মিহির সেনগুপ্ত বাংলা ভাষার এক আশ্চর্য লেখক, যিনি তাঁর আত্মজৈবনিক রচনা সমূহে বাংলা স্মৃতিসাহিত্যের খালে জোয়ারের স্ফীতি এনে দিয়েছেন। ছিন্নমূল মানুষের যন্ত্রণা আর জীবনের নড়ে যাওয়া ভরকেন্দ্রের কাহিনি নেহাৎ কম নেই। তবু সেই সব কাহিনিতে কোথাও খানিক নৈর্ব্যক্তিক দূরত্ব, কোথাও মনের মাধুরীর টানে আবেগের স্রোতে ডুবুডুবু শান্তিপুর। কিন্তু জীবনের মাদারিকা খেল দেখতে দেখতে বেড়ে ওঠা মিহির সেনগুপ্ত জীবন সম্পর্কে অদ্ভুত এক প্রশান্ত দৃষ্টিভঙ্গি অর্জন করেছেন। কোনো অভিযোগের ত্রিসীমানায় না থেকে বরং ধরেছেন স্মৃতির হাত। যে-স্মৃতি বাঙালির গত সত্তর বছরের সমষ্টিগত স্মৃতিরই অংশ।
সদ্য-শরতের এক দুপুরে লেখকের ভদ্রাসনে পরবাসের পক্ষে হাজির হয়েছিলেন শ্রীকুমার চট্টোপাধ্যায়, অরণি বসু, রাজীব চক্রবর্তী আর সিদ্ধার্থ সেন। গোটা দুপুর জুড়ে চলল স্মৃতিযাপন। পরবাসের পাতায় কয়েক কিস্তিতে সেই কথাবার্তা।
পরবাস : আপনার লেখার যে প্রধান অংশটা, সেটা স্মৃতিমূলক/স্মৃতিনির্ভর। আর এমনিতে ক্রিয়েটিভ লেখা বলতে আমরা যা বুঝি সেগুলিতে কল্পনার একটা বড়ো জায়গা থাকে। যখন আপনি লিখতে শুরু করছেন বা লেখার কথা ভাবছেন তখন এই স্মৃতি এবং কল্পনা, এর তো একটা দ্বন্দ্ব আছে, কীভাবে এর মোকাবিলা করলেন?
মিহির সেনগুপ্ত : হ্যাঁ, এটা নিয়ে অনেকেই আমাকে জিগ্যেস করেন তবে ঠিক এরকম পরিষ্কারভাবে আমাকে কেউ জিগ্যেস করেননি। আমার নিজের যে ধারণা তাতে সব লেখকই স্মৃতিনির্ভর লেখক। স্মৃতি ছাড়া কোনো কিছুই হয়না। স্মৃতি, শ্রুতি এগুলি আমাদের সভ্যতার প্রাথমিক স্তর থেকে শুরু হয়েছে। তারই লিখিত রূপে আমরা পরবর্তীতে পুরাণ এবং আরো অনেক কিছু পাই। কল্পনাও স্মৃতিমূলক। বিশেষ করে যে লেখাগুলির কথা আপনি বললেন , সেটাও কিন্তু স্মৃতির বাহক হিসেবেই আসছে। আমার এখন সঠিক মনে নেই, তবে গাবরিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ এ সম্বন্ধে একটা ভালো কথা বলেছেন। সেটা হল স্মৃতি হচ্ছে সর্বোত্তম রচনা। এবং যা ঘটে সেইটেই শুধু স্মৃতি নয়, তাকে অতিক্রম করে অনেক কিছু রচনায় এসে যায় যেগুলো ঠিক ওই বাস্তব স্মৃতি নয়। আমি এত বড় চিন্তার কথা বলতে পারব না, কিন্তু আমার ধারণা বেশিরভাগ ভালো লেখা, ভালো বই, পুরোনো আমলের যেসব ক্ল্যাসিক্যাল আখ্যান— প্রায় সবটাই স্মৃতিনির্ভর লেখা। হয়তো সেখানে উত্তম পুরুষের জায়গায় প্রথম পুরুষ ব্যবহৃত হচ্ছে। বা কোনো নাম , থার্ড পার্সন হয়তো সেটা। আমার যেটা ত্রুটি এবং এটা দেবেশদাও আমাকে কয়েকবার অভিযোগ করেছেন যে, ‘আপনি ওই আমি আমি না করে একটা নাম-টাম দিয়ে দেন না। তাহলেই তো...’। আমি বলেছিলাম এই মিথ্যাচারটা আমি করতে পারব না।
পরবাস : তাহলে একটা উপন্যাসের ফর্ম পায় আর কি ....
