তেইশে আগস্ট; দু হাজার আঠারো
দুপুর একটা- ‘কুম্ভস্থ’ হয়ে চলেছি হরিদ্বার। অনেক বছর ধরেই ভাবছি হেমকুন্ড আর নন্দনকানন (ভ্যালি অফ ফ্লাওয়ার্স) দেখতে যাব — কিছুতেই হয়ে উঠছিল না। এবারও যাত্রার নির্ঘন্ট বারবার এলোমেলো হয়ে গিয়েছে। প্রথমে ২১ জুলাই, তারপর ১৪ জুলাই হয়ে শেষমেশ যাত্রা-পালার শুভারম্ভ এসে ঠেকল এই তেইশে আগস্টে। যাত্রীসঙ্গীতেও বদল বারবার। চারজন থেকে তিনজন হয়ে পাঁচজন, আবার শেষবেলায় চারজন চলেছি — তা-ও একজন জুটবে সরাসরি হরিদ্বারে — এই মুহুর্তে আমরা তিনজন। এর মধ্যেও একজন, সৌমিত্রি আবার অন্য কামরায় — দেরিতে এন্ট্রির দৌলতে। কে জানে, কী আছে কপালে! একটাই ভরসা — হৃষিকেশ থেকে রমেশ কোঠিয়াল জানিয়েছে, বৃষ্টি এখন ঝড়তি-পড়তি — এই আছে, এই নেই। পথঘাটও টনকো।
বিকেল চারটে- আসানী'সে আসানসোল।
বিকেল পাঁচটা সাত- সবুজের ঢেউ ভেঙে চলেছে ট্রেন। খানিক আগে আকাশ ভেঙে নেমে আসতে দেখলাম। আকাশ এখনও দিগন্তবিস্তৃত স্লেট।
বিকেল পাঁচটা কুড়ি- মধুপুর সুমধুর।
বিকেল পাঁচটা পঞ্চাশ- জসীডিহ, ইয়ে, যশিডি?
সন্ধে ছ-টা বারো- শিমুলতলায় সাঁঝ নামছে।
খুব সন্ধে ছ-টা আটত্রিশ- ঝাঝা — আজা।
আঁধার সাতটা পাঁচ- জমুই। যম উই?
‘রাত’ সাতটা সাঁইত্রিশ- কিউল। কী উল?
রাত সাতটা একচল্লিশ- লক্খীসারায়। লক্ষ্মীর সরা!
রাত আটটা একত্রিশ- মোকামা। মোকাম আয়া!
রাত ন-টা তেতাল্লিশ- পটনা। পাট না?
রাত দশটা সাতান্ন- ঘুম আয়, আয় ঘুম.......
চব্বিশে আগস্ট
সকাল সাতটা সাতচল্লিশ- গত সাতচল্লিশ মিনিট ধরে বনের ধারে দাঁড়িয়ে উলটোদিক দিয়ে একের পর এক ট্রেনের চলে যাওয়া দেখছি।
সকাল আটটা তিন- দিলখুশ করে ট্রেন দিলখুশা পেরোলো।
সকাল আটটা ছয়- আবার ট্রেন স্ট্যাচু।
সকাল আটটা আট- আবার উজানে।
সকাল আটটা এগারো- লক্ষ্মণের রাজধানী, লক্ষ্মণাবতী, ইয়ে, লখনউ।
সকাল ন-টা তিন- অব ছোড় চলে লখনউ নগরী।
সকাল ন-টা উনত্রিশ- আলমনগর।
সকাল ন-টা ছত্রিশ- কাকোরি। স্বাধীনতা সংগ্রামে আত্মবলিদানের শহর; কাবারেও বটে।
সকাল এগারোটা পঁচিশ- রোজা জংশন। গোটা স্টেশন যেন রোজা রেখেছে! সুনসান।
দুপুর বারোটা বত্রিশ- বরেলি। এখানে নেমে বাজারে ঝুমকা খুঁজতে হয়।
দুপুর একটা ছাব্বিশ- মীলক। প্ল্যাটফর্ম জুড়ে তাঁবু — অল লক্ড্।
দুপুর একটা ছেচল্লিশ- রামপুর। এখানকার নবাব নাকি রাবণের মতো আখতারিবাঈকে (বেগম আখতার) গানের জন্য হরণ করেছিল।
বেলা দু-টো আঠারো- কটঘর। কাঠগড়ায় কে?
