মিহির সেনগুপ্ত বাংলা ভাষার এক আশ্চর্য লেখক, যিনি তাঁর আত্মজৈবনিক রচনা সমূহে বাংলা স্মৃতিসাহিত্যের খালে জোয়ারের স্ফীতি এনে দিয়েছেন। ছিন্নমূল মানুষের যন্ত্রণা আর জীবনের নড়ে যাওয়া ভরকেন্দ্রের কাহিনি নেহাৎ কম নেই। তবু সেই সব কাহিনিতে কোথাও খানিক নৈর্ব্যক্তিক দূরত্ব, কোথাও মনের মাধুরীর টানে আবেগের স্রোতে ডুবুডুবু শান্তিপুর। কিন্তু জীবনের মাদারিকা খেল দেখতে দেখতে বেড়ে ওঠা মিহির সেনগুপ্ত জীবন সম্পর্কে অদ্ভুত এক প্রশান্ত দৃষ্টিভঙ্গি অর্জন করেছেন। কোনো অভিযোগের ত্রিসীমানায় না থেকে বরং ধরেছেন স্মৃতির হাত। যে-স্মৃতি বাঙালির গত সত্তর বছরের সমষ্টিগত স্মৃতিরই অংশ।
সদ্য-শরতের এক দুপুরে লেখকের ভদ্রাসনে পরবাসের পক্ষে হাজির হয়েছিলেন শ্রীকুমার চট্টোপাধ্যায়, অরণি বসু, রাজীব চক্রবর্তী আর সিদ্ধার্থ সেন। গোটা দুপুর জুড়ে চলল স্মৃতিযাপন। পরবাসের পাতায় কয়েক কিস্তিতে সেই কথাবার্তা।
পরবাস : কিন্তু আপনি তো একটা তত্ত্বের কথা বলেন, আপনি লিখেছেন সেকথা, যে আমাদের বাংলাতে যখন ইসলাম এলো, সে প্রায় এক হাজার বছর আগে। তখন ইসলামের প্রসার যেভাবে হয়েছিল তাতে আঁটোসাঁটো বাঁধুনিটা অনেক কম ছিল তুলনায়। এবং বিশেষ করে আমাদের লোকসাংস্কৃতিক যে পরিসর সেই পরিসরে আমরা একে অপরের ঘনিষ্ঠ হতে পারছিলাম। একটা যৌথ সাংস্কৃতিক জীবনও ছিল আমাদের। কিন্তু সেটা, বিশেষ করে আয়ুব খানের সময়, ৫২ থেকে মোল্লাতন্ত্র এসে আরো গভীরে প্রবেশ করতে শুরু করল।
মিহির সেনগুপ্ত : না, অ্যাকচুয়ালি মোল্লাতন্ত্রের শুরুটা হয়েছিল ওয়াহাবি আন্দোলনের সময় থেকে। কিন্তু আমাদের ওইসব অঞ্চলকে সেটা স্পর্শ করতে পারেনি। হ্যাঁ, তবে অনেক কিছুই হয়েছিল। মুসলমানদের ধর্মটা আলাদা এটা আমরা বরাবর জানি। আর খাদ্যাখাদ্যের ব্যাপারটাও আলাদা ছিল। কিন্তু ওই যে এক সম্প্রদায় 'হরে কৃষ্ণ হরে রাম' করছে, বা মনসার গীত গাইছে। সেখানে মুসলমান সমাজের লোকরা সবচেয়ে বেশি যাচ্ছে। এই ব্যাপারগুলো আস্তে আস্তে ... তোমাদের স্মরণ থাকতে পারে যে জারি গানের আসরে বসে রিয়েলাইজেশন হচ্ছে আমার যে এইটা এই গানের পদ নয়। একটু বড় হয়ে খুঁজে পেতে বার করি ঢাকা অ্যাকাডেমির সেই বই, সেখানে দেখলাম ঠিক পাকিস্তান পিরিয়ডের একটা পার্টিকুলার সময়ে ওই চেঞ্জগুলো তৈরি করা হয়েছিল এবং পারপাসফুলি। জারিটা প্রধানত মুসলমান কালচার থেকে আসছে। মূলত কারবালার ঘটনা। বা নমরদ বাদশার কাহিনি বা রহিম বাদশার কাহিনি এইরকম কাহিনিমূলক।
