সুন্দরবনে মাতলা নদীর মোহনার ধারে বড় সুন্দরীগাছের গুঁড়িতে হেলান দিয়ে ল্যাজটা দোলাতে দোলাতে বাঘ বললো, “নাঃ, মাংস খাওয়া ছেড়ে দেবো এবার।”
বাঘমামার মাথার পাশে বসে একটা শালপাতার পাখা নিয়ে মামাকে হাওয়া করছিলো শেয়াল। কথাটা শুনে চমকে উঠে বললো, “মানে?”
-- না রে, ওজন বড় বেড়ে যাচ্ছে। আর তা ছাড়া বেশি মাংস খাওয়া তো শরীরের পক্ষে ভালো নয়!
-- কে বলেছে তোমাকে যে বেশি মাংস খাওয়া শরীরের পক্ষে ভালো নয়?
-- আরে সবাই জানে। ব্লাড প্রেসার, কোলেস্টেরল, ট্রাইগ্লিসারাইড -- আর কত বলবো? নাঃ, মাংস খাওয়াটা ছেড়েই দেবো এবার!
-- তবে খাবে কি?
এবারে খেঁকিয়ে উঠলো বাঘ, “কেন? মাংস না খেয়ে কি লোকে বাঁচে না?”
মামার কথার যুক্তি কী করে অস্বীকার করে শেয়াল, বিশেষ করে মামা যখন দাঁত বের করে খেঁকাচ্ছে। তবে মনে মনে প্রমাদ গোনে সে।
মাঝে মধ্যে এরকম সব উটকো ঝামেলা অবশ্য বাঘমামা তৈরী করেই চলে। এই যেমন গত বছরে তীর্থযাত্রা করার সময়ে কুমায়ুনের কিছু সাত্ত্বিক মানুষখেকো বাঘ তার বাঘমামাকে বুঝিয়ে ছেড়েছিলো যে গোরু খাওয়ার মতো পাপ পৃথিবীতে আর কোনকিছুতে নেই। অনেক কষ্টে নিজের পয়সায় মামাকে নিজামের গোস্ত-কাবাব খাইয়ে লাইনে এনেছিলো শেয়াল। মামা বেলাইনে গেলে তার মহা অসুবিধে। মামার শিকারের উচ্ছিষ্টে তার পেট ভরাতে কোনো অসুবিধে হয় না। কিন্তু মামা খাবার না জোগালে নিজেকেই খেটেখুটে খাবারের সন্ধানে ঘুরতে হয়। তাতে ঝামেলা অনেক।
তবে এবারের সমস্যাটা মনে হচ্ছে অনেক বড় মাপের। শুনে মনে হয় জল বহুদূর গড়াবে। ওজন বেড়ে যাওয়া ...মাংস ছেড়ে দেওয়া … মামাকে আবার লাইনে আনতে মনে হচ্ছে বেগ পেতে হবে প্রচুর।
আসলে অন্যবারের মতো এবারও ঝামেলাটা বাঘমামা নিজেই পাকিয়েছে। পাকিয়েছে মিস কাকদ্বীপ বাঘিনী দীর্ঘনখার সাথে ডেটিং করতে গিয়ে। প্রথম দিকে বেশ দিব্যি মাখোমাখো গদগদ ভাবে ব্যাপারটা এগোচ্ছিলো। কিন্তু মুশকিল হলো ডেটিং করতে গিয়ে কোনো রেস্টুরেন্টে ঢুকলেই বাঘমামার খিদেটা জোর চাগিয়ে ওঠে, আর সেটা যদি বাঘা-হ্যাংলা রেস্টুরেন্ট হয় তাহলে তো কথাই নেই। তাই যখন খাবার এলো, বলাই বাহুল্য যে বাঘমামা মাংসের সব ভালো টুকরোগুলো নিজের দিকে টেনে নিয়েছিলো। কিন্তু ফেমিনিস্ট দীর্ঘনখা এই জেন্ডার ইনইকুয়ালিটি সহ্য করবে কেন? প্রচণ্ড রেগে দাঁতমুখ খিঁচিয়ে বাঘকে সে “হোঁৎকা ভোঁদড়” বলে গালাগাল দেয় আর মাথায় এমনি এক মোক্ষম চাঁটি মারে যে বাঘমামা অজ্ঞান হয়ে যায়। এই ফাঁকে দীর্ঘনখা সমস্ত মাংস চেটেপুটে খেয়ে বাঘের থাবাতে বিলটি গুঁজে সরে পড়ে।
শেয়াল লক্ষ্য করেছে যে জ্ঞান আসার পর থেকেই বাঘের হাবভাব অন্যরকম হয়ে গেছে। সবকিছুতেই একটা ভ্যাবলা-ভ্যাবলা ভাব আর ভীষণ কনফিডেন্সের অভাব। মাথায় চোট লাগলে বোধ হয় এই রকমই হয়।
উঠে দাঁড়িয়ে পাশের গাছটার কাছে গিয়ে হাঁক পারলো বাঘ, “হনু! অ্যাই হনু!”
