শব্দ কথাটির দুই দ্যোতনা। একটিতে বোঝায় আওয়াজ, অন্যটিতে অর্থবহ বর্ণসমষ্টি। দ্বিতীয়টিতেও অবশ্য প্রথমটির ছায়া রয়েছে -- বর্ণ সাজিয়ে উচ্চারণ করতে গেলে আওয়াজ তো হবেই। আওয়াজ অর্থে শব্দ গৌরবান্বিত হয়েছে বৈদিক যুগ থেকেই, বলা হয়েছে ‘নাদ ব্রহ্ম’। নিরাকার অনির্বচনীয় ব্রহ্মকে ধ্বনিরূপ দেওয়ার প্রয়াস হয়েছে ওংকার ধ্বনিতে। ধ্বনিময় জগৎ পরিপুষ্ট করেছে মানুষের মনন আর সাংস্কৃতিক চেতনাকে, এমন কী তাকে নিয়ে গেছে বাস্তব থেকে পরাবাস্তবে -- যেখানে বজ্রের ধ্বনি কবির কানে বাঁশি হয়ে বেজেছে। আরও সাম্প্রতিক এক কবি প্রকাশ করেছেন তাঁর অনাবৃত মনস্কামনা –
অরুন্ধতি, সর্বস্ব আমার,সেই শব্দের অভিঘাত ব্রহ্মাণ্ড পাতাল না-হোক পারিপার্শ্বিক মহল্লায় কী অপঘাত ঘটাতে পারে তার চিন্তা তিনি করেন নি, যেমন করে না দেওয়ালির রাত্রে কর্ণবিদারক শব্দবাজি ফাটিয়ে প্রমোদোন্মত্ত জন বা জনতা। শুধু কান নয়, সেই শব্দ যে প্রাণঘাতীও হতে পারে সেই সংশয় জানিয়েছিলেন অসুস্থ নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর ‘সুনন্দর জার্নাল’-এর এক কিস্তিতে। জার্নালের পরের কিস্তি আর পাঠকের দরবারে পৌঁছায় নি। ‘সর্বমত্যন্তং গর্হিতম্’ এই আপ্তবাক্য মনে রেখে আমরা আশ্বস্ত হতে পারি এই ভেবে যে শব্দের পরিমিত আর সুচারু বিন্যাস, শুধু রাধা নয়, কানের ভিতর দিয়ে মরমে প্রবেশ করে আমাদেরও প্রাণ আকুল করে চলেছে যুগযুগান্তর ধরে।
হাঁ করো, আ-আলজিভ চুমু খাও,
শব্দ হোক ব্রহ্মাণ্ডে পাতালে।
রাধার ছিল বাঁশির শব্দ। বর্ণবন্ধনজাত শব্দ সম্বন্ধেও এই একই কথা প্রযোজ্য। মানবসভ্যতার উন্মেষপর্বেই ভাবপ্রকাশ আর ভাববিনিময়ের জন্য সৃষ্ট হয়েছিল মানুষের ভাষা, যা ছিল তার সহচর পশুপাখিদের ভাবপ্রকাশের ধ্বনি থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। ভাষার প্রথম উদ্গাতাকে তা হয়তো বিস্মিত করেছিল, যেমন বিস্মিত হয়েছিলেন পরবর্তী কালে আদিকবি বাল্মীকি তাঁর মুখনিসৃত প্রথম কবিতার শ্লোক ‘মা নিষাদের’ ধ্বনিব্যঞ্জনায়। সেই কথার ভাষায় সংযোজিত হতে থাকল শব্দের পর শব্দ। কথা বলতে বলতে তা মানুষের কাছে জল-হাওয়ার মতো সহজ হয়ে উঠল, আর সেইসঙ্গে জল-হাওয়ার মতোই তার অস্তিত্ব সম্বন্ধে উদাসীনতা। এটা কিন্তু বৈদিক ঋষির নজর এড়ায় নি। ঋগ্বেদের এক সূত্রে ধ্বনিত হয়েছে –