বেলা দু-টো চব্বিশ- মোরাদাবাদ। এখানকার বাসন নাকি বাসনা করার মতো।
বেলা তিনটে আট- হরথালা। শিবের থালা!
বেলা তিনটে তেত্রিশ- কন্ঠ্? কাঁঠ? কন্থ্? কান্থ্? ইংরেজি বানান এত confusing!
বেলা তিনটে চল্লিশ- সোহারা। কওন হারা?
বেলা চারটে ছেচল্লিশ- পুরেইনি। থামেইনি।
বেলা চারটে সাতান্ন- নগীনা। অমূল্য রতন।
বেলা পাঁচটা পঁয়ত্রিশ- নজীবাবাদ।
সন্ধ্যা ছ-টা- বালাবালি। শিশুসুলভ বাড়াবাড়ি।
সন্ধ্যা ছ-টা এগারো- লকসর। মাথায় তালা!
সন্ধ্যা ছ-টা উনত্রিশ- আমরা এখনও পৌঁছতে পারিনি দেখে আকাশের অঝোরে কান্না।
সন্ধ্যা ছ-টা ছাপান্ন- জ্বালাপুর। পুরো জ্বলে পুড়ে তো আছিই। এই বৃষ্টিতেও।
সন্ধ্যা সাতটা পনেরো- বল হরি — হরিদ্বার। বৃষ্টি এখন লাঞ্চ, থুড়ি, টী ব্রেকে।
সন্ধ্যা সাতটা বত্রিশ- আম্বালা থেকে আসা সারথির সারথ্যেরাহীরা এখন রাহী মোটেলের আরামে।
রাত এগারোটা এক- ঘন্টাখানেক আগে বর্ষা আবার রাগপ্রধান ধরেছে — লম্বা খেয়াল। তার তানের মাঝেই একসময় ফর্ফর্ ফোঁৎ।
পঁচিশে আগস্ট
ভোর সাড়ে পাঁচটা- ঘুম ভেঙেই দেখি বর্ষার জোর তবলালহরা।
সকাল সাড়ে সাতটা- বর্ষার ঘোর আপত্তি সত্ত্বেও গোপাল ভরসায় দুধসাদা গাড়ির সওয়ার হয়ে হরিদ্বারকে পরিত্যাগ করা গেল পুরো জোশ নিয়ে জোশিমঠের উদ্দেশ্যে।
সকাল সাতটা সাতচল্লিশ- হরিদ্বার-হৃষিকেশ হাইওয়ে গর্তে কলকাতাকেও লজ্জা দেবে। ঢেঁকুচকুচ খেলতে খেলতে চলেছি। বর্ষারাণী একবার ঘোমটা খুলছেন, একবার মুখ ঢাকছেন।
সকাল আটটা সাত- রায়ওয়ালা। এখান থেকে দেরাদুনের পথ বেঁকেছে।
সকাল আটটা বত্রিশ- গীতানগর। রমেশ কোঠিয়ালের দর্শন আর পেটকে আলুর পরোটা প্রদর্শনপর্ব।
সকাল ন-টা চুয়ান্ন- তপোবন। বনের তপস্যা পথের দুপাশে।
সকাল দশটা চার- গাড়ির সারি নট নড়ন চড়ন। ধস সারানোর কাজ চলছে।
সকাল দশটা সতেরো- ধসের কারণ নিয়ে গবেষণা চলছে। যা বোঝা গেল, পথ সম্প্রসারণের উন্নয়ন প্রক্রিয়া আর ঘনবর্ষার সুমধুর মেলবন্ধনেই এই মহাযন্ত্রণা। ওপরের মাটি-পাথর-গাছ উন্নয়ন দেখতে পথের ওপর হাজির।
সকাল সাড়ে দশটা- নড়েছে! নড়েছে! চতুর্দিকের উল্লাসরবে পাখপাখালি পগার পার।
সকাল দশটা বাহান্ন- অটলি। অটলই!