পাতার ফাঁক দিয়ে মুখ বাড়ালো হনুমান, “কি হলো? কি হয়েছে?”
-- বলি ফলটল কিছু আছে তোর কাছে? দে তো, খিদে পাচ্ছে।
হনুমান এত অবাক হয়ে গেলো যে আর একটু হলেই গাছ থেকে পড়ে যাচ্ছিলো। তবে কিছু বলার আগেই শেয়ালের সাথে তার চোখাচোখি হলো। হনুকে চোখ টিপলো শেয়াল। আর কোনো কথা না বলে বাসার ভিতর থেকে এক কাঁদি কলা এনে নিচে ফেলে দিলো হনুমান।
কচরমচর করে চিবিয়ে খোসা শুদ্ধই সবগুলো কলা গিললো বাঘ। তারপর মুখ ধোবার জন্য নামলো মাতলা নদীতে।
এতক্ষণ ধরে গাছের উপর থেকে হাঁ করে বাঘের কলা খাওয়া দেখছিলো হনু। বাঘ একটু দূরে যেতেই শেয়ালকে জিজ্ঞাসা করলো, “কি ব্যাপার? পেট-টেট খারাপ না কি?”
“নাঃ”, শেয়াল বললো, “হাত, পা, বুক, পেট সব ঠিক আছে, তবে মাথাটা …..”
সত্যি সত্যি-ই বাঘ মাংস খাওয়া একেবারে ছেড়ে দিয়েছে। এর মধ্যে হনুর কাছ থেকে চেয়ে আরও দু-দুবার কলা খেয়েছে, শুয়োরদের সাথে মিশে গাছের মূল, খরগোশদের সাথে গাজর। শেষে যখন জঙ্গলের পাশের ঘাসজমিতে গোরুগুলোর সাথে মিশে ঘাস খাওয়া শুরু করলো, তখন শেয়াল আর সামলাতে পারলো না, কাঁদতে কাঁদতে বললো, “মামা, সত্যি-করে বলো না, তোমার কি হয়েছে?’
বাঘ করুণ মুখে শেয়ালের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলো, “হ্যাঁ রে, ওজন-টা কি একটু কমেছে?”
শেয়াল ঠিক করলো বাঘকে লোভ দেখাতে হবে। মোটাসোটা একটা মুরগি মেরে নিয়ে এলো শেয়াল, পালক ছাড়িয়ে নুন-হলুদ আর তন্দুরি মসলা মাখিয়ে বাঘের সামনেই সেটাকে আগুনে সেঁকতে লাগলো ধীরে ধীরে। কিছুক্ষণ বাদে যখন সারা সুন্দরবন তন্দুরি চিকেনের গন্ধে মৌ-মৌ করছে, শেয়াল দেখে বাঘের জিভ দিয়ে জল পড়ছে, সারামুখে একটা স্বর্গীয় হাসি, আর ক্রমাগত দুলে দুলে মাথা নাড়িয়ে বলে চলেছে, “বাঃ! বাঃ!”
