশানযাত্রাটা বেশ জমজমাট করে দিও তো মতিদা!
সে প্রার্থনায় মৃত্যুপথযাত্রীর কারুণ্য কই! কানাইলালের উৎসাহদীপ্ত চোখদুটি যেন শিশুর মত উৎসব-আড়ম্বরের পরিকল্পনায় উন্মুখ হয়ে আছে। মতিলাল মুখে হাসি ফুটিয়ে আশ্বাস দেন, তাই হবে। নয়ই নভেম্বর অর্থাৎ ফাঁসির আগের দিন সন্ধ্যাবেলায় তিনি কলকাতায় থাকার জন্য বাসাবাড়ির ব্যবস্থা করে রেখেছেন তাঁর ও আশুতোষের জন্য।
জীবনে বহু শেষযাত্রায় সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছেন তিনি। কিন্তু তরতাজা এক যুবকের এহেন নিশ্চিত অকালমৃত্যুর পরবর্তী বন্দোবস্ত করতে ভিতরটা যেন কেঁপে ওঠে অজান্তেই।
দশই নভেম্বর ভোর সাড়ে চারটেয় আলিপুর জেলের প্রধান দ্বার দিয়ে পুলিশ কমিশনারের গাড়িটা ঢুকে আসে। পিছন-পিছন দ্বার বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর কিছুটা দূরে আর একটা পরিচিত চেহারা দেখতে পেয়ে কিছুটা অবাকই হন হ্যালিডে। গ্রীষ্মকাল হলে তাঁর এই পুলিস সুপার এ-সময় ময়দানে ঘোড়া ছুটিয়ে বেড়ায় প্রতিদিন। নভেম্বরের শীতেও সূর্য ওঠার পর তার প্রাতর্ভ্রমণের রুটিনে বেচাল হয় না সচরাচর। মাইক?
প্রায়ান্ধকার জেলচত্বরেও তাঁর মুখের রেখায় প্রশ্নচিহ্নটা খুবই স্পষ্ট করে পড়তে পেরেছে বোধহয় ও। এগিয়ে এসে বলে, মে আই সাজেস্ট য়ু সামথিং, সার?
গো অ্যাহেড! কৌতূহলী হন তিনি।
মাইক সংক্ষেপে তাঁকে পরিস্থিতিটা বুঝিয়ে বলে। বলে দেয়, মৃতদেহকে যথাসাধ্য গোপনে আর যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দাহ করে ফেলার চেষ্টা করতে। একটা সামান্য খুনীর ফাঁসির জন্য এত আয়োজন একটু বাড়াবাড়িই মনে হয় তাঁর, যদিও বক্তার নাম চার্লস টেগার্ট বলেই তিনি ব্যাপারটা উড়িয়ে দেন না। সম্মতি জানাতেই ঘাড় ঝুঁকিয়ে ‘হ্যাভ আ গুড-ডে, সার’ বলে অনাবশ্যক তাড়াহুড়োয় পাশের গেট দিয়ে প্রস্থান করে সে।
সেলের মধ্যে জোরালো আলো ফেলেছে হ্যালিডের পাশের জেলকর্মচারী। সেই আলোয় ঠোঁটে পাতলা হাসি লেগে থাকা ঘুমন্ত ছেলেটিকে দেখে হাতঘড়ির দিকে একবার তাকিয়ে নেন ফ্রেডরিক হ্যালিডে।
বোধ হয় কোন একটা সুখস্বপ্নের জগৎ থেকে উঠে আসে কানাইলাল। চশমা হাতড়ে নিয়ে সরাসরি কমিশনারের দিকে তাকিয়েই শুধোয়, মর্নিং! শ্যাল উই গো রাইট নাউ?
য়ু হ্যাভ হাফ অ্যান আওয়ার টু গেট ইওরসেলফ রেডি! উত্তরের অপেক্ষা না করেই সরে আসেন হ্যালিডে। ফাঁসিমঞ্চের দিকে হাঁটা দেন। প্রস্তুত তাঁরই বোধহয় আগে হওয়ার দরকার।
নো নো, ডোন্ট ব্ল্যাকেন মাই ফেস, প্লীজ!