উত ত্বঃ পশ্যন্ ন দদর্শ বাচম্‘ভাষাকে কেউ দেখেও দেখে না, কেউ শুনেও শোনে না, কিন্তু সে অন্যের জন্যে নিজের দেহ প্রকাশ করে, পতির জন্যে সুসজ্জিতা প্রেমময়ী জায়ার মতো।'
উত ত্বঃ শৃণ্বন্ ন শৃণোতি এনাম্।
উতো তু অস্মৈ তনুঅং বি সস্রে –
জায়েব পত্য উশতী সুবাসা।
কেউ না দেখুক বা না শুনুক, ওই বৈদিক ঋষির মতোই কেউ কেউ ভাষার অধরা মাধুরীকে ছন্দোবন্ধনে আর ব্যাকরণের বন্ধনে বাঁধতে সচেষ্ট হয়েছেন। ছয়টি বেদাঙ্গের মধ্যে শিক্ষা, নিরুক্ত, ব্যাকরণ ও ছন্দ এ-চারটিই ভাষাবিজ্ঞানের অঙ্গ। কিন্তু ভাষা তো ব্যাকরণ মেনে চলে না, ভাবপ্রকাশের তাগিদেই সে গতিময়। ব্যাকরণ তার গতিপথকে সুসংহত করার প্রয়াস। কালের পথ বেয়ে মানুষের নিত্য পরিবর্তনশীল আচার আচরণ জন্ম দিচ্ছে এবং দিয়ে চলেছে নিত্যনূতন শব্দভাণ্ডারের, এমন কী বাচনভঙ্গিমার। বহু শব্দ আবার হারিয়ে গেছে আর হারিয়ে যাচ্ছে অপ্রাসঙ্গিকতা আর অব্যবহারের কারণে। ব্যাকরণও এক জায়গায় দাঁড়িয়ে নেই, চলমান ভাষার স্বরূপকে আত্মসাৎ করে সে-ও পরিবর্তনশীল।
একই শব্দ, অথচ ভিন্ন অর্থের দ্যোতক। শুধু আমাদের বাংলাভাষায় নয়, সব ভাষাতেই এমনতরো উদাহরণ পাওয়া যাবে। ইংরেজিতে Well বলতে বোঝায় ভালো, আবার কুয়া-ও। Earth পৃথিবী, আবার মাটি। Country বোঝায় দেশ, আবার গ্রামাঞ্চল। অতি জনপ্রিয় খেলা Cricket বোঝায় ঝিঁঝিঁপোকাকে-ও। যে কোন অভিধানে এই অর্থান্তর এক দুই তিন করে চিহ্নিত করা থাকে। সংস্কৃত আর বাংলাভাষায় এরকম ভিন্নার্থক শব্দের উদাহরণ প্রচুর, বলা যেতে পারে অগুণতি। বিভিন্ন অর্থের মধ্যে একটি বা দুটি বহুল প্রচলিত, কতকগুলি পূর্বে প্রচলিত থাকলেও অধুনা পরিত্যক্ত, কতকগুলি আবার চমক বা হেঁয়ালি সৃষ্টির জন্য অথবা ভাষার সৌকর্যবৃদ্ধিকল্পে ব্যবহৃত। শেষেরটির উদাহরণ হিসাবে সংস্কৃত ভাষায় লিখিত দুটি শ্লোকের উপস্থাপনা করা যেতে পারে --