সকাল দশটা চুয়ান্ন- ব্যাসী। ভাই, আসি।
সকাল এগারোটা এগারো- এগারোর গেরোয় ফেঁসে। ল-ম্-বা জ্যাম।
সকাল এগারোটা বাহান্ন- নিষ্প্রাণ অজগরে প্রাণসঞ্চার।
সকাল এগারোটা ছাপ্পান্ন- আবার কোমায়।
দপুর বারোটা উনপঞ্চাশ- অবশেষে চলমান হওয়া গেল।
বেলা দু-টো পঁচিশ- পেটের জ্বালা, বড় জ্বালা। দেবপ্রয়াগকে দূরবীণদূরত্বে রেখে পেটপুজো।
বেলা তিনটে এক- ভরাপেটে আবার পথে।
বেলা তিনটে নয়- দেবপ্রয়াগে থামা নয়।
বেলা তিনটে তিপ্পান্ন- কল্লেগাঁও। চল্লে হম।
বেলা চারটে চার- কীর্তিনগরের কীর্তিকে অগ্রাহ্য করে ছুট।
বেলা চারটে বেয়াল্লিশ- কলিয়াসৌড়। জারি হমারী দৌড়; তবে, চা খেয়ে তবেই।
বেলা পাঁচটা এগারো- নরকোটা। নারীদের বোধহয় এখানে কোনও কোটা নেই।
বেলা পাঁচটা ছাব্বিশ- এইসময় জোশিমঠ আয়ত্তের মধ্যে এসে যাওয়ার কথা — সবে রুদ্রপ্রয়াগ। মেজাজে রুদ্রদেবের প্রভাব।
বেলা পাঁচটা চল্লিশ- রাতুরা। বলল, ‘যা তোরা’।
বেলা পাঁচটা পঞ্চাশ- নগরসু। এখন সবই কু মনে হচ্ছে।
বেলা পাঁচটা ঊনষাট- গৌচর। গরু ছাড়াও বিস্তর মানুষজন, গাড়ি ঘোড়া চরছে।
শেষ বিকেল ছ-টা ষোলো- কর্ণপ্রয়াগ। অওর জলদী ভাগ।
প্রায় সন্ধ্যা ছ-টা চৌত্রিশ- লঙ্গাসু। লং আঁসু?
সন্ধ্যা ছ-টা একান্ন- নন্দপ্রয়াগ। তালের বড়া ঢেলে দিলেও নাচার প্রশ্নই নেই।
রাত সাতটা আটত্রিশ- আঁধারে আটক।
রাত আটটা উনিশ- রতুলা। পথ উদয়শঙ্কর সরণি। বৃষ্টি। ধস। জ্যাম।
রাত আটটা পঁয়তাল্লিশ- পিপলকোটি। কোটি কোটি প্রণাম রাস্তার ক্ষুরে। রাস্তা যেন কাদা-পাথরের দধিকর্মা। JCB-র অক্লান্ত পরিশ্রম সত্ত্বেও গাড়িচালকদের অবিমৃষ্যকারিতায় গাড়ির জট জটিল। দু-দিকের গাড়িই আগে যেতে চায়। ফলং — শূন্যম্। শেষ এক কিলোমিটার আসতে বাইশ মিনিট লেগেছে।
রাত ন-টা সতেরো- হেলং। এখনও জোশিমঠ সোলং! বর্ষারাণী অবশ্য সঙ্গ ছাড়েনি।
রাত ন-টা উনপঞ্চাশ- স্বপ্ন নুঁ মায়াভ্রম নুঁ! জোশিমঠ।
রাত দশটা দুই- আগে উদরপূর্তি, তারপর বিশ্রামের ফুর্তি।
রাত দশটা সতেরো- অবশেষে নরসিংহের ডেরায়। প্রথম দিনের অ্যাডভেঞ্চারের ইতি।
ছাব্বিশে আগস্ট
সকাল ছ-টা- ঘুম ভাঙতেই অভ্যর্থনা জানালো বৃষ্টির টুপটাপ।
সকাল আটটা- বদরিনাথ জীপ স্ট্যান্ডে গোবিন্দঘাটের গাড়ি ধরার সুযোগ করে দিল বর্ষা তার কান্না সামলে।
সকাল আটটা চব্বিশ- গাড়িও ছাড়ল, টিপটিপও নামল।
সকাল আটটা পঁয়তাল্লিশ- বিষ্ণুপ্রয়াগ।
সকাল আটটা বাহান্ন- গোবিন্দঘাট বাসস্ট্যান্ড।
সকাল ন-টা একুশ- উপবাস ভঙ্গ করে, ইউজ অ্যান্ড থ্রো বর্ষাতি জোগাড় করে গোবিন্দঘাটের উৎরাইতে পা পড়ল।
সকাল ন-টা সাঁইত্রিশ- পুলনা-র গাড়ির অনুসন্ধান.....
