।। ১ ।।
বালতিটা বাথরুমের দরজায় ঠং করে নামিয়ে দিয়ে কানুর মা বলল, এই যে, গরমজল রইলো। কিন্ত এই কাত্তিক মাসের ভর সন্ধেবেলা নেয়ে তারপর সান্নিপাতিক হয়ে পড়ে থাকলে কিন্তু বৌদি চটবে, এই বলে রাখলুম। লোকে বলে সর্বজীবে নারায়ণ, আপোনার দেখি সর্বজীবে পোকা।
নিতাই গায়ে মাখলো না ঠেসটা। পুরনো লোক, খুব বিশ্বাসী, তার মায়ের আমল থেকে এবাড়িতে কাজ করছে। বলল, কিন্তু বৌদি গেল কোথায়?
—সে জানি নে। সেই বৈকালে বেরিয়েছে, বলে গিয়েছে তুমি এলে চা-জল দিয়ে তবে ঘর যেতে। আর হ্যাঁ, তোমার কাছে একশটা ট্যাকা হবে? কানুর বাপের জ্বর। মাইনে থেকে কেটে নিও।
—আচ্ছা, নিস। বৌদির ঠেঙে তো চাইতে পারতিস।
—সে যা হুটোপাটি করে বেইরেছে। চাবো কমনে?
একটা শ্বাস ফেলে চানঘরে ঢুকে গেল নিতাই। ক’মাস ধরেই খুব ছুটোছুটি করছে সবিতা, জিজ্ঞেস করলে মুখ টিপে হাসে, বলে দেখোই না, বলব’খন, কদিন পরে। আসলে সবিতার চিরকাল খুব ইচ্ছে নিজে কিছু একটা করবে। একটা অর্থনৈতিক স্বাধীনতা না থাকলে, আজকাল কি কারো ভাল লাগে? কিন্তু হাই ইস্কুলের বিদ্যে নিয়েই বা কোন ডাঙর চাকরি পাওয়া যায় আজকাল, ঘরে ঘরে কত গ্রাজুয়েট পচছে দ্যাখো গে। সবাই তো আর সঞ্জয় না!
সবিতা একগাদা কথা বলে যায়, যা নিতাই শুনেও শোনে না...গ্রাজুয়েট হলেই বা কী হবে, বড়শালি বাবলির স্বামী সঞ্জয় পুরসভায় কি একটা ছোটোখাটো চাকরি করে, এদিকে একটা বড় গাড়ি লোন নিয়ে কিনেছে, সেটা ভাড়াও খাটায়, অবরে-সবরে নিজেরাও চড়ে। তাছাড়া ওরা ঘড়িঘড়ি বেড়াতে যায়, এই আরাকু ভ্যালি তো এই লাভা-লোলেগাঁও কি নৈনিতাল...বাবলির গাদা গাদা দামি শাড়ির গল্পও নিতাইকেই শুনতে হয় ঘরের লোকের কাছে...
সবিতা কখনো-সখনো বোনের শাড়ি-গয়না ধারও নেয়, বিয়েবাড়ি-টাড়ি যেতে হলে ...এটাও নিতাইর একদম পছন্দ না। পছন্দ নয় বাবলিদের জীবনধারাও। তাছাড়া অন্যের জিনিষপত্র ব্যবহার করার কথা নিতাই ভাবতেই পারে না। ওসব হারালে, বিগড়োলে কিনে দেবে কোথা থেকে? অথচ এই একটা ব্যপারে সবিতা তাকে একদম মান্যি করে না। প্রতিবাদও না।
কাজেই সে শাড়ির ব্যবসাই হোক, রান্নার ক্লাস কি বিউটি পার্লারের কাজই হোক, কিছু একটা করে সবিতা যদি খুশি থাকে, আপত্তি নেই নিতাইপদর...অন্তত শাড়ি-গয়নার স্বল্পতা নিয়ে বিব্রত হবার সময় সে পাবে না, আরো ভালো হয এই কাজে যদি বাবলি বা সঞ্জয়ের কোন ভূমিকা না থাকে।