কেশবং পতিতং দৃষ্ট্বা দ্রোণঃ হর্ষমুপাগতঃ,সহজার্থে, কেশবকে অর্থাৎ কৃষ্ণকে পতিত হতে দেখে দ্রোণ হর্ষিত হলেন এবং পাণ্ডবেরা ‘হা কেশব, হা কেশব’ বলে কাঁদতে লাগলেন। রূপকার্থে, ‘কে’ অর্থাৎ জলে ‘শব’ অর্থাৎ মৃতদেহ পতিত হতে দেখে ‘দ্রোণ’ অর্থাৎ দাঁড়কাক হর্ষিত হল, আর ‘পাণ্ডবেরা’ অর্থাৎ শৃগালেরা ‘হায় জলের মড়া’ বলে কাঁদতে থাকল।
রুদন্তি পাণ্ডবাঃ সর্বে ‘হা কেশব, হা কেশব’।
দ্বন্দ্ব দিগুরাপিচাহং মদ্গৃহে সদা অব্যয়ীভাবঃ,সমাসের নামগুলিকে ভিন্নার্থে প্রয়োগ করে এক ব্রাহ্মণপণ্ডিত রাজানুগ্রহ প্রার্থনা করছেন – স্বামী স্ত্রী এবং দুটি গোরু নিয়ে আমার গৃহে সর্বদাই অভাব বিরাজমান; হে পুরুষবর, এমন কিছু করুন যাতে আমি শস্যশালী হতে পারি।
তৎপুরুষ কর্মধারয় যেনাহং স্যামি বহুব্রীহি।
শব্দের অর্থভিন্নতার সুরসিক ব্যবহার রয়েছে বাংলার এক লোককথায়। গ্রাম থেকে সহজসরল দুজন চাষি এসেছে স্যাকরার দোকানে কিছু গয়না বিক্রি করতে। কর্মচারীর সঙ্গে তাদের কথা বলতে দেখে গদি থেকে দোকানের মালিক বলে উঠলেন, ‘কেশব! কেশব!’ কর্মচারী সেটা শুনে বলল, ‘গোপাল, গোপাল’। মালিক তখন বললেন, ‘হর, হর’। কর্মচারীর প্রত্যুত্তর এল, ‘হরি, হরি’। এরকম ভগবৎ-নামের রমরমায় চাষি দুজন আশ্বস্ত হল যে এরকম জায়গায় গয়না বিক্রি করলে তাদের ঠকতে হবে না। এইসব উচ্চারণের আড়ালে যে ভাব-বিনিময় হয়েছে তা হল -- ‘কে সব?’--এরা কারা ? ‘গোপাল’ -– গোরুর পাল, ‘হর হর’ – হরণ করো, ‘হরি হরি’ - তথাস্তু, হরণ করছি।
তবে এই অর্থভিন্নতার অনবদ্য নান্দনিক প্রয়োগ রয়েছে ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গলে। ঈশ্বর পাটনির কাছে আত্মপরিচয় দিতে গিয়ে দেবী অন্নদা বলছেন --
গোত্রের প্রধান পিতা মুখ বংশজাত,সরলমতি পাটনি অর্থ করে নিল কুলীন বংশের মেয়ে স্বামীর সঙ্গে ঝগড়া করে গৃহত্যাগিনী হয়েছে, এবং সেই দুঃখে সে পাষাণ-হৃদয় বাবাকে অভিসম্পাত দিচ্ছে। অন্নদা কিন্তু যথাযথভাবেই জানিয়েছিলেন তাঁর পিতা গোত্রপ্রধান অর্থাৎ পর্বতদের মধ্যে প্রধান হিমালয়, স্বামী মহেশ্বর অবশ্যই পঞ্চমুখ, তিনি কণ্ঠে বিষধারণকারী নীলকণ্ঠ এবং ভূতপ্রেত নিয়ে তিনি শ্মশানচারী। গঙ্গা শিরে ধারণ করে তিনি গঙ্গাধর। তাঁর এই পরিচয়দান ব্যাজস্তুতি অর্থাৎ নিন্দাচ্ছলে প্রশংসা বাংলাসাহিত্যে উদাহরণস্বরূপ হয়ে রয়েছে।