মাংস সেঁকা শেষ হতে না হতেই বাঘ এসে শেয়ালকে সামনে থেকে এক ধাক্কায় সরিয়ে দিলো। তারপর তারিয়ে তারিয়ে খরখরে জিভ দিয়ে চিকেনের উপরে লেগে থাকা তন্দুরি মশলাটা পুরো চেটে চেটে খেলো। তারপর ন্যাড়া মুরগিটাকে শেয়ালের দিকে ছুঁড়ে দিয়ে বললো, “নে, এবারে তুই খাওয়া শুরু কর।”
শেয়াল এত অবাক হয়ে গেলো যে মুরগি খেতেও গেলো ভুলে!
মজাটা হলো এই ঘটনার পর থেকেই আবার বাঘের মেজাজ গেলো খিঁচড়ে। যখন তখন শেয়ালকে রেগে ধমকায়, আর কলা দেখলেই রাগে ফোঁসফোঁস করতে থাকে। সেদিন-ও অমনি রাগে ফোঁসফোঁস করতে করতে দু ডজন কলা গিললো বাঘ। শেষ কলাটা যখন খাচ্ছে পাশের রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে একটা বোকা নীলগাই সেই দেখে হেসেছিলো বলে তাকে এমন চাঁটি মারলো যে সে বেচারা মরেই গেলো। কিন্তু তারপর থেকে আবার কেমন যেন ভোম মেরে ঝিমোতে লাগলো বাঘ।
গত তিনদিন পেট ভরে খাওয়া হয় নি শেয়ালের। শেয়াল ভাবলো এই ফাঁকে পেটটা একটু ভরিয়ে নেবে। কিন্তু বাঘমামা যে ঝিমোতে ঝিমোতেও আড়চোখে সব দেখছে শেয়াল সেটা বোঝে নি! যেই শেয়াল নীলগাইয়ের মাংসে মুখ লাগিয়েছে অমনি বাঘ “তবে রে!” বলে শেয়ালকে এমনি তাড়া লাগালো যে শেয়াল ভড়কে গিয়ে তড়বড় করে পাশের গাছে উঠে পড়লো, একেবারে মগডালে। শেয়ালকে সেখানে দেখে হনুমান তো রেগে কাঁই। বললো, “অ্যাই, না বলে আমার বাড়িতে ঢুকেছিস কেন? বেরো শিগগির!”
ওদিকে শেয়ালকে ধরতে না পেরে বাঘের মেজাজ গেছে চড়ে। রাগে গরগর করতে করতে গাছটাকে ধরে প্রবল বেগে ঝাঁকাতে শুরু করলো বাঘ, গাছটা প্রায় ভেঙে পড়ে আর কি! ঝাঁকায় আর মুখ ভ্যাংচাতে ভ্যাংচাতে বাঘ বলে, “বটে! মাংস খাওয়া! আমি খাচ্ছি না আর তুই খাবি! কোনো ব্যাটাকে মাংস খেতে দেবো না আর!”
কি সর্বনাশ! শেয়ালের তবে হবে কি!
শেয়াল দেখে বাঘ সত্যি সত্যিই নীলগাইয়ের মরা দেহটাকে ছুঁড়ে মাতলা নদীর ওপারের জঙ্গলে পাঠিয়ে দিলো!
শেয়ালকে মাথায় হাত দিয়ে বসে থাকতে দেখে হনু বললো, “শিবে! কিছু একটা কর! এ তো দেখছি পুরো খেপে গেছে। পাগলা গারদে পাঠালে ভালো হয়, কিন্তু নিয়ে যাবে কে?”
শেয়াল বললো, “কি করবো? আরে আমার তো এখন খাওয়া বন্ধ হয়ে গেলো!”
হনু বিরক্ত হয়ে বললো, “নিকুচি করেছে তোর খাওয়া! আমার বাড়িটা ভেঙে না দেয় আবার। জানিস, ব্যাঙ্কে আমার লোন এখনো শোধ হয় নি! গোদা হনুমানকে রোজ দু ডজন করে কলা দিয়ে যাচ্ছি যাতে লোনটাকে মকুব করিয়ে দিতে পারে।”
শেয়াল চুপ করে রইলো।
হনু বললো, “চুপ করে কেন? তোর মামা, তুই সামলা! ওকে ডাক্তার দেখা!”