সকাল ন-টা ঊনষাট- .... এবং প্রাপ্তি।
সকাল দশটা এক- ঝুলনের ঝোলা সেতু পেরিয়ে গাড়ি পুলনার পথে। সাথী লক্ষ্মণগঙ্গা আর বৃষ্টি।
সকাল দশটা ঊনিশ- পুলনা। বৃষ্টি, পলিথিনের ঘেরাটোপের দোকান, গাড়ির সারি, ঘোড়া, থুড়ি, খচ্চরের দঙ্গল, তাদের স্তূপীকৃত ইয়ে, ডান্ডি এবং অগুণতি ভারবাহক — পিকাসোর গুয়ের্নিকাকেও হার মানায়।
সকাল দশটা একুশ- একজন ভারবাহককে সঙ্গী করে বর্ষাতি সজ্জিত হয়ে পদক্ষেপের শুরু। বৃষ্টি আমাদের দৃঢ়সঙ্গিনী। পাথরফেলা পথ; মাঝেমধ্যেই সিঁড়ির মতো ধাপ — বাপরে বাপ!
সকাল এগারোটা- একটা ‘রেনশেড’-এর তলায় হাঁফ ছাড়ার ফিকির।
সকাল এগারোটা ছয়- আবার পায়ের নিচে পাথর, মাথার ওপর জলের ঝালর। গাছেরা সব ঝুঁকে পড়ে মজা দেখছে। নিচে লক্ষ্মণগঙ্গা রণচণ্ডী।
ঠিক দুপুরবেলা- আকাশের কান্না ভয়ানক বেড়ে গেছে। চড়াইয়েরও কমতির কোনও লক্ষণ নেই। অতএব একটু আড়াল দেখে পিঠের বোঝা নামালাম। পিঠ বলছে, বয়স বেড়েছে, আর বোঝা বইতে পারিনে। অতএব নির্লজ্জের মতো আমার স্যাকটাও চাপিয়ে দিলাম ভারবাহক ভাইয়ের ঘাড়ে।
দুপুর বারোটা পাঁচ- চাতকের চা পিয়াস চেগে উঠেছে দোকান দেখে। বৃষ্টি ঝুপড়ির বাইরে নেচে চলেছে।
দুপুর একটা উনপঞ্চাশ- নীল প্লাস্টিকের শামিয়ানা দেখে ধড়ে প্রাণ এলো। চা চা, আমার প্রাণ বাঁচা। রেনকোট ডাহা ফেল। ভিজে চুপচুপে হয়ে ক্যামেরার নিমোনিয়া। এখন ফোন-ক্যামেরাই ভরসা। দোকানের বাইরে বৃষ্টির গজরানি চলছেই। নীল ছায়ামাখা শুকনো জায়গাটুকুতে একটা ঘুঘু চরছে।
দুপুর একটা উনষাট- সামনের চড়াইয়ের বাঁকের শেষেই নাকি ভুন্দার। অতএব, চরৈবতি।
বেলা দুটো তেইশ- ‘চাউমিন’ খেতে খেতে ভাবছি, কারও লেখাতেই পড়িনি যে দশ কিলোমিটারের পুরোটাই চড়াই। এখান থেকেই দেখা যাচ্ছে, অস্থায়ী ব্রিজ পেরিয়ে পথ গোঁত্তা মেরেছে আকাশপানে — সেই পথকে গিলে নিয়েছে অগাধ জঙ্গল।
বেলা দুটো চৌত্রিশ- বিশ্রামের একটু বাড়াবাড়িই হয়ে গেল। দুই তরুণ, সারথি(৪৪) আর সৌমিত্রি(৪৯) তো এতক্ষণে কাঁহা কাঁহা মুল্লুকে ভারবাহকও অদৃশ্য। এই দুই বুড়ো হাবড়া, আমি (৬৫) আর কাকা (৭২) যথারীতি লাস্ট বেঞ্চার। অতএব, গাত্রোত্থান করতেই হলো।
বেলা দুটো একান্ন- দু-দুবার পথ ভাসানো জুতো ডোবানো জলস্রোত পেরিয়েছি চড়াই সামলে। এই ঝরনা উৎপাতের বর্ণনাও কারও লেখায় পাইনি।