পরমকুলীন স্বামী বন্দ্য বংশখ্যাত।
পিতামহ দিলা মোরে অন্নপূর্ণা নাম,
অনেকের পতি তেঁই পতি মোর বাম।
অতি বড়ো বৃদ্ধ পতি সিদ্ধিতে নিপুণ
কোন গুণ নাহি তার কপালে আগুন।
কুকথায় পঞ্চমুখ কণ্ঠভরা বিষ
কেবল আমার সঙ্গে দ্বন্দ্ব অহর্নিশ।
গঙ্গা নামে সতা তার তরঙ্গ এমনি
জীবন-স্বরূপা সে স্বামীর শিরোমণি।
ভূত নাচাইয়া পতি ফেরে ঘরে ঘরে,
না মরে পাষাণ বাপ দিলা হেন বরে।
সাহিত্যসৃষ্টির ক্ষেত্রে শব্দপ্রয়োগের বৈশিষ্ট্য লেখককে বিশিষ্ট করে তোলে। শব্দপ্রয়োগ বলতে শব্দচয়ন এবং শব্দবিন্যাস দুটোই বুঝতে হবে। উপমাপ্রয়োগ যদি কালিদাসকে বিশিষ্ট করে থাকে, বিশেষণ প্রয়োগের প্রাচুর্যে বাণভট্ট বিশিষ্ট, যদিও স্বামী বিবেকানন্দ ‘দশপাতা বিশেষণের পর রাজা আসীৎ’ বলে তাকে কটাক্ষ করেছিলেন। দীর্ঘ সমাসবদ্ধ পদ সংস্কৃতসাহিত্যে যথেষ্ট আদৃত ছিল। শেষ ধ্রুপদী সংস্কৃত কাব্য গীতগোবিন্দের ‘কান্তকোমলপদের’ মূর্ছনা এখনও আমাদের বিমোহিত করে --
ললিতলবঙ্গলতাপরিশীলনকোমলমলয়সমীরেরবীন্দ্রনাথ কি এর থেকেই অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন তাঁর ‘মধুকরপদভরকম্পিতচম্পক’ কিংবা ‘ফুলগন্ধনিবেদনবেদনসুন্দর’-এর মতো সমাসবদ্ধ পদ অথবা ‘গুরুগুরু মেঘ গুমরি গুমরি গরজে গগনে গগনে’-র মতো অনুপ্রাসময় পঙ্ক্তি রচনায়?
মধুকরনিকরকরন্বিতকোকিলকূজিতকুঞ্জকুটীরে।
ভাবপ্রকাশের স্বাতন্ত্রে এই শব্দচয়ন আর শব্দবিন্যাসের ভূমিকা অনস্বীকার্য। বাল্মীকি বন্দনায় মধুসূদন শুরু করেছেন ‘নমি আমি কবিগুরু তব পদাম্বুজে’ দিয়ে, যা মন্ত্রোচ্চারণের মতো হয়ে উঠেছে। ‘পদাম্বুজে’-র জায়গায় ‘চরণকমলে’ লিখলে ছন্দোপতন তো হতোই, ভাবপ্রকাশ ব্যাহত হতো আরও অধিক পরিমাণে। মধুসূদন যখন লেখেন ‘যাদঃপতি রোধঃ যথা চলোর্মি আঘাতে’, তার অভিঘাত পাঠককে সচকিত করে, অর্থের আপাত-দুরূহতা তাকে রসাস্বাদনে বঞ্চিত করে না, বরং তাকে উদ্বুদ্ধ করে শব্দের অনাবিষ্কৃত ক্ষেত্রে পদচারণার অভিযানে। পরবর্তীকালে সুধীন্দ্রনাথ দত্ত আর বিষ্ণু দে এই প্রয়াসে ব্রতী হয়েছেন। যদিও শিবরাম চক্রবর্তী ‘সুধীন্দ্রনাথ দত্তের কবিতার বঙ্গানুবাদে’ প্রয়াসী হয়েছিলেন, তবু অনস্বীকার্য তাঁর ব্যবহৃত অনেক অপ্রচলিত শব্দ যেমন অনিকেত