ছোটবেলা থেকেই নিতাই পিটপিটে, ডেটল, সাবানের খরচ তার একটু বেশিই। এই প্রোটোজোয়া-ব্যাকটিরিয়া-ভাইরাস সঙ্কুল পৃথিবীতে নিজেকে রোগমুক্ত রাথতে বার বার সাবান দিয়ে হাত ধোওয়া, কাপড়জামা দৈবাৎ কখনো ধোপাবাড়ি ঘুরে এলে আরেকপ্রস্থ শুদ্ধিকরণ, এসব ছাড়া উপায় কি আর, কিন্তু সম্প্রতি এর সাথে যোগ হয়েছে পটাশ পারম্যাঙ্গানেটের জলে বাজারের শাকসব্জি প্রক্ষালন। বয়স বাড়ার সাথে সাথে তার বাতিক বেড়েছে বই কমে নি।
তাছাড়া আজকাল একটা অন্য ব্যাপার হচ্ছে। সে হঠাৎ-হঠাৎ সেই নীল মাছির মত পোকাটাকে দেখতে পাচ্ছে। সিনেমার ছবির মত স্পষ্ট—তেলাপোকার মত চকচকে অথচ গাঢ় নীল-সবুজ ময়ূরকণ্ঠী রঙের পোকাটা ছেতরে মরে আছে, লোমশ শুঙ্গদুটি তখনও একটু একটু নড়ছে, তার পেটের ভেতরের মালমশলা এক খাবলা বাটা জিরের মত লেপ্টে আছে হাফপ্যান্ট পরা কিশোর নিতাইর অনাবৃত হাঁটুতে – আর মনে পড়তেই শিউরে ওঠে নিতাই। গা-গুলিয়ে ওঠা সুন্দর মাছির মত পোকা। পোকামাকড় সম্পর্কে তার ঘেন্না আর অবিশ্বাসের সেই শুরু।
আসলে ঠিক মরে পড়ে থাকাও বোধহয় বলা যায় না। তার সেদিন কেমন যেন মনে হয়েছিল পোকাটা মরে গিয়েও তার দিকেই চেয়ে আছে, দৃষ্টির মাধ্যমেই যেন ঢুকেই পড়তে চাইছে তার শরীরে। জমাটি যাত্রার আসর ছেড়ে বাইরে উঠে এসে হড়হড় করে বমি করে ফেলেছিল সেদিন।
আজকাল হরবখত তার মনে হচ্ছে সেই কিশোর বয়সে দেখা সেই নীল পোকা যেন তার বুকে পাথরের মত চেপে বসে তার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে। এরকম ভাব শুধু দুঃস্বপ্নে হলেও কথা ছিল, অনেক সময় তার আশেপাশের লোকজনকে দেখেও এরকম হচ্ছে।
তার ধোওয়া-ধুইয়ির বাতিক নিয়ে তার সহকর্মীরা, আত্মীয়স্বজনরা, পাড়ার লোকেও খোলাখুলি হাসি ঠাট্টা করছে আজকাল। আপিসে ট্যাক্সেসন ডিপার্টমেন্টের কৌশিক দত্ত তার সেকশনে এসে তারই সামনের চেয়ারে বসে সবাইকে শুনিয়ে শুনিয়ে ছদ্ম-সমর্থনে বলবেই, না দাদা, আপনিই ঠিক। আমাদের জীনের মধ্যে অন্ততঃ পাঁচ পার্সেন্ট অমানুষের ভেজাল আছে, জানেন তো! অন্যদের মুখে চাপা হাসি দেখতে পেলেও নিতাই জানে, এসময় রাগ করতে নেই। আরো বিনয়ে বিগলিত হয়ে বলে, ভাই, আমার জন্য তোমাদের খুব অসুবিধা, তাই না? ব্যস্, তাতেই মামলা অন্যদিকে ঘুরে যায়। আরে না না, দাদা, আপনি একটু ঠাট্টাও বোঝেন না, ইত্যাদি, প্রভৃতি। নিতাইও মনে মনে হাসে, ভেজাল যে আছে, নিয়তই ঘটছে, তা যদি জানোই তবে আর খামোকা আমার পেছনে লাগা কেন বাপু!