বরাহ ডাক্তার শেয়ালকে দেখেই রাগে ঘোঁতঘোঁত করতে করতে বললো, “আগে আমার গতবারের ভিজিট-টা দে আর আমার বিরুদ্ধে লোক খ্যাপানো বন্ধ কর, তবে তোর কথা শুনবো!” হনুমান হাত জোড় করে অনেক বুঝিয়ে বরাহ ডাক্তারকে শান্ত করলো। কিন্তু যেই বরাহ ডাক্তার ওদের সমস্যাটার কথা শুনলো, অমনি হো হো করে হাসতে হাসতে বললো, “বাঘ মাংস খাচ্ছে না এর চেয়ে ভালো খবর আর হয় না কি রে? যা ভাগ, আমার এখানে সুবিধে হবে না!”
বরাহ ডাক্তারের চেম্বার থেকে বেরিয়ে হনু আর শেয়াল দুজনেই খুব মুষড়ে পড়লো। শেয়াল বললো, “হনু, তোর-আমার সমস্যাটা মনে হচ্ছে আর কেউ বুঝবে না। দেখছিস না সবাই কেমন খুশি।”
হনু বললো, “একটা কাজ করলে হয় না? গাধা ডাক্তারের কাছে যাবি? ওর তো বুদ্ধি বেশি নেই, হয়তো নিজেই বাতলে দেবে কি করলে বাঘ ওকে খাবে?”
শেয়াল মাথা নেড়ে বললো, “না রে! খাবে না! গাধা ডাক্তার স্রেফ একটা ওষুধের নাম জানে -- পচা মুলো! দিন রাত পচা মুলো ঘেঁটে ঘেঁটে ওর গা দিয়েও এখন পচা মুলোর গন্ধ বেরোয়। বাঘ মুলোর গন্ধ একদম সহ্য করতে পারে না, নইলে কবে গাধা ডাক্তারকে খেয়ে হজম করে ফেলতো!”
হনু বললো, “তাহলে কি করবি? মতলব ভাঁজতে হলে চল, হুলো তপস্বীর কাছে যাই!”
“সর্বত্যাগী” যোগী হুলো তপস্বী একটি গেরুয়া আলখাল্লা পরে তাঁর আশ্রমে নাম জপ করছিলেন। সারাটা দিন তাঁর নাম জপ করেই কাটে, খালি খাওয়ার সময়টুকু বাদে। সন্ধ্যাবেলা অবশ্য নানান জনকে নানান ব্যাপারে তিনি পরামর্শ দিয়ে থাকেন।
হুলো তপস্বীর গুণবর্ণনাকারীদের মধ্যে শেয়াল আর হনুর নাম সবার আগে করতে হয়। হুলো তপস্বী যে সার্থক ভবিষ্যৎ-দ্রষ্টা, তাঁর পরামর্শ নিয়ে চললে যে ছেলেপুলে দুধে-ভাতে থাকবে এ কথা তারা যাকে পারে তাকে ধরে বুঝিয়ে দেয়। যে দেশে জলে কুমীর আর ডাঙায় বাঘ সে দেশে এমন সত্যদ্রষ্টার চেলার অভাব হয় না। হনুমান আর শেয়ালের প্রচারের ফলে আজকাল সুন্দরবনের প্রায় সমস্ত প্রাণী, বিশেষ করে জঙ্গলের পাশের গ্রামগুলোর গোরুরা হুলো তপস্বীকে এত ভক্তি করে যে তাঁর পরামর্শ না নিয়ে কোনো কাজ করে না।
হনু আর শেয়াল যখন আশ্রমে এলো, হুলো তপস্বীর তখন সেবার সময়। দুপাশে দুই সুন্দরী বিড়ালনী তাঁকে চামচে দিয়ে দুধ খাওয়াচ্ছিলো। দুধ খেতে খেতে হুলো তপস্বী শুদ্ধ শাকাহারের গুণবর্ণনা করছিলেন, আর মুগ্ধ হয়ে তাই শুনছিলো কয়েকশ গোরু।