আত্মরতি আজ বাংলা রচনায় স্বচ্ছন্দচারী। তেমনই নজরুলের হাত ধরে রক্ত অর্থে খুন, সামসের, কামাল, মুসাফির, গুলবাগিচা বাংলার শব্দভাণ্ডার সমৃদ্ধ করেছে। পূর্ব পাকিস্তান জমানায় ‘ইসলামি বাংলা’ প্রবর্তনের প্রয়াস স্বাভাবিকভাবেই ব্যর্থ হয়েছে, তবু অনেক আরবি ফারসি শব্দের যথাযথ প্রয়োগে সেগুলো আদৃত ও প্রচলিত হয়েছে, যেমন আল মাহমুদের কবিতায় --
তোমার সালাত শেষে যেদিকেই ফেরাও সালাম
বামে বা দক্ষিণে, আমি ও-মুখেরই হাসির পিয়াসী,
এখনও তোমার ওষ্ঠে লেগে আছে আল্লার কালাম,
খোদার দোহাই বলো ও-ঠোঁটেই আমি ভালোবাসি।
তৎসম, অর্ধতৎসম, তদ্ভব, দেশি, বিদেশি, প্রতিশব্দ, ভিন্নার্থবোধক শব্দ, উপভাষা, অপভাষা নিয়ে গড়ে উঠেছে বাংলাভাষার শব্দের জগৎ। অনেক শব্দ তাদের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ হারিয়ে ব্যবহৃত হয় তাদের লক্ষ্যার্থে অথবা ব্যাঙ্গার্থে। আরও আছে মিশ্র শব্দ, দ্বৈত শব্দ, অনুবাদ শব্দ, পরিভাষা। দুটি ভিন্ন শ্রেণির শব্দ মিশিয়ে জোড়া শব্দ তৈরি করলে সেটা হয় মিশ্র শব্দ -- যেমন, মাস্টার মশাই (ইংরেজি+তদ্ভব), রাজাবাদশা বা শাকসবজি (তৎসম+ফারসি), আইনজীবী (আরবি+ তৎসম)। এই শ্রেণিতে এসে পড়ে দো-আঁশলা কিছু শব্দ -- ধোঁয়াশা (ধোঁয়া+কুয়াশা), মিনতি (আ. মিন্নৎ+বিনতি)। সুকুমার রায়ের সৃষ্ট হাঁসজারুর (হাঁস+সজারু) অনুসরণে এই ধরনের শব্দগুলোকে হাঁসজারু শব্দও বলা হচ্ছে। শব্দদ্বৈত হল একক শব্দের স্থানে জোড়া শব্দের ব্যবহার। সদৃশ ধ্বনির দুই শব্দের জোড়, যাদের দ্বিতীয়টি প্রথমটির অনুকার এবং আপাত অর্থহীন, এমন সব শব্দ বাংলাভাষায় বিশিষ্টতা এনেছে। যেমন, বিষয়আশয়, ব্যাপারস্যাপার, খাওয়াদাওয়া, বিয়েটিয়ে, মারধোর, অফিসটফিস, চাকরবাকর, কাজটাজ ইত্যাদি। সমার্থক অনুগামী শব্দ যোগে শব্দদ্বৈতের নিদর্শন হল কাজকর্ম, কুলিকামিন, গাছপালা, দাবিদাওয়া, ধারেকাছে ইত্যাদি। ধ্বন্যাত্মক শব্দযুগল বাংলাভাষার এক নিজস্ব বাগ্বিধি। ঝুরঝুর, ঝরঝর, গটগট হেঁটে যাওয়া, খুটখুট চলা, কচকচ কাটা, কচাকচ কেটে যাওয়া -- এই সব শব্দবন্ধের দ্যোতনা হয়তো অন্যভাবে প্রকাশ সম্ভবপর ছিল না। মূল ইংরেজি শব্দ থেকে অনুবাদ করা বেশ কিছু শব্দ বাংলায় এসেছে মূলত সংবাদপত্রের মাধ্যমে এবং তারা পাকাপোক্ত আসন অধিকার করে বসেছে। যেমন, অন্তরীণ, গণমাধ্যম, চিরুনি অভিযান, জোট নিরপেক্ষ, নলজাতক, তৃণমূল, সবুজ সংকেত, বাতানুকূল, উড়ালপুল, চরিত্রহনন, ভাবমূর্তি, বর্ণময় ব্যক্তিত্ব, অতীতবিধুরতা ইত্যাদি।