কেউ কেউ আবার কোন হলিউড ছবির গল্প শুনিয়ে দেয়, যেখানে নাকি একটা মানুষের মধ্যে মাছির জিন ঢুকে গিয়ে মানুষটায় মাছির মিশেল ঘটে গেছিলো। নিতাই হলিউডের ছবি না দেখলেও ঠিকই বোঝে, এ সবই তাকে অপদস্থ করার, হ্যাটা করার কায়দা।
মানুষের, জীবাণুর ছোঁয়াচ লাগার সব সম্ভাবনা এড়িয়ে চলবার তাগিদে আজকাল সে বাড়ি থেকে আপিস হেঁটেই যাতায়াত করে, বাসে ট্রামে উঠে পাশের লোকটির ঘেমো জামার গন্ধ নাকে এলেই তার গা গুলিয়ে ওঠে। তাছাড়া ঘাড়ের কাছে ফেলা নিশ্বাসে যে কি বিষ রয়েছে তা কে জানে।
আত্মীয়স্বজনের বাড়ি যাওয়াও আস্তে আস্তে কমে এসেছে। ট্যাক্সি খরচসাপেক্ষ, তাছাড়া বিয়ে পৈতে শ্রাদ্ধবাড়ির ভিড় আর তার বরদাস্ত হয় না আজকাল। তাছাড়া নিজের লোকজনও যদি তার সমস্যার কথা তুলে আড়ালে মুখ টিপে হাসে, সেটা সহ্য করাও মুশকিল।
বাবলি-সঞ্জয়দেরও বিশেষ পছন্দ না করার একটা কারণ সেটাই। সঞ্জয়দের গাড়ি কেনার পর সবিতারও খুব ইচ্ছে হয়েছিল একটা গাড়ির — লোনের ব্যাপারে বাবলির কাছে জানতে চেয়েছিল। বাবলি নাকি সেসব বলার আগেই হেসে অস্থির, আরে কোন মডেলের গাড়ি কিনবি সেটা আগে ভেবে নে দিদি, জাঁইবুর জন্য তো গাড়ির ছাদে একটা জলের ট্যাঙ্কও লাগাতে হবে, নইলে হাত ধুতে ধুতে যাবে কিভাবে? সবিতা সেবারই প্রথম দিন সাত আট বাবলিকে ফোন পর্যন্ত করেনি। কিন্তু সেই সাতদিন কথা বলেনি নিতাইর সাথেও। নিতাই এতসব ভেতরের কথা জানত না, সবিতার রকমসকম দেখে আঁচ পেয়ে, তারপর পেটের কথা বার করতেই বিস্তর ঝামেলা গেল তার। এসব কারণেই একলাটি থাকাই পছন্দ তার। ছোঁয়াচহীন।
চান করতে করতে বাথরুমের ফ্যাকাশে আলোয় নিরীক্ষণ করে নিল একবার। নাঃ, কাটাকুটি কিছুই নজরে পড়লো না তার, খালি কনুই থেকে কবজির লোমগুলো কি একটু শুঁয়োর মত বড় বড় লাগছে? ধুস, কি সব উল্টোপাল্টা ভাবছে সে! পোকাটা দিলে তার সব মাটি করে। নিজের গায়ের লোমেই বিভ্রম হচ্ছে দ্যাখো!