ফাঁসির মঞ্চে উঠে আসতে আসতে মাথা থেকে গলা পর্যন্ত ঢাকবার কালো কাপড় হাতে ধরে রাখা লোকটির দিকে চেয়ে অনুরোধের সঙ্গে একটা ভুবনভোলানো হাসি ছুঁড়ে দেয় কানাইলাল দত্ত। সদ্য স্নান সেরে এসে তাকে আরও নির্মল, আরও উজ্জ্বল দেখাচ্ছে কি? নিজের চিন্তাকেই শুধরে নেন হ্যালিডে, আহ্, এতক্ষণে সূর্যের আলোও ফুটছে তো!
মঞ্চের পিছনে দাঁড়িয়ে এ-হেন শেষ অনুরোধ শুনে কিছুটা বিব্রতই হয় ইথান প্রাইস। নাতিদীর্ঘ কর্মজীবনে এর আগে যে ফাঁসি দেখেনি সে, তেমনটা নয়। তবে এবারকার সবকিছুই যেন নতুন ঠেকছে, তার একটা প্রমাণ সে অনুভব করছে নিজের স্নায়ুতে।
হ্যালিডে ইঙ্গিত করেন, আসামীর ইচ্ছাকে মান্যতা দেওয়ার।
ফাঁসুড়ে তার হাতের দড়িটা মুখ-না-ঢাকা কানাইলালের গলায় দিতে এগিয়ে আসে।
ইট ডাজন্ট ফীল রাইট!
হ্যালিডে চমকে তাকান। ম্যানিলা রজ্জুটা কেমন করে যেন মাথা দিয়ে ঠিকঠাক গলানো হয়নি। সহাস্য আসামী ডান হাতের দুই আঙুলে সেটাকেই ঠিক করে নিজের গলায় পরে নিচ্ছে এবার!
মিস্টার প্রাইস, য়ু দেয়ার?
পরিচিত হাসির সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্নটা ভেসে আসতে মাথা আর সোজা রাখতে পারে না ইথান।
য়ু ওয়ন্টেড টু সী মি, রাইট? হাউ ডু আই লুক নাউ?
লিভার টানার চেনা শব্দটা ফুরিয়ে যাওয়া পর্যন্ত ইথান প্রাইস এক মনে ভাববার চেষ্টা করছিল, ওই কালো কাপড়টা দিয়ে তারই মাথা-মুখ ঢেকে দেওয়া হল না কেন!
হুইচ ওয়ান অফ দেম ইজ ডক্টর দত্ত?
হ্যালিডের প্রশ্নটায় সাড়া দেওয়ার অবস্থায় ছিলেন না আশুতোষ। প্রয়োজনও ছিল না। ভাইয়ের মৃতদেহের কপাল থেকে চুল সরিয়ে মুখ দেখতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েছেন তখন তিনি।
পাশে দাঁড়ানো অবিচলমূর্তি মতিলাল রায়ের দিকে চেয়ে রুক্ষস্বরে কমিশনার বললেন, মুখের ঢাকা সরাবেন না। এই অবস্থায় পিছনের দরজা দিয়ে বার করে নিয়ে যান।
মতিলাল বুঝলেন। ভোর সাড়ে পাঁচটায় প্রেসিডেন্সী জেলের সদর দরজায় কয়েকশো কমবয়সী ছেলের আনাগোনা তিনি নিজের চোখে দেখেই ঢুকেছেন।
কিন্তু কানাইলালের শেষ খেয়াল! মনে পড়তেই কঠিন স্বরে মতিলাল বললেন, দুঃখিত। মৃতদেহের উপর আপনার অন্যায় জুলুম চলতে দেওয়া হবে না।
দিস্ ইজ নট ইওর চন্দননগর, মিস্টার— হোয়াটস ইওর নেম? পার্শ্বচরকে হ্যালিডে বললেন নামটা লিখে নিতে।
মতিলাল কয়েক পা এগিয়ে এসে বললেন, অ্যারেস্ট মি ইফ য়ু ওয়ন্ট! কিন্তু কানাইলাল সামনের দরজা দিয়েই তার শেষযাত্রায় যাবে।
ফ্রেডরিক হ্যালিডে তখনই কিছু একটা আদেশ করতে যাচ্ছিলেন, পিছন থেকে আশুতোষ এসে মতিলালের হাত ধরলেন।
ঝামেলা বাড়িয়ে লাভ নেই ভাই! এখান থেকে অন্ততঃ —
ফের গলা বুজে আসায় কথাটা তাঁর শেষ হল না। মতিলাল ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে এগিয়ে গেলেন কানাইলালের শায়িত দেহ অভিমুখে।
হ্যালিডে উপস্থিত চারজন ওয়ার্ডারকে আদেশ দেন, শেষ পর্যন্ত সব ব্যবস্থা সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করা নিশ্চিত করতে। তারপর প্রধান দ্বারের দিকে দ্রুত পায়ে ফিরে যান তিনি। টেগার্টের সতর্কবার্তা মাথায় রেখে।
ইথান প্রাইস এগিয়ে এসে আশুতোষের কাঁধে হাত রাখে। রুদ্ধকণ্ঠে বলে, প্লিজ ডোন্ট উইপ, ডক্টর! ইওর ব্রাদার ডায়েড আ ব্রেভ ম্যান!