পরিভাষা হল বিশেষ অর্থে নির্দিষ্ট শব্দ বা সংজ্ঞা যার দ্বারা সংক্ষেপে কোন বিষয় সুনির্দিষ্ট ভাবে ব্যক্ত করা যায়। জ্ঞানচর্চার যে কোন বিষয়েরই নিজস্ব পরিভাষা আছে, বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে তো বটেই। বাংলাভাষায় বিজ্ঞানচর্চার অগ্রগতির সাথে সাথে প্রয়োজন পড়েছে ইংরেজি পরিভাষার জায়গায় বাংলা পরিভাষা উদ্ভাবনের। ইংরেজি পরিভাষার একটা বিরাট অংশ যেমন আহৃত হয়েছে ল্যাটিন এবং গ্রিক থেকে, বাংলা পরিভাষা গঠনে অবধারিতভাবে নিতে হয়েছে সংস্কৃত শব্দভাণ্ডারের সহায়তা – সৃষ্টি হয়েছে যোজ্যতা, অনুঘটক, উৎসেচক, আকরিক, বিজারণ, উত্তল, অবতল, বর্ণালি, কেলাস, প্রতিসরণ, প্রচ্ছায়া, তেজস্ক্রিয়, সংশ্লেষণ, প্রযুক্তি, অণুচক্রিকা, ঊর্বস্থি, তন্তুকলা, মধুমেহ, ত্বরণ, কেন্দ্রাতিগ, কেন্দ্রাভিগ, মহাকর্ষ, আনুভূমিক, উল্লম্ব, পরাবৃত্ত, কলনবিদ্যা, জীবাণু, জীবাশ্ম, ছত্রাক, অক্ষাংশ, দ্রাঘিমাংশ, নিরক্ষরেখা ইত্যাদি হাজারো শব্দের। এদের মধ্যে বেশ কিছু পরিচিতি লাভ করেছে আর তারা প্রথম শিক্ষার্থীর কাছে বাধা হয়ে দাঁড়ায় নি। আবার বেশ কিছু রয়ে গেছে অপরিচয়ের দূরত্বে, বিশেষত ইংরেজির মাধ্যমে যাদের প্রাথমিক শিক্ষা তাদের কাছে। অম্লজান উদ্জান যবক্ষারজান স্বাভাবিকভাবেই অনাদৃত রয়েছে তাদের ইংরেজি প্রতিশব্দ অক্সিজেন হাইড্রজেন নাইট্রোজেনের সাধারণ্যে অতি-পরিচিতির সুবাদে। তেমনই হয়েছে যন্ত্রগণকের পরিণতি-- বাংলাভাষায় কম্পিউটার শব্দটির আত্মীকরণ ঘটেছে।
সৃষ্টিশীল শক্তিশালী লেখক শুধু প্রচলিত শব্দপ্রয়োগ করে বা শব্দভাণ্ডার থেকে অপরিচিত শব্দ উদ্ধার করে এনে তার সার্থক প্রয়োগ করেই ক্ষান্ত হন না, প্রয়োজনে তাঁকে নতুন শব্দনির্মাণেও ব্রতী হতে হয়। মধুসূদন কাশীরাম দাসের কীর্তির স্মরণে লিখেছিলেন --