একমাত্র বরেনদার গলায় আজ অব্দি কখনো ব্যঙ্গের আভাস পায় নি নিতাই। অন্যরা প্রসঙ্গটা তুললেও কথাটা চট করে ঘুরিয়ে দেন। নিতাই পাড়ায় একমাত্র বরেনদার কাছেই কখনো সখনো দুদণ্ড গিয়ে বসে। একটু ভরসা, একটু প্রশ্রয় পায় বলেই না! মানুষটা সত্যিই অন্যরকম। পাড়ায় পৈতৃক বাড়ির দুই তলায় প্রায় তিরিশ-চল্লিশ বছর ধরে দুই ভাইয়ের বসবাস। বরেনদাকে দেখে কে বলবে ওনার জমানো টাকায় ছাতা পড়ে যাচ্ছে! ট্রান্সপোর্টের ব্যবসা ছাড়াও বরেনদার ধানকল, কোল্ড স্টোরেজ আছে বর্ধমান কি হুগলির দিকে কোথাও। গদীতে বসে সেসবের তদারক করা ছাড়া বরেনদার প্রধান কাজ পাড়ার রিটায়ার্ড অথবা নিষ্কর্মা মানুষদের সাথে আড্ডা। সকালে দশটা থেকে বারোটা একটা, আবার সন্ধ্যায় সাতটা থেকে নটা সাড়ে নটা পর্যন্ত বরেনদা সপার্ষদ আড্ডাধারী হয়ে বসে থাকেন।
অথচ, আজকাল বরেনদার আড্ডায় গেলেও কৌস্তুভ মণির মত সেই পোকাকে নিজের বুকের ওপর টের পাচ্ছে। বরেনদা লোক দিয়ে ডেকে পাঠিয়েছেন কয়েকবার, জানিয়েছেন দোকানে না হোক, বাডিতে গিয়ে যেন সে দেখা করে।
সবিতাও সেদিন কি একটা যেন বলছিল বটে, বরেনগিন্নি এসেছিলেন কথা বলতে, কিন্তু সেটা যে কী নিয়ে, ভাল করে না শোনার জন্য, এখন আর মনে নেই। সবিতাকে আবার জিজ্ঞেস করলে মুখঝামটা জুটতে পারে, তাই নিতাই আর ওসবে যাবে না। কালকে একবার সোজা বরেনদার কাছে গেলেই হবে।
পরের দিন যেতেই সাত-সকালে লুচি-তরকারি আর চা খাওয়ালেন বরেন-গিন্নি, বরেনদা ক্ষৌরি করতে করতে বললেন, আচ্ছা, নিতাই, বৌমার সাথে আমার গিন্নি কথা বলেছেন, তবুও তোমার একটা মতামত তো নিতে হয়, আমি বলি কি, তোমরা তো মোটে দুটি প্রাণী। তোমাদের বারান্দাওয়ালা সামনের ঘরটা ভাড়া দেবে? এ পাড়ায় একটা রক্ত পরীক্ষার ল্যাব হলে বিপদে আপদে...বুয়েচ না...।
অতি অবশ্য বুঝেছে নিতাই। বরেনদার মেয়ে জামাই দুজনেই ডাক্তার। প্যাথোলজিস্ট।
নিতাইর মনে হল সে সাতসকালে পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণ দেখছে। রক্ত-পেচ্ছাপ পরীক্ষার ডাক্তারের চেম্বার তার বাড়ির দাওয়ায়, সেখানে নানা টাইপের রুগি, তাদের নানান কিসিমের স্যাম্পেল, নানা আকারের শিশি আর কৌটোয়। তাছাড়া ছোট বাচ্চা, সামলাতে না পেরে বাহ্যে-পেচ্ছাপ করে ফেলেছে, কি বসে থাকতে থাকতে বুড়ো রোগি পটকেই গেল বুঝি হার্ট অ্যাটাকে...তাছাড়া রাজ্যের জীবাণু ঝাঁপিয়ে পড়েছে তার সামনের ঘরে ...সেখান থেকে উঠোন পেরিয়ে রান্নার ঘরে, শোবার ঘরে ...সেই দুঃস্বপ্নের পোকাটা যেন আবার বুকের ওপর চেপে বসে ঘরখানা অন্ধকার করে ফেলছে, ক্রমাগত জিভ ভেতর-বার করে আস্বাদ নিচ্ছে শিকারের। ওঃ মাথাটা কাজ করছে না কেন, যুৎসই একটা জবাবও আসছে না ঠোঁটের ডগায়, স্রেফ গলাটা বুজে গেছে। বরেনদা কি জানেন না এসবে তার কি ঘেন্না!