উইথ আ স্মাইল-টুকু যোগ করার আগেই চোখ দিয়ে অবাধ্য অশ্রু ঝরে পড়ে তারও। ইথান আজ নিজেকেই ঠিক যেন চিনতে পারছে না।
আদিগঙ্গার খাল আর আবর্জনাকে দুপাশে রেখেই ওয়ার্ডার আর মতিলালের কাঁধে কানাইলালের আবৃত শরীর আলিপুর জেল চত্বর নীরবে পেরিয়ে গেল।
না, ঠিক নীরবে নয়। মূল পথের বাঁকে এসেই থমকে দাঁড়ান ওঁরা। পথ রুদ্ধ। সামনে জনস্রোত। শত-শত নয়। সহস্রাধিক মানুষের ভিড়!
“বন্দে মাতরম্!”
প্রেসিডেন্সী কারাগারের ভিত পর্যন্ত যেন কেঁপে উঠল সেই চিৎকারে।
মতিলাল কিছু বোঝার আগেই দেখলেন, একদল যুবক তাঁদের ভাইয়ের মৃতদেহ কাঁধে তুলে নিয়েছে। এগিয়ে যাচ্ছে তারা ভিড়ের মধ্যে। ঘন-ঘন শঙ্খধ্বনি। দুধারের বারান্দা থেকে মহিলাদের লাজবর্ষণ। বিহ্বল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন তিনি।
ইথান তাঁদের হাত ধরে সামনে টেনে নিয়ে যায়। কিন্তু যাওয়ার জায়গা কই! পথ জুড়ে হাজার হাজার মানুষ দুধার থেকে হাত বাড়িয়ে শবদেহ ছুঁতে চাইছে! পায়ে চুম্বন করছে উন্মাদের মত! অন্তঃপুরচারিণীরা ভিড়ের মধ্যে নেমে তার কাছে আশীর্বাদ চাইছে; তার মত পুত্রের আকাঙ্ক্ষায়! মুখ আচ্ছাদনের কাপড় কোথায় হারিয়ে গেছে — কোঁচানো নতুন ধুতি-চাদরের উপর কানাইলালের মরদেহ আবরণ করে এখন শুধু আপামর জনতার অজস্র শেষ উপহার—ফুল-চন্দন আর তার প্রিয় গীতা!
আশুতোষ হোঁচট খেয়ে পড়েন এক বৃদ্ধের গায়ের উপর। তিলমাত্র ভ্রূক্ষেপ না করে বৃদ্ধ তাঁকে জড়িয়ে ধরে দূরে সরে যাওয়া মহাশবের দিকে আঙুল দেখান।
নারায়ণ! সাক্ষাৎ নারায়ণ চললেন যে! তোমরা দেখেছ?
সমবেত শঙ্খনাদ আর হুলুধ্বনি ছাপিয়ে ওয়ার্ডাররা প্রাণপণ চিৎকার করে জানাতে থাকে —কানাইলাল দত্তের পরিবারকে যেতে দিন!