সেইমতো ভাষা-পথ খননি স্ববলেমধুসূদন নিজেও সেই কাজে ব্রতী হয়েছিলেন। হয়েছিলেন বিদ্যাসাগর বঙ্কিমচন্দ্র রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথ এ-বিষয়ে অবশ্যই বিশেষভাবে উল্লেখনীয়। ‘অভিসার’ কবিতায় সন্ন্যাসী উপগুপ্তের নটী বাসবদত্তাকে ‘অয়ি লাবণ্যপুঞ্জে’ সম্বোধনে, ‘প্রাঙ্গনে মোর শিরীষ শাখায়’ গানে সন্ধ্যাবর্ণনায় ‘ক্ষান্তকূজন শান্তবিজন’ বিশেষণের প্রয়োগে, ‘বাদলদিনের প্রথম কদমফুল’ গানে ‘বিস্মৃতিস্রোত’ শব্দের প্রয়োগে সমাসবদ্ধ পদগুলি নতুন ব্যঞ্জনায় প্রতিভাত হয়েছে। লঘুচালের ‘প্রহাসিনী’ কাব্যগ্রন্থে দুষ্টুমির সঙ্গে মিল দিয়েছেন ‘রুষ্টুমি’ শব্দ তৈরি করে, ‘খাপছাড়া’ বইয়ে গরিষ্ঠর সঙ্গে মিল দিতে ‘নড়িষ্ঠ’ আর ‘দ্রড়িষ্ঠ’। ইংরেজি শব্দের বাংলা রূপান্তর তাঁর কাছ থেকে পেয়েছি institution অর্থে প্রতিষ্ঠান, ceremony অর্থে অনুষ্ঠান, report অর্থে প্রতিবেদন। তেমনই আবাসিক (resident), অনাবাসিক (non-resident), অনীহা (apathy), আপতিক (accidental), আঙ্গিক (technique), সংলাপ (conversation), প্রাগ্রসর (progressive) -- এবংবিধ আরও অনেক শব্দ। এগুলো সবই এখন নিত্যপ্রচলিত।
ভারত-রসের স্রোতঃ আনিয়াছ তুমি
জুড়াতে গৌড়ের তৃষা সে বিমল জলে,
নারিবে শোধিতে ধার কভু বঙ্গভূমি।
রবীন্দ্রনাথ এখানেই থেমে থাকেন নি। নতুন শব্দগঠনের অভীপ্সা জীবনের শেষপ্রান্তে তাঁকে প্ররোচিত করেছিল ‘গল্পসল্প’ বইয়ে বাচস্পতিকে দিয়ে তৈরি করতে ‘একেবারে গোড়াগুড়ি ভাষা’, যার নাম ‘বুগবুলবুলি’। সেই ভাষায় নায়িকা নায়ককে বলেছিল হাত নেড়ে ‘দিন রাত তোমার ঐ হিদ্হিদ্ হিদিক্কারে আমার পাঁজকুরিতে তিড়িতঙ্ক লাগে’, ভারতের ইতিহাস প্রসঙ্গে লেখা হয়েছিল ‘সমুদ্রগুপ্তের ক্রেঙ্কাটাকৃষ্ট তড়িৎত্রম্যন্ত পর্যুগাসন উত্থ্রংসিত’, ছোটোলাটের দরবারে সেই ভাষা শুনে ‘হেড পেডেণ্ডর টিকির চার ধারে ভেরেণ্ডম্ লেগে গেল, সেক্রেটারি চৌকি থেকে তড়তড়ং করে উৎখিয়ে উঠলেন’।
শব্দের জগতে পদচারণায় আমাদের আবিষ্ট আপ্লুত দিশাহারা হতে হয়।
তথ্য সহায়তা
১। বাংলা ভাষার ব্যাকরণ – জ্যোতিভূষণ চাকী (আনন্দ), ২০১৩
২। আ মরি বাংলা ভাষা – পলাশ বরণ পাল (অনুষ্টুপ), ২০১১
৩। ভাষার ইতিবৃত্ত – সুকুমার সেন (আনন্দ), ২০১৫