আমাদের বাড়িতে পুজো হোত। সেগুলো আমরা দেখিনি, আমাদের জন্মের আগে হোত। তবে পরে যেটা দেখেছি সেটা হচ্ছে যে অন্যান্য কালচারের অনুষ্ঠান হত বিজয়া দশমীর দিন। আর এটা হয়ে গেলে তারপর সামনের মাঠের মধ্যে ওইখানেই জারির আসর বসত সারা রাত ধরে। সেই জারি আমি শুনিনি, কারন অত রাত অবধি জেগে থাকার বয়স ওটা ছিল না। সারারাত ধরে সেগুলো হোত। সেটা কিন্তু হিন্দুর জায়গা। মানে আমরা তখন তথাকথিত জমিদার ইত্যাদি, সাধারণত যারা গণ্ডগোলটা লাগায়। কোনো অসুবিধে হয়নি, কিচ্ছু হয়নি। সবাই উপভোগ করে চলে গেছে। বড় হয়ে যখন এখানে আসি, তখন আমার ১৫-১৬ বছর বয়স হয়েছে। আমি ইন্টারমিডিয়েট ফাস্ট ইয়ার পড়ি। তখনো এই ব্যাপারপগুলো চালু ছিল। যাত্রা, রয়ানি (মনসার গান), জারি, মারফতির আসর এগুলো কিন্তু উভয় সমাজ ইক্যুয়ালি শেয়ার করত। পরে যখন আমি ১৯৭২ সালে গেলাম ওখানে। মানে দেশ স্বাধীন হবার কয়েকদিন বাদে গেছি। এই ভদ্রমহিলাকে (নিজের স্ত্রীকে দেখিয়ে) বিয়ে করার জন্য। অবশ্য তার আগেই উনি একেবারে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সরাসরি অফিসে এসে বসেছিলেন। তা হঠাৎ আমি একটু হকচকিয়ে গেছি। আমাকে বলল কি হল ভূত দেখলে নাকি? আমি বললাম, না পেত্নী আপাতত। (হাসি) আমাদের বিয়ে হয়েছে বাহাত্তর সালে। সেইসময় আমি গিয়ে এক মাস ছিলাম। ওই এক মাসে আমি আমার যুদ্ধ-বিধ্বস্ত অঞ্চলকে দেখি। আমি একটা বই লিখেছি, এদেশে প্রকাশ হয়নি সেটা। দু-তিনবার অ্যাটেম্পট নিয়েছি অন্য নাম নিয়ে কিন্তু হয়নি। বইটির নাম 'মহামাতৃকার জনপদ'। আমি কিছুদিন আগে দেবজ্যোতি দত্তকে (সাহিত্য সংসদ প্রকাশনার কর্নধার) দিয়ে এসেছি তিনটি বই নিয়ে একটি কালেকশন করতে, যাতে এই বইটি প্রধান। এই বইতে আমরা যে কথাগুলি আলোচনা করছি সেগুলি তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। সেখানে হয়তো কিছু কথার রিপিটেশন আছে। স্মৃতির ব্যাপারে সেগুলো থাকবে।
পরবাস : আপনি যে বিজয়া দশমীর সময় আসরের কথা বলছিলেন সেখানে কীর্তন-ও তো গাওয়া হত। বাতাসাও হরির লুট দেওয়া হত...
মিহির সেনগুপ্ত : হ্যাঁ। কীর্তনে সর্বস্তরের মুসলমান শ্রোতাদের উপস্থিতি থাকত এবং তারা ওই হরির লুটের বাতাসাও কুড়োতো। এটা বোধহয় আমি বিষাদবৃক্ষেই বেশি দেখিয়েছি। যে শীতলা বা কালীর থানে গ্রামের মহিলারা পুজোর পরে গান গাইছেন। আমার মায়ের স্মৃতিতেই লিখেছি সেকথা।
পরবাস : মানে রাষ্ট্রীয় একটা নক্শা ছিল, যে এটাকে ভাঙবার?
মিহির সেনগুপ্ত : এটাকে ভাঙবার নক্শাটা মোল্লারাই করেছে। তারা যখন সুবিধে পেয়েছে আয়ুব খান সবচেয়ে বেশি করেছে।
পরবাস : কিন্তু এটাও তো সত্যি, আপনিও লিখেছেন যে হিন্দু সামন্ত যারা ছিল, যেমন তার একজন প্রতিনিধি আপনার জ্যাঠামশাই। তাঁরাও যে খুব দয়াবান মানুষ ছিলেন এমনটাও নয়।
মিহির সেনগুপ্ত : না, একদমই নয়। এখানে আমি তো কোনো পক্ষা-পক্ষীর কথা বলিনি। তুমি তপন রায়চৌধুরীর সমালোচনাটা পড়েছিলে?