মিহির সেনগুপ্ত : হ্যাঁ, প্রথম কথা হচ্ছে যে আমি লিখতে গেলে সেটা ভালো হোক কি খারাপ হোক আমার মাথায় চিন্তা একটাই থাকে সেটা হচ্ছে যে আমি একটা লেখা লিখছি, যে-লেখা আমার জীবনের ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত। হ্যাঁ, সেখানে হয়তো কথার ছলে কিছু কথা, চুটকুলা আসতে পারে। সেগুলো যেসব ঘটনা হয় তাও নয়। স্মৃতি জীবনের একটা পার্টিকুলার বয়স পর্যন্ত আকর্ষক থাকে। যতদিন পর্যন্ত মানুষের মুগ্ধ হবার বয়সটা থাকে। এই মুগ্ধতা যখন Reason-এ পর্যবসিত হয়ে Converted হয়ে যায় তখন কিন্তু সেটা বিবরণ হয়ে যায়। আমার নিজের যেমন ‘বিষাদবৃক্ষ’-এর দ্বিতীয় ভাগটা লিখে তৃপ্তি হয়নি, তার প্রধান কারণ হচ্ছে যে সেটা যতটা শুকনো ন্যারেটিভ, ততটা জীবনকেন্দ্রিকতা তার মধ্যে প্রকাশ করতে পারিনি।
পরবাস : ঠিকই ‘বিষাদবৃক্ষ’-র প্রথম যে অংশটা আমরা পড়েছিলাম সেটার মধ্যে যাঁর স্মৃতি পড়ছি আমরা, তার যে স্মৃতি নিয়ে একটা মুগ্ধতাবোধ সেটা দ্বিতীয় খণ্ডে এসে Converted হয়ে যাচ্ছে একজন তুলনামূলকভাবে বয়সে বড় মানুষের জীবনদৃষ্টিতে। ফলে সেখানে সে বিশ্লেষণ করছে। বোঝবার চেষ্টা করছে যে এটা কেন হয়। এর ফলে দুটো লেখার মধ্যে একটা তফাত এসে যায়। মানে দু-খণ্ডের মেজাজে সঙ্গতি রক্ষা একটু অসেতুসম্ভব।
মিহির সেনগুপ্ত : ঠিক তাই অসেতুসম্ভব। এই সেতুবন্ধন করাটা খুবই মুস্কিল। একেবারেই ভাঙা সেতু। আমার যেটা মনে হয় যে জীবনের একেবারে বাল্য বা শৈশব পর্যায় থেকে তার জ্ঞান হওয়া পর্যন্ত, তখন তার মধ্যে যে রহস্যময়তা , যেমন চারদিকে যা দেখছে, যা ব্যবহার পাচ্ছে, সুখ-দুঃখ ইত্যাদি, এই যে অনুভূতিগুলো— এর প্রতি যে রহস্যময়তা এর একটা নির্ধারিত সীমা আছে। আপনারা ধরুন রবীন্দ্রনাথের ‘জীবনস্মৃতি’। কত বছর বয়স অবধি লেখা? ২৫ বছর। অন্যান্য অনেকেরই, এই ধরুন বিভূতিভূষণের অপু বা পথের পাঁচালী।
পরবাস : মণীন্দ্র গুপ্তের ‘অক্ষয় মালবেরি’ ...
মিহির সেনগুপ্ত : মণীন্দ্রবাবুর এই বইটা নিয়ে আমার কথাও হয়েছে। উনি ডেকে পাঠিয়েছিলেন আমাকে।
পরবাস : ‘অক্ষয় মালবেরি’ যেখানে শেষ হচ্ছে, উনি মিলিটারির চাকরিটা ছেড়ে জীবনে সবে প্রবেশ করলেন...