হয়তো সেই নাম উচ্চারণেই মন্ত্রের মত কাজ হয়। স্বেচ্ছাসেবক তরুণরা পথ করে দেয়। রাজ-অভিষেকের মর্যাদায় কানাইলালের দেহের অনুগমন করেন হতবুদ্ধি কয়েকটি মানুষ।
কালীঘাটের শ্মশানে পৌঁছে পূর্বনির্ধারিত ব্যবস্থার কিছুই খুঁজে পেলেন না ওঁরা। কারা যে কখন এসে প্রশস্ত চুল্লি কেটে রেখে গেছে নতুন করে, বুঝতে পারেন না।
একটা ঘোরের মধ্য থেকে মতিলাল শুধু বুঝতে পারলেন, কারা যেন তাঁকে কিছু বলতে অনুরোধ করছে। তারা কানাইলালের কথা শুনতে চায়। কী বলবেন মতিলাল? যেন সম্মোহিত হয়ে উঠে দাঁড়ান তিনি।
মতিলাল এগিয়ে যান। জনতাকে উদ্দেশ্য করে হৃদয় উজাড় করে দেন তিনি, কোন অদৃশ্য শক্তির প্ররোচনায়!
মন্ত্রমুগ্ধ জনতা কি তাঁকে বুঝেছে? বৃথা এ চিন্তা - লক্ষ ভাইয়ের নীরবতার মধ্যে চিৎকার করে আর-এক ভাইয়ের কথা তিনি কী বলে গেলেন, তা কি তিনি নিজেই বুঝেছেন? এত আগুন তাঁর কণ্ঠে ছিল, অনুভব করেছেন কি আগে কখনও?
চিতা জ্বলে ওঠে। জয়ধ্বনি ওঠে কানাইলালের নামে।
হরিধ্বনি মিলিয়ে যায় কোথায়। কেবল অযুত কণ্ঠে মুহুর্মুহু চিৎকার ওঠে “বন্দে মাতরম্!”
আদিগঙ্গায় বিসর্জন দেওয়ার জন্য একমুঠো অস্থির প্রয়োজন হবে আশুতোষ আর মতিলালের। সেটুকুও সংগ্রহ করতে পারলেন না তাঁরা। কারণ তাঁদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে—উন্মত্ত জনতা তখনও ভারে-ভারে চন্দনকাঠ এনে ফেলছে। তার উপরে ঢেলে দিচ্ছে ঘি।
মধ্যাহ্ন পেরিয়ে সূর্য হয়েছে অস্তাচলগামী। সে চিতার আগুন নিভতে তখনও অনেক, অনেক দেরী।
একদৃষ্টে সেই আগুনের দিকে চেয়ে বসে ছিলেন আশুতোষ দত্ত। ইথান প্রাইস দাঁড়িয়ে ছিল পাশে।
মতিলাল ধীরে ধীরে এসে দাঁড়ান সেখানে।
মিস্টার রায়?
ইথানের ভেজা গলার ডাকটা শুনেও আর শোনেন না তিনি।
হাউ মেনি মোর ডু য়ু হ্যাভ লাইক হিম?