বেলা দুটো বাহান্ন- উঠছি আর ভিজছি আর হাঁফাচ্ছি। উঠি উঠি উঠি, চড়াই-র তো নেই শেষ-। শেষ নেই বর্ষার ঝাপটারও।
বেলা তিনটে এক- আবার স্বর্গের উঁকিঝুঁকি — চায়ের দোকান! চা চা চা —
বেলা তিনটে সতেরো- চা চাপিয়ে চাগিয়ে উঠল উৎসাহ। অরণ্য! পাথুরে সিঁড়ি!! বৃষ্টি!!! ফু:।
বেলা পাঁচটা পাঁচ- চড়ি চড়ি চড়ি — ভিজি ভিজি ভিজি।
বেলা পাঁচটা পঞ্চাশ- পাইনবনের ফাঁক দিয়ে ঘোলাটে আকাশ উঁকি দিচ্ছে। আমি ছাড়া সবাই বোধহয় ঘাংঘারিয়া পৌঁছে গেছে।
সন্ধ্যা ছ-টা তিন- GMVN-এর নিশ্চিন্ত আশ্রয়ে প্রবেশ ঘটল কুন্ঠিত অবগুণ্ঠিত ঝোড়ো কাকের। অ্যাডভেঞ্চারের দ্বিতীয় পর্বের অন্ত। যদিও বৃষ্টি অনন্ত।
সাতাশে আগস্ট
সকাল ছ-টা- সারারাত কেঁদে এখন বর্ষা হেঁচকি তুলছে। পাইনবনের মাথায় যে পাথুরে পাহারাদারেরা মাথা তুলে রয়েছে, তারা মেঘের ফাঁকে উঁকি মারছে।
সকাল সাতটা সাত- আজ ঘর ছাড়তে হবে — টুরিস্ট লজ-ভরা লোক আসছে। মনটা এমনিই খিঁচড়ে আছে — ঘাংঘারিয়ার পাথুরে পথের দু-ধার ধরে ধারাবাহিক দোকানপাট, লজ আর একখানা গুরুদ্বারা। পথ জুড়ে খচ্চর বাঁধা অগুণতি, তাতে চড়ার লোকেরও অভাব নেই। খচ্চরওয়ালারা ডান্ডিওয়ালা — গিজগিজ করছে লোকজন, ঠিক যেন ভরসন্ধ্যের এসপ্ল্যানেড! সবকিছু ছাপিয়ে খচ্চরের ইয়ে গন্ধে ম ম করছে, গোটা ঘাংঘারিয়া, যার ভক্তিমন্ত নাম ‘গোবিন্দধাম’। তার ওপরে ছিঁচকাঁদুনের মতো ঘ্যানঘেনে বৃষ্টি।
সকাল আটটা আটত্রিশ- জলের গুঁড়ি গায়ে মেখে, গোমড়া আকাশকে সাক্ষী রেখে উপবাস ভঙ্গ করা গেল। আকাশ আর শরীরের অবস্থা দেখে কাকা জানিয়ে দিল, ‘পাদমেকং ন গচ্ছামি’। আমি আর সৌমিত্রি দোটানায় — কারণ এ তাবৎ যেসব রিপোর্ট পাওয়া গেছে, সেগুলো মোটেই উৎসাহব্যঞ্জক নয় — ভ্যালি অফ ফ্লাওয়ার্সে ফ্লাওয়ারের বড় অভাব; অতি বর্ষায় প্রায় সকলেই ঘোর নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মৃত — তায়, আমার ক্যামেরাটি কোমায়; জলে অচল। শুধু নবাগত সারথি পার্থসারথির মতো দৃঢ়প্রতিজ্ঞ — দেখেগা ভাই দেখেগা, ফুঁলো কী ঘাটী দেখেগা।
সকাল দশটা এগারো- নানান টালবাহানার পরও আরথিকে আটকানো গেল না। আমরা দুজন তার সঙ্গী হলাম এন্ট্রি পয়েন্ট পর্যন্ত। হেমকুন্ডের উদ্দেশেও কিছু যাত্রী পদব্রজে ডাণ্ডিতে খচ্চরবাহিত হয়ে রওনা হয়েছে।