মিহির সেনগুপ্ত : হ্যাঁ, আমি জানি। ওর থেকে ভালো স্মৃতিকথা আমি পড়িনি। ‘অক্ষয় মালবেরি’র প্রথম অংশ বিশেষ করে। অরণির [বসু] সঙ্গে টেলিফোনে আমার কথাও হয়েছে অনেকবার এই বই পড়ার মুগ্ধতা নিয়ে। ওই বয়সটা পেরিয়ে গেলে মুগ্ধতাটা অনুভব করা যায় না। এর পরের যে অংশগুলো ভালো লাগছে অবশ্যই কিন্তু ওই মুগ্ধতা নেই। মণীন্দ্রদা অসাধারণ লেখক। আমরা হতভাগ্য যে সেই মানুষটিকে যথাসময়ে যথোচিত মর্যাদা দেওয়া হয়নি। সেটা আমি একটা মিটিং-এ বলেছিলাম ওঁর সামনে। সেটা হয়েছিল জওহরলাল নেহরু চিলড্রেন্স মিউজিয়ামে। সেই সভায় অশ্রু সিকদারসহ আরো অনেকে ছিলেন। মণীন্দ্রদাকে সেখানে ইদানীংকালের লেখক-লেখিকারা বোধহয় একটা সম্বর্ধনা দিয়েছিল। কবিতাই ছিল তাদের আগ্রহের কেন্দ্র। আমি কবিতার পাঠক নই, কিন্তু আমি অশ্রু সিকদারকে বললাম যে আমি দুটো কথা বলতে চাই মঞ্চে দাঁড়িয়ে। উনি বললেন, তা আসুন। তখন আমি মঞ্চে দাঁড়িয়ে বললাম যে এই লোকটি [মণীন্দ্র গুপ্ত] এতকাল ধরে লিখছেন, তাঁর এত বয়স হয়েছে, আমাদের সরকারি বা বেসরকারি, কী আনন্দবাজার গোষ্ঠী, কী বামফ্রন্ট, আজ পর্যন্ত এই মানুষটির পরিচিতি কাউকে জানিয়েছেন? এখানে বোধহয় অনেকেই উপস্থিত আছেন। এইরকম মুখ-কাটা কথা বলায় আমার খুব খ্যাতি আছে, যে জন্য আমায় জেলও খাটতে হয়েছিল।
পরবাস : আমি আরেকটু পেছন দিকে যাব। স্মৃতি যে সাহিত্যের পক্ষে খুবই জরুরি উপাদান সে আপনি বললেন এবং পরবর্তী সময়ের যে স্মৃতিটা যখন কিনা Reasoning এসে মানুষের মাথায় বাসা বাঁধছে তখন সেই স্মৃতিমূলক লেখাকে ভালো লেখায় উন্নীত করতে একটু সমস্যা তৈরি করে। বা বলা যায় সংযোগ তৈরি করা যায় না। কিন্তু যে স্মৃতি ভালো লেখা তৈরি করতে পারে, যেমন ‘বিষাদবৃক্ষ’-য় হয়েছে, তখনও কিন্তু আপনি বালকই। এই স্মৃতিটা তো শুধু আপনার স্মৃতি নয়। এটাকে আমরা এক অর্থে বলতে পারি একটা কালেক্টিভ স্মৃতি।
মিহির সেনগুপ্ত :
‘বিষাদবৃক্ষ’-তে আমি জীবনের দশটা বছরের স্পেস নিয়েছি। ১৯৫০-৫২ থেকে ১৯৬০-৬২ এই পিরিয়ডটা প্রথমপর্ব। এই সময় আমার বয়স হবে কত? খুব বেশি হলে ১৪ বছর থেকে ২৪ বছর। কিন্তু সেই তৃপ্তিটা আমার পরবর্তী যে অংশগুলো আমি লিখেছি তাতে আসেনি। এই যে দশ বছরের স্মৃতি এটা সম্পূর্ণ কালেক্টিভ স্মৃতি। এবং ওখানে তো শুধু আমার ব্যাক্তিজীবনের আত্মকথা লিখিনি। আমি লিখেছি যে অঞ্চলটুকু নিয়ে, খুবই ছোট্ট জায়গা, একেবারে অজ গ্রাম এবং যে-গ্রামটা ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে ৫০-এর দাঙ্গার পর। অথচ সেখানে কোনো দাঙ্গা হয়নি। এখান থেকে আমার ট্রমা শুরু। এটা বলতে গেলে এখনও আমার ইমোশন কাজ করে। এটা কী কষ্টকর পর্যায়, যার জন্য আমি কখনোই বলতে পারি না আমাদের মেরে তাড়িয়ে দিয়েছে। কক্ষনোই বলতে পারি না। এবং সেটা আমার বিভিন্ন লেখায় এবং বক্তৃতায় আমি বার বার বলেছি। একটা সাজানো গোছানো আধুনিকতাযুক্ত গ্রাম, যে-গ্রামে দুটো থিয়েটারের মঞ্চ আছে, পাবলিক হাইস্কুল আছে, পাবলিক খেলার মাঠ আছে। গার্লস ইস্কুল আছে, সেলাই ইস্কুল আছে, এইসবগুলো আমি কয়েকটা দিনের জন্য দেখেছি। এগুলো আমার কাছে সব ছায়ার মতো স্মৃতি, তারপরে যেগুলো সব আস্তে আস্তে বিলীন হয়ে গেল। কীভাবে এবং কেন। এবং তার জন্য শুধু একটাই সম্প্রদায় দোষী এই চিন্তাটা কখনো আমার মাথায় আসেনি।