কোনোমতে নিতাই বলল, আচ্ছা দেখি। আমি না হয় আমার একবার ভায়রাভাইয়ের সাথে বিবেচনা করে দেখি দাদা। নিজের পায়ের নখ দেখতে দেখতেই নিতাই বুঝতে পারে বরেনদার মুখটা গম্ভীর হয়ে গেল। বরেনদা মুখে অবশ্য বললো, তাই হবে।
আপিসে সারাটা সকাল নিতাইর দারুণ উদ্বেগে কাটল। এমনকি বাড়ি থেকে বয়ে আনা রুটি আর বেগুন ভাজাও ছুঁতে ইচ্ছে হল না তার। কৌশিককে বলাতে সেও বলল, অমন কাজ করবেন না দাদা, না বলতে অসুবিধা, স্রেফ হাওয়া হয়ে যান, বৌদিকে বলুন কাল থেকে ওই ঘরেই মাদুর পেতে নার্সারির টিউশন শুরু করতে ....নইলে কদিন শ্বশুরবাড়ি থেকে আপিস করুন। না হয়, কদিন বেড়াতে চলে যান শিমুলতলা, ফিরে এসে আর দেখাই করবেন না, ভোরে আপিস এসে, নিশুতি রাত্রে বাড়ি ফিরুন।
টিউশন চলবে না, চলবে না শ্বশুরবাড়িও, কিন্তু শেষের প্রস্তাবটা মনে ধরলো নিতাইর। একটু ধাতস্থ হয়ে টিফিন খেয়ে, একঢোঁক জল খেয়ে, সবিতাকে বিস্তারিত জানাবে ভাবছে, এমন সময় সবিতাই ফোন করলো তাকে, কোনো ভূমিকা না করেই বললো, তুমি প্লীজ একখুনি বাড়ি চলে এসো। আমার খুব ভয় করছে। হতভম্ব নিতাই সেকশন ইন চার্জ সুধীরবাবুকে কোনোরকমে গিন্নির শরীর খারাপের মত কিছু একটা বলে বেরিয়ে পড়লো আপিস থেকে। সবিতার পাঁচ বছরে একদিন সর্দি হয় কি না সন্দেহ, সে তো বুঝতেই পারছিল না তার কি করণীয়, হঠাৎ কি এমন আকাশ ভেঙে পডলো।
পাড়ায় পৌঁছতে পৌঁছতে শীতের বেলা পড়ে আসছে। বরেনদাদের বাড়ির সামনে লোকে লোকারণ্য। পুলিশ, পুলিশের গাড়ি, আরো কি সব সরকারি দপ্তরের গাড়ি, সাদা পোষাকের সরকারি লোকজন, যাদের রোয়াব দেখেই বোঝা যায় এঁরা আদেশ দিতেই অভ্যস্ত, কথাবার্তা চালাতে না।
কোনোমতে এই জটলা কাটিয়ে গলির শেষে নিজের দরজায় কলিং বেল বাজালো সে। সবিতার কাঁপা কাঁপা গলার আওয়াজ ভেসে এল, কে? নিতাই একটু বিরক্ত হয়েই বলে, কে আবার, আমি!
সবিতা দরজা অল্প খুলে তাকে দেখেই প্রায় হিঁচড়ে ভেতরে টেনে আনে, দরজা বন্ধ করে দেয়।
নিতাই বলে, হয়েছেটা কি তোমার!
সবিতা বলে, কেন, তুমি দেখলে না আসার পথে? বরেনদার বাড়ি, গদীতে ইনকামট্যাক্সের লোকজন এসেছে পুলিশ-টুলিশ নিয়ে, তুমি আপিসে চলে যাবার একটু পরেই।
নিতাই আরো হতভম্ব হয়ে বলে তাতে আমাদের কি!
সবিতা এবার ফুঁপিয়ে ওঠে, ঘোষাল জ্যাঠা বলছিলেন পুলিশে নাকি খোঁজ নেয়, ওদের সাথে কাদের ওঠাবসা আছে, তেমন সন্দেহ হলে তাদের ব্যাপারেও খোঁজখবর...’
নিতাই তাকে থামিয়ে দেয়, আমার সঙ্গে ওঠাবসা নেই কারো। আর আমাদের আছেটা কি যে খোঁজখবর করে পাবে?
আছে, আছে। সবিতা ঠৌঁট কামড়ে উদ্গত কান্না চেপে রাখে কিছুক্ষণ, তারপর তার অর্গল খুলে যায়। চিটফান্ড। বরেন গিন্নি টোপ দিয়েছিলেন, নিজেও কিছু ঢেলেছিলেন... সে টোপ গিলেছিল। নিজের কষ্টে জমানো ব্যাঙের আধুলি ক’টি ঢেলেছে, চেনাজানা লোকের টাকা টেনে এনেছে। কানুর মা, মাছের বাজারের সুকান্ত... স্বল্প রোজগেরে কিন্তু স্বপ্নদেখা কিছু মানুষ, বাজারের চেয়ে বেশি সুদের লোভ ছাড়তে পারে নি। বৌদিকে বিশ্বাস করেছে। এরকম আরো অনেকে...