সকাল দশটা আঠারো- দোরাহায়, যার চলতি নাম Y, এসে আমরা বামপন্থী হলাম। সোজাপথ খানিক গিয়ে একটা প্রপাতের গা ঘেঁষে উঠে গেছে হেমকুন্ডে।
সকাল দশটা তেইশ- জঙ্গলের মাঝ দিয়ে দুপাশের ফুলেদের ইশারায় সাড়া দিতে দিতে এসে পড়লাম ফুঁলো কী ঘাটি-র এন্ট্রি পয়েন্টে। আমাদের দু:সাহস দেখে আকাশও কান্না সামলে নিয়েছে। আমাতে সৌমিত্রিতে চোখাচোখি হলো — তিনজনেরই ‘টিকিট’ করা হলো; মাথাপিছু (তিনদিনের জন্য) ১৫০ টাকা। আমি সিনিয়র সিটিজেন বলে হাফপ্রাইস।
সকাল দশটা উনত্রিশ- যতদূর পারি যাব ঠিক করে নিয়ে নিজেদের সঁপে দিলাম জঙ্গলের কোলে।
সকাল দশটা বাহান্ন- ব্রিজে চড়ে পুষ্পবতীকে পেরোবার সময় তার ভয়ংকর সুন্দর রূপ থেকে চোখ সরছিল না। সৌমিত্রি তো কাঁহা কাঁহা মুল্লুকে, এই সুযোগে সারথিও ওপারের জঙ্গলে হারিয়ে গেল।
সকাল দশটা আটান্ন- পেরিয়েই দেখি ঠাসবুনোট জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে চল্লিশ ডিগ্রি খাড়াই পথ! পথ মানে, এক হাত চওড়া, আলগা বোল্ডারের স্বর্গের সিঁড়ি।
সকাল এগারোটা সাতাশ- বাপ রে, কী পথ! নড়বড়ে পাথরের সাপের যেন স্বর্গে যাওয়ার ভয়ানক তাড়া। কোথাও চল্লিশ ডিগ্রি, কোথাও কোথাও পঞ্চাশ। বাঁদিকের ঠাসবুনোট সবুজে মাঝেমধ্যে রঙীন ফুলের ছিটে।
দুপুর বারোটা দুই- কিমাশ্চর্যম! পথের ধারে একটা বসার মতো জায়গা আর সেখানে সারথি। পাশে বসে দাঁত বের করলাম।
দুপুর বারোটা আট- ড্রাই ফুট আর জলের রসদে সেমি-বলীয়ান হয়ে আবার চড়ি চড়ি চড়ি।
দুপুর বারোটা চোদ্দ- সারথি অদৃশ্য। ভুঁড়িবাবু ভালুকের মতো হেলেদুলে এক-পা দেড়-পা করে চড়তে থাকলেন। দেখার মতো কিছু নেই, শুধু নাক বরাবর চড়াই এঁকেবেঁকে উঠেই চলেছে। দুটো মেয়ে হুমহুমিয়ে পাশ দিয়ে উঠে গেল। এমন বোরিং ট্রেক আগে করেছি বলে মনে পড়ছে না। ক্রমশ নিরুৎসাহিত হয়ে পড়ছি।
দুপুর বারোটা সাতাশ- ওপরে দেখতে পাচ্ছি, একজন ডান্ডিওয়ালা ডান্ডি নিয়ে দাঁড়িয়ে। আমাকে দেখতে পেয়ে ইশারায় ডাকল। হাঁচড়ে পাঁচড়ে উঠে এলাম। বেচারিকে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে হবে।