সেবা আর বাণী শেষ হতে বেশি সময় লাগলো না। ওদের আশ্রমের ভিতরের ঘরে নিয়ে গেলেন হুলো তপস্বী। শেয়ালের জন্য মুরগির সুরুয়া (শুধুমাত্র হুলো তপস্বীর একান্ত নিজস্ব সাধনকক্ষে বসে খাওয়া হয় এই সুরুয়া!) আর হনুমানের জন্য আমের রস আনতে বলে দিলেন শিষ্যাদের। ওরা কিছু বলার আগেই বললেন, “শোন হনু, আমি সিংহমশাইকে বলে দিয়েছি, গোদা হনুমানকে তোর সুপারিশ মতন আফ্রিকার জঙ্গলে রাষ্ট্রদূত করে পাঠানো হবে। গোদা হনুমান এখন থেকে তোর কাছ থেকে আর কলা নেবে না। ব্যাঙ্কের লোন-ও তোকে আর শোধ করতে হবে না!"
হনুমানের মুখে বিশাল এক হাসি ফুটলো। সাষ্টাঙ্গে হুলো তপস্বীকে প্রণাম করে বললো, “এই জন্যই তো বাবা আপনার কাছে আসি!”
মধুর হেসে হুলো তপস্বী বললেন, “আরে দাঁড়া, দাঁড়া! আমার আশ্রমে এক লাখ টাকা চাঁদা দিবি আর রোজ গোরুগুলোর জন্য আমপাতা জোগাবি!”
-- মানে? এক লাখ টাকা পাবো কোত্থেকে?
-- মানে টানে আবার কি? দশ লাখ টাকা বাঁচিয়ে দিলাম তোর আর এক লাখ টাকা নিয়ে ভাবছিস?
-- বিশ্বাস করুন বাবা, এত টাকা এক সাথে দেবার ক্ষমতা নেই।
-- ধার কর। গোদা হনুমানকে বল, ওই একই ব্যাংক তোকে আবার ধার দেবে। তাড়াতাড়ি কর, আফ্রিকার ব্যাপারে কিন্তু চিতাবাঘের ভাইপো লাইনে আছে।
হনু কি বলতে যাচ্ছিলো, ওকে এক কথায় থামিয়ে দিলেন হুলো তপস্বী, “না, আর কোনো কথা শুনবো না তোর। এবার বল, এখন আবার এসেছিস কেন?”
ওদের মুখে সব শুনে হুলো তপস্বী গম্ভীর হলেন। বললেন, “বাঘ মাংস না খেলে গোরু বাড়বে। যত গোরু, তত শিষ্য। তাহলে আমি এমন কাজ করবো কেন যে বাঘ আবার মাংস খাওয়া ধরে? তাছাড়া …”
ভুরু কুঁচকে শেয়াল বললো, “তাছাড়া কী?”
-- আসলে কি হয়েছে জানিস, আমার শিষ্য-শিষ্যাদের বুঝিয়েছি এই যে বাঘ মাংস খাচ্ছে না, তা আমার শাকাহারী মন্ত্রের গুণে। তাই বুঝতেই পারছিস, বাঘকে মাংস ধরানো তো নয়ই, বাঘ মাংস না খেয়ে থাকলেই আমার সুবিধে!”
ভয়ঙ্কর চটে গেলো শেয়াল। বললো, “বটে, আপনি তাহলে কিছু করবেন না! আমরাই করি তবে। আপনার সব জারিজুরি ফাঁস করে দেবো ভক্তদের কাছে।”
মধুর হেসে হুলো তপস্বী বললেন, “চেষ্টা করে দ্যাখ। পারবি না! আমার ভক্তরা তোদের গুঁতিয়ে দেশছাড়া করবে!”