।।দশ।।
শেষ সংবাদদাতাকে বিদায় করে এসে দুই হাতে কপালের রগ টিপে মাথা নিচু করে বসেছেন ফ্রেডরিক হ্যালিডে। রাত পোহালেই তাঁকে ফের চড়িয়ে নিতে হবে কমিশনারের দাম্ভিক আবরণীটুকু। অথচ ভিতর থেকে কিছু যেন ভীষণ দুর্বল হয়ে গেছে তাঁর।
ছ’মাস আগে মোকামা স্টেশনে প্রফুল্ল চাকীকে ধরিয়ে দেওয়ার অপরাধে গতকাল রাতেই কলকাতার সার্পেন্টাইন লেনে সেন্ট জেমস স্কোয়ারের সামনে খুন হয়েছে ইনস্পেক্টর নন্দলাল ব্যানার্জী। পৃথিবীর কোনো প্রান্তেই বিশ্বাসঘাতককে পালিয়ে বাঁচতে দেবে না বাংলার এই নতুন তরুণ দল — নন্দলালের পাঁজরায় আটকানো গুলি আর রিভলভারের ঘায়ে ফেটে যাওয়া মাথা সেটা জানান দিচ্ছে স্পষ্টভাবে। হ্যালিডে বোঝেন, এতক্ষণে মাইক-সহ তাঁর বিভাগের প্রতিটি কর্মচারীই জেনে গেছে, বাংলার বিপ্লবী শহীদ কানাইলালকে ওরা মারতে পারেনি।
কালচক্র ঘুরতে থাকবে এভাবেই।
খুব শীঘ্রই সেশন্স্ কোর্টের সামনে প্রকাশ্য দিবালোকে কানাইলালের মামলার পাবলিক প্রসিকিউটর আশু বিশ্বাসকে হত্যা করে কাঠগড়ায় উঠে দাঁড়াবে প্রতিবন্ধী যুবা চারুচন্দ্র বসু। পূর্বসূরীর মতই স্নিগ্ধ হাসি ঝরিয়ে জোর গলায় জানাবে, ফাঁসিই তার কাম্য, অ্যাপীল করার কোনো প্রয়োজন নেই।
তার কয়েকদিন পরেই হাইকোর্টের বারান্দায় আর-এক দেশদ্রোহী শামসুল আলমকে পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জে গুলি চালিয়ে মারবে বীরেন দত্তগুপ্ত। কানাইলালের চিতা জ্বলেছে যার বুকে।
ঢাকায় সুকুমার চক্রবর্তী, হাওড়ায় কেশব দে — একে একে প্রতিটি বিশ্বাসঘাতক গৃহশত্রুর ওপর নেমে আসবে বিপ্লবীদের চরমদণ্ড। আত্মোন্নতি সমিতির প্রাণপুরুষ বিপিন গাঙ্গুলীকে ধরিয়ে দেওয়ার অপরাধে মুরারী মিত্রের মৃত্যু-ঘোষণা উচ্চারিত হবে সহকর্মী শ্রীশ পালের আগ্নেয়াস্ত্রে। অনেকদিন পরেও আবার ওই আলিপুর জেলেই শাবলের মোক্ষম ঘায়ে আই.বি.র রায়বাহাদুর ভূপেন্দ্র চ্যাটার্জীর মাথা দুফাঁক করে দেবে প্রমোদরঞ্জন আর অনন্তহরি। তারও পরে বিপ্লবসূর্য মাস্টারদাকে ধরিয়ে দেওয়ার অপরাধে বিশ্বাসহন্তা নেত্র সেনের মাথাটা তারই ঘরে এসে স্কন্ধচ্যুত করে দিয়ে যাবে চট্টগ্রামের কিরণ। বিক্রমপুরে অত্যাচারী অফিসার কামাখ্যা সেনকে হত্যা করে ফাঁসির দড়ি গলায় টেনে নেবে কালীপদ মুখার্জী।
পুণার বিষ্ণুগণেশ পিংলে আর চন্দননগরের রাসবিহারী বসু কয়েক বছরের মধ্যেই মায়ের ডাকে এসে মিলবে পঞ্জাবে। কানাইয়ের দুই বন্ধুর মাঝে অনির্বাণ জ্বলবে তারই স্মৃতি। দুজনে একত্র জ্বালাবে দ্বিতীয় সিপাহী বিদ্রোহের হোমাগ্নি। সবটা হয়তো সুগম হবে না। সে যজ্ঞবেদী অপবিত্র করবে নতুন যুগের আর এক বিশ্বাসঘাতক কৃপাল সিং। এ বারের মতই সে আশ্রয় নিতে চাইবে ইওরোপীয় ছত্রছায়ায়। তারপর হঠাৎই একদিন বিশ্বযুদ্ধকালীন ব্ল্যাকআউটের লন্ডনের রাস্তায় তার ক্ষতবিক্ষত লাশ পাওয়া যাবে। মীরজাফরের রক্ত আবারও শুষবে ব্রিটিশ-শাসিত মাটি। কেউ কোনোদিন খুঁজেও পাবে না আততায়ীকে।
কানাইলালকে ওরা কোনোদিনই মারতে পারবে না।