পরবাস :হ্যাঁ।
মিহির সেনগুপ্ত : তাতে লাস্ট লাইনে উনি বলেছিলেন যে গৈরিকপন্থীদের এতে উল্লসিত হবার কারন নেই তাতে খুব একটা সুবিধে হবে না। কারন এটার মূল সুর হচ্ছে মানবতাপন্থী। তো সেখানে আমার জ্যাঠামশাই বলে, বা আমার বাবা বলে তো কোনো ভিন্নতা নেই। আমার জ্যাঠামশাই একটা প্রতিনিধি চরিত্র। আমার বাবার হাতে ক্ষমতা থাকলে তিনিও হয়তো ওইরকমই ব্যবহার করতেন। কিন্তু সেখানে আমি এক্সেপশনালি ভাগ্যবান যে তিনি সেটা হননি। তাতে আমার অনেক সুবিধে হয়েছে।
পরবাস : এবার আমি একটু জাম্প করব, তারপর তো আপনি বড় হলেন, কলকাতার দমদমে এলেন। কলেজে ভর্তি হবেন, সে সমস্ত গল্পগুলো আমরা পড়েছি আপনার লেখা থেকে। তারও অনেক পরে আপনি লেখক হলেন। মানে এই যে লেখক হিসেবে আপনি নিজেকে ভাবছেন, যে এইবার আমি কিছু এক্সপ্রেস করতে চাই, কিছু লিখতে চাই এই সময়টা আমরা একটু জানতে চাইব।
মিহির সেনগুপ্ত : শ্রীকুমার এই কথাটা বলতে আমার খুব কষ্ট হবে। কষ্ট হবে এইজন্য যে আমি একটা ট্রমার কথা বলছি মাঝে মাঝে। এই ট্রমাটা কিন্তু ওখান থেকে শুরু হয়েছে। সমবয়সী ছেলেপুলেরা হঠাৎ হঠাৎ দেখা যাচ্ছে যে নেই। মানে সঙ্গীসাথী, খেলার সাথী কেউ নেই। কোথায় যাচ্ছে তারা! কাদের সাথে খেলব, কাদের সাথে মিশব, কাদের সাথে স্কুলে যাব? স্কুলে যাওয়া হচ্ছে না। এখান থেকে একটা ট্রমার সৃষ্টি হল।
পরবাস : মানে আগের দিন বিকেলে যার সঙ্গে খেললাম পরের দিন স্কুলে যাবার সময় তাকে দেখতে পাচ্ছি না।
মিহির সেনগুপ্ত : শুধু দেখতে পাচ্ছি না, তাই নয়। জানতে পারছি যে তারা দেশ ছেড়ে হিন্দুস্তান চলে গেছে। অনেক পরে 'নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে' পড়তে গিয়ে এইরকম ঘটনার উল্লেখ পাই। "জ্যাঠামশাই আমরা হিন্দুস্তান চলিয়া যাইতেছি"। আর কারুর লেখায় তো দেখিনি। প্রফুল্ল রায়ের লেখায় কিছু কিছু আছে। যাইহোক এই ট্রমাটা ছোটবেলা থেকে আমার মনে একটা মেলানকোলিয়ার জন্ম দিয়েছিল। আমি তার থেকে কিছুতেই উত্তরণ পাচ্ছিলাম না। এমনকী আমি খুব অকপটে বলছি যে 'অ্যালকোহলিক ডিপ্রেশন' যাকে বলে, যে রোগ থেকে সাধারণত লোকেরা বাঁচে না, সুইসাইড অবধারিত, সেই পর্যায়ে চলে গেছিলাম। আমাকে মেন্টাল অ্যাসাইলামে ভর্তি করা হবে এইরকম অবস্থা। এর থেকে কিছুতেই বেরোতে পারছি না। তখন আমি মদ খাচ্ছি। অফিসে বসে মদ খাচ্ছি। সেসময়েই আমি ভাবলাম কিছু লেখা দরকার। সারাদিনের মধ্যে বেশিরভাগ সময় আমি বুঁদ হয়ে থাকছি। তারই মধ্যে লিখছি, অফিসের টেবিলে কাজ করার সাথেই আমি 'বিষাদবৃক্ষ' লিখছি। ড্রয়ারে খাতা রেখে লিখছি, সামনে মহিলারা বসে আছেন। মানে স্কুলের হয়তো মাইনে হয়েছে, তাঁরা এসেছেন। আমি তখন বর্ধমানের সাতগাছিয়ায় পোস্টেড। বইটা যখন আমি লিখছি তখন সামনে কাজ, কাউকে তো ওয়েটিং-এ রাখা যায় না। বেশিরভাগই এইরকম মাইনে-টাইনে তুলতে এসেছে। তাদের রেকর্ড দেখে সব দিতে হবে। পেনশনের টাকা দিতে হবে, এইসব ধরনের কাজই আমার ছিল। তখন আমার এক কলিগ, নামকরা লোক। মানে উয়াড়ি ক্লাব না কি একটা ফুটবল ক্লাব ছিল, দেবী দত্ত বলে একজন খুব ভাল নামকরা প্লেয়ার ছিল। দেবী আমাদের সঙ্গে ব্যাঙ্কে কাজ করত। ও মাঝে মাঝে এসে আমার পেছনে দাঁড়িয়ে ওই খাতাটা দেখত। ও পড়ত, যদিও ও লেখাপড়ার লোক নয়, তবুও বলত তোর লেখাটা খুব ভাল হচ্ছে। ও বলত তুই এক কাজ কর, পেছনে ওই ফাঁকা জায়গা আছে ওখানে গিয়ে বোস। আমি ম্যানেজারের সঙ্গে গপ্পো করে তোর টেবিল দেখে দিচ্ছি। বইটা যেদিন আমি শেষ করলাম আই গট রিলিভড। ভূমেনদা একটা ভালো কথা বলেছিলেন, "বিষাদবৃক্ষ আপনাকে দুটো জিনিস দিয়েছে। একটা নেশামুক্তি, আর কিছু টাকাও দিয়েছে।" পুরস্কারের কথাটা বলেছিলেন উনি।