বেরিয়ে আসতে আসতে ওরা শুনলো, হুলো তপস্বী বলছেন, “মনে রাখিস, বাঘের গুষ্টির পুষ্টি যত কম হয়, পৃথিবীর তুষ্টি তত বেশি!”
বাইরে বেরিয়ে শেয়াল মুচকি মুচকি হাসতে লাগলো।
হনু বিরক্ত হয়ে বললো, “অকারণে ফ্যাকফ্যাক করে হাসছিস কেন?”
-- অকারণে নয়। ঐ যে হুলো তপস্বী পুষ্টি কথাটা বললো!
-- তাতে হলোটা কি?
-- আরে, মাথায় একটা আইডিয়া এসেছে।
-- কি আইডিয়া?
-- বাঘমামাকে তাড়াতাড়ি কোনো বাঘিনীর সাথে জুতে দিতে হবে। ওর সব খ্যাপামির শুরু আগের কেসটা ফেঁসে যাওয়ায়। যদি আর একটা কোনো বাঘিনীর সাথে ভেড়াতে পারি, দেখবি আবার সব ঠিক হয়ে যাবে।
বত্রিশপাটি দাঁত বের করে হাসলো হনু।
-- ব্রিলিয়ান্ট, শিবে, ব্রিলিয়ান্ট। একদম ঠিক বলেছিস। কিন্তু মামুকে প্রেমে ফাঁসানোর এমন আইডিয়াটা এলো কোত্থেকে তোর মাথায়?
-- কেন? ওই যে হুলো তপস্বী পুষ্টি শব্দটা বললো!
-- তাতে হলোটা কি?
-- বুঝলি না? পুষ্টি থেকে পুষ্টিবিদ, মানে নিউট্রিশনিস্ট! আমার সাথে আয়, বুঝিয়ে বলছি!
এবারের ব্যাঘ্র সংবাদ পত্রিকার মূল আকর্ষণ তরুণী পুষ্টিবিদ বাঘিনী প্যান্থেরার লম্বা সাক্ষাৎকার। প্যান্থেরা নীলনয়না শ্বেতাঙ্গিনী, অর্থাৎ সাদা বাংলায় সাদা বাঘ। পুষ্টি নিয়ে তাঁর বিপুল পড়াশুনো এবং নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা সম্প্রতি বাঘেদের মধ্যে প্রবল আলোড়ন ফেলেছে। প্যান্থেরার উপদেশ মেনে নাকি এখনো অবধি প্রায় পাঁচশ রোগা বাঘ মোটা আর মোটা বাঘ রোগা হয়েছে। একে বিদুষী, তায় রূপসী, তার উপরে আবার এত ফর্সা যে ফেয়ার এন্ড লাভলি মাখতে হয় না। তাই ভারতের পুরুষ বাঘেরা সকলেই প্যান্থেরা বলতে একেবারে ফিদা।
দোকান থেকে কেনা ব্যাঘ্র সংবাদটা হনুর সামনে ধরে শেয়াল বললো, “এই দ্যাখ। একবার ভুলিয়ে ভালিয়ে মামাকে প্যান্থেরার কাছে নিয়ে গিয়ে ফেলতে পারলেই হলো!”
ব্যাঘ্র সংবাদ পড়তে পড়তে হনুমান হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গেলো। তারপর বললো, “শিবে, আমি তোর কী করেছি যে তুই আমার সাথে এত বড় শত্রুতাটা করছিস?”
-- কেন? কী হয়েছে?
-- ন্যাকা! যেন জানিস না!
হনুমান ব্যাঘ্র সংবাদের ৩৪ নম্বর পৃষ্ঠাটা খুলে আঙ্গুল দিয়ে দেখালো। প্যান্থেরার ব্লগ -- ব্যাঘ্র সংবাদ বক্স আইটেম করে ছাপিয়েছে -- “হনুমানের মাংসের চৌদ্দটি উপকারী দিক”!
হো হো করে হেসে উঠলো শেয়াল।
--- তোর মাংসের এত গুণ?