দুপুর বারোটা একত্রিশ- পথের ধারে ঠেকানো ডান্ডিটা (একটা লম্বাটে মোট বইবার ঝুড়ির একদিক কেটে চেয়ারের মতো বানানো। বসে থাকা মানুষের পিছনপানে চেয়ে বসে থাকা অসহায় অবস্থাটা করুণার উদ্রেক করে। করুণা অবশ্য ডুলিবাহকের জন্যও হয় — পেটের দায়ে মানুষকে কী না করতে হয়!) সাবধানে ধরে রইলাম। আরোহিনী বয়স্কা মহিলা এসেছেন দক্ষিণ ভারত থেকে। মেয়ে এবং ভাইঝি এগিয়ে গেছে, স্বামী এবং ভাই পায়ে পায়ে উঠে আসছেন পিছনে।
দুপুর বারোটা আটত্রিশ- ডান্ডিবাহকও জানালো, ঘাটীতে ১০% ফুলও নেই। ক-দিনের বেরসিক অতিবৃষ্টিই খলনায়ক। এমনিতেই মেজাজটা চটকে ছিল, কফিনে শেষ পেরেক পুঁতে দিল ডুলিবাহক ভাই। ঠিক করলাম যথেষ্ট ধ্যাস্টামো হয়েছে, আর নয়। এবার ব্যাক টু দ্য প্যাভিলিয়ন।
দুপুর বারোটা চুয়াল্লিশ- একরকম ঝড়ের গতিতেই নামছি। গাছের ফাঁক দিয়ে মেঘের যা ভ্রূকুটি দেখছি — চাচা, আপন প্রাণ বাঁচা। বর্ষাতি নেই, ছাতা নেই, নিধিরাম সর্দার।
বেলা একটা সতেরো- পুষ্পবতীর পুল দেখা যাচ্ছে! মার দিয়া হ্যায় কেল্লা। আমাকে নির্বিবাদে নেমে সতে দেখে আকাশ টুকটাক বৃষ্টির ঢিল ছুঁড়তে লাগল।
বেলা একটা তেত্রিশ- এন্ট্রি-পয়েন্টে নাম কাটিয়ে শুরু হলো বুড়ো ভালুকের তুড়ুক লাফ।
বেলা একটা তিপান্ন- আমি ঘাংঘারিয়ায় পৌঁছতেই আকাশ ঢিল ছোঁড়া থামালো।
বেলা দুটো ছত্রিশ- ফিরে এলো সৌমিত্রি।
বেলা চারটে চল্লিশ- বেশ কয়েক দফা চা-পর্ব শেষ করার পরও সারথির দেখা না পেয়ে, তার অনুসন্ধানে বেরোনো গেল।
বিকেল পাঁচটা- Y-এর মোড়েই মিলল সারথির সন্ধান।
রাত আটটা চল্লিশ- ডিনার সারতে গিয়ে এট্টু উত্তেজনার মশলা জুটল। ভালুকবাবাজীরা নাকি খচ্চর দিয়ে ডিনার সারতে এসেছিল — খচ্চরওয়ালাদের সম্মিলিত প্রতিরোধে তাদের সেই অভিযান ব্যর্থ হলো।
রাত ন-টা বাইশ- বৃষ্টির রাত্রিকালীন অধিবেশন শুরু।
আঠাশে আগস্ট
সকাল সাতটা- ভক্তরা ঝিরিঝিরি বৃষ্টির মধ্যেই খচ্চর এবং ডাণ্ডিবাহিত হয়ে হেমকুন্ডের উদ্দেশে বেরিয়ে পড়েছে। আমরা যদিও ঠিক করেছি, ঘন্টাখানেকের মধ্যে বৃষ্টি না থামলে ফিরতি পথে পা বাড়াব।
সকাল সাড়ে ন-টা- এতক্ষণে 'মেঘের কোলে রোদ হেসেছে'। এখন আর হেমকুন্ডের পথে পা বাড়াবার সময় নেই। অতএব — রিট্রিট।
দুপুর বারোটা দশ- নেমে এসেছি পুলনায়।
দুপুর বারোটা ছাব্বিশ- গোবিন্দঘাট। উদরপূর্তি।
দুপুর বারোটা আটান্ন- গোবিন্দঘাট বাসস্ট্যান্ড। অপেক্ষমান গাড়ীতে ডবল ভাড়ায় জোশিমঠমুখী।
দুপুর একটা আট- জোশিমঠ। অ্যাডভেঞ্চারের তৃতীয় অধিবেশনের সমাপ্তি।