প্রথমদিকে সময়মত ফেরত দিতে পেরেছে, আস্তে আস্তে সে উৎস শুকিয়ে যাওয়াতে কয়েকমাস আতান্তরে পড়েছে। প্রথমে আড়ালে আবডালে ফিসফিস করে ফেরত চেয়েছে, তারপর জানাজানি হওয়াতে জোর গলায়...সবিতা দিশেহারা হয়ে কাল বরেনগিন্নির কাছে ছুটে গিয়েছিল...কোনও সদুত্তর পায় নি। আজকে বরেনগিন্নি বিশ্বস্ত লোককে দিয়ে গোপনে বলে পাঠিয়েছিলেন, তারা যেন কদিন গা-ঢাকা দিয়ে থাকে, সেরকম হলে তিনিই টিকিট কেটে চুপিচুপি পাঠিয়ে দেবেন, বোলপুর... কেষ্টনগর...যেখানে যেতে মন যায়। শুধু আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব কাউকে জানালে চলবে না।
নিতাইয়ের নিজের মাথার চুল ছিঁড়ে ফেলতে ইচ্ছে করে। ইস, এমন একটা ফেরেব্বাজিতে কিনা তারই বৌ জড়িয়ে পড়ল! সবিতা কি খবরের কাগজও পড়ে না! মাথাটা হঠাৎ ঘুরে গেল নিতাইর। ধপ করে মাটিতেই বলে পড়ল সে, ধুলো-ধোঁওয়া তার আর কী করবে!
সবিতা গুমরে গুমরে কাঁদছিল। আজ বৃহস্পতিবার, সন্ধেবেলা ঘটা করে লক্ষ্মীপুজো করে সবিতা, তার আয়োজন করা আছে, ফল কেটে, মিষ্টি, ফুল সাজিয়ে রাখা আছে, শুধু বসে পড়ার অপেক্ষা। কিন্তু দেবীই যে চঞ্চলা।
আমানতকারীদের টাকার পরিমাণটা শুনে ইস্তক নিতাই শান্ত হয়ে গেছে। চাকরির পি এফ, যৎসামান্য সঞ্চয়, বাড়িটা কি বাঁচানো যাবে....বোধহয় না। পয়সা ফেরত না পেলে তারা হামলা করবে... আচ্ছা যদি তারা দুজনেই কোনো ম্যাজিকে অদৃশ্য হয়ে যেত?
সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত হয়। গাড়ির আসাযাওয়ার বিরাম নেই, লোকজনের হাঁকডাকের আওয়াজও বন্ধ জানালার এপার থেকে শোনা যাচ্ছে। এতক্ষণে নিশ্চয় মিডিয়ায় খবর হয়ে গেছে। মিডিয়ার ছাতা-ওয়ালা গাড়িতে তাদের গলির মুখটা ভরে গিয়েছে। পুলিশ হয়তো আরো খোঁজখবর নিচ্ছে। মিডিয়াও।
রাত আটটা, রাত দশটা। আওয়াজ কমছে। আজকের মত।
সে আর সবিতা পরস্পরের হাত ধরে বসে থেকে নিজেদের হৃদপিণ্ডের আওয়াজ শোনে। কাটা ফলে এই শীতের রাতেও একটা নীল মাছি এসে জুটেছে। নিতাইর মনে পড়ে গেল, সেই মাছির মত পোকাটার ছেতরে থাকা পেট, মরা-হাবা পুঞ্জাক্ষি নিয়ে তাকিয়ে থাকা...সব। আগের মতই। এরকম মূর্তির মত বসে থাকতে থাকতে হয়তো একসময় তারা দুজনে দুটো নীল মাছিই হয়ে যাবে। কিন্তু এই প্রথম ভাবনাটা তার মনে যেন স্বস্তি এনে দিল । মুখে কিছু না বলে সে অপেক্ষা করে থাকল।