-- ঠাট্টা নয়! এসব সিরিয়াস ব্যাপার নিয়ে ঠাট্টা করিস না। আর ওই সব প্যান্থেরা-ম্যান্থেরার ধান্ধা ছেড়ে দে। পুরো ফেঁসে যাবো আমি।
-- তোর শখ হয়েছে তুই ফাঁসবি, ফাঁস! তাতে আমার কী?
-- তুই আমাকে এত বড় বিপদের মুখে ফেলবি?
-- আমি কি না খেয়ে থাকবো নাকি? আর বিপদ আবার কী তোর? থাকিস গাছের উপরে, বাঘ তোর কী করবে?
-- তুই যাবিই?
-- হ্যাঁ, আমি যাবোই!
-- ঠিক আছে, যা! তবে কোনোদিন যদি সুযোগ পাই, তোকেও কেমন ল্যাং দেই দেখে নিস!
পালং শাকের শুক্তো খেয়ে মনমরা হয়ে ঝিমোচ্ছিলো বাঘ। শেয়াল এসে ব্যাঘ্র সংবাদ হাতে সামনে দাঁড়ালো। বললো, “মামা, আমি না একটা কথা ভাবছিলাম। তোমার শরীরটাতো ভালো নেই, তাই …”
রেগে খেঁকিয়ে উঠলো বাঘ, “কোনো হতচ্ছাড়া ডাক্তারের কাছে যাবো না আমি! সবগুলো গাধা আর গায়ে পচা মুলোর গন্ধ! তোর যেতে হয় তুই যা!”
-- না, না, মামা! বালাই ষাট! রোগী নাকি তুমি যে ডাক্তারের কাছে যাবে! তোমার খিদে হচ্ছে না, তাই বলছিলাম নিউট্রিশনিস্ট অর্থাৎ পুষ্টিবিদদের কথা!
কথাটা বাঘের মনে ধরলো।
-- অপারেশন করতে চাইবে না?
-- না!
-- ধরে ইঞ্জেকশন দেবে না?
-- একদম না!
-- হাত পা বেঁধে হাসপাতালে আটকে লক্ষ টাকার বিল ধরাবে না?
-- ধারেকাছে না!
বাঘমামার হাবভাব দেখে ফের আত্মবিশ্বাস ফিরে পেলো শেয়াল। বললো, “পুষ্টিবিদ তো আগে কখনো দেখনি মামা, দেখবে ওরা তোমাকে ভালো ভালো জিনিষপত্তর খেতে বলবে আর প্রচুর এক্সারসাইজ করাবে। তা, দৌড়ঝাঁপে তো তোমার উৎসাহ কম নেই। এই দ্যাখো--"
প্রচ্ছদে প্যান্থেরার ছবি দেখেই মুগ্ধ হয়ে গেলো বাঘ।
-- শিবে, এ নিউট্রিশনিস্ট না মুভি ষ্টার?
-- নিউট্রিশনিস্ট মামা! সিভি দেওয়া আছে, দেখো নি?
-- নিউট্রিশনিস্ট এই রকম দেখতে হয়?
-- হয় মামা, দেখেছ, কি ফিগার, কি গায়ের রং, কি চোখ!
-- কি গোঁফ, আ হা হা হা। এর নাম তো প্যান্থেরা না হয়ে গুম্ফবতী হওয়া উচিত ছিলো রে!
-- যাবে মামা? দেখাবে?
বাঘ লজ্জা-লজ্জা মুখ করে বললো, “ধ্যাৎ!”
-- যাও না! দেখাও না একবার! ক্ষতি তো নেই কিছু!
-- যা, যা, বিরক্ত করিস না, ঘুমোবো এখন!
শেয়াল বুঝলো ওষুধে ধরেছে। ঘুমোবার ভান করে চুপচাপ মটকা মেরে পড়ে রইলো শেয়াল!
একটু বাদেই নিঃশব্দে গা ঝাড়া দিয়ে উঠলো বাঘ। একবার শেয়ালের দিকে তাকালো। নাক ডাকিয়ে একেবারে মরার মত ঘুমোচ্ছে শেয়াল। চুপি চুপি পা টিপে টিপে কোথায় যেন রওনা দিলো বাঘ।
মুচকি হেসে একটু অপেক্ষা করলো শেয়াল। তারপর চুপচাপ বেশ কিছুটা দূর থেকে বাঘমামাকে ফলো করা শুরু করলো।
বিনা পয়সায় এমন মজা লুটবার সুযোগ জীবনে বারবার আসে না!
সিংহমশাইয়ের বড়শালী সুন্দরবনে বেড়াতে এসেছেন। আজ তিনি মাতলা নদীতে চান করতে যাবেন। তাই ভি আই পি প্রোটোকল অনুযায়ী সিংহমশাইয়ের চ্যালাচামুণ্ডারা সব রাস্তা আটকে রেখেছিলো। অভিসারের জায়গাতে পৌঁছতে তাই একটু দেরি হয়ে গেলো শেয়ালের।
গিয়ে দেখে প্রেম চাগিয়ে ওঠার আগের সেই অপূর্ব গদগদ মাখোমাখো ভাব -- দীর্ঘনখার বেলা ব্যাপারটা যেমন এগোচ্ছিলো একদম সেই রকম। শেয়াল তাড়াতাড়ি পা টিপে টিপে পাশের ঝোপে লুকিয়ে বসে মজা দেখতে লাগলো।
শেয়াল দেখে বাঘমামার পিঠে থাবা রেখে প্যান্থেরা বলছে, “ইস, কি রোগা তুমি! খাওয়া-দাওয়া করো ঠিক মতন?”
বাঘ একটু করুণ হাসি হাসলো।
-- বুঝেছি! একা তো! রান্না-বান্না সব নিজেকেই করতে হয়, তাই না?
ফোঁৎ করে এক দীর্ঘনিশ্বাস ছাড়লো বাঘ, তারপর চিনি ঝরানো এক বিশাল দেঁতো হাসি হাসলো।
প্যান্থেরা বললো, “না, না, এভাবে চলবে না। খাওয়া-দাওয়াটা তো ঠিক মতন করতে হবে! আজ দুপুরে কি খেয়েছিলে?
বাঘ ঘাড় গুঁজে মাথা নিচু করে বললো, “পালং শাকের শুক্তো!”
-- কি সাংঘাতিক! আর গতকাল?
-- গোটা কুড়ি কলা খেয়েছি শালপাতা দিয়ে মুড়ে!
-- পরশুও ওরকম?
-- না, না, পরশু একটু ভালো সবজি ছিলো -- গাজর আর বাঁধাকপি।
হো হো করে হেসে মাটিতে গড়াগড়ি খেলো প্যান্থেরা। বললো, “হাউ সুইট! তবে চিন্তা কোরো না। ভেজিটাইটিস রোগ আমার বড়মামার-ও ছিলো। আমি জানি কি করতে হবে। একদিনে সব ঠিক হয়ে যাবে। ওই দিনটাতে শুধু কোনো সলিড খাবার নয়, খালি ছয় গ্লাস শেয়ালের রক্ত খাবে, ব্যাস!”
কী সাংঘাতিক!
এখান থেকে যত তাড়াতাড়ি পারা যায় দূরে যাওয়াই মঙ্গল। সরে যাবার জন্য সবে পা বাড়িয়েছে শেয়াল, এমন সময় ঠিক পিছনে ---
“হুক্কা হুয়া!”
বিকট আওয়াজ আর একদম পুরোপুরি শেয়ালের গলায় …
হনুমান!
আওয়াজটি করেই টুপ্ করে এক লাফে একেবারে পাশের সেগুন গাছের মগডালে উঠে পড়লো হনুমান। প্রাণপণে দৌড়তে দৌড়তে শুনতে পেলো শেয়াল, প্যান্থেরা বাঘমামাকে বলছে, “ঐ তো, ঐ তো একটা শেয়াল পালাচ্ছে!”
সেই থেকে শেয়াল আর বাঘমামার ধারেকাছে ঘেঁষে না।
আর বাঘমামীর ধারেকাছে তো নয়ই!